মহামনীষী ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর জীবনী

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

বিশ্ববরেণ্য মহামনীষী ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর প্রকৃত নাম আবু হামিদ মুহম্মদ। তাঁহারপিতার ও পিতামহের উভয়ের নামই মুহম্মদ। তাঁহার মর্যাদাসূচক পদবী হুজ্জাতুল ইসলাম। খোরাসানের অন্তর্গত তুস জেলার তাহেরান নগরে গাজালা নামক স্থানে হিজরি ৪৫০ সনে, মুতাবেক ১০৫৮ খৃষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর যুগে পারস্যের সম্রাট ছিলে সলজুক বংশীয়সুলতান রুকনুদ্দিন তোগরল বেগ। এই যুগে মুসলমানদের বিদ্যার্জন স্পৃহা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তৎকালে প্রচলিত ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান ও পারসিকদের সঞ্চিত জ্ঞান আহরণ করিয়া মুসলমানগণ ভারতীয় জ্ঞানাহরনে প্রবৃত্ত হন।কিন্তু বিভিন্ন প্রকার মতবাদের সংমশ্রনে মুসলমান সমাজে বহু মতানৈক্যের সূত্রপাত হয় এবং ইসলামী আকাইদ ও জ্ঞানের সহিত নানাবিধ মারাত্নক অনৈসলামী ধর্ম-বিশ্বাস ও জ্ঞান এমনভাবে মিশিয়া পড়ে যে খাঁটি ইসলামী আকাইদ ও অনৈসলামী আকাইদে পার্থক্য করা দুরূহ ব্যাপার হইয়া উঠে। অত্যাধিক পরিমাণ পার্থিব জড়জ্ঞানের প্রভাবে ধর্ম জ্ঞানের শ্বাস প্রায় রুদ্ধ হইয়া পড়েএবং মুসলমান সমাজে আকাইদ ও ধর্ম-কার্যের ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। ইহা হইতে সমাজকে রক্ষার দায়িত্বই হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর উপর অর্পিত হয়। এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের অতুলনীয় প্রতিভা যে নিপুণতার সহিত এই দায়িত্ব সমাপন করিয়াছেন, সমগ্র বিশ্ব তজ্জন্য বিস্ময় ও ভক্তিআপ্লুত হৃদয়ে তাঁকে স্মরণ করবে।

• তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা

তৎকালে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রাথমিক স্তর হইতে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ছাত্রগণের খাওয়া পরার খরচসহ মাদ্রাসার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করিতেন। তদুপরি সকল মসজিদ ও সঙ্গতি সম্পন্ন লোকদের গৃহেও বহু বেসরকারি মাদ্রাসার ব্যবস্থা ছিল। দূরদেশীয় ছাত্রদের ভরন-পোষণ ও যাবতীয় ব্যয়ভার আমীর উমরাহ্‌গন বহন করিতেন। সুতরাং সেইকালে শিক্ষার পথ ধনী-নির্ধন সকলের জন্যই অত্যন্ত সুগম ছিল। প্রবীণ ও উচ্চশিক্ষিত সুধীজন যে সকল স্থানে শিক্ষাদান করিতেন, সে সব স্থানই উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হইত। এমতাবস্থায় অতিসহজে জ্ঞান পিপাসা নিবৃত্ত করিতে পারিত।

• শৈশবকাল ও ছাত্রজীবন

ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর পিতা ছিলেন দরিদ্রও; তথাপি তিনি পুত্রের শিক্ষার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেন নাই। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) অতি শৈশব কালেই পিতৃহীন হন। অন্তিমকালে তাঁহার পিতা তাঁহার জনৈক বন্ধুর উপর দুইপুত্র আহ্‌মদ ও মুহম্মদ (ইমাম গাজ্জালী (রঃ)) এর প্রতিপালন ও শিক্ষার ভার অর্পন করেন এবং তজ্জন্য সামান্য অর্থ প্রদান করেন। শিশুদ্বয় অসাধারণ মেধা-শক্তির অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পবিত্র কুরআন হিফয্‌ সমাপ্ত করিয়া তাঁহারা শহরের এক মাদ্রাসায় ভর্তি হইয়া অধ্যায়ন শুরু করেন। আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনী, আল্লামা আবু মুহম্মদ যোবায়নী প্রমুখ মহজ্ঞানী উস্তাদের নিকট তিনি শিক্ষালাভ করেন। খ্যাতনামা ফিকাহ্‌শাস্ত্রবিদ আল্লামা আহ্‌মদ বিন মুহম্মদ রাযকানীর নিকট তিনি ফিকাহ্‌শাস্ত্রের প্রাথমিক কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন।

• উচ্চ শিক্ষার জন্য জুরজানে গমন

মসজিদ আল আকছা’র এই স্থানে অবস্থান করে ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) অনেক মূল্যবান কিতাব রচনা করেছিলেন তাহেরানে শিক্ষা সমাপ্তির পর ইমাম গাজ্জালী সাহেব (রঃ) উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য জুরজান শহরে গমন করেন। এখানে তিনি হযরত আবু নসর ইসমাইল (রঃ) এর তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রন আরম্ভ করেন। তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাইয়া পুত্রবৎ স্নেহে সর্বশক্তি প্রয়োগে তিনি তাহাকে শিক্ষাদানে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে শিক্ষকগণ পাঠ্যবিষয়ে যে বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করিতেন শিক্ষার্থীগন উহা হুবহু লিপিবদ্ধ করিয়া লইতে বাধ্য করিতেন। এই লিখিত নোটগুলিকে তা’লিকাত বলা হইত। এইরূপে হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ)তা’লিকাতের এক বিরাট দপ্তর সঞ্চয় করিলেন। তাহারানা অভিমুখে যাত্রার পথে সর্বস্ব লুণ্ঠন জুরজানে অধ্যয়ন সমাপনান্তে ইমাম সাহেব জন্মভূমি তাহেরান অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে দস্যুদল তা’লিকাতসহ তাঁহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া লয়। টাকা-পয়সা ও পোশাক-পরিচ্ছদ অপহৃত হওয়াতে তিনি কোন পরওয়া করিলেন না। কিন্তু তা’লিকাতের অপহরণে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন। এইগুলি ফেরত দেবার জন্য দস্যু সরদারের নিকট তিনি এই বলিয়া অনুরোধ জানাইলেন যে, উহাতে তাঁহার সমস্ত অর্জিত বিদ্যা সঞ্চিত রহিয়াছে। দস্যু-সরদার উপহাসের স্বরে বলিলঃ তুমি তো বেশ বিদ্যা অর্জন করিয়াছ ! সবই কাগজে রহিয়াছে, মনে কিছুই নাই। এই কথা বলিয়া সে তা’লিকাত ফিরাইয়া দিল। সরদারের ব্যঙ্গোক্তি ইমাম সাহেবের মনে দাগ কাটিল। অনন্তর অল্প দিনের মধ্যেই সমস্ত তা’লিকাত তিনি মুখস্ত করিয়া লইলেন। এত অল্প সময়ে এত বড়বড় তা’লিকাত সমূহ মুখস্ত করা কোনসাধারণ ব্যক্তির কার্য নহে।

• নিযামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন

ইহ্‌ইয়াউ উলুমিদ্দিন খোরাসানের অন্তর্গত নিশাপুরে অবস্থিত নিযামিয়া মাদ্রাসা তৎকালে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। জুরজানে অধ্যয়ন সমাপ্তির পরও ইমাম সাহেবের জ্ঞান-পিপাসা নিবৃত্ত হইল না। তাই তিনি নিযামিয়া মাদ্রাসায় গমন করিলেন। সেকালে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিমরূপে স্বীকৃত ইমামুল হারামাইন (রঃ) ছিলেন এই মাদ্রাসার প্রধান অধ্যক্ষ। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ হইতে বহু লোক উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁহার নিকট ছুটিয়া আসিত। তিনি এত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে, গোটা দুনিয়ার সুলতানগণও জটিল বিষয়ের মীমাংসার জন্য তাঁহার নিকট উপস্থিত হইতেন এবং তাঁহার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হইত। ইমামগাজ্জালী সাহেব (রঃ) উপযুক্ত উস্তাদ পাইয়া তাঁহার তীব্র জ্ঞান-পিপাসা মিটাইতে লাগিলেন। ইমামুল হারামাইন (রঃ)ও ইমাম গাজ্জালী (রঃ) দর্শন ও জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে খুব আগ্রহের সহিত শিক্ষা দিতে লাগিলেন।
৪৮৭ হিজরিতে ইমামুল হারামাইন (রঃ) ইন্তিকাল করেন। তিনি ছাত্রগণের নিকট এতপ্রিয় ছিলেন যে, তাঁহারা তাঁহার ইন্তিকালে উন্মাদ প্রায় হইয়া পড়েন। কেউ বা বহুদিন যাবত শিশুর ন্যায় গড়াগড়ি দিয়া ক্রন্দন করিতে থাকেন। তাঁহার চারিশত ছাত্রের সকলেই নিজ নিজ দোয়াত-কলম ভাঙ্গিয়া ফেলেন। কারন ইহাদের সহিত তাহাদের প্রিয় উস্তাদের স্মৃতি বিজড়িত ছিল এবং এইগুলি তাহাদের হৃদয়ের শোকাগ্নিকে অধিকতর প্রজ্বলিত করিয়া তুলিত। ছাত্রগণ প্রায় একবছর কাল উস্তাদের শোকে মুহ্যমান হইয়া থাকেন। ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-র নিকটওউস্তাদের তিরোধান-যাতনা অসহনীয় হইয়া উঠিল এবং নিশাপুত তাঁহার নিকট অন্ধকার পুরির ন্যায় মনে হইতে লাগিল। তাই তিনি নিশাপুর পরিত্যাগ করিয়া বাগদাদে চলিয়া গেলেন। এই সময়ে হযরত গাজ্জালী (রঃ) এর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। তিনি জানিতেন যে, কেবল কিতাব পাঠ আল্লাহ্‌র জ্ঞানের জন্য যথেষ্ঠ নহে; ইহার জন্য দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন জীবন্ত উস্তদের নিতান্ত প্রয়োজন। তাই তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত পীরে কামেল হযরত শায়খ আবু আলি ফারমেদী (রঃ) এর হস্তেবায়াতপূর্বক তাঁহার মুরিদ হন।

• মাদ্রাসা নিযামিয়ার অধ্যক্ষ পদে ইমাম গাজ্জালী (রঃ)

 কিমিয়ায়ে সা’আদাত বাগদাদে তখন তুর্কিরাজ মালেক শাহের আধিপত্য ছিল। তাঁহার প্রধানমন্ত্রী হাসান বিন আলী নিযামুল মূলক একজন অসাধারণ পণ্ডিত ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার নামানুসারেই বাগদাদের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ‘মাদ্রাসায়ে নিযামিয়া’ এবং উহার পাঠ্যতালিকা ‘দরসে নিযামী’ নামেপ্রসিদ্ধি লাভ করে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সহিত হযতর ইমাম গাজ্জালী (রঃ) কেমাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। তখন তাঁহার বয়স মাত্র ৩৪ বছর, এত অল্প বয়সেও তিনি অধ্যাপনা ও পরিচালনা কার্যে নিতান্ত দক্ষতা ও নিপুণতার পরিচয় প্রদান করেন। স্বয়ং বাদশাহ ও রাজপুরুষগণও রাজকার্যের জটিল সমস্যাসমূহে তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। এ সময় তাঁহার নাম দুনিয়ার সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে এবং বিভিন্ন দেশ হইতে শত শত ছাত্র তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য ছুটিয়া আসেন। মাদ্রাসা নিযামিয়ার খ্যাতিও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি নানা জটিল বিষয়ে গবেষণাও করিতে থাকেন।এরূপে তিনি অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী হন।

• মাদ্রাসা নিজামিয়া পরিত্যাগ

প্রভূত যশ ও যোগ্যতার সহিত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) চারি বৎসরকাল মাদ্রাসা নিযামিয়াতে কাজ করেন । নানা জটিল বিষয়াদির চমৎকার ব্যাখ্যা স্রবণ ও তাহার জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করিয়া তাহার ছাত্রগণ একেবারে বিস্মিত হইয়া পড়িত । এখানে অবস্থানকালে তিনি দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থরাজি অধ্যায়ন সমাপ্ত করেন । তথাপি তাহার মন পরিতৃপ্ত হইল না । কিসের অভাবে যেন তাহার মন আনচান করিতে লাগিল । অজানাকে জানিবার এবং অদেখাকে দেখিবার জনয় তাহার মন ব্যাকুল হইয়া উঠিল । যাবতীয় কর্মের প্রতি তাহার মন বিতৃষ্ণ হইয়া উঠিল । তিনি ব্যাকুল বুঝিলেন যে, কেবল পুঁথিগত জ্ঞান দ্বারা বিশেষ কোন কাজ হয় না । বিশুদ্ধ জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে একাগ্র সাধনা ও কঠোর রিয়াযতের আবশ্যক । এ সম্পর্কে তিনি স্বয়ং বলেনঃ “মানুষের সদ্‌গুনরাজির বিকাশের জন্য অক্লান্ত সাধনা ও একনিষ্ঠ সংযমের একান্ত আওশ্যক”। এই উপলব্ধির পর স্বীয় স্বভাব ও কর্মের প্রতি মনোনিবেশপূর্বক দেখিলাম, আমার কোন কাজই এই নীতর অনুরূপ নহে, যাহার দ্বারা আমার স্বভাব, আত্মা ও মানবতের উন্নতি সাধন হইতে পারে । আমি আরও বুঝিতে পারিলাম যে, আমি প্রবৃত্তির বশীভূত হইয়া কার্য করিতেছি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আমার কাজ কোন কাজ হইতেছে না । তবে আল্লাহর সন্তোষ-লাভের নিমিত্ত লোকালয়ে অবস্থান করিয়াই দুনিটার সকল মোহ বর্জন করিতে হইবে । এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে যাবতীয় কর্মের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ও বৈরাগ্যভাব জন্মিতে লাগিল । মাদ্রাসার অধ্যাপনা এবং পরিচালনারকার্যেও শৈথিল্য দেখা দিল, মৌনাবলম্বনের স্পৃহা বৃদ্ধি পাইল; হজম শক্তি কমিতে লাগিল এবং ঔষধেও অশ্রদ্ধা জন্মিল । চিকিৎসকগণ বলিলেন, “এমতাবস্থায় কোন ঔষধই ফলপ্রদ হইবে না”। অনন্তর দেশ ভ্রমণে বাহির হওয়ার মনস্থ করিলাম । দেশের আমীর-উমরাহ,আলিম-উলামা, সুধীমণ্ডলী ও রাজপুরুষগণ এই সঙ্কল্প পরিত্যাগের জন্য আমাকে অনুরোধ করিতে লাগিলেন । কিন্তু আমি মনকে বশে আনিতে পারিলাম না । পরিশেষে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া হিজরি ৪৮৮ সনের যিলকাদাহ্‌ মাসে আমি গোপনে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হইলাম । হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এক অসাধারণ অনুসন্ধিৎসু মন লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন । জাগতিক জ্ঞান তাহার মনের তীব্র পিপাসা নির্বাপিত করিতে পারে নাই । তাই তিনি এবার আধ্যাত্নিক জ্ঞানের অন্বেষণে বাহির হইয়া পড়িলেন । শৈশবকাল হইতেই তাহার ধর্মের প্রতি অনুরাগ ও জ্ঞান পিপাসা ছিল অত্যন্ত প্রবল । প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সকল দার্শনিকের মতবাদও গভীর মনোনিবেশ সহকারে তিনিঅধ্যয়ন করেন । কিন্তু উহাতে তাহার মনের জিজ্ঞাসের কোন সঠিক জবাব তিনি খুঁজিয়া পাইলেন না । তাই এক অজ্ঞাত রহস্যের সন্ধানে সংসারবিরাগী সূফী দরবেশের বেশে জীবনের দীর্ঘ দশটি বৎসর নানা দেশ পর্যটনে তিনি অতিবাহিত করেন । এই পথেই তিনি তাহার চির আকাঙ্ক্ষিত রহস্যের সন্ধান খুঁজিয়া পান । তাহার মন চিররহস্যময় আল্লাহর সরূপ উদ্ঘাটনে সমর্থ হয় এবং তাহার অন্তরের পিপাসা নিবারিত হয় । কথিত আছে, মাদ্রাসা নিযামিয়াতে অবস্থানকালে হযরত ইমাম সাহেব (রঃ) মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করিতেন । কিন্তু দেশ পর্যটনের সময় তিনি নিতান্তু সাধারণ পরিচ্ছদে একটি মোটা কম্বল সম্বল করিয়া বাহির হন। কিন্তু ইহাতেও তাহাকে খুব প্রফুল্ল দেখাইত । সিরিয়ার পথে তিনি কিছুকাল দামেস্ক নগরিস্থিত উমাইয়া জামে মসজিদে অবস্থান করেন । তৎকালে এই মসজিদের পার্শে একটি বিরাট মাদ্রাসা ছিল । হযরত ইমাম সাহেব (রঃ) এই মসজিদের পশ্চিম প্রান্তস্থিত মিনারার এক প্রকোষ্ঠে বাসস্থান নির্ধারন করেন এবং অধিকাংশ সময়ই ইহাতেমুরাকাবা-মুশাহাদায় নিমগ্ন থাকেন । অবসর সময়ে তিনি কিছুসংখ্যক অতি আগ্রহী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করিতেন এবং সময় সময় আলিমগণের সহিত জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা করিতেন ।

• বায়তুল মাক্‌দাস গমন ও নির্জনবাস অবলম্বন

দুই বৎসর দামেস্ক নগরে অবস্থানের পর তিনি বায়তুল মাক্‌দাস গমন করেন । ইহার কারনস্বরূপ বর্নিত আছে যে, তিনি একদা স্বীয় প্রকোষ্ঠ হইতে বাহির হইয়া মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় গমন করেন এবং প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কোন বিষয়ে আলোচনার প্রবৃত্ত হন । আলোচনা কালে শিক্ষক সাহেব বলেনঃ ইমাম গাজ্জালী সাহবে এ সম্বন্ধে এরূপ লিখিয়াছেন । এই প্রশংসা তাহার মনেঅহংকারের সৃষ্টি করিতে পারে ভাবিয়া হযরত ইমাম সাহেব (রঃ) তথা হইতে সংগোপনেবায়তুল মাক্‌দাসে চলিয়া যান । তথায় তিনি ‘সাখ্‌রাতুস্‌সাম্মা’ নামক বিখ্যাত প্রস্তরের নিকটবর্তী এক নির্জন প্রকোষ্ঠে অবস্থান করিতে থাকেন । তিনি ইহাতে সর্বদা যিকর-ফিকরে মশগুল থাকিতেন এবং সময় সময় নিকটবর্তী পবিত্র মাযারসমূহ যিয়ারতে বাহির হইতেন । মাকামে খলিলে তিনটি প্রতিজ্ঞাঃবয়তুল মাকদাসের যিয়ারত শেষ করে ‘মকামে খলীল’ নামক স্হানে হযরত ইব্রাহিমআ: মাযার শরীফ যিয়ারত করেন।সেখানে তিনি তিনটি প্রতিজ্ঞা করেন- ১।কখনও কোন রাজ দদরবারে যাব না। ২। কোন বাদশাহর কোন দান বা বৃত্তি গ্রহন করবো না। ৩।কাহারও সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ট হব না। বায়তুল মাকদাসে অবস্হান কালে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: অনেক সময় বায়তুল আকসায় আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যনে মগ্ন থাকতেন।

• মদিনা শরীফ জিয়ারত

বায়তুল মাকদাস থেকে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: মদীনা শরীফ গমন করেরাসুলুল্লাহ সা: এর রওজা মোবারক জিয়ারত করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্হানকরেন।

• হজ্ব সমাপন ও দেশ ভ্রমন

মদীনা শরীফ হতে তিনি মক্কা শরীফ গমন করে তিনি হজ্ব সমাপন করেন।এখানেও তিনি ধীর্ঘকাল অবস্হান করেন।মক্কা মদীনায় অবস্হানকালে তিনি দুনীয়ার বিভিন্ন দেশের বহু বুজুর্গের সহিত সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা করেন। অতপর সেখান থেকে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া গমন করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্হানের পর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরিবার পথে তিনি আবার পবিত্র মক্কা-মদীনা যিয়ারত করেন।বাগদাদ হতে বের হয়ে দীর্ঘ দশ এগার বৎসরকাল তিনি বহু বন-জঙ্গল,জনপথ ওমরুপ্রান্তর পরিভ্রমন করেন।বলাই বাহুল্য তৎকালে যাতায়াতের জন্য বাহন পশু ব্যতীত অন্য কোন উপায় ছিল না।কিন্তু এত কষ্টকর ভ্রমনেও তার ইবাদত-বন্দেগী ও ও রিয়াযত ও মোঝাহাদায় কোন প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি হয়নি।ফলে তার অন্তর-আত্না নির্মল ও পবিত্র হয়ে পড়ে। এবং দিব্যজ্ঞানের পথে সমস্ত পর্দা একেবারে অপসারিত হয়ে পড়ে।

• পুনরায় মাদ্রাসা নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান

হযরত ইমাম গাজ্জালী র: উপলব্ধি করেন যে ,সমগ্র দুনিয়া ধর্মের দিক হতে মোড় ঘুরিয়ে নিচ্ছে এবং মুসলমানগন ধর্ম কর্মে দিন দিন শিথিল হয়ে পড়ছে।জড়বাদী দর্শন -বিজ্ঞানএর ঝড়-ঝন্জার সংঘাতে ধর্মের সুত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ছে।এজন্য নির্জন বাস পরিত্যগ করে ধর্ম প্রচারে আত্ননিয়োগের মনস্হ করেন।বাগদাদ অধিপতি সুলতান মালেক শাহের পুত্র সুলতান সালজানর সালজুকীর প্রধান মন্ত্রী ফখরুল মুলক(ভুত পুর্ব প্রধান মন্ত্রী নিজামুল মুলকের জৈষ্ঠপুত্র) এই সময় আবার হযরত ইমাম গাজ্জালী র:কে মাদ্রাসা নিযামিয়ার অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোঢ করেন।তাহার বন্ধুবান্ধবগনও তাহাকে তাহাকে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে আ্তবনিয়োগ করার অনোরোধ জানাতেথাকেন।এতদব্যতিত স্বপ্নযোগেও বহু পবিত্র আত্নার পরামর্শও আসতে থাকে।সুতরাং দেশে প্র্ত্যা বর্তন করত হিজরি ৪৯৯ সালের যিলকাদ মাসে পুনরায় তিনি মাদ্রাসা নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করে যথারীতি ধর্মশিক্ষায় আত্ননিয়োগ করেন।তিনি অতিউৎসাহের সাথে তার এই কার্জ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

• মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যগ

হিজরী ৫০০সালের মহররম মাসে প্রধান মন্ত্রী ফখরুল মুলক এক দুরাচার গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন।এই হৃদয়বিদারক ঘটনার অনতিকালেবপরেই হযরত ইমাম গাজ্জালী র: মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যগ করেন এবং স্বীয় বাসভবনের অনতিদুরে একটি খানকা প্রতষ্ঠা করে ইলমীদ্বীনের শিক্ষার্থী ও আল্লাহর পথের পথিকদেরকে শিক্সা দিতে থাকেন।বাকী জীবন তিনি এই স্হানে এই কার্জেই নিয়োজিত ছিলেন।

• হিংসার কোপে ইমাম সাহেব (র:)

মাদ্রাসা নিযামিয়ার অধ্যক্ষপদ পুন:গ্রহনের জন্য বাগদাদাধিপতি সুলতান সানজার সুলজুকী ইমাম সাহেব র: কে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন ।কিন্তু এতে তিনি রাজী হননি । এই সুযোগে হিংসাপরায়ন কিছু লোক তার বিরুদ্ধে সুলতানকে উত্তেজিত করার প্রয়াস পায় । সুলতান হানাফী মাযহাবালম্বী ছিলেন । তারা তার কাছে অভিযোগ করলো যে,’মন্‌খুল’ কিতাবে ইমাম গাযযালী সাহেব হযরত আবূ হানীফাক(র:)-কে তীব্রভাবে আক্রমন করেছেন । এতে ইমাম সাহেবের প্রতি সুলতানের  আসন্তোষের উদ্রেক হয় । রাজ দরবারে হাযির হওয়ার জন্য হযরত ইমাম সাহেবের উপর নির্দেশ দেওয়া হয় । তদনুযায়ি তিনি দরবারে উপস্থিত হলে সুলতান দন্ডায়মান হয়ে তাকে আলিঙ্গন করেন এবং তাকে সিংহাসনে বসান । হযরত ইমাম আবূ হানীফা(র:)-র বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন: ইহা সত্য নহে। তাহারসম্বন্ধে আমার সেই বিশ্বাসই বলবৎ আছে,যাহা আমি ‘ইয়াহইয়াউল উলূম’কিতাবে প্রকাশ করিয়াছি । তাহাকে আমি ফিকাহশাস্ত্র যুগস্রষ্টা ইমাম বলিয়া স্বীকার করি । এতে সুলতানের ধারনা সম্পূর্নরুপে পরিবর্তিত হলো ।

• নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদ পুন:গ্রহনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান

হযরত ইমাম গাযযালী র: মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যাগ করার পর এর যশ:গৈ*রব হ্রাস পায়। ইহা পুনরুদ্ধারের জন্য আমীর-উমরাহ ও রাজপুরুষগন নানা উপায়ে তাকে এর অধ্যক্ষ পদে পুন:অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে থাকেন । সালজুকী সুলতান এবং খলীফার দরবার হতেও তার কাছে বারবার অনুরোধপত্র আসতে থাকে । কিন্তু নিম্নলিখিত কারনে তিনি তা গ্রহনে অসন্মতি জানানঃ ১, তুসনগরে বর্তমানে আমার কাছে দেড়শত ছাত্র অধ্যয়নরত আছে। আমি বাগদাদে চলে গেলে তাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া দু:সাধ্য হবে। ২, পূর্বে আমার কোন সন্তান ছিল না । কিন্তু এখন আল্লাহ তা’আলা কয়েকটি সন্তান দান করেছেন । তাদেরকে ছেড়ে বাগদাদে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় । ৩, মাকামে খলিলে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, ভবিষ্যতে আর কোন বিতর্কে প্রবৃত্ত হব না । কিন্তু বাগদাদে ইহা হতেঅব্যাহতির উপায় নেই । ৪, খলিফার সন্মানার্থে তার দরবারে উপস্থিত হতে হবে । আমার এটা বরদাস্ত হবে না । ৫, রাজদরবার হতে কোন বেতন বা, বৃত্তি গ্রহন করবোনা বলে প্রতিজ্ঞা করেছি । বাগদাদে আমার কোনসমপত্তি নেই। সুতরাং, কিভাবে আমি বাগদাদে অবস্থান করবো ? মোটকথা সর্বপ্রকার অনুরোধ সত্তেও তিনি উক্ত অধ্যক্ষ পদ গ্রহণে আর সন্মত হননি । জীবনের অবশিষ্ট সময় তিনি তুস নগরেই অতিবাহিত করেন গ্রন্হ রচনায় ইমাম গাজ্জালী র: -জ্ঞানের আলো বিতরনের উদ্দেশ্যে হযরত ইমাম গাজ্জালী র: এর এ পৃথিবীতেআবির্ভাব।বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা নিঃসন্ধেহেঅতুলনীয়।এ মনীষি মাত্র ৫৫ বৎসরকাল জীবিত ছিলেন।শৈশব ও পাঠ্য জীবন বাদ দিলে মাত্র ৩৪/৩৫ বৎসর কর্মজীবনে তিনি প্রায় চার শত অমুল্য গ্রন্হ রচনা করেন।তার মধ্যে ”ইয়াকুতুততাবলিক” নামক তাফসীর ৫০ খন্ডে বিভক্ত এবং ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” বিড়াট চার খন্ডে সমাপ্ত।প্রত্যেকটি খন্ডও আবার দশটি পৃথক বিভক্ত।১০/১১ বৎসর তিনি আবার দেশ পর্যটন ও নির্জনবাসে অতিবাহিত করেন।তদুপরি অধ্যাপনা, অধ্যায়ন, ধ্যন-সাধনা ও এবাদৎ বন্দাগীতেও কিছু সময় ব্যয় হতো।তার দরবারে শিক্ষার্থী ও দীক্ষা প্রার্থীদের সংখ্যা কোন দিনই দেড়শত এর কম হতো না।তাছারাও দুরদুরান্ত হতে নানা জটিল বিষয়ে ফতোয়ার জন্য অনেকলোক তার দরবারে আগমন করতো এবং ওয়াজনসিহত ও বিতর্কসভাও তাকে করতে হতো।উহাতেও তার কম সময় ব্যয় হতো না।এতসব কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি এত গুলি গ্রন্হ রচনা করে তিনি অসাধারন প্রতিভারই পরিচয় দিয়েছেন। আল্লামা নববী বলেন ,ইমাম গাজ্জালী র: এর সম্পুর্ন আয়ুষ্কাল(জন্ম থেকেমৃত্যু পর্যন্ত) ও তার রচিত গ্রন্থাবলীর হিসাব আন্তে আমি গড় করে দেখেছি, তিনি গড়ে প্রত্যেকদিন ১৬ পৃষ্ঠা লিখেছেন।দর্শন,তর্ক,ইলমে কালাম, ধর্মতত্ব,মনস্তত্ত্ব,স্বভাব-বিজ্ঞান,নীতি-বিজ্ঞান,আধ্যাতিক তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গ্রন্হ রচনা করেন।তার রচিত গ্রন্হাবলীর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

• ফিকাহ

ওয়াসীত, বাসীত, ওয়াজীয, বয়ানুল কাওলায়নিলিশ শাফীঈ তা’লীকাতুন ফি-ফুরুইল মযহাব, খোলাসাতুর রাসাইল, ইখতিসারুল, মুখতাসার, গায়াতুল গাওর, মজমুআতুল ফতাওয়া ।

• ফিকাহ শাস্রের মুলনীতি

তাহসিনুল মাখাজ, সিফাউল আলীল, মুন্তাখাল ফি ইলমিল জিদল, মনখুল, মুসতাসফা, মাখায় ফিল খিলাফিয়াত,মোফাসসালুল খিলফি ফি উসুলিল কিয়াস।

• মানতিক

মিয়ারুল ইলম, মীযানুল, আ’মল (ইউরোপে প্রাপ্তব্য)

• দর্শন

মাকাসিদুল ফালাসিফাহ, তাহাফুতুল ফালাসিফাহ (ইউরোপে সংরক্ষিত)

• ইলমি কালাম

আহাতাফুল ফালাসিফাহ, মুনকিয, ইলজামুল আওয়াম ইকতিসাদু, মসতাযহারী ফাযাইহুল ইবাহিয়্যাহ হাকিকাতুর রুহ, কিসতাসুল মুসতাকিম, কাওলুল জমিল ফি রাদ্দিনআলামান গায়্যারাল ইন্জিল, মাওয়াহিবুল বাতিনিয়্যাহ, তাফাররাকাতুম বায়নাল ইসলামি ওয়াল জিন্দিকাহ, আর রিসাতুল কুদসিয়াহ।

• আধ্যাত্নিক ও নৈতিক বিষয়

ইয়াহইয়াওমুল উলুম, কিমিয়ায়ে সাআদাত, আল মাকসুদুল আকসা, আখলাকুল আবরার, জওয়াহিরুল কুরআন, জওয়াহিরুলকুদসি ফী হাকীকাতিন্নাফস, মিশকাতুলআনওয়ার, মিনহাজুল আবেদীন, মিরাজুস সালিকীন, নাসীহাতুল মূলক, আয়্যুহালওলাদ, হিদায়াতুল হিদায়াহ,মিশকাতুল আনওয়ার, ফী লাতাইফিল আখয়ার।

নিশাপুর অবস্হানকালে, ইমাম গাজ্জালী র: গ্রন্থাদি রচনা শুরু করেন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের যে জড়বাদ বিশেষত গ্রীক দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদ মুসলমানদের ধর্ম-বিশ্বাসে প্রবেশ করেছিল। এ সময়েই তিনি অতিসুন্দর ও সুক্ষ যুক্তিপুর্ন বিচারে ‘মনখুল’ (চালনি দ্বারা চালা) নামক গ্রন্হ রচনা করে এইসব দোস ত্রুটির মুলুৎপাটন করার প্রয়াস পান।প্রথম জীবনের লেখা হলেও ইহাসুধী উচ্চপ্রশংসা অর্জন করে।এমনকি তাহার উস্তাদ হযরত ইমানুল হারামাইন স্বয়ং এই গ্রন্হ পাঠে মন্তব্য করেন, ”জীবতাবস্হায়ই তুমি সমাধিস্ত করিলে।” অর্থাৎ ছাত্রের খ্যাতি উস্তাদের জীবদ্দশায়ই তার খ্যাতিকে অতিক্রম করে গেল।

ইমাম গাজ্জালী র: এর রচিত ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” গ্রন্হখানি ইসলাম জগতে বিশেষ সমাদৃত।সুধীগন ইহার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। এ সম্পর্কে শীর্ষস্থানীয় কতিপয় মনীষীর উক্তি হল, ”জগতের সমস্ত জ্ঞান প্রদীপনির্বাপিত করে দিলে কেবল ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” দ্বারাই উহা পুনরুদ্ধার করা যাবে। ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” এর পুর্ব এরুপ গ্রন্হ জগতে আর লিখিত হয়নি। ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” কোরান শরীফের নিকটবর্তীগ্রন্থ।” জগদ্বিখ্যাত সিদ্ধপুরুষ হযরত গাজজালী র: একদা এক বিরাট জনতাকেসম্বোধন করে বললেন : আমার হাতে কোন গ্রন্থ তোমরা জান কি? ইহা ”ইয়াহইয়উলউলুমুদ্দীন” । গ্রন্থখানিকে অবজ্ঞা করার কারনে আমার বিরুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে অভিযোগ করা হয়। স্বপ্নযোগে দেখলাম,বিচারে আমার পৃষ্ঠে চাবুক মারা হয়েছে । এই দেখ, আমার পৃষ্ঠে চাবুকের চিহ্ন বিদ্যমান ।

তাঁর রচিত ‘মাকাসিদুল-ফালাসিফা’, ‘তাহাফুতুল-ফালাসিফা’ প্রভৃতি দর্শন শাস্ত্রের কিতাব সমগ্র ইউরোপে সমাদৃত হয়েছে এবংইংরেজি,ফারসী,ল্যাটিন,হিব্রু ইত্যাদি ভাষায় এগুলোর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে । এই সকল গ্রন্থ ইউরোপীয় বহু বক্রপন্থী পন্ডিতের জ্ঞানচক্ষু প্রস্ফুটিত করে দিয়েছে।জনৈক ইউরোপীয় পন্ডিত বলেছেন, ইমাম গাজ্জালী র: ও ইবনে রুশদের জন্ম না হলে মোসলমানগন নিউটন ও এরিষ্টটলের জাতি হয়েই থাকতো বস্তুত পাশ্চাত্যের জড়বাদী ভ্রান্ত দার্শনিক মতবাদের মোকাবিলায় খটি দর্শনকে বলিষ্ঠ যুক্তিতে প্রকাশ করে ইমাম গাজ্জালী র: বিশ্ব মানবের মুল্যবোধ ওচিন্তাধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করেন।বিশেষত আধ্যাতিক জ্ঞান ওচিন্তাধারাকে সঠিক পথের সন্দ্ধান দিয়ে তি মানব ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।

মুসলিম বিশ্ব অপেক্ষা খৃষ্টান ইউরোপেই ইমাম গাজ্জালী র: এর গ্রন্হাবলী সমাদৃত বেশি। প্রখ্যত কবি দান্তে, মনিষী রেমন্ড মার্টিন, মনীষীসেন্ট টমাস একুইনাস, প্রখ্যাত ফরাসি মিসটিক ব্লেইসি প্যাসকেল ইমাম গাজ্জালী র: এর গ্রন্হরাজি হতেই তাদএর যুক্তি ও উদাহরন গ্রহন করেন এবং তার মতামতকেই প্রামান্য বলেই উল্লেখ করেন। তার ৪০ টি গ্রন্হ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত ও প্রকাশিত হয়। ”কিমিয়ায়া সাদাত” ইমাম গাজ্জালী র: এর অপর একখানি অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্হ। দুনিয়ার প্রায় সকল ভাষায় এই মুল্যবান গ্রন্হের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বার্ন শহরে লেটিন ভাষায় ইহা সর্বপ্রথম অনুদিত হয় এবং অধ্যাপক হিথজীন ইহার কঠিন শব্দসমুহের ভাষ্য রচনা করেন।

• শোকের ছায়া

বাগদাদে অবস্থিত ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর পবিত্র মাজার শরীফ। সোমবার মাহে জামাদাল উখরা, হিজরী ৫০৫ সাল মোতাবেক ১৯ শে ডিসেম্বর ১১১১খ্রীষ্টাব্দ।ফজরের নামাজ সমাপনান্তে সমগ্র বিশ্বের বিশ্বয়কর প্রতিভা, যুক্তি ও যুক্তিবাদী অপ্রতিদন্দ্বী দার্শনিক, বিশ্ব মানবতারদিশারী, সুফীকুল শিরমনি হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম আবু হামিদ মুহম্মদ গাজ্জালী র: মাত্র ৫৫ বৎসর বয়সে দুনিয়াবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে হাজির হন। সম্পুর্ন সুস্হদেহেই তিনি ইন্তেকাল করেন। তাহার তিরোধান সম্পর্কে তার ভ্রাতা হযরত ইমাম আহমদ র: বলেন, সোমবার দিন অতিপ্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে তিনি স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাস অনুসারে অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করেন।তৎপর পুর্বপ্রস্তুত করা তার কাফনটি চেয়ে নেন এবং ইহা চোখে স্পর্শ করে বললেন, প্রভুর আদেশ শিরধার্য। কথাটি মোখ হতে নিঃসৃত হওয়ার সাথে সাথে তিনি স্বিয় পদদ্বয় প্রসারিত করলেন এবং সেই মুহুর্তেই ইহজগত ত্যাগ করলেন।পরম করুনাময় আল্লাহ পাক তাকে ইহজগত পর জগতেযথাযোগ্য মর্যাদা দান করুন, আমিন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment