মহানবীর শ্রেষ্ঠত্বের দ্বীপ্তিময় স্মারক মে‘রাজঃ মে‘রাজের সর্বোত্তম উপহার নামায
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও মহাবিস্ময়কর ঘটনা ‘পবিত্র মেরাজ’। রজব মাসের ২৭ তারিখ একটি ঐতিহাসিক দিবস। যে দিবস উম্মতে মুসলিমার কাছে অতি মর্যাদাবান ও সম্মানিত। পবিত্র কুরআনের ১৫তম সূরা সূরা ইসরা/বনী ইসরাইল এই ঘটনার সাক্ষী। প্রায় ২২ জনের অধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে মে‘রাজের ঘটনা। এ ঘটনা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। মে’রাজ শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠতম মু‘জিযা। নবী-রাসূলগণের ম‘ুজিযা বিশ্বাস করা ঈমানের অন্যতম অঙ্গ। পবিত্র কুরআনের আয়াত, বিশুদ্ধ হাদিস ও ইতিহাস সমর্থিত মে‘রাজের ঘটনা অস্বীকার করলে ঈমান থাকে না। সূরা বনি ইসরাইল এর প্রথম আয়াতে মে‘রাজের ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিরল মর্যাদার কথা আলোকপাত করা হয়েছে ; যা অন্য কোন নবী বা রাসূলের শানে করা হয়নি। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِه لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ.
অর্থাৎ “পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি স্বীয় খাস বান্দাহকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই। নিশ্চয়ই তিনি অধিক শ্রবনকারী এবং অধিক দ্রষ্টা।” উম্মতের জন্য শবে ক্বদর সর্বোত্তম রাত। আর নবীজির জন্য শবে ক্বদরের চেয়ে শবে মেরাজ কোটিগুণের চেয়েও বেশী উত্তম। নবীজি আল্লাহ পাকের সাথে সরাসরি সাক্ষাত লাভে ধন্য হয়েছেন। দুনিয়াতে অনেক নবী-রাসূল আবেদন করলেও আল্লাহ কাউকে সরাসরি দেখা দেননি। মেরাজের রাতে আল্লাহর দীদার লাভ করা শুধু নবীজির জন্য নয় বরং আমরা উম্মতের জন্যও অনেক বড় নিয়ামত। নবীজির জীবনে মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল মোট ৩৪ বার। স্বপ্নে ৩৩ বার ও জাগ্রত অবস্থায় ১বার। শায়খে আকবর কুদ্দিছা ছিররুহুল আজিজ বলেন,
قَالَ الشَّيْخُ الْأَكْبَرَ قُدِّسَ سِرُّهُ الْعَزِيْزُ أَنَّ مِعْرَاجَه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعٌ وَّثَلَاثُوْنَ مَرَّةً وَاحِدَةً بِجَسَدِه وَالْبَاقِيُ بِرُوْحِه.
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হয়েছিল মেরাজ ৩৪বার। একবার স্বশরীরে আর বাকীগুলো রূহানীভাবে। অন্য বর্ণনা মতে, আমাদের প্রিয় রাসুলের হায়াতে জিন্দেগীতে ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছে মোট ৩৪ বার। ১১বার স্বপ্নে, ১১বার নামাযে এবং ১১ বার চলাফেরা ও উঠাবসা অবস্থায়।
মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমনকে ‘ইসরা’ বলে। মসজিদে আকসা থেকে আসমান পর্যন্ত ভ্রমনকে মেরাজ বলে। আসমান থেকে ‘কাবা কাউসাইন’ পর্যন্ত ভ্রমনকে ‘ইরাজ’ বলে। কিন্তু সাধারণ পরিভাষায় সামগ্রিক ঘটনাকে ‘মেরাজ’ বলা হয়ে থাকে। “মক্কা শরীফ থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ইসরা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। এর অস্বীকারকারী কাফের। মসজিদে আকসা থেকে আসমান পর্যন্ত সফর ‘হাদিসে মশহুর’ দ্বারা প্রমাণিত। তা অস্বীকারকারী ফাসিক্ব ও বিদ‘আতি। অন্যান্য আশ্চর্যজনক ঘটনা ‘খবরে ওয়াহিদ’ দ্বারা প্রমাণিত। তা অস্বীকারকারী জাহেল, বদনসীব ও বঞ্চিত।” মিরাজের মাধ্যমে নবীজির তিনটি শান প্রমাণিত হয়েছে। যেমন: ১. বাশারিয়াত (মানবীয় আকৃতি) ২. মালাকিয়াত (রূহানী ও আত্মিক রূপ) ৩. হাক্বিক্বাত (মুহাম্মদিয়্যাত বা প্রকৃত রূপ) যা আল্লাহ তায়ালার গুনাবলীর বিকাশস্থল। বাশারিয়াতের মেরাজ হয়েছে মানব জগতে। নূরানীয়াতের মে‘রাজ হয়েছে আত্মা বা নুরের জগতে আর হাক্বীক্বতে মুহাম্মদীয়ার বা প্রকৃত রূপ বিকাশের মেরাজ হয়েছে আল্লাহর দরবারে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অসংখ্য আক্বীদা প্রতিফলিত হয়েছে।
লাইলাতুল মে‘রাজের আমল
লাইলাতুল মেরাজ উদযাপন করা বিদ‘আত নয় বরং উত্তম আমল। এ আমল শরীয়ত সম্মত ও সর্বজনস্বীকৃত। যেমন:
وَهِيَ لَيْلَةُ سَبْعِ وَّعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبَ لَيْلَةَ الْإِثْنَيْنِ وَعَلَيْهِ عَمَلُ النَّاسِ.
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত আরব দেশেও শবে মেরাজের আমল প্রচলিত ছিল।
إِعْلَمْ أَنَّ قَدْ إِشْتَهَرَ بِدِيَارِ الْعَرَبِ فِيْمَا بَيْنَ النَّاسِ أَنَّ مِعْرَاجَه كاَنَ لِسَبْعِ وَّعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبَ وَمَوْسِمُ الرَّجَبِيَّةِ فِيْهِ مُتَعَارَفٌ بَيْنَهُمْ.
অর্থাৎ …..। মেরাজের রাতে মাহফিল করা, আল্লাহর যিকির করা, নবীজির বেমেছাল শান-মানের আলোচনা করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, নাতে রাসূল পরিবেশন করা, দরূদ শরীফ পাঠ করা, নফল ইবাদত-বন্দেগী করা সবই জায়েজ ও শরীয়ত সম্মত। কেননা, শবে মে’রাজের আলোচনা স্বয়ং আল্লাহ পাক করেছেন পবিত্র কুরআনে এবং নবীজি অসংখ্য হাদিসে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং মে’রাজের ইবাদত আল্লাহর রহমত ও বরকত পাওয়ার অনন্য উসিলা।
মে‘রাজের সর্বোত্তম উপহার নামায
উম্মতের নাজাতে জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে আনীত মে’রাজের শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম উপহার হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামায। কীভাবে ফরয হলো এ নামায তা জানার চেষ্টা করব হাদিসের আলোকে।
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ …وَفَرَضَ عَلَيَّ فِي كُلّ يَوْم وَلَيْلَة خَمْسِينَ صَلَاة فَنَزَلْت حَتَّى انْتَهَيْت إلَى مُوسَى فَقَالَ مَا فَرَضَ رَبّك عَلَى أُمَّتك قُلْت خَمْسِينَ صَلَاة فِي كُلّ يَوْم وَلَيْلَة قَالَ ارْجِعْ إلَى رَبّك فَاسْأَلْهُ التَّخْفِيف فَإِنَّ أُمَّتك لَا تُطِيق ذَلِكَ وَإِنِّي قَدْ بَلَوْت بَنِي إسْرَائِيل وَخَبَرْتهمْ قَالَ فَرَجَعْت إلَى رَبِّي فَقُلْت أَيْ رَبّ خَفِّفْ عَنْ أُمَّتِي فَحَطَّ عَنِّي خَمْسًا فَرَجَعْت إلَى مُوسَى قَالَ مَا فَعَلْت فَقُلْت قَدْ حَطَّ عَنِّي خَمْسًا قَالَ إنَّ أُمَّتك لَا تُطِيق ذَلِكَ فَارْجِعْ إلَى رَبّك فَاسْأَلْهُ التَّخْفِيف لِأُمَّتِك قَالَ فَلَمْ أَزَلْ أَرْجِع بَيْن رَبِّي وَبَيْن مُوسَى وَيَحُطّ عَنِّي خَمْسًا خَمْسًا حَتَّى قَالَ يَا مُحَمَّد هِيَ خَمْس صَلَوَات فِي كُلّ يَوْم وَلَيْلَة بِكُلِّ صَلَاة عَشْر فَتِلْكَ خَمْسُونَ صَلَاة وَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَة فَإِنْ عَمِلَهَا كُتِبَتْ لَهُ عَشْرًا وَمَنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ وَلَمْ يَعْمَلْهَا لَمْ تُكْتَبْ فَإِنْ عَمِلَهَا كتبت له سيئة واحدة فنزلت حتى انتهت إلَى مُوسَى فَأَخْبَرْته فَقَالَ ارْجِعْ إلَى رَبّك فَاسْأَلْهُ التَّخْفِيف لِأُمَّتِك فَإِنَّ أُمَّتك لَا تُطِيق ذَلِكَ فَقُلْت قَدْ رَجَعْت إلَى رَبِّي حَتَّى اسْتَحْيَيْت (رَوَاهُ الْبُخَارِيُ وَمُسْلِمٌ(
অর্থাৎ রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ……..আর আমার উপর ফরয করেন প্রতিদিন ও রাতে ৫০ ওয়াক্ত নামায। অত:পর আমি ঊর্ধ্ব জগত হতে নিচে অবতরণ করলাম। অবশেষে (৬ষ্ঠ আসমানে অবস্থানরত) হযরত মূসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত আসলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার প্রভু আপনার উম্মতের উপর কী ফরয করেছেন? আমি বললাম, প্রতিদিন ও রাতে ৫০ওয়াক্ত নামায। তিনি বললেন, আপনি আপনার প্রভূর নিকট পুনরায় গিয়ে আবেদন করুন সহজ করার জন্য। কেননা, আপনার উম্মত তা আদায় করতে সক্ষম হবে না। আমি বনি ইসরাইলীদের ব্যাপারে পরীক্ষিত হয়েছি এবং অবগত হয়েছি। নবীজি বলেন, আমি গেলাম আমার প্রভুর নিকট এবং বললাম, হে আমার প্রভূ! আপনি আমার উম্মতের উপর থেকে সহজ করে দিন। অত:পর তিনি আমার পক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। আবার আমি ফিরে আসলাম হযরত মুসা আলাইহিস সালামের কাছে। তিনি বললেন, আপনি কী করেছেন? আমি বললাম, আমার পক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত এতে সক্ষম হবে না। আপনি আপনার প্রভূর নিকট আবারো ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য কমিয়ে দেয়ার আবেদন করুন। নবীজি বলেন, আমি আমার প্রভূ এবং মূসা আলাইহিস সালামের মাঝে এভাবে আসা যাওয়া করতে লাগলাম এবং প্রতি বারে পাঁচ ওয়াক্ত করে কমানো হলো। অবশেষে আল্লাহ পাক বললেন, হে মুহাম্মদ দ.! দিনে ও রাতে এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায আপনার উম্মতের উপর ফরয করে দিলাম। প্রতি নামাযের বিনিময়ে দশ নামাযের বিনিময় প্রদান করা হবে। এভাবে পাঁচ নামাযের বিনিময়ে দশ গুণ তথা ৫০ নামাযের বিনিময় প্রদান করা হবে। যে ব্যক্তি সওয়াবকে সংকীর্ণ ও হালকা মনে করে আমল করবে না তাহলে তাকে এক গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। আর যে দশগুণ সওয়াব মনে করে গুরুত্বের সাথে আমল করবে তাকে দশগুণ সওয়াব দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি গুনাহের কাজকে নিকৃষ্ট মনে করে তা করবে না তার গুনাহ লিখা হবে না। আর যদি তা করে তাহলে একটি গুনাহ লিখা হবে। পরিশেষে আমি মুসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত ফিরে আসলাম এবং উক্ত বিষয় সম্পর্কে তাকে অবহিত করলাম, তখন তিনি পরামর্শ দিলেন আপনার প্রভূর নিকট আপনার উম্মতের সহজের জন্য আবেদন করুন। কেননা, আপনার উম্মত তা পারবে না। আর আমি বললাম, আমি আল্লাহর কাছে গিয়েছি তবে এতে লজ্জাবোধ করেছি। এ হাদিসটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ে সংকলন করেছেন।
নামাযের বিশেষ গুরুত্ব
বে-নামাযী মাথা ছাড়া মুসলমান। কেননা, ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো নামায। অনেকেই সপ্তাহে একদিন জুমু‘আর নামায পড়েন। অন্যান্য ফরয নামাজ আদায় করে না, বিভিন্ন অজুহাত দেখায়, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নামাযের পরিবেশ তৈরী করা যায়। হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের নিকট নোটিশ জারি করে লিখেছিলেন-“তোমাদের অফিসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নামায। যে অফিসার যথাসময়ে নামায আদায় করে সে অফিসের সকল দায়িত্ব যথাযতভাবে আদায় করে। আর যে কর্মকর্তা নামাযকে নষ্ট করে আমি মনে করি সে অন্যান্য সকল দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করে না। অতএব, নামায পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার প্রধান কর্মসূচী। নামায আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয় ইবাদাত এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ঈমানের পর সকল ইবাদতের মধ্যে নামাযই প্রথম। যা কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। অন্যান্য আমলসমূহ হয়ত জীবনে একবার কিংবা বছরে একবার আদায় করতে হয়। কিন্তু নামায প্রতিদিন এবং দৈনিক পাঁচবার আদায় করা ফরয। বান্দাহকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদতের জন্য। আর সকল ইবাদতের যাবতীয় উপকরণ ও পদ্ধতি নামাযে বিদ্যমান। প্রত্যেক জিনিসের একটি নিদর্শন আছে। ঈমানের নিদর্শন হলো নামায। ঈমান ও কুফরীর বিশাল প্রাচীর হলো নামায। নামায ঈমানদারের জন্য মে’রাজ স্বরূপ। মে’রাজের শ্রেষ্ঠতম উপহার হচ্ছে নামায। যাবতীয় ইবাদতের নির্দেশ আল্লাহ পাক জিবরাইল আলাইহিস সালামার মাধ্যমে দুনিয়াতে নবীর কাছে পাঠিয়েছেন। কিন্তু নামাযই একমাত্র ইবাদত যা আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবীবকে আপন দরবারে মেহমান হিসেবে দাওয়াত দিয়ে একান্ত সাক্ষাতে উম্মতের নাজাত ও মুক্তির অন্যতম উসিলা হিসাবে প্রদান করেছেন। পবিত্র কুরআনের ৮২টি স্থানে নামাযের আলোচনা এসেছে। যে দৃশ্য দেখলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়, কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায় তা হল নামাযের দৃশ্য। জামাতবদ্ধ নামাযে একজন ইমামের পেছনে অসংখ্য মুসল্লী আনুগত্য করে একই সাথে রুকু, সিজদা, উঠা, বসা ইত্যাদি অনুসরণ করে বলেই নামাযীর প্রতি আল্লাহ বেশী খুশি হন। আগুনের বৈশিষ্ট্য হলো গরম হওয়া, বরফের বৈশিষ্ট্য হলো ঠান্ডা হওয়া, সূর্যের বৈশিষ্ট্য হলো প্রখরতা, আর চন্দ্রের বৈশিষ্ট্য হলো জ্যোতি বিকিরণ করা, ফুলের বৈশিষ্ট্য হলো সুগন্ধি বিতরণ করা। আর মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা। নর-নারী, ধনী গরিব, ছোট বড়, স্বাধীন, গোলাম, দাসদাসী, আরবি, অনারবি, সাদা, কালো, যুবক, বৃদ্ধ, সুস্থ, অসুস্থ, মুসাফির, মুকিম প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ-মহিলা উভয়ের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ফরযে আইন তথা অলংঘনীয় ইবাদত। নামায তরক করা আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্পর্কহীনতার প্রকাশ্য লক্ষণ। নামাযীর জন্য রয়েছে কল্পনাতীত পুরষ্কার। পক্ষান্তরে বেনামাযীর জন্য রয়েছে বর্ণনাতীত শাস্তি। যে কাজের গুরুত্ব ও ফযিলত বেশী সে কাজে অবহেলা ও গড়িমসি করলে এর শাস্তিও অত্যন্ত ভয়াবহ।
নামায এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
নামায ও অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। অন্যান্য ইবাদতের সাথে নামাযের কোন তুলনা হয়না। কারণ, ১.নামায অবস্থায় দুনিয়াবী কাজ করা যায় না। সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নামাযীর আয়ত্বে থাকে। অন্যান্য ইবাদতে দুনিয়াবী কাজ করা যায়। যেমন: হজ্জে ব্যবসা বাণিজ্য করা যায়। রোযার মধ্যে দুনিয়াবী কাজ করা যায়। ২.নামায জাহেরী ও বাতেনী অঙ্গ দ্বারা আদায় করা হয়। আর রোযা মুখ ও পেট দ্বারা আদায় করা হয়। ৩. নামায হলো ফেরেস্তাদের ইবাদতের সমষ্টি এবং অন্যান্য মাখলুকাতের ইবাদতের সমষ্টি। যেমন: বৃক্ষরাজি দন্ডায়মান, চতুষ্পদ জন্তু রুকু অবস্থায়, পোকামাকড় সিজদা অবস্থায়, ব্যাঙ বসা অবস্থায় রয়েছে। অতএব, সকল সৃষ্টির ইবাদত একই সাথে নামাযে নিহিত আছে। ৪.নামায ধনী, গরীব সকলের উপর ফরয। হজ্জ ও যাকাত গরীবের উপর ফরয নয়। রোযা মুসাফির ও অসুস্থ ব্যক্তির উপর ফরয নয়। ৫.নামায প্রতিদিন পাঁচবার ফরয আর রোযা ও যাকাত বছরে একবার ফরয। ৬. নামায মানুষের জীবনে আমুল পরিবর্তন আনায়ন করে। নামাযীকে সদা পবিত্র থাকতে হয়। নামাযী সর্বদা ইবাদতের চিন্তায় থাকে। আর ইবাদতের চিন্তা ও ইবাদতে গণ্য।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার তাৎপর্য
اَلصُّبْحُ صَلَاةُ آدَمَ وَالظُّهْرُ لِدَاؤُدَ وَالْعَصْرُ لِسُلَيْمَانَ وَالْمَغْرِبُ لِيَعْقُوْبَ وَالْعِشَاءُ لِيُوْنُسَ عَلَيْهِمُ السَّلَامُ . وَجُمِعَتْ فِىْ هذِه الْأُمَّةِ.
অর্থাৎ ফজর নামায হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর নামায, জোহর হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর নামায, আছর হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর নামায, মাগরিব হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর নামায, ইশা হযরত ইউনুচ আলাইহিস সালাম এর নামায। আর এ উম্মতের উপর সকল নামায একত্রিত করা হয়েছে। [ফাতাওয়া শামীর খ–২, পৃষ্টা-৩ কৃত: আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রহ.)]
আদম আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে আগমনের পর রাত দেখে একটু বিচলিত হলেন। অত:পর সকাল উদ্ভাসিত হতে দেখে আনন্দিত হলেন এবং শোকরিয়া স্বরূপ দুই রাকা‘আত নামায আদায় করলেন। এটি ছিল ফজর নামায। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বীয় পুত্রের কুরবানীর পরিবর্তে বেহেস্তী দুম্বা কুরবানী করে আল্লাহর শোকরিয়া স্বরূপ চার রাকাআত নামায আদায় করেছিলেন। এটাই ছিল জোহরের নামায। হযরত উযাইর আলাইহিস সালাম ১০০ বছর যাবৎ মৃত থাকার পর জীবিত হয়ে শোকরিয়া স্বরূপ চার রাকাআত নামায আদায় করেছিলেন। তা হলো আছর নামায। দাউদ আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে তাওবা কবুলের শোকরিয়া স্বরূপ চার রাকাআত নামাযের নিয়ত করার পর তিন রাকা‘আত পড়ে অতি দূর্বল হওয়ার কারণে তিন রাকা‘আত পর সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করেন। এটাই ছিল সর্বপ্রথম মাগরিব নামায। আমাদের নবীজি চার রাকা‘আত নামায আদায় করেছিলেন। এটাই ছিল এশার নামায।[আছরারুল আহকাম পৃষ্টা-৯ কৃত: হাকীমুল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (রহ.)]
আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়া রেজভিয়াতে লিখেন, আমার রাসূলের উপর যেদিন প্রথম ওহী নাযিল হয় এবং নবুয়তের অভিষেক হয় ঐ দিনই জিবরাইল আলাইহিস সালাম হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাকে সাথে নিয়ে নামায আদায় করেন। ঐ দিনই উম্মুল মো’মেনীন খাদিজাতুল কোবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা হুযুরের শিখানো পদ্ধতিতে নামায আদায় করেছেন। দ্বিতীয় দিন আমিরুল মো’মেনীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হুযুরের সাথে নামায আদায় করেন। [ফাতাওয়া রেজভিয়া, কৃত: আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরেলভী (রহ.)]
আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহকে মে‘রাজের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণপূর্বক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি অধিক যত্নবান হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।।
টিকা:
সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত : ১
সীরাতে হালভীয়া, ৪০৪-পৃষ্টা, আল্লামা বুরহান উদ্দিন হালভী (রহ.) পাদটীকা, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে রুহুল বয়ান, খন্ড-৫ম, পৃষ্টা-১০৫, কৃত: আল্লামা ইছমাইল হক্কী (রহ.)
মাদারেজুন নবুয়ত, ১ম-খন্ড, পৃষ্টা-১৮৯, কৃত: আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহলভী (রহ.),
আশ শিফা বি তারিখে হুকুকিল মোস্তফা, খন্ড-১, পৃষ্টা- ১১৩, কৃত: কাজী আয়াজ (রহ.)
ফাওয়াইদুল ফুয়াদ, খন্ড-৪র্থ, পৃষ্টা-৩৫০ কৃত : হযরতে নিযাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.)
মাদারেজুন নবুয়ত, খন্ড-১, পৃষ্টা-১৮৯ কৃত: আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহলভী (রহ.),
তাফসীরে নঈমী, খন্ড-১৫ত, পৃষ্টা-২৮, কৃত: মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.)
তাফসীরে রুহুল বয়ান, খন্ড-৫, পৃষ্টা-১০৫ কৃত: আল্লামা ইছমাইল হক্কী (রহ.)
মা ছাবাতা বিছ সুন্নাহ, কৃত: আল্লামা শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহলভী (রহ.), পৃষ্টা-১৯১
বুখারী ও মুসলিম শরীফ,
আছরারুল আহকাম কৃত: হাকীমুল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (রহ.)



