ব্রেলভীদের খন্ডনে দেওবন্দীদের ইলমী খিয়ানত কেন?(১ম পর্ব)

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

প্রাথমিক পর্যায়ে আমার উদ্দেশ্য ছিলো, নজদী-তাইমীদের পাশাপাশি ব্রেলভীদের আকিদা-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা খন্ডন করা। ব্রেলভীদের বিষয়ে দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের মাঝে কমন কিছু ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে। আমিও শুরু থেকে সেগুলো বিশ্বাস করে আসছি। অন্যান্য সাধারণ দেওবন্দীদের মতো প্রচলিত ধারণাগুলোকে সঠিক মনে করে প্রচার করতাম।

২০১৩ সালে আল-মুহান্নাদের অনুবাদেও এই জাতীয় কিছু ধ্যান-ধারণা তুলে ধরি। ব্রেলভীরা হক্বপন্থী উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে ইংরেজদের দালালি করে নানা ষড়যন্ত্র করেছে। শাহ ইসমাইল শহীদ ও বালাকোট আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়ার জন্য তারা অন্যায়ভাবে তাকফীর করেছে। বিশেষ করে আহমাদ রেজা খান ব্রেলভী যেই হুসামুল হারামাইন লিখেছেন, সেটিও মারাত্মক তাকফিরী ফেতনা ছিলো। মানুষের বক্তব্য কাট-ছাট করে অন্যায়ভাবে আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি তাকফির করে তাদেরকে বদনাম করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া তারা নিজেদেরকে হানাফী – মাতুরিদি পরিচয় দিলেও নিজেদের মনগড়া অনেকগুলো আকিদা তৈরি করেছে, যেগুলো মূল আহলে সুন্নতের আকিদা নয়। এভাবে ব্রেলভীরা একটি বিদয়াতি ভ্রান্ত ফেরকায় পরিণত হয়েছে।

এগুলো ছিলো স্বাভাবিক ধারণা। অধিকাংশই দেওবন্দীই উপরের ধারণাগুলো কম-বেশি ধারণ করে। হঠাৎ আমার মাথায় এলো, দু’শ – আড়াই শ’ বছরেও যেই বিতর্কের অবসান হচ্ছে না, সেই বিতর্কগুলো আরেকটু গভীরে গিয়ে যাচাই করা প্রয়োজন। এবং ব্রেলভীদেরকে ভাসা ভাসা খন্ডন না করে একেবারে তাদের মৌলিক কিতাব থেকে তাদের ভ্রান্তি তুলে ধরা উচিৎ। শক্ত ও মজবুত উসূলী আলোচনার আলোকে একেবারে বুনিয়াদী কিতাব থেকে যদি ব্রেলভীদের খন্ডন করা যায়, তাহলে বিষয়গুলোর একটা কুল-কিনারা হওয়া সম্ভব। সেই চিন্তা থেকে উভয় – পক্ষের দাবীগুলো যতটুকু গভীরে যাওয়া সম্ভব, সেখান থেকে যাচাই করা শুরু করি। প্রত্যেকটা বিষয়ের জন্য মূল কিতাব ঘেটে বের করা, সেগুলো মুতালায়া করা ছিলো বেশ সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে কিতাবগুলো ঘাটতে হয়েছে। অধিকাংশ কিতাবের পুরাতন নুসখা ঘেটে বের করা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য। আবার বহু কিতাব উর্দুর পাশাপাশি ফার্সীতে লেখা। আল্লাহর বিশেষ শোকর, আমি ছাত্র জামানায় ভালোভাবে ফার্সী শেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, আল-হামদুলিল্লাহ।

আমার সামনে দু’টি মূলনীতি ছিলো।

১। আহলে সুন্নতের স্বীকৃত উসূলের আলোকে যার বক্তব্য সঠিক হবে, তারটা মেনে নিব। এক্ষেত্রে সত্য যদি আমার প্রচলিত ধারণার বিপরীতও হয়, এরপরও গড়িমসি না করে সত্য গ্রহণের প্রস্তুত থাকব ইনশা আল্লাহ।

২। কোন বিষয়ে কারও রেফারেন্সের উপর নির্ভর না করে যতদূর সম্ভব মূল কিতাব খুৃঁজে বের করে বক্তার বক্তব্য হুবহু তার কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করা।

এই দু’টি মূলনীতি সামনে রেখে বিষয়গুলো যাচাই করতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেয়েছি। আমার প্রচলিত বহু ধারণায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পুরো জার্নিটা আমার জন্য একেবারে সহজ ছিলো না। বার বার নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে, সত্য ও বাস্তবতা মেনে নিব ইনশা আল্লাহ। যদিও সেটি আমার দলের, মতের বা আমার পছন্দের ব্যক্তিদের বিরোধী হোক। এভাবে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছি।

আমার জার্নির কিছু বিষয় আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করব ইনশা আল্লাহ। তাহলে এই বিষয়ের কিছু বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সহজ হবে।

তাইসীর অথবা মিজান জামায়াত থেকে এদেশের প্রথিতযশা আলিম ও মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব হুজুরের নাম শুনে আসছি। হুজুরের ইলমী অবস্থান নিয়ে দেশ ও বিদেশের বহু প্রাজ্ঞ আলিমও স্বীকৃতি দিয়েছেন। হযরতের সাথে যতবার দেখা হয়েছে, স্বভাব-সুলভ বিনয়, তাওয়াজু, সাদা-সিধে জীবন, অমায়িক হাসি বার বার মুগ্ধ করেছে। হুজুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো কোন যোগ্যতা না থাকলেও তিনি স্নেহের পরিচয় দিয়েছেন। আমার কাঁচা হাতের কিছু লেখা হুজুরকে দিলে তিনি গুরুত্বের সাথে দেখে মতামত দিয়েছেন। ভুল সংশোধন করেছেন। হুজুরের প্রতিষ্ঠিত মারকাজ ও মাসিক আল-কাউসার এ দেশের ইলমী অঙ্গনের আস্থা ও ভরসার প্রতীক হয়ে আছে।

সামগ্রিকভাবে হুজুরের মানহাজ ও মারকাজের মানহাজকে আমি যতটুকু বুঝেছি,

১। তাহকীক করা।

এমনকি তাহকীকেরও তাহকীক করা। কওমী অঙ্গনে নতুন প্রজন্মের মাঝে নতুন তাহকীকের যেই মেজাজ গড়ে ওঠেছে বরং যেই বিপ্লব তৈরি হয়েছে, এটি মূলত: হুজুরের একক অবদান বললে অত্যুক্তি হবে না।

২। ইলমী আদব ও শারাফাত ( ভদ্রতা)

ইলমী আলোচনায় আদবের গুরুত্ব সীমাহীন। হুজুর তার বিভিন্ন লেখনী, বয়ান ও ব্যক্তি-জীবনে আদবের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন বলেই জানি।

৩। আদল ও ইনসাফ

হুজুরের বেশ কয়েকটি বয়ানে ইলমী আলোচনায় আদল ও ইনসাফের উপর গুরুত্ব দেয়ার কথা শুনেছি। এমনকি নিচের আয়াতটিও হুজুর বার বার ব্যবহার করেন এ বিষয়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য,

وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَـَٔانُ قَوْمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعْدِلُواْ ۚ ٱعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ

কোন সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না (সূরা আল-মায়েদা ৫:৮)।

মারকাজ থেকে ফারেগ হওয়া হুজুরের ছাত্রদের কাছ থেকেও উপরের বিষয়গুলির গুরুত্বের কথা বহুবার শুনেছি। ব্রেলভিয়াত সম্পর্কে মোতালায়ার ক্ষেত্রেও বিষয়গুলো সামনে রাখার চেষ্টা করেছি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন বাতিল চিন্তার খন্ডনে শক্ত ভাষা ব্যবহার করি, এরপরও উপরের বিষয়গুলো যে চলার পথে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সেই অনুভূতি অন্তরে ধারণ করার চেষ্টা করি।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে ভূমিকা স্বরুপ কিছু কথা বলে নেয়া। আমাদের এই জার্নির মৌলিক চিন্তাগুলো যাতে পাঠকের সামনে স্পষ্ট থাকে।

মাসিক আল-কাউসারে ব্রেলভীদের সম্পর্কে হুজুরের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রয়েছে। ব্রেলভিয়াত সম্পর্কে পড়াশোনার শুরু থেকে আমি হুজুরের লেখাগুলো সামনে রাখার চেষ্টা করেছি। এ বিষয়ক একটি সিরিজ আলোচনা বেশ প্রসিদ্ধ। অনলাইনে লেখাটি অসংখ্যবার বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম হলো, “এতদঞ্চলে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ : পরিচিতি, মহিমা ও মজলুমি”।

এছাড়া ‘বেরলভী মতবাদ : ভিত্তিহীন আকীদা ও ভ্রান্ত ধ্যানধারণা’ নামে হুজুরের আরেকটি প্রসিদ্ধ প্রবন্ধ রয়েছে। এই লেখাটিও বেশ গুরুত্বের সাথে প্রচার হয়ে থাকে।

ব্রেলভিয়াত সম্পর্কে মোতালায়ার ক্ষেত্রে হুজুরের লেখাগুলো সামনে রাখার চেষ্টা করেছি। তবে আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা যেহেতু গভীরে যাওয়া, সে হিসেবে হুজুরের বক্তব্যগুলোও আরও গভীরে গিয়ে যাচাই করার চেষ্টা করেছি।

এই সিরিজে এমন কিছু বিষয় তুলে ধরব, যেগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে আমার জন্য বেশ পেরেশানির কারণ ছিলো। হুজুরের তাহকীকের প্রতি যথেষ্ট আস্থা ও ভরসা রাখার পরও যখন বেশ কয়েকটি বিষয়ে হুজুরের আলোচনায় বড় বড় কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ে, তখন পেরেশানি আরও বেড়ে যায়। হুজুরের এই আলোচনাগুলো থেকে যেসব মোটাদাগের অসঙ্গতি চোখে পড়েছে, তার দুএকটি তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।

ফজলে রাসূল বাদায়ূনীর দ্বীনদারি ও আমানতদারি

ব্রেলভিয়াত সম্পর্কে মোতালায়ার ক্ষেত্রে আমার প্রাথমিক কাজ ছিলো, তাদের চিন্তা-চেতনার একেবারে গোড়ার উলামায়ে কেরামকে খুঁজে বের করা। তাদের কিতাব সংগ্রহ করা। এবং মূল কিতাব থেকে তাদের চিন্তা-চেতনা বোঝার চেষ্টা করা। এরই ধারাবাহিকতায় মাওলানা ফজলে রাসূল বাদায়ূনীর সাথে আমার পরিচয়। বর্তমানে প্রচলিত তার প্রায় সবগুলো কিতাব সংগ্রহ করি। অধিকাংশ কিতাবই পড়ার সুযোগ হয়েছে। কিছু কিছু কিতাব এখনও পুরাতন ফার্সীতে রয়েছে। সেগুলোও সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করেছি।

মাওলানা বাদায়ূনীর দু’টি জীবনী গ্রন্থ পাওয়া যায়।

১। তাওয়ালিউল আনোয়ার

২। আকমালুত তারিখ (২ খন্ড বিশিষ্ট)

মাওলানা বাদায়ূনীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হিসেবে এতটুকু বলা যথেষ্ট যে, মাওলানা ফজলে হক্ব খাইরাবাদী রহ, মুফতী সদরুদ্দীনসহ তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরাম মাওলানা বাদায়ূনীকে সমীহ করতেন। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ছিলেন বাদায়ূনীর ছাত্র। অন্য কোথাও বাদায়ূনীর ইলমী অবস্থান নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ।

মাওলানা বাদায়ূনী সম্পর্কে মাসিক আল-কাউসারে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব হুজুর লিখেছেন,

“ এক. প্রথমে মৌলভী ফযলে রাসূল বাদায়ুনীকে চিনে নিন, কে এই লোক? তার দ্বীনদারি ও আমানতদারির অবস্থা তো তার নিম্নোক্ত ফতোয়া থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

ইংরেজ শাসনামলে সে ফতোয়া দিয়েছিল-

ببینید ساختن بت کفر نیست، و در جواز بیع آن تفصیل علی الاختلاف، ومزدوری ساختن بتخانہ وبرا فروختن نارمعبود مجوس جائز۔

অর্থাৎ : লক্ষ্য কর, মূর্তি বানানো কুফর নয় এবং এর বেচাকেনা জায়েয হওয়ার বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। আর মন্দির নির্মাণে মজদুরি করা ও অগ্নিপূজকের অগ্নি প্রজ্জ্বালনে মজদুরি করাও জায়েয।’ -ফাতাওয়া মৌলভী ফযলে রাসূল বাদায়ুনী পৃ. ১৪, মুদ্রণ : আল খালাইক প্রেস, ১২২৮ হিজরী, শাহ জাহান আবাদ; শাহ ইসমাঈল শহীদ, ড. খালেদ মাহমুদ পৃ. ১৭৭

যে লোক মন্দির নির্মাণে ও অগ্নিপূজার জন্য আগুন প্রজ্জ্বালনের সেবাদানকে জায়েয বলে এবং মূর্তি নির্মাণে উৎসাহিত করা হয় এমন সব কথা ফতোয়া আকারে সমাজে প্রচার করে, তার কাউকে কাফির বলা বা মুসলমান বলায় কী আসে যায়?

এখানে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব হুজুর মাওলানা বাদায়ূনীর দ্বীনদারি ও আমানতদারির উপর প্রশ্ন তুলেছেন তার একটি ফতোয়াকে কেন্দ্র করে। এবং এই আপত্তি থেকে হুজুর আরেকটি উপসংহার টেনেছেন যে, যিনি এমন ফতোয়া দিতে পারে এবং এজাতীয় বিষয় সমাজে প্রচার করতে পারে, তিনি কাউকে কাফের বলুক বা মুসলমান বলুক, তাতে কী আসে যায়? অর্থাৎ তার দ্বীনদারি ও আমানতদারি এতটাই প্রশ্নবিদ্ধ যে, তিনি কাউকে কাফের বা মুসলমান বলাটা তেমন ধর্তব্যের বিষয় নয়।

হুজুরের ভাষায়,

“যে লোক মন্দির নির্মাণে ও অগ্নিপূজার জন্য আগুন প্রজ্জ্বালনের সেবাদানকে জায়েয বলে এবং মূর্তি নির্মাণে উৎসাহিত করা হয় এমন সব কথা ফতোয়া আকারে সমাজে প্রচার করে, তার কাউকে কাফির বলা বা মুসলমান বলায় কী আসে যায়? “

বাদায়ূনীর দ্বীনদারি ও আমানতদারির উপর হুজুর দু’টি কারণে প্রশ্ন তুলেছেন।

১। মন্দির নির্মাণে ও অগ্নিপূজার জন্য আগুন প্রজ্জ্বালনের সেবাদানকে জায়েয বলা

২। মূর্তি নির্মাণে উৎসাহিত করা হয় এমন সব কথা ফতোয়া আকারে সমাজে প্রচার করা।

উপরের দু’টি বিশেষ অন্যায়ের কারণে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব হুজুর মাওলানা বাদায়ূনীর দ্বীনদারি ও আমানতদারি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমার এখানে তাহকীকের বিষয় ছিলো, উপরের কারণ দু’টির বাস্তবতা কী? এখানে মাওলানা বাদায়ূনী কি আসলে অপরাধী? তিনি যে কাজ করেছেন, এর উপর ভিত্তি করে কি তার আমানতদারি ও দ্বিয়ানদারি নিয়ে আপত্তি তোলা যায়?

চলুন উপরের প্রশ্নগুলো যাচাই করার চেষ্টা করি।

মাওলানা বাদায়ূনীর ফতোয়ার গোড়ার কথা

শুরুতেই আমার মূল কাজ ছিলো, যেই ফতোয়ার উপর ভিত্তি করে আব্দুল মালেক সাহেব হুজুর মাওলানা বাদায়ূনীর দ্বিয়ানতদারি ও আমানতদারিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, সেই ফতোয়ার বাস্তবতা খুঁজে বের করা। কেন এই ফতোয়া দিয়েছিলেন, আর ফতোয়ার মূল বক্তব্য আসলে কী?

মাওলানা বাদায়ূনীর সবচেয়ে বিস্তৃত জীবনী লিখেছেন মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব হোসাইন জিয়া আল-কাদেরী। তিনি এর নাম দিয়েছেন, আকমালুত তারিখ। আমার কাছে এই কিতাবের দু’টি নুসখা আছে। ১৩৩৩ হিজরীতে প্রকাশিত প্রাচীন একটি নুসখা এবং সম্প্রতি মাওলানা উসাইদুল হক কাদেরী এর হাতে পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ। আকমালুত তারিখ এর দ্বিতীয় খন্ডে উপর্যুক্ত ফতোয়াটি মূল প্রেক্ষাপটসহ উল্লেখ রয়েছে। নিচে উভয় সংস্করণের ছবি দেয়া হলো।

মাওলানা বাদায়ূনীর মূল ফতোয়াটি ছিলো ফার্সীতে। সম্প্রতি মাওলানা উসাইদুল হক্ব কাদেরী রহ: এটি তরজমা করে পৃথকভাবে ছেপেছেন। এর নাম দিয়েছেন, ‘ইখতিলাফী মাসাইল পর তারিখি ফতোয়া’ (মতবিরোধপূর্ণ মাসাইলের উপর একটি ঐতিহাসিক ফতোয়া)।

আমরা নীচে মূল ফার্সি ফতোয়া এবং মাওলানা উসাইদুল হক্বের অনুবাদ করা উর্দুটাও দিয়ে দিব ইনশা আল্লাহ। সচেতন পাঠক উর্দু ও ফার্সী থেকে মিলিয়ে নিতে পারবেন। ফতোয়ার উত্তরটি বেশ লম্বা হলেও আমরা এখানে পুরো বক্তব্যটি অনুবাদে দেয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে বক্তব্যের মূল মর্ম অনুধাবন করতে সহজ হয়।

ফতোয়ার প্রেক্ষাপট:

উক্ত ফতোয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মাওলানা ইয়াকুব জিয়া কাদেরী ‘আকমালুত তারিখ’- এ লিখেছেন,

“ মাওলানা বাদায়ূনী রহ: এর প্রকাশিত – অপ্রকাশিত রচনার মধ্যে একটি ফতোয়া রয়েছে। ফতোয়াটি মূলত: শেষ ইসলামী শাসক ও সর্বশেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এর কিছু প্রশ্নের উত্তর। প্রশ্নগুলি দিল্লি থেকে বাহাদুর শাহ জাফর বাদায়ূনী রহ: এর প্রতি বিশেষ সুধারণার কারণে তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রশ্নগুলি সুলতানের দরবার থেকে নওয়াব মুহিউদ্দীন খান বাহাদুর ও মুহাম্মাদ মুনীর খান বাহাদুর বাদায়ূনে এনেছিলেন। হযরত বাদায়ূনীর কাছে শাহী নিয়মে সুলতানের প্রশ্নগুলি পেশ করা হয়। তখন বাদায়ূনী রহ: শাহী মেহমানদেরকে দরবেশীভাবে আপ্যায়ন করেন। বাদায়ূনী রহ: উপস্থিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দেন। এই ফতোয়ার উপর তৎকালীন দিল্লির সমস্ত আকাবির উলামায়ে কেরাম সত্যায়ন ও নিজেদের মহর সহ স্বাক্ষর করেন। শাহী ফরমান অনুযায়ী উক্ত ফতোয়াটি জামাদুস সানী ১২৬৮ হিজরী মোতাবেক ১৮৫২ সালে খিলাফাতের রাজধানী শাহ জানাবাদ জয়নাব বাড়ী মহল্লার মুফীদুল খালাইক প্রেস থেকে প্রকাশ করা হয়। যেহেতু ফতোয়াটি হিন্দুস্তানের সর্বশেষ মুসলিম শাসকের একটি বিশেষ স্মৃতিচিহ্ন। তাছাড়া এটি উলামাদের প্রতি তার আস্থা ও সুধারণার বিশেষ নিদর্শন। এবং বর্তমানে মতবিোধপূর্ণ অনেকগুলো মাসআলার সমাধান এই ফতোয়াতে রয়েছে এজন্য পুরো ফতোয়াটি হুবহু উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। “

[আকমালুত তারীখ, পৃ: ১৫৩, পুরাতন নুসখা ]

সর্বশেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর বাদায়ূনী রহ: এর কাছে মোট ৯ টি প্রশ্ন করেন। বাহাদুর শাহ জাফরের মূল প্রশ্নটি নিচে দেয়া হলো।

প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ:

উলামা ও মুফতীগণ ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে কী বলেন যে নিচের কথাগুলো বলে,

১। দিন নির্দিষ্ট করে মিলাদ-মাহফিল করা কবীরাহ গোনাহ।

২। মিলাদ-মাহফিলে কিয়াম করা শিরক।

৩। খানা – দানা ও শিরনীর উপর ফাতেহা খানি করা হারাম।

৪। ওলীদের কাছে মদদ বা সাহায্য চাওয়া শিরক।

৫। পুরাতন রীতি অনুযায়ী পাঁচ আয়াতের খতম করা বিদয়াতে সাইয়্যাহ বা নিকৃষ্ট বিদয়াত।

৬। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জুতা মোবারকের মু’জিযা বা ফজীলত সঠিক নয়।

৭। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় শিয়াদের তা’জিয়া দেখা কুফুরী।

৮। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হিন্দুদের হোলী বা দশমী দেখতে যাওয়া কুফুরী। একারণে উক্ত ব্যক্তির বিবি তালাক হয়ে যাবে।

৯। কা’বা শরীফ ও মদীনার ওই এলাকার বিশেষ কোন মর্যাদা নেয়। কেননা সেখানে জুলুম হয়েছে। শোনা যায়, সেখানকার অধিবাসীরা জালেম। কারণ, তারা মদীনায় হজরত উসমান রা: কে হত্যা করেছিল। এবং মক্কায় হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রা: কে হত্যা করেছিল। হযরত হোসাইন রা: কে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছিল। বর্তমানে দ্বীনে মুহাম্মাদির যেসব উলামায়ে কেরাম হিজরত করে সেখানে গিয়েছিল, তাদেরকেও হিন্দুস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে। যদিও হযরত উসমান ও আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়েরের হত্যাকারীরা এবং হযরত হোসাইনকে দেশ ত্যাগে বাধ্যকারীরা নিজেদেরকে মুসলমান মনে করত।

প্রশ্ন হলো, এধরণের বক্তব্য প্রদানকারীর কথা অনুসরণ করা জায়েজ কি না? এমন ব্যক্তির হাতে মুসলমানদের বাইয়াত হওয়া জায়েজ কি না? শরীয়তের দৃষ্টিতে এই ব্যক্তি ও তার অনুসারীদের কী বিধান? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন

বাহাদুর শাহ জাফর

ঐতিহাসিক বিচারে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের উপরের প্রশ্ন এবং বাদায়ূনীর উত্তর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখানে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করতে পারব না। মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব যে মাসআলার উপর ভিত্তি করে মাওলানা বাদায়ূনীর দ্বিয়ানতদারি ও আমানতদারির উপর প্রশ্ন তুলেছেন, শুধু সেই বিষয়টি নিয়েই কথা বলো। উপরের ৯ টি প্রশ্নের মধ্যে ৭ ও ৮ নং প্রশ্নের উত্তর আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। নিচে মাওলানা বাদায়ূনী রহ: এর সম্পূর্ণ উত্তরের অনুবাদ দেয়ার চেষ্টা করেছি। সেই সাথে মূল বই থেকে উর্দু ও ফার্সী উত্তরের ছবি দেয়া থাকবে।

ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শি’য়াদের তা’জিয়া দেখা কি কুফুরী? একইভাবে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হিন্দুদের হোলী বা দশমী দেখা কি কুফুরী? আর একারণে কি বিবি তালাক হয়ে যাবে?

এই প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা বাদায়ূনী রহ: লিখেছেন, [ ফতোয়ার শুরু ]

“ আহলে সুন্নতের নিকট ঈমান ও কুফুর তাসদীক (সত্যায়ন) ও তাকজীব (মিথ্যা প্রতিপন্ন করা) এর নাম। আর উভয়টি মানুষের অন্তরের কাজ। মুখে ঈমানের স্বীকারোক্তি প্রদান করা একটি অতিরিক্ত রুকন অথবা দুনিয়াবি বিধান প্রয়োগের জন্য মুখের স্বীকারোক্তি শর্ত।

অন্য দিকে ভ্রান্ত ফেরকা খারেজীদের নিকট অন্তরের সত্যায়নের সাথে বাহ্যিক আমলের নাম হলো ঈমান। এজন্য খারেজীরা প্রত্যেকটি গোনাহকে তারা কুফুরী বলে এবং আল্লাহর প্রত্যেকটি অবাধ্যতাকে তারা শিরক বলে। খারেজীদের এই ভ্রান্তি চিন্তা-চেতনা যেহেতু সর্বজন বিদিত এজন্য এর দলিল দেয়ার প্রয়োজন নেই।

প্রশ্নের ব্যক্তি শুধু চোখের কাজ তথা দেখার উপর কুফুরীর হুকুম লাগিয়েছে, ব্যক্তির অন্তরে সত্যায়ন থাকুক বা না থাকুক, এটি তার কাছে কুফুরী। এই ব্যক্তির এধরণের তাকফির স্পষ্ট প্রমাণ করে যে সে আহলে সুন্নত থেকে বহির্ভূত বাতিল চিন্তা লালন করে। সে অন্ত:ত এতটুকু বলতে পারত যে, মানুষ যেহেতু তা’জিয়ার ঈবাদত করে এজন্য তা’জিয়া দেখার দ্বারা কুফুর হতে পারে।

মোটকথা, ঐ ব্যক্তির এধরণের তাকফির করা সম্পূর্ণ বাতিল। কারণ, তার এই বক্তব্য আক্ষরিকভাবে নিলে চাঁদ-সূর্য্য দেখা, গঙ্গা-যমুনা দেখা ও এর পানি পান করা কুফুরী হবে। (কারণ এগুলোর তো ইবাদত করা হয়।)

একইভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত, হিজরতের আগে ও পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু উমরাহ করেছেন, সেই সময় সাহাবায়ে কেরাম হজ্বও করেছেন, মক্কা – বিজয়ের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সকলেই মুশরিকদের বাতিল মা’বুদদেরকে চোখে দেখেছেন। যা খুবই স্পষ্ট ও প্রমাণিত সত্য ( যদি শুধু চোখে দেখা কুফুরী হতো তাহলে নাউজুবিল্লাহ তাদের উপর কুফুরীর হুকুম চলে আসত) ।

মক্কা বিজয়ের পূর্বে হজ্ব ফরজ হলে সাহাবায়ে কেরাম হজ্ব করতে আসতেন। সাফা-মারওয়ায় ইসাফ ও নাইলা নামে দু’টি মূর্তি ছিলো। এদের কারণে সাফা-মারওয়ার সায়ী করতে সাহাবায়ে কেরাম ইতস্তত: করছিলেন। তখন পবিত্র কুরআনের আয়াত নাজিল হয়,

فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا

নিশ্চয়ই ‘সাফা’ এবং ‘মারওয়া’ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম। কাজেই যে ব্যক্তি কাবাগৃহের হাজ্জ অথবা ‘উমরাহ করবে, এ দু’টোর সাঈ করাতে তাদের কোনই গুনাহ নেই (২:১৫৮)

তবে এখানে মনে রাখতে হবে, ফিকহের কিতাবসমূহে মুশরিকদের ঈদসমূহে তাদেরকে সম্মানের উদ্দেশ্যে যাওয়া এবং তাদের কাজগুলোর সাথে একাত্ম হওয়াকে কুফুরী লেখা হয়েছে। সুতরাং হানাফী ফিকহের কিতাব ত্বহতাবীতে রয়েছে,

و يكفر باتيانه عيد المشركين تعظيما

অর্থাৎ, সম্মানের উদ্দেশ্যে মুশরিকদের ঈদে অংশগ্রহণ করা কুফুরী

[ হাশিয়াতুত ত্বহতাবী আলাদ দুররিল মুখতার, খ: ২, পৃ: ৪৭৯ ]

ফতোয়ায়ে আলমগীরিতে রয়েছে,

ويكفر بخروجه إلى نيروز المجوس والموافقة معهم فيما يفعلونه في ذلك اليوم وبشرائه يوم نيروز شيئا لم يكن يشتريه قبل ذلك تعظيما للنيروز لا للأكل والشرب وبإهدائه ذلك اليوم للمشركين ولو بيضة تعظيما لذلك اليوم.

ولا يكفر بإجابة دعوة مجوس وحلق رأس ولده.

অর্থ: অগ্নিপূজকদের নববর্ষ উদযাপনে অংশগ্রহণ করা এবং সেদিন তারা যা করে সেগুলোর সাথে একাত্মতা ঘোষণার দ্বারা ব্যক্তি কুফুরী করবে। একইভাবে মুশরিকদের নববর্ষের সম্মানে ওই দিন যদি এমন কিছু সে ক্রয় করে যা অন্য কোন সে ক্রয় করে না তাহলেও কুফুরী হবে। তবে এটি যদি খানা-পিনা বা অন্য উদ্দেশ্য ক্রয় করে তাহলে কুফুরী হবে না। একইভাবে মুশরিকদের নববর্ষকে সম্মান দেখানোর উদ্দেশ্য সেই দিন যদি তাদেরকে কিছু উপহার দেয় এমনকি একটি ডিম দিলেও কুফুরী হবে। তবে নববর্ষের দিনে অগ্নিপূজক কেউ যদি দাওয়াত দেয় অথবা তার ছেলের মাথা মুন্ডানোর জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে তাহলে সেখানে উপস্থিত হতে পারবে। (এতে কুফুরী হবে না)।

[ ফতোয়ায়ে আলমগীরি, খ: ২, পৃ: ২৭৭ ]

একই ধরণের বক্তব্য অন্যান্য ফতোয়ার কিতাবেও রয়েছে।

প্রাচীনকাল থেকে শামের শহরগুলোতে এই প্রচলন ছিলো যে, মুসলমান মুসাফিররা কাফেরদের ইবাদতখানায় রাত-যাপন করত। এমনকি বর্তমানেও হিন্দুস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলে এর প্রচলন রয়েছে। হযরত উমর রা: শামের জিম্মি-কাফেরদের থেকে এই অঙ্গীকারনামা নিয়েছিলেন যে, তারা মুসলমান মুসাফিরদেরকে তাদের ঈবাদতখানায় অবস্থান করতে বাঁধা দিবে না। বর্ণনাটি ত্বহতাবীসহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য কিতাবে রয়েছে।

ফতোয়ায়ে আলমগীরিতে রয়েছে, কোন মুসলমান যদি অগ্নিপূজকের অগ্নি প্রজ্বলনের কাজ করে মজদুরি গ্রহণ করে তাহলে এতে সমস্যা নেই। এমনটি খুলাসাতুল ফাতাওয়াতে রয়েছে।

নাওয়াদিরে হিশামে ইমাম মুহাম্মাদ রহ: থেকে বর্ণিত আছে,

কোন ঘর বা তাবুকে ছবি বা মূর্তি বানাবার জন্য ভাড়ায় দেয়া মাকরুহ। তবে যে ভাড়া দিয়েছে সে এর বিনিময় পাওয়ার হক্বদার।

হিশাম বলেন, বাড়ীর মালিক তখনই ভাড়া পাওয়ার যোগ্য হবে যখন ঘরের রং সে নিজে করবে। যেমনটি জাখীরা ইত্যাদি গ্রন্থে রয়েছে। কিন্তু রং যদি ভাড়াটে করে, তাহলে ছবি মূর্তির জন্য সে কোন বিনিময় পাবে না। যেমনটি সিরাজিয়্যাহ বা অন্যান্য গ্রন্থে রয়েছে।

কোন মুসলমান অন্য কোন কাফের জিম্মির জন্য তার ইবাদতখানা বা গীর্জা ইত্যাদি বানানোর দিনমজুরি করা জায়েজ আছে এবং তার মজুরিও হালাল হবে। যেমনটি আল-মুহীতুল বুরহানী সহ অন্যান্য ফতোয়ার কিতাবে রয়েছে।

সহীহ বোখারীতে ইমাম বোখারী রহ: একটি অধ্যায়ের শিরোনাম এনেছেন এভাবে,

باب الأسْوَاقِ الَّتِى كَانَتْ فِى الْجَاهِلِيَّةِ فَتَبَايَعَ بِهَا النَّاسُ فِى الإسْلامِ

ওই সব বাজারের বর্ণনা যেগুলো জাহেলী যুগে প্রচলিত ছিলো এবং পরবর্তীতে মুসলমানরাও সেখানে ক্রয়-বিক্রয় করেছে।

ইবনে হাজার আসকালানী রহ: ‘ফাতহুল বারী’ – তে লিখেছেন,

“ জাহেলী যুগের অন্যায় ও ইবাদতের জায়গাগুলোতে ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যের কাজে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই”

এই অধ্যায়ে বোখারীতে যেই হাদীসটি এসেছে সেখানে ইবনে আব্বাস রা: বলেন,

كَانَتْ عُكَاظٌ وَمَجَنَّةُ وَذُو الْمَجَازِ أَسْوَاقًا فِى الْجَاهِلِيَّةِ، فَلَمَّا كَانَ الإسْلامُ تَأَثَّمُوا مِنَ التِّجَارَةِ فِيهَا، فَأَنْزَلَ اللَّهُ: (لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ) [البقرة: 198] فِى مَوَاسِمِ الْحَجِّ، قَرَأَ ابْنُ عَبَّاسٍ كَذَا

অর্থাৎ, উকাজ, মাজান্না ও জুল-মাজায নামক জায়গাগুলো ছিলো জাহেলী যুগের বড় বড় বাজার। যখন ইসলাম এলো, মুসলমানদের সেখানে ব্যবসা করতে অপরাধবোধ কাজ করছিলো। তখন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেন এই মর্মে যে, এগুলোতে হজ্বের মৌসুমে ব্যবসা করতে কোন সমস্যা নেই।

[সহীহ বোখারী, ক্রয়-বিক্রয়ের অধ্যায় ]

আল্লামা আইনী তার বোখারী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘উমদাতুল ক্বারী’ – তে লিখেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই সব বাজারে গিয়েছেন এবং সেখান থেকে কাপড় ইত্যাদি ক্রয় করেছেন মর্মে গ্রহণযোগ্য বর্ণনা রয়েছে।

বোখারী শরীফে রয়েছে,

عن جابر بن عبد الله -رضي الله عنهما- أنه سمع رسول الله -صلى الله عليه وسلم- يقول عام الفتح وهو بمكة: «إن الله ورسوله حرم بيع الخمر والميتة والخِنزير والأصنام»،

অর্থাৎ হযরত জাবের আব্দিল্লাহ বলেন, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কা বিজয়ের বছর মক্কায় বলতে শুনেছেন, আল্লাহ এবং তার রাসূল মদ, মৃত জানোয়ার, শূকর ও মূর্তি বেচা-কেনা হারাম করেছেন।

বোখারীর উপর্যুক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী ফাতহুল বারীতে লিখেছেন,

والعلة في منع بيع الأصنام عدم المنفعة المباحة ، فعلى هذا إن كانت بحيث إذا كسرت ينتفع برضاضها جاز بيعها عند بعض العلماء من الشافعية وغيرهم ، والأكثر على المنع حملا للنهي على ظاهره ، والظاهر أن النهي عن بيعها للمبالغة في التنفير عنها ، ويلتحق بها في الحكم الصلبان التي تعظمها النصارى ويحرم نحت جميع ذلك وصنعته

অর্থাৎ হাদীসে মূর্তি বিক্রি করার যেই নিষেধাজ্ঞা এসেছে এর মূল কারণ হলো, মূর্তি থেকে বৈধ কোন উপায়ে উপকৃত হওয়া যায় না। এজন্য কোন মূর্তি যদি এমন হয় যে, সেটা ভেঙ্গে এর বিভিন্ন অংশ দিয়ে উপকৃত হওয়া সম্ভব, তাহলে শাফেয়ী মাজহাব সহ অন্য মাজহাবের কিছু উলামায়ে কেরামের কাছে এটি বিক্রি করা জায়েজ। তবে অধিকাংশ উলামাদের মত হলো, মূর্তি বিক্রি জায়েজ নয়। তারা হাদীসটিকে এর বাহ্যিক অর্থের উপর রেখে এই মত গ্রহণ করেছেন। আর এটিও স্পষ্ট যে, মূর্তি বিক্রির নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ মূর্তির প্রতি যেন বেশি ঘৃণা তৈরি হয়। মূর্তির এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হবে ক্রুশও। যা খ্রিষ্টানদের কাছে বিশেষ সম্মানের। এগুলোর সব কিছু বানানও হারাম হবে।

[ফাতহুল বারী, খ: ৪, পৃ: ৪২৬ ]

উপরের আলোচনা থেকে বোঝার বিষয় হলো, শুধু মূর্তি বানান কুফুর নয়। আর মূর্তির ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে উলামাদের মাঝে মতবিরোধ আছে। মন্দির বা গীর্জা বানানোর দিনমজুরি, অগ্নিপূজকদের আগুন প্রজ্জলনের মজুরি নেয়া যদি জায়েজ হতে পারে, তাহলে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় শুধু তা’জিয়া দেখা কুফুর হবে কেন?

যে ব্যক্তি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তা’জিয়া দেখাকে সরাসরি কুফুর বলে দেয়, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত দ্বীন ও শরীয়তের স্পষ্ট বিরোধিতা করেছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

[বাদায়ূনী রহ: এর ফতোয়া শেষ হলো]

এটি ছিলো বাহাদুর শাহ জাফরের ৯ টি প্রশ্নের মধ্যে ৭ ও ৮ নং প্রশ্নের উত্তর। অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর দেখতে হলে মূল কিতাবটি দেখতে হবে। এই উত্তরটি যেহেতু আমাদের মূল আলোচনার সাথে সম্পর্কিত এজন্য আমরা এখানে শুধু এ বিষয়টিই তুলে ধরেছি।

বাদায়ূনী রহ: এর এই ফতোয়া শুধু তার একার ছিলো এমন নয়। উনার এই ফতোয়ার উপর তৎকালীন সময়ের বড় বড় উলামায়ে কেরাম প্রায় সকলে সাক্ষর ও নিজেদের মহর দিয়ে সমর্থন জানিয়েছেন।

যারা এই ফতোয়ায় সমর্থন দিয়েছিলেন তাদের নাম নিচে দেয়া হলো,

১। মুফতী মুহাম্মাদ সদরুদ্দীন রহ:। শাহজানাবাদের সদরুর সুদূর।

২। মাওলানা মওলবী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সাহেব রহ:। মাদ্রাসায়ে আরাবী দিল্লির শিক্ষক।

৩। হযরত শাহ আহমাদ সাইদ সাহেব।

৪। মৌলভী মুহাম্মাদ মাজহার সাহেব।

৫। মৌলভী মুহাম্মাদ উমর সাহেব।

৬। জনাব মাওলানা কারীমুল্লাহ সাহেব।

৭। মৌলভী মুহাম্মাদ ফরীদুদ্দীন সাহেব। দিল্লির জামে মসজিদের ওয়ায়েজ।

৮। হাকীম মুহাম্মাদ ইমামুদ্দীন খান সাহেব।

৯। জনাব হাকীম মুহাম্মাদ আহসানুল্লাহ খান সাহেব।

১০। কাজী আহমাদুদ্দীন সাহেব।

১১। কাজী মুহাম্মাদ আলী সাহেব।

১২। মৌলভী মুহাম্মাদ আজীজুদ্দীন সাহেব।

১৩। মৌলভী তাফাজ্জাল হুসাইন খান সাহেব।

১৪। সাইয়্যেদ বশীর আলী সাহেব আমরুহী।

১৫। মুনতাহাল কালামের লেখক জনাব মাওলানা হায়দার আলী সাহেব।

১৬। মাওলানা দিলদার বখশ সাহেব।

১৭। মাওলানা হাসানুজ্জামান সাহেব।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, উপরের ১৭ জন আলিমের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন সরাসরি শাহ পরিবারের ছাত্র এবং শাহ পরিবারের দিল্লির মাদ্রাসায়ে রহিমিয়া থেকে পাশ করা। যেমন,

১। মুফতী সদরুদ্দীন আজুরদাহ রহ: ( শাহ আব্দুল কাদের রহ: ও শাহ আব্দুল আজিজ রহ: এর সরাসরি ছাত্র)।

২। মাওলানা হায়দার আলী ফয়েজ আবাদদী ( শাহ রফিউদ্দীন রহ: ও শাহ আব্দুল আজীজের ছাত্র)

৩। মাওলানা আহমাদ সাইদ নকশবন্দী ( শাহ আব্দুল কাদের ও শাহ আব্দুল আজিজ রহ: এর ছাত্র)

৪। মাওলানা কারীমুল্লাহ ( শাহ আব্দুল আজিজ রহ: এর ছাত্র)

৫। মাওলানা ফরীদুদ্দীন দেহলবী ( শাহ আব্দুল আজিজ রহ: এর ছাত্র)

[পববর্তী পর্বে লেখার বাকী অংশ দেয়া হবে ইনশা আল্লাহ ]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment