লাইন এবং ধারা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। মানে কোন ঘরানার লোক কি বলে তা আগে জানতে হয়। তারপর তার কথার অর্থ ও মূল্যায়ন করা যায় সঠিকভাবে। সাহিত্যে একটা কথা আছে, ‘কবির কবিতা বুঝতে হলে কবিকে বুঝতে হবে আগে’। নজরুলকে না বুঝে ‘বিদ্রোহী’ পড়লে কয়েকশ কুফরি ফতোয়া দেয়া যাবে। নজরুল মুসলমান। তাই তাঁর মুসলিম সত্তা ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় রেখেই কবিতাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে। ‘মুখতাসারুল মায়ানি’র কথাটি মনে আছে তো।
ﺍﻧﺒت ﺍﻟﺮﺑﻴﻊ ﺍﻟﺒﻘﻞ –
অর্থাৎ ‘বসন্তকাল শস্য উৎপন্ন করেছে’। শস্য উৎপন্ন করেন তো মহান আল্লাহ তায়ালা। এখানে বসন্তকাল এলো কোত্থেকে। সে কারণে এই কথাটির অর্থ নির্ধারণের জন্য কে কথাটি বলল তা দেখার প্রয়োজন আছে। কারণ তাওহিদে বিশ্বাসী মুসলমান বসন্তকালকে প্রকৃত উৎপাদনকারী বিশ্বাস করে না। তার অন্তর্নিহিত এই বিশ্বাস এই কথাটির সঠিক অর্থ নির্ধারণ করে দিচ্ছে এবং সেকারণে তাকে মুশরিক বলা যাবে না। সুতরাং মুসলমান বললে তা ব্যাখ্যা ( ﺗﺄﻭﻳﻞ) করে তার রূপক অর্থে নির্ধারণ করতে হবে।
আর মুশরিক বললে তার ভিন্ন অর্থ হবে। কারণ তার ধর্মবিশ্বাসই হলো আল্লাহ ছাড়া আরও নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা আছে।
মানে কোন ঘরানার মানুষ কথাটি বলল তা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মেরাজকে আবু জেহেলও অস্বীকার করেছে, আর হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহাও বলেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র দেহ কোথাও যায়নি। দুটোকে কি এক করে দেখার সুযোগ আছে?
ﺍﻧﻲ ﺍﺧﺎﻑ ﺍﻟﻠﻪ –
‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’ কথাটা নবিগণও বলেছেন। বদরের যুদ্ধের দিন শয়তানও বলেছে। এই দুই বলার মাঝে ভাবার্থগত পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য শব্দ থেকে উৎসারিত নয়; কে বলেছে এবং কোন্ উদ্দেশ্যে বলেছে সেই বিবেচনায়। যারা এই পার্থক্য বুঝে না তারা ভালোকে কালো, মুমিনকে মুশরিক, আল্লাহওয়ালাকে ভণ্ড বলার প্ররোচনায় পড়ে যাবে। আর কোন ইজম-তাড়িত হলে তো আর কথাই নেই। প্রতিপক্ষকে সহজেই বাতিল, ভণ্ড বানানো যাবে।
ফেরাউনও রব দাবি করেছে। আবার মুসলিম শরিফে আল্লাহ তায়ালার এক বান্দা, যে মরুভূমিতে তার হারানো সওয়ারি ও ছামান খুঁজে পাওয়ার পর আনন্দের আতিশয্যে ‘আল্লাহ, আমি তোমার রব, তুমি আমার বান্দা’ বলে চিৎকার করে উঠেছে বলে বর্ণিত আছে। আর সুরা ইউসুফে আজিজে মিশরকেও ‘রব’ বলা আছে। এই দুই কথার অর্থ কি এক? দুই ঘরানার দুইজন হওয়ার কারণে ভাবার্থে পার্থক্য আছে।
সুতরাং সুন্নিদের কথার অর্থ আর ওহাবিদের কথার অর্থ এক করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ ওহাবিরা স্বভাবগতভাবেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে বেয়াদবি করে। আর সুন্নিরা জন্মগতভাবে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শান ও মর্যাদাকে শিরোধার্য করে রাখে। সেকারণে কোন কথার ব্যাখ্যা তথা ﺗﺄﻭﻳﻞ হবে, কোন কথার ব্যাখ্যা তথা ﺗﺄﻭﻳﻞ না করে বরং সমালোচনা ও ফতোয়া হবে, তা ঠিক করাই হলো একজন আলেমের মূল কাজ।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে বেখাপ্পা লাগে এমন বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে ইমাম আবু হানিফাসহ পর্ববর্তী কোন্ আলেম এমন ছিল যাদের দু’চারটি কথার ব্যাখ্যা করে হক আকিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়নি? একেবারে কোন উপায়অন্তর না পেলে ‘ ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺍﻻ বলে ‘ বক্তব্যকে ‘ ﻣﺤﻤﻞ ﺻﺤﻴﺢ ‘ তথা সঠিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার শেষ চেষ্টাটুকু করতেও দেখেছি অনেক কিতাবে। তারপরও বক্তব্য দানকারীকে কটাক্ষ করা হয়নি। কারণ হক ঘরানার লোক। তবে জীবিত থাকলে সম্মানজনক উপায়ে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করাও বজুর্গদের আদর্শ ছিল। আর এই ব্যাখ্যা না করে চলতে গেলে গাউছে পাক রা, এর ‘ফুতুহুল গাইব’ এবং ইবনে আরাবী রা, এর ‘ফুসুসুল হিকামসহ’ হাজারো কিতাব এমন আছে যেখানে আটলান্টিকের ঢেউয়ে দিকভ্রান্ত পথিকের মতো মরতে হবে বৈকি।
আর মির্জা গোলামের কথার ব্যাখ্যা করা বৃথাশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না’।
আজ আমাদের অনলাইন-অফলাইনে এত মুফতির ছড়াছড়ি যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় মাঝে মধ্যে!
‘ঘরানা’র পাশাপাশি ‘উদ্দেশ্যে’র বিষয়টাও বিবেচনায় নেয়া খুব জরুরি, যদি হক ঘরানার মানুষ হয়। হযরত হাতেব বিন আবু বালতা (রা.)কে পেয়ারা নবি দায়মুক্তি দিয়েছিলেন উদ্দেশ্যের বিবেচনায়। হক পন্থীদের জন্য এই বিবেচনাকে আবার পক্ষপাতিত্ব বলারও কোন সুযোগ নেই। এই বিবেচনা দীনের স্বার্থে, ইমানের স্বার্থে।
আলা হযরতের কালাম লক্ষ্য করুন,
واسطہ پیارے کا ایسا ہو کہ جو سنی مرے
یوں نہ فرمائیں ترے شاہد کہ وہ فاجر گیا
হাবিব রেজভির প্রসঙ্গ:
নিয়্যত বা উদ্দেশ্য ভালো ছিল তা আমি যদ্দুর বুঝতে পেরেছি। কিন্তু বক্তব্যটা চরম আপত্তিকর ছিল। ‘রাসুল মুসলমান না, মুসলমান বললে কাফের হয়ে যাবে’। চরম আপত্তিকর কথা! ‘মুসলমান বললে, আমরাও মুসলমান, তাতে ভাই ভাই হয়ে যাবে, উম্মুহাতুল মুমিনিন আমাদের ভাবি হয়ে যাবেন’;— ফিকহ ও উসুল না জানা ভাইগণ এমন ভারসাম্যহীন ইজতিহাদ করা থেকে বিরত থাকুন। আমরাও মুমিন, আল্লাহও নিজের নাম রেখেছেন মুমিন। তাতে কি ‘ইন্নামাল মুমিনুনা ইখওয়াহ’র মানদণ্ডে আল্লাহ তায়ালাকে ভাই বলার যৌক্তিকতা কিংবা অপরিহার্যতা তৈরি হবে? নাউজুবিল্লাহ!! এমন সারবত্তাহীন ইজতিহাদ অনেক বক্তাদেরই করতে দেখা যায়! হাবিব রেজভির বক্তব্যটা নিশ্চিতভাবে ভুল ছিল। তবেঁ তার শাস্তি গ্রেপ্তার নয়। ওহাবিরা তো তাদের ‘পীর’কে ‘নবি’ বলে ছেড়েছে। তাতে তো এখনো কারো আতে ঘা লাগেনি তেমন করে। তাতে তো গ্রেপ্তার প্রসঙ্গও আসে নি। আমি তার মুক্তি প্রত্যাশা করছি।
আল্লামা আকবর আলী রেজভি (রহ.) প্রসঙ্গ:
আল্লামা আকবর আলী রেজভি (রহ.) এর কিছুকিছু কথা ও ফতোয়ার সাথে আমি একমত নই এবং এরকম ভিন্নমত থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। বিশেষকরে ওনার বৃদ্ধ অবস্থায় দেয়া অনেক ফতোয়ার সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করি— যে বয়সে পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের আয়াতের ভাষ্য অনুসারে ارذل العمر এ পৌঁছলে মানুষের বিবেকের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ইবনে মাযাহর ৪২৩৬ ও তিরমিযীর ৩৫৫০ নং হাদিসে যেখানে এই উম্মতের গড় আয়ু ৬০-৭০ বলা হয়েছে, সেখানে সূরা নাহলে যে আয়াতে ঐ ارذل العمر এর কথা আছে সে আয়াতের নাম্বারও ৭০! তাই শতোর্ধ্ব এই আলেমের বৃদ্ধাবস্থায় বক্তব্যগুলোর দায় আমার মতে ওনার উপর নয়— যাঁরা ওনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের উপর।
কিন্তু বাংলাদেশের সিলেট, বৃহত্তর কুমিল্লা, ময়মনসিংহসহ বৃহৎ এলাকাজুড়ে সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠায় ওনার যে খেদমত তা স্বীকার করতে আমি বাধ্য। একসময় আল্লামা আবেদ শাহ মুজাদ্দেদি র,, আল্লামা আকবর আলী রেজভি র, এবং আমার শ্বশুর আল্লামা আব্দুল বারী জেহাদি মুদ্দা, এই তিন জনের জুটির কথা শুনলে ওহাবিদের মরণতৃষ্ণা তৈরি হয়ে যেতো! ওহাবীরাই ওনাদের বিরোধিতা করতো। ওনাদের খেদমতের সময় আমাদের অনেকের জন্মই হয়নি। ওনাদের খেদমতের সুফল এখনো আমরা অনেক জায়গায় ভোগ করছি এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক দিন হয়তো ভোগ করতে থাকবো। তাই ওনাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা রাখাই আমি কর্তব্য মনে করি। কারণ, অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ওনারা আছেন এবং থাকবেন আরও অনেক দিন। তবে আল্লামা রেজভী সাহেবের খলিফা ও ভক্তদেরও আরও হিসাব নিকাশ করে কথা বলা উচিত মনে করি। আল্লাহ তায়ালা আল্লামা আকবর আলী রেজভী র, এর খেদমত কবুল করে ওনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন আমীন।