বিখ্যাত ৫ মুসলিম দার্শনিক

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইতিহাসের পথচলায় বহু মহান মুসলিম দার্শনিক, শাসক, সেনাপতি ও শিল্পীর জন্ম হয়েছে যারা বিশ্বে ইসলামকে নতুন করে বুঝতে সহায়তা করেছেন।এরা বিচরণ করেছেন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। এ মনীষীদের অবদান ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এবারের আয়োজন পাঁচ শ্রেষ্ঠ দার্শনিককে নিয়ে যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল। লিখেছেন লায়লা আরজুমান্দ

আল কিন্দি (৮০১-৮৭৩ খ্রি.)

আল কিন্দি মুসলিম বিশ্বের সোনালি দিনের বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। পুরো নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল কিন্দি। তিনি ছিলেন একাধারে কোরআন, হাদিস, ইতিহাস, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, রাজনীতি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, মিউজিক, মনোবিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি নানা বিষয়ে বিশারদ। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় দক্ষতা দেখালেও দর্শনের মুনশিয়ানার কারণেই তিনি বেশি খ্যাতি পেয়েছেন। এছাড়া বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখায় তিনি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন।

কিন্দির সেরা দার্শনিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘অন ফার্স্ট ফিলসফি’ যাকে অনেকে বলেন ‘স্টাডি অব গড’ বা সৃষ্টিকর্তার অধ্যয়ন। আল কিন্দি সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কেই অধ্যয়ন করবার চেষ্টা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তাই সকল পার্থিব অস্তিত্বের কারণ। আর তাই সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে ভাবনার মধ্যেই পার্থিব সকল দর্শন নিহিত। এই বইয়ের মূল কপি, কিন্দির নিজ হাতে লেখা। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এর পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। এছাড়া এ পর্যন্ত আল কিন্দির লেখা ২৭০টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়।দার্শনিক প্রয়োগ পদ্ধতি বিষয়ে আল-কিন্দির ধারণা বেশ মৌলিক। তিনি নিছক ধ্যান বা অনুধ্যানের মাধ্যমে দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার পক্ষে ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, সঠিক দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের আশ্রয় নিতে হবে। এজন্যই তিনি দর্শনে গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন। এদিক দিয়ে তার সঙ্গে আধুনিক দর্শনের জনক রনে দেকার্তের সঙ্গে মিল দেখা যায়। জ্ঞানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কিন্দি তিনটি পৃথক বিষয় প্রবর্তন করেন : ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং কল্পনা। তার মতে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করি আর বুদ্ধি প্রজ্ঞার জন্ম দেয়। কিন্তু এ দুয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করে কল্পনা। এই মতবাদের সঙ্গে ইমানুয়েল কান্টের সমন্বয়বাদী জ্ঞানতত্ত্বের মিল দেখা যায়। তার দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চা ছিল প্রবলভাবে গ্রিকদের দ্বারা প্রভাবিত। তার অনেক অর্জনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল গ্রিক ও হেলেনীয় দর্শনকে আরব জগতে পরিচিত করে তোলা। কিন্দিকে আরব ইতিহাসের অন্যতম সেরা দার্শনিকের মর্যাদা দেওয়া হয়। তাকে অনেকে সরাসরি ‘আরবদের দার্শনিক’ নামে ডাকেন। এছাড়াও আল কিন্দিই প্রথম বলেছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের সকল সূত্র সকল ক্ষেত্রে খাটবে না। যা অনেক পরে মহান বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইন প্রমাণ করেছেন।

কিন্দির আত্মা বিষয়ক চিন্তায় প্লেটোর প্রভাবও দেখা যায়। তিনি মনে করতেন আত্মা এবং জড় সম্পূর্ণ পৃথক দুটি সত্তা। এর মধ্যে আত্মাই উচ্চতর। আত্মা থেকেই সব কাজের উৎপত্তি ঘটে, জড়ের কাজ কেবল আত্মার নির্দেশ পালন করা। ঈশ্বরকে তিনি আত্মসচেতন আত্মা বলেছেন।

তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী কিন্দা গোত্রের সদস্য। যাদের ইসলামের স্বর্ণযুগের প্রাথমিক পথপ্রদর্শক মনে করা হয়। তার জন্ম কুফা নগরীতে। তার বাবা ইসহাক ছিলেন কুফা নগরীর গভর্নর। এখানেই তিনি শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেছেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বাগদাদ যান। তার সঠিক জন্মতারিখ জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় তার জন্ম ৮০১ খ্রিস্টাব্দের দিকে। মারা যান ৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে।

আল ফারাবি (৮৭২-৯৫১ খ্রি.)

বিখ্যাত ৫ মুসলিম দার্শনিক

ইসলামি দর্শনের ইতিহাসে যে কয়জন মহান জ্ঞানসাধক প্রাচ্যের সেরা দার্শনিকরূপে খ্যাতি লাভ করেছেন আল ফারাবি তাদের অন্যতম। শুধু তাই নয় ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র, সংগীতে আল ফারাবির ছিল অসামান্য জ্ঞান। তিনিই প্রথম ইসলামি বিশ্বকোষ ও মুসলিম তর্কশাস্ত্র রচনা করেন।

৮৭২ খ্রিস্টাব্দে এক সম্ভ্রান্ত তুর্কি বংশে আল ফারাবির জন্ম। তার পুরো নাম আবু নসর মুহাম্মাদ ইবনে তুরান ইবনে উসলুগ। শিক্ষার উদ্দেশ্যে বাগদাদে আসার পর সেখানেই তিনি প্রথম দর্শন শাস্ত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

আল ফারাবি বাগদাদে প্রায় ৪০ বছর অবস্থান করেন এবং এই সময়ের মধ্যে বাগদাদে মোট ছয়জন আব্বাসীয় খলিফার আবির্ভাব ঘটে। এভাবে ঘন ঘন খলিফা পরিবর্তনের ফলে বাগদাদে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

এই পরিবেশে স্বাধীনভাবে জ্ঞানসাধনা করা অসম্ভব হয়ে যাওয়ায় বাগদাদ ত্যাগ করে আলেপ্পোতে আমির সায়ফুদ্দৌলার দরবারে চলে যান ফারাবি। তার পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে সেই আমির তাকে রাজদরবারে আশ্রয় দান করেন। সে সময় আলেপ্পোতে বহু দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদের সমাবেশ ঘটেছিল। আল ফারাবি তার জীবনে অনেক ভ্রমণ করেছেন। এসব ভ্রমণ তাকে করেছিল আরও বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মারা যান তিনি।

ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলিমদের কাছে সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটলদের দর্শন অনুবাদের মাধ্যমে যারা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আল ফারাবি ছিলেন অন্যতম। আল মদিনা আল ফাদিলা বা আদর্শ নগর তার সব থেকে বিখ্যাত গ্রন্থ। প্লেটোর রিপাবলিকের মতো তিনিও একটি আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছেন তার আদর্শ নগর বইতে।

প্লেটোর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হলেও তিনি প্লেটোকে অনুকরণ করেননি। বইয়ে তিনি এমন একটা শহরের কথা বলেন যার নেতৃত্বে থাকবেন দার্শনিকরা, যে শহরের পরম লক্ষ্য হবে নাগরিকের খুশি।

মধ্যযুগের দার্শনিকরা খুব বেশি ধর্ম দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। তাদের কাছে দর্শন মানেই হলো ধর্মীয় দর্শন। আল ফারাবি এই ধারণার বিরোধী ছিলেন। তিনি প্রথম ধর্ম ও দর্শনের মাঝে তফাৎ করেন। তিনি রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও কাজ করেছেন। তার রাজনৈতিক দর্শনের মূলে রয়েছে সামষ্টিক সুখ।

তিনি স্রষ্টার সর্বাধিপত্য স্বীকারের পাশাপাশি সৃষ্টিকেও শাশ্বত বলে মনে করতেন। তিনি কোনো চরম মত পোষণ করতেন না এবং চিন্তার ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী মতকে প্রায়শই একসঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করেছেন।

আল ফারাবি দর্শনকে দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

আল ফারাবির কাজ এবং দর্শন মুসলিমদের এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তাকে দর্শনের ‘সেকেন্ড মাস্টার’ বা ‘দ্বিতীয় শিক্ষক’ খেতাব দেওয়া হয়। সে সময় দর্শনের প্রথম শিক্ষক বলা হতো অ্যারিস্টটলকে।

আল গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রি.)

বিখ্যাত ৫ মুসলিম দার্শনিক

পুরো নাম ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি। তিনি ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী একজন চিন্তক। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, একজন পন্ডিত এবং ধর্মতত্ত্ববিদ। ইমাম আল গাজ্জালি ১০৫৮ সালে ইরানের খোরাসানের তুশ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য তিনি অনেক দেশ ভ্রমণও করেছিলেন।

১১১১ সালে খোরাসানের তুশ নগরীতেই তিনি মারা যান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মৃত্যুর দিন ভোরবেলায় তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন এবং তার ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিজ হাতে কাফনের কাপড় পরিধান করেন এবং কেবলার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়েন। এভাবেই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই মহান দার্শনিক।

পরিণত বয়সে বাগদাদে তৎকালীন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনায় যোগ দেন। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি ছিল তার অগাধ আগ্রহ। তাই অল্প সময়ের মধ্যে নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা ছেড়ে সৃষ্টি রহস্যের সন্ধানে তিনি পথে বেরিয়ে পড়েন। প্রায় দশ বছর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে অবশেষে আবার বাগদাদে ফেরেন।

ইমাম আল গাজ্জালি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তার চিন্তাধারাকে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের বিবর্তন বলে ধরা হয়। কারণ সেই সময়ে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই ছিল গ্রিক দর্শন দিয়ে প্রভাবিত। তিনি প্রচলিত দার্শনিক চিন্তাধারার বাইরে এমন কিছু দার্শনিক মতবাদ প্রদান করেন যা সমকালীন আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি সর্বপ্রথম ইসলামের দার্শনিক চিন্তাধারাকে স্বতন্ত্র রূপ দিতে সক্ষম হন। সর্বোপরি গ্রিক দর্শনের প্রভাব থেকে তিনি ইসলামকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন বলে তাকে ‘হুজ্জাতুুল ইসলাম’ বলে অভিহিত করা হয়।

দর্শনকে বরাবরই ধর্মের বাইরের একটি বিষয় হিসেবে দেখা হতো। সর্বপ্রথম ধর্মের অন্তর্নিহিত দর্শন তত্ত্ব বের করে এনে ধর্ম এবং দর্শন, এই দুটির মিলন ঘটিয়ে আলাদা একটি দার্শনিক ধারা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, যা দর্শনের সংজ্ঞাকেই বদলে দিয়েছিল।

ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ (সংস্কারক)ও বলা হয় তাকে। সে সময়কার ইসলামের নামে প্রচলিত যেসব ভয়ংকর মতবাদ ও ভ্রান্ত দর্শন মুসলমানদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সে সবের বিরুদ্ধে কার্যকর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের কারণে তাকে এই উপাধি দেওয়া হয়। তার রচিত বিশেষ দুটি গ্রন্থ হলো ‘মাকাসেদুল ফালাসেফা’, ‘তাহাফাতুল ফালাসেফা’। তিনি বিশ্লেষণমূলকভাবে যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং প্রকৃতি বিদ্যার সারসংক্ষেপ পেশ করেন। এমনকি পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গিরও সমালোচনা লিপিবদ্ধ করেন।

ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮ খ্রি.)

বিখ্যাত ৫ মুসলিম দার্শনিক

অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদে সর্বপ্রথম স্বাধীনভাবে দার্শনিক অনুসন্ধান হিসেবে প্রাচীন ইসলামি দর্শনের উদ্ভব ঘটে। অষ্টম থেকে ১২শ শতাব্দী হলো প্রাথমিক ইসলামি দর্শনের ব্যাপ্তিকাল এ সময়কালকে ইসলামি স্বর্ণযুগ বলা হয়। দার্শনিক আল কিন্দি এর সূচনা করেন এবং ইবনে রুশদের হাতে এই প্রাথমিক সময়কালটির সমাপ্তি ঘটে।

মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও পণ্ডিত হিসেবে ইবনে রুশদের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। রেনেসাঁর যুগে ইউরোপে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। তবে এই দর্শনের জন্যই তার জীবনে একসময় নেমে আসে অভিশাপ।

ইবনে রুশদের পুরো নাম আবু আল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে রুশদ। তবে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত ‘অ্যাভেরোস’ নামে। অ্যাভেরোসের ভিন্ন কোনো অর্থ নেই। তার পুরো নামের সংক্ষিপ্ত অংশ ইবনে রুশদেরই ল্যাটিন উচ্চারণ হয়েছে অ্যাভেরোস।

স্পেনের কর্দোভায় ১১২৬ সালে এক সম্ভ্রান্ত ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইবনে রুশদ। তার দাদা আলমোরাভিদ রাজবংশের শাসনামলে কর্দোভার প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার বাবা আবুল কাসিম আহমাদও আলমোরাভিদ রাজপরিবারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন।

শিক্ষাজীবনের শুরুই করেছিলেন হাদিস শিক্ষা, কুরআন ও ফিকহশাস্ত্র, সাহিত্য এবং আইনশিক্ষা দিয়ে। দর্শনের প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিল মূলত তার গৃহশিক্ষক এবং বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে বাজ্জাহের হাত ধরে। দর্শন ছাড়াও তিনি ইসলামি শরিয়াহ, গণিত, আইন, ওষুুধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।

দর্শনশাস্ত্রে তিনি বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের লেখাগুলো অনুবাদ করে। অ্যারিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে তিনি ইসলামি মতবাদের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। তার দ্য ডিসিসিভ ট্রিটিজ বইয়ে তিনি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শন ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। এই বইতে দর্শন কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে আলোচনা শুরু করেছেন পবিত্র কোরআন থেকে নেওয়া দুটি আয়াত দিয়ে।

তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন আন্তরিক মুসলিম। তাই কোরআনকেই শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ বলে ঘোষণা দেন তিনি। তার মতে, প্রতিপাদক পদ্ধতিতে সত্য যাচাই করতে গেলে শেষতক কোরআনের কাছেই পৌঁছতে হবে। কারণ কোরআনে প্রকৃতির সত্য উদঘাটন করা হয়েছে।

রুশদের মতে, ধর্মগ্রন্থকে তিনভাবে বিশ্লেষণ করে তা থেকে দর্শন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রতিপাদন, ন্যায়শাস্ত্রে যাচাই এবং অলংকারশাস্ত্র। আর এই তিন উপায়ে ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা করে মানবজাতি তিন শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যায়।

ইবনে রুশদ মারাকেশ ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে তিনি খলিফা আবদ আল মুমিনের সংস্পর্শে আসেন। খলিফা তাকে তার দার্শনিক গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় যথেষ্ট সহায়তা করেন। তবে এই খলিফাই তার প্রতি একসময় বিরূপ মনোভাব পোষণ শুরু করেন। ইবনে রুশদ ছিলেন উদারবাদী দার্শনিক। সে সময় ধীরে ধীরে বাড়ছিল উদারবাদী দর্শনবিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের মুখে তিনি নির্বাসনে গিয়েছিলেন লুসিয়ানায়। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তার সব গ্রন্থ।

রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালা থেকে বিজ্ঞানবিষয়ক বই ছাড়া তার বাকি বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। চার বছর পর নির্বাসন থেকে ফেরেন ইবনে রুশদ। তবে শর্ত ছিল তিনি কিছু লিখতে পারবেন না। ১১৯৮ সালে মারাকেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ইবনে রুশদ। কর্দোভায় তাকে দাফন করা হয়।

ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি.)

বিখ্যাত ৫ মুসলিম দার্শনিক

তিনি চৌদ্দ শতকের একজন মুসলিম ইতিহাসবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং সর্বোপরি একজন দার্শনিক। তাকে আধুনিক ইতিহাস রচনা, সমাজবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির অন্যতম একজন জনক বলা হয়। তার পুরো নাম আবু জায়েদ আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ বিন খালদুন আল হাদরামি। সংক্ষেপে তাকে ইবনে খালদুন বলা হয়।

তিউনিসের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৩৩২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন ইসলাম ধর্ম বিষয়ক পণ্ডিত। বাবার কাছেই তিনি শৈশবে শিক্ষালাভ করেছেন। খুব অল্প বয়সে তিনি কুরআন, হাদিস, আইন, বক্তৃতা, ব্যাকরণ, দর্শন, সাহিত্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১৩৪৯ সালে প্রথম রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখেন তিনি। যদিও তখন পর্যন্ত তার রাজনৈতিক জ্ঞান খুব একটা ছিল না। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কাটে তার রাজনৈতিক জীবন। কারাগারে বন্দিও ছিলেন এক সময়। জীবনের শেষ সময় তিনি কাটিয়েছেন মিসরে। ১৪০৬ সালে কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান দার্শনিক। কায়রোর আবু নাসর নামক একটি সুফি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। ইবনে খালদুনের আত্মজীবনী অনুযায়ী তার কাজকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ঐতিহাসিক দর্শন এবং ইসলামিক দর্শন। তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল-মুকাদ্দিমা’, যা তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডটি পরিচিতিপর্ব বা ভূমিকা, দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে সর্বজনীন ইতিহাস আর তৃতীয় খণ্ডটি ‘মাগরিব এর ইতিহাস’। শেষ খণ্ডটি মূলত তার আমৃত্যু ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা। সূচনা অংশে ইবনে খালদুন তার সময়কালীন ঐতিহাসিকদের ইতিহাসগ্রন্থ রচনার সময়ে তাদের ত্রুটিসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এই সূচনা বা পরিচিতিপর্বকে ভাগ করা যায় মোট ছয়টি অংশে। এই ছয়টি অংশের তথ্যগুলো অত্যন্ত চমৎকার যুক্তিতর্কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন খালদুন। মুকাদ্দিমা’র আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য ছিল আস্যাবিয়া-এর ধারণা। শাব্দিকভাবে যার অর্থ হতে পারে ‘গোত্রবাদ’ বা আধুনিক পরিভাষায় আমরা একে জাতীয়তাবাদ বলেও উল্লেখ করতে পারি। সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন কী করে কাজ করে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইবনে খালদুন আস্যাবিয়ার ধারণার উদ্ভব ঘটান। ১৯ শতকের ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এই বইয়ের গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং ইবনে খালদুনকে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করতেন। ইবনে খালদুনকে আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। কেননা তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সামাজিক বিজ্ঞানের একেবারে নতুন একটি ধারা, ‘সাংস্কৃতিক বিজ্ঞান’ এর সূচনা করেন। ইবনে খালদুন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ছিলেন অন্য সবার থেকে আলাদা। সূত্র যথাযথ না হলে তিনি সেটাকে গ্রহণ করতেন না। মধ্যযুগীয় ইতিহাস লেখকদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনই কেবল ইতিহাস লেখাকে নির্ভুল করার জন্য এর উৎসের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তার মতে ইতিহাসও এক ধরনের বিজ্ঞান। পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে ইতিহাসকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। বর্তমানে ইস্তানবুলে ইবনে খালদুন সোসাইটি নামে একটি সংগঠন রয়েছে। তারা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় খালদুনীয় দর্শনের গুরুত্ব নিয়ে কাজ করছে।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment