বাইশতম অধ্যায়ঃ লাশ বহন করা ও যথা শীঘ্র কবর দেওয়া

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

প্রশ্নঃ লাশ বহন করার সময় কী কী পড়তে হয় এবং খাট কিভাবে বহন করতে হয়? কবরে লাশ  দাফন করার সময় কী পড়তে হয় এবং দাফনকাজ সমাধা করে কিভাবে যিয়ারত ও তালক্বীন করতে হয়?

জওয়াবঃ খাটে লাশ বহন করতে হয় চারজনে। প্রথমে দশ কদম গুণে গুণে চলার পর মুর্দারের ডান হাতের ব্যক্তি কাঁধ বদল করে ডান পায়ের পায়া কাঁধে নিবে। ডানপায়ের বহনকারী যাবে বাম পায়ের পায়ায়। বাম পায়ের বহনকারী যাবে মুর্দারের বাম হাতের পায়ায়। এভাবে দ্বিতীয় দশ কদমের পর আবার কাঁধ বদলাবে পূর্ব নিয়মে। তৃতীয় দশ কদমের পর পূর্ব নিয়মে কাঁধ বদলাবে। চতুর্থ দশ  কদমও পূর্ব নিয়মে কাঁধ বদল করলে প্রত্যেকেরই চার  পায়ায় কাঁধ রাখা হবে। এভাবে আস্তে আস্তে গুণে গুণে ৪০ কদম চলার পর সাধারণভাবে ধীরগতিতে পায়ে হেঁটে কবর পর্যন্ত লাশ নিয়ে যাবে- অথবা গাড়িতে তুলে গন্তব্যস্থানে নিয়ে  যাবে। এ সময়- “আল্লাহু রাব্বি-মোহাম্মদ নবী” তথা কালেমা শরীফ পড়তে থাকবে। কবরে স্থাপন করার পরও এভাবে যিকির করতে থাকবে। এভাবে মুর্দাকে শাহাদাতবাণী স্মরণ করিয়ে সাহায্য করবে।

আবু আব্দুল্লাহ্ কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাযকিরাহ্ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- “স্পেন ও কর্ডোভায় এই রীতি ৬৭১ হিজরীর পূর্ব হতেই চালু রয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম  অঞ্চলেও লাশ বহন করার সময় একদল বলে “আল্লাহু রাব্বী” অন্যরা বলে, “মুহাম্মদ নবিয়্যী”। এই প্রথাকে আন্দরকিল্লা  জামে মসজিদের তৎকালীন খতীব আবদুল আহাদ  আল্ মাদানী বিদ্আত ও হারাম বলাতে চট্টগ্রামের সুন্নী ওলামাগণ তাঁর প্রতিবাদ করেন এবং তাযকিরাহ্ গ্রন্থের  হাওয়ালা দিলে ঐ জাহেল খতীব লা-জওয়াব হয়ে যায়। তখন  ছিল সম্ভবত ১৯৬৮-৬৯ সাল। আমিও  ঐ জানাযায় ছিলাম।  (লেখক)

(১) কবর হলো এমন  এক নির্জনস্থান-  যেখানে আপনজনও সাথে  থাকেনা। এর মত ভীতিপূর্ণ স্থান আর হতে পারে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  কবরের একাকীত্ব সম্পর্কে এরশাদ করেন-
روی مسلم عن انس بن مالک رضی اللّٰہ عنہ قال قال رسول اللّٰہ ﷺ  یتبع المیت ثلاث فیرجع اثنان ویبقی واحد  : یتبعہ اھلہ ومالہ وعملہ فیرجع اھلہ ومالہ ویبقی عملہ ۔

অর্থঃ হযরত আনাছ ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন- রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন-“মুর্দারের সাথে তিন জিনিস গমন করে। দুই জিনিস ফিরে আসে-  এক জিনিস সাথে যায়। যে তিন জিনিস গমন করে, তা  হলো- আপনজন, মাল সামানা এবং আমল। আপনজনেরা ও মাল সামানা ফিরে আসে; কিন্তু  আমল তাঁর সাথে কবরে যায়। (মুসলিম শরীফ)।

হাদীসের  সারমর্ম হলো- ঈমান  ও আমল হচ্ছে নিত্যসঙ্গী ও প্রকৃত  বন্ধু। আপনজন ও মালদৌলত হলো সুসময়ের বন্ধু। এরা কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাথে থাকে। দুনিয়ার সুখে-দুঃখে কাজে লাগে সত্য- কিন্তু কবরের বন্ধু হতে কেউ রাযী হয় না। ঈমান ও আমল এমন জিনিস- যাকে ফেলে কবরে যাওয়া যায় না।  আমল ভাল হোক  অথবা মন্দ হোক- সাথে যাবেই।

অন্য এক হাদীসে  উল্লেখ আছে- মুনকার নাকীরের ঈমানী পরীক্ষার (ছওয়াল-জওয়াবের) পর মুমিনের আমল মানুষের সুরতে উত্তম পোশাকে কবরে উপস্থিত হয়ে তাঁর পাশে বসবে এবং বলবে- আমি তোমার নেক আমল। কাফির ও গুনাহ্গারের বদ আমল বদ সুরতে মানুষরূপ ধারণ করে  উপস্থিত হয়ে বলবে- আমি তোমার বদ আমল। ইতিপূর্বে দীর্ঘ হাদীসে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

(২) হযরত ওসমানের (রাঃ) কান্নাঃ
======
হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু  কবর দেখলেই জারজার হয়ে কাঁদতেন-
روی ابن ماجۃ عن ھانیء بن عثمان قال کان عثمان رضی اللّٰہ اذا وقف علی قبر بکی حتی یبل لحیتہ فقیل لہ تذکر الجنۃ والنار ولا تبکی ۔ وتبکی من ھذا ۔ قال ان رسول اللّٰہ ﷺ قال ان القبر اول منازل الاخرۃ  فان نجا منہ احد فما بعدہ ایسر منہ وان لم ینج منہ فما بعد اشد منہ ۔

অর্থঃ হযরত হানী ইবনে ওসমান (রাঃ) বলেন- হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন কোন কবরের পাশে দাঁড়াতেন- তখন  এমন কান্না করতেন যে, চোখের পানিতে তাঁর পবিত্র  দাঁড়ি ভিজে যেতো। লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন- আপনি বেহেস্ত- দোযখ স্মরণ করেও এমনভাবে কাঁদেন না- যেরূপ কাঁদছেন কবর দেখে।  এর কারণ কী? হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বল্লেন- “রাসুলেকরীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- “কবর  হলো পরকালের প্রথম ষ্টেশন। কেউ যদি এখানে নাজাত পেয়ে যায়- তাহলে পরবর্তী মনযিল ও ষ্টেশনগুলো  সহজ হয়ে যাবে। আর কেউ যদি এখানে নাজাত না পায়- তাহলে পরবর্তী স্টেশনগুলো হবে তাঁর জন্য আরও কঠিন”। (আত্ তাযকিরাহ্)

লাশ বহনঃ মৃত ব্যক্তির আহ্বান
======
(৩: ক) হযরত  আবু  ছায়ীদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন-
عن ابی سعید الخدریؓ کان النبی ﷺ یقول اذآ   وضعت الجنازۃ واحتملہ الرجال علی اعناقھم فان کانت صالحۃ قالت قدمونی قدمونی وان کانت غیر صالحۃ قالت : یا ویلھا ۔ این تذھبون بھا ؟ یسمع صوتھا کل شئی الا الانسان ولو سمعہ لصعق ۔ وفی روایۃ انس  انھا تقول یا اھلی ویا ولدی رواہ البخاری۔

অর্থঃ হযরত  আবু ছায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন-  নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলইহে ওয়া সাল্লাম সব সময় এ কথা বলতেন- “যখন লাশ খাঁটে রেখে পুরুষ লোকেরা কাঁধে  তুলে নেয়- তখন মুর্দা নেক্কার হলে বলে- ‘আমাকে তাড়াতাড়ি সামনে নিয়ে চলো, আমাকে সামনে নিয়ে চলো। ” আর যদি বদকার হয়- তাহলে পিছটান  দিয়ে বলে- ‘হায়  তোমরা আমাাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? তার চিৎকার মানুষ ছাড়া অন্য সবাই শুনতে পায়। যদি মানুষ তার চিৎকার শুনতো, তাহলে বেহুঁশ হতো  অথবা মৃত্যু  বরণ করতো”।

অত্র হাদীসে হযরত আনাছ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনায় বদকারের আর একটি কথা বর্ণিত আছে। তা হলো- সে চিৎকার করে বলতে থাকে- হায়! কোথায় আমার পরিবার? কোথায়  আমার ছেলেমেয়েরা”? (বুখারী শরীফ)

ব্যাখ্যাঃ বুঝা গেল- নেক্কার লোকেরা যথাসম্ভব শীঘ্র কবরে যাওয়ার আরযু করবে- আর বদকার লোকেরা কবরের দিকে যেতে চাইবে না। আরো বুঝা গেল- ঐ সময়েও তার সাথে রূহের সংযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হবেনা। দূর হতে শরীরের সাথে  সব সময় রুহের সংযোগ থাকে। সাধারণ লোকের যদি এই বোধশক্তি প্রখর থাকে- তাহলে আল্লাহর ওলীগণের বোধশক্তি যে আরো বেশি প্রখর হবে- এতে কোনই সন্দেহ নেই। আরো বুঝা গেল- বদকার ব্যক্তিরা পূর্বেই টের পেয়ে যায়- কবরে গেলে কী হবে।

(৩: খ) হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন-
عن ابی ھریرۃ عن النبی ﷺ قال : اسرعوا بالجنازۃ فان تک صالحۃ فخیر تقدمونھا الیہ۔ وان تک سوی  ذلک فشر تضعونہ عن رقابکم ۔ رواہ البخاری ومسلم ۔

অর্থঃ হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- “তোমরা যথাশীঘ্র কবরের দিকে লাশ নিয়ে যাও। যদি  লাশ নেক্কার হয়, তাহলে তোমরা উত্তম লাশকেই কবরের দিকে নিয়ে চলেছো। আর যদি অন্য রকম (বদকার) হয়, তাহলে অধম লাশকেই তোমরা কাঁধ হতে নামিয়েছো”। (বুখারী ও মুসলিম)

-এখানে যথাশীঘ্র অর্থ- চলার সময় কবরের দিকে শান্ত ও ধীর গতিতে বিনা বিলম্বে বহন করা; শীঘ্র শীঘ্র মাটি দেয়া নয় এবং দৌঁড়ে খাট বহন করাও নয়।

(৩:  গ) হযরত উওয়াইনা ইবনে আবদুর রহমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন-
حدثنی ابی قال شھدت جنازۃ عبد الرحمن بن سمرۃ وخرج زیاد یمشی بین یدی السریر ۔ فجعل رجال من اھل عبد الرحمٰن وموالیھم یستقبلون السریر ویمشون علی اعقابھم ۔ ویقولون رویدا رویدا ۔ بارک اللّٰہ فیکم ۔ فکانوا یذکرون حتی اذا کنا فی بعض الطریق لحقنا ابو بکرۃؓ یمشی علی بغلۃ فلما رأی الذین یصنعون حمل علیھم ببغلتہ واھوی علیھم بالسوط فقال خلوا فوالذی کرم وجہ ابی  القاسم لقد رأیتنا مع رسول اللّٰہ ﷺ وانا لنکاد نرمل بھا رملا۔ فانبسط القوم  ۔ رواہ النسائی ۔

অর্থঃ হযরত উওয়াইনা ইবনে আব্দুর রাহমান (রাঃ) বলেন- আমার পিতা আব্দুর রহমান (রাঃ) থেকে আমি শুনেছি। তিনি একটি ঘটনা এভাবে আমাকে বলেছেন- “আমি আবদুর রহমান  ইবনে ছামুরা (রাঃ) -এর জানাযায় শরিক হয়েছিলাম। যিয়াদ নামের এক ব্যক্তি উক্ত লাশের সামনে পায়ে হেঁটে  চলছিল। আব্দুর রহমান ইবনে ছামুরা (রাঃ) -এর পরিবারের পুরুষেরা ও তাঁর আশ্রিতরা খাটের অভ্যর্থনা করে বহনকারীদের পিছনে পিছনে  চলছিল। তাঁরা বহনকারীদেরকে বললো- আস্তে আস্তে  চলুন! আল্লাহ্ আপনাদেরকে মোবারক করুন। কিন্তু তাঁরা সবাই দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো।

আমরা লাশ নিয়ে  কোন এক গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় হযরত আবু বাক্রাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খচ্চরে চড়ে আমাদের সাথে এসে মিলিত হলেন। তিনি লোকদের দ্রুত গতিতে চলার অবস্থা দেখে তাঁর খচ্চর নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করে বসলেন এবং হাতের বেত দিয়ে তাঁদেরকে তাড়া করলেন। তিনি আরো  বললেন, আমাকে ছাড়ো। আমি ঐ যাতেপাকের কছম করে বলছি- যিনি আবুল  কাছেম হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর পবিত্র সত্ত্বাকে সম্মানিত করেছেন- আমি দেখছি- আমরা যেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাওয়াফের মত লাশ  নিয়ে রমল করছি (মৃদু দৌড় দিচ্ছি)। তাঁর কথা শুনে সবার মন খুশি হয়ে গেলো”। (নাছায়ী শরীফ)

ব্যাখ্যাঃ অত্র হাদীসে একটি লাশ দ্রুত গতিতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখে হযরত আবু বাক্রাহ্ (রাঃ) -এর গোস্বার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি রাসুলেপাকের সাথে শুধু তাওয়াফকালে মৃদু দৌড়ের কথা  উল্লেখ করায় সবাই খুশি হয়ে গেলেন। বুঝা গেল- লাশ নিয়ে অতিদ্রুত গতিতে চলা ঠিক নয়- বরং  শান্ত ও ধীর গতিতে চলা উচিত। ইহাই হাদীসের মূল বিষয়। হুযুর (ﷺ) -এর হাদীস اسرعوا الجنازة অর্থঃ “বিনা বিলম্বে যথাসম্ভব শীঘ্র কবরে  লাশ নেয়া- দৌঁড়িয়ে যাওয়া নয়।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment