বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুন্নী মহিলা মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুন্নী মহিলা মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা: প্রেক্ষিত কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মহিলা মাদরাসা
আলহাজ্ব মুহাম্মদ সিরাজুল হক

নারী আমাদের মাতৃজাতি। জগতের মহামানব, সাধক-তাপসকুলের জননী, নবী-রাসূল ওলী-আউলিয়াদের গর্ভধারিনী। বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক সকলেই মায়ের কোলে লালিত। ইসলামে মায়ের অধিকার সমান নয়, সমানের চেয়ে বেশি। কারণ, মানব সভ্যতার মূলভিত্তি বহুলাংশে নারীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মায়ের কোলইতো সমাজ সংস্কারক মহাপুরুষদের প্রাথমিক শিক্ষাগার। এ নারীকে একটি নির্মল ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের সুযোগ দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে বিদ্যায়-বুদ্ধিতে ও স্বভাব-চরিত্রে সুগঠিত করে সমাজকে এক একটি যোগ্যতর কন্যা ও যোগ্যতর মা উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদর্শভিত্তিক মহিলা মাদরাসা সমূহের প্রয়োজনীয়তা ও ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পবিত্র কুরআনে মহিলাদের অধিকার ও বিধানাবলী সংক্রামত্ম বেশ কয়েকটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, যেমন-সূরায়ে নিসা, সূরায়ে আহ্যাব, সূরায়ে নূর, সূরায়ে তালাক্ব ইত্যাদি। তন্মধ্যে সূরায়ে নিসা’র নামকরণই করা হয়েছে নারীজাতির নামে। আন-নিসা অর্থ ‘নারীগণ’। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, যে নারীজাতির অধিকার ও বিধি বিধান নিয়ে কুরআনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অবতীর্ণ হল, সে নারীগণ কুরআনের সে অংশের সম্যক জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত থাকবে, তা হতেই পারে না। বরং কুরআনের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি মহিলা সংক্রামত্ম অংশের জ্ঞান তাদেরকে তুলনামূলক বেশী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। যাতে তাদের মধ্যে সচেনতা সৃষ্টি হয় এবং ইসলামে নারীর প্রতি বৈষম্যমুলক আচরণের যে মিথ্যা অপপ্রচার পাশ্চাত্য জগত চালিয়ে আসছে তা স্বয়ং নারীদের কাছেই ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়।
উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে আমরা অতি সহজেইই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, ইসলামী শিক্ষায় সুশিক্ষিত নারী নিজের পরিবার ও সমাজের চিমত্মা চেতনা গঠনে ও সভ্যতা সংস্কৃতির পরিশুদ্ধি ও সংস্কার কাজে সুদূরপ্রসারী,ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রাখতে পারে। এর বাসত্মব প্রতিফলন উম্মুল মুমেনীন অর্থাৎ প্রিয় নবী (দঃ) এর সহধর্মীনীগণের পবিত্র জীবনীতে বিসত্মারিতভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের পবিত্র কুটিরগুলিতে সর্বদাই মহিলা শিক্ষার্থীগণের সমাবেশ বিদ্যমান ছিল। এব্যাপারে আম্মাজান হযরত আয়শা সিদ্দীকা (রাঃ)-র গৃহতো তাঁর ইমেত্মকাল পর্যমত্মই বলতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগারের রুপ লাভ করেছিল। প্রিয় নবী (দঃ) হাতে গড়া এই মহিয়সী রমণী নিজেই নারীজগতের শ্রেষ্ঠতমা ও আদর্শ শিক্ষিকা বা মুআল্লিমা ছিলেন।
তৎকালীন নারীদের ইলম বা ওহীর জ্ঞান লাভের প্রতি অণুরাগ এবং তৎপ্রতি প্রিয় নবীজি (দঃ) -এর মনোযোগ ও মূল্যায়ন সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত সর্বশ্রেষ্ঠ হাদিস গ্রন্থ বুখারী শরীফে চমৎকার বর্ননা রয়েছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করে যে, একদা (মদীনায়) প্রিয় নবীর (দঃ) নিকট এক মহিলা (নারীদের পক্ষ থেকে) এসে আবেদন জানালেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! পুরুষগণ সরাসরি এসে আপনার পবিত্র কথাগুলো আহরণ করে থাকেন, কিন্তু আমরা নারীগণ এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অতএব, আমাদের জন্য আপনি নিজের তরফে(সপ্তাহে বা মাসে) একটি দিন ধার্য্য করে দিন, আমরা আপনার খেদমতে উপস্থিত হব আর আপনি আল্লাহর প্রদত্ত জ্ঞান হতে আমাদেরকে শিক্ষা দান করবেন। প্রিয় নবী (দঃ) মহিলার এ আবেদন স্থায়ীভাবে মঞ্জুর করে বললেন, ‘‘তোমরা (সপ্তাহের বা মাসের) অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক স্থানে সমবেত হও, আমি এসে তোমাদের তা’লীম দেব’’। অতপর এ ধারা চালু হয়ে গেল। (বুখারী, মেশকাত) এটা মহিলা মাদরাসার জন্যই একটি দলিল।
মহিলাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার স্বপক্ষে উপরোক্ত হাদিসখানা নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক। এমনকি মজবুত ভিত্তি বা দলিল। সুতরাং মুসলিম অধ্যুষিত এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সমত্মানরা যেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষা ইসলাম বিরোধী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ইহুদী খূস্টান ও পৌত্তলিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি নামের বর্বরতা ও পশুত্বের জীবন ধারণে নিমজ্জিত হয়ে নাসিত্মক্য চেতনা, বস্ত্তবাদী ধ্যান-ধারণা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ইত্যাদিকে প্রগতির প্রতীকরুপে লালন করে চলেছে, সেখানে মুসলমি সমত্মানদের মধ্যে নির্ভেজাল ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে ইসলামী চিমত্মা চেতনা ও সভ্যতা সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের স্থায়ী ব্যবস্থা কল্পে বর্তমান মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা একামত্মই অপরিহার্য।
উপরিউক্ত সুমহান কর্মের ধারাবাহিকতায় এবং রাসূলে করিম (সা.) এর ৪০তম বংশধর কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরাতুল আল্লামা শাহ সূফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যেব শাহ (রা.) এর একান্ত মনোবাসনা প্রতিফলনের নিমিত্তে ও আমাদের মাশায়েখ হাজরাতের নেক নজর ও করমে বর্তমান হুজুর কিবলায়ে আলম হযরাতুল আল্লামা শাহ সূফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ (মা.জি.আ.)এর নূরানী হস্ত মোবারকে ৯, অক্টোবর ২০১০ সালে ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র মোহাম্মদপুরস্থ টিককা পাড়ায় হাজী চিনু মিয়া (রহ.) এর বোন মরহুমা গুলবাহার বেগমের প্রদত্ত জমিতে কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মহিলা মাদরাসা নামে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে একটি ঐতিহাসিক মাইল ফলক কর্মযাজ্ঞের শুভ সূচনা করেন। যুগের চাহিদা মোতাবেক মাদরাসা পরিচালনা কমিটির অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মাদরাসাটি দিন-দিন উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দাখিল স্তরের জনবল কাঠামো অনুযায়ী সুদক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা দ্বারা আদর্শ জাতি গঠনের মহান প্রত্যয় সামনে রেখে তাদের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগীময় বিশ্বের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত, দক্ষ ও উন্নত চরিত্রের অধিকারীনী রূপে গড়ে তোলার মিশন চালু করতে আল্লাহ ও তার প্রিয় হাবীব (সা.) এর অশেষ মেহেরবানীতে আমরা সফল কাম হবো (ইনশা আল্লাহ)। আমরা অত্যন্ত বুকভরা আশা নিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলতেপারি আওলাদে রসূলের কোন মিশনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়নি এবং হবেও না- ইনশা আল্লাহ। সেই নিরীক্ষে বলবো ‘‘কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মহিলা মাদরাসাও এদেশের শ্রেষ্ঠতম মাদরাসা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। আল্লাহ ও তার প্রিয় হাবিব (সা.) এর মেহেরবানী এবং আমাদের মাশায়েখ হাজারাতের নেগাহে করমে মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের কর্ম প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে মাদরাসার ৭তলা বিশিষ্ট নতুন ক্যাম্পাস নির্মিত হয়েছে। যেখানে কামিল স্তর পর্যন্ত ছাত্রীদের ক্লাশ নেয়া সম্ভব হবে। প্রয়োজনের তাগিদে ছাত্রীদের আবাসিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার বিষয়টিও কর্তৃপক্ষের বিবেচনাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে ছাত্রীদের ইউনিফর্মের আওতায় আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ছাত্রীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করা মাদরাসা কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে।
এজন্য প্রয়োজন অর্থের। তাই সমাজের বৃত্তবানদের নিকট হুজুর কেবলায়ে আলমের এই মিশন জারি রাখার লক্ষ্যে তাদের সার্বিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে একটি আদর্শ জাতি গঠনের এ বিশাল কর্মজ্ঞে শামিল হওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে এই প্রয়োজন পূরণ করার নিমিত্তে ছেলেদের জন্য উল্লেখযোগ্য হারে মাদরাসার ব্যবস্থা থাকলেও মেয়েদের জন্য তা একেবারেই অপ্রতুল। তাই সময়ের বলিষ্ঠ দাবী হচ্ছে শুধু বাংলাদেশে নয় দেশ-বিদেশের প্রতিটি মুসলিম এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে সুন্নি মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতঃ মুসলিম কন্যাদের এ তীব্র অভাব পূরণে সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিৎ। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ মহৎ কাজের তাওফিক ও সৎ সাহস দান করুন। আমীন।
অনুলিখক: মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম
সহ:অধ্যাপক (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment