হিজরি চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস হলো ‘শাবান’। এই মাসটি বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এ মাসেই কিবলা পরিবর্তন হয়; অর্থাৎ পূর্ব কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয়। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনা-সংবলিত অসাধারণ আয়াতটি (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৫৬) এই মাসেই অবতীর্ণ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদত, নফল রোজা পালন ও নফল নামাজ আদায় করতেন।
এই শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত ১৫ তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত বা রজনী আর বরাত মানে মুক্তি। সুতরাং শবে বরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। ‘শবে বরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাত’, তথা মুক্তির রজনী। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ, ইরানসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি ‘শবে বরাত’ নামেই সমধিক পরিচিত।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে—উজ্জ্বল কিতাবের শপথ! নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী, যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন এবং সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল এবং উভয়ের মাঝে যা আছে, সেসবের রব।
যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা করো সেদিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধোঁয়াচ্ছন্ন হবে। (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ২-১০)। মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসের পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)।
প্রখ্যাত মুফাসসিরে কোরআন মুফতি মুহাম্মাদ শফী (রহ.) বলেন, হজরত ইকরিমাহ (রহ.) প্রমুখ কয়েকজন তফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখানের দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত্রিকে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)।
শবে বরাতের ফজিলত
শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস শরিফে আছে, হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫৬৬৫)। ইবনে খুজাইমা হজরত আবু বকর (রা.), হজরত আওফ ইবনে মালেক (রা.) এবং আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৯০, রাজিনন, হাদিস: ২০৪৮; সহিহ ইবনে খুজাইমা, কিতাবুত তাওহিদ, পৃষ্ঠা: ১৩৬)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা এ রাতে বিদ্বেষ পোষণকারী ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারী ছাড়া বাকি সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৬)। হজরত আবু সালাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা মাখলুকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদের ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না। (কিতাবুস সুন্নাহ, শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)। হজরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমার উদ্দেশে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কী আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি
কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছো কি? আমি রিজিক দেব; আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন
মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই
ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) ইরশাদ করলেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।
হাদিস শরিফে বর্ণিত শবে বরাতের বিখ্যাত আরও একটি ঘটনা বিভিন্ন কিতাবে বহু সূত্রে হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: নবীজি (সা.) এ রাতে জান্নাতুল বাকিতে এসে মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। হজরত আয়িশা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া-বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গোনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)।
শবে বরাতের করণীয় আমল সম্পর্কে হাদিস শরিফে আছে, হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কেননা, এ দিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন: কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছো কি? আমি রিজিক দেব; আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৩৮৪)। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব (র.) বলেন, এ দিনের রোজা আইয়ামে বিজ অর্থাৎ চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৫১)।
শবে বরাতে করণীয় আমলসমূহ
(১) নফল রোজা রাখা; (২) নফল নামাজ [ক] আউওয়াবিন [খ] তাহাজ্জুদ [গ] সালাতুত তাসবিহ [ঘ] অন্যান্য নফল ও (ঙ) তাওবার নামাজ ইত্যাদি পড়া; (৩) কোরআন শরিফ [ক] সুরা দুখান ও [খ] অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা; (৪) দরুদ
শরিফ বেশি বেশি পড়া; (৫) ইস্তিগফার বেশি পরিমাণে করা; (৬) দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার ইত্যাদি করা; (৭) কবর জিয়ারত করা; (৮) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা।
শবে বরাতে বর্জনীয় বিষয়সমূহ
(১) আতশবাজি, পটকা ফোটানো, (২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে খামোখা ঘোরাঘুরি করা, (৩) অযাচিত আনন্দ-উল্লাস করা, (৪) বেহুদা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, (৫) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো, (৭) হালুয়া, রুটি বা খানাদানার পেছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদত থেকে বিরত থাকা।