বদনযর

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, বদনযরের বাস্তবতা আছে। আল্লাহ্তায়ালা কারো  কারো মধ্যে এরকম স্বভাব রেখেছেন যে, সে ব্যক্তি কোনোকিছুর প্রতি ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলে সে বস্তুর, ব্যক্তির বা প্রাণীর ক্ষতি সাধিত হয়। নবী করীম  (ﷺ) আরও এরশাদ করেছেন, কোনো বস্তু যদি তকদীরকে হার মানাতে পারতো, তাহলে সেটা হতো বদনযর। উলামা কেরামের অধিকাংশের মত এটাই

যে, বদনযরের বাস্তবতা আছে। বেদাতী লোক যেমন মুতাযিলা এবং যারা তাদের আকীদা বিশ্বাসকে পছন্দ করে তারা অবশ্য বদনযরের বাস্তবতায় সন্দেহ পোষণ করে। রসুলেপাক (ﷺ) যিনি সত্য সংবাদদাতা, তিনি যখন এ ব্যাপারে খবর প্রদান করেছেন,  তখন তার উপর বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব এবং তাকে অস্বীকার করা বাতিল। কেউ যদি এরকম মনে করে, সবকিছুই তকদীরে এলাহী অনুসারে হয়ে থাকে। সুতরাং বদনযর কোনো ধর্তব্য ব্যাপার হতে পারে না। উত্তর এই যে, বদনযরও তকদীরে এলাহী অনুসারেই হয়ে থাকে। দৃষ্টির প্রতিক্রিয়া কোনো মূল সত্তাগত বিষয় নয়। আর যারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের তরীকায় রয়েছে, তারা  বলে থাকে, বদনযর একটি স্বভাবগত আমল। অর্থাৎ আদতে এলাহী এভাবেই জারী হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তির দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালে আল্লাহ তায়ালা তার মধ্যে ক্ষতি ও অমঙ্গল সৃষ্টি করে দেন।

তবে এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, দৃষ্টি নিক্ষেপকারীর  দৃষ্টিপাতের প্রতিক্রিয়া হতেও পারে নাও পারে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষের উপর দৃষ্টিপাতের প্রতিক্রিয়া হবেই-  একথা বলা যায় না। প্রকৃতিবাদীরা বলে থাকেন, দৃষ্টিপাতকারীর চোখ থেকে এক প্রকারের অদৃশ্য সূক্ষ্ম কণিকা উৎক্ষেপিত হয়ে প্রতিপক্ষের দেহে মিশে যায়। আর সে সূক্ষ্ম কণিকাগুলো বাইরের পরিচিত বস্তুর নামে দৃষ্টি নিক্ষেপকারীর চোখে প্রবেশ করে। তখন আল্লাহ তায়ালা নযরকৃত বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে ক্ষতি সৃষ্টি করেন। বিষপান করার পর যেমন শরীরে বিষের প্রতিক্রিয়া হয়। এই যে তথ্যটি একটি সম্ভাব্য  তথ্য মাত্র। আর সম্ভাব্য কোনো তথ্যকে নিঃসন্দেহ এবং অকাট্য জ্ঞান করা ভুল। কোনো কোনো বদনযরকারী থেকে এরকম বক্তব্য পাওয়া গেছে, কোনোকিছু দেখতে খুব ভালো লাগলে অনুভব করি, আমাদের চোখ থেকে এক ধরনের উত্তাপ বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলেন, বদনযরকারীর চোখ থেকে বিষাক্ত শক্তি প্রবল বেগে বেরিয়ে দর্শিত ব্যক্তি, বস্তু বা প্রাণীর মধ্যে মিশে যায়। আর সেই বিষাক্ত শক্তিটিই তার দেহের স্বাভাবিকতায় বৈকল্য সৃষ্টি করে।

সর্পদংশিত  ব্যক্তির দেহে  বিষ যেমন প্রতিক্রিয়া  সৃষ্টি করে, তেমনি এমন সরীসৃপ আছে যারা তীক্ষè দৃষ্টি দ্বারা দেহের বিষ দর্শিত স্থানে পৌঁছে দিতে পারে। মোটকথা কোনো তীক্ষè জিনিস যখন দৃষ্টিকারীর চোখ থেকে বের হয়ে দর্শিত স্থানে যায়, তখন দোয়া কলেমা, তাআউয ইত্যাদি পাঠ করলে আমলগুলো ঢাল হয়ে তাকে রক্ষা করে। আর আমলকারী যদি শক্তিশালী হয় তবে তীরের মতো সেটা ফিরে যায় প্রতিপক্ষের দিকেই।

নবী করীম (ﷺ) এই বদনযরের চিকিৎসা করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর চিকিৎসা ছিলো  সুরা ফাতেহা, কুলআউযু বি রব্বিলফালাক, কুলআউযুবিরব্বিন্নাস এবং আয়াতুল  কুরসী। উলামা কেরাম বলেন, সবচেয়ে ভালো রাকিয়ার আমল হচ্ছে সুরা ফাতেহা, কুলআউযু বিরব্বিল ফালাক, কুলআউযু বিরব্বিন্নাস এবং আয়াতুল কুরসী। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সহীহ্ হাদীছে নবী করীম (ﷺ) থেকে প্রাপ্ত আমলসমূহের মধ্যে অন্যতম

اَﻋُﻮْذُ  ﺑِﻜَﻠِﻤَﺎتِ  اﷲِ اﻟﺘﱠﺎﻣﱠﺎتِ  اﻟﱠﺘِﻲْ ﻟَﺎﯾُﺠَﺎوِزُ ﻣِﻦْ ﺑِﺮﱟ وﱠﻟَﺎ ﻓَﺎﺟِﺮٍ اﷲِ  اﻟْﺤُﺴْﻨﻲ ﻣَﺎ ﻋَﻠِﻤْﺖُ ﻣِﻨْﮭَﺎ وَﻣَﺎﻟَﻢْ اَﻋْﻠَﻢْ  ﻣِﻦْ ﺷَﺮﱢ ﻣَﺎ ﺟَﺮَأَ وَﻣِﻦْ ﺷَﺮﱢ ﻣَﺎ ﯾُﻨَﺰﱢلُ ﻣِﻦَ اﻟﺴﱠﻤَﺎءِ  وَﻣِﻦْ ﺷَﺮﱢ ﻣَﺎ وﱠﺑِﺎَﺳْﻤَﺎءِ ﺧَﻠَﻖَ وَﻣَﺎ

ﯾَﻌْﺮُجُ ﻓِﯿْﮭَﺎ  وَﻣِﻦْ ﺷَﺮﱢ ﻣَﺎ ذَرَأَ ﻓِﻲ اﻟْﺎَرْضِ  وَﻣِﻦْ ﺷَﺮﱢ ﻣَﺎ ﯾَﺨْﺮُجُ

ﻣِﻨْﮭَﺎ  ﻣِﻦْ ﺷَﺮﱢ  ﻓِﺘَﻦِ اﻟﻠﱠﯿْﻞِ  وَاﻟﻨﱠﮭَﺎرِ وَﻣِﻦْ  ﺷَﺮﱢ ﻃَﻮَارِقِ اﻟﻠﱠﯿْﻞِ

وَاﻟﻨﱠﮭَﺎرِ اِﻟﱠﺎ ﻃَﺎرِﻗًﺎ ﯾُﻄْﺮَقُ ﺑِﺨَﯿْﺮٍ ﯾﱠﺎرَﺣْﻤَﺎنُ –

বদনযর দূর করার জন্য এই  দোয়াও পাঠ করতে হয়— মাশা আল্লাহু লা কুওয়াতাইল্লা  বিল্লাহ­ । বদনযরকারী নিজে যদি আতঙ্কিত থাকে যে, তার বদনযরে তাছির  না জানি তার কাছেই ফিরে আসে, তখন এই দোয়া পড়বে আলা­ হুম্মা বারিক আলাইহি। এ সকল আমল করলে ইনশাআল্লাহ্ বদনযর দূর হয়ে যাবে।

এক হাদীছে এসেছে, হজরত আমের ইবনে রবিয়া (رضي الله عنه) হজরত সাহল ইবনে হানীফ (رضي الله عنه) কে গোসল করতে দেখলেন। তাঁকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিলো। হজরত আমের (رضي الله عنه) তাঁর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, আল্লাহ্র কসম! আমি এতো সুন্দর  শরীর পর্দানশীন কোনো নারীরও দেখিনি। কেনো পুরুষেরও দেখিনি। একথা শুনে হজরত সাহল ইবনে হানিফ আনন্দাপু­ত হয়ে যমীনের উপর পড়ে গেলেন। বেহুঁশ হয়ে গেলেন। এ খবর রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে পৌঁছলো।

তিনি (ﷺ) বললেন, তোমরা কি কারও উপর অপবাদ দিচ্ছো? লোকেরা নিবেদন করলো, ইয়া রসুলালা­ হ! আমের তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তার প্রশংসা করেছিলেন। একথা শুনে রসুলেপাক (ﷺ) হজরত আমের (رضي الله عنه)কে ডেকে আনলেন এবং তাঁর উপর সন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করে বললেন, তোমার ভাইয়ের কোনো জিনিস যখন তোমার কাছে সুন্দর মনে হলো, তাকে দেখার পর তুমি যখন তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেলে তখন তুমি আল্লাহুম্মা বারিক আলাইহি এই দোয়া পাঠ করলে না কেনো? তারপর রসুলেপাক (ﷺ) তাঁকে বললেন, সাহল ইবনে হানীফের জন্য তোমার শরীর ধোয়া পানি দাও। তখন তিনি তাঁর চেহারা, দু’হাত কনুই পর্যন্ত, দু’পা রান পর্যন্ত এবং লজ্জাস্থান ধৌত করে এক পেয়ালা পানি দিয়ে দিলেন। তারপর সেই পানি হজরত সাহল (رضي الله عنه) এর মাথা এবং পিঠে ঢেলে দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সুস্থ হয়ে অন্যান্য  লোকের সঙ্গে হেঁটে চলে গেলেন। মনে হলো যেনো তাঁর কোনো অসুবিধাই হয়নি।

হজরত ইবনে কাছীর (رحمة الله) এর বর্ণনার মাধ্যমে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে অঙ্গ  ধৌত করার পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে তৎকালীন সময়ে মানুষের মধ্যে এই দস্তুর ছিলো যে, কারও বদনযর লাগলে, ডানদিক দিয়ে পানি শরীরে প্রবাহিত করার পর কুলি করা হতো। কুলি করা পানি কোনো পাত্রে জমা করা হতো। চেহারা ধৌত করা হতো। তারপর বাম হাত বরতনে দিয়ে পানি নিয়ে  শরীরে ঢেলে দেয়া হতো এবং ডান হাতেও পানি দেয়া হতো। তারপর আবার ডান হাত পানিতে দিয়ে বাম হাতে পানি প্রবাহিত করা হতো। তারপর বাম হাত পানিতে দিয়ে পানি নিয়ে ডান হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করা হতো। তারপর বাম হাত পানিতে দিয়ে পানি নিয়ে ডান হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করা হতো। তারপর বাম হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করা হতো। তারপর বাম হাত দিয়ে পানি নিয়ে ডান পা ধৌত করা হতো। তারপর ডান হাত দিয়ে পানি নিয়ে বাম পা ধৌত করা  হতো। তারপর বাম হাত দিয়ে পানি নিয়ে ডান রানে পানি দেয়া হতো। তারপর ডান হাত দিয়ে বাম রানে পানি প্রবাহিত করা হতো। তারপর লজ্জাস্থান ধৌত করা হতো। ধৌত করার সময় পা যমীনের উপর রাখা হতো না। এভাবে ধৌত করার পর সে পানি বদনযর লাগা লোকের শরীরে বা পিছন দিক দিয়ে ঢেলে দেয়া হতো। এমন করলে আলা­ হ্পাকের ইচ্ছায় বদনযরের তাছীর থেকে রোগী সুস্থ হয়ে যেতো।

হজরত ইবনে কাছীর (رحمة الله) এর বর্ণনায় মানুষের দস্তুরের কথার উল্লেখে মনে হয়, রসুলেপাক  (ﷺ) এর সামনেও এমন করা হতো। আলা­ হ্ই ভালো জানেন। এ ধরনের আমলের মধ্যে ভেদ কী তা বোঝা মুশকিল।

কাযী  আবু বকর  ইবনুল আরাবী  বলেন, কোনো শরীয়তপন্থী  লোক যদি উল্লিখিত আমলের ব্যাপারে  মৌনতার নীতি অবলম্বন করেন, তবে তাকে  বলে দিতে হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে আলা­ হ্ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। নবী করীম (ﷺ) থেকে এ ধরনের আমল পাওয়া গেছে। তদুপরি অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্বাস করা হয়েছে। আর এই ব্যাপারে যদি কোনো দার্শনিক মৌনতা অবলম্বন করে, তবে তা রদ  করা তো খুবই সহজ। কেনোনা তাদের নিকট এটা সুসাব্যস্ত যে, কোনো কোনো ঔষধ তো তার আপন শক্তির বলে রোগের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং আপন বৈশিষ্ট্য দ্বারা কাজ করে। সুতরাং এটাও সেই ধরনের একটি ঔষধ। কাহরুবা  (এক প্রকার গাছের কস) এবং চুম্বকের মধ্যে যেরকম আকর্ষণ শক্তি আছে- এ পানির মধ্যেও এ ধরনের কিছু রয়েছে। সুতরাং এটা অসম্ভব ও অবাস্তব কিছু নয়। লজ্জাস্থান ধৌত করার ব্যাপারে কয়েকটি মত পেশ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, লজ্জাস্থান বলতে লুঙ্গির অভ্যন্তরের লজ্জাস্থানকেই বুঝানো হয়েছে। কাযী  আয়ায (رحمة الله) বলেন, লজ্জাস্থান বলতে এখানে লুঙ্গির সাথে মিলিত শরীরের অংশকে বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, লজ্জাস্থান বলতে নাভীকে বুঝানো হয়েছে।

সলফে  সালেহীনের  এক জামাত কোরআনে  করীমের মাধ্যমে বদনযরগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসা করাকে জায়েয মনে কেেছন। তাঁরা বলেছেন, কোরআনে করীম লিখে  তা ধৌত করে রোগীকে পান করিয়ে দেয়াতে কোনো দোষ নেই। তা কোরআনের যে কোনো অংশই হোক, বা শেফা সম্পর্কিত কোনো আয়াত হোক অথবা আল্লাহ তায়ালার নাম ও সিফাতের লেখা হোক।

হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, জনৈকা মহিলা প্রসব বেদনায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। তিনি কোরআন শরীফের একখানা বা দু’খানা আয়াতের কথা বলে দিলেন যে, তা লিখে ধৌত করে সে পানি মহিলাকে পান করিয়ে দাও।

➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment