ফাঁসি

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

হঠাৎ টিভিতে ব্রেকিং নিউজ,কলেজ ছাত্রী হত্যা মামলায় সাত আসামির মৃত্যদণ্ড দিলো আদালত,এদের মধ্যে একজন আমাদের ছেলে আয়মান,গত একবছর ধরে নিখোঁজ ছিলো,অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আয়মানের হদিস মেলেনি।
আমি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শেখ সাইফ আহমেদ,ভালোবেসে বিয়ে করেছি টের্টাক্সো কোম্পানির সিইও সানজিদা আফরোজকে,বিয়ের পর থেকে অন্যসব কাপলদের মত লাইফটা ছিলো না আমাদের, সানজিদা সবসময় অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতো,আমিও অফিসের কাজের চাপে একদম সময় দিতে পারতাম না,বিয়ের পর অফিস থেকে ছুটি নিলাম হানিমুনে যাবো বলে কিন্তু সানজিদার জন্য যাওয়া হয়নি,সানজিদা কোম্পানির কাজে কখনো ঢাকার বাহিরে আবার কখনোবা দেশের বাইরে থাকতো,একটি কোম্পানির সিইও হওয়া চারটে খানি কথা না।
আমরা একজন অন্যজনকে বুঝতাম,অন্তর দিয়ে Fill করতাম,তাইতো আমাদের মধ্যে শক্তিশালী ভালোবাসার বন্ধন ছিল।
বিয়ের পর সব পুরুষই চায়,সংসারে বাচ্চাকাচ্চা থাকবে,বন্ধন আরো মজবুত হবে,বাচ্চাকাচ্চারা সংসারটা মাতিয়ে রাখবে।আমিও চাইতাম,কিন্তু সানজিদা চায়নি,সানজিদার মতবাদ হলো বিয়ের পর পরই বাচ্চাকাচ্চা নেওয়া একদম ঝামেলার কাজ আগে জীবনটা উপভোগ করি চার পাঁচ বছর পর দেখা যাবে।
আমিও সানজিদা কথাই চলতাম,ঐযে,, বউ আমার একটি কোম্পানির সিইও।
আমার বন্ধু-বান্ধবরা যখন আমার পরে বিয়ে করে বাচ্চা কোলে নিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড দিতো,খুব কষ্ট লাগতো, মহুর্তটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না চোখ থেকে টপটপ পানি ঝরতো।
এদিকে সানজিদাকে বিয়ের ৩ বছর পর রাজি করালাম,সানজিদার কোল আলো করে ফুটফুটে আয়মানের জন্ম।ঐদিনের আনন্দ বলে বোঝানো অসম্ভব।ছেলের কানে আজান দিলাম,দোয়া কালাম যা জানতাম তা পড়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিলাম।ওর মায়ের মত গায়ের রঙ দফদফে সাদা সুন্দর।
আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো আয়মান,আমরা স্বামী স্ত্রী দু’জনই বাড়ির কাজের বুয়ার উপর নির্ভরশীল ছিলাম,বুয়ার কাছে থাকতো সারাদিন,সানজিদা অফিস,মিটিং,এসব নিয়েই থাকতো, রাতে আসতো,ঐসময় আয়মান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতো।বুয়ার কাছে থাকতে থাকতে বুয়াকেই মা মা বলে ডাকতো,আর আমজাদ চাচাকে আব্বু আম্মু ডাকতো,
এ নিয়ে সানজিদার সাথে ঝামেলা হয়,বাড়ির কাজের বুয়া মজিনা এবং কাজের লোক আমজাদ চাচাকে বিদায় করে নতুন কাজের বুয়া আনা হয়।আর অফিস থেকে তারাতারি বাসায় ফি’রে ছেলেকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করি।
আমি যখন অফিসে যেতাম,ছেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়াত,অফিসে যেতে দিবে না,ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে জোর করে বুয়ার কাছে রেখে অফিসে যেতাম,সানজিদার বেলায় ও একই অবস্থা আয়মান কতবার ওর মায়ের কাপড়ের আঁচল ধরে কান্নাকাটি করেছে তার কোন হিসেব নেই।আমরা একপ্রকার জোর করে বাড়ির কাজের বুয়ার কাছে রেখে যেতাম।
আয়মান বারান্দায় এসে সারাক্ষণ দাড়িয়ে থাকতো কখন ওর মা আসবে,কখন আমি আসবো,ছেলেটা মনমরা হয়ে থাকতো।আমারও একই অবস্থা অফিসের কাজে মন বসতো না সারাক্ষণ ছেলেকে নিয়ে ভাবতাম,
অফিস থেকে বিকেলে যখন আসতাম আয়মান দোড়ে এসে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়তো,মনে হতো কোন এক হারানো রাজ্য ফিরে পেয়েছে।
সন্তানের জন্য বাবা মায়ের আদর স্নেহ ভালবাসা সবচেয়ে জরুরি।অনেক হতভাগা সন্তানই বাবা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত।আমাদের আয়মান ও অবহেলা অনাদরে বড় হয়েছে।
আমার এখনও মনে আছে আয়মানের যখন ৫ বছর তখন স্কুলে ভর্তি করছি ঠিকই তারপর থেকে ওর লেখাপড়ার আর খোঁজখবর নেওয়া হয়নি,সব দায় দায়িত্ব প্রাইভেট টিউটরের,সকালে একজন আসতো,তারপর ড্রাইভার স্কুলে নিয়ে যেত,এরপর দুপুর বেলা ড্রাইভার আবার স্কুল থেকে নিয়ে আসতো,ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলে টিউটরের কাছে পড়তে বসতো,আরেক জন সন্ধ্যায় আসে রাত ৯ টা পর্যন্ত পড়াতো।
অর্থাৎ পড়ালেখার সব দায় দায়িত্ব প্রাইভেট টিউটরের,আমি আর সানজিদা অফিসের কাজে মহা ব্যস্ত।
আয়মান সব ক্লাসেই ফাস্টবয় ছিলো,ওওওও যখন কলেজে পা রাখে তখন থেকে বাজে ছেলেপেলেদের সাথে মিশতে শুরু করে,কয়েকটি কিশোর গ্যাঙ এর সাথে যুক্ত হয়,এসবের কিছুই আমি জানতাম না আর ওর মা তো আমার চেয়েও মহাব্যস্ত,ফিরে রাতে, যে সময় ছেলে ঘুমাতে যায়।
আয়মান শুরুতে সিগারেট খেত কিশোর গ্যাঙ এর ছেলেদের সাথে, আস্তে আস্তে মদ গাঁজা ইয়াবা ফেনসিডিল সবই সেবন করতো,এক কথায় পুরোদস্তুর মাদকের করাল গ্রাসে নিমর্জিত হয়ে গেছে।
একসময় মাদক বাইরে খেলেও এখন সব বন্ধুদের নিয়ে নিজের রুমে খেত,বাড়িটাকে মাদকের আস্তানা বানিয়ে ফেলে,আয়মানকে যা টাকা দিতাম তা দিয়ে আর হয়না,চুরি ডাকাতি সন্ত্রাসী সবই করতো আয়মান ঐ কিশোর গ্যাঙের সবাইকে নিয়ে।
আয়মান কলেজেও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে,কিশোর গ্যাঙের সহায়তায় গড়ে তোলে মাদক অস্ত্রের সমরাজ্য,কলেজে মেয়েদের বিরক্ত করতো,স্যারদের বেয়াদবী নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
এসবের কিছুই ওর মা সানজিদা জানেনা আমি জানিনা আমরা তো অফিসের কাজে মহাব্যস্ত।ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দিনরাত অফিস মিটিং এসব করে কাটিয়ে দিচ্ছি আমরা।কয়জন বাপ পেরেছে সন্তানের জন্য ঢাকা শহরে ২০ তলা বাড়ি BMW গাড়ি কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যেতে।
আয়মানের বন্ধু তাসফিক কলেজের কোন এক মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে না করে এবং মেয়ের মামা ডেপুটি কমিশনার সাহেব কিশোর গ্যাঙের সব সদস্যের নামে থানায় মামলা করে,গ্যাঙের সবাই রাগে ক্ষোভে চুরি চাকু দিয়ে মেয়েটির উপর হামলা করে,হামলার একপর্যায়ে মেয়েটি মারা যায়।
দীর্ঘদিন আয়মান পালিয়ে থাকার পর গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আটক হয়।
এসবের কিছুই আমি জানতাম না অফিস শেষে রাতে যখন বাসায় এসে আয়মানের রুমে গিয়ে অনেকদিন না পেয়ে চারদিকে খোঁজখবর নিলাম কেউ কিছু বলতে পারে না।
গত ১০ তারিখ দুপুর ২টায় টিভিতে ব্রেকিং নিউজে দেখলাম,কলেজ ছাত্রী হত্যা মামলায় কিশোর গ্যাঙের সাত আসামিকে ফাঁসির রায় দিলো আদালত,এদের মধ্যে আমাদের আয়মানকেও দেখতে পেয়ে হঠাৎ মাথার উপর আকাশটা ভেঙে পড়লো।
অনেক আইনজীবী ধরেছি যাতে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়,অন্তত ছেলেটা প্রাণে বেচে থাকুক,কোন কাজ হয়নি।
গতকাল রাত ১০টায় কারাগারে আয়মানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হয়।থানা থেকে ছেলের লাশটা এনে আজ দাফন করলাম।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment