প্রিয় নবী রাসূলে আকরাম সৈয়দুল মুরসালীন (দ.) এর বেলাদতের সময় পৃথিবীতে এমন কিছু অলঘটনা ঘটেছিল, যা সবাইকে অবাক করে ও শ্রেষ্ঠ নবীর আগমনকে মানুষের সামনে স্পষ্ট করে। এমনি কিছু ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
১. হজরত ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর সম্মানিতা মা রাসুল (সা.)-এর শুভজন্মক্ষণে এক নূর দেখেন, যার দ্বারা সিরিয়া এলাকার প্রাসাদসমূহ উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।’ (মাজমাউ যাওয়ায়েদ : ৮/২২২)
বিশ্বনবীর জন্মক্ষণে একদিকে পৃথিবীতে নবুওয়াতের সূর্যোদয়, অপরদিকে পারস্য সম্রাট কিসরার রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এই ভূমিকম্পের দরুন রাজপ্রাসাদের চৌদ্দটি গম্বুজ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। পারস্যের এক অগ্নিকুণ্ড যা এক হাজার বছরব্যাপী বিরতিহীনভাবে জ্বলছিল তা সেই শুভ মুহূর্তে হঠাৎ নিভে যায়। সাওয়াহ নামক এক নদীতে যথারীতি পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, বিশ্বনবীর আগমন মুহূর্তে হঠাৎ তার অথৈ জলরাশি শুকিয়ে যায়।’ (মাওলানা ইদরিস কান্দলভী, সিরাতে মুস্তফা : ১/৬৯)।
প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অগ্নিপূজাসহ সব ভ্রান্তি অবসানের ইঙ্গিত।
১. হজরত উসমান ইবনে আবুল আস (রা.)-এর মা হজরত ফাতিমা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর জন্মগ্রহণ মুহূর্তে আমি মা আমিনার কাছে ছিলাম। আমি দেখলাম, বিবি আমিনার ঘরটি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল এবং আকাশের সব তারকারাজি নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আমার মনে হতে লাগল, তারকাসমূহ যেন আমার ওপর এসে পড়বে।’ (ফাতহুল বারী : ৬/৭২৬)
লক্ষণীয় বিষয় হলো, তারকারাজির নিম্নমুখী হয়ে ঝুঁকে পড়ার দ্বারা এই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, অচিরেই পৃথিবী থেকে কুফর ও শিরকের অমানিশা দূরীভূত হবে এবং হেদায়েতের উজ্জ্বল আলোকে এ নিখিলধরা আলোকিত হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন,
قَدۡ جَآءَکُمۡ مِّنَ اللّٰہِ نُوۡرٌ وَّ کِتٰبٌ مُّبِیۡنٌ – یَّہۡدِیۡ بِہِ اللّٰہُ مَنِ اتَّبَعَ رِضۡوَانَہٗ سُبُلَ السَّلٰمِ وَ یُخۡرِجُہُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ بِاِذۡنِہٖ وَ یَہۡدِیۡہِمۡ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ –
‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে (হেদায়াত) আলো এবং সুস্পষ্ট কিতাব। যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এই হেদায়াতের আলোকবর্তিকা ও কিতাবের সাহায্যে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং তাঁরই অনুমতিক্রমে কুফর-শিরকের অন্ধকার হতে তাদেরকে হেদায়াতের পথে নিয়ে আসেন।’ (সুরা মায়েদা : ১৫-১৬)
৩. সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে, জন্মের সময় বিশ্বনবীর মা’র উদর থেকে এমন একটি নুরের বিচ্ছুরণ ঘটেছিল যার আলোকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত সবকিছু আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, বিশ্বনবী (সা.) যখন ভূমিতে আবির্ভূত হলেন তখন উভয় হাতের ওপর ভর দিয়ে ছিলেন। অতঃপর এক মুষ্টি মাটি নিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।’ (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া)
৪. হজরত ইবনে সুফিয়ান বর্ণনা করেছেন, আয়শা (রা.) বলেন, ‘বিশ্বনবীর (সা.) জন্মগ্রহণের সময় এক ইহুদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরীতে বসবাস করত। যে রাতে বিশ্বনবী পৃথিবীতে আগমন করেন, সে রাত-পরবর্তী সকালে সে কুরাইশদের কাছে জিজ্ঞেস করল, গত রাতে এ এলাকাতে কোনো শিশুর জন্ম হয়েছে কি? উপস্থিত কুরাইশের লোকেরা বলল, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। লোকটি বলল, তোমরা এ বিষয়টির অনুসন্ধান করো। কেননা এই রাতে বর্তমান উম্মতের নবী ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। তাঁর কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বিশেষ নিদর্শন (অর্থাৎ মোহরে নবুওয়াত) রয়েছে। জন্মের পরপর শিশুটির মুখে জিন আঙুল পুরে রাখার দরুন শিশুটি দুদিন যাবৎ কারও দুধ পান করবে না। কুরাইশের লোকেরা সন্ধান নিয়ে জানতে পারল, আব্দুল মুত্তালিবের প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহর এক পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে।
ইহুদিকে এ সংবাদ জানানো হলে সেও শিশুটিকে দেখার আগ্রহ ব্যক্ত করে বলল, চলো! আমিও শিশুটিকে দেখব। ইহুদি লোকটি যখন শিশুটিকে দেখল এবং তাঁর দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুওয়াতের নিদর্শনও দেখতে পেল, তখন সে চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে গেল। হুঁশ ফিরে আসার পর লোকটি বলল, নবুওয়াতে বনি ইসরাইল আজ থেকে শেষ হয়ে গেল। হে কুরাইশ সম্প্রদায়! ভবিষ্যতে এই শিশু তোমাদের প্রতি এমন এক আক্রমণ পরিচালনা করবে যার সংবাদ পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। (ফাতহুল বারী : ৬ /৪২৫)
ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী, ঢাকা।
২৩. ০৯. ২০২৩