অনেক দিন ধরেই মিলাদুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরোধীরা এটাকে বিতর্কিত করার জন্য প্রচার করে আসছে, “জন্ম তারিখ নিয়ে মতনৈক্য আছে”।১২ তারিখের ব্যপারে সম্পূর্ণ সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত আছে। যিনি বর্ণনা করেছেন তিনি হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আপন চাচা হযরত ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
হাফিজে হাদীস হযরত আবু বকর ইবনে আবী শায়বা রহমাতুল্লাহি আলাইহি (ওফাত ২৩৫ হিজরি) যেটা বিশুদ্ধ সনদে হাদীস শরীফে বর্ননা করেন-
ورواه ابن أبى شيبة في مصنفه عن عفان ، عن سعيد بن ميناء ، عن جابر وابن عباس أنهما قالا : ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم عام الفيل يوم الاثنين الثانى عشر من شهر ربيع الاول
অর্থ : হযরত আফফান রহমাতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্নিত,তিনি হযরত সাঈদ ইবনে মীনা রহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ননা করেছেন যে, হযরত জাবির ও হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিলাদত শরীফ হস্তি বাহীনি বর্ষের ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবার শরীফ হয়েছিল।
[সূত্রঃ মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা; বুলূগুল আমানী ফী শরহিল ফাততিহর রব্বানী’ ২য় খণ্ড, ১৮৯ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’ ২য় খণ্ড, ২৬০ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত]
উক্ত হাদীস শরীফ উনার রাবী হচ্ছেন–
★ হযরত আফফান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
★ সাঈদ ইবনে মীনা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
★ হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু
★ হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
উক্ত বর্ণনার ‘সনদ’- এর মধ্যে শেষের দু’জন হলেন বিশিষ্ট সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। খোদ বুখার-মুসলিম এ তাঁদের থেকে হাদীস বর্ণিত আছে। প্রথম দু’জন বর্ণনাকারী সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলেছেন,
1. “আফফান একজন উচ্চ পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য ইমাম, প্রবল স্মরণশক্তি ও দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব”
[সূত্রঃ খোলাসাতুত তাহযীব ২৬৮ পৃঃ বৈরুতে মুদ্রিত]
2. “দ্বিতীয় বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনে মীনা । তিনিও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ।”
[সূত্রঃ খোলাসাহ ১৪৩ পৃঃ এবং তাক্বরীব ১২৬ পৃঃ]
এ দুজন উচ্চ পর্যায়ের ফক্বীহ সাহাবীর বিশুদ্ধ সনদসহকারে বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হলো, ১২ই রবিউল আউয়াল হচ্ছে হুযূর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র মিলাদ দিবস। সুতরাং পরবর্তী যুগগোলোর কোন ইতিহাস লেখকের ভিন্নকথা, ধারণা বা অনুমান অথবা কোনো জ্যোতির্বিদ (যেমন- মাহমুদ পাশা) উক্ত বিশুদ্ধ বর্ণনার মোকাবেলায় দৃষ্টিপাতযোগ্য ও গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। কেননা উপরের সনদটি সব থেকে ছোট এবং সম্পূর্ণ সহীহ। ১২ তারিখ ব্যতীত অন্য যে সব তারিখের কথা শোনা যায় সেগুলোর একটাও সহীহ সনদে বর্ণিত নয়।
আমাদের জানতে ইচ্ছা করে যারা সারাদিন “সহীহ হাদীস” বলে চিল্লাচিল্লি করে তারা কেন এবং কাদের স্বার্থে এই সম্পূর্ণ সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসটি সাধারণ মুসলমানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে?? আছে কোনো জবাব এর??
অতএব, হযরত যোবায়ের ইবনে বাক্কার, ইমাম ইবনুল আসাকির, ইমাম জামাল উদ্দিন ইবনে জূযী এবং ইবনুল জাযযার প্রমুখ ১২ই রবিউল আউয়াল ‘বিশ্বনবীর মিলাদ দিবস’ হওয়াই নির্ভরযোগ্য ও সেটার উপর গবেষক ইমামদের ‘ইজমা’ (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হবার কথা ঘোষনা করেছেন।
[সূত্রঃ মায়াহেবুল লাদুননিয়া; সীরাত ই হালবিয়াহ ১ম খণ্ডঃ ৯৩ পৃঃ; যারক্বানী আলাল মাওয়াহিব ১ম খণ্ডঃ ১৩২ পৃঃ; মা-সাবাতা মিনাস সুন্নাহ কৃত শায়খ আল-মুহাক্বক্বিক্ব দেহলভী ৯৮ পৃঃ; শামামাহ-ই আম্বিয়াহ কৃত নাওয়াব সিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী আহলে হাদীস ০৭ পৃঃ]
আরও যে সমস্ত কিতাবে ১২ই রবিউল আউয়াল পাওয়া যায় সেগুলো হল,
** হযরত জাবের এবং হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বণির্ত হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের জন্ম হস্তি ঘটনার বছর ১২ ই রবিউল আওয়াল তারিখে সোমবারের দিন হয়েছিল ।
[সিরাতুন নবুবিয়াহ ইবনে কাসির ১ম খন্ড ১৯৯ পৃঃ,আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া ২য় খন্ড ২৬০ পৃঃ]
** ইমাম ইবনে জারীর তাবরাণীর মন্তব্যঃ-
ইবনে জারীর তাবরানী লিখেছেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের জন্ম রবিউল আওয়ালের ১২ তারিখে হস্তির বছর হয়েছিল ।
[তারিখে তাবারী ২য় খন্ড ১২৫ পৃঃ]
** মোহাম্মদ বিন ইসাহক্ব (85-151H) ও ইমাম ইবনে হেশামের (213H) ও মোহাম্মদ ইবনে জওযীর মন্তব্যঃ-
** মোহাদ্দীস ইবনে জওযী লিখেছেন যা ইমাম ইবনে ইসাহক্ব বণর্না করেছেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের জন্ম ১২ই রবিউল আওয়াল সোমবারের দিন হস্তী বছর হয়েছিল।
[আল ওফা ১ম খন্ড ৯০ পৃঃ,সাবলুল হুদা অয়ার রসাদ ১ম খন্ড ৩৩৪ পৃঃ ,আসসিরাতুন নবুবিয়াহ ১ম খন্ড ১৮১ পৃঃ]
** ইমাম বায়হাক্বীঃ-
প্রশিদ্ধ মোহাদ্দেস ইমাম বায়হাক্বী লিখেছেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম সোমবারের দিনে ১২ ই রবিউল আওয়ালে জন্মগ্রহন করেছিলেন ।
[দালায়েলুল নবুওত ১ম খন্ড ৭৪ পৃঃ]
** ইবনে কাসীরঃ-
শারহে মোওয়াহিবের মধ্যে ইবনে কাসীর হতে বণির্ত হয়েছে যে, অধিকাংশ ওলামার নিকট ১২ই রবিউল আওয়াল তারিখ ই প্রশিদ্ধ ।
[আন নেমাতুল কুবরা ২০২ পৃঃ, সিরাতুন নবুবীয়া ৪ থ খন্ড ৩৩ পৃঃ উ উন আল আসার ১ম খন্ড ২৬ পৃঃ সিরাতুল হালাবীয়া ১ম খন্ড ৫৭ পৃঃ]
শুধুমাত্র ওহাবী ও দেওবন্দীরা এর বিরোধীতা করে। তাদের এক জন করে আলেমের মন্তব্য দেখি
** ওহাবীদের
ভারতীয় উপমহাদেশের আহলে হাদীস ফিরকার জনক নবাব সিদ্দিক হাসান খান বোহাপালভি ১২ই রবিউল আউয়াল বলে উল্লেখ করেন। [আশ শুমামা তুল আম্বিয়া ফি মাওলিদ খায়ির আল বারিয়া পৃঃ ০৭]
** দেওবন্দীদের
তাদের অতীব স্বনামধন্য আলেম তাফসির মা’রিফুল কুর’আনের রচয়িতা এবং “ফতওয়ায়ে দেওবন্দ” এর অন্যতম লেখক মুফতি শফী উসমানী (রঃ) ১২ই রবিউল আউয়াল বলে মন্তব্য করেছেন। [সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া পৃঃ ১৩, নাদিয়াতুল কুর’আন প্রকাশনী, চকবাজার, ঢাকা]
তিনি উক্ত কিতাবে আরও বলেন,
“১২ই রবিউল আউয়াল প্রসিদ্ধ অভিমত। হাফিজ ইবন হাজর আসকলানী (রঃ) এর উপর ইজহার দাবী করেছেন। মাহমুদ পাশা মিশরী যাহা গণনার মাধ্যমে ৯ তারিখ গ্রহণ করেছেন। তাহার অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য অভিমতের বিরুদ্ধে সনদ বিহীন উক্তি। চন্দ্রোদয়ের স্থান বিভিন্ন হওয়ার কারণে গণনার উপর এমন কোন নির্ভরযোগ্যতার জন্ম হয় না যে, এর উপর ভিত্তি করে জামহুরের বিরুদ্ধাচারণ করা যাবে”। [প্রাগুক্ত ১৪ পৃ এর টিকা নং ১]
সুতরাং উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মাণ হল, ১২ই রবিউল আউয়াল হল সর্বগ্রহণযোগ্য মত, এর উপর সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত রয়েছে এবং এটার উপর ইযমাও হয়েছে। এছাড়া বাকি যে সব তারিখ আছে তার একটাও সহীহ সনদে বর্ণিত নয়। এরপরও যারা বিলাদত শরীফ উনার তারিখ নিয়ে মতবিরোধ আছে বলবে তাদের বক্তব্য গ্রহনযোগ্য নয় প্রমাণ হলো।