প্রশ্ন: বিদআত সম্পর্কীয় আপত্তির জবাব।
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد.
“যে আমার দ্বীনে এমন জিনিস আবিস্কার করল যা আমার দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত ৷
উক্ত হাদিসে “আমার দ্বীনে” কথাটি দ্বারা প্রমানিত হল বিদআত হল সেটিই যেটি দ্বীনের মধ্যে সৃষ্টি হয়। আর দ্বীনের মধ্যে বিদআত বলতে বুঝায় সেগুলোই যেগুলো সওয়াবের আশায় করা হয়, তথা ইবাদতের নিয়তে করা হয়। সুতরাং দুনিয়াবী আবিস্কৃত জিনিস বিদআত নয়, কেননা তা সওয়াবের আশায় বা ইবাদতের নিয়তে করা হয় না ৷ অতএব, গাড়ী, মোবাইল, ইন্টারনেট, খেলাধুলা, প্রতিযোগিতা, টিভি চ্যানেল, নতুন খাদ্য – পানিয়, শরীর চর্চা, নতুন পোষাক এ গুলো যেহেতু ধর্মের অন্তর্ভূক্ত নয় বরং দুনিয়াবী কাজ, তাই এগুলো বিদআত নয় ৷ বিদআত সেগুলোই যা ধর্মের মধ্যে আবিস্কৃত হয়।
জবাবঃ
_______প্রথমতঃ অভিযোগকারীদের আপত্তি তথা “আমার দ্বীন” শব্দটি দ্বারা দুনিয়াবী বিদআত ও ধর্মীয় বিদ্আত বিভক্ত করার শর্তারোপ করাটা সম্পূর্ণই তাদের মনগড়া বক্তব্য যার কোন ভিত্তি নেই এবং তা হাদিস, সাহাবা, তাবেয়ীন, মুজতাহেদীন, ওলামা মাশায়েখগণের ব্যাখ্যা ও আমল সমূহের বিপরীত। কেননা তারা যে সব আমল বা আবিস্কার সওয়াবের নিয়ত বা ইবাদতের উদ্দেশ্যে করা হয় না বলে যুক্তি দিয়ে দুনিয়াবী আবিস্কার নামকরণ করেছেন এবং সেগুলোকে দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয় বলে শরীয়ত থেকে পৃথক করার চেষ্টা করেছেন তা অযৌক্তিক ও মিথ্যা। কেননা ইসলাম হল Complete code of life বা মানব জীবনের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। একজন মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় যত রকম কর্মকাণ্ড থাকুক সব কিছুকেই শরীয়ত অন্তর্ভূক্ত করে তার পূর্ণাঙ্গ সমাধান দিয়েছে। এমন কি নবীজি রাসুলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) নিজেই আমাদেরকে আচার – ব্যবহার, ব্যবসা – বানিজ্য, বেচাকেনা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি, খাদ্য – পানিয়, বিবাহ – সংসার, শরীরের যত্ন নেয়া ইত্যাদি সবই শিক্ষা দিয়ে গেছেন ৷ সুতারাং দুনিয়াবী কাজও শরীয়ত তথা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত, এটাকে দ্বীনের বাইরে বলা অযৌক্তিক ৷
এবার আসুন দেখে নিই, তারা দুনিয়াবী কাজ বলে যে বিষয়কে দ্বীন হতে পৃথক করতে চাচ্ছেন, তা শরীয়ত বা দ্বীনের কোন স্তরের অন্তর্ভূক্ত ৷
মূলতঃ যে সকল আমল বা কর্ম করলে সওয়াব ও গুনাহ কোনটিই হয় না, সে সকল আমল বা কাজকে মুবাহ বা জায়েজ বলে ৷
যেমন: ইসলামী শরীয়ত বিশ্লেষকগণ বলেনঃ
و المباح ما لا يثاب على فعله و تركه ولا يعاقب على تركه
অর্থাৎঃ “মুবাহ বলা হয় সে সব বিষয়কে, যেগুলো করলে কোন সওয়াবও নেই, না করলে কোন গুনাহও নেই ৷ যেমন: শরীর চর্চা, হাঁটা – চলা, সামাজিক কাজ, রাষ্ট্রীয় কাজ, ব্যবসা – বানিজ্য, চাকরী, খাদ্য – বস্ত্র, পানীয়, গাড়ী, বাড়ী, ঘড়ি, মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি চ্যানেল ইত্যাদি।
অতএত প্রমানিত হলো মুবাহ বা দুনিয়াবী কাজও দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত।
এবার আসুন দেখে নিই, যে সকল দুনিয়াবী কাজ বা মুবাহ নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) ‘র ওফাত মোবারকের পর সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো বিদআতের অন্তর্ভূক্ত কিনা।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত বলা হয় সে সকল বিষয় যা নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) ‘র ওফাত মোবারকের পরে আবিস্কার হয়েছে ৷ অতএব দুনিয়াবী বা পার্থিব প্রয়োজনে যে সকল বিদআত সৃষ্টি হয়, সেগুলোও বিদআতের অন্তর্ভূক্ত হবে ৷ এগুলোকে বলা হয় মুবাহ বিদআত যা বিদআতে হাসনার অন্তর্ভূক্ত।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্লেষকগণের বক্তব্য লক্ষ্য করুনঃ
১/ বিখ্যাত ফতওয়ার গ্রন্থ “ফতওয়ায়ে শামী”তে দুনিয়াবী বিষয়, যেমন খানা – পিনা, পোষাক পরিচ্ছদের নতুনত্বকে বিদআতের অন্তর্ভূক্ত করে এগুলোকে মুবাহ বলে আখ্যা দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে,
فقد تكون واجبة كنصف الادلة وتعلم النحو ومندوبة كاحداث نحو رباط و مدرسة وكل احسان لم يكن فى الصدر الاول ومكروهة كزخرفة المسجد ومباحة كالتوسع بلذيذ الماكل والمشارب والثياب.
অর্থাৎঃ “কোন বিদআত ওয়াজিবে পরিণত হয়, যেমন প্রমাণাদি উপস্থাপন করা, ইলমে নাহু (আরবী ব্যাকরণ) শিখা, কোন কোন সময় আবার মুস্তাহাব হয়, যেমন মুসাফির খানা, মাদরাসা, এবং সেসব ভাল কাজের প্রচলন করা যা আগের যুগে ছিল না ৷ আবার কোন কোন সময় মাকরূহ হয়, যেমন মসজিদ সমূহে গৌরববোধক কারুকার্য করা ৷ এবং কোন কোন সময় মুবাহ হয়, যেমন খানা – পিনা ও পোষাক পরিচ্ছদের ব্যপারে উদারতা প্রদর্শন করা
[সূত্রঃ ফতওয়ায়ে শামী, ১ম খণ্ড, কিতাবুস সালাত, আল – ইমামাত অধ্যায় হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন আলহানাফী, খণ্ড ৪, পৃ: ২৪২।]
২/ ইমাম নববী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন,
البدعة خمسة اقسام : واجبة ومندوبة ومحرمة ومكروهة ومباحة
অর্থাৎঃ “বিদআত ৫টি প্রকারের অন্তর্ভূক্ত, যথা: ১ ৷ ওয়াজিব ২ ৷ মুস্তাহাব ৩ ৷ হারাম ৪ ৷ মাকরূহ ৫ ৷ মুবাহ বা বৈধ ৷
৩/ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) দুনিয়াবী বিষয়কে মুবাহ বিদআতের অন্তর্ভূক্ত করে বলেনঃ
البدعة اما واجبة كتعلم النحو لفهم كلام الله ورسوله وكتدوين اصول الفقه واما محرمة كمذهب الجبرية — واما مندوبة كاحداث الربط والمدارس وكل احسان لم يعهد فى الصدر الاول كالتويح اى بالجماعة العامة — واما مكروهة كزخرفة المساجد وتزويق المصاحف يعنى عند الشافعية — واما عند الحنفية فمباح — اما مباحة كالمصافحة عقيب الصبح والذائذ المأكل والمشارب –
অর্থাৎঃ “বিদআত হয়তো ওয়াজিব, যেমন: ইলমে নাহু শিখা এবং ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতিসমূহ একত্রিত করা ৷ অথবা হারাম, যেনন: জবরীয়া সম্প্রদায়। অথবা মুস্তাহাব, যেমন – মুসাফির খানা, মাদরাসা এবং সে সব ভাল কাজের প্রচলন করা যা আগের যুগে ছিল না, যেমন – জামাত সহকারে তারাবিহের নামাজ আদায় করা ৷ অথবা মাকরূহ, যেমন – মসজিদসমূহ গৌরববোধক কারুকার্য করা ৷ অথবা মুবাহ ,যেমন – ফজরের নামাজের পর মুসাফাহ করা ও ভাল খানা -পিনার ব্যাপারে উদারতা প্রদর্শন করা ৷
[সূত্রঃ মিরকাত শরহে মিশকাত, ১ম খণ্ড, ৪৯০পৃ: আল -ইতিসাম বিল কিতাব ওয়াস -সুন্নাহ অধ্যায়।]
উপরোক্ত ইসলামী শরীয়তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফোকহায়ে কেরামগণের ফায়সালার পর এ বিষয়ে তর্কের অবকাশ নেই যে, দুনিয়াবী বিষয় সমূহ যেগুলো সওয়াবের নিয়ত ছাড়াই পালন করা হয় সেগুলো দ্বীনেরই অন্তর্ভূক্ত এবং এর নতুন আবিস্কার সমূহ বিদআতেরই অন্তর্ভূক্ত।
________দ্বিতীয়তঃ এবার আসুন দেখে নিই, অভিযোগকারীদের উত্তাপিত হাদিস প্রসঙ্গে ৷
হাদিস খানা হল, নবী করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) এরশাদ করেছেনঃ
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد.
অর্থাৎঃ “যে ব্যক্তি আমার দ্বীনে এমন জিনিস আবিস্কার করল যা আমার দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়, তা পরিত্যাক্ত “। উক্ত হাদিসে বলা হয়েছে সে সকল নতুন আবিস্কারই পরিত্যাজ্য হবে, যা সুন্নাতকে বদলে দেয় বা ইসলামী শরীয়তের বিরোধী হয়। আর এ ধরণের বিদআতকে ইসলামী শরীয়তে বিদআতে সায়্যিয়াহ বলে ৷ যা সর্বসম্মতিক্রমে ভ্রষ্ট ও পরিত্যাজ্য কিন্তু যে নতুন আবিস্কৃত বিষয় শরীয়তের বিরোধী নয়, তা মুবাহ তথা জায়েজ ৷ এ ধরণের মুবাহ বিদআতকে বিদআতে হাসানা বলে।
বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করলে তা আরো সুষ্পষ্ট হয়।
যেমন ইসলামী শরীয়তে সাধারণত দুই ধরণের ইবাদত রয়েছেঃ
ক/
কতিপয় ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম – পদ্ধতি রয়েছে ৷ যেমন, নামাজ, রোজা, হজ্ব, ওযু, গোসল ইত্যাদি। এ ধরণের ইবাদতের ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্ধারিত পদ্ধতি অবলম্বন করা আবশ্যক ৷ যেমন নামাজের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রাকাত, নির্দিষ্ট আরকান (নির্দিষ্ট রুকু, সিজদা, কিয়াম, বৈঠক ইত্যাদি) রয়েছে ৷ অতঃপর নির্দিষ্ট নিয়মে সিজদা না করলে বা দুই সিজদার পরিবর্তে এক বা তিন সিজদা করলে, বা রুকু বাদ দিয়ে দিলে কিংবা চার রাকাত না পড়ে পাঁচ কিংবা ছয় রাকাত পড়লে তা হবে শরীয়তে বিপরীত, যা সুন্নাতকে পরিবর্তন করে, আর এ সবই হল বিদআতে সায়্যিয়াহ যা অত্র হাদিসে পরিত্যাজ্য বলা হয়েছে।
খ/
আর কতেক ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম পদ্ধতি নেই ৷ যেমন, কোরান তেলাওয়াত, দরূদ, সালাম, দান – সদকাহ, অপরকে সাহায্য করা, সেবা করা ইত্যাদি।
যেমন, আপনি যদি দান -সদকাহর ক্ষেত্রে কোটি টাকা দান করেন তাও জায়েজ, আবার এক টাকা দান করলে তাও জায়েজ; নতুবা টাকা দান না করে কোন দ্রব্য দান করলেন তাও জায়েজ।
আর কোরান তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে এক আয়াত বা সম্পূর্ণ কোরান পাঠ করা, দরূদের ক্ষেত্রে একবার বা একশবার পাঠ করা- এগুলো দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে যে কোন উপায়ে পাঠ করা জায়েজ।
এগুলোর পরিবর্তন শরীয়তের বিপরীত নয়, কারণ এগুলোর নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই।
অনুরূপ কোরান তাফসীরের মাহফিল, ইসলামী মাহফিল, হাদিসের মাহফিল, মাসয়ালা – মাসায়েলের মাহফিল, জিকিরের মাহফিল, ইত্যাদি যে কোন শরীয়ত সম্মত উপায়ে পালন করা যাবে ৷ যদিও বর্তমানে ব্যাপকভাবে এ সব মাহফিল পালন করা বিদআত বা এভাবে নতুন। কিন্তু এগুলো শরীয়ত বিরোধী বা সুন্নতের পরিবর্তনকারী নয়। তাই এগুলো হল মুবাহ বা জায়েজ; বা বিদ্আতে মুবাহ বা বিদআতে হাসানা ৷ যা সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ ৷
যেমন উক্ত হাদিসে কোন ধরণের বিদআত পরিত্যাজ্য বলা হয়েছে তার ব্যাখ্যায় বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ বলেনঃ
১ ৷ মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) অত্র হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,
و قال النبووى رحمة الله وفيه دليل على ان العبادات من الغسل والوضوء والصوم والصلاة اذا فعلت على خلاف الشرع تكون مردودة على فاعلها –
অর্থাৎঃ এতে দলিল রয়েছে যে, যখন নির্ধারিত ইবাদত সমূহ যেমন, গোসলের নিয়ম, ওযুর নিয়ম, রোজা, নামাজের নিয়মের ক্ষেত্রে যদি শরীয়তের নির্ধারিত নিয়মের বিপরীত অন্য নিয়ম গ্রহণ করা হয়, তখন তার আমল পরিত্যাজ্য হবে ৷
[সূত্রঃ শরহুল আরবায়িন, পৃ : ৩১।]
২ ৷ বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর বিখ্যাত কিতাব “আশিয়াতুল লুমআত” এ উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ
و مراد جيزى است كه مجالف و مغير ان باشد
অর্থাৎঃ অত্র হাদিস শরীফে পরিত্যাজ্য বলতে সেসব বিষয়কেই বুঝানো হয়েছে যা ধর্মের বিপরীত ও ধর্মের পরিবর্তনকারী”।
সুতারাং প্রমানিত হল, উক্ত হাদিসে সে সব বিদআত বা নব আবিস্কারকেই পরিত্যাজ্য বলা হয়েছে যা শরীয়তের বিপরীত এবং সুন্নাতের পরিবর্তনকারী; আর যে সব নতুন আবিস্কার শরীয়ত ও সুন্নতের বিরোধী নয়, তা মুবাহ বা জায়েজ।
__________
প্রিয় রাসুলে কারিম (صلى الله عليه و آله وسلم) অপর এক হাদীস পাকে ইরশাদ করেন,
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد
“যে এমন আমল করল যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।”
[সূত্রঃ মুসলিম, হা/ ১৭১৮।]
উক্ত হাদীস পাকে মানব জীবনের সকল ধরণের কর্ম বা কাজ তথা সর্বপ্রকারের আমলকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, শরীয়ত তথা ক্বুরআ’ন, সুন্নাহ্, ইজমা, ক্বিয়াসের নির্দেশনায় কোন কাজ বা আমল বাতীল সাব্যস্থ হলে তা প্রত্যাখ্যাত।