প্রশ্নোত্তর :
আল্লামা মুফ্তী সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান
হাফেজ মাওলানা বখতেয়ার হোসেন সিরাজী
হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: পবিত্র ক্বোরআন শরীফ অনেক বেশি পুরাতন হওয়ায় এবং তিলাওয়াতের অনুপযোগী হওয়ায় বর্তমানে উক্ত পুরাতন ক্বোরআন শরীফ কী করতে হবে বা কী করা উত্তম? ইসলামী শরীয়তের নির্ভরযোগ্য ফিক্হ ফতোয়ার কিতাবসমূহের উদ্ধৃতিসহ জানানোর আবেদন রইল।
উত্তর: যদি ক্বোরআন শরীফ অনেক বেশি পুরাতন হয়ে তিলাওয়াতের অনুপযোগী হয়ে যায় এবং এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তখন একটি পবিত্র কাপড় দ্বারা মুড়িয়ে পবিত্র স্থানে (যেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা হয় না) দাফন করে ফেলা উত্তম। অর্থাৎ একটি গর্ত কবরের মত খনন করে, আর তাতে মাসহাফ মোবারক (পুরাতন ক্বোরআন শরীফ) রেখে তার উপর ছাদ দিয়ে মাটি চাপা দিবে। অথবা, লাহাদ কবর খনন করবে, যাতে সরাসরি পুরাতন ক্বোরআন শরীফের উপর মাটি না পড়ে কারণ ক্বোরআন শরীফের উপর সরাসরি মাটি পড়লে তাও এক প্রকার সম্মানের পরিপন্থি। এ ব্যাপারে হানাফী মযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাব সমূহের উদ্ধৃতি পেশ করা হল:
১. আল ফাতওয়াল হিন্দিয়া ৫ম খণ্ড, ৩২৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে-
المصحف أذا صار لايقرأ منه ويخاف أن يضيع يجعل فى خرقة طاهرة ويدفن ودفنه أولى من وضعه موضعًا يخاف أن يقع عليه النجاسة أونحو ذالك يلحد
له لانه لو شق ودفن يحتاج ألى اهالة-
অর্থ: যখন মাসহাফ (ক্বোরআন শরীফের পাণ্ডুলিপি) এত বেশি পুরাতন হয়ে যায় যে, যা পড়ার অনুপযোগী এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। তখন উক্ত পুরাতন ক্বোরআন শরীফকে একটি কাপড় দ্বারা জড়িয়ে দাফন করতে হবে। আর যেখানে রেখে দিলে নাপাকি ইত্যাদি লাগার আশংকা সেখানে রাখার চেয়ে দাফন করাটাই উত্তম। আর (দাফন করার জন্য) লাহাদ কবর খনন করবে। কারণ পুরাতন ক্বোরআন শরীফ যখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে যায় এবং দাফন করা হয়, তখন তার উপর মাটি চাপা দেয়া অসম্মান জনক, কিন্তু পুরাতন ক্বোরআন শরীফকে দাফনের পর তার উপর ছাদ দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হলে পুরাতন ক্বোরআন শরীফের উপর মাটি লাগার সম্ভাবনা থাকে না, এটা খুবই উত্তম ও সুন্দর পদ্ধতি। এভাবে গারায়েব কিতাবেও আছে। আরো উল্লেখ থাকে যে, এ ধরনের পুরাতন ও তিলাওয়াতের অনুপযোগী ক্বোরআনের পাণ্ডলিপি আগুনে পুড়ানো যাবে না। যেমন আলমগিরী তথা ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ৫ম খন্ডে ৩২৩ পৃষ্ঠায় রয়েছে-
المصحف أذا صار خلقا وتعذرت القرأة عنه لا يحرق بالنار أشار الى هذا فى السير الكبير وبه نأخذ كذا فى الذخيرة- ولا يجوز فى المصحف الخلق الذى لايصلح للقرأة ان يجلد به-
অর্থাৎ: পবিত্র কোরআনের পাণ্ডুলিপি যখন বেশি পুরাতন হয়ে যায় এবং পড়ার অনুপযোগী হয়ে যায় তখন তা আগুনে পুড়ানো যাবে না। (বরং তা দাফন করবে)। ইমাম মুহাম্মদ শায়বানি রহমাতুল্লাহি আলায়হি আস সিয়ারুল কবির কিতাবে এ দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আর আমাদের হানাফী ফকিহ্গণ এটাকে গ্রহণ করেছেন, অনুরূপ যখিরাহ কিতাবের মধ্যেও রয়েছে। আর এমন পুরাতন ক্বোরআন শরীফের পাণ্ডুলিপি যা পড়ার উপযুক্ত নয়, তা (আবার) বাঁধাই করে রাখা জায়েয নেই।
২. আদ্ দুররুল মুখতার কৃত: ইমাম আলাউদ্দীন হাছকফী ১ম খণ্ড, ১৭৭ পৃষ্ঠায় রয়েছে-
المصحف أذا صار بحال لا يقرأ فيه يدفن كالمسلم أنتهى-
অর্থাৎ: পুরাতন ক্বোরআন শরীফের পাণ্ডুলিপি যদি পড়ার উপযোগী না থাকে তখন তা মুসলিম মৃতের মত দাফন করা হবে।
৩. রদ্দুল মুহতার, কৃত: ইমাম ইবনে আবেদিন শামী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১ম খণ্ড, ৩৫৪ পৃষ্ঠায় রয়েছে-
أى يجعل فى خرقة طاهرة ويدفن فى محل غير
ممتهن لا يوطاء أنتهى-
অর্থাৎ উক্ত পুরাতন ও পড়ার অনুপযোগী ক্বোরআন শরীফকে একটি পবিত্র কাপড়ের টুকরায় জড়িয়ে এমন পবিত্র স্থানে দাফন করে দিবে যে স্থান অসম্মানজনক নয়।
৪. আল বাহরুর রায়েক শরহে কানযুদ দাকায়েক, কৃত: ইমাম ইবনে নুজাইম মিসরী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১ম খণ্ড, ৩৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
وفى التجنيس المصحف أذا صار كهنا أى عتيقا وصار بحال لا يقرأ فيه وخاف أن يضيع يجعل فى حرقة طاهرة ويدفن لان المسلم أذا مات يدفن فالمصحف اذا صار كذالك كان دفنه أفضل من وضعه
موضعا يخاف أن تقع عليه النجاسة أو نحو ذالك-
অর্থাৎ তাজনীস কিতাবে রয়েছে ক্বোরআন শরীফের পাণ্ডুলিপি যদি এমনভাবে হয়ে যায় যে, যা পড়ার উপযোগী নয় এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয়, তখন তা পবিত্র একটি কাপড়ের টুকরায় জড়িয়ে দাফন করা হবে। যেভাবে কোন মুসলমান মারা গেলে দাফন করা হয়। আর পবিত্র ক্বোরআনের পুরাতন পাণ্ডুলিপিকে দাফন করা উত্তম। কারণ ওটা এভাবে কোথাও রেখে দিলে তার উপর নাপাকি লাগার সম্ভাবনা থাকে। তদ্রুপ বাহারে শরীয়ত ৩য় খণ্ড, ১২৬ পৃষ্ঠায় ছদরুশ শরীয়া মুফতি আমজাদ আলী খান রহমাতুল্লাহি আলায়হি উল্লেখ করেছেন যে, পবিত্র ক্বোরআনের পুরাতন পাণ্ডুলিপি আগুনে না জ্বালিয়ে বা পানিতে না ফেলে পবিত্র কাপড়ে জড়িয়ে পবিত্র স্থানে দাফন করাটাই উত্তম পন্থা। এবং পবিত্র ক্বোরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও উত্তম পন্থা।
মুহাম্মদ আবদুল মতিন
ছাত্র- বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: ১. কোন মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার সময় কবর সামনে নিয়ে আযান দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং তার উপকারিতা কী হতে পারে, জানালে কৃতার্থ হবো।
২. জনৈক মৌলভী বলেন, একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া হেদায়তের মালিক আর কেউ নয়। এমন কি নবী রাসূলগণও হেদায়েত করার ক্ষমতা রাখেন না (নাউজুবিল্লাহ্)। আর তারা যদি হেদায়তের ক্ষমতা না রাখেন তাদেরকে কি জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে? উত্তর দিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।
উত্তর: মুসলমান ব্যক্তির লাশ কবরে দাফন করার পর আযান দেওয়া জায়েয এবং মুস্তাহাব। বিভিন্ন বর্ণনা ও ফকীহগণের উক্তি থেকে এর প্রমাণ মিলে। বিখ্যাত ফতোয়া ও ফিকহ গ্রন্থ ‘‘আদ্ দুররুল মুখতার’’র ১ম খণ্ড আযান অধ্যায়ে বেশ কিছু জায়গায় আযান দেওয়াকে সুন্নাত বলা হয়েছে। তাছাড়া ‘‘ফতওয়ায়ে শামী’’তেও একই বর্ণনা পাওয়া যায়। আর তা হলো ফরজ নামাযের জন্য, নবজাতক শিশুর কানে জ্বীনের উপদ্রব বৃদ্ধি পেলে, মৃগী রোগী ও রাগান্বিত ব্যক্তির কানে কানে, মুসাফির যে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে, অগ্নি কাণ্ডে ও ভূ-কম্পনের সময় এবং মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার সময় আযান দেওয়া সুন্নাত। আর বিভিন্ন হাদীসে পাক ও ফিকহ গ্রন্থে পবিত্র আযানের সাতটি উপকারের বর্ণনা রয়েছে- প্রথম- মুনকির-নাকীরের সওয়ালের জওয়াব সহজ হয়, দ্বিতীয়- শয়তান পলায়ন করে, তৃতীয়- মনের ভয়ভীতি দূর হয়, চতুর্থ- আযানের বরকতে মানসিক অশান্তি দূর হয় এবং আত্মিক সান্ত্বনা পাওয়া যায়, পঞ্চম- প্রজ্জ্বলিত আগুন নিবে যায়। ষষ্ঠ- আযান যেহেতু আল্লাহর যিকির এর বরকতে কবরের আযাব দূরীভূত হয়, কবর প্রশস্ত হয় এবং সংকীর্ণ কবর থেকে নাজাত পাওয়া যায়। সপ্তম-আযানের মধ্যে প্রিয় নবী হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যিকির ও রেসালতের শাহাদাত আছে এবং আল্লাহর প্রিয় বন্ধুগণের যিকরের সময় আল্লাহর রহমত নাযিল হয়। কবরে আযান দেয়া যেহেতু ইসলামী শরীয়তে নিষেধ করা হয়নি তাই কবরে আযান দেয়া জায়েজ এবং মুস্তাহাব। এতে অনেক উপকার রয়েছে। এ বিষয়ে হযরত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘জা-আল হক্ব’ ২য় খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
উত্তর: ২. হেদায়তের মালিক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা। তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করেন, যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট বা গোমরাহী করেন। এটাই প্রকৃত মুমিন-মুসলমানদের আক্বিদা। তাছাড়া আল্লাহ্ তা’আলা নবী-রসূল, অলি-গাউস-কুতুব-হক্কানী ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে এমনকি ক্বোরআন করীমের দ্বারাও মানুষকে হেদায়াত দান করেন। ক্বোরআনুল কারীমে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন-الله يهدى من يشأء অর্থাৎ আল্লাহ্ যাকে চান হিদায়াত দান করেন। [সূরা ক্বাসাস- ৫৬]
অন্যত্রে ইরশাদ করেছেন-
نهدى به من نشأء من عباد نا وأنّك لتهدى الى صراط مستقيم [সূরা শু‘আরা- ৫২]
অর্থাৎ: তা দ্বারা অর্থাৎ (ক্বোরআন পাক দ্বারা) আমি (আল্লাহ্) পথ দেখাই আপন বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করি, এবং নিশ্চয় আপনি (হে আমার প্রিয় নবী) সেরাতে মুস্তাকিম তথা সোজা রাস্তার দিকে হিদায়াত করেন। এখানে به শব্দটি দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা ক্বোরআন মাজীদ দ্বারা হিদায়তের কথা উল্লেখ করেছেন। অপর আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন- أن هذا القرأن يهدى للتى هى اقوم অর্থাৎ নিশ্চয় এই ক্বোরআন ওই পথ দেখায় তথা হেদায়ত করে যা সর্বাপেক্ষা সোজা ও সরল। [সূরা বনী ইস্রাঈল]
সরকারে দো‘আলম নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন-
انزلنه اليك لتخرج الناس من الظلمات الى النور-
অর্থাৎ এই (মহাপবিত্র) কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি। যাতে আপনি মানুষকে (জুলমত) অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন। এ আয়াত হতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দাদের (ঈমান-ইসলাম) তথা আলোর পথে হেদায়ত দান করেছেন। এবং লক্ষাধিক সাহাবাকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ রাসূল ও জান্নাতের দিকে পথ প্রদর্শন ও হেদায়াত দান করেছেন। স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে ক্বোরআনুল কারীমের অপর আয়াতে ঘোষণা করেছেন-وانّك لتدعوهم الى صراط مستقيم অর্থাৎ এবং নিশ্চয় আপনি তাদেরকে (মানুষ) সরল পথের দিকে তথা হেদায়তের দিকে আহ্বান করেছেন।
[সূরা- মু-মিন:আয়াত৭৩]
ক্বোরআনুল করীমের এসব আয়াতে পাক থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় মহান আল্লাহ্ হেদায়তের মালিক আর নবী-রসূল এবং প্রকৃত আউলিয়ায়ে কেরাম ও ওলামায়ে এজামকে হেদায়ত করার ক্ষমতা দান করেছেন। আর যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্যই হলো দিশেহারা বান্দাদেরকে সরল-সহজও আলোর পথ প্রদর্শন করা। এবং সঠিক রাস্তার দিকে হেদায়ত করা সুতরাং নবী-রাসূলগণও হেদায়তের ক্ষমতা রাখেন না বলা বা এ ধরনের মন্তব্য করা মারাত্মক বেয়াদবী এবং ক্বোরআন-হাদীসকে অস্বীকার করার নামান্তর। এসব গোমরাহ্ ও বেয়াদবদের সংস্পর্শও সঙ্গ হতে দূরে থাকা প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর জন্য একান্ত অপরিহার্য। নতুবা ঈমান-আমল ধ্বংস হয়ে যাবে।
মুহাম্মদ হোসেন আহমদ
দোহাজারী, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: একজন আলেমের মুখে শুনলাম নামাযের মধ্যে সূরা লাহাব পড়ে আবু লাহাবের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে হবে। না হলে নামায আদায় হবে না। এ ছাড়াও নামাযের জন্য এমন কোন নিয়ম আছে যে, নামাযে অন্তত পক্ষে ১বার হলেও সূরা লাহাব পড়তে হবে- এব্যাপারে জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: ক্বোরআন করীমের সূরা সমূহের মধ্যে একটি হল সূরা লাহাব। এটা অন্যান্য সূরার ন্যায় ক্বোরআন করীমের সূরা সমূহের অন্তর্ভুক্ত। শরীয়তের ফায়সালা হল সাধারণত ক্বোরআন করীমের যে কোন সূরা হতে নামাযে লম্বা এক আয়াত বা সংক্ষিপ্ত তিন আয়াত পাঠ করা ফরয ও সূরা ফাতেহা পাঠ করা ওয়াজিব। আর সূরা ফাতেহার সাথে অন্য যে কোন সূরা বা আয়াত মিলানো ওয়াজিব। সূরা লাহাব অবশ্যই পড়তে হবে এরকম কোন বাধ্য বাধকতা নেই। তবে খতমে ক্বোরআনের মাধ্যমে নামাযে তারাবীহ আদায় করলে তখন ক্বোরআন খতমের স্বার্থে অবশ্যই সূরা লাহাব পাঠ করতে হবে। আর প্রত্যেক নামাযে একবার অবশ্যই সূরা লাহাব পাঠ করতে হবে- এ রকম কোন শর্ত নেই। সূরা লাহাব পাঠকালে আবু লাহাবের প্রতি ঘৃণা আসাটা সত্যিকার মুমিনের পরিচয়। তাতে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। কেননা আল্লাহ্-রাসূল ও দ্বীনের দুশমনকে ঘৃণা করা এটাও ইবাদত।
কাজী রুবাইদা ইসলাম ইমা
ওষখাইন, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: ১.নাপাক বা গোসল ফরয হওয়া অবস্থায় গোসল না করে শুধু হাত-মুখ ধুয়ে ও কুলি করে খাবার খাওয়া মাকরূহ হবে কিনা। জানালে খুশি হব।
২. ইমাম সাহেব নামাযের কেরাতের মধ্যে দুরূদ শরীফের আয়াত-ياايها الذين امنوا صلوا عليه وسلموا تسليما- পাঠ করার সময় হঠাৎ একজন মুসল্লির মুখ থেকে অনিচ্ছাকৃত দরূদ শরীফ বেরিয়ে পড়ল। এতে কি নামায ভঙ্গ হবে?
উত্তর:১. অযু বা তায়াম্মুম না করে নাপাক অবস্থায় শুধু হাত মুখ ধুয়ে ও কুলি করে কিছু পানাহার করলে মাকরূহ হবে না। তবে উত্তম হলো গোসল করে পানাহার করা, কোন কারণে গোসলে বিলম্ব হলে অন্তত অযু করে পানাহার করা উত্তম। কেননা যেখানে নাপাকী ও জুনুবী থাকে সেখানে রহমতের ফিরিশতা আসে না। হাদীস শরীফে এরকম বর্ণনা বিদ্যমান আছে। তদুপরি দুররুল মোখতারে ইমাম আলাউদ্দীন খাচকপি হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি উল্লেখ করেছেন- لابأس باكل وشرب بعد مضمضة وغسل يد وأمّا قبلها فيكره للجنب অর্থাৎ নাপাক অবস্থায় শুধু কুলি করে এবং হাত মুখ ধুয়ে কিছু পানাহার করা দোষণীয় নয়। হাত মুখ না ধুয়ে কুলি না করে জুনুবীর (যার উপর গোসল ফরয হয়েছে) জন্য পানাহার করা মাকরূহ। রদ্দুল মোহতার তথা ফতোয়া শামীতে আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি উল্লেখ করেছেন-وضوء الجنب لهذه الاشياء مستحب كوضوء للحدث- অর্থাৎ অযু করে নাপাক ব্যক্তির (যার উপর গোসল ফরয হয়েছে) পানাহার করা মুস্তাহাব, যেমন অযু ভেঙ্গে গেলে অযু করে নেওয়া মুস্তাহাব। [দুরুল মোখতার ও রদ্দুল মোখতার ইত্যাদি]
উত্তর: ২. ইমাম সাহেব নামাযের কেরাতের মধ্যে ياايهاالذين امنوا صلواعليه وسلموا تسليما আয়াত পাঠ করলে এবং মুকতাদী উক্ত আয়াত শুনে হঠাৎ অনিচ্ছাকৃত ভাবে তার মুখ দিয়ে দুরূদ শরীফ বের হলে নামায ভঙ্গ হবে না, কেননা সে ইমামের নির্দেশনা মানেনি, বরং আল্লাহর নির্দেশ মানার উদ্দেশ্যে সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছে। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে মুসল্লি নামাযের কেরাতের সময় দরূদ পড়বে না। বরং চুপ থাকবে এবং মনোযোগ সহকারে ইমাম সাহেবের কেরাত শুনবে।
[ইরফানে শরীয়ত, কৃত: আ’লা যহরত শাহ্ আহমদ রেযা বেরলভী রহ. ইত্যাদি]
মুহাম্মদ লোকমান
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) পালন করা সম্পর্কে শরিয়তের হুকুম কি? কেউ ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) পালন না করলে তার সাথে ঝগড়া-বিবাদ করে তাকে ফাসিক বলা যাবে কিনা? ঈদে মিলাদুন্নবীকে সকল ঈদের সেরা ঈদ বলা যাবে কিনা? এগুলো নির্ভরযোগ্য দলিলের মাধ্যমে জানিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তর: এ পৃথিবীপৃষ্ঠে আমাদের প্রিয়নবী হুযূর পুরনূর মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাহমাতুল্লীল আলামীন হিসেবে শুভাগমন করেছেন। আর তাঁর আগমনের বদৌলতে ঈদুল ফিতর-ঈদুল আযহযা, শবে বরাত, শবে ক্বদর এমনকি সাপ্তাহিক ঈদ জুমা’ সহ সকল প্রকার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান লাভে ধন্য হয়েছি। তাই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের শত শত বছর যাবৎ ১২ রবিউল আউয়াল অতি ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) উদযাপিত হয়ে আসছে। আমাদের বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং বিভিন্ন সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় মাহে রবিউল আউয়ালে অতি জাক-জমকের সাথে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) পালিত হয়ে আসছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন সারা পৃথিবীর জন্য রহমত। আর এই রহমত বা অনুগ্রহ লাভ করার পর ঈদ বা খুশি উদ্যাপন করার আদেশ রাব্বুল আলামীন পবিত্র ক্বোরআন পাকেই প্রদান করেছেন-
قل بفضل الله وبرحمته فبذالك فليفرحوا—–
অর্থাৎ (হে হাবীব) আপনি বলুন! আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত প্রাপ্তিতে তারা (মানব জাতি) যেন অবশ্যই আনন্দ-খুশি উদ্যাপন করে। [সূরা ইউনুস: আয়াত-৫৮]
আর আল্লাহর প্রদত্ত অনুগ্রহ-রহমত দয়া তথা নেয়ামত সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ, নেয়ামত ও রহমত হচ্ছেন বিশ্বনবী সরকারে দো’আলম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র এ ধরাতে শুভাগমন। আল্লাহ্ পাক তাইতো ক্বোরআন পাকে ইরশাদ করেন-
وما ارسلناك الا رحمة للعلمين (الانبياء)
অর্থাৎ আমি আপনাকে সমস্ত বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। [সূরা আম্বিয়া: আয়াত ১০৭]
সুতরাং ঐ অনুগ্রহ ও নেয়ামত প্রাপ্তির দিনে শুকরিয়া হিসেবে ঈদ তথা ঈদে মিলাদুন্নবী ¬(সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) উদ্যাপন করা মুমিন মুসলমানদের উপর অবশ্যই কর্তব্য। মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের গুরুত্ব বা ফযিলত আল্লাহ্ পাক তার পাক ক্বোরআনেই ঘোষণা করেছেন। তা হলো -هو خير مما يجمعون অর্থাৎ আল্লাহর দয়া ও রাসূলে পাক এর শুভাগমনের শুকরিয়া স্বরূপ খুশি উদ্যাপন করা তা সমস্ত সঞ্চিত ধন-দৌলত ও নেকী সমূহ আপেক্ষা শ্রেয়।
আর মিলাদুন্নবী তথা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র শুভাগমনের ওসিলায় রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে ইবাদত-বন্দেগী, অসংখ্য নেয়ামত ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা দান করেছেন। তাই ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)কে সকল ঈদের সেরা ঈদ বলা হয়। ধরা বুকে প্রিয় নবীর শুভাগমনে খুশি ও আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর জন্য ফরয ও অপরিহার্য। তবে তারই শুভাগমন ও মিলাদ শরীফের মাস মাহে রবিউল আউয়ালে পবিত্র ও ভাব-গম্ভীর পরিবেশে বিশেষত: ক্বোরআন তেলাওয়াত, খতমে সহীহ বোখারী, খতমে মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল (দ.), খতমে গাউসিয়া শরীফ, রাসূলে পাকের শান-মান ও বেলাদত শরীফের নূরানী বর্ণনা, হামদ, সালাত, দরূদ-সালাম, জশনে জুলুস, মিলাদ শরীফ ও দোয়া মুনাজাত, শুকরিয়া স্বরূপ তবারুক ও জিয়াফতের আয়োজন করা নফল, মোস্তাহাব ও অসংখ্য সওয়াব ও বরকতময় হিসেবে ইসলামী মনিষীগণ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক ফতোয়া/ফয়সালা প্রদান করেছেন। যারা অন্তরিক বা শ্রদ্ধার সাথে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) উদ্যাপন করে না বরং বিরোধীতা ও কটূক্তি করে তারা ফাসিক, মুনাফিক ও ইবলিস শয়তানের অনুসারী হিসেবে বিবেচিত। মূলত তাদের অন্তরে নেফাকের রোগ তথা প্রিয় নবীর প্রতি হিংসা-বিদ্ধেষ থাকায় তারা ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র মত প্রকৃত সত্য ও মহান নেয়ামতকে ভক্তি-মহব্বতের সাথে গ্রহণ করতে পারছে না। এ বিষয়ে ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) তাঁর রচিত ‘‘আন্ নেমতুল কুবরা আলাল আলম’’ কিতাবে, সহীহ বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারী ইমাম আহমদ কসতলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) তাঁর রচিত ‘‘আল মাওয়াহেবুল লাদুনিয়া’’ কিতাবে আরো অনেক মুসলীম দার্শনিক ও মনিষীগণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম
দোহাজারী, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: ১. মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র মধ্যে পার্থক্য কী? কোন কোন স্থানে মিলাদুন্নবীর পরিবর্তে সিরাতুন্নবীর নামে মাহফিল করতেও দেখা যায়। কোনটি যথাযথ। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার নিবেদন রইল।
২. আমাদের দেশের মুরব্বিরা বলেন, মানুষের চারদিনের ফাতিহায় ফলমুল, মুড়ি এককথায় যে, ফলার দেয়া হয় তা খেলে নাকি স্মৃতি শক্তি কমে যায় এটা কতটুকু সত্য? নাকি কুসংস্কার? জানালে খুশি হব।
উত্তর: ১. মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী হল ব্যাপক আলোচিত শব্দ। শাব্দিক তথা অভিধানিক অর্থে মিলাদুন্নবী (দ.) দ্বারা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র শুভাগমন এবং সিরাতুন্নবী (দ.) দ্বারা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র চরিত্র বুঝালেও ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। আল কিফায়া নামক কিতাবে উল্লেখ আছে সিরাতুন্নবী নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ’র যুদ্ধ জীবনের সাথে সীমিত। কেননা ইমাম ইবনে হুম্মাম বলেন ফোকহায়ে কেরামের পরিভাষায় কাফেরদের সাথে যুদ্ধ/জিহাদ করার ক্ষেত্রে শরিয়তের যে সমস্ত কর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় তার নামই হল সিরাত। অনুরূপভাবে ইমাম নাসাফী বলেন, জিহাদ তথা যুদ্ধের কর্ম পদ্ধতির নাম হল সিরাত। পক্ষান্তরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূরী জগতের সৃষ্টি হতে শুরু করে নূরানী জগতে লক্ষ লক্ষ বৎসর বিচরণ, তারপর দুনিয়ার বুকে শুভাগমন ও দুধপান করার অবস্থা থেকে তেষট্টি বছর নূরানী জাহেরী হায়াতে তৈয়্যবার প্রতিটি বিষয় আলোচনার স্থান পায় মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানে। সুতরাং সিরাতুন্নবী হল শুধু নবীজির যুদ্ধ ও জিহাদী জিন্দেগীর অংশের নাম। আর মিলাদুন্নবী হল নবীজির নূর মোবারকের সৃষ্টি থেকে ইনতেকাল পর্যন্ত গোটা নূরানী হায়াতের বর্ণনার নাম। তদুপরি মাহে রবিউল আউয়াল প্রিয় নবীর শুভাগমনের মাস হিসেবে এ মাসের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবীর (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) সংশ্লিষ্টতা ও সংম্পৃক্ততা বিদ্যমান। কোন কোন কুচক্রী মহল মিলাদুন্নবীর বিশাল আয়োজনকে সহ্য করতে না পেরে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) থেকে মুসলমানদের দূরে সরানোর অপচেষ্টা হিসেবে সিরাতুন্নবী মাহফিলের অবতারণা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হল নবী প্রেমিক মুমিনদের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবীর সাথে সংঘর্ষ ও বিরোধিতা করা। এবং মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র প্রতি আঘাত ও কটূক্তি করা। যুগ যুগ ধরে বিশ্বের মুসলমানগণ রবিউল আওয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) নামে নবীজির শুভাগমনকে ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে পালন করে আসছেন। এটাকে ইসলামী শরিয়তের ফকিহ-মুফতিগণ বরকতময় ও মুস্তাহাব হিসেবে ফতোয়া ও ফয়সালা প্রদান করেছেন যা প্রকৃত ওলামায়ে কেরাম ও আউলিয়া কেরামের উত্তম তরিকা। তার বিপরিত ও খেলাফ করা মিলাদুন্নবীকে অস্বীকার করার নামান্তর। যা নবী বিদ্ধেষী ও ফিতনা বাজদের চরিত্র।
উত্তর: ২. মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর চতুর্থদিনে জীবিত অলি-ওয়ারেস-আত্মীয় স্বজনরা ফলার ফলমূলসহ বিভিন্ন খাবার ইত্যাদি জিয়াফত ইছালে সওয়াব বা মৃত ব্যক্তির রূহে সওয়াব পৌঁছানোর নিমিত্তে যা কিছু আয়োজন করেন ওটাকে সংক্ষেপে চাহারম শরীফ ও কুলখানি বলা হয়। তা মুস্তাহাব ও উত্তম তরিকা। তা আহার করা জায়েয ও সওয়াব। এগুলো আহার করলে স্মৃতি শুক্তি কমে যায় এ সব কথা ভিত্তিহীন।
মাওলানা মিজানুর রহমান আত্ তাহেরী
সুলতানপুর, ব্রাহ্মণ বাড়ীয়া।
প্রশ্ন: আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ হুজুর কেবলা (মু.জি.আ.) বাংলাদেশে বর্তমানে কাউকে খিলাফত দিয়েছেন কি? তার সঠিক তথ্য জানানোর অনুরোধ রইল।
২. ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় এক ব্যক্তি হুজুর কেবলার নামে লোকজনকে বাইয়াত করাচ্ছেন। এটা সঠিক কিনা। যদি খিলাফত না দিয়ে থাকেন তা হলে এ ব্যাপারে কি করা উচিত। জানালে ধন্য হবো।
উত্তর: হুজুর কেবলা রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত, আওলাদে রাসূল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) দরবারে কাদেরিয়া আলীয়া সিরিকোট শরীফের সাজ্জাদানশীন। তিনি রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরীকত গাউসে জমান পেশওয়ায়ে আহলে সুন্নাত হুজুর আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক খিলাফত প্রাপ্ত। তিনি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য দেশে বর্তমানে সিলসিলার কার্যক্রম আল্লাহর অসীম মেহেরবানী ও দয়ায় পরিচালনা করে আসছেন। আমার জানা মতে হুজুর কেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) বাংলাদেশে কাউকে সিলসিলা ও বাইয়াতের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য খিলাফত প্রদান করেননি। কেউ যদি হুজুর কেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেবের খলিফা দাবী করে লোকদের বাইয়াত করাই তা হবে সম্পূর্ণ প্রতারণা ও খেয়ানত। এ বিষয়ে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট চট্টগ্রাম ও ঢাকাকে অবহিত করার জন্য আহ্বান রইল। খোঁজ-খবর নেয়া ও সতর্ক হওয়া জরুরি। যারা ঁেধাকায় পড়েছে তারা যেন অবশ্যই পরবর্তীতে হুজুর কেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) বাংলাদেশে আগমন করলে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে সিলসিলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
মুহাম্মদ কামরুজ্জামান
মসজিদ ম্যাস, লাকসাম, কুমিল্লা
প্রশ্ন: ইমাম সাহেব খুতবার আগে বয়ান করতে গিয়ে কবর সম্পর্কে আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, পৃথিবীর সকল নবী, রাসূল মাটির তৈরি এমনকি বিশ্ব মানবতার দূত, নবী কূলের সরদার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মাটির মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেন। ইমাম সাহেব বিভিন্নভাবে সহজ-সরল মুসলমানকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মাটির তৈরি। একমাত্র ফেরেশতারা নূরের তৈরি। আমি অনেক বিজ্ঞ আলেমদের কাছে শুনেছি রাসূল (দ.) নূরের তৈরি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর জাতি নূর থেকেই সৃষ্ট। তাই তিনি আপাদমস্তক নূর ছিলেন। এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার নূর হতে সৃষ্টি জগতের সব বস্তু সৃষ্টি হয়েছে। যেমন দালায়েলুল খায়রাতের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মতালেয়ুল মুসররাতে উল্লেখ আছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اول ما خلق الله نورى ومن نورى خلق كل شى-
অর্থাৎ সর্ব প্রথম আল্লাহ্ তা’আলা আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নূর থেকে প্রত্যেক বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন। উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সৃিষ্টগত দিক দিয়ে নূর এবং মা আমিনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার গর্ভে নূর হিসেবে ছিলেন। তাই হযরত আমিনার গর্ভকালীন অন্য গর্ভবতী মহিলাদের মত ভারী তথা গর্ভের বোঝা এবং কোন প্রকার কষ্ট অনুভব করেননি। এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন এ পৃথিবীতে শুভপদার্পন করেছিলেন তখন বেমেছাল-অতুলনীয় নূরী মানব হিসেবে শুভাগমন করেছিলেন। যার নূরের ঝলকে হযরত আমিনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা মক্কা শরীফ হতে সুদুর মুলকে শামের রাজ প্রাসাদগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সূর্য-চন্দ্র ও বাতির আলোতে কখনো নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নূরানী শরীর মোবারকের ছায়া প্রদর্শিত হত না। বিখ্যাত হাদীস বিশারদ হযরত হাকিম তিরমিযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘‘নাওয়াদেরুল উলুম’’ কিতাবে হযরত যকওয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে হাদীস শরীফ বর্ণনা করেছেন-
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يكن له ظل
فى الشمس ولا فى القمر-
অর্থাৎ অবশ্যই নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সূর্য ও চন্দ্রের আলোতে কোন ছায়া প্রকাশ পেত না। আল মাওয়াহেবুল্লাদুনীয়্যা ফিশ্শামায়িলিল মুহাম্মদীয়া ও যুরকানী আলাল মাওয়াহেবে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারক ও হাফেজ ইবনে জুযী, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন-
لم يكن لرسول الله ظل ولم يقم مع الشمس الا غلب
ضوء ولا مع سراج الا غلب ضوءه ضوءه-
অর্থাৎ নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দেহ মোবারকের কোন ছায়া ছিল না, সূর্যের রোদেও কোন ছায়া পড়ত না। বাতির আলোতেও কোন ছায়া দেখা যেত না বরং হুজুরের নূরানী দেহ মোবারক সূর্য ও বাতির আলোর উপর প্রভাব বিস্তার করত। বস্তুত চন্দ্র সূর্য ও বাতির আলোর চেয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দেহ মোবারকের জ্যোতি ও আলো বেশী প্রখর ও শক্তিশালী ছিল।
খাসাইসে কুবরা শরীফে উল্লেখ আছে-
انّ ظله كان لايقع على الارض لانه كان نورنورا
অর্থাৎ: অবশ্যই যমীনের উপর তাঁর (রাসূলে করিমের) ছায়া পতিত হত না। কেননা তিনি ছিলেন নূর। উল্লিখিত বর্ণনা সমূহ দ্বারা স্পষ্ট যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপাদমস্তক নূরই ছিলেন। অতঃপর নবীজির দেহ মোবারককে মাটির বলা অজ্ঞতা, পথভ্রষ্টতা ও নবী বিদ্ধেষীর নামান্তর।
উল্লেখ্য আমাদের প্রিয় নবী সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মানব বংশে বনী আদম হয়ে অসাধারণ নূরানী মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নূরানী রাসূল হিসেবে ধরা বুকে শুভাগমন করেছেন। তিনি অবশ্যই ফেরেশতা বা জ্বীন বংশের অন্তর্ভুক্ত নন। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াত ও হক পন্থিদের আক্বিদা বিশ্বাস।
[আল্খাসায়েছুল কুবরা, কৃত: ইমাম জালাল উদ্দীন সূয়ূতী রহ., শরহে মাওয়াহেব, কৃত: ইমাম জুরকানী রহ., আন্ নেমতুল কুবরা, কৃত: ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী রহ. ইত্যাদি]
মুহাম্মদ আবু ছালেহ্
ধুরুং, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাযির-নাযির কিনা? এ বিষয়ে কেউ কেউ অনেক আপত্তি করে- এ ব্যাপারে কিছু তথ্য তুলে ধরার আবেদন রইল।
উত্তর: আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা বলে এক স্থানে অবস্থান করে কুলকায়েনাতকে হাতের তালুর মত দেখে থাকেন, দূরের কাছের সব আওয়াজ শুনে থাকেন, এক মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত জগত ভ্রমণ করে থাকেন, লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে অবস্থান রত নিজের ভক্ত অনুরক্ত দেরকে সাহায্য করতে পারেন। এটা হল হাযির নাযির এর শরয়ী অর্থ। আম্বিয়ায়ে কেরাম, আউলিয়ায়ে এযাম বিশেষত নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে উক্ত হাযির-নাযির গুণে-গুনান্বিত। এটা ক্বোরআন করিম, হাদীস শরীফ, ফোকাহায়ে কেরাম, মুহাদ্দেসীন ও মুফাসসেরীনে এযামের বাণী দ্বারা প্রামণিত। এটাকে অস্বীকার করা মূলত: মহান আল্লাহ কর্তৃক নিজের প্রিয় বান্দাদেরকে প্রদত্ত বিশেষ ঐশী ক্ষমতাকে অস্বীকার করা। যা নবী-অলীর দুশমনদের চরিত্র। ক্বোরআন করিমে উল্লেখ আছে-
النبى اولى بالمؤمنين من انفسهم
অর্থাৎ: নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের প্রতি তাদের প্রাণের চেয়ে অতি নিকটে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ওহাবীদের বড় প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলবী কাসেম নানুতবী স্বীয় পুস্তক ‘‘তাহজীরুন নাসে’’ লিখেন, উক্ত আয়াতে اولى শব্দের অর্থ হল অতীব নিকটে। অতএব আয়াতে অর্থ হবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের প্রতি তাদের প্রাণের চেয়েও বেশী নিকটে। উক্ত ব্যাখ্যা দ্বারা বুঝা গেল নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বিশ্বের সকল মুমিনের কাছে হাযির-নাযির।
খ. আল্লামা যুরকানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শরহে মওয়াহেবে লাদুনিয়্যায় উল্লেখ করেছেন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
ان الله رفع لى الدينا فانا انظر اليها والى ما هو
كائن فيها الى يوم القيامة كانما انظرالى كفى هذا-
অর্থাৎ অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলা সমগ্র পৃথিবীকে আমার সামনে, পেশ করেছেন, অতঃপর আমি এই দুনিয়া এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সব কিছুকে এভাবে দেখছি যেভাবে আমি আমার এ হাতের তালুকে দেখছি।
গ. শেখ মুহাক্কেক আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলবী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তার কিতাব ‘‘মাজমাউল বরকাতে’’ উল্লেখ করেছেন-
وى عليه السلام براحول واعمال امت مطلع است هرمقربان وخاصاں
درگاه خود ميضل وحاضرو ناظر است-
অর্থাৎ নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের উম্মতের অবস্থাবলী ও সব কার্যাদি সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনি নৈকট্যবান ও বিশেষ উম্মতকে ফয়েজ বিতরণকারী এবং হাযির-নাযির। উল্লেখ্য যে, উপমাদেশের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকিহ্ শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রিয় নবীর শানে হাযির ও নাযির উভয় শব্দ বর্ণনা করেছেন। বিরুদ্ধাবাদীরা এখান থেকে সবক নিতে পারে।
ঘ. আওয়ারেফুল মায়ারিফ কৃত শেখ শিহাবউদ্দীন সহরোয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলায়হির উক্ত কিতাবের তরজমা মিছবাহুল হেদায়তে উল্লেখ আছে-
پس با يد كه بنده همچناں كه حق سبحانه را پيوسته برجميع احوال خود ظاهرًا وباطن واقف ومطلع بند رسول صلي الله عليه وسلم را نيز
ظاهر وباطن حاضر داند-
অর্থাৎ যেমনিভাবে বান্দা নিজের সমস্ত অবস্থার উপর আল্লাহ তা’আলাকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে অবগত ও ওয়াকেফহাল জেনে থাকে সেভাবে বান্দা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকেও তার সকল অবস্থার উপর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে হাযির জানবে।
উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল কুলকায়েনাতই হাতের তালুর ন্যায় নবীজির সামনে বিদ্যমান। হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাবের বরং ইমামগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে ফতোয়া প্রদান করে বলেছেন-
لافرق بين حياته وموته صلى الله عليه وسلم فى مشاهدته لامته ومعرفته باحوالهم ونياتهم وعزائمهم وذالك جلى عنده هكذا ذكره الامام ابن امير الحاج فى المدخل والامام احمد رضا فى كتابه
الدولة المكية بالمادة الغيبية-
অর্থাৎ নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হায়াত ও ইনতেকাল এর মধ্যে স্বীয় উম্মতকে প্রত্যক্ষ করার ক্ষেত্রে এবং তাদের যাবতীয় অবস্থা সমূহ, অন্তরের নিয়ত ও দৃঢ় ইচ্ছা জানার ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই অর্থাৎ যেভাবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্য জীবদ্দশায় আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে উম্মতকে প্রত্যক্ষ করতেন, তাদের অবস্থা সমূহ, নিয়ত ও ইচ্ছার বিষয়ে জানতেন ইনতেকালের পরও বাতেনী হায়াত দ্বারা অনুরূপ প্রত্যক্ষ করছেন এবং জানছেন। এ ক্ষমতা মহান আল্লাহ্ নিজের প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন। এটাকে বলা হয় নবীজি হাযির-নাযির। এটাকে অস্বীকার করা মূলত আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতাকে অস্বীকার করা, যা হতভাগা কাফির ও মুনাফিকগণকে বদচরিত্র।
[আল মাদ্খাল কৃত: ইমাম ইবনে আমিরুল হাজ্ব রহ.,আদ্ দাউলাতুল মক্কিয়া বিল মাদ্দাতিল গায়বিয়া কৃত: ইমাম আহমদ রেজা খান রহ., মাজমাউল বরকাত কৃত: শেখ আবদুল হক দেহলভী রহ., আমার রচিত যুগ জিজ্ঞাসা, তরজুমানে আহলে সুন্নাতের বিগত সংখ্যা সমূহ ইত্যাদি]
মুহাম্মদ ইব্রাহীম খান
হাটহাজরী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: মৌলভী রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী তার ফতোয়ায়ে রশিদিয়ার (১ম খণ্ড, পৃ. ১০২) এ লিখেছেন- সাধারণ ভাবে হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করা মুস্তাহাব। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা অবলম্বন মাকরূহ। কাজেই প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মিলাদ পাক ধারাবাহিক প্রতি বছর করে আসার বিষয়ে মাকরূহ কিংবা নাজায়েয না হওয়ার কোন দলিল ক্বোরআন-হাদীসে রয়েছে কিনা? জানানোর অনুরোধ রইল।
উত্তর: শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন বস্তু মুস্তাহাব হিসেবে গন্য হলে অতঃপর তা নিয়মিত পালন করা হলে বা তাতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হলে উক্ত মুস্তাহাব বস্তু মকরূহ হয়ে যায় না। বরং শরিয়তের দৃষ্টিতে তা মুস্তাহাব হিসেবেই বিদ্যামান থাকে। যেমন নফল নামায দাঁড়িয়ে আদায় করা মুস্তাহাব। অনুরূপভাবে কেউ উক্ত নফল নামায নিয়মিত ও ধারাবাহিক দাঁড়িয়ে আদায় করলে মুস্তাহাবই থাকবে। এই ধারাবাহিকতার ফলে এটা মকরূহ হয়ে যায় না। যেমন জোহরের বার রাকাত নামাযের মধ্যে দু’রাকাত নফল, তা নিয়মিত আদায় করা মাকরূহ নয় বরং নফলই হবে। তদ্রƒপ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মিলাদ পাক প্রত্যেক বছর ও প্রতি মুহূর্তে উদ্যাপন করা এবং নবীজীর জীবনী আলোচনায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করা- তাও মুস্তাহাব। নবীজীর জীবনী আলোচনাকে মুস্তাহাব বলে জীবনী আলোচনার ধারাবাহিকতাকে মকরূহ বলা নবী বিদ্বেষীর নামান্তর এবং মুর্খতা।
মুহাম্মদ আবদুর রহিম
ভাটিয়ারী, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কোন মহিলার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে কিন্তু তার স্বামী নেই। তার সাথে ছেলে অথবা অন্য কোন মুহরিমও যাচ্ছে না। কিন্তু সেই মহিলা হজ্বে যেতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় তিনি পীর ভাই অথবা মামাত ভাই, চাচাতো ভাই, খালাত ভাই প্রমুখের সাথে হজ্বে যেতে পারবেন- কিনা। বর্তমান সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা অতি সহজ হওয়ায় এ মহিলার একাকী অথবা অন্য কারো সথে হজ্বে যাওয়া যাবে- কিনা। ক্বোরআন-সুন্নাহর আলোকে দলিল সহকারে জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: আপন স্বামী, ভাই, ছেলে, নাতি, ভাগিনা, ভাতিজা ( যাদের সাথে বিবাহ হারাম) ছাড়া পীর ভাই, চাচাত ভাই, মামাত ভাই, খালাত ভাই, ফুফাত ভাই, কোন বেগানা পুরুষ, হজ্ব কাফেলার কোন লোকের সাথে বা একা কোন বালেগা মহিলা হজ্বে অন্য বা কোন দূরত্বের সফরে যেতে পারবে না। ফরয হজ্বের বেলায় ও একই হুকুম। যদি যায় অবশ্যই গুনাহগার হবে। দুনিয়ায়ে সুন্নিয়াতের তাজেদার আকায়ে নেয়ামত ইমাম আ’লা হযরত শাহ্ আহমদ রেজা খান রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ ধরনের মহিলার ক্ষেত্রে ফায়সালা প্রদান করে বর্ণনা করেছেন যে, প্রত্যেক কদমে কদমে গুনাহ হবে। হজ্ব কাফেলার কোন কোন লোক ব্যবসার উদ্দেশ্যে নানা কথা বলে বা তাদের কেউ কেউ মিথ্যা মুহরিম পরিচয় দিয়ে এ ধরনের মহিলাদেরকে হজ্বে নিয়ে যায়, এটা প্রতারণা। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার অনুরোধ রইল।
[আনোয়ারুল বেশারত কৃত: ইমাম আ’লা হযরত রহ.]
মুহাম্মদ মন্জুর এলাহী
কালুশাহ্ নগর, ফৌজদারহাট
সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: ১. কোন পীর ভাই অথাব পীর বোন প্রতি চাঁদের ১১/১২ তারিখে সওয়াবের উদ্দেশ্যে নিজের বাসায় একাকী গেয়ারভী শরিফ এবং বারবি শরিফ আদায় কতে পারবে কিনা?
২. আমরা বিভিন্ন পীর ভাইয়ের বাসায় অথবা বাড়িতে গিয়ে খতমে গাউসিয়া শরিফ আদায় করি। যদি উক্ত দাওয়াতের তারিখে চাঁদের ১১/১২ তারিখ হয় তাহলে উক্ত স্থানে তাৎক্ষণিকভাবে সবাই মিলে গিয়ারভী শরিফ বা বারবি শরিফ গাউসিয়া শরিফের সাথে পড়া যাবে কিনা। জানানোর অনুরোধ রইল।
উত্তর: ১. গেয়ারভী শরিফ ও বারবি শরিফের ফজিলত অগণিত, যার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে শেষ করা যাবে না। যদিও এগুলো নফল ইবাদত, প্রতিমাসে নিয়মিত আদায় করা হলে অনেক ফায়দা হাসিল হয়। দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম হওয়া যায়, আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের নৈকট্য অর্জন হয় এবং আল্লাহর বন্ধুত্বের মকাম হাসিল হয়। জীবন দুঃখ ও চিন্তামুক্ত হয়ে সুখে শান্তিতে অতিবাহিত হয়। তাই নিয়মিত গেয়ারভী শরিফ ও বারবি শরিফের মাহফিলে অংশ গ্রহণ করা অনেক মঙ্গলময় ও কল্যাণ কর। নিজের বাড়ি বা বাসার নিকটে খানকাহ্ থাকলে তখন উক্ত খানকায় গেয়ারভী শরিফের মাহফিলে শরীক হবে। অন্যথায় বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে বা একাকী গেয়ারভী শরিফ ও বারবি শরিফের অযিফাগুলো নিজের বাসায়ও আদায় করা যাবে। তাতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন অসুবিধা নেই। তবে গিয়ারভী ও বারবি শরিফের বেলায় স্বীয় সিলসিলার পীর মুর্শিদের অনুমতি গ্রহণ করা অধিক ফয়েজ বরকত হাসিল করার জন্য অন্যতম ওসিলা।
উত্তর: ২. কোথাও গাউসিয়া শরিফ পালন কালে উক্ত দিবস গেয়ারভী শরিফ বা বারবি শরিফের রাত বা দিবস হলে তখন খতমে গাউসিয়ার পাশাপাশি গেয়ারভী শরিফ ও বারবি শরিফ পাঠ করলে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন অসুবিধা নেই। বরং উত্তম ও বরকতময়। তবে গেয়ারভী ও বারবী শরিফ স্বীয় বাসায় ও দফতরে পাঠ করার জন্য সিলসিলার মশায়েখ হযরাত ও স্বীয় পীর-মুর্শিদের অনুমতি গ্রহণ করা অধিক কল্যাণ ও বরকত লাভের জন্য অন্যতম ওসিলা। আর খতমে গাউসিয়া বাসায় দোকানে-দফতরে-মসজিদে ও খানকা সবখানে আদব-ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে পাঠ করার জন্য হযরাতের পক্ষ হতে আম ইজাজত বা সাধারণ অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
মুহাম্মদ মনজুর এলাহী
কালুশাহ্ নগর, সলিমপুর,
সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: খতমে গাউসিয়া শরিফ পড়ার সময় যখন শাজরা শরিফ পড়া হয় তখন কিছু লোক হাতকে দুই রানের উপর রাখে মোনাজাতের ভঙ্গিতে। আবার কিছু লোক হাতকে উপুড় করে রাখে অথবা বন্ধ করে রাখে। এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে শাজরা শরিফ পড়ার সময় হাতকে কিভাবে রাখতে হবে তরিকতের নিয়ম জানিয়ে উপকৃত করবেন।
উত্তর: শাজরা শরিফে মূলত সিলসিলার মাশায়েখ হযরাতের ওসিলা নিয়ে মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া ফরিয়াদ করা হয়। এটাও মুনাজাতের অন্তর্ভুক্ত। তাই আমিন বলা হয়। অবশ্য শাজরা শরিফ পাঠ করার সময় প্রথম হতে উপস্থিত সকলের কষ্ট হবে বিধায় শেষে হাত উঠানো হয়। তদুপরি হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হির নাম যুক্ত পঙক্তির সাথে হাত উঠানোর বিবরণ যুক্ত আছে বিধায় ঐ সময় হাত উঠানো হয়। শাজরা শরিফ তেলাওয়াতের সময় যদি হাতকে সাধারণভাবে রাখা হয় তাতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন অসুবিধা নেই। এটা নিয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ নেই।
মুহাম্মদ আনিছুর রহমান ভূঁইয়া
লাকসাম, কুমিল্লা।
প্রশ্ন: বিবাহের মোহরানার ক্ষেত্রে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কমপক্ষে দশ দিরহাম বর্তমানে হিসেবে কত টাকা হতে পারে? জানিয়ে খুশি করবেন।
উত্তর: সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার পরিমাণ হল দিরহাম হিসেবে দুইশত দিরহাম। সে হিসেবে দশ দিরহামের পরিমাণ হবে ২ সমস্ত ৮ ভাগের ৫ তোলা/ভরি। ২.৫/৮ হিসেবে দশ দিরহামের পরিমাণ হবে ২.৬২৫। বর্তমান বাজার দরে রূপার মূল্য প্রতি ভরি যদি ২০০০/= (দুই হাজার) টাকা হয় তবে সে হিসেবে ২.৬২৫ তোলা রূপ্য মূল্য হবে ৫২৫০/= টাকা। অতএব, বর্তমান মূল্য হিসেবে বিবাহের ক্ষেত্রে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কমপক্ষে স্ত্রীর মোহরানা রূপা দশ দিরহামের মূল্য হবে ৫২৫০/= টাকা। উপরোক্ত পরিমাণ ও হিসাব হযরত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক মিশকাত শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মির’আত (কিতাবুয যাকাত) হতে সংগৃহিত।
মুহাম্মদ খাইরুন্নেছা
চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদ্যাপন শরিয়ত সম্মত কিনা? ক্বোরআন হাদীসের আলোকে জানালে ধন্য হব।
উত্তর: জুলুস আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ শোভা যাত্রা বা বর্ণাঢ্য মিছিল, শাহী সওয়ারী ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় সমগ্র সৃষ্টির প্রাণ ও উৎস হুজুর নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ ধরাধামে শুভাগমনকে কেন্দ্র করে শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে হামদ-না’ত, দুরূদ-সালাম, যিকির-আযকার ইত্যাদির মাধ্যমে শোভা যাত্রা ও খুশি উদযাপন করাকে জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলা হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনে খুশি উদ্যাপন করা, হামদ-না’ত, দুরূদ-সালাম ও যিকির আযকারের মাধ্যমে জুলুস করতঃ উক্ত মহান নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং তার প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করা শরিয়ত সম্মত এবং তা ক্বোরআন করিমের আল্লাহর করুনা ও খাস রহমতকে স্মরণ করে খুশি উদযাপন করার নির্দেশের অনুসরণ মাত্র। আর মহান আল্লাহর নির্দেশে নূরানী ফেরেশতা কর্তৃক পালনকৃত একটি সুন্নাতের অনুকরণ মাত্র। যেমন ক্বোরআন করিমের সূরা ইউনুসে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- قل بفضل الله وبرحمته فبذالك فليفرحوا هو خير مما يجمعون- অর্থাৎ হে হাবীব! আপনি (বিশ্ববাসীকে) বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তারই দয়া (তথা প্রিয় মাহবুব (দ.)কে স্মরণ করে সেটার উপর তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের জমাকৃত সমস্ত ধন-সম্পদ ও নেক আমল সমূহ অপেক্ষা অধিক উত্তম। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় তফসীরে ‘‘আদ্ দুররুল মনসুরে’’ উল্লেখ করেছেন যে, রয়িসুল মুফাসসেরীন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা برحمته এর তফসীরে আল্লাহর প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার পবিত্র ও নূরানী জাতে পাক বলে বর্ণনা করেছেন। উল্লিখিত ব্যাখ্যা দ্বারা বুঝা গেল মহান আল্লাহর প্রিয় মাহবুব আক্বা ও মওলা হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন আল্লাহর অদ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ করুণা ও নেয়ামত। অতএব উল্লিখিত আয়াতের আলোকে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনকে উপলক্ষ করে তাঁরই শুভাগমনের মাসে শরিয়তসম্মত তরিকায় হামদ-না’ত, দুরূদ-সালাম, যিকির-আকার ও দোয়ার মাধ্যমে আনন্দ উৎসব করা এবং শান শওকত পূর্ণ জুলুস বের করা মহান আল্লাহর নির্দেশের বাস্তবায়ন যা মুস্তাহাব ও নবীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। যার বর্ণনা মাওয়াহেবে লাদুনিয়্যা কৃত ইমাম কসতলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, ও খাসায়েছুল কুবরা কৃত ইমাম সূয়ূতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি সহ অনেক নির্ভরযোগ্য কিাতবে বর্ণিত আছে।