প্রশ্নঃ আমরা জানি যে, ১২ রবিউল আউয়াল নবী করিম সরওয়ারে কায়েনাত [ﷺ] দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছেন এবং এই দিনে দুনিয়ার ইহজীবন হতে জাহেরীভাবে পর্দা করেছেন। প্রশ্ন হলো ঐ দিনে আমরা কী প্রিয় নবীর শুভাগমনের দিন হিসেবে ঈদে মিলাদুন্নবী করে ইবাদত-বন্দেগী-দরূদ-সালাম, খানা-পিনা-সদকা-খায়রাতের মধ্যে আনন্দ প্রকাশ করব? না প্রিয় নবীর ওফাত দিবস হিসেবে সিরাতুন্নবী বা ওফাতুন্নবীর নামে মাহফিল করে শোক প্রকাশ করবো� শরীয়তের আলোকে বিস্তারিত জানানোর আবেদন রইল।

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম (প্রশ্নকারী)

কদলপুর, রাউজান, চট্টগ্রাম।

✍🏻 উত্তরঃ প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্র মাসের ১২ রবিউল আউয়ালে আমাদের আক্বা ও মাওলা হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ [ﷺ] এ ধরাধামে পবিত্র মক্কায়ে মোকাররামায় শুভাগমন করেছেন। এটাকে ইমাম ইবনে হেশাম [رحمه الله عليه], ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাক [رحمه الله عليه] সহ অনেক মনীষীগণ কাওলে মাশহুর বা প্রসিদ্ধ বর্ণনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ দিনেও এ নূরানী মাসে ইমাম ইবনে জোজী [رحمه الله عليه], ইমাম আহমদ কাস্তলানী [رحمه الله عليه], মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে দাহিয়া [رحمه الله عليه], শায়খে মুহাক্কিক হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী [رحمه الله عليه], ইবনে হাজর মক্কী [رحمه الله عليه] এবং ইমাম বরজনজি [رحمه الله عليه] সহ বিশ্বের অধিকাংশ ইমাম, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণের মতে যুগে যুগে বিশ্বের মুসলমানগণ হুযূর আকরাম রাসূলে পাক [ﷺ]-এর ধরাবুকে বেলাদত শরীফ ও পবিত্র শুভাগমনের খুশী তথা ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] উদ্যাপন করে আসছেন। রবিউল আউয়াল শরীফে প্রিয়নবী [ﷺ]’র ওফাত শরীফ হওয়া সত্ত্বেও এ মাসে ওফাতুন্নবী বা ওফাত দিবস ইত্যাদি পালনার্থে শোক বা দুঃখ প্রকাশ করতে ইসলামী মনীষীগণ নিষেধ করেছেন। কেননা মহানবী [ﷺ] হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন, ‘‘আমার হায়াত অর্থাৎ দুনিয়ার বাহ্যিক জীবন যেভাবে তোমাদের জন্য মঙ্গলময় আমার ওফাত শরীফও তোমাদের জন্য মঙ্গলময় ও কল্যাণময় (দুঃখ বা শোকের বিষয় নয়)। রবিউল আউয়াল মাসে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ]’র অনুষ্ঠান পালন না করে যারা পবিত্র মাসে সীরাতুন্নবী বা ওফাতুন্নবী ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান করে থাকে তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো মিলাদুন্নবীর খুশী উদযাপন থেকে বিরত রেখে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভূতিকে ভিন্ন দিকে ফেরানোর অপচেষ্টা, অসৎ উদ্দেশ্যে এবং ষড়যন্ত্র মূলক যা মূলত: ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ]-এর বিরুদ্ধে চক্রান্ত।

আরো উল্লেখ্য যে, ১২ রবিউল আউয়াল ওফাত দিবস নির্ণয় করলেও প্রিয় রাসূলের ওফাতের শোক পালন করা শরীয়ত মোতাবেক নিষিদ্ধ। কারণ অধিকাংশ ফকিহগণের মতে ওফাতের শোক প্রকাশ ওফাতের তিন(০৩) দিন পর স্ত্রী ব্যতীত পরিবারের অন্যদের জন্য নিষিদ্ধ। তদুপরি আল্লাহর সম্মানিত নবী-রাসূলগণ [عليهم السلام]’র ইনতিকাল ও ওফাত দিবস উম্মতের জন্য শোকের নয়। বরং মঙ্গল ও কল্যাণময়। যা হাদিস দ্বারা স্বীকৃত। মূলত সাধারণ মানুষও আল্লাহর প্রিয় নবীগণের ওফাতের মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য।

উল্লেখ্য যে, পবিত্র হাদীসে প্রিয় নবী সরকারে দো’আলম [ﷺ] এরশাদ করেছেন-

[ انَّ من افضل اياكم يوم الجمعة فيه خلق ادم وفيه قبض الحديث- (سنن نسائى- صفحه ১৫০)]

অর্থাৎ তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে আফজল বা উৎকৃষ্ট দিন হচ্ছে জুমার দিন। কারণ ঐ দিনে হযরত আদম [عليه السلام]’কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ঐ দিনেই তাঁর ওফাত হয়েছে।

[সুনানে নাসায়ী:পৃষ্ঠা ১৫০]

হুযূর পাক [ﷺ] আরো ইরশাদ করেছেন-

[ ان هذا يوم عيد جعله الله للمسلمين- (سنن ابن ماجه- ৭৮) ]

অর্থাৎ এ জুমার দিবস হচ্ছে ঈদের দিন। এটাকে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।

[সুনানে ইবনে মাজাহ:পৃ. ৭৮]

সুতরাং পবিত্র হাদীসের আলোকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে জুমার দিনটি আবার একজন নবীর (হযরত আদম عليه السلام)-এর সৃষ্টির দিন আবার তাঁর ওফাতের দিনও। এটা সত্ত্বেও আল্লাহর প্রিয় নবী রাসূলে আকরাম [ﷺ] ওফাতের শোককে উপেক্ষা করে বাবা আদম নবীর সৃষ্টির দিবসের খুশিকেই স্থায়ীত্ব দান করেছেন এবং প্রত্যেক জুমার দিবসে ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে ঈদ বা খুশী উদ্যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, কোন কোন ঐতিহাসিক ১২ রবিউল আউয়ালকে প্রিয় নবীর ‘মিলাদ’ তথা পৃথিবীর বুকে শুভাগমনের দিবসের সাথে ‘ওফাত’ দিবস হিসেবে মেনে নিলেও উক্ত দিবস বা উক্ত মাসে ওফাত দিবসের শোক পালনের বৈধতা ওফাত শরীফের তিন(০৩) দিন পরই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মীলাদের খুশী কিয়ামত পর্যন্ত বাকী থাকবে। তাই এ মোবারক মাস ও দিবস ওফাত বা শোক দিবস নয় রবং মিলাদুন্নবী [ﷺ] ঈদ তথা প্রিয় রাসূলের ধরাবুকে শুভাগমনকে কেন্দ্র করে ইবাদত-বন্দেগী ও শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে উৎসব পালনই শরীয়ত সমর্থিত। যারা এ দিবস ও মাসকে ওফাতুন্নবী ও সীরাতুন্নবী পালনের মধ্য দিয়ে শোক পালন করার জন্য তৎপর তারা মূলত ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ। এ মাসে ও এ নূরানী দিবসে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মাহফিলে ঈদে মিলাদুন্নবীর বিরুদ্ধাচরণ। যা প্রকৃত ঈমানদারের কাম্য হতে পারে না।

এ বিষয়ে ইতোপূর্বে প্রকাশিত মাসিক তরজুমান ঈদে মিলাদুন্নবী [ﷺ] রবিউল আউয়াল সংখ্যা সমূহে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

[মা সাবাতা বিসসুন্নাহ্ কৃত- শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী [رحمه الله عليه], মাওয়াহেবুল লাদুনিয়া কৃত- ইমাম আহমদ কস্তালানী [رحمه الله عليه], আল্ হাবীলিল ফতোয়া কৃত- ইমাম জালালউদ্দীন সুয়ূতী [رحمه الله عليه] ও আননেমাতুল কুবরা আলাল আলম কৃত- ইমাম ইবনে হাজর মক্কী [رحمه الله عليه] ইত্যাদি]

।।।

মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান আলকাদেরী

প্রধান ফকিহ্-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।

মাসিক তরজুমান-Monthly Tarjuman (প্রশ্ন-উত্তর বিভাগ)

প্রকাশনায় : আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট

৩২১ দিদার মার্কেট, দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment