নবী করীম [ﷺ]-এঁর উর্দ্ধজগতের মো’জেযা সমূহের মধ্যে মি’রাজ গমন একটি বিস্ময়কর মো’জেযা। এজন্যই মি’রাজের আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ পাক ‘সোব্হানাল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন – যা কেবল আশ্চর্য্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ স্বরূপ কোরআনের ‘বিআব্দিহী’ শব্দটি তাৎপর্য্যপূর্ণ। কেননা, ‘আবদুন’ শব্দটি দ্বারা রুহ ও দেহের সমষ্টিকে বুঝান হয়েছে। তদুপরি- বোরাক প্রেরণ ও বোরাক কর্তৃক নবী করীম [ﷺ]-কে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সর্বোপরী স্বপ্নে বা রূহানীভাবে মি’রাজের দাবী করা হলে কোরাইশদের মধ্যে এত হৈ চৈ হতোনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামগণই স্বশরীরে মি’রাজ গমনের কথা স্বীকার করেছেন। মি’রাজের ঘটনাটি নবীজীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এর সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সঙ্কোচনের তত্ত্ব জড়িত রয়েছে। সূর্যের আলোর গতি সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছতে লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এ হিসেবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব- নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। অথচ নবী করীম [ﷺ] মূহুর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদরাতুল মোনতাহা, আরশ-কুরছি ভ্রমণ করে লা-মকানে আল্লাহর দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কালাম করে পুনরায় মক্কা শরীফে ফিরে আসেন। এসে দেখেন, বিছানা তখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি হতে পারে? নবী করীম [ﷺ]-এঁর নূরের গতি কত ছিল- এ থেকেই অনুমান করা যায়। কেননা, তিনি ছিলেন নূর। যাওয়ার সময় বোরাক ছিল – কিন্তু ফেরার সময় বোরাক ছিলো না (রুহুল বয়ান)। মি’রাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- অন্যান্য নবীগণের সমস্ত মো’জেযা নবী করীম [ﷺ]-এঁর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুছা (عليه السلام) তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈছা (عليه السلام) স্বশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام) স্বশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন। তাঁদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চমর্যাদায় আল্লাহ পাক নবী করীম [ﷺ]-কে নিয়ে সবার উপরে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুছা (عليه السلام) নিজে গিয়েছিলেন তূর পর্বতে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ]-কে আল্লাহ্তায়ালা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেশতাদের মিছিলসহকারে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাছে নিয়েছিলেন। সেখানে সমস্ত নবীগণকে স্বশরীরে উপস্থিত করে হুযুর করীম [ﷺ]-এঁর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগনের ইমাম হয়ে নবী করীম [ﷺ] নবীগণেরও নবী অভিষেক লাভ করেছিলেন। সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাটু, নাক ও কপাল) দিয়ে স্বশরীরে নামায আদায় করেছিলেন সেদিন। সমস্ত নবীগণ যে স্বশরীরে জীবিত, তারই বাস্তব প্রমাণ মিলেছিল মি’রাজের রাত্রে। সমস্ত নবীগণ আপন আপন রওযায় জীবিত। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১০৮৫) মি’রাজের রাত্রে নবী করীম [ﷺ]-কে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো জিব্রাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল ফেরেশতাসহ তাঁদের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেশতা দ্বারা। দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দেছে নবীগণের (عليهم السلام) দ্বারা। তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেশতা, হুর ও নবীগণের দ্বারা এবং চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। সিদরাতুল মুনতাহা এবং আরশ মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একশত বার সম্বর্ধনামূলক বাক্য دن منى يا محمد অর্থাৎ ‘হে প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকটে আসুন” - একথা বলে নবী করীম [ﷺ]-কে সম্মানিত করেছিলেন। কোরআন মজিদে ( ৪- سورة النجم – الآية ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى ( আয়াতটি এদিকেই ইঙ্গিতবহ- বলে ‘তাফসীরে মুগ্নী’ ও ‘মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাত শত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত। লেখকের নিকট কিতাবখানা সংরক্ষিত আছে। মি’রাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়তের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ নবুয়তের ২৩ বৎসরের দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুযুর [ﷺ]-এঁর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন। সন ছিল নবুয়তের দ্বাদশ সাল। তিনটি পর্যায়ে মি’রাজকে ভাগ করা হয়েছে। মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাছ পর্যন্ত মি’রাজের অংশকে বলা হয় ইসরা বা রাত্রি ভ্রমণ। বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মি’রাজ। সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশ ও লা-মকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ই’রাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মি’রাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কোরআন, হাদীসে-মোতাওয়াতি এবং খবরে ওয়াহেদ দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মি’রাজ প্রমাণিত। মি’রাজের প্রথম পর্যায়ঃ রজব চাঁদের ২৭ তারিখ সোমবার পূর্ব রাত্রের শেষাংশে নবী করীম [ﷺ] বায়তুল্লায় অবস্থিত বিবি উম্মেহানী (رضي الله عنها)-এঁর ঘরে অবস্থান করছিলেন। বিবি উম্মেহানী (رضي الله عنها) ছিলেন আবু তালেবের কন্যা এবং নবী করীম [ﷺ]-এঁর দুধবোন। উক্ত গৃহটি ছিল বর্তমান হেরেম শরীফের ভিতরে পশ্চিম দিকে। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়ায়াত মোতাবেক-গন্ডদেশ দিয়ে নবী করীম [ﷺ]-এঁর কদম মোবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই হুযুরের তন্দ্রা টুটে যায়। জিব্রাইল (عليه السلام) আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং নবীজীকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। সিনা মোবারক বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করে নূর এবং হেকমত দিয়ে পরিপূর্ণ করলেন। এভাবে মহাশূন্যে ভ্রমণের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করলেন। নিকটেই বোরাক দন্ডায়মান ছিল। বোরাকের আকৃতি ছিল অদ্ভুত ধরণের। গাধার চেয়ে উঁচু, খচ্চরের চেয়ে নীচু, মুখমন্ডল মানুষের চেহারাসদৃশ, পা উটের পায়ের মত এবং পিঠের কেশর ঘোড়ার মত (রুহুল বয়ান-সুরা ইসরাইল)। মূলতঃ বোরাক ছিল বেহেস্তী বাহন- যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমান্তে মাত্র এক কদম। নবী করীম [ﷺ] বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়াচড়া শুরু করলো। জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন- “তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেন- সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও।” বোরাক বললো, “কাল হাশরের দিনে নবী করীম [ﷺ] আমার জন্য আল্লাহর দরবারে শাফাআত করবেন বলে ওয়াদা করলে আমি স্থির হবো।” নবী করীম [ﷺ] ওয়াদা করলেন। বোরাক স্থির হলো। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিব্রাইল (عليه السلام) সামনে লাগাম ধরে, মিকাইল (عليه السلام) রিকাব ধরে এবং ইস্রাফিল (عليه السلام) পিছনে পিছনে অগ্রসর হলেন। পিছনে সত্তর হাজার ফেরেশতার মিছিল। এ যেন দুলহার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করীম [ﷺ] ছিলেন আরশের দুলহা (তাফসীরে রুহুল বয়ান)। মক্কা শরীফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদীনার রওযা মোবারকের স্থানে গিয়ে বোরাক থামলো। জিব্রাইলের ইশারায় তথায় তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। এভাবে ঈছা (عليه السلام)-এঁর জন্মস্থান বাইতুল লাহাম এবং মাদ্ইয়ান নামক স্থানে হযরত শুয়াইব (عليه السلام)-এঁর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করীম [ﷺ] দু’রাকাত করে নামায আদায় করলেন। এজন্যই বরকতময় স্থানে নামায আদায় করা ছুন্নত। এই শিক্ষাই এখানে রয়েছে। নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলাম- হযরত মুছা (عليه السلام) তাঁর মাযারে (জর্দানে) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছেন। অতঃপর জিব্রাইল (عليه السلام) বায়তুল মোকাদ্দাছ মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিব্রাইল (عليه السلام) বোরাককে রশি দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাছের ছাখরা নামক পবিত্র পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আযান দিলেন। সমস্ত নবীগণ (عليهم السلام) নামাযের জন্য দাঁড়ালেন। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ]-কে মোসল্লাতে দাঁড় করিয়ে ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করলেন। হুযুর [ﷺ] সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সত্তর হাজার ফেরেশতাকে নিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। তখনও কিন্তু নামায ফরয হয়নি। প্রশ্ন জাগে নামাযের আদেশ নাযিল হওয়ার পূর্বে হুযুর [ﷺ] কিভাবে ইমামতি করলেন? বুঝা গেল, তিনি নামাযের নিয়ম কানুন পূর্বেই জানতেন। নামাযের তা’লীম তিনি পূর্বেই পেয়েছিলেন – তানযীল বা নাযিল হয়েছে পরে। আজকে প্রমাণিত হলো- নবী করীম [ﷺ] হলেন ইমামুল মোরছালীন ও নবীউল আম্বিয়া (عليهم السلام)। নামায শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সর্বশেষ সভাপতি (মীর মজলিশ) হিসাবে ভাষণ রাখলেন নবী করীম [ﷺ]। তাঁর ভাষণে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে তিনি বললেন- “আল্লাহ পাক আমাকে আদম সন্তানগণের মধ্যে সর্দার, আখেরী নবী ও রাহমাতুল্লিল “আলামীন বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।” এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে। তা হলো- আম্বিয়ায়ে কেরামগণের মধ্যে চারজন ব্যতিত আর সকলেই ইতিপূর্বে ইনতিকাল করেছেন এবং তাঁদের রওযা মোবারকও বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। যে চারজন নবী জীবিত, তাঁরা হচ্ছেন- হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام) বেহেশতে, হযরত ঈসা (عليه السلام) আকাশে, হযরত খিযির (عليه السلام) জলভাগের দায়িত্বে এবং হযরত ইলিয়াছ (عليه السلام) স্থলভাগের দায়িত্বে। জীবিত ও ইনতিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (عليهم السلام) বিভিন্ন স্থান থেকে মূহুর্তের মধ্যে কিভাবে স্বশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত হলেন? তাফসীরে রুহুল বয়ানে এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়া হয়েছে- “জীবিত চারজন নবীকে আল্লাহ তায়ালা স্বশরীরে এবং ইন্তিকাল প্রাপ্ত আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে মেছালী শরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত করেছিলেন।” কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে স্বশরীরে উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। কেননা, নবীগণ অষ্ট অঙ্গ দ্বারা সিজদা করেছিলেন। নবীগণ ও অলীগণ মেছালী শরীর ধারণ করে মূহুর্তের মধ্যে আসমান জমিন ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত লোকদের মতই সব কিছু শুনতে ও দেখতে পারেন (মিরকাত ও তাইছির গ্রন্থ)। আধুনিক থিউসোফীতেও (আধ্যাত্মবাদ) একথা স্বীকৃত। ফিজিক্যাল বডি, ইথিক্যাল বডি, কস্যাল বডি, এস্ট্রাল বডি- ইত্যাদি রূপ ধারণ করা একই দেহের পক্ষে সম্ভব এবং বাস্তব বলেও আধুনিক থিউসোফীর বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন। আমরা মুসলমান। আল্লাহর কুদরত ও প্রদত্ত ক্ষমতার উপর আমাদের ঈমান নির্ভরশীল। এ বিষয়ে কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইখানায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায় মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে এবং শেষ হয় সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে। প্রথম আকাশে গিয়ে জিব্রাইল (عليه السلام) ডাক দিলেন প্রথম আকাশের ভারপ্রাপ্ত ফেরেশতাকে এবং দরজা খুলে দিতে বললেন। উক্ত ফেরেশতা পরিচয় নিয়ে হুযুর [ﷺ]-এঁর নাম শুনেই দরজা খুলে দিলেন। প্রথমেই সাক্ষাত হলো হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর সাথে। হুযুর [ﷺ] তাঁকে ছালাম দিলেন। কেননা ভ্রমণকারীকেই প্রথমে সালাম দিতে হয়। হযরত আদম (عليه السلام) নবীগণের আদি পিতা। তাই তাঁকে দিয়েই প্রথম অভ্যর্থনা শুরু করা হলো। হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর নেতৃত্বে অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং প্রথম আকাশের ফেরেশতারা উক্ত অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈছা, হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (عليهم السلام) এবং অন্যান্য নবী ও ফেরেশতারা অভ্যর্থনা জানালেন। হযরত যাকারিয়া (عليهم السلام) ও উক্ত অভ্যর্থনায় শরীক ছিলেন। নবী করীম [ﷺ] তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- “যখন আপনাকে করাত দ্বারা দ্বিখন্ডিত করা হচ্ছিল- তখন আপনার কেমন অনুভব হয়েছিল? উত্তরে যাকারিয়া (عليه السلام) বললেন- তখন আল্লাহ তায়ালা আমাকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন- “আমি তোমার সাথে আছি।” এতদশ্রবণে আমি মউতের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।” প্রকৃত আশেকগণের মউতের সময় নবীজীর দিদার নছিব হয়। তাই তাঁদের মউতের কষ্ট অনুভূত হয় না (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়াঃ যাকারিয়া অধ্যায়)। তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এঁর নেতৃত্বে অন্যান্য নবী ও ফেরেশতাগণ নবী করীম [ﷺ]-কে অভ্যর্থনা জানান এবং ছালাম কালাম বিনিময় করেন। চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (عليه السلام) ফেরেশতাগণসহ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ৬ষ্ঠ আকাশে হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায়কালে আশ্চর্য হয়ে বললেন- “এই যুবক নবী শেষকালে এসেও আমার পূর্বে বেহেস্তে যাবেন এবং তাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতের পূর্বে বেহেস্তে প্রবেশ করবে।” হযরত মুছা (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ] ও তাঁর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা দেখে আনন্দাশ্র ঝরিয়ে ছিলেন। যেমন মা সন্তানের কোন সুসংবাদ শুনতে পেলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তাঁর এই আফ্সোস ছিল আনন্দসূচক ও স্বীকৃতিমূলক- বিদ্বেষমূলক নয়, এটাকে ইর্ষা বলে। ইর্ষা শরিয়তে জায়েয- কিন্তু হাছাদ বা হিংসা করা জায়েয নয়। হযরত মুছা (عليه السلام) সে সময় নবী করীম [ﷺ]-এঁর নিকট একটি হাদীসের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। হাদীসটি হলো- নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেনঃ علماء امتي كانبياء بني اسراءيل অর্থাৎ “আমার উম্মতের যাহেরী-বাতেনী এলেম সম্পন্ন আলেমগণ বনী ইসরাইলের নবীগণের ন্যায় (এলেমের ক্ষেত্রে)। নবী করীম [ﷺ] উক্ত হাদীসের যথার্থতা প্রমাণের জন্য রূহানী জগত থেকে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) কে হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর সামনে হাযির করালেন। হযরত মুছা (عليه السلام) বললেন- “আপনার নাম কি? উত্তরে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) নিজের নাম, পিতার নাম, দাদার নাম, পরদাদার নাম সহ ছয় পুরুষের নাম বললেন। হযরত মুছা (عليه السلام) বললেন, আমি শুধু আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি। আপনি এত দীর্ঘ তালিকা পেশ করলেন কেন? ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) আদবের সাথে জবাব দিলেন- “আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে আপনিও তো আল্লাহ তায়ালার ছোট্ট একটি প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিলেন।” ইমাম গাযালীর (رحمه الله عليه) এলেম ও প্রজ্ঞা দেখে হযরত মুছা (عليه السلام) মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং হুযুর [ﷺ]-এঁর হাদীসখানার তাৎপর্য্য স্বীকার করে নিলেন। (রুহুল বয়ান তৃতীয় পারা ২৪৮ পৃষ্ঠা)। [এখানে একটি বিষয় তাৎপর্য্যপূর্ণ। হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরে মক্কার জমিনে প্রদত্ত হুযুর [ﷺ]-এঁর ভাষণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, আপন রওযা থেকে। অপরদিকে দুনিয়াতে আসার পূর্বে আলমে আরওয়াহ্ থেকে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه)-এঁর মত একজন বিজ্ঞ অলী আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে তুর পর্বতে ঘটে যাওয়া মুছা (عليه السلام)-এঁর ঘটনা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। এতে প্রমাণিত হলো- আল্লাহর নবী ও অলীগণকে আল্লাহ তায়ালা বাতেনী প্রজ্ঞা দান করেন- যাকে নূরে নযর বা ফিরাছাত বলা হয়। আল্লাহর অলীগণ আল্লাহ প্রদত্ত কাশ্ফ দ্বারা অনেক সময় মানুষের মনের গোপন কথাও বলে দিতে পারেন। ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله عليه) কুফার এক মসজিদে জনৈক মুছল্লিকে অযু করতে দেখে বলেছিলেন, “তুমি যিনা করে এসেছো। লোকটি অবাক হয়ে বললো, আপনি কিভাবে জানলেন? ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله عليه) বললেন- আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার অযুর পানির সাথে যিনার গুনাহ্ ঝরে পড়ছিল।” হাদীসেও অযুর পানির সাথে গুনাহ্ ঝরে পড়ার কথা উল্লেখ আছে। লোকটি ইমাম সাহেবের বাতেনী এলেম দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো এবং সাথে সাথে ইমাম সাহেবের হাতে তওবা করলো। বড়পীর হযরত গাউছুল আ’যম আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله عليه) বাহ্জাতুল আসরার কিতাবে বলেনঃ ان السعداء والاشقياء ليعرضون على عينى فى اللوح المحفوظ – অর্থাৎ “দুনিয়ার নেককার ও বদকার- সকলকেই আমার দৃষ্টিতে পেশ করা হয় লওহে মাহ্ফুযে।” লওহে মাহ্ফুযে নেককার-বদকার সকলের তালিকা রয়েছে। হযরত বড়পীর (رحمه الله عليه)-এঁর নযরও দুনিয়া থেকে লওহে মাহ্ফুযে নিবদ্ধ। এজন্যই মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী (رحمه الله عليه) মসনবী শরীফে বলেছেনঃ لوح محفوظ است پیش اولیا -آنچه محفوظ است محفوظ از خطا – অর্থাৎ “লওহে মাহফুয অলী-আল্লাহগণের নযরের সামনে। একারণেই তাঁদের দিব্যদৃষ্টি সমস্ত ক্রটি থেকে মুক্ত।”] হযরত মুছা (عليه السلام) থেকে বিদায় নিয়ে নবী করীম [ﷺ] জিব্রাইল (عليه السلام) সহ সপ্তম আকাশে গেলেন। সেখানে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ফেরেশতাগণসহ নবী করীম [ﷺ]-কে অভ্যর্থনা জানালেন। নবী করীম [ﷺ] ইরশাদ করেন- “আমি হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কে একটি কুরছিতে বসে বাইতুল মামুর মসজিদের গায়ে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়েছি” (রুহুল বয়ান)। হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) দুনিয়াতে আল্লাহর ঘর কা’বা শরীফ তৈরী করেছিলেন। তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সপ্তাকাশের বাইতুল মামুর মসজিদের মোতাওয়াল্লীর সম্মান দান করেছেন। দীর্ঘ এক হাদীসে এসেছে- বাইতুল মামুরে হুযুর [ﷺ]-এঁর সাথে নামায আদায় করেছিলেন সাদা পোষাকধারী একদল উম্মত- যাদের মধ্যে গাউসুল আযমও ছিলেন। (আ’লা হযরতের ইরফানে শরিয়ত তৃতীয় খন্ড)। আসমানে ভ্রমণের সময়ই নবী করীম [ﷺ] বেহেস্ত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করেন। পরকালে বিভিন্ন পাপের কি রকম শাস্তি হবে, তার কিছু নমুনা তিনি মেছালী ছুরতে প্রত্যক্ষ করেছেন। সুদ, ঘুষ, অত্যাচার, নামায বর্জন, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ, প্রতিবেশীর উপর যুলুম, স্বামীর অবাধ্যতা, বেপর্দা ও অন্য পুরুষকে নিজের রূপ প্রদর্শন, যিনা, ব্যাভিচার ইত্যাদির শাস্তি নবী করীম [ﷺ] স্বচক্ষে দেখেছেন। বেহেস্তে হযরত খদিজা (رضي الله عنها)-এঁর জন্য সংরক্ষিত প্রাসাদ, হযরত ওমরের (رضي الله عنه) প্রাসাদ, হযরত বেলালের (رضي الله عنه) পাদুকার আওয়ায- এসব দেখেছেন এবং শুনেছেন। বেহেস্তের চারটি নহরের উৎসস্থল নবী করীম [ﷺ]-কে দেখান হয়েছে। ”বিছ্মিল্লাহ”র চারটি শব্দের শেষ চারটি হরফ থেকে (م-ه-ن-م) চারটি নহর প্রবাহিত হয়ে হাউযে কাউছারে পতিত হতে দেখেছেন। দুধ, পানি, শরবত ও মধু এই চার প্রকারের পানীয় বেহেস্তবাসীকে পান করানো হবে। যারা ভক্তি ও ঈমানের সাথে প্রত্যেক ভাল কাজ “বিছ্মিল্লাহ” বলে শুরু করবে, তাদের জন্য এই নেয়ামত রাখা হয়েছে। (তাফসীরে রুহুল বয়ানে বিছমিল্লাহর ব্যাখ্যায় এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে)। সপ্ত আকাশ ভ্রমণের পর জিব্রাইল (عليه السلام) খাদেম বা প্রটোকল হিসাবে নবী করীম [ﷺ]-কে সিদরাতুল মুনতাহা বা সীমান্তের কুলবৃক্ষের নিকট নিয়ে যান। হাদীসে এসেছে- “এ বৃক্ষের পাতা হাতীর কানের মত এবং ফল ওহোদ পাহাড়ের ন্যায় বিশাল। শহীদগণের রূহ মোবারক সবুজ পাখীর ছুরতে উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করছেন। নবী করীম [ﷺ] স্বচক্ষে তা দর্শন করেছেন। সিদরা বৃক্ষ পৃথিবীর সপ্ত তবক নীচ থেকে চৌদ্দ হাজার বছরের রাস্তার উপরে অবস্থিত। সিদরা থেকে আরশের দূরত্ব ছত্রিশ হাজার বৎসরের রাস্তা। সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার বৎসরের দূরত্বে আরশে মোয়াল্লা। (ইবনে আব্বাস)। আরশে মোয়াল্লা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ ফেরেশতাগণের নিকট আসে। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) সিদরাতুল মুনতাহা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ গ্রহণ করে থাকেন। এখানে এসেই জিবরাঈলের সীমানা শেষ হয়ে যায়। মি’রাজের তৃতীয় পর্যায়ঃ সিদরা হতে আরশে আযীম পর্যন্ত সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছে জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ] থেকে বিদায় নিলেন এবং বললেনঃ لو دنوت منها أنملة لا حرقت وفى رواية شعرة – অর্থাৎ “সিদরাতুল মুনতাহা থেকে এক আঙ্গুল – অন্য রেওয়ায়তে চুল পরিমাণ অগ্রসর হলে আমার ছয়শত নূরের পাখা আল্লাহ্ পাকের নূরের তাজাল্লীতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।” সোব্হানাল্লাহ! যেখানে নূরের ফেরেশতা জিব্রাইল (عليه السلام) জ্বলে যায়, সেখানে আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ] স্বশরীরে স্বাচ্ছন্দে সামনে অগ্রসরমান। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থের প্রারম্ভে হযরত জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টির হাদীসখানা আর একবার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- “তিনি আল্লাহর যাতী নূরের জ্যোতি হতে পয়দা হয়েছেন।” বুঝা গেল- তিনি মাটি নন। মাটি হলে তথায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতেন। জিব্রাইল (عليه السلام) আমাদের নবীজীর [ﷺ] নূরের সামান্যতম অংশের তাজাল্লী দিয়ে সৃষ্ট। যেখানে জিব্রাইলের সীমানা শেষ, সেখান থেকে আমাদের নবীজীর [ﷺ] যাত্রা শুরু। হাকিকতে মুহাম্মদী [ﷺ] সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করতে হবে- সিদরাতুল মুনতাহার পরে জিব্রাইল (عليه السلام) নবীজীকে কেমন দেখেছিলেন। জিব্রাইলও বলতে পারবেনা – তার পরের ঘটনা কি ঘটেছিল। ফিরতি পথে হুযুর [ﷺ]-এঁর স্বরূপ কেমন ছিল - তা জানতে হবে মুছা (عليه السلام)-এঁর কাছে। সেদিন তিনি প্রকৃতপক্ষে কাকে দেখেছিলেন? বিদায়ের সময় জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম [ﷺ]-এঁর কাছে একটি আরয পেশ করেছিলেন- “আল্লাহ যেন হাশরের দিনে জিব্রাইলকে পুলছিরাতের উপর তার ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দান করেন।” উম্মতে মুহাম্মদী যেন উক্ত পাখার উপর দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে যেতে পারে। নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর দরবারে জিব্রাইলের এই ফরিয়াদ পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ছাহাবায়ে কেরাম ও আহলে মহব্বতের লোকদের জন্য তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আল্লাহ্ পাক বলেছিলেন, هذا لمن صحبك وأهل محبتك (মাওয়াহেব লাদুন্নিয়া)। অর্থাৎ “জিব্রাইলের পাখার ওপর দিয়ে পুলছিরাত অতিক্রম করার আরজি মঞ্জুর করা হলো-আপনার সাহাবী এবং আশেকানদের জন্য।” এই দুই শ্রেণীর লোক জিব্রাইলের পাখার উপর দিয়ে পুলছিরাত পার হয়ে যাবে। জিব্রাইল (عليه السلام) থেকে বিদায় হওয়ার পর রফরফ নামে এক বাহন এসে নবী করীম [ﷺ]-কে আরশে আযিমে পৌঁছিয়ে দেয়। এ পথে নবী করীম [ﷺ] সত্তরটি নূরের পর্দা ভেদ করেন। এক এক পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। এ হিসাবে ৩৬ হাজার বৎসরের রাস্তা অতিক্রম করে নবী করীম [ﷺ] আরশে মোয়াল্লায় পৌঁছলেন। এ পথে যখন তিনি একাকীত্ব অনুভব করছিলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-এঁর আওয়ায শুনতে পেয়ে শান্ত হয়েছিলেন। আর একটি আওয়াজও তিনি শুনতে পেয়েছিলেনঃ قف يا محمد فان ربك يصلى অর্থাৎঃ “হে প্রিয় মুহাম্মদ [ﷺ], আপনি একটু থামুন, আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।” আল্লাহর সাথে দীদারের সময় নবী করীম [ﷺ] এ দু’টি বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমার সালাত অর্থ আপনার উপর দরূদ পাঠ করা। আর আবু বকরের সুরতে এক ফেরেশতা সৃষ্টি করে আবু বকরের আওয়াজ নকল করা হয়েছিল- যেন আপনি শান্ত হন। মহিউদ্দিন ইবনে আরবী (رحمه الله عليه)-এঁর তাফসীরে বলা হয়েছে- হযরত আবু বকর সিদ্দিকই (رضي الله عنه) রূহানীভাবে ফেরেশতার সূরতে তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা ছিল তাঁর কারামত। কেননা, তিনি ছিলেন রাসুলে পাকের নিত্য সঙ্গী। তিনি দুনিয়াতে, মাযারে, হাশরের ময়দানে এবং জান্নাতেও নবী করীম [ﷺ]-এঁর সঙ্গী থাকবেন। সুতরাং মি’রাজে রূহানীভাবে উপস্থিত থাকা খুবই স্বাভাবিক (দেখুন ইরফানে শরিয়ত)। আরশে পৌঁছার পর লাওহে মাহফুয অবলোকনকালে নবী করীম [ﷺ] দেখতে পেলেন, তথায় শেষ বাক্যটি লেখা ছিল এরূপঃ قد سبقت رحمتى على غضبى অর্থাৎঃ “আমার গযবের উপর আমার রহমত প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে।” উক্ত হাদীসে কুদসীর মধ্যে উম্মতের জন্য একটি গোপন ইশারা নিহিত রয়েছে। তা হলো- কিছু শাস্তি ভোগ করার পর সমস্ত হকপন্থী উম্মতই আল্লাহর রহমতে নাজাত পাবে। [বুখারীঃ ৭০৪৪ ইফাবা] নবী করীম [ﷺ] আরশকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি সমগ্র জাহানের জন্য রহমত- তোমার জন্য কিরূপে রহমত? আরশ তখন আরয করলো- আল্লাহ তায়ালা যখন আমার মধ্যে কলেমার প্রথম অংশ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ লিখলেন, যখন আল্লাহর জালালী শানে আমার মধ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল- যেন আমি টুকরো হয়ে যাব। তারপর যখন তার পার্শ্বে আপনার জামালী নামের অংশটুকু- ‘মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’ লিখে দিলেন- তখন আমার কম্পন বন্ধ হয়ে গেল (শানে হাবীব)! সুতরাং আপনি আমার জন্য বিরাট রহমত। লা মাকানের উদ্দেদ্দ্যে রওনা আরশ মোয়াল্লা হতে এবার লা-মাকানের দিকে- অজানা পথে রওনা দিলেন নবী করীম [ﷺ] - যেখানে স্থান-কাল বলতে কিছুই নেই। সমগ্র সৃষ্টি জগতই তখন নবীজির কদমের নীচে। আসমান, জমিন, চন্দ্র-সূর্য আরশ কুর্ছি- সবকিছু, এমন কি আলমে খালক (সৃষ্টি জগত) ও আলেমে আমর (নির্দেশ জগত) সবকিছু নবী করীম [ﷺ]-এর পদতলে রয়ে গেল। তিনি সমস্থ কিছু অতিক্রম করে আল্লাহর এত নিকটবর্তী হলেন যে, দুই ধনুকের চার মাথার ব্যবধান বা তার চেয়েওে কম ব্যবধান রয়ে গেল। এটা রহস্য জগত। এ অবস্থাকে মুতাশাবিহাত বা দুর্বোধ্য অবস্থা বলা হয়। কোরআন মজিদে এই মাকামকে قاب قوسين বলা হয়েছে। শারিরীক সান্নিধ্য এখানে উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য ও ঘনিষ্ট সান্নিধ্য বুঝানো। তাফসীরে রুহুল বয়ান ৩য় পারা প্রথম আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করা হয়েছে যে, “নবী করীম [ﷺ]-এঁর নূরানী সুরতের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল সে সময়। তাঁর বাশারিয়াত সে সময় উন্নত হতে হতে নূরে ওয়াহ্দানিয়াতের মধ্যে মিলে গিয়েছিল” যেমন মিশে যায় পানিতে চিনি। এই মাকামকে তাসাওফের ভাষায় ‘ফানা’ বলা হয়। রুহুল বায়ানের এবারতটুকু নিম্নে পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করা হল। انه عليه السلام ما يبقى في مكان ولا في الامكان في ليلة المعراج لانه كان فانيا عن ظلمة وجوده -باقيا بنور وجوده -ولهذا سماه الله نورا في قوله ثعالي قد جاء كم من الله نور وكثاب مبين – অর্থঃ- “নবী করীম [ﷺ] লাইলাতুল মিরাজে কোন স্থানে বা সৃষ্টি জগতের সীমাবদ্ধ ছিলেন না। কেননা, তখন তিনি তাঁর জড় অস্তিত্বের অন্ধকার ভেদ করে ফানা হয়ে আল্লাহর নূরের অস্তিত্বে অস্তিত্ববান হয়েছিলেন। এ কারণেই কোরানে মজিদে ( সুরা মায়েদা-১৫) আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘নূর‘ বলে আখ্যায়িত করে এরশাদ করেছেন, হে জগতবাসী, তোমাদের কাছ থেকে আল্লার পক্ষ হতে প্রথমে এক মহান নূর ও পরে একটি স্পষ্ট কিতাব এসেছে।“ বুঝা গেল- তিনি দুনিয়াতে আগমনকালে নূর ছিলেন- মাটি নয়। যারা মাটি বলে – তারা ভ্রান্ত। (তাফসীর রুহুল বয়ান পৃ: ৩৯৫ তৃতীয় পারা ১ম আয়াত)। উক্ত আয়াতের পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল “ক্বাবা কাওছাইন” মাকামে। আল্লাহর সাথে কালাম মহান আল্লাহ রাব্বুল ’আলামীনের সাথে নবী করীম [ﷺ]-এর কি কি কথোপকথন হয়েছিল, তা কোরআনে গোপন রাখা হয়েছে। শুধু এরশাদ করা হয়েছেঃ فاوحي الي عبده ما أوحى – অর্থঃ- ‘যা গোপনে বলার- আল্লাহ তায়ালা তা আপন প্রিয় বান্দার কাছে গোপনেই বলে দিয়েছেন’। নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেঃ اوتيت العلوم وأمرت بكتمان بعضها অর্থঃ- “আমাকে অনেক প্রকারের গুপ্ত-সুপ্ত এলেম দান করা হয়েছে এবং সাথে সাথে ঐ এলেমের কোন কোন বিষয় গোপন রাখতে আমাকে নির্দেশ করা হয়েছে।” “কাসাসুল আম্বিয়া” নামক উর্দ্দু কিতাব নব্ব্ই হাজার কালামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ত্রিশ হাজার কালাম হাদিসের আকারে সকলে জন্য এবং ত্রিশ হাজার কালাম খাছ খাছ লোকদের নিকট প্রকাশ করার জন্য এবং অবশিষ্ট ত্রিশ হাজার সম্পূর্ণ নিজের কাছে গোপন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীরে ছাভী দেখুন নিছা-১১৩ আয়াত) তাফসীরে রুহুল বায়ানে বর্ণনা করা করা হয়েছে যে, নবী করীম [ﷺ] এক পর্যায়ে আল্লাহর দরবারে আরয করেছিলেন- “আমার উম্মতকে সর্বশেষে এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী করে কেন পাঠানো হলো এবং তাদের হায়াত পূর্বের তুলনায় কম রাখা হল কেন? উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, “আপনার উম্মতগণ যেন গুনাহ করার সময় কম পায়। সেজন্য তাদের হায়াত সংকীর্ণ করেছি এবং আপনার উম্মত যেন কম সময় কবরে থাকে- তাই তাদেরকে কিযামতের নিকটবর্তী সময়ে সর্বশেষ প্রেরণ করেছি। সুবহানাল্লাহ্! [এই সময়ের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক জ্ঞানী লোকের উচিত। নবীজির [ﷺ] উম্মত হওয়ার কারণেই আমাদেরকে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।] প্রত্যক্ষ দর্শনঃ আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছার পর প্রথমে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর প্রশংসা করলেন এভাবে- التحيات لله والصلوات والطيبات – অর্থঃ- “আমার জবান, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও ধন সম্পদ দ্বারা যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য হাদিয়া স্বরূপ পেশ করছি।” এর উত্তরে আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে সালাম দিয়ে বললেন- السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته – অর্থঃ- “হে আমার প্রিয় নবী, আপনার প্রতি আমার সালাম, রহমত ও বরকতসমূহ বর্ষিত হোক।” উক্ত সালামের জবাবে নবী করীম [ﷺ] আরয করলেন- السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين – অর্থঃ- “হে আল্লাহ! তোমার সালাম এবং আমি আমার গোনাহগার উম্মতের উপর এবং তোমার অন্যান্য নেককার বান্দাদের উপর বর্ষিত হোক”! আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের এই ছালাম বিনিময়ের কৌশলপূর্ণ উক্তি ও ভালবাসার নমুনা এবং উম্মতের প্রতি নবীজির [ﷺ] স্নেহ-মমতা দেখে ও শুনে জিব্রাইল সহ আকাশের মোকাররাবীন ফেরেশতাগণ সমস্বরে বলে উঠলেন- أشهر أن لا إله إلا الله واشهد ان محمدا عبده ورسوله অর্থঃ- “আমি (প্রত্যেকে) সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ] আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং তাঁর প্রিয় রাসূল।” “আল্লাহর কাছে তিনি প্রিয় বান্দা- কিন্তু বিশ্ব জগতের কাছে তিনি প্রিয় রাসূল।” কি যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক এখানে বর্ণনা করা হয়েছে- তা কেবল মহাজ্ঞানীরাই অনুধাবন করতে পারবেন। আল্লাহ তায়ালা নিজের ও হাবীবের মধ্যে ভাব বিনিময়ের এই তাশাহুদ আমাদের নামাযের একটি ওয়াজিব অংশ করে দিয়েছেন। এর প্রতিটি শব্দ নামাযের বৈঠকে ওয়াযিব। আল্লাহ তায়ালার দরবারে নবী করীম [ﷺ] যেভাবে সম্মোধনমূলক তাহ্যিয়াত পাঠ করে ছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা যেভাবে সম্মোধন করে নবীজিকে [ﷺ] সালাম দিয়েছিলেন, অনুরূপভাবে তাশাহুদ পড়ার সময় প্রত্যেক মুছল্লিকে আল্লাহকে সম্মোধন করে তাহিয়্যাত অংশটুকু পাঠ করতে হবে এবং নবী করীম [ﷺ]-কেও সম্মোধন করে সালাম পেশ করতে হবে। ফতোয়ে শামীর এবারত দেখুন- ويقصد بها الإنشاء لا الاخبار – অর্থঃ- “আল্লাহর তাহিয়্যাত এবং রাসূলের প্রতি ছালাম পাঠকালীন সময়ে খেতাব বা সম্মোধন করতে হবে।” (ফতোয়ায়ে আলমগীরী ও বাহারে শরীয়ত দ্রষ্টব্য)। যেহেতু মু’মিনদের নামায মি’রাজ স্বরূপ- সুতরাং মি’রাজের মতই আল্লাহ ও রাসূলকে সম্মোধন করতে হবে। সম্মোধন করা হয় হাযির নাযির ব্যাক্তিকে। সুতরাং নবীজি [ﷺ] হাযির-নাযির। (ইমাম গাযালীর ইহইয়া) উম্মতের জন্য মাগফিরোতের সুপারিশঃ রিয়াজুন্নাছেহীন কিতাবে তাফসীরে মুগনী ও মিরছাদুল ইবাদ নামক দুটি গ্রন্থের সূত্রে বর্ণিত আছে – নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমার কাছে কি প্রার্থনা করেন”? নবী করীম [ﷺ] বললেন- “হে আল্লাহ, আপনি রাব্বুল ’আলামীন, আর আপনি আমাকে বানিয়েছেন রাহমাতুল্লিল ’আলামীন হিসেবে। আমার উম্মত বেশুমার গুনাহগার মুযনেবীন। আমার খাতিরে আমার গুনাহগার উম্মতকে মাফ করে দিন।” আল্লাহ তায়ালা বলেন- “আপনার খাতিরে আপনার উম্মতের মধ্যে হতে সত্তর হাজারকে ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। এরপর আর কি প্রার্থনা আছে?” নবী করীম [ﷺ] পুনরায় গুনাহগার উম্মতের উল্লেখ করেলেন। এভাবে ৭০০ (সাতশত) বার প্রার্থনা করলেন। প্রত্যেকবার সত্তর হাজার গুনাহগার উম্মতের ক্ষমার ঘোষণা করলেন পাক পরওয়ারদেগার। এভাবে চার কোটি নব্বই লক্ষ উম্মতকে ঐ দিন ক্ষমার আওতায় আনা হল। নবী করীম [ﷺ] উম্মতের মায়ায় আবারও আরয পেশ করলেন। আল্লাহ তায়ালা এবার বলেন- “এখন আপনি ও আমি একা। হাশরের ময়দানে ফেরেশতা, আম্বিয়া, আউলিয়া ও হাশরবাসীদের সবার সামনে অবশিষ্টকে ক্ষমা করবো। আপনি চাইবেন- আমি দিবো। সবাই স্বাক্ষী থাকবে এবং আপনার মর্তবা তখন সকলেই উপলদ্ধি করবে।” সুবহানাল্লাহ্। এমন এক শাহী দরবারে গিয়েও নবী করীম [ﷺ] নিজের ও পরিবারের জন্য কিছুই না চেয়ে শুধু গুনাহগার উম্মতের নাজাত প্রার্থনা করেছেন। সত্যিই তিনি ঈমানদারদের জন্য রাউফুর রাহীম। সুরা তাওবার শেষাংশে এরশাদ হয়েছেঃ بالمءمنين رؤوف الرحيم – অর্থঃ- “নবী করীম [ﷺ] মু’মিনদের জন্য স্নেহময় ও দয়াশীল।” এই স্নেহ ও দয়ার বহিঃ প্রকাশ হয়েছিল মি’রাজ রাত্রীতে এবং ভাবিষ্যতে হবে হাশরের ময়দান। আল্লাহর ভয়ে কেউ সুপারিশের জন্য অগ্রসর হবে না- তখন নবী করীম [ﷺ] হতাশ হাশরবাসীকে অভয় দিয়ে বলবেন, انا لها “তোমাদের শাফায়তের জন্য আমি আছি”- (বোখারি ও মুসলিম)। সুবহানাল্লাহ্! মিরাজ হতে ষষ্ঠ আকাশে প্রত্যাবর্তন ও পূনঃ গমন অনেক রায ও নেয়াযের কথার পর আল্লাহ তাযালা উম্মতে মুহাম্মদীর উপর দিনে রাত্রে ৫০ (পঞ্চাশ) ওয়াক্ত নামায ফরয করলেন এবং নবী করীম [ﷺ]-কে বিদায় দিলেন। নবী করীম [ﷺ] যখন ষষ্ঠ আকাশে আসলেন, তখন মুছা (عليه السلام)-এর সাথে সাক্ষাত হলো। সিদরাতুল মুনতাহাতে জিব্রাইল (عليه السلام), কিংবা সপ্তম আকাশে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কিংবা অন্য কোন আকাশে অন্যান্য নবীগনের সাথে সাক্ষাতের উল্লেখ কোন হাদিস গ্রন্থে দেখা যায় না। শুধু মুছা (عليه السلام)-এর উল্লেখ রয়েছে। [(বুখারী ৭৫১৭, ই ফাঃ ৭০০৯, মুসলিমঃ ১৬২, আহমাদঃ ১২৫০৭) মুসলীম, মিশকাত প্রভৃতি হাদিস গ্রন্থ)] হযরত মুছা (عليه السلام) আরয করলেন- “কত ওয়াক্ত নামায ফরয করা হলো আপনার উম্মতের উপর?” হুযুর [ﷺ] বললেন- “পঞ্চাশ ওযাক্ত”। মুছা (عليه السلام) বললেন, “আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি – আপনার উম্মত তা আদায় করতে পারবে না। কেননা, আমার উম্মতের উপর কম হওয়া সত্বেও তারা তা আদায় করতে পারেনি। আপনি রবের কাছে আবার ফিরে যান এবং হাল্কা করার প্রার্থনা করুন। হাদীসের এবারত নিম্নরূপ- ارجع الى ربك واسءل التخفيف – অর্থঃ- “ আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং হাল্কা করার দরখাস্ত পেশ করুন।” হুযুর [ﷺ] এরশাদ করেন – “অতঃপর আমি ফরে গেলাম। আল্লাহ তায়ালা এবার পাঁচ ওয়াক্ত কমালেন। আমি পুনঃ ৬ষ্ঠ আকাশে ফিরে আসলাম। এবারও মুছা (عليه السلام) পুনরায় আমার রবের কাছে ফিরে যেতে আরয করলেন।” এই ভাবে নয় বার ৬ষ্ঠ আকাশ থেকে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর দরবারে যাওয়া-আসা করলেন। আল্লাহ তায়ালা প্রতি বার পাঁচ ওয়াক্ত করে নামায কমাতে থাকলেন এবং পঞ্চাশের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ ওয়াক্ত কমিয়ে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত বাহাল রাখলেন। এবারও হযরত মুছা (عليه السلام) পুনরায় আল্লাহর দরবারে ফিরে যাওয়ার জন্য আরয পেশ করলেন। নবী করীম [ﷺ] বললেন- “আমি পাঁচ ওয়াক্তেই রাজী হলাম। পুনরায় ফিরে যেতে লজ্জা লাগে।” আল্লাহন পাক সাথে সাথে ওহী নাযেল করলেনঃ لاتبديل لكلمات الله – অর্থাৎ- “আল্লাহ ফায়সালার আর কোন পরিবর্তন হবে না।” তবে আল্লাহ তায়ালা শান্তনা দিয়ে নবী করীম [ﷺ]-কে বললেন, “আপনার উম্মত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করলে আমার এখানে পঞ্চাশ ওয়াক্তই লিখা হবে। সুতরাং আপনার উম্মতকে ওয়াক্ত দেয়া যেমন ঠিক, তেমনভাবে আমার পঞ্চাশ ওয়াক্তের নির্দেশও ঠিক। পার্থক্য শুধু সংখ্যায়- গুণে নয়।” সুবাহানাল্লাহ! আল্লা্হর কি অসীম দয়া! বান্দা পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করবে, আর আল্লাহ তায়ালা তার দশগুণ করে রেকর্ড করবেন! পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার হেকমত তাফসীরে রুহুল বায়ান, ইতকান, বেদায়া নেহায়া- প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ফজর নামাজ হযরত আদম (عليه السلام) আদায় করতেন। যোহরের নামায হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام), আসরের নামায হযরত ইউনুস (عليه السلام), মাগরিবের নামায হযরত ঈছা (عليه السلام)এবং এশার নামায হযরত মুছা (عليه السلام) আদায় করতেন। আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করে পাঁচজন পয়গাম্বরের পাঁচ ওয়াক্ত নামায একত্রিত করে উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করলেন। সুতরাং নামাযের ইবাদতটি নবীগণের স্মৃতি বহনকারীও বটে। [মূলতঃ প্রত্যেক এবাদতের মধ্যেই, এমনকি- প্রত্যেক তসবিহ’র মধ্যেও কোন না কোন নবী, অলী অথবা ফেরেশতার ইবাদত বা স্মৃতি বিজড়িত রয়েছে, যেমন- হজ্বের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام), কোরবনীর মধ্যে হযরত ইসমাইল (عليه السلام), সাঈ-এর মধ্যে বিবি হাযেরা এবং আরফাতে অবস্থানের মধ্যে হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর স্মৃতি জড়িত। নামাযের মধ্যে কিয়াম, রুকু, সিজদা, তছবিহ্-ইত্যাদি ফেরেশতাদের স্মৃতি- নবী করীম [ﷺ] মি’রাজে প্রত্যক্ষ করে প্রথমে নিজে আমল করেছেন। পরে আমাদেরকে হুকুম করেছেন- হুযুর [ﷺ]-কে দেখে দেখে অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং নবী করীম [ﷺ]-এঁর অনুকরণ ও অনুসরণের নামই ইবাদত- যার মধ্যে রয়েছে অন্যদের স্মৃতি বিজড়িত (জালালুদ্দীন সূয়ুতি কৃত শরহে সুদূর)। এখানে প্রশ্ন জাগে- মি’রাজ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে শুধু মুছা (عليه السلام)-এর সাথে হুযুর [ﷺ]-এর সাক্ষাৎ এবং তাঁর অনুরোধে বারবার আল্লাহর দরবারে নবী করীম [ﷺ]-এর যাতায়াত কি আল্লাহর ইচ্ছায় এবং পরিকল্পনা মোতাবেক হয়েছিল- নাকি নবীজির [ﷺ] ইচ্ছায় হয়েছিল? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। সাথে সাথে আর একটি প্রশ্নও এসে যায়। তাহলো- নবী করীম [ﷺ] বার বার আল্লাহর দরবারে গেলেন কিসে করে এবং দুনিয়াতে ফেরত আসলেন কেমন করে? আর একটি প্রশ্ন জাগে -মুছা (عليه السلام) কি উদ্দেশ্যে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য সুপারিশ করেছিলেন? অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিহীত ছিল কিনা? বিভিন্ন কিতাবে এসবের উত্তর দেয়া আছে। নিম্নে তা ক্রমান্বয়ে বর্ণনা করা হলো। ১। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলোঃ আল্লাহ তায়ালার পূর্ব পরিকল্পনা মোবাবেকই হযরত মুছা (عليه السلام) ৬ষ্ঠ আকাশে অপেক্ষমাণ ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল- তাঁর প্রিয় হাবীব বারবার তাঁর দরবারে ফিরে যাক এবং বারবার তাঁর সাথে হাবীবের দীদার নসিব হোক। (তাফসীরে সাভী) ২। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হচ্ছেঃ ষষ্ঠ আকাশ থেকে আল্লাহর দরবারে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বা দুনিয়াতে ফেরত আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদিসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলা হয়েছেঃ যেভাবে বোরাকে নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ গমন করেছেন, সেভাবে ফেরত এসেছেন। এটাই স্বাভাবিক ধারণা। তাফসীরে রুহুল বায়ান তাফসীরে রুহুল মাআনীরও পূর্বে রচিত- তাই এর মতামত অধিক শক্তিশালী। উক্ত তাফসীরে রুহুল বায়ানের গ্রন্থকার সুরা নাজম-এর তিন আয়াত-এঁর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ والنجم -إذا هوى -ما ضل صاحبكم وما غوى – অর্থঃ-“নিম্নগামী তারকার শপথ! তোমাদের সাথী মুহাম্মদ [ﷺ] কখনও পথ ভুলেননি বা প্রথভ্রষ্ট হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি।” তাফসীরকারক বলেন- উক্ত আয়াত মি’রাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (رضي الله عنه)-এঁর মতে ‘নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করীম [ﷺ]-কেই বুঝান হয়েছে। কেননা হুযুর [ﷺ]-এঁর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম।” আর هوى অর্থঃ- নিন্মগামী। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় – “আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-এঁর শপথ।” আর ‘পথ ভুলেননি বা টের বাঁকা হননি’- এই মন্তব্যর অর্থঃ যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেপথেই ফিরত গিয়েছেন।” বোরাক বা রফরফের মাধ্যেমে প্রত্যাবর্তন করলে একথার প্রয়োজন হত না। কেননা, তখন তো বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো। সুতরাং নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ থেকে আসা কালীন সময়ে আল্লাহর কুদরতে একা একা যাতায়াত করেছেন- এটাই সুস্পষ্ট। কেননা, তিনি তো নূর। নূর ও আলো সব কিছু ভেদ করে সোজা গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত (তাফসীরে ইবনে আব্বাস রুহুল বায়ান-সুরা আন নাজম)। শুধু বাইতুল মোক্কাদাছে এসে বোরাকে আরোহণ করে তিনি মক্কায় পৌছেন। ৭০০ বৎসর পূর্বের ফারছী গ্রন্থ “রিয়াজুন নাসিহীন”- এ ইমাম জা’ফর সাদেক (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- “মি’রাজ হতে ফিরে আসার পথে রফরফ বোরাক বা ফেরেশতা- কিছুই সাথে ছিলো না”। ৩। তৃতীয় প্রশ্নের জবাব হলোঃ একজন নবী ইনতিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরও অন্যের উপকার করতে পারেন, যেমন উপকার করেছিলেন মুছা (عليه السلام) উম্মতে মুহাম্মদীকে। এভাবে আল্লাহ’র নবী এবং অলীদের উসিলায় সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হয়। এ সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণ ও দলীল বিদ্যমানে আছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় – হযরত মুছা (عليه السلام) আমাদের উপকারের জন্য ৬ষ্ঠ আকাশে দাঁড়িয়ে থেকে নবী করীম [ﷺ]-কে বারবার যাতায়াত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্যও এর মধ্যে নিহীত ছিল। তাফসীরে সাভীতে উল্লেখ আছে, তূর পর্বতে হযরত মুছা (عليه السلام) আল্লাহ্ পাকের নূরের তাজাল্লীতে বেহুঁশ হওয়ার কারণে আল্লাহকে দর্শন করতে পারেননি। কিন্তু মি’রাজ রাত্রীতে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে আল্লাহর যে তাজাল্লী বয়ে নিয়ে এসেছিলেন- তা দেখে হযরত মুছা (عليه السلام)-এর তূর পর্বতের সাধ পূনরায় জেগে উঠে। তাই আল্লাহর তাজাল্লী দর্শনের জন্যই উম্মতে মুহাম্মদীর বাহানায় নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহর দরবারে বারবার ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। আমাদের জন্য সুপারিশ করা ছিল উপলক্ষ মাত্র। সুবহানাল্লাহ্! (তাফসীরে সাভী ২য় খন্ড ৮১৯ পৃঃ) একটি কাজে কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং উভয়বিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে উম্মতের কল্যাণ ও খোদা দর্শনে কোন বিরোধ নেই। আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা (رضي الله عنه) বলেন- کس کو دیکھا یھ موسی سے پوچھے کوی – آنکھ والوں کی ھمت یھ لا کھون سلام -مصطفٰے – অর্থঃ- “মুছা (عليه السلام) সেদিন কাকে দেখেছিলেন এবং তাঁর মধ্যেমে কার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন- তা মুছা (عليه السلام) কেই জিজ্ঞেস করো।” দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন লোকেদের দিব্য জ্ঞানের উপর শত সহস্র ছালাম।” (হাদায়েকে বখশিষ- আলা হযরত)। রাসুলে খোদা [ﷺ] হলেন আল্লাহর দর্শনের আয়না স্বরূপ (মসনবী)। مصطفے آءنھ ظل خدا است -منعکس دورے ھمھ خوئے خداست – আল্লাহর দীদার সম্ভব কিনা? হাবীবে খোদা [ﷺ] স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখেছেন। আল্লাহর দীদার বা দর্শন সম্ভব কিনা এবং সম্ভব হলে কিভাবে এবং কোথায় সম্ভব? এ প্রসঙ্গটি এর সাথে সম্পৃক্ত বলে এ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। প্রথমতঃ নীতিগত ভাবে আল্লাহর দর্শন লাভ করা সম্ভব। নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ গমন করে জাগ্রত অবস্থায় স্বচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ করেছিলেন। চক্ষু মোবারক দিয়ে এবং হৃদয় দিয়েও তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর চোখ এবং কলব উভয়ের দর্শনই সমান গুরুত্ববহ। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- “তিনি চোখে যা দেখেছেন- হৃদয় তা অস্বীকার করেনি।” (সুরা নাজমঃ ১১) হযরত মুছা (عليه السلام) আল্লাহর নূরের তাজাল্লী এই চোখে সহ্য করতে পারেন নি বলেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। বুঝা গেল- সহ্য করতে পারলে তিনি আল্লাহকে দেখতে পেতেন। দুনিয়ার চোখে আল্লাহকে দেখার আরয করার কারণে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন لن تراني অর্থাৎ- এই চোখে কখনো দেখতে পাবে না। কিন্তু নবী করীম [ﷺ]-কে স্বচক্ষে দর্শন দিয়েছেন মি’রাজে। একবার নয়- দশবার। আর ৩৩ বার দর্শন দিয়েছেন দুনিয়াতে স্বপ্নে। (বোখারীর হাশিয়া- আহম্মদ আলী সাহরানপুরী – নামায দ্রষ্পব্য, রু’ইয়াতুল্লাহি, দারাকুতনী, হাদীস নং ২২৭, পৃ. ৩০৯)। মহিউদ্দিন আরবী (رضي الله عنه) স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন যে, নবী করীম [ﷺ]-এর মি’রাজ হয়েছিল ৩৪ বার। তন্মধ্যে ১ বার জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ও সচক্ষে এবং ৩৩ বার হয়েছিল স্বপ্নযোগে এবং রূহানীভাবে। সে সময় তিনি মদীনায় বিবি আয়েশা (رضي الله عنها)-এঁর ঘরে অবস্থান করেছিলেন। ঐ স্বপ্নের মি’রাজের ব্যাপারেই হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) বলেছেন যে , “আমি মি’রাজ রাত্রে নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারককে আমার বিছানা হতে হারিয়ে ফেলিনি- বরং তিনি আমার বিছানায় শুয়েই মি’রাজ করেছেন”- অর্থাৎ স্বপ্নে আল্লাকে দেখেছেন। বাতিলপন্থীরা এই হাদীসকে মক্কার মি’রাজের সাথে একত্রিত করে বলেছে – হুজুরের স্বশরীরে মি’রাজ হয়নি। হাদীসের প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে বুঝতে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক! আল্লাহ তায়ালা মদীনায় ৩৩ বার রূহানী সাক্ষাৎ দিয়েছেন নবীজির সাথে। স্বশরীরের মি’রাজ হয়েছিল মক্কা শরীফ থেকে, যে সময় হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) স্বামীগৃহে গমনই করেন নি। হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) কর্তৃক হুযুর [ﷺ]-এঁর সশরীরে মি’রাজ অস্বীকৃতিসূচক বর্ণনা বা হাদিসখানা মদীনায় সংগঠিত রূহানী মি’রাজের সাথে সম্পর্কিত। মক্কা হতে মিরাজ গমনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, সলফে সালেহীন ও সাহাবায়ে কেরামের মত। আউলিয়ায়ে কেরামগণ স্বপ্নে বা মোশাহাদার মাধ্যেমে আল্লাহর দিদার লাভ করেছেন বলে আক্বায়েদের কিতাবে উল্লেখ আছে। ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله عليه), ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمه الله عليه), এবং ক্বেরাতের সপ্ত ইমামের অন্যতম ইমাম হযরত ক্বারী হামযা (رحمه الله عليه) প্রমুখ অলীগণের আল্লাহ দর্শন এই শ্রেণীভূক্ত। আর পরকালে যখন মু’মিনই আল্লাহকে চাক্ষুস দেখতে পাবে বলে ২৩ জন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত মোতাওয়াতের হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায়। (নিবরাছ) কিন্তু কিছু কিছু জ্ঞানপাপী আলেম- যারা নিজেকে বড় আলেম বা শাইখুল হাদীস বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে- তারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর স্বপ্নে আল্লাহর দীদার লাভ করাকে অবাস্তব বলে এক ফতোয়ায় উল্লেখ করেছে। তারা এমনও দাবী করেছে যে, কোন সাহাবী- এমনকি নবী করীম [ﷺ] ও স্বপ্নে আল্লাহর দীদার লাভ করার দাবী করেন নি। বাস্তবে বা স্বপ্নে আল্লাহর দীদারের ঘটনা নাকি গাজাখুরী কথা। হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه) রচিত সিররুল আসরার কিতাবে বর্ণিত এ সম্পর্কীত হাদীসকে এই পাপীরা সনদবিহীন হাদীস বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। অধম লেখক (আব্দুল জলিল) ১৯৯৩ইং সনে ২৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী এক ফতোয়ায় তাঁদের দাবীকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ্, তাদেরই দেওবন্দ মাদ্রাসার কিতাব “তালিকুছ ছবিহ্” ও “ফয়যুল বারী শরহে বোখারী” দিয়ে এবং হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত তাদের কিতাব “তানজিমুল আশতাত ফি হাল্লিল মিশকাত” থেকে সনদসহ হাদীস পেশ করে। এছাড়াও মোল্লা আলী ক্বারীর “মিরকাত” গ্রন্থের মধ্যেও উক্ত হাদীসখানা লিপিবদ্ধ আছে। নবী করীম [ﷺ] উক্ত হাদীসে এরশাদ করেছেন, “আমি আমার প্রভূ আল্লাহ তায়ালাকে গোফবিহীন যুবকের ন্যায় (নিখুঁত) দেখেছি।” এই হাদীসখানা মোতাশাবিহি বা দুর্বোধ্য- যার প্রকৃত অবস্থা রহস্যাবৃত। কেননা, হানাফী মাযহাব মতে আল্লাহ’র কোন আকৃতি নেই। তাই বলে এ হাদীস সনদ বিহীন নয়। আমার উক্ত ফতোয়ায় সনদ উল্লেখ করেছি। মোদ্দাকথা হলো- আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। হাশরের ময়দানে মু’মিনগণ দেখবে রহমানী অবস্থায়, আর কাফেররা দেখবে গযবী ও কাহহারী অবস্থায়। নবী করীম [ﷺ] ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টি আল্লাহকে প্রত্যক্ষ স্বচক্ষে দেখেনি। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল হযরত ইবনে আব্বাছ (رضي الله عنه)-এঁর বর্ণিত হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে জোর দিয়ে বলেছেন যে, “নবী করীম [ﷺ] আল্লাহ তায়ালাকে স্বচক্ষে দেখেছেন।” এভাবে বার বার বলতে বলতে তার (ইবনে হাম্বল) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল। তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে, হিজরতের সাত মাস পূর্বে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহ তায়ালা যে-সব এলেম দান করেছেন, তা উর্দ্ধজগতের যাবতীয় গায়েবী বিষয়ের এলেমের সমষ্টি বা ইলমে মুহীত। আরবী এবারত দেখুনঃ صار علمه عليه السلام محيطا لجميع المعلومات الغيبية الملكوتية – অর্থাৎঃ “হুযুর [ﷺ]-এঁর এলেম উর্দ্ধজগতের যাবতীয় গায়েবী বিষয়ের বেষ্টনকারী।” সুতরাং নবী করীম [ﷺ]-এঁর “ইলমে গায়েব মুহীত” অস্বীকারকারীদের দাবী মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ওহাবী সম্প্রদায় ইলমে গায়েব মূহীত অস্বীকার করে। ইমামে রাব্বানী (رحمة الله عليه) বলেছেনঃ “আল্লাহ তায়ালা তাঁর খাছ ইলমে গায়ব বিশেষ বিশেষ নবীগণকে দান করেছেন। মকতুব নং ৩১০ প্রথম খন্ড। (আল্লাহর খাছ এলেম পাঁচটি। যথাঃ (১) কিয়ামতের বিষয় (২) বৃষ্টি বর্ষণ (৩) মাতৃগর্ভের সন্তান ছেলে-না মেয়ে (৪) আগামীদিনের রিযিক (৫) কোথায় কে মৃত্যু বরণ করবে। এগুলোর ইলম বিশেষ বিশেষ নবীকে দান করেছেন। (মকতুবাত শরীফ প্রথমখন্ড মকতুব নং ৩১০)। বুঝা যাচ্ছে-পঞ্চ গায়েবের এলেমও আল্লাহপাক তাঁকে দান করেছেন। মি’রাজের রাত্রিতে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-কে যেভাবে সম্মানিত করেছেন, তাতেই বুঝা যায়- তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, অতিমানব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু মৌলভি দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মওদুদীর মতবাদ গ্রহণ করে নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহর ‘দাস’ বলে বিভিন্ন মাহফিলে তাফসীরের নামে অপপ্রচার চালিয়েছেন। তিনি বলতে চান- عبده শব্দের অর্থ আল্লাহর দাস। নাউযুবিল্লাহ! আমরা বলতে চাই- তার দাবী অনুযায়ী-দাসের জন্য কি এত অভ্যর্থনা ও শাহী এন্তেজাম করা হয়? দাস হলো নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোক। হিন্দুদের মধ্যে দাশ হলো চতুর্থ শ্রেণীর বা সর্বনিম্ন শ্রেণীর শুদ্র জাত। “দাস” শব্দটি ২৭টি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে- “যার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় হয় এবং যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ প্রতীক্ষমান।” আল্লামা ইকবাল عبده শব্দটির তাৎপর্য্য সুন্দরভাবে তার কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে- عبد دیگر عبدہ چیزے دیکر -اوسر آپا انتظار این منتظ – অর্থ্যাৎ- ‘আবদ’ এক জিনিস, আর ‘আবদুহু’ অন্য জিনিস। আব্দ অর্থ আল্লাহর জন্য এন্তেজারকারী এবং আবদুহু অর্থঃ- যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ্ এন্তেজারী করেন। মি’রাজ থেকে নবী করীম [ﷺ] ফিরে এসে দেখতে পেলেন – বিছানা তখনও গরম রয়েছে। ভোরে তিনি কাবাগৃহে তশরীফ নিয়ে সকলের কাছে এ ঘটনা বললেন। আবু জাহল প্রমুখ কোরাইশ দলপতিরা একথা শুনে পরীক্ষার ছলে বাইতুল মোকাদ্দাসের দরজা-জানালা ইত্যাদির বিবরণ জানতে চাইল। তারা জানতো যে, নবী করীম [ﷺ] কোনদিন বাইতুল মোকাদ্দাস যান নি। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন সাথে সাথে জিব্রাইলের মারফতে বাইতুল মোকাদ্দাসের পূর্ণ ছবি তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরলেন- যেন বর্ণনা দিতে হুযুরের তকলীফ না হয়। নবী করীম [ﷺ] দেখে দেখে সব বলে দিলেন। এতেও তারা ক্ষান্ত হলনা। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো- আপনি কি আমাদের কোন বাণিজ্য কাফেলা দেখেছেন? নবী করীম [ﷺ] বললেন- “হাঁ, তারা মক্কার অতি নিকটে পৌঁছেছে এবং বুধবার সূর্য উঠার পূর্বেই তারা মক্কায় প্রবেশ করবে।” (বেদায়া)। আবু জাহল প্রমুখ ঐদিন খুব ভোরে ঘরের ছাদে উঠে কাফেলার আগমন পরীক্ষা করতে লাগলো। এদিকে সূর্য উঠে উঠে অবস্থা-অথচ কাফেলা তখনো দৃষ্টি গোচর হচ্ছিলো না। আবু জাহল বললো- এবার পরীক্ষা হয়ে গেছে- নবীর মি’রাজ মিথ্যা। কেননা, তিনি বলেছেন- বুধবার সূর্য উঠার পূর্বে কাফেলা মক্কায় প্রবেশ করবে- অথচ আমরা আমাদের দৃষ্টি পথে কাফেলার কোন চিহ্নই দেখছিনা। আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-এঁর কথা ও সম্মান ঠিক রাখার জন্য সেদিন রাত্রিকে আরও দীর্ঘায়িত করে দিলেন – সূর্যের গতি থামিয়ে দিয়ে। পরে দেখা গেল, সূর্য উঠার পূর্বেই কাফেলা মক্কায় পৌঁছে গেছে। সুবহানাল্লাহ! (বেদয়া নেহায়া)। এভাবে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-এঁর মি’রাজের ঘটনা সত্য প্রমাণিত করলেন। কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। আবু জাহল নবীজীর মি’রাজ গমনকে অসম্ভব বলে প্রমাণ করার জন্য হৈ চৈ শুরু করে দিল। সে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-কে বাড়ী হতে আসতে দেখে মি’রাজ বিষয়ে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করলো। তার কথা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) জিজ্ঞাসা করলেন, একথা কে বলেছেন? আবু জাহল উপহাস করে বললো, কে আর বলবে? তুমি যাঁর পিছনে এতদিন ঘুরছো, তিনি ছাড়া এমন অসম্ভব কথা আর কে বলতে পারে? তখন আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) বললেন- “নবী করীম [ﷺ] বলে থাকলে সত্যই বলেছেন।” এ কথা শুনে আবু জাহল দমে গেল। আবু বকর (رضي الله عنه) নবীজীর খেদমতে গিয়ে মি’রাজ ঘটনার প্রকৃত অবস্থা জানতে চাইলেন। নবী করীম [ﷺ] ঘটনা স্বীকার করে এরশাদ করলেন, তুমি কিভাবে অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে? আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) বললেন- এটা বিশ্বাস করা তো অতি সহজ। এর চেয়ে কঠিন বিষয় ছিল আল্লাহ্কে না দেখে বিশ্বাস করা- এখন তাঁর কাছে যাওয়া তো অতি সহজ ব্যাপার। আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর উত্তর শুনে নবী করীম [ﷺ] এত প্রীত হলেন যে, ‘সিদ্দিকে আকবর’ খেতাবে তাঁকে ভূষিত করলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর সব কথা এভাবে বিশ্বাস করা সিদ্দিকগণেরই পরিচায়ক। সেযুগে বিজ্ঞানের জ্ঞান এত প্রসারিত ছিলো না। তাই তারা সময়ের সংকোচন এবং স্থানের সংকোচন সম্পর্কে ছিল সন্দিহান। গতিবেগ সম্পর্কেও তখনকার দিনে ধারনা ছিলো না। বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এবং চাঁদের দেশে মানুষের গমনের ফলে মি’রাজের ঘটনা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আল্লাহর অসীম কুদরতের কোন সীমা নেই। তিনি আপন কুদরতে এবং নিজ ব্যবস্থাপনায় নবী করীম [ﷺ]-কে উর্দ্ধজগতে এবং লা-মাকানে নিয়ে তাঁর কুদরতের নিদর্শনাবলী, তাঁর যাত ও সিফাত দর্শন এবং তাঁর গোপন রহস্যরাজী সম্পর্কে অবহিত করেছেন- ঈমানদারদের জন্য নবীজীর কথাই সত্যতার মূলভিত্তি। এটাই মুমিনদের জন্য যথেষ্ঠ। “আল্লাহ সর্ববিষয়ে আপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বশক্তিমান” (ছুরা বাক্বারা)। হুযুর [ﷺ]-এঁর দেহতত্ত্বঃ পবিত্র মি’রাজ প্রসঙ্গে নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহতত্ত্ব সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা দরকার। হুযুর পাক [ﷺ] নিজেকে ‘খোদার নূর হতে সৃষ্ট নূর’ বলে হাদীসে এরশাদ করেছেন। মানুষের প্রয়োজনেই তাঁকে মানবাকৃতি দান করা হয়েছে। আকৃতিতে বশর হলেও গুণাবলী এবং প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন ফেরেশতাদের চেয়েও অনেক উর্দ্ধে। তাঁর চালচলন, খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা, স্বভাব ও চরিত্র ছিল অনুকরণীয়। আমরা হলাম অনুসরণকারী মাত্র। তাঁর হুবহু অনুকরণকারী হওয়া সম্ভব নয়। কেননা অনুকরণ বলা হয় সর্ববিষয়ে হুবহু সামঞ্জস্য রক্ষা করে অনুসরণ করাকে। এটা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। হুযুর [ﷺ]-এঁর নামায, রোযা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী এবং দুনিয়াবী কাজ-কর্মের গুণাগুণ এবং আমাদের নামায-রোযার গুণাগুণ এক হতে পারে না। আমাদের শরীরে মশা-মাছি বসে- কিন্তু হুযুর [ﷺ]-এঁর পবিত্র বদনে কোনদিন নাপাক মশা-মাছি বসেনি। আমাদের শরীরের ছায়া আছে- কিন্তু হুযুর [ﷺ]-এঁর ছায়া ছিলো না। কেননা তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর (কাজী আয়ায-শেফা শরীফ)। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত-এঁর আকিদা- যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আম্বিয়াগণের দেহ মোবারক সম্পর্কে নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেনঃ نحن معاشر الأنبياء اجسادنا كالجسد الملائكة – অর্থাৎ “আমরা আম্বিয়ায়ে কেরামের দেহ মোবারক ফেরেশতাদের দেহের ন্যায় সূক্ষ্ম, অর্থাৎ নূরানী ও সুক্ষ্মতায় আমরা ফেরেশতাদের ন্যায়।” এরপরও কেহ হুযুর [ﷺ]-এঁর দেহ মাটি বা সাদা মাটি দ্বারা গঠিত বলে অপপ্রচার চালালে এটাকে হাদীসের অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। হুযুর [ﷺ]-এঁর সুরত বা হাল তিনটি। সুরতে বশরী, সুরতে মালাকী ও সুরতে হাক্কী। মি’রাজের রাত্রে তাঁর সুরতে মালাকী ও সুরতে হাক্কীর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এটা বিশ্বাসের বিষয়, দেখার বিষয় নয়। মৌলভী ফজলুল করীম তার ‘নূরে মুহাম্মদীর হাকিকত’ বইয়ে একটি মৌযু হাদীস দ্বারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক মাটির তৈরী বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ইবনে জওযীর মতে উক্ত হাদিসটি বানোয়াট ও জাল বলে বাংলা মাআরিফুল কোরআন ৮৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে- যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। শুধু বশরী ছুরত স্বীকার করলে বাকী ২টি সুরতকে অস্বীকার করা হয়। বিঃ দ্রঃ নবী করীম [ﷺ]-এঁর তিন সুরতের অর্থঃ মানুষের কাছে মানুষের মত, ফেরেশতাদের কাছে ফেরেশতার মত এবং আল্লাহর কাছে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত অবস্থা। ১। সুরতে বাশারীর প্রমাণঃ قل انما انا بشر مثلكم “আমি শুধু সুরতে বা আকৃতিতে তোমাদের মত মানুষ।” ২। সুরতে মালাকীর প্রমাণঃ لي مع الله وقت لا يسعني فيه نبي مرسل ولا ملك مقرب “আল্লাহর সাথে আমার এমন ঘনিষ্ট সময় আসে – যেখানে কোন প্রেরীত নবী অথবা নিকটবর্তী কোন ফেরেশতাও আমার সমকক্ষ হতে পারে না।” ৩। সুরতে হাক্কী সম্পর্কে হাদীসে বর্নিত হয়েছঃ من رآني فقد راي الحق “যে ব্যক্তি আমাকে দেখেছে, সে হক্ক-কেই দেখেছে।”
নূরনবী ﷺ ২৬তম অধ্যায়ঃ মি’রাজ
পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।