প্রসঙ্গঃ যুদ্ধের বিরাট চাঁদা দানের বিনিময়ে হযরত ওসমান (رضي الله عنه)-এর জান্নাত লাভ, গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানে অবস্থান না করা, পানিতে বরকত, ২১টি খুরমা দিয়ে ৩০ হাজার সৈন্য বাহিনীর খাদ্য প্রদান, হযরত আবু হুরাইয়া (رضي الله عنه) কে ২১ টি খুরমা দান এবং তা দিয়ে ২৬ বৎসর সংসার পরিচালনা, তীব্র বায়ু প্রবাহের গায়েবী সংবাদ প্রদান, একই সময়ে নবীজি [ﷺ] তাবুক ও মদীনায় হাযির-নাযির, মদীনা থেকে নাজ্জাশীর জানাযা আদায়।
মক্কা বিজয়ের পর তাবুকের যুদ্ধ ৯ম হিজরীর রজব মাসে পরিচালিত হয়। মদীনা শরীফ থেকে দামেস্কের মধ্যপথে রাস্তায় তাবুক অবস্থিত, বর্তমানে সৌদি আরবের বর্ডার। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অধীনে খৃষ্টান সামন্ত রাজারা এসব অঞ্চল শাসন করতো। আরব উপদ্বীপ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে আসার পর সিরিয়ার খৃষ্টানদের মধ্যে মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা মদীনা আক্রমণ করার পাঁয়তারা করতে থাকে।
এই সংবাদে নবী করীম [ﷺ] প্রকাশ্যে তাবুক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে লোক ও রসদ সংগ্রহ করতে থাকেন। মৌসুম ছিল অত্যন্ত গরম। মদীনা শরীফে ছিল অর্থকরী খেজুর ফসলের মৌসুম। খেজুর পাকার মাস। তদুপরি অপরিচিত দূর দেশে অভিযান। এসব দিক বিবেচনা করে লোক ও অর্থ সংগ্রহ করা খুবই প্রয়োজন ছিল। নবী করীম [ﷺ] স্বয়ং চাঁদা আদায়ের জন্য নিয়মিতভাবে মসজিদে নববীতে সভার আয়োজন করেন এবং মিম্বার শরীফে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ তহবিলে চাঁদা দানের জন্য আহবান জানান। নবী করীম [ﷺ]-এঁর আহবানে সাড়া দিয়ে সকল সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنهم) সাধ্যমত দান করতে থাকেন।
হযরত ওসমান (رضي الله عنه) চাঁদার অপ্রতুলতা দেখে একাই দশ হাজার সৈন্যের যাবতীয় খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দেন। নবী করীম [ﷺ] হযরত ওসমানের দানে এতই খুশী হলেন যে, তিনি পবিত্র জবানে ঘোষণা করে দিলেন,
لَا يَضَرَّ عُثْمَانَ شَيْئٌ بَعْدَ الْيَوْمِ (بُخَارِىْ)
“আজকের পর হতে আর কোন গুনাহই (যদি হয়) ওসমানের জন্য ক্ষতিকর হবে না।” (বুখারীঃ ৩৪৩০ ইফাবা, বায়হাকী সূত্রে বেদায়া)
এই সুসংবাদটি ছিল শুভ পরিণতির চরম ঘোষণা। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) ঘরের সবকিছু দান করলেন। হযরত ওমর (رضي الله عنه) দান করলেন অর্ধেক সম্পদ।
নবী করীম [ﷺ] তাঁদের দু’জনের মুখে এ কথা শুনে হেসে হেসে বললেনঃ “তোমাদের দু’জনের কথা ও দানের মধ্যে কতটুকু ব্যবধান ঈমানের ক্ষেত্রেও ততটুকু ব্যবধান।” (রুহুল বয়ান)
একজন সাহাবী খুবই গরিব ছিলেন। তিনি কাঠ বিক্রি করে দৈনিক দু’ছা গম খরিদ করতেন। এক ছা (৪ সের) গম নিয়ে তিনি নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে পেশ করলেন। হুযুর [ﷺ] উক্ত গম সমস্ত মালের স্তুপের উপর ছিটিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি সকলের দানের সাথেই শরীক হয়েছ।”
মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই এবং তার দলের মোনাফিকরা এ অবস্থা দেখে ভিতরে ভিতরে সমালোচনা করতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো, দেখো, নাম ফুটাবার জন্য ওমুকে ওমুকে এত টাকা দিয়েছেন আর এত বড় যুদ্ধের খরচ বাবদ ওমুকে দান করেছে মাত্র ১ ছা গম। এতে কী হবে? ইত্যাদি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধের প্রস্তুতি বানচাল করে দেয়া।
মুনাফিকদের টালবাহানাঃ
তারা এসে ওযর পেশ করলো – এত গরমের মধ্যে সফর করা আমাদের সহ্য হবেনা। তাই ক্ষমা করুন। এক বেহায়া মোনাফেক বললো, তাবুকের যুবতী মেয়েদেরকে দেখলে আমি স্থীর থাকতে পারবো না। তাই আমাকে রেহাই দিন। নবী করীম [ﷺ] মোনাফিকদের এসব খোড়া ওযর কবুল করে তাদেরকে বাদ দিলেন। কিন্তু মুসলমানদেরকে জোর তাগিদ দিলেন। অনেকেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু যানবাহন ও অস্ত্রের অভাবে যেতে পারেন নি। তাঁরা কেঁদে অস্থির হয়ে পড়লেন। নবী করীম [ﷺ] তাদেরকে শান্তনা দিয়ে রেখে গেলেন।
এমনিভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি রজব মাসে বৃহস্পতিবার দিন তাবুক পানে রওয়ানা দিলেন। কোরআনের সূরা তওবায় মুসলমানদের আগ্রহ ও মোনাফেকদের টালবাহানার ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।
মুসলমানদের মধ্যে ১০জন সাহাবী ওজর বসত বিনানুমতিতে যোগদান থেকে বিরত ছিলেন। তারা পরে লজ্জিত হয়ে নিজেদেরকে মসজিদে নববীর খুটির সাথে বেধে নবীজী [ﷺ] এঁর দরবারে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। কিছুদিন পর আল্লাহর অনুমতিক্রমে নবী করীম [ﷺ] তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।
কা’ব ইবনে মালেক, হেলাল ইবনে উমাইয়া এবং মুরারা ইবনে রাবিয়া – নামক তিনজন সাহাবী বিনা ওজরেই ফসল তোলার কাজে ব্যস্ততার কারণে যাবো যাবো করেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। এই জন্য আল্লাহ তাঁদেরকে ৫০ দিন বয়কটের শাস্তি দিয়ে পরে ক্ষমা করেন। নবীর দরবার থেকে বঞ্চিত হলে আল্লাহর দরবারেও স্থান হয় না। অবশ্য তাঁদের তওবা ক্ববুল হওয়ার পর তারা সমস্ত সম্পত্তি নবীজির খেদমতে ছদকা করে দেন। নবী করীম [ﷺ] এক তৃত্বীয়াংশ কবুল করে বাকী অংশ ফেরত দিয়ে দেন।
হযরত আবু জর গিফারী (رضي الله عنه) যানবাহনের অভাবে হুজুর [ﷺ]-এঁর সাথে যেতে পারেন নি। অবশেষে পায়ে হেঁটে তিনি একা তাবুকে গিয়ে নবীজি [ﷺ] এঁর সাথে মিলিত হন। নবী করীম [ﷺ] আবু জর (رضي الله عنه)-কে একা দেখে বলে উঠলেনঃ “আল্লাহ আবু জরকে রহম করুন! সে চলবে একা, মরবে একা এবং পুনরোত্থিতও হবে একা।”
নবী করীম [ﷺ]-এঁর উক্ত গায়েবী সংবাদ ছিল আবু জর গিফারী’র জীবনের শেষ পরিনতি সম্পর্কে। সম্পদের ব্যক্তি-মালিকানা সম্পর্কে তিনি সকল সাহাবী থেকে ভিন্নমত পোষণ করতেন এবং নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সকল সম্পদ দান করার প্রবক্তা ছিলেন তিনি। তাই তাকে একলা চলতে হয়েছে, নির্বাসনে গিয়ে। মদীনার নিকটবর্তী রাবযা নামক স্থানে তাকে হযরত ওসমান (رضي الله عنه) কর্তৃক নির্বাসন দেওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি একাকী ইন্তেকাল করেন। এভাবে নবীজি [ﷺ] এঁর এলমে গায়েবের সংবাদ বাস্তবে পরিণত হয়।
পথিমধ্যে মো’যেজা প্রদর্শনঃ
নবী করীম [ﷺ] দশ হাজার উট ও ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাবুকের পথে রওয়ানা হলেন তখন কতিপয় অলৌকিক মোযেজা প্রদর্শণ করেন। যথাঃ
(১) পিপাসাঃ নবীজির ইশারায় বৃষ্টি বর্ষণঃ
হযরত ওমর (رضي الله عنه) বলেন, আমরা তাবুকের যাত্রায় তিনটি কষ্টে পতিত হয়েছিলাম। (ক) পানির কষ্ট (খ) খাদ্যের কষ্ট (গ) গরমের কষ্ট। এই তিন কষ্টের কারণে আমাদের এই সফরকে “কষ্টের সফর” বলা হতো। পানির অভাবে আমরা এতই কাতর ও কাহিল হয়ে পড়েছিলাম যে, মনে হচ্ছিল যেন আমাদের প্রাণ এখনই বের হয়ে যাবে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যানবাহন হিসাবে ব্যবহৃত নিজেদের উট জবেহ করে তার পানির থলে বের করে ঐ পানিটুকু পান করে পিপাসা নিভৃত্ত করছিলেন। কেউ কেউ উটের কলিজা বের করে চিবিয়ে তা পান করলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ [ﷺ]! আপনি পানির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন।“ নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেন, “তুমি কী এটাই ভালো মনে কর?” আবু বকর (رضي الله عنه) বললেন, “হ্যাঁ।” নবী করীম [ﷺ] আকাশের দিকে দু-হাত তুলে কি যেন বললেন। হাত নামানোর পূর্বেই আকাশ গর্জন করে উঠলো এবং বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। সাহাবীগণ (رضي الله عنهم) যার যার পাত্র পানিতে পূর্ণ করে নিলেন। আমাদের (সাহাবীগনের) প্রয়োজন শেষ হল। বর্ষণও বন্ধ হয়ে গেল। (বুঝারীঃ ৪৬ ইফাবা, ইবনে কাসীর কৃত বেদায়া নেহায়া)।
(২) হারানো উটের সন্ধান দানঃ
ইমাম বায়হাকী ও আবু নোয়াইম (رحمة الله عليهما) বর্ণনা করেন, তাবুকের পথে এক স্থানে বিশ্রামকালে নবী করীম [ﷺ]-এঁর উটটি হারিয়ে যায়। অনুসন্ধানের জন্য তিনি লোক পাঠালেন। একজন মুনাফিক (জায়েদ ইবনে লুছাইত) বলে উঠলো, দেখুন মুহাম্মদ [ﷺ] একদিকে বলছেন, তিনি নবী এবং আকাশের গায়েবী খবরও তিনি তোমাদেরকে বলেন – অন্যদিকে দেখছি – তিনি জমিনের খবরই জানেন না। তার উটটি কোথায় আছে – তা তিনি বলতে পারছেন না। নবী করীম [ﷺ] তার কথা শুনতে পেয়ে বললেনঃ-
“এক নিকৃষ্ট ব্যাক্তি বলাবলি করছে আমি নাকি জমিনের গায়েবী খবর জানিনা। তোমরা শুনো! আমি নিজে নিজে গায়েবী সংবাদ জানিনা বটে, কিন্তু আল্লাহ আমাকে যেসব গায়েবী খবর জানান – তা অবশ্যই জানি। যাও তোমরা গিয়ে দেখো- আমার উটটি ময়দানের একটি গাছের সাথে রশি আটকিয়ে আছে। তোমরা গিয়ে উটটি নিয়ে এসো।“ [ইবনে হিশাম তাঁর ’সীরাহ’ (৫:২০৩) ও আত-তাবারী তাঁর ‘তারিখ’ (২:১৮৪) গ্রন্থে সহীহ সনদে এ হাদিসটি বর্ণনা করেন।]
সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنهم) উক্ত স্থানে গিয়ে গায়েবী খবর অনুযায়ী উটটি পেয়ে নিয়ে আসলেন। উক্ত মোনাফেক তখন লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। সে নবী করীম [ﷺ]-এঁর ইলমে গায়েবের পরিচয় পেয়ে তওবা করে খালেস মুসলমান হয়ে গেলো। (মাওয়াহেব) আমাদের দেশের বাতিল পন্থীরা তওবা করে না – বরং আরও জিদ করে হুযুর [ﷺ] এঁর ইলমে গায়েবকে অস্বীকার করে।
(৩) কুপে পানির ফোয়ারা প্রবাহিতঃ
মুসলিম শরীফে হযরত মোয়ায ইবনে জাবাল (رضي الله عنه) সূত্রে হাদীসে বর্ণিত আছে – সাহাবীগণ তাবুকের একটি শুষ্ক কুপের নিকট পৌছে অল্প অল্প করে পানি তুলে একটি ভান্ডে রাখলেন। নবী করীম [ﷺ] ঐ পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে অবশিষ্ট পানিটুকু পূণরায় কূপে ঢেলে দিলেন। অমনি কূপে পানির স্রোত প্রবাহিত হতে লাগলো। এভাবে তিনি পানির অভাব পূরণ করেন। এই পানির সংযোগ ছিল হাউযে কাউছারের সাথে এবং এই পানিই পৃথিবীতে প্রাপ্ত পানির মধ্যে সর্বোত্তম। (সূত্র : বেদায়া নেহায়া)। তিনি তো হাউযে কাউছারের অধিকারী।
(৪) তীব্র বায়ু প্রবাহের আগাম সংবাদ প্রদানঃ গযবের স্থান হিজর অতিক্রমঃ
নবী করীম [ﷺ] তাবুক যাওয়ার পথে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি সামুদ গোত্রের আবাসস্থল ‘হিজর’ এলাকা তাড়াতাড়ি অতিক্রম করলেন এবং চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন। তিনি এরশাদ করলেন – “যখনই তোমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থান অতিক্রম করবে তখন কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে পানাহ্ চাইবে, যেন তোমাদের উপর ঐরূপ আযাব অবতীর্ণ না হয়।” [বুখারীঃ ৩১৪১, ৪০৭৭ ইফাবা]
হিজর অতিক্রমকালে সাহাবীগণের কেউ কেউ ঐ স্থানের কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে নিলেন। ঐ স্থান অতিক্রম করে যাওয়ার পর নবী করীম [ﷺ] ঘোষণা দিলেন এই স্থানের পানি দিয়ে তোমরা কেউ অজু করবে না এবং পানও করবে না। ঐ পানি দিয়ে যদি কেউ রুটির খামির তৈরি করে থাকো, তাহলে তাও নিজেরা খাবেনা – বরং ঐ রুটি উটকে খাইয়ে ফেলবে। আজ রাত্রে তোমাদের উপর দিয়ে প্রবল ঝাঞ্জা বায়ু প্রবাহিত হবে। সুতরাং তোমরা কেউ তাঁবু থেকে একা বের হবে না।” [বুখারীঃ ৩১৩৯ ইফাবা]
নবী করীম [ﷺ]-এঁর নির্দেশ মেতাবেক সবাই ঘরে আবদ্ধ রইলেন। কিন্তু মদীনার বনু সায়েদার দুই ব্যক্তি তাঁবু থেকে বের হলেন – একজন প্রকৃতির ডাকে, আর একজন উটের সন্ধানে। এমন সময় হঠাৎ করে প্রবল বায়ু প্রবাহিত হলো। প্রকৃতির ডাকে যিনি বের হয়েছিলেন, তিনি দম বন্ধ হয়ে পড়ে গেলেন। আর যিনি উটের সন্ধানে বের হয়েছিলেন, বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে “তাঈ” নামক পাহাড়ে নিক্ষেপ করলো। নবী করীম [ﷺ]-কে এই সংবাদ দেয়া হলে তিনি বেঁহুশ ব্যক্তির জন্য দোয়া করলেন। তিনি সাথে সাথে জ্ঞান ফিরে পেলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে ইবনে ইসহাকের বর্ণনা হলো, নবী করীম [ﷺ] তাবুক থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তণ করার পর নবীজি [ﷺ] এঁর সম্মানে তাঈ পাহাড় উক্ত ব্যক্তিকে মদীনায় পৌছে দেয় (সূত্র : বেদায়া-নেহায়া)।
[উল্লেখ্য, হযরত সালেহ (عليه السلام) উক্ত হিজর এলাকার নবী ছিলেন। তাঁর উম্মতগণ কুদরতী উটের পা কেটে দিলে তাদেরকে গযবী পাথর (শিলা) মেরে ধ্বংস করা হয়। কুফায় হযরত সালেহ (عليه السلام)-এঁর মাজার অবস্থিত। আমি কাফেলা সহ উক্ত মাযার জিয়ারত করেছি।]
(৫) ২১টি খেজুর দিয়ে সকল সৈন্যকে উদরপূর্তি করে যেয়াফত দানঃ
তাবুকের যুদ্ধে খাদ্যাভাব ছিল প্রকট। সাহাবীগণ (رضي الله عنه) খাদ্যের অভাবের কথা নবী করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে পেশ করেন। নবী করীম [ﷺ] হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه)-কে ডেকে বললেন – “দেখো, কারো কাছে সামান্য খাদ্যবস্তু আছে কিনা?” হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) অনুসন্ধান করে ২১টি খেজুর থলেতে করে নবী করীম [ﷺ] খেদমতে পেশ করলেন। প্রিয় নবী [ﷺ] ঐগুলোর উপর হাত মোবারক রেখে দোয়া করলেন এবং লোকদের ডেকে আনলেন। সবাইকে তিনি উক্ত খেজুরের থলে থেকে প্রয়োজন মাফিক খুরমা-খেজুর সরবরাহ করলেন। সকলে খেয়ে তৃপ্ত হলেন। এভাবে পূরো বাহিনী উক্ত খেজুর খেয়ে তৃপ্ত হলেন। তাবুক বাহিনীতে ত্রিশ হাজার সৈন্য ছিলো। এরপর থলে খুলে দেখা গেলো ২১টি খেজুরই অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সুবহানাল্লাহ ! (সূত্র : জিকরে জামিল)
নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করলেন, হে আবু হোরায়রা! তুমি খেজুরের থলেটি নিয়ে যাও। যখনই তুমি প্রয়োজন মনে করবে, তখন থলের মুখে হাত প্রবেশ করে খেজুর বের করে আনবে কিন্তু মুখ একেবারে খুলবে না। হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) বললেন – নবী করীম [ﷺ]-এঁর বাকী যুগ, হযরত আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর আড়াই বৎসরের খেলাফতের যুগ, হযরত ওমর (رضي الله عنه)-এঁর দশ বছর খেলাফতের যুগ, হযরত ওসমান (رضي الله عنه)-এঁর বারো বৎসরের খেলাফতের যুগ – মোট সাড়ে ছাব্বিশ বছর উক্ত থলে থেকে নিজ পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়েছি এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছি। যেদিন হযরত ওসমান (رضي الله عنه) শহিদ হলেন (৩৫ হিজরী), সেদিন আমার অন্যান্য আসবাবসহ উক্ত থলেটিও লূট হয়ে যায়। আমি কী আপনাদেরকে বলবো- কি পরিমাণ খেয়েছি এবং কি পরিমান দান করেছি? নিজেরা খেয়েছি দুইশত ওয়াছাক এবং দান করেছি পঞ্চাশ ওয়াছাক (সূত্র : বায়হাকী)।
২৪০ শের বা ছয় মনে এক ওয়াছাক (খুচী) হয়। এ হিসাবে আড়াইশ ওয়াছাকে ২৫০×৬=১৫০০ (এক হাজার পাঁচশত মন) হয়। সোবহানাল্লাহ! প্রশ্ন জাগে-এত গায়েবী খেজুর কোথা থেকে আসলো? বস্তুতঃ আল্লাহ তায়ালা আসমান জমিনের ধনদৌলতের চাবিকাঠি নবী করীম [ﷺ]-এঁর নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারীঃ ৩৩৪১ ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। উক্ত ধনদৌলত দেখা যায়না বটে, কিন্তু পাওয়া যায়। দাতা আর গ্রহীতার ভেদ অন্য কেউ অনুধাবন করতে অক্ষম। হতবাক হওয়া ছাড়া গতি নেই। এটা বিশ্বাস করার নামই সুন্নী আক্বিদা।
(৬) একই সময় হুজুর [ﷺ] তাবুক ও মদীনায় হাজির-নাযিরঃ
তাবুক যুদ্ধের সময়ের একটি ঘটনা। হযরত আনাছ ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বলেন- আমরা এবং নবী করীম [ﷺ] তখন তাবুকে অবস্থানরত। এসময়ে মদীনাবাসী সাহাবী মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়া লাইছী (رضي الله عنه) মদীনায় ইন্তেকাল করেন। ঐদিন সূর্যের আলো ছিল তীব্র উজ্জল। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) হুযুর পাক [ﷺ]-এঁর দরবারে এসে এর কারণ এভাবে বর্ণনা করলেন – “মদীনাবাসী মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়া লাইছী (رضي الله عنه) ইনতিকাল করেছেন। তাঁর জানাযাতে শরিক হওয়ার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা আকাশ থেকে নেমে এসেছে। তাই আজ এত আলো। সূর্যের আলোর সাথে ফেরেশতাদের নূর মিশে এমন আলো ছড়াচ্ছে। মোয়াবিয়া দিনে-রাতে, উঠা-বসায়, চলা-ফেরায় সর্বদা ছুরা ইখলাছ পড়তে ভালোবাসতেন।” জিবরাঈল (عليه السلام) আরয করলেনঃ
فهل لك يا رسول الله ان افتض لك الاض فتصلي عليه؟ قل نعم ـ قل (انس) فسلى عليه ثم رجع ـ
“হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ইচ্ছা করলে আমি জমিনকে সংকুচিত করে দেবো – যাতে আপনি তাঁর জানাযা পড়াতে পারেন।”
হুযুর [ﷺ] বললেন - তাই করুন। বর্ণনাকারী হযরত আনাছ ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বলেন, “রাসূল মকবুল [ﷺ] মদীনায় জানাযা পড়ে মুহুর্তের মধ্যে আবার তাবুকে ফিরে আসলেন।” (ইয়াযিদ ইবনে হারুন (رضي الله عنه) সূত্রে হযরত আনাছ ইবনে মালেক (رضي الله عنه) থেকে-বায়হাকী)।
ইমাম বায়হাকী অন্য একটি সনদে ওসমান ইবনে হাইসাম সূত্রে হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে উপরোক্ত বর্ণনার পর আরো কিছু শব্দ যোগ করেছেন। তাহলে –
قل عثمان ـ فسألت أبى ميمونة اين كان النبى (علي)؟ قال بغزوة تبوك بالشام ومات معاوية بالمدينة ورفع له سريره حتى نظر اليه وصلى عليه ـ
অর্থঃ- “বর্ণনাকারী রাবী ওসমান বলেন- আমি আমার উপরের বর্ণনাকারী আবু মাইমুনাকে জিজ্ঞাসা করলাম- আচ্ছা, “মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়ার জানাযা পড়ার সময় নবী করীম [ﷺ] কোথায় ছিলেন? তিনি জবাব দিলেন- সিরিয়ার তাবুকে ছিলেন। ঐ সময় মোয়াবিয়া ইবনে আবু মোয়াবিয়া মদীনাতে মৃত্যুবরণ করেন। আর নবী করীম [ﷺ] ছিলেন তাবুকে। এমতাবস্থায় মধ্যখানের পর্দা সরে গেল। নবী করীম [ﷺ] তার দিকে চেয়ে চেয়ে নামাযে জানাযা পড়েছিলেন। আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه)-এর বর্ণনায় একথাও উল্লেখ আছে যে, হুজুরের পিছনে সত্তর হাজার করে দুই কাতারে একলক্ষ চল্লিশ হাজার ফেরেশতা শরিক ছিল।” (আল-বেদায়া ৫ম খন্ড ১৫ পৃষ্ঠা)।
প্রথম বর্ণনায় বুঝা গেল- হুযুর [ﷺ] একই সময় তাবুক এবং মদীনা উভয় স্থানে উপস্থিত ছিলেন। নবীজীর জন্য জমিন সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার পরও যদি কেউ বলে- নবীজী [ﷺ] একসাথে বিভিন্ন স্থানে হাযির হতে পারেন না- তাহলে তাকে অন্ধ জাহেল ছাড়া আর কি বলা যাবে?
জঙ্গে তাবুকের সংক্ষিপ্ত ঘটনাঃ
নবী করীম [ﷺ] ঊনিশকিংবা বিশ দিন তাবুকে অবস্থান করেন। এই অভিযানের সংবাদ পেয়ে খৃষ্টান সামন্ত রাজারা একে একে সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে হাযির হলো। তাদের মধ্যে আয়লার অধিপতি ইউহনা এবং “জারবা ও আজরুহ” শহরদ্বয়ের সামন্তগণ উল্লেখযোগ্য। তারা সকলে নিয়মিত জিযিয়া কর প্রদানের অঙ্গীকার করে নবী করীম [ﷺ]-এঁর সাথে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। নবী করীম [ﷺ] তাদেরকে নিরাপত্তানামা লিখে দেন (সূত্র : বেদায়া-নেহায়া)।
রোম অধিপতি হিরাক্লিয়াস সে সময় কুসতুনতুনিয়া থেকে সিরিয়ার হিমস শহরে এসে অবস্থান করছিল। নবী করীম [ﷺ] হযরত দাহইয়া কলবী (رضي الله عنه)-এঁর মাধ্যমে হিরাক্লিয়াসের নিকট হিমস শহরে পূণরায় একখানা দাওয়াতি পত্র প্রেরণ করেন। হিরাক্লিয়াস তার আমাত্যবর্গকে ডেকে পত্রের মর্ম অবগত করিয়ে ইসলাম গ্রহণের ব্যপারে তাদের মতামত জানতে চাইলে তারা উত্তেজিত হয়ে দরবার ত্যাগ করেন। হিরাক্লিয়াস ভীত হয়ে তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় এবং খৃষ্টান ধর্মের প্রতি তার আনুগত্য পুনঃঘোষণা করে। সে বদনসিবই রয়ে গেল। পূর্বে হিজরী সপ্তম সালেও তার কাছে দাওয়াতি পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল।
দুমাতুল জন্দল নামক স্থানে অধিপতি উকাইদির ইবনে আবদুল মালিক নামক খৃষ্টান সামন্তের নিকট খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (رضي الله عنه)-কে ৪০০ সৈন্য দিয়ে প্রেরণ করা হয়। হযরত খালেদ (رضي الله عنه) দুমাতুল জন্দলে উপস্থিত হয়ে উকাইদির ও তার ভাই হাসসানকে দেখতে পেয়ে তাদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে হাসসানকে নিহত করেন এবং উকাইদিরকে ধরে নিয়ে আসেন। সে জিযিয়া কর আদায় করার শর্তে নবী করীম [ﷺ]-এঁর সাথে সন্ধি চুক্তি করে আত্মরক্ষা করে। তাবুক যুদ্ধই রাসুলুল্লাহ [ﷺ] এঁর জীবনের সর্বশেষ বড় যুদ্ধ।
মদীনায় প্রত্যাবর্তন ও মুনাফিকদের মসজিদে দিরার ধ্বংসঃ
তাবুক অভিযান শেষ করে নবী করীম [ﷺ] মদীনার পথে রওয়ানা হন। মদীনা শরীফের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি খবর পেলেন, মুনাফিকরা ইত্যবসরে কুবায় একটি পৃথক মসজিদ তৈরি করে ফেলেছে। এই মসজিদটি মুসলমানদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে দূর্গ হিসাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এজন্য আল্লাহ তায়ালা এই মসজিদকে “মসজিদে দিরার” বা ক্ষতিকর মসজিদ বলে আখ্যায়িত করে একে ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দেন। মসজিদে কুবার বিরুদ্ধে এই মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল। আবু আমের পাদ্রি এই মসজিদের নির্মাতা। নবী করীম [ﷺ] মদীনায় পৌছার পূর্বেই মালেক ও আছেম নামের দুই ভাইকে পাঠিয়ে উক্ত মসজিদটি জালিয়ে দেন। (সূত্র : বেদায়া-নেহায়া) [এখনও বাতিল পন্থীরা সুন্নী মসজিদের বিপরীতে বাতিল মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে পৃথক মসজিদ তৈরী করে। এগুলোও মসজিদে দিরার হিসাবে গন্য।]
নবী করীম [ﷺ] মদীনা শরীফের নিকটবর্তী হয়ে মদীনা শরীফকে উদ্দেশ্য করে বললেন- “এটা তাবা” এবং ওহোদ পাহাড়কে উদ্দেশ্য করে বললেন- “এটি ওহোদ পাহাড়”- সে আমাকে ভালবাসে এবং আমিও ওহোদকে ভালবাসি।” সে সময় থেকে মদীনা শরীফের সাথে “তাইয়েবা” যোগ হয়ে মদীনা তাইয়েবা হয়। ওহোদ পাহাড় পাথর হয়েও নবী কারিম [ﷺ] কে ভালবাসে। একারণে নবী করীমও [ﷺ] ওহোদকে ভালবাসতেন। যে প্রেমিক রাসূলকে [ﷺ] ভালবাসবে, নবী করীমও [ﷺ] নিশ্চয়ই তাকে ভালবাসবেন। [মুসলিমঃ ৩২৪১ ইফাবা]
নাজ্জাশীর (رحمة الله عليه) জানাযাঃ
রমযানের প্রথম ভাগে মদীনায় আসার পর তিনি আবিসিনিয়ার মুসলমান বাদশাহ আসহামা নাজ্জাশীর মৃত্যু সংবাদ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত হন। নবী করীম [ﷺ] এবং আবিসিনিয়ার মধ্যখানের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেল। তিনি নাজ্জাশীকে চোখের সামনে রেখে জানাযা পড়ালেন। তাবুক থেকে ফেরৎ এসে প্রথমে তিনি মসজিদে নববীতে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। মদীনার নারী-পুরুষ-যুবা-শিশু নির্বিশেষে সকলেই ঘর থেকে বের হয়ে নবী করীম [ﷺ]-কে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন এবং গেয়ে উঠেনঃ
طلع البدر علينا ـ من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينا ـ مادعا لله داع ـ
তাঁরা হিজরতের সময়ও নবীজীর আগমনে এরূপ গেয়েছিলেন।
তাবুকের যুদ্ধ হতে ফেরত এসে নবী করীম [ﷺ] হযরত আলী (رضي الله عنه) কে লক্ষ্য করে এরশাদ করলেনঃ
رجعنا من الجهاد الا صغير الى الجهاد الاكبر ـ
অর্থঃ- “আমরা ছোট যুদ্ধ শেষ করে এবার বড় যুদ্ধের দিকে (নফসের বিরুদ্ধে) অগ্রসর হলাম” (বায়হাকীঃ ৩৮৪, কিতাবুল জিহাদ)। মানুষ শত্রুর চেয়ে নফ্ছশত্রু অনেক ভয়ঙ্কর। তাই নফছ শয়তানের বিরুদ্ধে জেহাদ করা হলো বড় জেহাদ।