যে এবারত ‘জাহিরুর রেওয়ায়েত’ নামে প্রচারিত! সে এবারত সম্পর্কে দু’টি কথা। ولا عبرة لأختلاف المطالع “উদয়াস্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়।”
মূলত এটা জাহিরুর রেওয়ায়েত নয়। ইমাম মুহাম্মদ রহ. এর লিখিত জাহিরুর রেওয়ায়েতের ছয় কিতাব- ১. আল-মাবসুত, ২. জামেউল কবীর, ৩. জামেউস সাগীর, ৪. সিয়ারু কবীর, ৫. সিয়ারু সাগীর ও ৬. আয-যিয়াদাত, এই ছয় কিতাবের কোথাও এই এবারতের অস্তিত্ব নেই।
এছাড়াও ‘মুখতাছারুত তাহাবী’ (ওফাত ৩২১ হি.), ‘মুখতাছারুল কারখী’ (ওফাত ৩৪০ হি.), ‘আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস’ (ওফাত ৩৭০ হি.), ‘মুখতাসারুল কুদুরী’ (ওফাত ৪২৮ হি.), ‘বিদায়াতুল মুবতাদী’ (ওফাত ৫৯৩ হি.), ‘তুহফাতুল ফুকাহা’ (ওফাত ৫০৮ হি.) এই কিতাবগুলোও জাহিরুর রেওয়ায়েতের মাসায়েলের বিশেষ সূত্র হিসেবে গণ্য। কিন্তু এসব কিতাবেও কথিত সেই জাহিরুর রেওয়ায়েতের কোনো অস্তিত্ব নেই।
বরং ৫৪০ হিজরীর পূর্বে ولا عبرة لأختلاف المطالع এই এবারতকে জাহিরুর রেওয়ায়েত বলে কেউ দাবীই করেনি। সর্বপ্রথম ইফতেখার উদ্দিন ইবনু তাহির ইবনে আহমাদ ইবনে আব্দির রশিদ বুখারী রহ. (ওফাত ৫৪২ হি.) তদীয় ‘খুলাসাতুল ফাতওয়া’ গ্রন্থে এটা তাসামূ’ এর কারণে ফকিহ্ আবুল লাইস সমরকান্দি রহ. এর রেফারেন্সে জাহিরুর রেওয়ায়েত বলে দাবী করেছেন। পরবর্তীতে তিনার ছাত্র ইমাম কাজীখাঁন রহ. (ওফাত ৫৯২ হি.) তদীয় ফাতওয়ার গ্রন্থে এটাকে ইমাম হালওয়ানী রহ. এর সূত্রে জাহিরুর রেওয়ায়েত বলে উল্লেখ করেছেন।
বাস্তবে এই এবারত না ফকিহ্ আবুল লাইস সমরকান্দী রহ. এর কিতাবে আছে! না ইমাম হালওয়ানী রহ. এর কিতাবে আছে!!
প্রিয় পাঠক, আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি, ফকিহ্ আবুল লাইস সমরকান্দী রহ. (ওফাত ৩৭৫ হি.) এর বিখ্যাত গ্রন্থ “عيون المسائل في فروع الحنفية” এর মধ্যে المنتقي গ্রন্থ থেকে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর ভিন্ন একটি ফাতওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু ولا عبرة لأختلاف المطالع এই ধরণের কোন কথাই তিনি উল্লেখ করেননি। এমনকি তিনার আরো দুইটি গ্রন্থ রয়েছে- “খিজানাতুর রিওয়ায়াহ ও মুখতালিফুর রিওয়ায়াহ”। এই দুইটি গ্রন্থের মধ্যেও ওই এবারতের কোন অস্তিত্ব নেই।
অপরদিকে ইমাম কাজীখাঁন রহ. এই এবারতটি ইমাম হালওয়ানী রহ. এর রেফারেন্সে বলেছেন। অথচ ইমাম হালওয়ানী রহ. এর কোন গ্রন্থেও এরূপ কোন এবারতের অস্তিত্ব নেই। বড় আজিব ব্যাপার!
শামসুল আইম্মা ইমাম হালওয়ানী রহ. (ওফাত ৪৪৮ হি.) এর ফাতওয়াটি হল নিম্নরূপ-
قال الحلواني: الصحيح من مذهب اصحابنا أن الخبر اذا استفاض في بلدة أخرى وتحقق يلزمهم حكم تلك البلدة.
অর্থাৎ ইমাম হালওয়ানী বলেন, আমাদের মাযহাবে বিশুদ্ধ ফাতাওয়া হল, যখন চাঁদ দেখার সংবাদ অন্য কোন শহরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হবে এবং ইহার উপর কাজী কর্তৃক গবেষণা করা হবে তখন দ্বিতীয় শহরবাসীর জন্য রোজা রাখা আবশ্যক হবে। (আল-মুহিতুল বুরহানী, ২/৩৭৯)
প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন, পৃথিবীর এক প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলে অপরপ্রান্তে রোজা রাখতে হবে! এই ধরনের আজব কথা তিনি বলেননি।
পরবর্তীতে যেসকল ফকিহগণ এই এবারতকে উল্লেখ করেছেন তারা সবাই হয়৷ خلاصة الفتاوي অথবা فتاوي قاضيخان এর রেফারেন্স দিয়ে উল্লেখ করেছেন। তাদের ইহাকে জাহিরুর রেওয়ায়েত হিসেবে উল্লেখ করেননি। যেমন ইমাম মজিদ উদ্দিন আবুল ফজল হানাফী রহ. (ওফাত ৬৮৩ হি.) তদীয় ‘আল-এখতিয়ার লিতা’লিলিল মুখতার’ গ্রন্থে বলেছেন-
ولا عبرة لأختلاف المطالع هكذا ذكره قاضيخان قال وهو ظاهر الرواية،
অর্থাৎ উদয়াস্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়, ইহা উল্লেখ করেছেন কাজীখাঁন, তিনি বলেছেন: এটা জাহিরুর রেওয়ায়েত।
জগদ্বিখ্যাত ফাতওয়ায়ে আলমগীরীতেও উল্লেখ আছে,
ولا عبرة لأختلاف المطالع في ظاهر الرواية كذا في فتاوي قاضي خان.
অর্থাৎ জাহিরুর রেওয়ায়েতে আছে, উদয়াস্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়, যেমনটা ফাতওয়ায়ে কাজীখাঁনে উল্লেখ আছে।
এছাড়াও ইমাম ফরিদ উদ্দিন আন্দারাতী হিন্দি রহ. (ওফাত ৭৮৬ হি.) তদীয় ‘ফাতওয়া তাতারখানিয়া’-তে এভাবে উল্লেখ করেছেন, وفي الخانية لا عبرة لأختلاف المطالع অর্থাৎ কাজীখাঁনে আছে- উদায়স্থলের ভিন্নতা ধতর্ব্য নয়। আল-মুহিতুল বুরহানীর মধ্যেও কাজীখাঁনের সূত্রেই এই এবারত উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম ফখরুদ্দিন যায়লায়ী রহ. (ওফাত ৭৪৩ হি.) তদীয় ‘তাবইনুল হাকাইক শারহু কানজুদ দাকাইক’ গ্রন্থে এই এবারতকে ‘কানজুদ দাকাইক’-এর মুছান্নিফ ইমাম আবুল বারাকাত হাফিজুদ্দিন নাসাফী রহ. (ওফাত ৭১০ হি.) এর বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন, জাহিরুর রেওয়ায়েত হিসেবে নয়। যেমন তিনি লিখেছেন-
قال رحمه الله ولا عبرة باختلاف المطالع.
এছাড়াও এই এবারতকে ইমাম কাজী মুহাম্মদ ইবনু ফারামুজ মোল্লা খসরু রহ. (ওফাত ৮৮৫ হি.) জাহিরুর রেওয়ায়েত হিসেবে উল্লেখ করেননি বরং কোন কোন ফকিহ্ এর বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন-
من قال لا عبرة باختلاف المطالع
এরূপ আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে।
অতএব, প্রিয় দুঃখজনক হলেও সত্য এটা মূলত জাহিরুর রেওয়ায়েত নয়। বরং সর্বপ্রথম ইফতেখার উদ্দিন বুখারী রহ. তাসামূ’ এর কারণে এটা خلاصة الفتاوي গ্রন্থে পরবর্তীতে তিনার শাগরীদ ইমাম কাজীখাঁন রহ. জাহিরুর রেওয়ায়েত নামে চালিয়ে দিয়েছেন। যার ফলে পরবর্তী যুগে ইহাকে ফলো করেছেন।
অথচ ইমাম কাজীখাঁনের পূর্বে হানাফী মাজহাবের প্রায় ২০ জন মুজতাহিদ ফাতওয়া দিয়েছেন, উদয়াস্থলের ভিন্নতা হলে তাদের চাঁদ দেখার উপর আমল করা জায়েয হবে না। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ। (পর্ব ২)
মহান আল্লাহ তা’আলা সবাইকে বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুক, আমিন।
অধম- মুফ্তী মুহাম্মদ আলাউদ্দিন জেহাদী
খাদেমঃ বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আটরশি পাক দরবার শরীফ, ফরিদপুর।