ব্রেলভীদের খন্ডন করতে গিয়ে মাওলানা মিজান হারুন আহমদ রেজা খান বেরলভীর উপর ‘সুস্পস্ট শিরক’ এর অভিযোগ এনেছেন। সুস্পষ্ট শিরক বলতে যদি তিনি শিরকে আকবর ( বড় শিরক), শিরকে জলী ( সুস্পষ্ট বা প্রকাশ্য শিরক) উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন, তাহলে এটি গুরুতর একটি অভিযোগ। এধরণের বড় শিরকের মাধ্যমে খোদ আহমদ রিদা খান মুসলমান ছিলেন নাকি মুশরিক সেই প্রশ্ন এসে পড়ে। সুস্পষ্ট শিরক দ্বারা মাওলানা মিজান হারুনের উদ্দেশ্য যদিও নজদীদের মতো বড় শিরকের অভিযোগ করে আহমদ রিদ্বা খানকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়া, তবে এখানে তার ব্যাখ্যার সুযোগ আমরা রাখছি। আশা করি, তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রদান করবেন। আশ্বর্য্যের বিষয় হলো, তার এই আলোচনার পাঠকগণও তার আলোচনা থেকে ‘সুস্পষ্ট শিরক’ দ্বারা বড় শিরক উদ্দেশ্য নিয়েছেন। বেশ কয়েকজন কমেন্টও করেছেন আহমদ রিদ্বা খানকে বড় শিরকের অভিযোগ করে। মাওলানা মিজান হারুন সাহেব সেখানেও কোন প্রতিবাদ করে বলেননি যে, সুস্পষ্ট শিরক দ্বারা আমি বড় শিরক উদ্দেশ্য নেইনি, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এর অর্থ হলো, তার বক্তব্য ও তার পাঠকদের বক্তব্যও কাছাকাছি। অর্থাৎ সালাতে গাউসিয়ার মাধ্যমে আহমদ রিদ্বা খান বা তার অনুসারীরা বড় শিরক করেছেন। এটি তাদের অভিযোগের মূল বিষয়।
এখানে বলে নেয়া প্রয়োজন যে, মিজান হারুন সাহেব আহমদ রিদ্বা খানের পক্ষ থেকে উলামায়ে দেওবন্দের উপর তাকফির হওয়ার কারণে বেশ কিছু আবেগঘণ পোস্ট দিয়েছেন। আবার এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি নিজেই সেই আহমদ রিদ্বা খানের উপর সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ আনছেন। আপনার কাছে যিনি সুস্পষ্ট শিরককারী, সেই যদি আপনার পছন্দনীয় কাউকে কাফের বলে এতে আশ্চর্য্য হওয়ার কী আছে? হুকুমের দিক থেকে মাওলানা মিজান হারুনের পক্ষ থেকে দেয়া অভিযোগ অর্থাৎ শিরকের অভিযোগ বেশি গর্হিত কুফর থেকে। এক দিকে আহমদ রিদ্বা খানের পক্ষ থেকে তাকফির হলে সেটাকে খুব বড় করে উপস্থাপন করছেন আবার সেই তিনিই খোদ আহমদ রিদ্বা খানের উপর সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ করছেন। কারও উপর শিরক বা কুফরের অভিযোগ যদি গুরুতর বিষয় হয়, তাহলে তিনি নিজেও সেই একই কাজ করেছেন, যেই কাজের জন্য তিনি অন্যকে অভিযোগ করছেন। বেরলভীরা যদি দেওবন্দীদেরকে তাকফির করে থাকে, তাহলে খোদ মিজান হারুন বেরলভীদের উপর সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ এনে একই কাজ করেছেন। ফলাফলের দিক থেকে উভয়ের কাজ সমান।
আমাদের আজকের পর্যালোচনায় আমরা দেখব, আহমদ রিদ্বা খানের উপর মিজান হারুন যে সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ এনেছেন এর বাস্তবতা আসলে কী? আহমদ রিদ্বা খান কি এমন কিছু বলেছেন বা করেছেন যা তার সুস্পষ্ট শিরকের প্রমাণ হতে পারে? এখানে মিজান হারুন কি অন্যায়ভাবে আহমদ রিদ্বা খানের উপর শিরকের অভিযোগ এনেছেন? নাকি বাস্তবেই আহমদ রিদ্বা খান সুস্পস্ট শিরক করেছেন?
এই প্রশ্নের উত্তরের আগে চলুন মাওলানা মিজান হারুনের বক্তব্য দেখে নেয়া যাক। মাওলানা মিজান হারুন লিখেছেন,
ব্রেলভীদের নামাযে গাউসিয়্যাহ
ব্রেলভীদের একটি নামাযের নাম হলো ‘নামাযে গাউসিয়্যাহ’ বা ‘গুপ্ত নামায’ (صلاة الأسرار)। আব্দুল কাদের জীলানীর কাছে সাহায্যপ্রার্থনার জন্য এই নামায পড়া হয়। ‘নামাযে গাউসিয়্যাহ’ এর পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমদ ব্রেলভী আব্দুল কাদের জীলানীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন এভাবে: قال سيدنا ومولانا الغوث الأعظم رضي الله تعالى عنه: من توسل بي في شدة فرجت عنه، ومن استغاث بي في حاجة قضيت له، ومن صلى بعد المغرب ركعتين، ثم يصلي ويسلم على النبي صلى الله تعالى عليه وسلم، ثم يخطو إلى جهة العراق احدى عشرة خطوة، يذكر فيها اسمي قضى الله تعالى حاجته অর্থাৎ ‘আমাদের সাইয়্যেদ ও মাওলানা, গাউসুল আজম রাযিয়াল্লঅহু আনহু বলেন, ‘যে ব্যক্তি সংকটের সময় আমার উসিলা গ্রহণ করে আমি তার সংকট দূর করে দিই। আর যে কোনো প্রয়োজনে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, আমি তার প্রয়োজন পূর্ণ করি দিই। আর মাগরিবের নামাজের পরে যে ব্যক্তি দুই রাকাআত নামাজ পড়বে। রাসূলুল্লাহর ওপর দরূদ পড়বে। অতঃপর ইরাকের দিকে এগারো কদম অগ্রসর হতে হতে মুখে আমার নাম যপবে। আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দিবেন’ [ফাতাওয়া: ৭/৬৩৮] এটাকেই বলা হয় নামাযে গাউসিয়্যাহ। [অবশ্য এই বক্তব্য জীলানী র. এর ওপর মিথ্যাচার। এটা আবিষ্কার করেছেন তার জীবনীকারক শাতনূফী]
ব্রেলভী বলেন, ‘এগুলো করার সময় ধ্যান করবে যেন সে বাগদাদে আছে। হযরতের কবর তার চোখের সামনে। তিনি কিবলামুখী হয়ে শুয়ে আছেন। বান্দা তার অনুগ্রহ চাওয়ার ইচ্ছা করবে। কিন্তু অপরাধবোধ ও লজ্জার কারণে চাইতে পারবে না। ফলে তখন পেরেশান থাকবে। যেন তার কাছে অনুমতি চাইবে। তার সাগরসম উদারতা ও তার ‘আমার প্রত্যাশী ভালো না হলেও আমি ভালো’- এই সুসংবাদের সুবাদে তার কাছে শাফায়াত প্রার্থনা করতে চাইবে। এই দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই যেন গউসে আজম তার দিকে চোখ তুলে তাকাবেন। তার দুরবস্থা ও লজ্জা দেখবেন। পাপী বান্দার প্রতি দয়াপরবশ হবেন এবং সুপারিশ করবেন। যেন তিনি বলবেন, ‘আমি তাকে সামনের কদমগুলো পূর্ণ করার অনুমতি দিচ্ছি’। তখন সে আমার নাম যপবে। আমার কাছে গুনাহের কারণে ভয় পাবে না। কারণ আমি তার জামিনদার। তার দুনিয়া ও আখিরাতের সবকিছুর অভিভাবক। বান্দা তখন উদ্দীপ্ত হবে। প্রচণ্ড ভাবাবেগে সামনে অগ্রসর হবে আর প্রতি কদমে বলতে থাকবে, ‘হে জ্বিন ও ইনসানের মুক্তিদাতা! হে দয়ালু পুণ্যাত্মা! আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করুন! হে প্রয়োজন পূর্ণকারী! আমার প্রয়োজন পূরণে সাহায্য করুন’ (ويذكر فيها اسمي ولا يخشى المعاصي عندي، فإني أنا ضمينه وكفيل مهماته في الدنيا والآخرة، فينشط العبد ويتقدم على أقدام الوجد قائلا على كل خطوة: يا غوث الثقلين، ويا كريم الطرفين، أغثني، وأمددني في قضاء حاجتي يا قاضي الحاجات)!!! [ফাতাওয়া: ৭/৬৪৬-৬৪৭]
ইন্নালিল্লাহ! জীলানী জ্বিন ও ইনসানের মুক্তিদাতা। প্রয়োজনপূর্ণকারী। তাহলে আল্লাহর জন্য তারা কী বাকি রেখেছে? আল্লাহ বলেছেন, ’তোমরা আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো’ [মুমিন: ৬০] আর তারা শেখাচ্ছে আব্দুল কাদের জীলানীকে ডাকতে। এগুলো সুস্পষ্ট শিরক। অপব্যাখ্যাকারীদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিন।
বক্তব্যের স্ক্রিনশট:
মিজান হারুন সাহেব শুরুতে লিখেছেন, “আব্দুল কাদের জীলানীর কাছে সাহায্যপ্রার্থনার জন্য এই নামায পড়া হয়।”
তার এই বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ নিলে একজন পাঠকের কাছে খুব নিকৃষ্ট একটি অর্থ বুঝে আসে। তিনি কেমন যেন বোঝাতে চান, আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। যদিও আমাদের এই পর্যালোচনার পর খুবই সম্ভাবনা আছে, তিনি বলবেন, আমি উক্ত কথার বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নেয়নি। যদিও তার পাঠকরা কিন্তু ঠিকই এই নিকৃষ্ট অর্থটি বুঝেছে। এবং স্বাভাবিকভাবে কেউ যদি তার লেখা পড়ে, বাহ্যিকভাবে এটিই বুঝে আসে যে, আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। এজন্য মিজান হারুনের এক ভক্ত পাঠক আবু হাফসা লিখেছে,
শিরক মিশ্রিত সালাত আবার কী জিনিস? হয়ত এখানে শিরক-মিশ্রিত সালাত বলতে আসলে মিজান হারুন সাহেবের উপরের বক্তব্য থেকে বোঝা নিকৃষ্ট অর্থটি উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্যের জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। আর আমরা সবাই জানি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য যে কোন প্রকারের ইবাদত সুস্পষ্ট শিরক। সেই ইবাদত যদি নামাজ হয়, তাহলে সেটি শিরক হওয়ার ক্ষেত্রে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। মিজান হারুন সাহেব যেভাবে লিখেছেন, এতে এই ধরণের একটি নিকৃষ্ট শিরকের অভিযোগ ওঠে আহমদ রেজা খান বেরলভী ও তার অনুসারীদের উপর। যদিও মিজান হারুন সাহেব তার বক্তব্যকে বাহ্যিক অর্থে নিয়ে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এই দাবী করতে পারেন, এজন্য তার বক্তব্যের ব্যাখ্যার দায় তার উপর রেখেই আমরা পরবর্তী আলোচনায় যাব। আমরা চাই, তিনি নিজেই তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিক। তবে যারা তার বক্তব্য থেকে এধরণের শিরকী অর্থ বুঝে আহমদ রেজা খানের উপর অন্যায়ভাবে শিরকের অভিযোগ করেছে, তাদের ভুল ধারণা অপনোদন করা জ্বরুরি।
শুরুতেই দু’টি মূলনীতি বুঝে নেয়া দরকার।
১। ইসলামে ছোট-বড় যে কোন ধরণের ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য সুনির্দিষ্ট। যে কোন ইবাদতই আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করা শিরক। সেই ইবাদত ছোট হোক কিংবা বড় হোক। ইবাদতের নিয়তে যে কোন কাজ গাইরুল্লাহর জন্য করা শিরক।আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন নবী, রাসূল, গাউস, কুতুব কারও জন্য কোন প্রকার ইবাদত করার সুযোগ নেই।
২। শরীয়াতে বিভিন্ন ইবাদত, আমল, ব্যক্তিকে আল্লাহর কাছে দু’য়া করার মাধ্যম বা ওসিলা হিসেবে গ্রহণ করা স্বীকৃত। খোদ কুরআনেই আল্লাহ তায়ালা ওসিলা গ্রহণের কথা বলেছেন। এজন্য নামাজ, রোজাসহ বিভিন্ন আমলকে আল্লাহর নিকট ওসিলা হিসেবে পেশ করার অনুমতি রয়েছে। এবং এধরণের ওসিলা গ্রহণের বিষয়ে পুরো উম্মতের ইজমা রয়েছে। নজদী-তাইমীরা ওসিলার কিছু প্রকারকে অস্বিকার করলেও মৌলিক ওসিলাকে তারাও স্বীকার করে।
শরীয়াতের এমন কিছু আ’মলের নির্দেশনা রয়েছে যেগুলোর বাহ্যিক নাম দেখলে মনে হবে এটি গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত করা হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো, এগুলোর ক্ষেত্রে মূল ইবাদত আল্লাহর জন্যই করা হচ্ছে। তবে সেই ইবাদতকে সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণের ওসিলা হিসেবে আল্লাহর কাছে পেশ করা হচ্ছে। যেমন, সালাতুল ইস্তিসকা। বা বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ।
বৃষ্টির জন্য নামাজের অর্থ কী? যদি বাহ্যিক অর্থ নেন, তাহলে এটি খুব নিকৃষ্ট একটি অর্থ হবে। অর্থাৎ গাইরুল্লাহ তথা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। আর আমরা জানি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর জন্য ইবাদত শিরক। তাহলে কি বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়া শিরক? কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে নাউজুবিল্লাহ একথা বলতে পারে, গ্রহ-নক্ষত্র বা মেঘের জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে, যাতে বৃষ্টি হয়।
এভাবে বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ নিলে শিরক সাব্যস্ত হয়। কিন্তু শরীয়াতে আসলে বিষয়টিকে এই নিকৃষ্ট অর্থ নেয়ার জন্য সাব্যস্ত করা হয়নি। বরং সালাতুল ইস্তিসকা বা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ দ্বারা এমন নামাজ উদ্দেশ্য যা আল্লাহর জন্যই পড়া হয়েছে। নামাজ বা ইবাদত হয়েছে একমাত্র আল্লাহর জন্য। কিন্তু এখানে উক্ত নামাজকে বৃষ্টির প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহর কাছে ওসিলা হিসেবে পেশ করা হচ্ছে।
একইভাবে সালাতুল হাজাহ বা প্রয়োজন পূরণের নামাজ। সালাতুল কুসুফ বা সূর্যগ্রহণের নামাজ। সূর্যগ্রহণের নামাজ দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে, সূর্যগ্রহণের জন্য কিংবা সূর্য্যের জন্য ইবাদত করা হচ্ছে। বরং নামাজ পড়া হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতের জন্য। এবং এই নামাজের ওসিলায় আল্লাহর কাছে সূর্য্যগ্রহণের মতো একটি বিপদের বিষয় থেকে হেফাজত চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাহ্যিক অর্থ নিলে এখান থেকে একটি নিকৃষ্ট অর্থ বের হয়। যা শিরক বোঝায়। একইভাবে সালাতুল খুসুফ বা চন্দ্রগ্রহণের নামাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ইস্তিখারা, হাজত, কুসুফ, খুসুফ, ইস্তিসকা এভাবে আল্লাহ ছাড়া গাইরুল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করে যত নামাজের কথা শরীয়াতে আছে, সব ক্ষেত্রেই মূল ইবাদত আল্লাহর জন্য করা হচ্ছে। সেই ইবাদতকে আল্লাহর কাছে ওসিলা হিসেবে পেশ করা হচ্ছে।
এখানে কেউ যদি বাহ্যিক শব্দের ব্যবহার থেকে গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত বা শিরক সাব্যস্ত করে, তাহলে তার বক্তব্য খন্ডনের পূর্বে তার আক্বল-বুদ্ধির চিকিৎসা প্রয়োজন।
এবার আসুন সালাতুল গাউসিয়া নিয়ে আলোচনা করা যাক। সালাতুল গাউসিয়া এর অর্থ কী? আব্দুল কাদের জিলানীর জন্য নামাজ পড়া কিংবা মাওলানা মিজান হারুনের ভাষায় আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্যের জন্য নামাজ পড়া?
এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ ছাড়া আব্দুল কাদের জিলানী বা অন্য কারও ইবাদতের জন্য নামাজ পড়া বড় শিরক। এধরণের কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে সরাসরি মুশরিক হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, সালাতুল গাউসিয়াতে কি আল্লাহর জন্য নামাজ পড়া হয় নাকি আব্দুল কাদের জিলানীর জন্য পড়া হয়?
মাওলানা মিজান হারুনের বাহ্যিক বক্তব্য থেকে বোঝা যায় (যদিও তিনি তার বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার সম্ভাবনা আছে) এটি আব্দুল কাদের জিলানীর জন্য পড়া হয়। নাউজুবিল্লাহ। মাওলানা লিখেছেন,
“ব্রেলভীদের একটি নামাযের নাম হলো ‘নামাযে গাউসিয়্যাহ’ বা ‘গুপ্ত নামায’ (صلاة الأسرار)। আব্দুল কাদের জীলানীর কাছে সাহায্যপ্রার্থনার জন্য এই নামায পড়া হয়।”
আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় হলো, মাওলানা মিজান হারুনের উপরের বক্তব্যটি কতটুকু বাস্তব? আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী বা তাদের অনুসারীরা কি এই নামাজকে আল্লাহর ইবাদত ছাড়া আব্দুল কাদের জিলানীর সাহায্য পাওয়ার জন্য পড়ে থাকে?
চলুন, খোদ আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্য থেকেই এর জওয়াব নেয়ার চেষ্টা করি। আমি এখানে আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্যটি দীর্ঘ হলেও সম্পূর্ণ বক্তব্যের মূল অংশগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব, যাতে পুরো বিষয়টা পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়।
আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী লিখেছেন,
“সালাতুল আসরারের পদ্ধতি হলো, কোন ব্যক্তির যদি দ্বীনি বা দুনিয়াবী কোন প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সে মাগরিবের নামাজের পরে মাগরিবের সুন্নতের সাথে দু’রাকাত নামাজ আদায় করবে। সালাতুল আসরারের নিয়ত করে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে (তাকাররুবান ইলাল্লাহ) এটি আদায় করবে এবং এই নামাজের সওয়াবের হাদিয়া গাউসে আজম আব্দুল কাদের জিলানীর রুহের জন্য পাঠাবে। যদি এর জন্য নতুন ওজু করে তাহলে ভালো। কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক অন্ধ সাহাবির চোখের সুস্থ্যতার জন্য যেই সালাতুল হাজত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখানে নতুন ওজুর কথা বলেছিলেন। যদিও এখানে নতুন ওজু না করার সুযোগ আছে। যদি ওজু করে তাহলে ভালোভাবে করবে। কারণ, অন্ধ সাহাবিকে এমন নির্দেশ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছিলেন। আমার কাছে পছন্দনীয় হলো, সালাতুল আসরার পড়ার পূর্বে কিছু দান – সাদকা করবে। কারণ, এটি দু’য়া কবুলের জন্য দ্রুততর মাধ্যম। এবং বালা-মুসিবতের দরজা বন্ধের ওসিলা। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোন কিছু জিজ্ঞাসা বা চাওয়ার পূর্বে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সদকা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাওয়ার পূর্বে সাদকা করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে সামগ্রিকভাবে সালাতুল আসরারে নবীজীর কাছে চাওয়ার বিষয়ও আছে। নবীজীর কাছে জিজ্ঞাসা বা চাওয়ার পূর্বে সাদকা করার আয়াতটির ওয়াজিব বিধান আল্লাহর রহমত হিসেবে রহিত হলেও এটি মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
নামাজে সূরা ফাতিহার পরে যদি এগারবার সূরা ইখলাস পাঠ করে তাহলে এটি উত্তম। নামাজের সালাম শেষে আল্লাহর শান মোতাবেক তার হামদ ও সানা (গুণকীর্তন) করবে। এক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত শব্দে হামদ – সানা করা উত্তম। কারণ, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো অন্য কেউ আল্লাহর প্রসংশা করতে সক্ষম নয়। হামদের ভেতরে সুন্দর একটি হামদ হলো,
الحمدلله حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه ملء السموات وملء الارض وملء مابينهما وملء ماشئت من شئ بعد
অথবা এটি পড়বে,
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا دَائِمًا مَعَ خُلُودِكَ ، وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا لا مُنْتَهَى لَهُ دُونَ مِشْيَتِكَ ، وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا لا يَزِيدُ قَائِلُهَا إِلا رِضَاكَ ، وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا مَلِيًّا عِنْدَ كُلِّ طَرْفَةِ عَيْنٍ وَتَنَفُّسِ نَفَسٍ
অথবা
اللَّهُمَّ لَكَ الحَمْدُ كَمَا يَنْبَغِي لِجَلَالِ وَجْهِكَ وَعَظِيمِ سُلْطَانِكَ
اللهم لك الحمد شكرا ولك المن فضلا
অথবা,
اللهم لك الحمد كالذي نقول وخيرا مما نقول
অথবা এজাতীয় যতো হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর কোন একটি পড়বে। এক্ষেত্রে সবগুলো জমা করে পড়তে পারে অথবা এগুলোর কিছু কিছু পড়তে পারে। আমার পছন্দ হলো, হামদ – সানা শেষ করবে এর মাধ্যমে, কারণ এটি আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা জমা করে এবং এটি প্রশংসার মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক পর্যায়ের।
اللهم لا أحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك
যে উপরের কোনটি ভালোভাবে পারে না সে শুধু তিনবার আল-হামদুলিল্লাহ পড়বে। অথবা আল্লাহর প্রশংসার নিয়তে সূরা ফাতিহা অথবা আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে। কারণ এগুলোর চেয়ে অধিক প্রশংসার কোন কিছু সে করতে পারবে না।
এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ১১ বার দুরুদ ও সালামের হাদিয়া পেশ করবে। কারণ, আল্লাহর কাছে নবীজীর উপর দুরুদ পাঠ করা ছাড়া কোন দু’য়া কবুল হয় না। দুরুদের সাথে এখানে সালামও পেশ করবে। যাতে দুুরুদ ও সালাম উভয়টির ফজীলত হাসিল করতে পারে। আবার শুধু দুরুদ বা সালাম পেশ করার ক্ষেত্রে উলামাদের ইখতিলাফের বিষয় থেকে বাঁচার জন্য উভয়টি পাঠ করা উত্তম। কারণ, কিছু কিছু আলিম দুরুদ ও সালামের যে কোন একটা পড়াকে মাকরুহ বলেছেন।
দুরুদ ও সালামের ক্ষেত্রে অধম (আহমদ রিদ্বা খান) এর পছন্দ হলো, এক্ষেত্রে আব্দুল কাদের জিলানী থেকে বর্ণিত দুরুদটি পড়বে। সেটি হলো,
اللهم صل على سيدنا و مولانا محمد معدن الجود و الكرم و اله و سلم
অধম এই দুরুদকে এভাবে পড়ে থাকি,
اللهم صل على سيدنا و مولانا محمد معدن الجود و الكرم واله الكرام و ابنه الكريم و امته الكريمة يا اكرم الاكرمين و بارك و سلم
এরপর সে তার অন্তরকে মদিনার দিকে ধাবিত করবে এবং এগারবার বলবে,
يا رسول الله يا نبي الله اعثني و امددني في قضاء حاجتي يا قاضي الحاجات
(অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল, হে আল্লাহর নবী, আমার এই প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে আপনি আমাকে সাহায্য করুন, মদদ করুন। হে নবী, আপনি প্রয়োজনসমূহ পূর্ণকারী)
এরপর স্বাভাবিকভাবে ইরাকের দিকে এগার কদম হাটবে। (এরপর আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী হিন্দুস্তান থেকে ইরাকের দিক নিয়ে কিছু আলোচনা করেছেন। আমরা সেই আলোচনা এড়িয়ে গিয়েছি)। কারণ এটি স্বাভাবিক থাকা বাঞ্চনীয়। সাধারণ মানুষ যেভাবে করে সেভাবে নয়। অর্থাৎ তারা এক কদম বলতে কী উদ্দেশ্য সেটা বোঝে না। তারা প্রতি কদমে দুই চার আঙ্গুল অগ্রসর হয়। এটি আসলে কোন কদম নয়। এজন্য এখানে এক কদম হাটার কথা আছে। প্রয়োজন ছাড়া ভিন্ন কিছু করা এখানে ভুল। তবে যদি এমন জায়গায় থাকে যেখান হাটার সুযোগ নেই কিংবা বাহির কোন জায়গা নেই, তাহলে যতটুকু পারে ততটুকু করবে। এর চেয়ে নিকৃষ্ট একটি বিষয় আমি দেখেছি সাধারণ মানুষের মাঝে, সেটি হলো, তারা নামাজ আদায় করে। এমনকি দ্বিতীয় রাকাতের ক্বিরাত শেষ করে নামাজের মধ্যেই ইরাকের দিকে এগার কদম অগ্রসর হয়। এরপর সেখান থেকে ফিরে এসে কেবলার দিকে ফিরে বাকী নামাজ আদায় করে। অথচ এই মিসকীন জানে না যে, এর দ্বারা তার নামাজই বাতিল হয়ে যায়। আর এটি আব্দুল কাদের জিলানী থেকে বর্ণিত পদ্ধতিরও বিরোধী। শরীয়াতে এভাবে কোন আমলকে বাতিল করা হারাম। আর নফল শুরু করলে সেটির কাজা করা ওয়াজিব। সে এটি জানেও না। এভাবে সে দ্বিগুন গুণাহের মধ্যে নিপতিত হয়। এধরণের লোকদেরকেই হাদীসে এসেছে, সঠিক ফিকহ না জেনে আমলকারী হলো সেই গাধার মতো যে আটা পিষতে পিষতে জীবন কাটিয়ে দেয়। এই লোকের চেয়ে তার যে শায়খ তাকে এই ধরণের আমলের কথা বলেছে সে বড় অপরাধী। লা হাউলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।
ইরাকের দিকে হাটার সময় আদব, ভয়, নম্রতা ও বিনয়ের সাথে অগ্রসর হবে। আমি পছন্দ করি সে যেন এই কল্পনা করে যে, সে কেমন যেন বাগদাদে উপস্থিত। আব্দুল কাদের জিলানীর কবর তার চোখের সামনে। তিনি কেবলামুখী হয়ে সেখানে শায়িত আছেন। অধম তার অনুগ্রহের আশাবাদী হয়ে তার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করবে তবে অধিক গোনাহের কারণে যেন লজ্জার আড়স্টতা তাকে গ্রাস করেছে। সে হয়রান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপর কেমন যেন সে তার কাছে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি চাচ্ছে এবং তার সুপারিশের আবেদন করছে। কারণ, তার বদান্যতা ও অনুগ্রহ প্রশস্ত। কারণ তিনি সুসংবাদ দিয়েছেন, আমার মুরিদরা যদি ভালো না থাকে তাহলে আমি কীভাবে ভালো থাকব?।
সে এভাবে কল্পনা করবে যে, তিনি তাকে দেখছেন এবং তার দীনতা ও লজ্জার বিষয়টি জানেন। তখন তার বদান্যতা ও অনুগ্রহের কারণে তিনি গোনহগার অধম বান্দার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন। কেমন যেন তিনি বলছেন, “এই অধম মিসকিনকে আমি ইরাকের দিকে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি দিয়েছি, সে আমার নাম স্মরণ করে। আমার কাছে তার গোনাহের ভয় করে না। তার দুনিয়া ও আখিরাতের চিন্তা-পেরেশানির দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার আমি।” এভাবে বান্দা নিজেকে প্রস্তুত করে ওয়াজদ অবস্থায় প্রতিটা কদম অগ্রসর হয়ে বলবে,
يا غوث الثقلين و يا كريم الطرفين اغثني و امددني في قضاء حاجتي يا قاضي الحاجات
(অর্থ: হে উভয় জাহানের সাহায্যকারী, হে পিতৃ-মাতৃকুল উভয় দিক থেকে সম্মানিত, আপনি আমাকে আমার এই প্রয়োজন পূরণে সাহায্য ও সহযোগিতা করুন। আপনি প্রয়োজনসমূহ পূর্ণকারী)
এরপর সাইয়্যিদুল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসিলায় এবং তার এই সম্মানিত সন্তান গাউসুল আজমের ওসিলায় আল্লাহর কাছে দু’য়া করবে। আর দু’য়ার শব্দসমূহের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম যেসব দু’য়ার আদব লিখেছেন সেগুলো রক্ষা করবে। বিশেষ করে হিসনে হাসীন সহ অন্যান্য দু’য়ার কিতাবে যা বর্ণিত হয়েছে। দুয়ার ফজীলত ও বিভিন্ন দু’য়া সংকলনের ক্ষেত্রে আমার সম্মানিত পিতা ইমামুল মুহাক্কিকীন মাওলানা নকী আলী খান একটি সুন্দর কিতাব লিখেছেন। এর নাম দিয়েছেন, আহসানুল বিয়া লি-আদাবিদ দু’য়া। আমি জাওয়াহিরুল বায়ান ফি আসরারিল আরকান কিতাবের হজ্বের অধ্যায়ে এর সার-সংক্ষেপ তুলে ধরেছি।
আল্লাহর কাছে দু’য়ার ক্ষেত্রে ইয়া আরহামার রাহিমীন তিনবার বলে শুরু করবে। কারণ, যে এটি বলবে, এর জন্য নির্ধারিত একজন ফেরেশতা তাকে ডাক দিয়ে বলবে আরহামুর রহিমীন তোমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এবং ইয়া বাদীয়াস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ, ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম পড়বে। কারণ একটি বর্ণনা অনুযায়ী এটি ইসমে আজম। একইভাবে দু’য়ায়ে ইউনুস পাঠ করবে। তিনবার আমীন বলে দু’য়া শেষ করবে। কারণ এটি দু’য়া শেষ করার বাক্য এবং আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে উম্মতে মুহাম্মাদীকে এটি দান করেছেন। সেই সাথে খাতামুন নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ ও সালাম পেশ করবে এবং শেষে হামদ পাঠ করবে। যাতে করে তার দু’য়ার শুরু ও শেষ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদের মাধ্যমে হয়। কারণ দু’য়া হলো পাখির মতো। এই পাখির ডানা হলো দুরুদ। সুতরাং দুরুদের মাধ্যমে দু’য়ার ডানা পরিপূর্ণ হয়। আর যেহেতু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পাঠ করা নি:সন্দেহে কবুল হয়, এজন্য কোন দু’য়ার উভয় প্রান্ত যদি কবুল হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালার অধিক দয়ার কারণে মাঝের দু’য়াগুলি কবুলের ব্যাপারেও আশা করা যায়। আর দু’য়া যেন বেজোড় হয়। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বেজোড়, তিনি বেজোড় পছন্দ করেন। প্রত্যেক দু’য়ার পরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পাঠ করবে। কারণ দু’য়া কবুলের জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পাঠের চেয়ে অধিক কার্যকরী কোন কিছু নেই। আর চেষ্টা করবে যেন চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয়। কারণ এটি দু’য়া কবুলের আলামত। যদি কান্না না আসে, তাহলে কান্নার ভান করবে। কারণ, যে যাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হবে। দু’য়া করার সময় আমার কাছে পছন্দনীয় হলো, ইরাকের দিকে মুখ করে থাকবে। কারণ এটি তার জন্য সুপারিশকারীদের দিক। তার জন্য তখন কেবলামুখী হওয়া জ্বরুরি নয়। দ্বিতীয় আব্বাসী খলিফা আবু জা’ফর মানসুর মদিনার শ্রেষ্ঠ আলিম ইমাম মালিককে জিজ্ঞেস করেন, হে মালিক, আমি কি দু’য়ার সময় কেবলামুখী হয়ে দু’য়া করব নাকি নবীজীর দিকে মুখ করে দু’য়া করব? তখন ইমাম মালিক রহ: বলেন, আপনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুখ ঘোরাবেন কেন? তিনি তো আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন আপনার ও আপনার আদি পিতা আদম আলাইহিস সালামের ওসিলা। বরং আপনি তার দিকে মুখ করে থাকুন, তাকে সুপারিশকারী বানান। আল্লাহ তায়ালা আপনার জন্য তার সুপারিশ কবুল করবেন।
মোটকথা, যে ব্যক্তি অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে, আল্লাহর কাছে তাড়াহুড়া করা যেমন বলল যে, আমি দু’য়া করলাম, কবুল হলো না, এগুলো করা ব্যতিরেকে দু’য়া করবে, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন। তবে শর্ত হলো এক্ষেত্রে কোন গোনাহ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না।
(ফতোয়ায়ে রিদাভিয়্যা, খ: ৭, পৃ: ৬৩৯-৬৫২)
আহমদ রিদ্বা খানের এই দীর্ঘ বক্তব্য উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্য হলো, এই বক্তব্য থেকে যেভাবে মাওলানা মিজান হারুন ‘সুস্পষ্ট শিরক’ বের করার চেষ্টা করেছেন, সেটি আদৌ এখানে পাওয়া যায় কি না। আমরা শুরুতেই বলেছি, মাওলানা মিজান হারুন সালাতুল গাউসিয়াকে যেভাবে আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্যের জন্য নামাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, আসলে বিষয়টি এমন নয়। মূল নামাজ পড়া হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতের জন্য। যেটি আহমদ রিদ্বা খান খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, নামাজটি তাকাররুবান ইলাল্লাহ বা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বা আল্লাহর ইবাদতের জন্য পড়বে। সুতরাং সালাতুল গাউসিয়াকে আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য প্রার্থনার নামাজ হিসেবে উপস্থাপন সঠিক নয়। বরং এখানে ব্যক্তি তার প্রয়োজন পূরণের জন্য, নামাজ, দুয়া-দুরুদ, নবীজীর কাছে ইস্তিগাছা, আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে ইস্তিগাছা সবই করছে ওসিলা হিসেবে। উপরের কোনটায় সরাসরি মৌলিক উদ্দেশ্য নয়। বরং সব কিছুই ওসিলা হিসেবে করা হচ্ছে। যা খোদ আহমদ রিদ্বা খান আলোচনার কয়েক জায়গায় স্পষ্ট করে লিখেছেনও। এবং সর্বশেষ তিনি বলেছেন, ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ করবেন আল্লাহ তায়ালা। এখানে আব্দুল কাদের জিলানীকেও সরাসরি প্রয়োজন পূরণকারী সাব্যস্ত করা হয়নি। বরং সকল আমল ও ওসিলার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রয়োজন পূরণ করবেন সেটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে।
মাওলানা মিজান হারুন যেই ফতোয়ায়ে রেজভিয়া থেকে তার বক্তব্যের উদ্ধৃতি এনেছে সেখানেই বিষয়গুলো স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। ইলমি আমানতের দাবী ছিলো, আহমদ রিদ্বা খানের এধরণের স্পষ্ট বক্তব্য উদ্ধৃত করা। যার মাধ্যমে শিরক সহ যে কোন ধরণের অপবাদের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখানে মাওলানা মিজান হারুন সচেতনভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে এমন একটি বক্তব্য লিখেছেন, যাতে মানুষের ধারণা শিরকের দিকে যায়। তিনি হয়ত দাবী করতে পারেন, কারও বক্তব্যের সব কিছু তো উদ্ধৃত করা জ্বরুরি নয়। কিন্তু এধরণের তা’বীল এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এই আলোচনার মৌলিক অংশ যার মাধ্যমে পুরো বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যেত, সেটি এড়িয়ে গিয়ে আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য প্রার্থনার জন্য নামাজ পড়া হয়, এজাতীয় একটি বাহ্যিক শিরকী বক্তব্য দিয়ে পুরো বিষয়টাকে তিনি ধোয়াশাপূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন।
(ফেসবুকে একই সাথে লম্বা পোস্ট শেয়ার কার যায় না। এজন্য বাকী অংশের জন্য আমার পরবর্তী পোস্টগুলো দেখুন)