ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে ফায়সালা দিয়েছেন আল্লামা হুসাইন হিলমী ঈশীক্ব (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) তাঁর এই লেখাটিতে [২০১২ সালে বাংলায় অনুবাদকৃত সংস্করণ], যা এখানে প্রকাশ করা হলো –
সম্প্রতি “সালাফিয়্যা” নামের একটি নতুন মনগড়া ও পথভ্রষ্ট ধর্মীয় মতবাদের উৎপত্তি হয়েছে। এই মতের অনুসারীরা নিজেদেরকে “সালাফী” দাবি করছে এবং নিজেদের নামের পেছনে “সালাফী” শব্দটি যোগ করছে; উপরন্তু দাবি করছে যে, তারা সালাফ আস্ সালেহীন তথা ইসলামের প্রাথমিক যুগের পূণ্যবান মুসলমানদের মযহাবের অনুসরণ করছে। বিশেষ করে সউদী ওহাবীদের বেতনভুক এদেশীয় দালাল ওহাবী-মওদূদীপন্থীরা এবং আহলে হাদীস সম্পদায়ের লোকেরা এ মতের পক্ষে ওকালতি করছে।
এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে তথাকথিত সালাফীদের ধোঁকাবাজি সম্পর্কে মুসলিম সমাজকে অবগত করার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তুরস্কের প্রথিতযশা আলেম ও লেখক আল্লামা হুসাইন হিলমী ইশিক (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি)। তাঁর এ প্রবন্ধ ‘নব্য ফিতনা: সালাফিয়্যা’- এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ।
প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, আহলে সুন্নাতের উলামায়ে কেরামের বইপত্রে ‘সালাফিয়্যা’ বা ‘সালাফিয়্যা মযহাব’ নামের কোনো কিছু উল্লেখিত হয় নি। এ সকল নাম, যা নাকি লা-মযহাবীদের দ্বারা পরবর্তীকালে বানানো হয়েছে, তা ধর্মীয় পদে সমাসীন অজ্ঞ লোকদের দ্বারা লা-মযহাবীদের আরবী বই-পত্র থেকে তুর্কী ভাষায় অনূদিত হওয়ার কারণে তুর্কীদের মধ্যে প্রসার লাভ করেছে। তাদের মতে: ‘সালাফিয়্যা’ হচ্ছে সেই মযহাবের নাম, যা আশআরিয়া ও মাতুরিদিয়া মযহাবগুলোর গোড়াপত্তনের আগে সকল সুন্নী মুসলিম কর্তৃক অনুসৃত হয়েছিল। তাঁরা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনগণের অনুসারী ছিলেন। সালাফিয়্যা মযহাব হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনগণের মযহাব। চারজন মহান ইমামই এ মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সালাফিয়্যা মযহাবের সমর্থনে লিখিত প্রথম পুস্তক হচ্ছে ইমামুল আযম হযরত আবু হানীফা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর ‘ফিকাহ আল্ আকবর’। ইমাম গাযযালী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) তাঁর প্রণীত ‘ইলজামুল আওয়াম আন্ ইলমিল কালাম’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, সালাফিয়্যা মযহাবে সাতটি প্রয়োজনীয় নীতি ছিল।
মুতা’খিরীন বা পরবর্তী উলামাগণের ইলমুল কালাম আরম্ভ হয়েছিল ইমাম গাযযালী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) হতে। কালাম শাস্ত্রের পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামগণের মযহাবসমূহ এবং ইসলামী দার্শনিকগণের দর্শনসমূহ অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ করে ইমাম গাযযালী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) ইলমুল কালামের পদ্ধতিসমূহের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করেন।
তিনি তাঁদেরকে (পূর্ববর্তীদেরকে) খণ্ডন করার লক্ষ্যে ইলমুল কালামের মধ্যে দার্শনিক বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত করেন।
আল-রাযী ও আল-আমিদী কালামশাস্ত্র ও দর্শন শাস্ত্রকে মিশ্রিত করে একটি জ্ঞানের শাখায় রূপান্তরিত করেন। আর আল-বায়দাবী এ দুটোকে অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে ফেলেন। মুতা’খিরীনগণের ইলমুল কালাম সালাফিয়্যা মযহাবের প্রসার রোধ করে দেয়।
ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্য ইবনে আল কাইয়েম আল জাওযিয়া সালাফিয়্যা মযহাবকে সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করেন- যা পরবর্তীতে দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে; পূর্ববতী সালাফীগণ আল্লাহ্তা’লার সিফাত (গুণাবলী) কিংবা মুতাশাবিহ্ (দ্ব্যর্থবোধক) নাস্ বা কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস ইত্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপৃত হন নি।
কিন্তু পরবর্তী সালাফিগণ তা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এ বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয় ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে আল কাইয়েম আল জাওযিয়ার মত পরবর্তী সালাফীদের ক্ষেত্রে।
পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সালাফীদেরকে সম্মিলিতভাবে ‘আহল্ আস সুন্নত আল খাস্সা’ বলা হয়ে থাকে।
আহলে সুন্নতের কালাম শাস্ত্রের ব্যক্তিবর্গ কিছু ’নস’কে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিন্তু সালাফীগণ তার বিরোধিতা করেন। আল্লাহ্তায়ালার চেহারা ও তাঁর আগমন মানুষের চেহারা ও আগমন হতে ভিন্ন এই কথাটি বলে সালাফীয়্যাগণ মুশাববিহা সম্প্রদায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন”। (লা-মযহাবীদের বক্তব্য শেষ হলো)
আল-আশআরী ও আল-মাতুরিদী মযহাবগুলোর গোড়াপত্তন পরবর্তীকালে হয়েছে বলাটা সঠিক নয়। এ দুইজন মহান ইমাম (আল-আশআরী ও আল-মাতুরিদী) সালাফ-এ সালেহীনগণ কর্তৃক রেওয়ায়েতকৃত ই’তিক্বাদ ও ঈমানের জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করে এবং শ্রেণীবিভক্ত করে প্রকাশ করেছিলেন, যাতে করে যুব সম্প্রদায় তা সহজে বুঝতে পারেন। ইমাম আল্ আশআরী ইমাম শাফেয়ীর শিষ্যদের শৃংখলভুক্ত ছিলেন। আর ইমাম মাতুরিদী ছিলেন হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি)-এর শিষ্যদের শৃংখলের অন্তর্ভুক্ত। আল্ আশআরী ও আল্ মাতুরিদী কখনোই তাঁদের ইমামের সার্বিক মযহাবের বাইরে যান নি। তাঁরা নতুন কোনো মযহাবের গোড়াপত্তন করেন নি। এই দুইজন এবং তাঁদের শিক্ষকগণ এবং চার মযহাবের ইমামগণ সবাই একটি সার্বিক (common) মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বিশ্বাস (আকিদা) সংক্রান্ত এই মযহাবটি আহলুস- সুন্নাতে ওয়াল জামাত নামেই সুপরিচিত। এই সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের বিশ্বাস হচ্ছে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীনগণের বিশ্বাস। ইমামুল আযম হযরত আবু হানীফা (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) কর্তৃক লিখিত ‘ফিকাহ্ আল আকবর’ পুস্তকটি আহলে সুন্নতের মযহাবটিকে সমর্থন করে।
‘সালাফিয়্যা’ শব্দটি সেই পুস্তকে কিংবা ইমাম গাযযালী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি)-এর ’ইলজামুল আওয়াম আন্ ইলমিল কালাম’ গ্রন্থটিতে অস্তিত্বহীন। ‘ফিকাহে আকবর’ গ্রন্থের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘কওলুল ফসল’ আহলে সুন্নতের মযহাবটি শিক্ষা দেয় এবং বাতিলপন্থী সম্প্রদায় ও দার্শনিকদের জবাব দেয়। ইমাম গাযযালী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) তাঁর “ইলজামুল আওয়াম” গ্রন্থে লিখেছেন, “এ বইটিতে আমি দেখাবো যে সালাফগণের মযহাবটি সত্য এবং সঠিক। আমি আরো ব্যাখ্যা করবো যে, যারা এ মযহাবটি হতে বিচ্যুত হয় তারা বিদ’আতী! সালাফগণের মযহাব হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও তাবেয়ীনগণের অনুসৃত মযহাব। এ মযহাবটির প্রয়োজনীয় নীতি হলো সাতটি।”
অতএব, পরিস্ফুট হলো যে, “ইলজাম” পুস্তকটি “সালাফগণের” মযহাবের সাতটি মূলনীতি সম্পর্কে লিখেছে। কিন্তু এগুলোকে ‘সালাফিয়্যাদের’ প্রয়োজনীয় নীতি বলাটা হলো বইটির ভাষ্যকে বিকৃত করা এবং ইমাম
গাযযালী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) -এর কুৎসা রটনা করা। আহলে সুন্নাতের অন্যান্য পুস্তকের মতই মহামূল্যবান ফিকাহ গ্রন্থ ‘দুররুল মুখতার-এর ‘সাক্ষ্য’ অধ্যায়ে ‘সালাফ’ ও ’খালাফ’ শব্দগুলোর পরে লেখা আছে: ‘সালাফ’ শব্দটি হলো সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ও তাবেয়ীনগণের নাম। তাঁদেরকে ‘সলফে সালেহীন’ হিসেবেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে। আর আহলে সুন্নতের সেই সকল উলামা যাঁরা সলফে সালেহীনের পরে এসেছেন তাঁদেরকে বলা হয় “খালাফ”।
তাবে তাবেয়ীনগণও সলফে সালেহীনের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম আল-গাযযালী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি), ইমাম আল-রাযী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) ও ইমাম আল- বায়দাবী (রহমাতুল্লাহি ‘আলাইহি) যাঁদেরকে মুফাস্সিরিনে কেরাম বা কুরআন মজীদ ব্যাখ্যাকারীগণ সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন ও ভালবাসতেন, তাঁরাও সলফে সালেহীনের মযহাবের অন্তর্গত ছিলেন।
উপরোক্ত বুযূর্গবৃন্দের সময়ে আবির্ভূত বিদআতী সম্প্রদায়গুলো ইলমুল কালামকে দর্শনের সাথে মিশ্রিত করে। বস্তুতঃ দর্শনের ওপরই তারা তাদের ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করে। “আল মিলাল ওয়ান্ নিহাল” পুস্তকটি ওই সকল গোমরাহ্ (পথভ্রষ্ট) দলগুলোর বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেছে। ওই সকল গোমরাহ্ দলের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা খণ্ডন করে আহলে সুন্নতের মযহাবটিকে সমর্থন করতে যেয়ে এই তিনজন মহান ইমাম তাদের ভ্রান্ত দর্শনের প্রতি বিস্তারিত জওয়াব দিয়েছিলেন। ওই সকল জওয়াব দেয়ার অর্থ এই নয় যে, তাঁরা আহলে সুন্নতের মযহাবের সাথে দর্শনকে মিশ্রিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে, তাঁরা কালাম শাস্ত্রকে ওরই মধ্যে সন্নিবেশিত দার্শনিক ধ্যান- ধারণা থেকে পরিশুদ্ধ করেন। আল্ বায়দাবীর তাফসীরগ্রন্থ কিংবা সেটার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যাগ্রন্থ শায়খজাদার তাফসীরের কোনোটাতেই দার্শনিক ধ্যান- ধারণা অথবা দার্শনিক পদ্ধতি নেই। এ সকল মহান ইমাম দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন বলাটা জঘন্য কুৎসা রটনা ছাড়া আর কিছু নয়। ইবনে তাইমিয়াই সর্বপ্রথমে তার “আল ওয়াসিতা” নামক পুস্তকে সুন্নী জামাতের উলামাদের প্রতি এই অপবাদটি প্রদান করে। উপরন্তু, ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্য ইবনে কাইয়েম আল্ জাওযিয়া সালাফিয়্যা মযহাবকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিল বলাটা আসলে হকপন্থী ও বাতিলপন্থীদের মতপার্থক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আরেকটি ভাওতা যোগ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দুই ব্যক্তির আগে “সালাফিয়্যা” নামের। কোনো মযহাবই ছিল না, এমন কি “সালাফিয়্যা” শব্দটিও ছিল না; তাহলে কীভাবে দাবি করা যায় যে তারা এটাকে সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিল? ওই দুই জনের আগে কেবলমাত্র একটি সঠিক মযহাব ছিল – সলফে সালেহীনের সঠিক মাযহাব, যার নাম আহল্ আস্ সুন্নত ওয়াল জামাত। ইবনে তাইমিয়াই এই সঠিক মাযহাবটিকে বিকৃত করতে চেষ্টা করেছিল এবং বহু বিদআতের আবিষ্কার করেছিল। বর্তমানকালের লা-মাযহাবী লোকদের বিকৃত ও গোমরাহ চিন্তাধারা, বক্তব্য এবং বইপত্রের উৎস হচ্ছে ইবনে তাইমিয়ার আবিষ্কৃত বিদআতসমূহ।
মুসলিমদেরকে ধোঁকা দেবার জন্যে এবং যুব সম্প্রদায়ের
আস্থা অর্জন করবার জন্যে এ সকল গোমরাহ ব্যক্তি এখন একটি অত্যন্ত ধূর্ত চাল চেলেছে।
তারা “সলফে সালেহীন” শব্দটি থেকে “সালাফিয়্যা” শব্দটি বানিয়ে নিয়েছে, যাতে করে তারা ইবনে তাইমিয়ার বিদআত ও ভ্রষ্ট ধ্যান-ধারণাকে সঠিক প্রতিপন্ন করতে পারে এবং যুব সমাজকে তাদের গোমরাহীতে টেনে নিয়ে যেতে পারে। তারা সালাফ- ই-সালেহীনদের উত্তরসূরী ইসলামী উলামাদের প্রতি বিদআত ও দর্শনের অপবাদ ছুঁড়ে দিয়েছে এবং তাঁদেরকে তাদেরই আবিষ্কৃত “সালাফিয়্যা” নামটির বিরুদ্ধাচরণ করার জন্যে দোষারোপ করেছে।
তারা ইবনে তাইমিয়াকে একজন মুজতাহিদ হিসেবে পেশ করে, যে নাকি “সালাফিয়া”কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, সালাফ-ই সালেহীনের উত্তরসূরী আহলে সুন্নতের উলামাবৃন্দই সলফে সালেহীনের মযহাব আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের এ’তেকাদ (আকিদা-বিশ্বাস) সংক্রান্ত শিক্ষাসমূহ নিষ্কলুষ রাখতে তৎপর ছিলেন এবং আজ পর্যন্ত তাঁরা যা লিখেছেন এবং লিখছেন তাতে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন এবং জানাচ্ছেন যে ইবনে তাইমিয়া, শওকানী এবং অনুরূপ ব্যক্তিবর্গই সালাফে সালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তারাই মুসলমানদেরকে ধ্বংস করছে ও জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যাঁরা “আত তাওয়াসসুলু বিন্ নবী ওয়া জাহলাতুল ওয়াহহাবীয়িন”, “উলামাউল ইসলাম ওয়াল ওয়াহহাবীঈন”, “শিফাউস সিকাম” এবং তার মুখবদ্ধ “তাতহিরুল ফুয়াদ মিন দানিসিল এ’তেকাদ” পড়েছেন, তাঁরা স্পষ্টই বুঝতে পারবেন, যে সকল লোক ‘নতুন সালাফিয়্যা’ নামক মহাভ্রান্ত বিশ্বাসসমূহ আবিষ্কার করে নিয়েছে, তারা আসলে মুসলিমদেরকে ভেতর থেকে ধ্বংস করছে।
আজকাল কিছু মুখ খুব ঘন ঘন ‘সালাফিয়্যা’ নামটি উচ্চারণ করে থাকে। অথচ প্রত্যেক মুসলমানেরই এটা ভাল করে জানা উচিৎ যে, “সালাফিয়্যা মযহাব” নামে ইসলামে কোনো কিছু নেই; বরং হাদীস শরীফে প্রশংসিত প্রথম দুই ইসলামী শতাব্দীর মুসলমান তথা সালাফ-ই-সালেহীনগণের একটি মযহাবই আছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে আগমনকারী ইসলামী উলামাকে বলা হয় “খালাফ আস সোয়াদেকীন”। এ সকল সম্মানিত জ্ঞান বিশারদদের এ’তেকাদ বা বিশ্বাসসমূহকেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের মতাদর্শ বলে। এটা হচ্ছে ঈমানের মযহাব। আসহাবে কেরাম ও তাবেয়ীনগণেরও এই একই ঈমান ছিল। তাঁদের ঈমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। বর্তমানকালে পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিমই আহলে সুন্নতের আদর্শে বিশ্বাসী।
ইসলামী দ্বিতীয় শতাব্দীর পরে বাহাত্তরটি মহাভ্রান্ত বিদআতী দলের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করে; তাদের মধ্যে কয়েকটি দলের স্থপতিরা পূর্বেই আগমন করেছিল, কিন্তু তাবেয়ীনগণের পরেই তাদের বইপত্র পকাশ পায় এবং তারা দলে দলে আবির্ভূত হয়ে আহলে সুন্নাতকে আক্রমণ করতে শুরু করে।
রাসুলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) -ই আহলে সুন্নাতের বিশ্বাসসমূহ নিয়ে এসেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামগণ ঈমান সংক্রান্ত এ সকল শিক্ষা উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন। আর তাবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীনগণ ক্রমানুসারে এগুলো তাদের থেকে গ্রহণ করে নেন।
এরপর তাঁদের উত্তরসূরীগণ এগুলো শিক্ষা করেন; ফলশ্রুতিতে এই শিক্ষাসমূহ আমাদের কাছে ‘তাওয়াতুর’ (জনশ্রুতি) ও বর্ণনার মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছে। এ শিক্ষাগুলো যুক্তি বা বিশ্লেষণ দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। মস্তিষ্ক এগুলোকে পরিবর্তিত করতে পারে না, বরং উপলব্ধি করতে সহায়তা করতে পারে। অর্থাৎ এগুলোকে বুঝতে হলে মস্তিষ্কের প্রয়োজন আছে; এগুলো যে সঠিক এবং মূল্যবান তা জানবার ও বুঝবার জন্যে মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয়। সকল হাদীসের উলামাই আহলে সুন্নতের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আমল সংক্রান্ত চারটি মযহাবের (যথা হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী) ইমামগণও এ আদর্শে বিশ্বাস করতেন। আর বিশ্বাস সংক্রান্ত আমাদের মযহাবটির দুইজন ইমাম হযরত মাতুরিদী এবং হযরত আশআরী উভয়ই এই মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উভয় ইমামই এই মযহাবটি প্রচার করেছিলেন। তাঁরা সব সময়ই গোমরাহ ব্যক্তিবর্গ এবং প্রাচীন গ্রীক দর্শনের চোরাবালিতে আটকে পড়া বস্তুবাদীদের বিরুদ্ধে এই মযহাবের পক্ষাবলম্বন করে এটাকে সমর্থন যুগিয়েছেন।
যদিও তাঁরা সমসাময়িককালের ছিলেন, তবুও তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন স্থানের অধিবাসী হওয়ার কারণে এবং তাঁদের মোকাবিলাকৃত বিরুদ্ধবাদীদের চিন্তা-চেতনা ভিন্ন হওয়ার দরুন তাঁদের জওয়াব দেবার পদ্ধতিও পৃথক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন মযহাবের অন্তর্গত ছিলেন। এই দুই জন মহান ইমামের পরবর্তীকালে আগত শত সহস্র উচ্চ শিক্ষিত উলামা ও আউলিয়া তাঁদের বইপত্র অধ্যয়ন করে সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেছেন যে, তাঁরা আহলে সুন্নতের অনুসারী ছিলেন। সুন্নী উলামাগণ ’নাস্’সমূহের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং প্রয়োজন ব্যতিরেকে সেগুলোকে তাবিল তথা ভিন্নতর ব্যাখ্যা প্রদান কিংবা পরবর্তিত করেন নি। আর তাঁরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যান- ধারণা মাফিক কোনো পরিবর্তনও করেন নি। কিন্তু যারা গোমরাহ ও লা-মযহাবী দলগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা ইসলামের দুষমন গ্রীক দার্শনিক ও ভণ্ড বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষানুযায়ী ঈমান ও এবাদতের শিক্ষাসমূহের পরিবর্তন সাধন করতে কালবিলম্ব করে নি।
আহলে সুন্নতের উলামাদের খেদমতগার ও ইসলামের ধারক বাহক উসমানীয়দের যখন পতন ঘটলো – যা সম্ভব হয়েছিল সর্বশক্তি নিয়োগকারী বৃটিশদের শয়তানী চাল ও মিশনারী এবং ম্যাসন (অন্তর্ঘাতী মুনাফিক)-দের নিরলস অপতৎপরতা দ্বারা, তখন লা-মযহাবীরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো। চালবাজী ও ঘৃণ্য পন্থায়। তারা আহলে সুন্নাহকে আক্রমণ শুরু করে দিল এবং ইসলামকে ভেতর থেকে ধ্বংস করতে লাগলো।
এটা ঘটতে থাকলো সেই সব দেশে যেখানে সুন্নী উলামাদের কোনো বাক্- স্বাধীনতা নেই (উদাহরণস্বরূপ, সউদী আরব)।
সউদী ওহাবীদের হাতে ব্যয়কৃত কোটি কোটি প্রেট্রো ডলার এ আক্রমণকে সারা বিশ্বে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে।
পাক-ভারত ও আফ্রিকী দেশগুলো হতে প্রাপ্ত খবরে বোঝা যাচ্ছে যে, ইসলমী জ্ঞানে অজ্ঞ ও খোদা ভীতিহীন কিছু লোককে তাদের দালালির জন্যে এ সকল আক্রমণকারীরা উচ্চপদ ও ভরণ-পোষণ দান করছে।
বিশেষ করে যুব সমাজকে ধোঁকা দিয়ে সুন্নী পথ হতে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্যেই তাদেরকে এ সকল ঘৃণিত সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে।
গোমরাহ ওহাবীদের দ্বারা মাদ্রাসার ছাত্রদের এবং মুসলিম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে লিখিত বইসমূহের একটিতে লেখা হয়েছে : “আমি মযহাবসমূহের একগুঁয়েমি দূর করতে এবং সবাইকে শান্তিতে নিজ নিজ মযহাবে জীবন ধারণ করতে সহায়তা করার উদ্দেশ্যেই এ পুস্তকখানি প্রণয়ন করেছি”। এ লোকটি বোঝাতে চাচ্ছে যে, মযহাবসমূহের ‘একগুঁয়েমির’ সমাধান আহলে সুন্নাতকে আক্রমণ ও সুন্নী উলামায়ে কেরামকে হেয়করণের মধ্যেই নিহিত।
সে ইসলামের বুকে ছুরিকাঘাত করছে এবং তারপরে বলছে যে, সে এটা মুসলমানদের শান্তিতে বসবাসের জন্যেই করছে!
পুস্তকটির অন্যত্র লেখা আছে, “যদি কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি তাঁর চিন্তায় সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, তবে তাঁকে দশটি পুরস্কার দেয়া হবে। যদি তিনি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে ব্যর্থ হন, তবে তিনি একটি পুরস্কার পাবেন”। এ কথা অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি – হোক সে খ্রীষ্টান কিংবা মুশরিক মূর্তি পূজারী – তার প্রতিটি চিন্তার জন্যে পুরস্কৃত হবে! দেখুন কীভাবে এ লোকটি আমাদের রাসুলুল্লাহ্ (صلى الله عليه و آله وسلم) -এর পবিত্র হাদীস শরীফকে বিকৃত করছে এবং কীভাবে সে চালবাজী করছে! হাদীস্ শরীফটি এরশাদ ফরমায়: ‘যদি কোনো মুজতাহিদ কোনো আয়াতে করীমা কিংবা হাদীস শরীফ হতে আইন-কানুন বের করতে যেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, তবে তাঁর জন্যে দশটি সওয়াব থাকবে। আর যদি তিনি তাঁর ইজতিহাদে ভুল করেন, তাহলে তাঁকে একটি সওয়াব দেয়া হবে’ (আল হাদিস)। হাদিস শরীফটি পরিস্ফুট করে এ সকল সওয়াব যে কোনো চিন্তাভাবনাকারী ব্যক্তিকে প্রদান করা হবে না, বরং ইজতেহাদের মর্যাদা লাভকারী একজন ইসলামী জ্ঞান বিশারদকেই প্রদান করা হবে; তাঁর প্রতিটি চিন্তার জন্যে এগুলো প্রদান করা হবে না, বরং ‘নস’ বা শরীয়তের দলিল হতে তাঁর আইন কানুন বের করার জন্যেই তাঁকে এগুলো দেয়া হবে। কেননা, তাঁর এ কাজটি একটি এবাদত। অন্য যে কোনো এবাদতের মতো এটাকেও সওয়াব দেয়া হবে।
সালাফ-এ-সালেহীন ও তাঁদের উত্তরসূরী মুজতাহিদ ইমামগণের যমানায়, অর্থাৎ ইসলামী চতুর্থ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত, যখনি জীবনধারা ও জীবন মান পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে কোনো নতুন বিষয়ের আবির্ভাব ঘটত, তখনি মুজতাহিদ ইমামগণ রাত দিন পরিশ্রম করে ‘আল্ আদিল্লাত আশ্ শরীয়ত’-এর চারটি উৎস হতে সেই বিষয়টি কীভাবে পালন করা হবে তার ফয়সালা বের করতেন।
আর সকল মুসলমান তাঁদের নিজ নিজ মযহাবের ইমামের প্রদত্ত সিদ্ধান্তানুযায়ী তা পালনও করতেন এবং যাঁরা পালন করতেন তাঁদেরকে দশটি কিংবা একটি সওয়াব প্রদান করা হতো!
ইসলামী চতুর্থ শতাব্দীর পর মানুষেরা ওই সকল মুজতাহিদের সিদ্ধান্তগুলোই অনুসরণ করতে থাকেন। এ দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় কোনো মুসলমানই আমল করার ব্যাপারে কোনো সমস্যায় পেরেশানগ্রস্ত হন নি।
ইত্যবসরে কোনো আলেম বা মুফতীকে এমন কি ইজতেহাদের সপ্তম সারিতে পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করা হয় নি। ফলে আমাদেরকে আজকাল এমন একজন মুসলমানের কাছ থেকে তা শিক্ষা করতে হয় যিনি চার মযহাবের কোনো একটি মযহাবের ইমামগণের বইপত্র পাঠ করতে পারেন এবং বুঝতে পারেন এবং যিনি সেগুলো অনুবাদও করতে পারেন; আমাদেরকে সেগুলো অনুযায়ী আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন ও এবাদত-বন্দেগী সম্পন্ন করতে হবে।
আল্লাহ তা’লা তাঁর কুরআনুল করীমে প্রত্যেক বস্তুর আইন- কানুন ঘোষণা করেছেন। তাঁর মহান রাসূল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেগুলোর সবই ব্যাখ্যা করেছেন। আর আহলে সুন্নাতের উলামাগণ সেগুলো সাহাবায়ে কেরামের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ সকল পুস্তক বর্তমানে সারা বিশ্বে বিরাজ করছে। কেয়ামত পর্যন্ত যে কোনো স্থানে উদ্ভূত যে কোনো বিষয়ের সাথে এ সকল পুস্তকের কোনো একটি শিক্ষার সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যাবেই। এ সম্ভাবনাটি হলো কুরআনুল করীমের একটি মু’জিযা এবং ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের একটি কারামত। কিন্তু একজন প্রকৃত সুন্নী মুসলমানের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে শেখাটা এ ক্ষেত্রে একান্ত জরুরি। যদি আপনারা একজন লা-মযহাবী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে সে আপনাদেরকে ফেকাহ গ্রন্থের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ জবাব দিয়ে গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট করবে।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি কীভাবে যুব সম্প্রদায় সে সমস্ত লা-মযহাবী মূর্খ ব্যক্তিদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে, যারা কিছু বছর আরব দেশগুলোতে অবস্থান করে আরবী শিক্ষা লাভ করে এবং সেখানে আমোদ- ফূর্তিতে সময় অতিবাহিত করার পর আহলে সুন্নতের একজন শত্রু লা-মযহাবী গোমরাহ ব্যক্তির সইকৃত সনদপত্র সংগ্রহ করে ভারত কিংবা পাকিস্তানে (বাংলাদেশেও) ফিরে যায়।
যুবকেরা তাদের নকল সনদপত্র দেখে এবং আরবী কথাবার্তা শুনে মনে করে যে সত্যি সত্যি বুঝি তারা ইসলামী উলামা! অথচ তারা ফেকাহর একটি গ্রন্থও বুঝতে সক্ষম নয়। আর তারা ফেকাহ্ গ্রন্থের শিক্ষাসমূহ সম্পর্কেও অজ্ঞ। বস্তুতঃ তারা এ সকল ধর্মীয় শিক্ষায় বিশ্বাসই করে না; বরং তারা এগুলোকে কুসংস্কার ও একগুঁয়েমি আখ্যায়িত করে থাকে।
পূর্ববর্তী যমানায় ইসলামী উলামাগণ তাঁদের প্রতি করা প্রশ্নসমূহের উত্তর ফেকাহর গ্রন্থাবলীতে খুঁজে দেখতেন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত উত্তর প্রশ্নকারীকে প্রদান করতেন।
কিন্তু লা-মযহাবী একজন ধর্মীয় ব্যক্তি ফেকাহর গ্রন্থাবলী পড়তে ও বুঝতে অক্ষম হয়ে নিজের মূর্খতা ও ত্রুটিপূর্ণ মস্তিষ্কে যা কিছু আসবে তাই প্রশ্নকারীদেরকে জবাব দিয়ে তাদেরকে গোমরাহ (পথভ্রষ্ট) ও জাহান্নামী বানাবে। এ কারণেই আমাদের রাসূলে করীম (صلى الله عليه و آله وسلم) এরশাদ করেছেন-
“(সৃষ্টিতে) খারাপের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হলো (বদকার, বদ আকিদাসম্পন্ন) আলেম। আর ভালোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো আলেমে (হক্কানী-রব্বানী, বুযুর্গানে দ্বীন)” (আল হাদীস)। হাদীসটি পরিস্ফুট করে যে, আহলে সুন্নতের বিজ্ঞ আলেমগণ হলেন সৃষ্টির সেরা; আর লা-মযহাবীরা হলো সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি।
কেননা, সুন্নী উলামাগণ মানুষদেরকে রাসুলুল্লাহ (صلى الله عليه و آله وسلم) -এর পথ অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন, ফলশ্রুতিতে জান্নাতে দাখিল হতে সহায়তা করেন। পক্ষান্তরে, লা-মযহাবীরা নিজেদের গোমরাহ ধ্যান-ধারণার দিকে মানুষদেরকে প্ররোচণা দিয়ে থাকে এবং ফলস্বরূপ তাদেরকে জাহান্নামের বাসিন্দা বানিয়ে দেয়।
জামে’ আল-আজহার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক স্নাতক ডিগ্রিধারী উস্তাদ ইবনে খলীফা আলাউয়ী তাঁর কৃত “আকিদাতুস সালাফ ওয়াল খালাফ” গ্রন্থে আল্লামা আবু জুহরা রচিত ’তারিখ আল মযাহিবিল ইসলামিয়া’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, কিছু লোক যারা হাম্বলী মযহাবের সাথে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল, তারা নিজেদেরকে সালাফ্যিয়ীন আখ্যায়িত করেছিল। আবুল ফারাজ ইবনে আল্ জাওযী এবং অন্যান্য হাম্বলী মযহাবের উলামাগণ সেই সব সালাফীকে সালাফ আস্ সালেহীনের অনুসারী নয় বরং মুজাস্সিমা সম্প্রদায়ের বিদআতী হিসেবে ঘোষণা করে তাদের ফিতনাকে দমন করেন। সপ্তম শতাব্দীতে ইবনে তাইমিয়া পুনরায় এই ফিতনা জাগ্রত করে”।
[সূত্রঃ আকিদাতুস সালাফ ১ম প্রকাশ দামেশক ১৯৭৮ ইং]।
লা-মযহাবীরা “সালাফিয়্যা” নামটি গ্রহণ করেছে এবং ইবনে তাইমিয়াকে ‘সালাফিগণের মহান ইমাম’ বলে দাবি করছে। এই শব্দটি একটি ক্ষেত্রে সত্য এ কারণে যে, তার আগে সালাফী শব্দটির অস্তিত্বই ছিল না।
ইবনে তাইমিয়ার আগে কেবলমাত্র সালাফ আস্ সালেহীনগণের অস্তিত্ব ছিল, যাঁদের মযহাব (পথ) ছিল আহল্ আস্ সুন্নাহ। ইবনে তাইমিয়ার গোমরাহ ধ্যান-ধারণাই ওহাবী, মওদূদী ও লা-মযহাবী ব্যক্তিবর্গের জন্যে উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইবনে তাইমিয়া পূর্বে হাম্বলী মযহাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছিল; অর্থাৎ সে পূর্বে সুন্নী ছিল। কিন্তু যখন সে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে সমর্থ হলো এবং ফতোয়া প্রদানের ডিগ্রী অর্জন করলো, তখনি সে অহংকারী হয়ে উঠলো এবং আহলে সুন্নতের উলামাদের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে যাহের করতে শুরু করে দিল। তার জ্ঞান বৃদ্ধিই তার গোমরাহীর সূচনা করল। অতঃপর সে আর হাম্বলী মযহাবের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কেননা, চার মযহাবের অন্তর্গত হতে হলে সুন্নী বিশ্বাস গ্রহণ করতে হবে।
আহলে সুন্নতের আকিদা-বিশ্বাসবর্জিত কোনো ব্যক্তিকে হাম্বলী মযহাবের অন্তর্ভুক্ত বলা যায় না।
[নিম্নের নোটে সমাপ্ত।]