নবী-নন্দিনী

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

নবী-নন্দিনী

সালমন সালমা

অভ্যাস, তাই রাত জাগি। বদঅভ্যাসও বলতে পারেন। পেঁচার মত জেগে থাকি। বই পড়ি, লেখালিখি করি, সিনেমা দেখি। এরপর ঘুমিয়ে গেলেও উঠে নামায পড়ি, আর না হয় একেবারে নামায পড়েই ঘুমাই। আমি দুইটা সময় ফোন রিসিভ করিনা। প্রথমতো ঘুমের সময়, দ্বিতীয় গাড়িতে থাকলে। সকাল ৮টায় ফোন বেজে উঠল। যথারীতি ফোন তুললাম না৷ কিন্তু অবাধ্য ফোন বেজেই চলল। চোখ কচলে ফোন তুলে দেখলাম শম্পার কল। রিসিভ করতেই কেটে গেল। শম্পা আমার বান্ধবী। খুব ভাল বান্ধবী। বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড় বছর৷ জামাই বাড়ি থেকে যখন কোন মেয়ে কল দেয়, তখন সেটাকে অতটা লাইটলি নেওয়া যায় না। আমিও নিলাম না। দিলাম কল।

-কিরে কেমন আছিস? কখন থেকে ফোন করছি! সালাম-কালামের বালায় নাই। সোজা কথা। তাও অনেকটা বিচলিত কণ্ঠে। চিন্তা এখন দুশ্চিন্তায় পরিণত হল। সহজ গলায় বললা, “গতকাল রাত করে ঘুমিয়েছি, তাই৷ কেন রে? এত সকাল সকাল কল দিলি, কিছু হয়েছে নাকি?” শম্পা গলা নিচু করে জবাব দিল, “বলিস নারে বোন, খুব অশান্তিতে আর ঝামেলায় আছি।”

আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম। কিছু একটা বলার আগেই শম্পা আবার কথা শুরু করল-

গতমাসের ১৩ তারিখ ছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকী৷ বছরে মাত্র একটা দিন তাও সে কিনা তারিখটা ভুলে গেল৷  আমিও আর মনে করিয়ে দেই নি৷ আফিস থেকে এসেও তার স্মরণ হল না দেখে খুব রাগ হল। অপেক্ষা করছিলাম ঘরে আসার। ঘরে আসতেই আচ্ছামত রাগ ঝেড়ে নিলাম। যদিও একটু বেশিই করে ফেলেছিলাম। তারপর দুজনেই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।  

ফোনের ওপাশে থেকে রীতিমতো হতাশ আমি। ভাবতে লাগলাম এটাও বুঝি অভিযোগ হতে পারে! থাক, এত ভেবে লাভ নেই।  জানতে চাইলাম এখন সব ঠিকঠাক আছে কিনা? 

শম্পা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কি আর ঠিকঠাক।  কোনোরকম বেঁচে আছি আরকি। রোজ কোন না কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া বেঁধেই যায়। বাঁধবে নাই বা কেন বল?  রাতুল আমার কোনো চাহিদাই পূরন করছে না৷” 

শম্পার স্বামীর নাম রাতুল। “চাহিদা পূরণ করছেনা” কথাটা শুনতেই আমি অন্যমনষ্ক হয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, বিয়ের পরপরই ওরা হানিমুনে গিয়েছিল দুবাই। সম্পূর্ণ শম্পার ইচ্ছেতে। তাই আমি হিশেব মিলিয়ে নিচ্ছিলাম যে, যেই মানুষ বউয়ের ইচ্ছা মত দুবাই নিয়ে গিয়ে হানিমুন করে আসে, সে আবার কোন চাহিদা পূরণ করেছেনা। অতি কৌতুহলী হয় শম্পাকে জিঙ্গেস করলাম, “কী এমন চাহিদা তোর, যা রাতুল ভাই পূরণ করল না? 

শম্পা বলল, “নতুন কালেকশনের কিছু শাড়ি চেয়েছি, অমনি মুখের উপর বলে দিল, সে নাকি পারবেনা। আমি কি বেশি কিছু চাই নাকি? সামান্য এই আবদারটুকুও সে রাখল না আমার। খুব আফসোস হল। বসে বসে ভাবি এটা কি সেই রাতুল যে আগে আমার সব ইচ্ছা পূরণ করত!

কথাগুলো শুনে ফোনেই বেশ বড় ঢেকুর তুললাম। ভাবতে লাগলাম, কি অদ্ভুত মেয়ে, শাড়ি নিয়ে দিল না বলেই, কত অভিযোগ দাঁড় করিয়ে দিল!  আমার জানামতে রাতুল ভাই খুব পরিশ্রমী মানুষ।  সকাল ৮টায় বের হয়, ফিরে রাত ৯টায়৷ অন্যের খবরদারিতে চাকরি করে। আফিসে নানাবিধ মানসিক চাপ। ঘরে এসেও তার এখন শান্তি হয় না। রাতুল ভাই কখনই শম্পার কোন ইচ্ছা অপূরণ রাখেনি, আজ যতসামান্য কটা শাড়ি না দেয়াতে পূর্বের সবকিছুই শম্পা কি করে ভুলে গেলো!  

এতক্ষণের সব কথা শুনে মাথা একেবারে তাওয়ার মত তেঁতে উঠেছে। একেতো সকাল সকালের স্বর্গীয় ঘুম থেকে বঞ্চিত করল, তারপর আবার শোনাচ্ছে তার যত্তসব ন্যাকামি কথা-বার্তা। তবুও বান্ধবি কষ্টে আছে ভেবে কিছুই বললাম না। খানিকটা বিরক্তিকর স্বরেই জিজ্ঞাস করলাম, “আর কি কিছু বলবি? ”

“না, থাক। তোকে ডিস্টার্ব করলাম। রাখছি।”  বলে ফোনটা কেটে দিল। শম্পা বুঝেছে যে, তার কথাগুলো আমার কোন মনে কোন দরদ জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই প্রথাটা আমাকে প্রচণ্ড রাগান্বিত করে। ডিস্টার্ব হব, এটা যখন এতই জানা ছিল তখন এই সাদসকালে কলটা দিলিই বা কেন? ধুর ছাই! আমিও ফোনটা রেখে দিলাম।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু মস্তিস্ক বন্ধ হল না। ভাবতে লাগলাম শম্পার কথা। কুরআনে পাকের  একটি আয়াত মনে পড়ল। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “তারা তোমাদের পোশাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোশাকস্বরূপ(সুরা বাকারাহ-১৮৭)।” একজন স্বামীকে যথাযথ মানসিক ভাবে সাপোর্ট দেয়া একজন স্ত্রীর কর্তব্য। রাতুল ভাই আসলে চায় কী? সারাদিন অন্যের খাটুনি খেটে এসে বাড়ি ফিরে একটি প্রশান্তির হাসি দেখতে চায়। অফিসের কষ্টের মুহূর্তগুলো শেয়ার করে কিছুটা হালকা হতে চায় হয়তো৷ যা তার সারাদিনের অমানসিক খাটনিকে মুহূর্তে দূর করে দিবে।  রাতের ঘুম ভালো করে দিবে। মন-মেজাজ ফুরফুরে করে দিবে। 

পৃথিবীর সব চাহিদা পূরণে সবাই সক্ষম হয় না৷ একজন স্ত্রীর মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ থাকতে হয়। এটাতো একটা কমনসেন্সের ব্যপার যে, যেই মানুষ গত কয়েক বছর ধরে আমার সব আবদার পূরণ করে গেল, আমাকে খুশি রাখল, আজ সামান্য কটা শাড়ীর জন্য আমি তার সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ কীভাবে করবো!  এটা মনুষ্যত্ব নয়৷  শম্পার আরো সংবেদনশীল হতে হবে। হতে হবে আরো বিনয়ী৷

আসলে নারীদের উত্তম চরিত্রের জন্য একটি আশ্রয়স্থল থাকা উচিত। যার কাছে গিয়ে একজন নারী তার চলার প্রতিটি কদম-কদমের শিক্ষা নিতে পারবে। পৃথিবীর বুকে এমন আশ্রয়স্থল কেবল একটিই পাওয়া যায়। তিনি হলেন- নন্দিনী, সুন্দরী,  স্বচ্ছ,  শুভ্রা, নির্মল, পবিত্রা এবং বিষ্ময়ী এক নারী। তিনিই হলেন- ‘সৈয়্যদা ফাতেমা বতুল বিনতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহা ওয়াসাল্লাম।’ 

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্নিত,  তিনি বলেন হুযুর (দঃ) এরশাদ করেন, 

“তোমরা চলার সময় সূর্যের আলোকে অনুসরণ করে চল, আর সূর্য অস্ত গেলে রাত্রি বেলায় চন্দ্রের আলোকে অনুসরন করে চল, আর চন্দ্র অস্ত গেলে শুকতারাকে অনুসরন করে চল। আর শুকতারা অস্ত গেলে দুই ফরক্বদ, তথা পূর্ব ও পশ্চিমের দুইটি তারাকে অনুসরণ কর।  অতঃপর, হুযুর (দঃ) বলেন, সুর্য হলাম- আমি (নবুয়তের),  আর চন্দ্র হল- হযরত আলী (বেলায়তের) আর শুকতারা হল- হযরত ফাতেমাতুয যাহরা (রাঃ) ,  আর দুই ফরক্বদ হচ্ছে ইমাম হাসান (রাঃ) ও ইমাম হোসাইন(রাঃ)।” 

হাদিসে পাকে শুকতারার অনুসরণের মর্মার্থ হল,  হযরত সাইয়্যিদা ফাতিমা(রাঃ) এর আর্দশের পথে ও মতে জীবন পরিচালিত করা৷  তিনিই অনুসরণীয় আর্দশ।  

হযরত মা ফাতেমা(রাঃ) সারা জাহানের নারীদের একমাত্র পথ-প্রদর্শক।  আর যে কেউ তাঁকে অনুসরণ করবে, সে জানতে পারবে যে, সাইয়্যিদা ফাতেমা (রাঃ) সবসময় হযরত আলী(রাঃ)-এর দুঃখ-কষ্টের ভাগী হতেন। দোষ অন্মেষণ করা থেকে বিরত থাকতেন। মনে কষ্ট পায় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতেন। হযরত আলী (রাঃ)-এর সাধ্যের বাইরে কোন কিছুই চাইতেন না। অপ্রয়োজনীয় আবদার করে হযরত আলী (রাঃ) কে কষ্ট দিতেন না। কখনোই তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ করতেন না। 

ভাবলাম কোথায় নবী-নন্দিনী, জান্নাতের সর্দারনী সাইয়্যেদা ফাতেমা বাতুল (রাঃ)-এর সুমহান চরিত্র, আর কোথায় আমাদের আজকালের লাইফস্টাইল। কোথায় তাঁর জাতে পাক থেকে আমরা ধৈর্য, শোকর এগুলোর শিক্ষা নিব। অথচ আমরা কিনা আছি, কিছু শাড়ি না পাওয়ার শোকে স্বামীর সাথে ঝগড়া করার মানসিকতায়।

কতই না পবিত্র, স্বচ্ছ তাঁর জীবন! তাঁর চরিত্রের অনুসরণ কতটাই না আলোয়-আলোকিত। অথচ আমরা, কখনো স্বাধীনতা, আবার কখনো আধুনিকতার নামে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছি গভীর আঁধারে। কাজী নজরুল ইসলাম কত সুন্দর করেই না বলেছিলেন-

সাহারার বুক এমাগো তুমি মেঘ-মায়া,

তপ্ত মরুর প্রাণে স্নেহ-তরুছায়া;

মুক্তি লভিল মাগো তব শুভ পরশে বিশ্বের যত নারী বন্দিনী।

খাতুনে জান্নাতা ফাতেমা জননী- বিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনী,

মদিনাবাসিনী পাপতাপ নাশিনী উম্মত-তারিণী আনন্দিনী।

(নজরুল রচনাবলী, দশম খণ্ড , ২২৯ পৃষ্ঠা।)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a reply

  • Default Comments (0)
  • Facebook Comments