(১) মিশকাত শরীফে ”ফাযায়েলে ওমর (রাঃ)” অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার কামরায় প্রবেশ করলেন। তখন ছিল রাত্রি এবং আকাশ ছিল তারকারাজীতে সুশোভিত। হযরত আয়েশা (রাঃ) আর্য করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ! এমন কোন ব্যক্তি আছে কি- যার ইবাদত ও নেকী তারকারাজীর সমসংখ্যক? হযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হ্যাঁ, ওমরের।
হযরত আয়েশা (রাঃ) এতে একটু মনঃক্ষুন্ন হলেন- কেননা, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পিতা হযরত আবু বকর (রাঃ) -এর নেকীর কোন উল্লেখ করেন নি। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মনোভাব টের পেয়ে বললেন- “তোমার পিতার একরাত্রের নেকী হযরত ওমরের সারা জীবনের নেকীর চেয়েও বেশি”।
উল্লেখ্য- ঐ একটি রাত্রি ছিল গারে ছাওরের প্রথম রাত্রি- যে রাত্রিতে হযরত আবু বকর (রাঃ) সাপের দংশন হজম করে নবীজিকে আরাম দিয়েছিলেন।
এখানে বুঝার বিষয় হলো- আকাশের তারকারাজীর সংখ্যা সম্পর্কে হুযুরের জ্ঞান বা ইলেমের পরিমাণ। তারকারাজী বিভিন্ন আসমানে রয়েছে। এমনসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারকা রয়েছে- যার অস্তিত্ব এখনও পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি। কিন্তু হুযুরের দৃষ্টিতে ঐসব তারকাও ছিল। মা আয়েশা (রাঃ) -এর আক্বীদা ছিল– হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর দৃষ্টি আরশ ও ফরশে বিস্তৃত। এটাই ইলমে গায়েব (আতায়ী)।
তাই কোন আশেক কবি গেয়েছেন –
سر عرش پر ھے تیری گزر
دل فرش پرھے تیری نظر
مکلوت و مللٹ میں کؤی شیخ نھیں
وہ جو تجاه پر عیان نھیری۔
অর্থ- ”আরশের উপর ভ্রমণ তোমার- দিলের ফরশে নযর তোমার,
ঊর্ধ্বজগতে নেই কিছু এমন- যা অজানা বিষয় তোমার।”
উক্ত ঘটনায় কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে-
ক) হযরত আয়েশা (রাঃ) -এর তারকা সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা বলেন নি যে, অপেক্ষা করো জিব্রাঈল আসুক- তাকে জিজ্ঞেস করে তারকার সংখ্যা বলবো। অপেক্ষা না করেই বলে দিলেন।
খ) একথাও তিনি বলেন নি যে, একটু চিন্তা করে হিসাব করে তারকার সংখ্যা তোমাকে বলে দিব – বরং সাথে সাথেই বলে দিলেন- ”আকাশের তারকার সংখ্যা যত, ওমরের নেকীর সংখ্যাও তত”। নবীজির মহাশুন্যের জ্ঞান হলো আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়েব, ইলমে লাদুমী বা ইলমে হুযুৱী।
গ) হযরত ওমর (রাঃ) এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) -এর নেকীর পরিমাণ যে নবী জানেন- সেই নবী সমস্ত উম্মতের নেক আমল সম্পর্কেও অবহিত রয়েছেন। তিনি হলেন উম্মতের সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত নবী। হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে-
انما اعمالكم تعرضون على فان رأيت فيها خيرا خمذاث الله ٔ وان رایت شرا اشتغفاز لگام –
অর্থ- “তোমাদের যাবতীয় আমল (মন্দ বা ভাল) আমার দৃষ্টিতে আনা হয়। যদি ভাল দেখি- তাহলে আল্লাহর প্রশংসা করি। আর যদি মন্দ দেখি তাহলে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি”।
(২) মিশকাত শরীফে “সদকা” বিষয়ক পরিচ্ছেদে উল্লেখ আছে- হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিবিগণ জানতে চাইলেন-
ايتنا أوّلُ لحَوقا بك يارسول اللّه অর্থ- ”হে আল্লাহর প্রিয় রাসূল! আমাদের মধ্যে সবার আগে কে আপনার সাথে মিলিত হবে”? হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথে বললেন- أطولكن يدا “তোমাদের মধ্যে যার হাত লম্বা- তিনি”।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন- আমরা হাত মেপে দেখতে পেলাম- হুযুরের দ্বিতীয় বিবি হযরত সত্তদা (রাঃ) -এর হাত বেশী লম্বা। আমাদের ধারণা তিনিই আমাদের মধ্যে প্রথম ইনতিকাল করবেন। কিন্তু আমাদের ভুল ভাঙলো তখন- যখন দেখলাম হযরত জয়নব বিনতে খোযায়মা (রাঃ) আমাদের মধ্যে প্রথমে ইনতিকাল করলেন। তখন বুঝতে পারলাম- লম্বা হাত মানে সদকা খয়রাত করা। কেননা, আমাদের মধ্যে হযরত জয়নবই বেশী দান খয়রাত করতেন।” (মিশকাত)
উক্ত হাদীসে যে কয়টি বিষয় জানা গেলো- তা হলোঃ
ক) হুযুরের বিবিগণের এই আক্বিদা ছিল যে, কে কখন মারা যাবে- তা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানেন। তা না হলে উক্ত প্রশ্ন করতেন না। এটি মৃত্যু সম্পর্কীয় ইলমে গায়েব- যা আল্লাহর পঞ্চ-এলেমের একটি।
খ) “আপনার সাথে প্রথম কে মিলিত হবেন” -এই প্রশ্নের দ্বারা বুঝা গেল ওনাদের ইনতিকাল ঈমানের উপর হবে- এই বিষয়টিও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা জানতেন বলেই ঐ রূপ উত্তর দিয়েছিলেন।
গ) ”কে কখন মারা যাবে”- তা আল্লাহর পঞ্চ-এলেমের অন্তর্ভুক্ত- যাকে ”মাফাতীহুল গায়ব” বলা হয়। এক শ্রেণীর লোক দাবী করে- এই এলম আল্লাহর জন্য খাস- অন্য কেউ মোটেই তা জানে না। তাদের এই বদ ও বাতিল আক্বীদা অত্র সহীহ হাদীস দ্বারা খণ্ডন হয়ে গেলো। কেননা, উন্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) সহ হুযুরের সমস্ত বিবিগণের আক্বীদা ছিল- আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে পঞ্চ-এলেমের অন্যতম এলেমও দান করেছেন। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সঠিক আক্বিদা।
(৩) বুখারী শরীফে ”প্রস্রাব থেকে সতর্ক থাকা” শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখ আছে- একদা নবী করিম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি স্থান অতিক্রম করছিলেন। তিনি পার্শের দুইটি কবরের প্রতি ইঙ্গিত করে এরশাদ করলেন-
هُمَا يُعدّ بان وما يُعدّ بان بكبير الخ
অর্থ- “এই কবরবাসীদ্বয়ের আযাব হচ্ছে। তাদের আযাবের কারণ এমন দুটি কাজ- যার থেকে বেঁচে থাকা তেমন কঠিন ছিলনা। তাদের একজন চৌগলিখুরী করতো, আর একজন উটের প্রস্রাব থেকে সতর্ক ছিল না”।
অতঃপর একটি তাজা খেজুরের ডাল নিয়ে দু’ভাগ করে দু’জনের কবরে গেড়ে বললেন- ”যতক্ষণ ডাল দুটি তাজা থাকবে- তাদের কবরের আযাব হালকা হবে” (বুখারী)।
এ হাদীস থেকে কয়েকটি মাসআলা জানা যায়-
ক) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর দৃষ্টিশক্তিকে মাটি আড়াল করতে পারেনা। মাটির নীচেও তিনি দেখেন। হাদীস শরীফে আছে, “আল্লাহ তায়ালা আকাশ জমীন হুযুরের দৃষ্টির সামনে উন্মুক্ত করে রেখেছেন। কিয়ামত অবধি তিনি সব কিছু এক নজরে হাতের তালুর ন্যায় দেখতে থাকবেন” (তিবরানী)।
খ) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত উম্মতের নেকী, বদী ও তার পরিমাণ সম্পর্কে অবহিত। উক্ত দুই ব্যক্তি দুনিয়াতে কি কাজ করতো- তা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন। একজন করতো চৌগলিখুৱী, দ্বিতীয়জন ছিল উটের বা নিজের প্রস্রাবের ছিটাফোটা থেকে অসতর্ক। তিনি উম্মতের যাবতীয় আমলের গায়েবী সংবাদদাতা নবী।
গ) কবর আযাব হালকা করার জন্য তাজা ডাল, তাজা ফুল, তাজা ঘাস ইত্যাদি কবরে স্থাপন করা বা লাগানো অত্র হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কারণ তাজা বস্তু আল্লাহর তাসবীহ পড়ে। এই তাসবীহের গুণে কবরবাসীর আযাব হালকা হয়।
ঘ) কবরের পার্শে কোরআন তিলাওয়াত করলেও কবরের আযাব হালকা হয় এবং মাফ হয়। ডাল আর ফুলের তাসবীহ যদি আযাব হালকা হওয়ার কারণ হয়- তাহলে মানুষের তাসবীহ যে আরো বেশী উপকারী হবে- তাতে কোন সন্দেহ নেই (ফতোয়ায়ে শামী)।
ঙ) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ায়, কবরে, হাশরে, মিজানে, পুলসিরাতে- সর্বত্র উম্মতের খবরাখবর রাখেন ও রাখবেন এবং সাহায্য করেন ও করবেন। হাশরে সর্বপ্রথম তিনিই গমন করবেন- যাতে তাঁর আগাচরে কিছু না ঘটে। তিনিই বিচার অনুষ্ঠানের প্রথম সুপারিশ করবেন। তারপর অন্যান্য নবীগণ নিজ নিজ উম্মতের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন এবং তা গৃহীত হবে। বিচার অনুষ্ঠানের সুপারিশ একমাত্র আমাদের প্রিয় নবীর জন্য খাস। এটাকে শাফাআতে কোবরা বলা হয় (হাদিকাতুন নাদিয়া)।
বিঃদ্রঃ- আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাশরে পাঁচ প্রকারের সুপারিশ করবেন- (১) বিচার অনুষ্ঠানের জন্য। (২) বিনা হিসাবে ৪৯০ কোটি লোকের জান্নাতে প্রবেশের জন্য। (৩) জান্নাতীদের পদমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। (৪) জাহান্নামের তালিকাভূক্ত কিছু মো’মেনদের নাম খারিজ করার জন্য এবং (৫) জাহান্নামে প্রবিষ্টদের বের করে আনার জন্য (হাদিকতুন-নাদিয়া, আল্লামা আবদুল গণি নাবুলুসী)।