আল্লাহ্তায়ালার দরবারে নবী করীম (ﷺ) এর দোয়া কবুল হওয়াও এক প্রকারের মোজেজা। এ প্রসঙ্গে আশশেফাতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নবী করীম (ﷺ) এর দোয়া মঙ্গলের জন্য হোক অথবা অমঙ্গলের জন্য সবই আল্লাহ্তায়ালার দরবারে গৃহীত হয়েছে। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, যা অর্থের দিক দিয়ে মুতাওয়াতিরের মর্যাদা রাখে।
হজরত হুযায়ফা (رضي الله عنه) বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) কখনও কারও জন্য দোয়া করলে সে দোয়ার প্রতিক্রিয়া তার পুত্র, নাতী ও পুতি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতো। হজরত আনাস (رضي الله عنه) এর জন্য নবী করীম (ﷺ) যে দোয়া করেছিলেন, সেই দোয়াটি সবচেয়ে বিখ্যাত। তিনি পুরো দশ বছর নবী করীম (ﷺ) এর খেদমত করেছেন। তিনি (ﷺ) তাঁর জন্য দোয়া করেছেন। ফলে জাহেরী ও বাতেনী বিভিন্ন প্রকারের নেয়ামত ও সম্মানে ধন্য হয়েছেন তিনি। তাঁকে তাঁর মাতা রসুলেপাক (ﷺ) এর খেদমতে হাজির করে নিবেদন করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনার খাদেম আমার সন্তান আনাস আপনার খেদমতে হাজির হয়েছে। দ্বীনি ব্যাপারে আম খাস সকলের জন্যই আপনি দোয়া করে থাকেন। আনাসের জন্য খাস দোয়া করবেন, যাতে সে দুনিয়াবী স্বাচ্ছন্দ্যও হাসিল করতে পারে। রসুলেপাক (ﷺ) তাঁর জন্য দোয়া করলেন। বললেন, হে আল্লাহ্! তুমি তার মাল ও আওলাদের মধ্যে বরকত প্রদান করো। আর যে সব নেয়ামত তুমি তাকে দান করেছো তারমধ্যে আরও বেশী বরকত দান করো।
হজরত ইকরামা (رضي الله عنه) বলেছেন, হজরত আনাস (رضي الله عنه) বলতেন, আল্লাহ্র কসম! আমার মাল অধিক হয়েছে। আমার আওলাদের সংখ্যা একশ’র উপরে। এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন, আমার মতো এরকম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পৃথিবীতে কেউ লাভ করতে পেরেছে কিনা জানি না। আমি স্বহস্তে আমার একশত সন্তানের লাশ কবরে শুইয়ে দিয়েছি। আর গর্ভ নষ্ট হওয়া অন্যান্য সন্তানদের তো হিসেবই নেই। এক বর্ণনায় আছে, তাঁর বাগানের খেজুর বৎসরে দুবার ফলতো। নবী করীম (ﷺ) হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (رضي الله عنه) এর জন্যও বরকতের দোয়া করেছিলেন। তিনি বলেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) দোয়া করার পর আমি যদি কোনো পাথর ওঠানোর ইচ্ছা করতাম, তখন এই বিশ্বাস করতাম যে, তার নীচে সোনা লুকিয়ে রয়েছে। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফের জন্য রিযিকের দরজা খুলে দেয়া হয়েছিলো। তিনি যখন হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় যান, তখন একেবারেই দরিদ্র ছিলেন। ধনদৌলত বলতে কিছুই ছিলো না। কিন্তু তাঁর ইনতেকালের পর দেখা গেলো, রেখে যাওয়া সম্পত্তির মধ্যে স্বর্ণের বড় বড় টুকরা রয়েছে, যা ছেনি দিয়ে কাটতে হয়েছিলো। তাঁর স্ত্রী ছিলেন চারজন। প্রত্যেকে ভাগে পেয়েছিলেন আশি হাজার স্বর্ণমুদ্রা। এক বর্ণনায় আছে, প্রত্যেকে একলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পেয়েছিলেন। অপর এক বিবরণে আছে, তাঁর তালাকপ্রাপ্তা বিবির জন্য আশি হাজারের বেশি স্বর্ণমুদ্রা দেয়া হবে বলে সাব্যস্ত হয়েছিলো। তিনি দুই হাতে দান করেছেন। এছাড়া পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দানের ব্যাপারে ওসিয়তও করে গিয়েছিলেন। তিনি দৈনিক তিরিশজন করে গোলাম আযাদ করতেন। একসময় তিনি পুরো একটা উটের কাফেলাই দান করে দিয়েছিলেন। কাফেলায় সাতশ উট ছিলো। উটগুলোতে বিভিন্ন প্রকারের মাল আসবাব ভর্তি করে দিয়ে তারপর সেগুলো দান করেছিলেন।
তাঁর এই বিরাট ধরনের দানের কারণ ছিলো এই— হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) একদিন বলেছিলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমি দেখেছি আবদুর রহমান ইবনে আউফ জান্নাতের একটি মহল খরীদ করে নিয়েছে। এই শুভ সংবাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে তিনি এতো দান করতেন।
নবী করীম (ﷺ) হজরত আমীর মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) এর জন্য দীর্ঘ রাজত্বের দোয়া করেছিলেন। তাই হয়েছিলো। সুদীর্ঘ হুকুমত পেয়েছিলেন তিনি। নবী করীম (ﷺ) তাঁকে বলেছিলেন, হে মুয়াবিয়া! তুমি যখন রাজত্ব পাবে, তখন তোমার স্বভাব ও আচরণকে নম্রতামন্ডিত করো।
হজরত মুআবিয়া (رضي الله عنه) বলেন, যেদিন রসুলেপাক (ﷺ) আমার ব্যাপারে এ মন্তব্য করেছিলেন, সেদিন থেকে আমার মনে রাজ্যশাসনের বাসনা জন্মেছিলো।
হজরত সায়াদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) এর ব্যাপারেও তিনি (ﷺ) দোয়া করেছিলেন। হকতায়ালা তা কবুলও করেছিলেন। তিনি কারও জন্য দোয়ায়ে খায়ের করলে তা কবুল হয়ে যেতো। তাঁর দোয়াকে এমন তীরের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যা কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। ইসলামের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি আল্লাহ্তায়ালার কাছে দোয়া করেছিলেন, যেনো হজরত ওমর অথবা আবু জাহেলকে ইসলামের খাদেম বানিয়ে দেওয়া হয়। আল্লাহ্তায়ালা হজরত ওমর (رضي الله عنه) কে কবুল করেছিলেন। হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) এর ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই প্রতিনিয়ত ইসলামের মহিমা ও বিজয় অর্জিত হচ্ছিলো।
এক যুদ্ধে সাহাবীগণ নবী করীম (ﷺ) এর সঙ্গে ছিলেন। পিপাসায় সকলেই কাতর হয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় হজরত ওমর (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) এর নিকট দোয়ার জন্য নিবেদন করলেন। নবী করীম (ﷺ) দোয়া করার সঙ্গে সঙ্গে বর্ষণ শুরু হলো। এসতেস্কার ক্ষেত্রে বৃষ্টি হওয়ার ঘটনা নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র জীবদ্দশায় অসংখ্য রয়েছে।
নাবেগা জাদীর জন্য নবী করীম (ﷺ) দোয়া করেছিলেন, আল্লাহ্তায়ালা যেনো তাঁর দাঁতকে নষ্ট না করেন। দেখা গেছে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হজরত নায়েগা জাদীর একটি দাঁতও নষ্ট হয়নি। অন্য এক বর্ণনায় আছে, হজরত নাবেগা জাদী দাঁতের ব্যাপারে বড়ই সৌভাগ্যবান ছিলেন। তাঁর দাঁত পড়ে গেলে সেখানে নতুন দাঁত গজিয়ে যেতো। তিনি একশ বিশ বৎসর জীবিত ছিলেন। কেউ কেউ তার চেয়ে বেশীও বলেছেন। তিনি ছিলেন আরবের প্রাচীন কবিগণের অন্যতম, যাঁরা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এই বইয়ের শেষের দিকে ‘নবীর জন্য নিবেদিত কবিগণ’ অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
নবী করীম (ﷺ) হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর জন্য দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ্! তুমি তাকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করো। আর তাফসীর করার এলেম দাও । এই দোয়ার ফলে তিনি তরজুমানুল কোরআন বা কোরআনের মুখপত্র বলে উম্মতের নিকট খ্যাত হন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের জন্য দোয়া করেছিলেন ব্যবসায়ে উন্নতি ও বরকতের জন্য। এরপর থেকে তিনি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে যা কিছুই করতেন, তাতেই লাভ হতো। হজরত মেকদাদ (رضي الله عنه) এর জন্য মালের বরকতের ব্যাপারে দোয়া করেছিলেন। তাঁর নিকট সবসময় অধিক পরিমাণে মাল থাকতো।
গুযুহ ইবনে আবী জাআদ এর জন্য দোয়া করেছিলেন। তিনি বলেন, আমি বাজারের এক গলিতে দাঁড়াতাম। আর একেকদিন চল্লিশ হাজার করে লাভ করতাম। বোখারী শরীফে আছে, গুযুহ ইবনে আবী জাআদ বলেন, আমি মাটি খরিদ করলেও লাভ হতো। তিনি আরও বলেন, একবার রসুলেপাক (ﷺ) এর উটনী পালিয়ে গিয়েছিলো, তিনি সেটিকে ডাকছিলেন। আমি নিজে যেয়ে উটনিটিকে ধরে এনেছিলাম। তখন রসুলেপাক (ﷺ) আমার জন্য দোয়া করেছিলেন।
রসুলেপাক (ﷺ) আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর মায়ের জন্য দোয়া করেছিলেন, যাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আগে তিনি রসুলেপাক (ﷺ) সম্পর্কে মন্দ কথা বলতেন। হজরত আলী (رضي الله عنه) এর জন্য দোয়া করেছিলেন, যাতে তিনি শীত ও গরমের তীব্রতা থেকে সুরক্ষিত থাকেন। তাঁর অবস্থা এমন হয়েছিলো যে, তিনি গরমের দিনে শীতের দিনের কাপড় আর শীতের দিনে গরমের দিনের কাপড় পরিধান করতে পারতেন। শীত ও গরম তাঁর ক্ষতি করতে পারতো না। হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) এর জন্য দোয়া করেছিলেন, যেনো তিনি কখনও ক্ষুধার্ত থাকেননি।
বাকী জীবনে তিনি কোনোদিন ক্ষুধার্ত থাকেননি। তুফায়েল ইবনে আমর (رضي الله عنه) তাঁর কাওমের জন্য নবী করীম (ﷺ) এর কাছে মোজেজা প্রদর্শনের নিবেদন করলেন। রসুলেপাক (ﷺ) দোয়া করলেন। বললেন, হে আল্লাহ্! তুমি তুফায়েলকে নূর দান করো। এরপর তাঁর দু’চোখের মধ্যবর্তী স্থানে নূর দেখা যেতে লাগলো। তিনি নিবেদন করলেন, আমার চিন্তা হয়, মানুষ একে না জানি শ্বেতী রোগ মনে করে। তখন নূরের স্থান পরিবর্তন করে দিয়ে তা তাঁর হাতের লাঠির মধ্যে এনে দেয়া হলো। রাতের অন্ধকারে পথ চলার সময় তাঁর লাঠি থেকে নূর বিচ্ছুরিত হতো। এ জন্য তিনি যুন্নুর নামে খ্যাত হয়েছিলেন।
একদা নবী করীম (ﷺ) মুদার গোত্রের জন্য দোয়া করেছিলেন। তারা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়েছিলো। নবী করীম (ﷺ) এর দোয়ায় দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে গেলো। পারস্যের বাদশাহ্ কেসরা যখন নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র পত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিলো, তখন তিনি দোয়া করেছিলেন, আল্লাহ্তায়ালা যেনো তার বাদশাহী ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেন। তাই হয়েছিলো। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে পারস্য রাজত্ব চিরদিনের জন্য মুছে গিয়েছিলো।
এক ব্যক্তি রসুলেপাক (ﷺ) এর নামাজে বাধা সৃষ্টি করেছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) দোয়া করলেন, আল্লাহ্তায়ালা যেনো তার পা দুটি ভেঙে দেন। তাই হয়েছিলো, সে যেস্থানে বসে ছিলো, সেখান থেকে ওঠে যেতে পারেনি।
নবী করীম (ﷺ) একদিন এক ব্যক্তিকে বাম হাতে খেতে দেখলেন। তিনি তাকে ডান হাতে খেতে বললেন। লোকটি বললো, আমি ডান হাতে খেতে পারি না। লোকটি মিথ্যে বলেছিলো। ফলে পরবর্তী জীবনে আর কোনোদিন সে ডান হাতে খাবার গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি তার ডান হাতটি ওঠানোর শক্তিও তার হতো না।
উৎবা ইবনে আবু লাহাবের ব্যাপারে বলেছিলেন, আল্লাহ্তায়ালা তাঁর সৃষ্ট কুকুরসমূহ থেকে যেনো কোনো একটি কুকুর তার জন্য নিয়োজিত করেন। তাকে বাঘে ছিঁড়ে ফেড়ে খেয়েছিলো।
কুরাইশ গোত্রের যে সকল হতভাগ্য নামাজ আদায়ের সময় রসুলেপাক (ﷺ) এর গর্দান মোবারকে উটের ভূঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিলো, রসুলেপাক (ﷺ) তাদের ব্যাপারে বদদোয়া করেছিলেন। ফলে বদর যুদ্ধের দিন তারা সকলেই লাঞ্ছনার মৃত্যুবরণ করেছিলো। হাকাম ইবনুল আস নামক এক পাপিষ্ঠ অহংকার, দম্ভ আর ঘৃণা প্রকাশার্থে তার চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলো। নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র চেহারা সে দেখতে চায়নি। নবী করীম (ﷺ) বলেছিলেন, এমনই যেনো হয়। হয়েছিলোও তাই। তার নিকৃষ্ট চোখ সে আর কোনোদিন খুলতে পারেনি।
মাহকাম ইবনে জুহামা নামক জনৈক হতভাগার ব্যাপারে তিনি বদদোয়া করেছিলেন, মাটি যেনো তাকে কবুল না করে। মৃত্যুর পর তাকে কবরে নামানো হলে কবর তাকে গ্রহণ করলো না। উপরে বের করে দিলো। কয়েকবার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কবরের ভিতর লাশ রাখা গেলো না। পরিশেষে তার লাশটি দুটি গর্তের মধ্যবর্তী স্থানে রেখে তার চারদিকে প্রাচীর বানিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু সেখান থেকেও তার লাশ বেরিয়ে এলো।
নাফরমান বারা ইবনে আমের নামক জনৈক পাদ্রীর ব্যাপারে বদদোয়া করেছিলেন, যেনো সে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়ে নিঃসঙ্গ মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যু সেভাবেই হয়েছিলো। আশশেফা কিতাবের লেখক কাযী আয়ায (رحمة الله) বলেন, এ জাতীয় ঘটনার বর্ণনা এতো অধিক যা শুমার করা সম্ভব নয়।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]