দুনিয়া ও আখিরাতের মেলবন্ধন

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইসলাম ঈমানদারদের দুনিয়াকে সুন্দর করার এবং আখিরাতকেও সজ্জিত করার উপায় শিক্ষা দিয়েছে।

#পরকালের_সহায়ক_পার্থিব_বস্তু_অমঙ্গলজনক_নয়ঃ 

ইমাম গাজ্জালী রহঃ লিখেন, ভোগ্যবস্তু দুই ভাগে বিভক্ত।

১. যে সকল বস্তু দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত এবং মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসও হয়ে যায়, কিন্তু পরকালের কাজ- ইলম ও আমলের সহায়তা করে এবং মুসলমানের বংশ বৃদ্ধি করে, এগুলি মন্দ নয়; যেমন বিবাহ, পানাহার – পরিচ্ছদ ও বাসস্থান। এই সকল বস্তু পরিমাণগত ও পরকালের আবশ্যক অনুযায়ী ব্যবহার করলে খারাপ নয়। প্রশান্ত মনে ইবাদতে লিপ্ত থাকার উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি এই সকল বস্তু আবশ্যক পরিমাণে লাভ করে পরিতুষ্ট থাকে, সে দুনিয়াদার নয়।

২. পার্থিব বস্তুর মধ্যে যেগুলির উদ্দেশ্য পরকাল নয় বরং যা ইবাদতের প্রতি উদাসীনতা, অহংকার ও দুনিয়ার আসক্তি বৃদ্ধি করে এবং পরকালের প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মাইয়া দেয় তা-ই ঘৃণ্য ও মন্দ। এইজন্যই রসূলে ﷺ বলেনঃ দুনিয়া ও তার মাঝের সকলকিছুই অভিশপ্ত (যা আল্লাহ’র স্মরণ ভুলিয়ে দেয়), কিন্তু আল্লাহ্ তাআ’লার যিকির (স্মরণ) ও তার সাথে সংগতিপূর্ণ অন্যান্য আমল, আলিম ও ইলম অন্বেষণকারী এর ব্যতিক্রম। ইলম ও মুনাজাতের আনন্দ এবং আল্লাহ’র যিকিরের প্রতি আসক্তি, সংসারের সকল ভোগ্য বস্তু অপেক্ষা মিষ্টতম। এগুলি দুনিয়াতে থাকলেও দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত নহে। এজন্য দুনিয়ার সকল ভোগ্যবস্তুই মন্দ নয়। এমনকি যে সকল ভোগ্যবস্তু ধ্বংস হয়ে যায়, স্থায়ী থাকে না, তাদের সবই মন্দ নয়।

[ইমাম গাজ্জালী রহঃ কিমিয়ায়ে সাআদাত

(সৌভাগ্যের পরশমণি), ১ম খন্ড, ৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]

#উপার্জন_ও_ব্যবসাঃ দুনিয়া পরকালের পথে একটি পান্থশালা। জীবন-ধারণের জন্য মানুষের পানাহার আবশ্যক এবং উপার্জন ব্যতীত পানাহারের সামগ্রী পাওয়া সম্ভব নয়৷ সুতরাং উপার্জনের নিয়মাবলী জেনে নেয়া আবশ্যক; কারণ দুনিয়া অর্জনে যে ব্যক্তি দেহ-মন সম্পূর্ণরূপে লিপ্ত রাখে সে নিতান্ত হতভাগা। যে ব্যক্তি আল্লাহ’র উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করতঃ সর্বদা কেবল পরকালের পাথেয় সংগ্রহে নিজেকে মশগুল করে রাখেন, তিনি অতি সৌভাগ্যবান। কিন্তু মধ্যপন্থা এই যে, মানুষ পার্থিব সম্পদও উপার্জন করবে এবং তার সঙ্গে পরকালের সম্বল সংগ্রহেও লিপ্ত থাকবে। কিন্তু পরকালের সম্বল সংগ্রহ-ই হবে মুখ্য উদ্দেশ্য এবং একমাত্র পরকালের সম্বল নিরুদ্বেগে সংগ্রহের সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যেই পার্থিব সম্পদ উপার্জন করবে।

একদা রসূলুল্লাহ ﷺ উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক বলিষ্ঠ যুবক অতি প্রত্যুষে অপর পাশ দিয়ে এক দোকানে গেল। সাহাবাগণ বললেন: আফসোস, এই ব্যক্তি যদি আল্লাহ’র পথে (লিপ্ত হওয়ার জন্য) এত প্রত্যুষে উঠত! রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এমন বলিও না। কারণ এই ব্যক্তি যদি নিজকে বা নিজের মাতাপিতা অথবা নিজের স্ত্রী-পুত্রকে পরমুখাপেক্ষী না করার উদ্দেশ্যে গমন করে থাকে তা হলেও সে আল্লাহ’র পথে আছে। আর বাহাদুরী, অহংকার এবং অতিরিক্ত ধনার্জনের উদ্দেশ্যে গমন করে থাকলে সে শয়তানের পথে আছে।

রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ যে ব্যক্তি নিজেকে পরমুখাপেক্ষী না করার উদ্দেশ্যে কিংবা স্বীয় প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি মঙ্গল সাধনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে হালাল উপার্জন করে, কিয়ামত দিবসে তার মুখমণ্ডল পূর্ণিমার চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় হবে।

[ইমাম গাজ্জালী রহঃ, কিমিয়ায়ে সাআদাত (সৌভাগ্যের পরশমণি), ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯ ইফাঃ]

#দুনিয়ার_ছলনার_একটা_দৃষ্টান্তঃ দুনিয়াদার লোক দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হয়ে আখিরাতের কথা ভুলিয়া যায়। এদেরকে একদল নৌকারোহী যাত্রীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যাত্রাপথে নৌকা কোন দ্বীপে গিয়ে পৌঁছল। আরোহীগণ মল-মূত্র পরিত্যাগ ও হস্তপদ ধৌত করার জন্য নৌকা হতে অবতরণ করল। নৌকার মাঝি ঘোষণা করে দিলঃ কেউই অধিক বিলম্ব করতে পারবে না, মল-মূত্র পরিত্যাগপূর্বক পাকসাফ হওয়া ব্যতীত অন্য কোন কাজে লিপ্ত হতে পারবে না। কারণ, নৌকা শীঘ্র ছেড়ে যাবে। কিন্তু যাত্রীরা দ্বীপে গিয়েই বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। যারা অতি বুদ্ধিমান, তারা তাড়াতাড়ি মল-মূত্র পরিত্যাগ করে পাকসাফ হয়ে নৌকায় ফিরে আসল। তখন নৌকা খালি থাকায় তারা নিজেদের পছন্দমত স্থান বেছে নিল। অপর একদল যাত্রী দ্বীপের বিস্ময়কর বস্তুসমূহ দেখার জন্য রয়ে গেল। তারা তথায় মনোরম পুষ্প, সুগায়ক পক্ষী, কারুকার্য খচিত প্রস্তর ও নানাবিধ রঙ-বেরঙের দ্রব্যাদি দেখতে লাগল। তারা প্রত্যাগমন করে স্থান না পেয়ে সঙ্কীর্ণ ও অন্ধকারময় স্থানে বসে কষ্ট ভোগ করতে লাগল। অন্য একদল দ্বীপের বিস্ময়কর বস্তুসমূহ দেখেই ক্ষান্ত হল না, দ্বীপ হতে ভাল ভাল পাথরসমূহ বেছে নিয়ে আসল। কিন্তু নৌকায় এগুলি রাখবার স্থান পেল না। নিতান্ত সঙ্কীর্ণ স্থানে উপবেশনপূর্বক পাথরগুলি নিজেদের স্কন্ধের উপর রাখল। দুই দিন পর ঐ বিচিত্র বর্ণের প্রস্তরসমূহের রং পরিবর্তিত হয়ে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল এবং তা হতে দুর্গন্ধ বের হতে লাগল৷ এখন এই কদাকার দুর্গন্ধময় প্রস্তরগুলি ফেলে দেওয়ার স্থানও পাওয়া গেল না। তাই এই দলটি নিতান্ত লজ্জিত হল এবং প্রস্তরের বোঝা নিজেদের স্কন্ধে রেখে অপরিসীম যাতনা ভোগ করতে লাগল। সর্বশেষ দলটি দ্বীপের বিচিত্র দৃশ্যাবলী দর্শনে এত বিমুগ্ধ হইয়া পড়ল যে, তা দেখতেই থাকল৷ এদিকে নৌকা চলে আসল, তারা দূরে পড়ে রইল যে, তা দেখতেই থাকল। মাঝির নিষেধ না মেনে ঐ দ্বীপে রয়ে গেল। তাদের কেউ কেউ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা পড়ল; আবার কতগুলিকে হিংস্রজস্তু হত্যা করল। প্রথম দলের বুদ্ধিমান লোকদেরকে পরহেযগার মুসলমানের সাথে তুলনা করা যায়। আর সর্বশেষ যে দলটি ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও হিংস্রজন্তুর হস্তে প্রাণ হারাল তারা কাফিরদের তুল্য। তারা নিজেকে এবং আল্লাহ্ ও আখিরাতকে ভুলে গিয়া সম্পূর্ণরূপে দুনিয়ার মোহে লিপ্ত ছিল। তাদের সম্বন্ধেই আল্লাহ্ বলেন, “তারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের জীবন অপেক্ষা অধিক ভালবেসেছে।” মধ্যবর্তী দুই দল গুনাহ্গার মু’মিনের তুল্য। তারা আসল ঈমান রক্ষা করেছে বটে, কিন্তু দুনিয়া হতে হাত সঙ্কুচিত করে নাই। একদল দীনতার সহিত ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করেছে। অপর দল ভ্রমণের তৃপ্তি ভোগের সঙ্গে সঙ্গে কতগুলি প্রস্তরখণ্ড সংগ্রহ করিয়া নিজ নিজ স্কন্ধে স্থাপন করে দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে।

#দুনিয়াতে_চিরস্থায়ী_মঙ্গলের_উপাদানঃ দুনিয়ার অনিষ্টকারিতা যা বর্ণিত হল তাতে ভাবিও না যে, দুনিয়াতে যা কিছু আছে সবই মন্দ। বরং দুনিয়াতে এমন অনেক বস্তু আছে যাহা দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, ইলম ও আমল দুনিয়াতে থাকিলেও দুনিয়ার অন্তর্গত নয়। কেননা এ দুইটি মানুষের সাথে পরকালে যাবে। ইলম তো প্রকাশ্য তা সঠিকভাবে মানুষের সাথে থাকবে এবং আমল সঠিকভাবে না থাকিলেও তার প্রভাব থাকিবে। সৎ আমলের প্রভাব দুই প্রকার। একটি আত্মার পবিত্রতা ও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। এটা পাপ পরিত্যাগের ফলস্বরূপ অর্জিত হয়ে থাকে ৷ অপরটি আল্লাহ’র যিকিরের মহব্বত। এটা সর্বদা ইবাদতে লিপ্ত থাকার ফলে অর্জিত হয় (দুনিয়াবী কাজসমূহ উত্তম নিয়তের কারণেও কিন্তু ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়)। এইগুলি চিরস্থায়ী মঙ্গলজনক কার্যরূপে পরিগণিত। এই সম্বন্ধে আল্লাহ্ বলেনঃ “আর চিরস্থায়ী মঙ্গলজনক কর্মসমূহ তোমার প্রভুর নিকট অতি উত্তম।”

#মানুষের_পার্থিব_আবশ্যকতা_ও_সংসারের_ছলনায়_মানুষের_ভ্রমঃ আল্লাহ’র পরিচয় লাভ ও তাঁর মুহাব্বত হল আত্মার আহার্য। আল্লাহ ব্যতীত অন্য জিনিসের মুহাব্বতে ডুবে থাকা আত্মার ধ্বংসের কারণ। আত্মার জন্যই শরীরের রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন; কেননা শরীর বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং আত্মা চিরস্থায়ী থাকবে।

আত্মার জন্যই যে শরীর আবশ্যক, এটা বুঝার জন্য একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হচ্ছে- কা’বা শরীফে যাবার পথে হাজ্বীর জন্য যেমন উটের আবশ্যক, আত্মার গন্তব্য পথে শরীরও তেমন আবশ্যক। হাজ্বীর জন্য উটের আবশ্যক, উটের জন্য হাজ্বী নয়। কা’বা শরীফে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত উটের আবশ্যক এবং সেই পর্যন্ত খাবার দিয়ে উটকে প্রতিপালন করাও হাজ্বীর কর্তব্য। কিন্তু উটের পরিচর্যা আবশ্যক পরিমাণ হওয়া উচিত। পথচলায় ক্ষান্ত দিয়ে হাজ্বী সাহেব যদি উটের আহার যোগাইতে ও সাজসজ্জা করতে দিবারাত্র মশগুল থাকে, সে কাফেলার পিছনে পড়ে বিনাশ হবে। তেমনিভাবে মানুষ দিবারাত্র শরীরের পরিচর্যা করলে অর্থাৎ আহার সংগ্রহ, বাসস্থান নির্মাণ প্রভৃতি কার্যে ব্যাপৃত থাকলে স্বীয় সৌভাগ্য লাভে বঞ্চিত থাকবে।

মানুষ একথা বুঝে না যে, সংসারের অসংখ্য ব্যবসার মূল হল একমাত্র আহার, পরিচ্ছদ এবং বাসস্থান। এই তিন পদার্থ লাভের জন্যই দুনিয়ার সকল ব্যবসা। আবার এই ত্রিবিধ পদার্থ শরীর রক্ষার জন্য। শরীর (প্রয়োজন) আত্মার বাহনের জন্য এবং আত্মা কেবল আল্লাহ’র জন্য। কিন্তু মানুষ নিজেকে ও আল্লাহ’কে ভুলে গেছে। সে এমন হজ্জযাত্রীর ন্যায় যে নিজের উদ্দেশ্যে, কা’বা শরীফের কথা ও যাত্রার বিষয় ভুলে গিয়ে বাহন উটের পরিচর্যায় তার সমস্ত সময় অপচয় করে। দুনিয়াতে মানুষের দুই প্রকার বস্তুর আবশ্যক।

১. আত্মাকে ধ্বংসের কারণসমূহ হতে রক্ষা করা এবং আত্মার আহার্য সংগ্রহ করা, ২. শরীরকে ধ্বংসকারী কারণসমূহ হতে রক্ষা করা এবং শরীরের খাদ্য সংগ্রহ করা।

[ইমাম গাজ্জালী রহঃ, কিমিয়ায়ে সাআদাত (সৌভাগ্যের পরশমণি), ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৭-৯৩ ইফাঃ]

প্রিয়তম রসূল ﷺ বলেনঃ যাকে চারটি নি‘আমত দান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দান করা হয়েছে-

১. কৃতজ্ঞ বা শুকরগুজার অন্তর,

২. জিকির-আযকারে রত জিহ্বা,

৩. বিপদাপদে ধৈর্যশীল দেহ,

৪. নিজের (ইজ্জত-আব্রু) ও স্বামীর ধন-সম্পদে আমানতদারিতায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ স্ত্রী। [মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৭৩]

رَبَّنَآ اٰتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّار

“হে আমাদের প্রতিপালক! এ দুনিয়াতেও আমাদের কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদের রক্ষা করুন।” [সূরা বাকারাহ ২/২০১]

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment