দুনিয়ার হাকীকত

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

“ছেরাজুছ্-ছালেকীন” – আব্দুল খালেক এম এ

দুনিয়ার হাকীকতঃ

  মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহতায়ালার রেজা বা সন্তুষ্টিলাভ এবং ইহা এবাদত ও নেক আমল ব্যতীত হইতে পারে না। মোটামুটিভাবে দেখা যায় যে, দুনিয়া, মানুষ, শয়তান ও নফ্‌ছ আল্লাহ প্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধক। দুনিয়ার হাকীকত কি তাহা ভালরূপে বুঝিয়া লওয়া দরকার। আল্লাহতায়ালা বলিয়াছেন: সাধারণতঃ লোকের অনুরাগ খাহেশের বস্তুগুলির প্রতি হইয়া থাকে, যথা: স্ত্রীলোকগণ, সন্তানাদি, স্বর্ণ-রৌপ্যের ধনভান্ডার, চিহ্নিত ঘোড়া, গবাদি পশুরাজি ও শস্যাদি এইগুলি সাংসারিক জীবনের ব্যবহারের বস্তু এবং সুফল পরিণাম কেবলমাত্র আল্লাহরই নিকট আছে। আপনি (হজরত) লোকদিগকে বলুন: আমি কি তোমাদিগকে এমন বস্তুর সংবাদ দিব যাহা তদপেক্ষা বহুগুণে শ্রেষ্ঠ? (তবে শুন) যাহারা আল্লাহকে ভয় করে, তাহাদের জন্য তাহাদের পরওয়ারদেগারের নিকট এমন বাগানসমূহ রহিয়াছে যাহাদের নিম্নদেশে নহর সমূহ প্রবাহিত হইতেছে তথায় তাহারা চিরকাল অবস্থান করিবে এবং পাক পবিত্র বিবিগণের সঙ্গে বাস করিবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করিবে।

  ‍উল্লিখিত বস্তুগুলির সুখভোগই যদি কেবলমাত্র জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যে হয় তবে নিশ্চয়ই উহা মন্দ, আর যদি এইগুলিকে দ্বীন বা আল্লাহর রেজামন্দি হাছেল করার উদ্দেশ্যে ভোগ বা ব্যবহার করা হয় তখন উহা এবাদতে গণ্য হইবে। হজরত ফরমাইয়াছেন: নেককার ব্যক্তির জন্য মাল কি উত্তম বস্তু! যদি স্ত্রী-পুত্রাদি, টাকা-কড়ি, জীব-জানোয়ার, ফসলাদি প্রভৃতির ভালবাসা ও লোভ লালসা আল্লাহ হইতে গাফেল করিয়া দেয় অথবা আল্লাহ প্রাপ্তির পথে বাধা জন্মায় তবে উহা দুনিয়ার মধ্যে গণ্য হইবে এবং উহার পরিণাম অতি মন্দ হইবে। দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র, এই দুনিয়াতে নেক আমলের বীজ বপন করিলে পরকালে উহার ফলভোগ করিবে। দুনিয়ার সব দিকটা মন্দ নয়। যদি তুমি আল্লাহর আদেশ মতে দুনিয়ার বস্তুগুলিকে ব্যবহার কর, তবে তুমি অসংখ্য নেয়ামত ও অনন্ত সুখের অধিকারী হইবে। আর যদি দুনিয়ার ভোগবিলাসই তোমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তবে তোমার দুঃখ ও অশান্তির অবধি থাকিবে না।

  হাদীছঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর রেজামন্দি লাভের আশায় দুনিয়াকে অসুন্তষ্ট করে, আল্লাহ দুনিয়াকে তাহার গোলাম করিয়া দেন। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার সন্তুষ্টি লাভের আশায় আল্লাহতায়ালাকে নারাজ করে, আল্লাহতায়ালা দুনিয়াকে বলেন তুমি তাহাকে খুব কষ্ট দাও। ইহাতে স্পষ্টই বুঝা গেল যে, আল্লাহতায়ালাকে নারাজ করিয়া দুনিয়ার সুখ ও ভোগ বিলাসে মত্ত হইয়া পড়িলে আখেরাতে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হইতে হইবে। দুনিয়ার হালাল বস্তুগুলিকে হাতিয়ার স্বরূপ ব্যবহার করিয়া জীবন সংগ্রামে অগ্রসর হইলে আখেরাতে আল্লাহর বহু নেয়ামতের অধিকারী হইতে পারা যায় এবং সর্বোত্তম নেয়ামত আল্লাহর রেজা হাছেল হইয়া থাকে।

  কি ভাবে দুনিয়ার  লোভ-লালসাকে পরিত্যাগ করিতে হয় তাহা বুঝা একটিু কঠিন ব্যাপার। আল্লাহতায়ালা বলেন: “দুনিয়ার জীবন একটি ছলনার বস্তু ব্যতীত আর কিছুই নহে।” দুনিয়ার জাহেরী চাকচিক্য ও মধুরতা উহার প্রকৃত স্বরূপকে গোপন করিয়া রাখে। যদি তুমি উহার জাহেরী রূপলাবণ্যে বিদ্ধুগ্ধ হইয়া পড় তবে তোমার মত নাদান আর কেহ নাই, কারণ তাহা হইলে আখেরাতে তোমার দুঃখ কষ্টের কোন সীমা থাকিবে না।

  দুনিয়ার লোভ-লালসা, বাসনা ও লিপ্সা দুইটি কারণে পরিত্যাগ করা দরকার। প্রথম কারণ এই যে, এবাদত ভিন্ন ইন্‌ছানের গতি নাই আর দুনিয়ার লোভ পরিত্যাগ করিতে না পারিলে খালেছ এবাদত হইতে পারে না। মাওলানা রুমী ফরমাইয়াছেন: যদি তুমি আল্লাহ প্রাপ্তি ও দুনিয়া প্রাপ্তি উভয়ের আশা মনে মনে পোষণ কর তবে প্রকৃত প্রস্তাব উহা কাল্পনিক, অসম্ভব ও পাগলামী ব্যতীত আর কিছুই নহে। হজরত আবু দারদা (রাঃ) বলেনঃ আমি এবাদত এবং (দুনিয়ার উদ্দেশ্যে) তেজারত করিতে চাহিলাম কিন্তু আমি উহাতে অপারগ হইলাম, কাজে কাজেই আমি তেজারত পরিত্যাগ করিয়া এবাদতে মশগুল হইয়া পড়িলাম। হজরত ওমর (রাঃ) ফরমাইয়াছেন: যদি দুনিয়া ও আখেরাত একত্রিত হইতে পারিত তবে যে শক্তি আল্লাহতায়ালা আমাকে দান করিয়াছেন উহার বলে আমার নিকট উহা সংগৃহীত হইত। দ্বিতীয় কারণ এই যে, দুনিয়ার লোভ পরিত্যাগ করিলে নেক আমলের ছওয়াব অধিক মিলিবে। হজরত ফরমাইয়াছেন: সংসার ত্যাগী আলেমের দুই রাকাত নামাজ সমস্ত সংসারী আবেদগণের কেয়ামত পর্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিয়া এবাদত করা অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অধিকতর ভাল। যাঁহারা সংসারে থাকিয়া তাঁহাদের দিল দুনিয়ার লোভ ও বাসনা হইতে মুক্ত করিতে পারিয়াছেন, তাঁহারাই আল্লাহর অলী। হজরত ইবনে ওমর রাসুলুল্লাহ্‌কে জিজ্ঞাসা করিলেন: যাহাদের আমল ভাল তাহারা কে? তিনি বলিলেন: যাহাদের আকল ভাল, যাহারা হারাম হইতে অধিকতর পরহেজ করে এবং আল্লাহর কাজে ত্বরা করে।

  এস্থলে বুঝা দরকার যে, কোন্‌ কোন্‌ উপায়ে দুনিয়ার লোভ বা খায়েশ পরিত্যাগ করা যাইতে পারে। দুনিয়ার লোভ পরিত্যাগ করাকে জোহ্‌দ বলে। জোহ্‌দ দুই প্রকার। এক প্রকার যাহা ইনছানের ক্ষমতার অধীনে। আর এক প্রকার যাহা তাহার ক্ষমতার অধীনে নয়। প্রথমটি তিন প্রকারেঃ এক প্রকার এই যে, যে সকল বস্তু তাহার নাই উহার লোভ পরিত্যাগ করা। দ্বিতীয় প্রকার এই যে, যাহা তাহার নিকট মৌজুদ আছে তাহার লোভ পরিত্যাগ করা। তৃতীয় প্রকার এই যে, দুনিয়ার লোভ দিল হইতে বাহির করিয়া দেওয়া। দ্বিতয়িটি এই যে, দুনিয়ার লোভ ও বাসনা যেন দিলের ধারেও আসিতে না পারে। এই শেষোক্ত জোহ্‌দ অতি কঠিন আল্লাহতায়ালার সাহায্য ব্যতীত ইহা লাভ করা যায় না। কিন্তু যাহারা প্রথমোক্ত তিনটি জোহ্‌দ আমল করে তাহারাই শেষোক্ত জোহ্‌দ পালন করিতে আল্লাহতায়ালার সাহায্য প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেনঃ “আখেরাতের ঘর আমি ঐ লোকগণকে দান করিব যাহারা জমীনে উচ্চ হইবার ও ফাছাদ সৃষ্টি করিবার ইচ্ছা করে না এবং যাহারা আল্লাহকে ভয় করে তাহাদের পরিণামই উত্তম হইবে”।

  দুনিয়ার খায়েশ ত্যাগ করিবার কায়দা এই যে, উহার দুঃখরাশি ও দোষাবলী স্মরণ করিতে থাকিবে। একজন বুজুর্গ বলিয়াছেনঃ দুনিয়া আমি এই জন্য ত্যাগ করিলাম যে, উহার লাভ অল্প ও কষ্ট বেশি এবং উহা শীঘ্রই হাতছাড়া হইয়া যাইবে। বুদ্ধিমান লোক উহার অপকারিতা বুঝিতে পারিয়া উহাকে ত্যাগ করে আর নাদান লোক উহার জাহেরী চাকচিক্যের মোহে পড়িয়া তাহার ধোকায় পড়ে। জোহ্‌দ হালাল ও হারাম উভয়ের মধ্যেই হইয়া থাকে। কতক হালাল বস্তুর লোভ ত্যাগ করা মোস্তাহাব। হারাম বস্তুর লোভ বর্জন করা ফরজ। তবে এস্থলে প্রশ্ন হইতে পারে যে, দুনিয়ার অল্প বিস্তর কিছু গ্রহণ না করিলে কেমন করিয়া চলা যায়? উহার উত্তর এই যে আবশ্যকীয় হালাল রুজী তলব করা ফরজ। জোহ্‌দ অর্থে কেবলমাত্র জরূরাতের অতিরিক্ত বস্তুর লোভ বর্জনকে বুঝিতে হইবে। দুনিয়ার এতটুকু হইলেই যথেষ্ট যদ্বারা এবাদত করা চলে। আল্লাহতায়ালা বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে তাহার বিপদ হইতে উদ্ধার হইবার পথ আল্লাহতায়ালা বাহির করিয়া দেন এবং তাহাকে এমন স্থান হইতে রেজেক যোগাইয়া দেন যে, সে ব্যক্তি উহা কখনও চিন্তাও করে নাই।

  মোট কথা এই যে, দুনিয়াকে আখেরাতের উদ্দেশ্যে তলব করিতে হইবে। দুনিয়ার ওছিলায় আখেরাতের সম্বল সংগ্রহ করিতে হইবে। এবাদতের জন্য দুনিয়ার সাহায্য গ্রহণ করিবে। বুজুর্গানে দ্বীনের জীবনী আলোচনা করিলে দেখা যায় যে, তাঁহারা বিবাহ করিতেন, পানাহারে তৃপ্তিলাভ করিতেন এবং লোকের সঙ্গে মেলামেশা করিতেন কিন্তু দুনিয়ার ভোগ বিলাস তাঁহাদের আদৌ উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের প্রাণের রাসুল (সাঃ) ও ছাহাবাগণ (রাঃ) সকলেই ঐ বিষয়গুলিতে আপাততঃ মশগুল ছিলেন বটে, তাঁদের দিল ঐসব এলাকা হইতে বহুদূরে অবস্থান করিত। মাওলানা রুমী বলিয়াছেন: নৌকার ভিতরে পানি প্রবেশ করিলে নৌকা ডুবিয়া যায়, কিন্তু নৌকার নীচে পানি থাকিলে নৌকা চলাচলের সাহায্য করে। অনুরূপভাবে দুনিয়ার মহব্বত ক্বাল্‌বের মধ্যে প্রবেশ করিলে হালাক হইয়া যাইবে, আর তাহা ক্বাল্‌বের বাহিরে থাকিলে তোমার জীবন যাত্রা সহজ হইবে।

   নিম্নে দুনিয়া সম্বন্ধে কতিপয় হাদীছের মর্ম দেওয়া গেল:

  হাদীছঃ দুইটি নেয়ামত আছে, যাহাতে অধিকাংশ লোক প্রতারিত হইয়া থাকে – স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা।

  হাদীছঃ ঈমানদারের জন্য দুনিয়া কয়েদখানা, আর কাফেরদের জন্য বেহেশ্‌ত।

  হাদীছঃ সত্য সত্যই কোনও ঈমানদারের নেকীকে আল্লাহ নষ্ট করেন না। উহার ওজরত (ছওয়াব) আল্লাহ দুনিয়াতে দান করেন এবং উহার জ্বেজা (ছওয়াব) আখেরাতেও দান করিবেন। কিন্তু কাফের যে সকল নেক কাজ পূণ্যের আশায় করিয়া থাকে, উহার বদলা (প্রতিদান) আল্লাহতায়ালা তাহাকে দুনিয়াতেই ভোগ করাইয়া থাকেন। অনন্তর যে ব্যক্তি যখন আলমে আখেরাতে যাইবে তাহার ছওয়াব দেওয়ার জন্য আর কোন নেকীই বাকী থাকিবে না।

  হাদীছঃ দোজখ শাহওয়াত বা বদখাহেশ দ্বারা এবং বেহেশ্‌ত পরিশ্রম ও দুঃখরাশি দ্বারা আবৃত।

  হাদীছঃ একদা হজরত কোন একটি মৃত কানকাটা বকরীর বাচ্চার নিকট গমন করিয়া বলিলেনঃ “তোমাদের মধ্যে কি কেহ উহাকে এক দেরেম মূল্যে লইতে পছন্দ কর”? তাহারা বলিলেন: কখনও আমরা উহা পছন্দ করি না, কেননা উহা কোন বস্তুই নয়। হযরত ফরমাইলেন: আল্লাহর কছম, নিশ্চয়ই দুনিয়া এর চেয়েও জঘন্য (ঘৃণিত)।

  হাদীছঃ হযরত বলিয়াছেন: আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যকে ভয় করি না, বরং আমার ভয় হয় যে, পাছে তোমাদের পূর্বপুরুষগণের ন্যায় তোমাদেরও ধন-দৌলত বাড়িয়া পড়ে এবং তাহাদের ন্যায় তোমরাও তৎপ্রতি অনুরাগী হইয়া পড় এবং অবশেষে উহা তোমাদিগকে এমনভাবে ধ্বংস করিয়া ফেলে, যেরূপ তাহাদের বিনাশসাধন করিয়াছিল।

  হাদীছঃ মানুষ বলে আমার মাল, আমার মাল। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনটি বস্তু তাহার মাল: যাহা সে ভক্ষণ করিল, যাহা সে পরিধান করিয়া পুরাতন করিল এবং যাহা দান করিয়া পরকালের জন্য সম্বল সংগ্রহ করিল। এতদ্ব্যতীত সব কিছুই তাহা হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে এবং সে অপরের জন্য ছাড়িয়া যাইবে।

  হাদীছঃ তিনটি বস্তু মৃত ব্যক্তির সঙ্গে গমন করে, তন্মধ্যে দুইটি ফিরিয়া চলিয়া আসে, আর একটি তাহার সঙ্গে থাকিয়া যায় – তাহার আওলাদ, তাহার মাল ও তাহার আমল তাহার সঙ্গে সঙ্গে গমন করে কিন্তু তাহার আওলাদ ও মাল ফিরিয়া আসে এবং শুধু তাহার আমল সঙ্গে থাকে।

  হাদীসঃ আল্লাহতায়ালা বলেন: “হে আদম সন্তান! তুমি আমার এবাদতের জন্য অবসর গ্রহণ কর। আমি তোমার দিলকে গণী(আজাদ) করিয়া দিব এবং তোমার অভাব মোচন করিয়া দিব। আর যদি তাহা না কর, তবে তোমার হাত নানাবিধ কাজে জড়িত করিয়া দিব এবং তোমার অভাব কখনও মোচান করিব না”।

  হাদীছঃ যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসিল, সে ব্যক্তি তাহার আখেরাতের ক্ষতি করিল। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে ভালবাসিল সে দুনিয়ার ক্ষতি করিল। অতএব স্থায়ী বস্তুকে অস্থায়ী বস্তুর পরিবর্তে গ্রহণ কর।

  হাদীছের ভাবার্থঃ একদা হজরত বেড়াইতে বাহির হইলে এক খানা ঘরের উঁচু চূড়া দেখিতে পান। তিনি জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন যে উহা জনৈক আনছারের বাড়ী। তৎপর ঐ বাড়ীর মালিক তথায় আসিয়া হযরতকে সালাম করিলে তাঁহার দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইলেন। তিনি তাহা বারবার করিতে লাগিলেন। তিনি হজরতের চোহারা মুবারকে রাগ ও বিরক্তির ভাব বুঝিতে পারিয়া আছহাবগণের নিকট উহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন ও বলিতে লাগিলেন, “কছম আল্লাহর, আমি নিশ্চয়ই হজরতকে অসন্তুষ্ট করিয়াছি।” ছাহাবাগণ বলিলেন: ‘হযরত তোমার ঘরের উঁচু চূড়া দর্শন করিয়াছেন’ তিনি তৎক্ষনাৎ বাড়ী ফিরিয়া আসিলেন এবং ঘরের উঁচু চূড়াকে ধ্বংস করিয়া ভূমিস্মাৎ করিয়া দিলেন। তারপর হজরত বেড়াইতে বাহির হইলে উক্ত চূড়াকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখিয়া বলিলেন: ঐ কোব্বা কি হইল? ছাহাবাগণ বলিলেন: বাড়ীর মালিক হুজুরের অসন্তুষ্টির কারণ জিজ্ঞাসা করায় আমরা তাহাকে উহার সংবাদ দিয়াছিলাম। তখন হজরত ফরমাইলেন: কেবলমাত্র ঐ ঘরবাড়ী যাহা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যাহা না হইলে চলে না, তাহা ছাড়া অন্যান্য ঘরবাড়ী মালিকের জন্য আজাবের কারণ।

  হাদীছঃ দীনার ও দেরেমের গোলাম লানতের পাত্র।

  হাদীছঃ এক ব্যক্তি হজরতের নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন: হুজুর। আমাকে এমন একটি কাজ শিখাইয়া দিন যাহা আমল করিলে আল্লাহ আমাকে ভালবাসিবেন এবং লোকজনও আমাকে ভালবাসিবে। হজরত বলিলেন: দুনিয়ার খাহেশ পরিত্যাগ কর, তবে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসিবেন এবং যাহা মানুষের নিকট আছে, তাহার লোভ বর্জন কর, তবে লোকজন তোমাকে ভালবাসিবে।

  হাদীছঃ হজরত ইবনে মাছউদ (রাঃ) বলিয়াছেন যে, হজরত নবী করিম (সাঃ) খেজুর পাতার চাটাইর উপর শুইয়াছিলেন, তৎপর বিছানা হইতে গাত্রোত্থান করিলে দেখা গেল যে, তাঁহার শরীরে উহার দাগ বসিয়া গিয়াছে। তাহা দেখিয়া হযরত ইবনে মাছউদ (রাঃ) বলিলেন: ইয়া রাসুলাল্লাহ্‌ (সাঃ)! যদি আপনি আমাকে আদেশ করিতেন তবে আমি উত্তম কাপড় ও নরম বিছানা বিছাইয়া দিতাম। হযরত ফরমাইলেন: দুনিয়ার প্রতি আমার ভালবাসা নাই এবং দুনিয়ারও আমার প্রতি ভালবাসা নাই। আমার সহিত দুনিয়ার তুলনা এই যে, যেমন কোন আরোহী (ছওয়ার) গাছের ছায়াতলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিল এবং পরক্ষণেই উহা ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

  হাদীছঃ আমার পরওয়ারদেগার আমার জন্য মক্কাশরীফের প্রস্তরময় স্থানকে স্বর্ণে পরিণত করিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন, তাহাতে আমি বলিলাম, না’। হে আমার পরওয়ারদেগার! বরং আমি পছন্দ করি যে, আমি  একদিন পানাহারে তৃপ্তিলাভ করিব, আর একদিন ক্ষুধার্ত থাকিব। যেদিন আমি ক্ষুধার্থ থাকিব, তোমার নিকট কান্নাকাটি করিব ও তোমার জিকির করিব, আর যেদিন পানাহারে তৃপ্তিলাভ করিব, সেদিন তোমার হামদ বা প্রশংসা করিব ও শোকর করিব।

  হাদীছঃ যে ব্যক্তির নিকট প্রাতঃকালে তাহার নিজের নিরাপত্তা, তাহার শরীরের স্বাস্থ্য ও একদিনের খোরাক (জীবিকা) মৌজুদ থাকে, তাহার নিকট সমস্ত দুনিয়াই মৌজুদ রহিল।

  হাদীছঃ কোন লোক পেট অপেক্ষা অধিকতর মন্দ আর কোনও পাত্র পরিপূর্ণ করে নাই। আদম সন্তানের জন্য কতক লোকমা খাদ্যই যথেষ্ট, যদ্বারা পৃষ্ঠদেশ সোজা থাকে (অর্থাৎ সাংসারিক কাজকর্ম ও এবাদত চলিতে পারে, এই পরিমাণ খাদ্য হইলেই যথেষ্ট) আর অগ্যতা যদি বেশি খাইতে হয়, তবে তাহার পক্ষে উচিত যে, এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের দ্বারা, এক তৃতীয়াংশ পানির দ্বারা পরিপূর্ণ করে, আর এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস গ্রহণের জন্য খালি রাখ।

  হাদীছঃ কেয়ামতের দিন আদম সন্তানকে যতক্ষণ পাঁচটি বিষয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা না করা হইবে ততক্ষণ তাহাদের পদদ্বয় নাড়িবার অনুমতি পাইবে না – কিভাবে তাহারা জীবন অতিবাহিত করিয়াছে, যৌবনকাল কিভাবে তাহারা কাটাইয়াছে, মাল কোথা হইতে উপার্জন করিয়াছে এবং কিসে ব্যয় করিয়াছে এবং যে জ্ঞান লাভ করিয়াছিল উহার আমল কি পরিমাণে করিয়াছে।

  হাদীছঃ যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি বিরাগ বা অভক্তির ভাব পোষণ করে, তাহার দিলের মধ্যে আল্লাহ হেকমত (জ্ঞান) উৎপন্ন করেন, হেকমতের কথাবার্তা তাহার মুখে জারি করিয়া দেন, দুনিয়ার দোষরাশি এবং উহার রোগ ও ঔষধ দেখাইয়া দেন এবং তাহাকে দুনিয়া হইতে বাহির করিয়া নিরাপদে বেহেশ্‌তে পৌছাইয়া দেন।

  হাদীছঃ হযরত আবু দারদা (রাঃ) – এর মাতা হজরত আবু দারদা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করিলেন: তুমি কেন অপর লোকের ন্যায় দুনিয়ার তলব কর না? তিনি বলিলেন: আমি হজরতকে বলিতে শুনিয়াছি: সত্য সত্যই তোমাদের সম্মুখে কঠিন ঘাঁটি সমূহ (মৌত, কবর, হাশর ইত্যাদি) রহিয়াছে। যাহাদের বোঝা ভারি  হইবে তাহারা ঐগুলি অতিক্রম করিতে পারিবে না। অতএব আমি পছন্দ করি যে, ঐ ঘাঁটি সমূহের জন্য আমার বোঝা পাতলা করিয়া রাখি।

  হাদীছের ভাবার্থঃ আদম সন্তান কেয়ামতে নিরীহ বকরীর বাচ্চার ন্যায় আল্লাহর নিকট আসিয়া দাঁড়াইবে। তখন আল্লাহতায়ালা তাহাকে বলিবেন: আমি তোমাকে (হায়াত, স্বাস্থ্য, সুখ- সম্পদ ইত্যাদি) দিয়াছিলাম এবং আমি তোমাকে (কিতাব, রাসুল প্রভৃতি)  নেয়ামত প্রদান করিয়াছিলাম (অর্থাৎ বহু প্রকার জাহেরী বাতেনী নেয়ামত আমি তোমাকে দান করিয়াছিলাম) তুমি তাহার কিরূপ ব্যবহার করিয়াছ? সে ব্যক্তি বলিবে: হে পরওয়ারদেগার! আমি মাল জমা করিয়াছি এবং উহাকে বাড়াইয়াছি, অতঃপর উহার অধিকাংশকে ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি। আবার তুমি আমাকে দুনিয়াতে ফেরত পাঠাও তোমার নিকট অবশিষ্ট মালগুলি লইয়া আসিব। তখন আল্লাহ বলিবেন: আমাকে ঐ মাল দেখাও যাহা তুমি আগে আখেরাতের জন্য পাঠাইয়াছ। সে ব্যক্তি বলিবে: হে পরওয়ারদেগার। আমি উহাকে জমা করিয়াছি এবং উহাকে বাড়াইয়াছি। অতঃপর উহার অধিকাংশকে ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি। আবার তুমি আমাকে দুনিয়াতে ফেরত পাঠাও, তোমার নিকট অবশিষ্ট মালগুলি লইয়া আসিব। তৎপর প্রকাশ হইয়া পড়িবে যে, সে ব্যক্তি কোন নেকীই (সৎকার্যই) আখেরাতের জন্য করে নাই। অতঃপর তাহাকে দোজখে নিক্ষেপ করিবার জন্য আদেশ করিবেন। হজরত ফরমাইয়াছেন: মাল জমা করিতে এবং (দুনিয়ার) ব্যবসায়ী হইতে আল্লাহ আমার নিকট অহী পাঠান নাই, বরং আমাকে অহী পাঠাইয়াছেন – তোমার পরওয়ারদেগারের তারীফের সহিত তছবীহ পড় এবং ছেজ্‌দাকারীগণের অন্তর্ভুক্ত হও এবং যতক্ষণ মৌত উপস্থিত না হয় ততক্ষণ তোমার পরওয়ারদেগারের এবাদত কর।

 হাদীছঃ পরকালে যাহার ঘরবাড়ী নাই দুনিয়াই তাহার ঘর-বাড়ী, পরকালে যাহার কোন মালামাল নাই দুনিয়াই তাহার মাল, যাহার কোন আকল নাই সে দুনিয়ার জন্য সংগ্রহ করে।

  হাদীছঃ সূর্য উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার দুই পার্শ্বে দুইজন ফেরেশ্‌তা দাঁড়াইয়া ঘোষণা করিতে থাকে: যাহা জ্বিন ও ইন্‌ছান ছাড়া সকলেই শুনিতে পায় – হে লোকগণ! আল্লাহর নিকট অল্প বিস্তর নেকী লইয়া উপস্থিত হও, উহা প্রচুর ধন-সম্পদ, কেননা যাহা মানুষকে আল্লাহ হইতে দূরে রাখে তদপেক্ষা অল্প নেকী অধিকতর ভাল।

  হাদীছঃ শরাব সকল পাপের মূল। মেয়েলোক শয়তানের রশি এবং দুনিয়ার মহব্বত সকলের দোষের মূল।

  হাদীছঃ যখন মানুষ মরিয়া যায় তখন ফেরেশ্‌তাগণ বলে – “ এই ব্যক্তি কি কি আমল আখেরাতের জন্য পাঠাইয়াছে, আর আদম সন্তান বলে – এই” ব্যক্তি কি কি বস্তু ছাড়িয়া গিয়াছে।”

  হযরত আলী (রাঃ) ফরমাইয়াছেনঃ দুনিয়া পিঠ দেখাইয়া প্রস্থান করে আর আখেরাত সম্মুখ দেখাইয়া অগ্রসর হয়। দুনিয়া এবং আখেরাত উভয়েরই সন্তান সন্তুতি আছে। অতএব তোমরা আখেরাতের সন্তান হও এবং দুনিয়ার সন্তান হইও না। কেননা আজ তোমার কাজের সময়, হিসাব নিকাশের সময় নয় এবং কেয়ামতে তোমার হিসাব নিকাশের সময়, কাজের সময় নয়।

  হাদীছঃ যখন কোন লোককে দুনিয়ার প্রতি বিরাগ বা উদাসীন দেখ এবং সে কম কথা বলে, তাহার নিকটবর্তী হও, কারণ এই প্রকার লোক তোমাকে জ্ঞান দিতে পারিবে।

  হাদীছঃ এক ব্যক্তি হজরতের নিকট আসিয়া আরজ করিলেন: আমাকে সংক্ষেপে কিছু উপদেশ দান করুন। হযরত বলিলেন: তুমি যখন নামাজ পড় তখন বিদায় গ্রহনকারী লোকের মত নামাজ পড়, আর এমন কথা মুখে আনিও না যাহার জন্য পরে মাফ চাহিতে হয়।

  হাদীছঃ যখন তুমি কোন লোককে দেখ সে আল্লাহর নাফরমানী করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাহাকে দুনিয়ার ধনদৌলত বাড়াইয়া দিতেছেন, তখন জানিয়া রাখ যে আল্লাহ তাহাকে ভালেবাসেন না। উহা এছ্‌তেদ্‌রাজ (ভেল্কী) হইতেছে। অতঃপর তিনি কোরআন শরীফের এক আয়াত পাঠ করিলেন: “যখন তাহাদিগকে যে সকল উপদেশ দেওয়া হইয়াছিল তাহা ভুলিয়া গেল, তখন আমি (আল্লাহ্‌) তাহাদের উপর সর্বপ্রকার নেয়াতের দ্বারসমূহ খুলিয়া দিলাম। তখন তাহারা প্রদত্ত নেয়ামতগুলি পাইয়া সন্তুষ্ট হইয়া পড়িল, তখন আমি হঠাৎ তাহাদিগকে ধরিলাম (আজাব নাজেল করিলাম) এবং তাহারা নিরাশ হইয়া পড়িল”।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment