আমরা দেখি কি দিয়ে? আলো দিয়ে। আলো যত উজ্জ্বল, দেখব তত বেশী। সবচে উজ্জ্বল কি? উত্তর, সূর্য। দুপুরের সূর্য। কিন্তু আমরা সূর্যকেই দেখতে পাই না। চোখে সয় না। মাধ্যম লাগে, চশমা লাগে। আজব না!
আজ এমনি সূর্যের কথা লিখব। একের পর এক। যাঁকে বুঝতে-দেখতেও মাধ্যম লাগে। এ মাধ্যমের নাম, বিবেক। যিনি সূর্যের মত প্রকাশিত। অবুও অদেখা। অযোগ্যতা আমাদের। তাঁকে পেয়েও পাই নি।
১৪ জুন ১৮৫৬। ২৮ অক্টোবর ১৯২১। ৬৫ বছর ৪ মাস, ১৫ দিন। ২৩,৮৭৭ : তেইশ হাজার আটশত সাতাত্তুর দিন।
গ্রন্থ সংখ্যা পনেরো শতাধিক। হিসেবের সুবিধায় ধরলাম দেড় হাজার। এবার ‘দিন’ এবং ‘বই-সংখ্যা’ ভাগ করি।
২৩,৮৭৭ ÷ ১,৫০০ = ১৫.৯১৮ (প্রায় ষোল দিন)।
থামুন। একটু ভুল হচ্ছে। আট বছরে তাঁর প্রথম বই। অতএব, আগের সাত বছর বাদ, ৬৫-৭। ফলাফল, ৫৭ বছর ৪ মাস ১৫ দিন । ২০,৮০৫ : বিশ হাজার আটশ পাঁচ দিন। লিপ ইয়ার ধরি নি। এবার ভাগ করি।
২০,৮০৫÷১,৫০০ = ১৩.৮৭ ( প্রায় চোদ্দ দিন) মানে চোদ্দ দিনে একটি বই লেখা হয়েছে।
আচ্ছা, দেড় হাজার বইয়ে মোট পাতা কত? তবে একদিনে কত পাতা লিখেছেন? ঘন্টায় কত? খোদার কসম জানি না। কল্পনাতেও আসে না।
ছোটতে রচনা পড়েছি। গরুর রচনা। ‘কাউ ইজ আ ডোমেস্টিক এনিমেল’। আধ মাস যুঝেছি। মুখস্থ হয় নি। আর আধ মাসে একটা বই লেখা! মাসে দুইটা। থুক্কু! আটাশ দিনে।
সে বই কি রকম? না, ‘আম পাতা জোড়া জোড়া’ বই না। মহাকাশে কোটি নক্ষত্র। লক্ষ গ্রহ-উপগ্রহ। সব ছুটছে। প্রভাব রাখছে পৃথিবীতে। এইসব ছোটাছুটির হিসেব রাখে জ্যোতির্বিজ্ঞান। তিনি সেই আলোকবর্ষের হিসেব লিখেছেন।
সমাজবিজ্ঞান। আগে মানবিক বিভাগে ছিল। ক’বছর আগেই আলাদা হল। নতুন ফ্যাকাল্টি খুলল। অথচ তিনি শত বছর আগেই সমাজ বিজ্ঞানের ওপর লিখেছেন। জ্ঞানের স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গণিতে দশের ওপর পাই নি। ম্যাট্রিকের টেস্টেও। একুব-বেকুবের সূত্র আজও বুঝি না। তিনি গণিতের সব শাখায় লিখেছেন। এমনকি প্রাইম নাম্বার নিয়েও। গণিত বিভাগের প্রধানও তাঁর থেকে সমাধান নিত।
আমি যাযাবর। জেলায়-থানায় ঘুরি। কত গাছ যে দেখি। প্রায় কিছুই চিনি না। বোটানির ছাত্রদের জিজ্ঞেস করি। তারাও জানে ন। অথচ তিনি গাছ-গাছরার ওপর বিশাল গ্রন্থ লিখে বসে আছেন। শত বছর আগেই। গাছ থেকে ওষুধ হয়। একে ভেষজবিদ্যা বলে। তিনি ভেষজবিদ্যাও লিখেছেন। ‘হামদার্দ-বিশ্ববিদ্যালয়’ তাঁর লেখার ওপর গবেষণা করেছে। স্বীকার করেছে তাঁর পাণ্ডিত্য।
ভাষা বড় অদ্ভুত। প্রতি তিন মাইলে ভাষা পালটায়। ‘খাইছো’ হয় ‘খাইছুন’। একে বলে ধ্বনিতত্ব। তিনি এর ওপরেও লিখেছেন। তাঁর প্রথম বই আরবী ব্যাকরণে ওপর।
আমি কবিতা লিখি। কবিতার আইন আছে। অনুপ্রাস, অন্তমিল, স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত – আরো মেলা কিছু। অত জানি না, মানিও না। অত মানলে কবিতা লেখাই অসম্ভব। আমার অযোগ্যতা। আর তিনি এসব আইনের মাস্টার ছিলনে। এবং স্রষ্টাও ছিলনে। এ আইনকে বলে বালাগাত, অলংকরণশাস্ত্র।
সব কিছু ছাপিয়ে ছিল তাঁর ফতওয়া। আমাদের সমাজে ‘ফতওয়া’ শব্দটা ব্যাকডেটেড। খ্যাত-খ্যাত শুনায়। যদিও বিষয়টা বিপরীত। আম্মা বলেন, ‘ভাল্লুকের হাতে কোদাল’। ভাল্লুকের হাত ছোট। কোদাল না ধরতে পারে। না কোপাতে পারে। হাস্যকর অবস্থা। ঠিক তেমনি মূর্খ কওমী সম্প্রদায় ফতওয়াকে বাজারে শব্দ বানিয়েছে।
ফতওয়া মানে আইন। মুফতি সাহেব ফতওয়া দেন। মুফতি মানে আইন নির্ধারক। আইন প্রণেতা না। এবার ভাবুন তো, সুপ্রিমকোর্টের জজ সাহেবের মর্যাদা। যেকোনো জজের মর্যাদা। তারা কি আমজনতা? আমাদের মত? আফসোসের বিষয়, ভাল্লুকের মতই এদেশে চামড়া-চান্দা তুলে খাওয়ারা বিষাক্ত ছত্রাকের মত মুফতি আর ফতওয়ার জন্ম দিচ্ছে।
তাঁর লিখা ফতওয়া গ্রন্থ ‘ফওয়ায়ে রেজভিয়া’। মোট তিরিশ খণ্ড। প্রতি খণ্ড গড়ে ৭০০ পাতা। মোট একুশ হাজার পাতা। বিয়াল্লিশ হাজার পৃষ্ঠা। মানবজীবনের সব আছে এতে।
তাঁর ফতওয়া ছিল যুগান্তকারী। জেনে অবাক হবেন, আপনার মানিব্যাগে যে টাকার নোট, সেটা তাঁর বদৌলতেই পেয়েছেন। তাঁর বদৌলতেই এখনো ৯৯.৯০% মুসলিম উদার, মানবিক।
আল্লাহ বলেন : হে মানব জাতী, তোমরা বড়ই তাড়াহুড়ো। আমাদের ধৈর্য কম। তাই লেখা বাড়াচ্ছি না। আজকের সমাপীকা টানছি।
তিনি দুই ঘন্টা ঘুমাতেন। বাইশ ঘন্টা কাজ করতেন। বেশি সময় লেখালেখি। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? তাঁরও সংসার ছিল। আয়-রোজগার ছিল। এত লিখতেন কিভাবে? মাসে দুইটা বই। যার জন্য আলাদা ছাপাখানাই দেয়া হয়েছিল।
তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করা হল : আ’লা হযরত! এত কিভাবে লিখেন? তিনি হাসলেন। স্নিগ্ধ তাবাসসুম। বললেন, কলম দিয়ে লেখা হয়। তাই বলে কলম কি লিখতে পারে? না, যিনি কলম ধরেন তিনি লেখেন। জেনে রাখো, আমি আহমাদ রেযা একটি কলম মাত্র। আর আমাকে ধরে যিনি লিখছেন, তিনি বাগদাদ ওয়ালা। তিনি আমার গাউসে পাক!