পিএইচডি তো বুঝি। ধরুন প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শেষ। মাস্টার্স বা স্নাতক করলেন। কিন্তু আরো জানতে চান। কিন্তু কি পড়বেন? এখানেই পিএইচডি। জ্ঞান-পিপাসা মেটানোর সন্ধান।
মাস্টার্স অবধি আপনি একাডেমি মুখি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাই পড়াবে পড়তে হবে। আপনি বাধ্য। কিন্তু পিএইচডিতে আপনি স্বাধীন। একটি বিষয় পছন্দ করবেন। যা আপনার সাধ্যের মধ্যে। সাধ্য বলতে ক্ষমতা বুঝিয়েছি। দর্শনের কেউ নিশ্চই রসায়নে পারদর্শী নয়।
যা-হোক, সে বিষয়ে গবেষণা করবেন। নতুন কিছু আবিষ্কার করবেন। অভিসন্দর্ভ তৈরী করবেন। এই গবেষণায় আপনাকে একজন গাইড করবে। নির্দেশনা দিবে। যিনি আপনার সিনিয়র। আপনার থেকে ভালো বুঝেন। তাঁর নির্দেশনা ছাড়া চলা দুষ্কর। এরপর আপনার গবেষণা নিয়ে বোর্ড বসবে। তারা সিদ্ধান্ত নিবেন। আপনার কাজ সঠিক কিনা। সঠিক হলে আপনি ডক্টোর। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী।
মূল কথায় আসি। প্রায়ই একটা কথা শুনি। ইসলাম ইজ দা ফুললি কোড অভ লাইফ। ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনবিধান। এখন প্রশ্ন জীবন মানে কি? কখনো ভেবেছেন? বিশাল ফিলোসোফিলাক প্রশ্ন। আমার কাছে, জীবন মানে বিকাশ। বীজ অঙ্কুরিত না হলে কখনোই গাছ হবে না। গাছ না হলে ফুল-ফল-ছায়া আসবে না। এটাই বিকাশ।
একই ভাবে, মানুষ নিজেকে বিকশিত না করলে, সে পঁচনশীল বস্তু ছাড়া কিছুই না। বীজ যেমন পঁচে যায়। কেউ খোঁজও রাখে না।
এখন মানুষের বিকাশ কেমন? মানুষ জন্মায়। সমাজ তাঁকে শিক্ষিত করে। নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবতা ইত্যাদি যোগান দেয়। চারা গাছে যেমন সার-পানি দেয়া হয়। এসব গুণ না থাকলে মানুষ শুধু পশু। পশু এবং মানুষ উভয়ে দেহধারী। উভয়ে পঁচনশীল।
সমাজের নৈতিকতা, মানবতা, মূল্যবোধ আসে কোত্থেকে? ধর্মদর্শন থেকে। মুসলিম সমাজে ইসলাম থেকে। ইসলাম সমাজকে স্কুল বানায়। স্কুলের আইন আছে। আইনের বাহিরে যাওয়া নিষিদ্ধ। ঠিক আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত। এই আইনই হচ্ছে শরিয়া, শরিয়ত। শরিয়ত জীবনের সকল জায়গায় মানুষকে মানুষ হতে নার্সিং করে।
এখন প্রশ্ন, জীবন কয়টা? খাওয়া-ঘুমা-বেঁচে থাকাই কি জীবন? হালাল-হারামের পার্থক্যই কি জীবন? না, জীবন দুটো। ইহকাল এবং পরকাল। ইহকালের জীবনে তো শরীয়ত গাইড করে। কিন্তু পরকালে!
এ পরকাল বা অপার্থিব জীবনের জন্যই মারেফত। শরিয়ত আমাদের মানুষ বানায়। মাস্টার্স পাস করায়। আর পিএইচডি বা জ্ঞানের উন্মুখ রাজ্যে যাওয়ার দরজাই মারেফত।
মাস্টার্সের আগে স্বাধীনতা নেই। কারণ আপনি শিখছেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আপনার তখনো হয় নি। সিদ্ধান্তের ক্ষমতা এলেই স্বাধীন। কারণ শিশুর হাতে আগুন দিলে সে নিজেই পুড়বে। আর স্বাধীনতা তখনি আসে, মানুষ যখন স্রষ্টার সান্নিধ্য পায়। সীমাবদ্ধ সৃষ্টি থেকে অসীম স্রষ্টার স্বাদ পাওয়া। যা মানুষ সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য।
পিএইচডি করতে গাইড লাগে। মারেফাতে চলতেও গাইড লাগে। এই গাইড হচ্ছেন, মুর্শিদ বা পীর। অবশ্য পিএইচডি বিভিন্ন বিষয়ে হয়। মারেফাতের বিষয় একটি। স্রষ্টাকে পাওয়া। তাহলে মারেফাতে কি গবেষণা করা হয়? মারেফাতে গবেষণা করা হয় পথ, পন্থা, উপায়। কারণ একেক জনের জন্য পথ ভিন্ন। অসীম স্রষ্টা একেক ভাবে ধরা দেয় একেক জনের কাছে।
বলা হয়, সমস্ত মানুষ যত নি:স্বাস নিয়েছে, নিচ্ছে, নিবে – ঠিক তত সংখ্যক পথ আছে স্রষ্টাকে পাওয়ার।
মোটকথা, শরিয়ত মানুষকে পশু থেকে মুমিন বানায়। স্কুল যেমন মূর্খকে শিক্ষিত করে। আর মারেফাত মানুষকে জ্ঞান বা লক্ষ্যের চূড়ান্তে নিয়ে যায়।
ভার্সিটিতে ফ্যাকাল্টি থাকে। এক ফ্যাকাল্টিতে বহু বিষয়। বহু বিষয়ে অসংখ্য পিএইচডি। তেমনি মারেফাতেও ফ্যাকাল্টি বা অনুষদ থাকে। একে বলা হয় তরিকা (Sufi Order)। একটি তরিকায় ভর্তি হন। বায়াত গ্রহন করুন। একটি বিষয় নিন। গবেষণা করুন। নিজেকে জানুন। নিজের পথ চিনুন। স্রষ্টাকে চিনবেন। আপনার গবেষণা সঠিক হলে ডিগ্রি পাবেন। মারেফতে এ ডিগ্রির নাম খেলাফত।
এবার মূলেরও মূল কথা। একটি খেলাফত যথেষ্ট সত্যায়নের জন্য। কেউ যে স্রষ্টার সান্নিধ্য পেয়েছেন এটা তারই প্রমাণ। কিন্তু কেউ যদি একে একে তেরটা বা তারো বেশি খেলাফত পায়, তবে? তাহলে বুঝতে হবে স্রষ্টাকে সে ১৩ বার পেয়েছেন। তেরটা পিএইচডির মত। ভার্সিটির পিএইচডি না। অসীম স্রষ্টাকে পাওয়ার পিএইচডি।
ইমাম আ’লা হযরত একে একে ১৩ টি তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত। তরিকাগুলো হচ্ছে :
1) কাদেরিয়া বারাকাতিয়া জাদীদাহ
2) কাদেরিয়া আবাইয়াহ কাদীমাহ
3) কাদেরিয়া আহদাইয়াহ
4) কাদেরিয়া রাজ্জাকিয়াহ
5) কাদেরিয়া মুনাওয়ারিয়াহ
6) চিশতিয়া নিযামিয়াহ
7) চিশতিয়া সাবরিয়াহ
8) নকশাবন্দি উলাইয়াহ (আবুল উলাইয়া)
9) নকশাবন্দি সিদ্দিকিয়া
10) সোহরাওয়ার্দিয়া কাদীমাহ
11) সোহরাওয়ার্দাহ জাঈদাহ
12) সিলসিলা এ বাদী’আহ
13) সিলসিলায়ে মানামিয়াহ
বেশির ভাগ তরিকায় আ’লা হযরত বায়াত ছিলেন না। কিন্তু সে তরিকতের মাশায়েখগণ উপহার স্বরুপ খেলাফত দিয়েছেন। কবি নজরুল ডক্টোরেট করেন নি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডি. লিট’ উপাধি দেয়। ডক্টোর অভ লিটারেচার। কারণ তার কর্ম সে যোগ্যতা রাখে।
একইভাবে আ’লা হযরত সব সিলসিলায় বায়াত হন নি। কিন্তু তাঁর কর্ম সব ছাপিয়ে গিয়েছিল। তাঁর যোগ্যতার কারণেই তাঁকে খেলাফত উপহার দেয়া হয়েছে।
শেষ কথা। ভাবুন তো, এই ১৩ জন মাশায়েখ কি মূর্খ ছিলেন। তাঁরা কি জানতেন না, আ’লা হযরত কুফরি করেছেন। কেউ কুফরি করলে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছায় কিভাবে? আল্লাহ পর্যন্ত না পৌঁছালে খেলাফত পায় কিভাবে? তখন তো বাপের ছেলে, তাই খেলাফত এমন ছিল না।
জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
মালিক আমাদের বুঝার শক্তি দিক। ধৈর্য দিক। হেদায়ত দিক। ধন্যবাদ।