তাবেয়ীগণের ফতোয়া
সাহাবায়ে কেরাম থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত তাবেয়ীগণের মধ্যে যারা শীর্ষস্থানীয়, বিশেষ করে তৎকালীন প্রায় প্রতিটি ইসলামী শহরের যারা বড় বড় তাবেয়ী মনীষী ছিলেন, তাদের থেকেও জানাযার নামাযে সূরা ফাতেহা না পড়ার ফতোয়া পাওয়া যায়। যেমন :
১.মক্কা মুকাররমার বিখ্যাত তাবেয়ী আতা ইবনে আবী রাবাহ এর ফতোয়া :
عَنْ حَجَّاجٍ قَالَ : سألت عطاء عن القراءة على الجنازة فقال ما سمعنا بهذا إلا حديثا
হাজ্জাজ রহ. বলেন, আমি আতাকে জানাযার নামাযের কেরাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমরা তো একথা নতুন নতুন শুনছি। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৭ )
২.মদীনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ হযরত সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বলেছেন,
لا قراءة على الجنازة
জানাযায় কোন কেরাত নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫৩২)
৩.মদীনার আরেক প্রখ্যাত তাবেয়ী সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব র. বলেন,
ما نعلم في الصلاة على الميت من قراءة ولا دعاء شيئا معلوما
জানাযার নামাযে নির্দিষ্ট কোন কেরাত ও দুআ আছে বলে আমার জানা নেই। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস নং ৬৪৩৬)
৪.কুফা নগরীর বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত শাবী রহ. বলেন,
ليس في الجنازة قراءة
জানাাযার নামাযে কোন কেরাত নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৮ )
৫.কুফার-ই আরেক প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রহ. বলেন,
لا قراءة على الجنازة ولا ركوع ولا سجود ولكن يسلم عن يمينه وعن شماله إذا فرغ من التكبير. (كتاب الآثار لمحمد ، ২৩৬)
জানাযার নামাযে কোন কিরাআত নেই, কোন রুকু-সেজদা নেই। বরং তাকবীর বলা শেষ হলে ডানে-বামে সালাম ফিরাতে হবে। (কিতাবুল আছার, হাদীস : ২৩৬)
শাবী রহ. বরং স্পষ্ট করে বলেছেন,
التكبيرة الاولى على الميت ثناء على الله والثانية صلاة على النبي صلى الله عليه و سلم والثالثة دعاء للميت والرابعة تسليم
জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীর আল্লাহর প্রশংসা, দ্বিতীয় তাকবীর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ পড়া, তৃতীয় তাকবীর মৃতের জন্য দুআ করা এবং চতুর্থ তাকবীর হচ্ছে সালাম ফিরানো। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস নং ৬৪৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৩৭৫, ১১৩৭৮)
ইমাম মুহাম্মদ রহ. কিতাবুল আছারে ইবরাহীম নাখায়ীর অনুরূপ একটি ফতোয়া উদ্ধৃত করেছেন। (নং ২৩৮)
৬.মক্কার মনীষী আতা ইবনে আবী রাবাহ আর ইয়েমেনের বিখ্যাত তাবেয়ী তাউস সম্পর্কে ইবনে তাউস বলেছেন,
أنهما كانا ينكران القراءة على الجنازة
তারা দুজন জানাযার নামাযে কেরাত অপছন্দ করতেন।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৯)
৭.বসরার প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুহাম্মদ ইবনে সীরীন রহ. থেকে বর্ণিত,
كان لا يقرا في شيء من التكبيرات وكان يقول
তিনি জানাযার তাকবীরগুলোতে কোন কেরাত পড়তেন না। বরং পড়তেন,
اَللّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَاَلِّفْ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ وَاجْعَلْ قُلُوْبَهُمْ عَلَى قُلُوْبِ اَخْيَارِهِمْ، اَللّهُمَّ ارْفَعْ دَرَجَتَهُ فِيْ الْمُهْتَدِيْنَ وَاخْلُفْهُ فِيْ تَرِكَتِهِ فِيْ الْغَابِرِيْنَ، اَللّهُمَّ لا تَحْرِمْنَا اَجْرَهُ وَلا تُضِلَّنَا بَعْدَهُ.
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক,হাদীস নং ৬৪৩২)
৮.আবুল আলিয়া রহ. এর ফতোয়া :
عَنْ أَبِي الْمِنْهَالِ قَالَ : سألت أبا العالية عن القراءة في الصلاة على الجنازة بفاتحة الكتاب فقال ما كنت أحسب أن فاتحة الكتاب تقرأ إلا في صلاة فيها ركوع وسجود
আমি আবুল আলিয়াকে জানাযার নামাযে সূরা ফাতেহা পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমি মনে করি, সূরা ফাতেহা শুধু সে নামাযেই পড়া যাবে যেখানে রুকু ও সিজদা রয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৪ )
৯. আবু বুরদা রহ. এর ফতোয়া :
عَنْ أَبِي بردة قَالَ : قَالَ لَهُ رَجُلٌ أَقْرَأُ عَلَى الْجِنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ؟ قَالَ : لاَ تَقْرَأْ
এক লোক তাকে বলল, আমি জানাযার নামাযে সূরা ফাতেহা পড়ব। তিনি তাকে বললেন, তুমি (তা) পড়ো না। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৬।
১০.বাক্র ইবনে আব্দুল্লাহ রহ. বলেন,
لا أعلم فيها قراءة
জানাযার নামাযে কোন কেরাত আছে বলে আমি জানি না।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫৩০ )
ফিকহে মালেকীর প্রসিদ্ধ কিতাব আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা-য় সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের উপরোক্ত আমলের কথাই বর্ণিত হয়েছে:
قال ابن وهب عن رجال من أهل العلم عن عمر بن الخطاب وعلي بن أبي طالب وعبد الله بن عمر وفضالة بن عبيد وأبي هريرة وجابر بن عبد الله وواثلة بن الأسقع والقاسم بن محمد وسالم بن عبد الله وابن المسيب وربيعة وعطاء بن أبي رباح ويحيى بن سعيد: أنهم لم يكونوا يقرءون في الصلاة على الميت. قال ابن وهب وقال مالك: ليس ذلك بمعمول به ببلدنا إنما هو الدعاء، أدركت أهل بلدنا على ذلك.
অর্থ: ইবনে ওয়াহব র. উমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবু তালিব, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, ফাযালা ইবনে ওবায়দ, আবু হুরায়রা, জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ, ওয়াসিলা ইবনে আসকা রাযিয়াল্লাহু আনহুম ও কাসেম ইবনে মুহাম্মদ, সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ, ইবনুল মুসায়্যাব, রবীয়া, আতা ইবনে আবী রাবাহ ও ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ র. সম্পর্কে বর্ণনা করেন, তাঁরা জানাযার নামাযে কেরাত পড়তেন না। ইবনে ওয়াহব বলেন, মালেক র. বলেছেন, আমাদের শহরে (অর্থাৎ মদীনায়) এর উপর (অর্থাৎ জানাযার নামাযে কেরাত পড়ার উপর) আমল করা হয় না। জানাযা তো দোয়ারই নাম। আমি আমাদের শহরের অধিবাসীদেরকে এর উপরই পেয়েছি। (দ্র, খ: ১ পৃ:২৬৭)
দোয়া হিসেবে সূরা ফাতেহাও পড়া যায়
কোন কোন হাদীসে দেখা যায়, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কেউ কেউ জানাযার নামাযের প্রত্যেক তাকবীরের পরই সূরা ফাতেহা পড়তেন এবং দুআ করতেন। এ থেকেও বোঝা যায়, তারা সূরা ফাতেহা কেরাত হিসেবে নয়, বরং হামদ বা প্রশংসা হিসাবেই পড়েছেন। যেমন: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকের বর্ণনা –
عن أبي هريرة وأبي الدرداء وأنس بن مالك وابن عباس أنهم كانوا يقرؤون بأم القرآن ويدعون ويستغفرون بعد كل تكبيرة من الثلاث ثم يكبرون الرابعة فينصرفون ولا يقرؤون.
আবু হুরায়রা, আবুদ্দারদা, আনাস ইবনে মালেক ও ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত, তারা প্রথম তিন তাকবীরের পর সূরা ফাতেহা পড়তেন, দুআ করতেন ও ইসতিগফার করতেন। এরপর চতুর্থ তাকবীর বলতেন। এবং কোন কেরাত না পড়েই নামায শেষ করতেন। (হাদীস নং ৬৪৩৭)
وعن الحسن كان يقرأ في التكبيرات كلها بأم القرآن
হাসান )বসরী) র. থেকে বর্ণিত, তিনি প্রত্যেক তাকবীরের পরই সূরা ফাতেহা পড়তেন। (হাদীস নং ৬৪৩০)
সূরা ফাতেহা পড়াকে সুন্নত বলার ব্যাখ্যা
তিরমিযী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে,
إنه من السنة أو من تمام السنة
অর্থাৎ সূরা ফাতেহা পড়া সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত অথবা সুন্নতের পরিপূর্ণতা। এটি যদিও বাহ্যত পূর্বোক্ত বক্তব্যগুলোর বিপরীত মনে হয়, কিন্তু সবগুলো বক্তব্যের মাঝে সমন্বয় করলে এটাই সাব্যস্ত হয় যে, ইবনে আব্বাস রা. দুআ হিসেবেই তা পড়তেন। আর তিনি যে এটাকে সুন্নত বলেছেন, তার অর্থ হলো: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কখনো কখনো দুআর উদ্দেশ্যেই সেটি পড়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মধ্যে যে আমল করেছেন, সাহাবীগণ সেটিকেও সুন্নত আখ্যা দিতেন। তিরমিযী শরীফে দুই সেজদার মাঝে বসার পদ্ধতি সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা.ই বলেছেন, ইকআ করা (অর্থাৎ পা খাড়া রেখে গোড়ালির উপর বসা) সুন্নত। অথচ এ আমল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়তো হঠাৎ কখনো করেছেন।