তুর্কি নবঃজাগরণের পর্দার পিছনের কারিগরঃ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

তুরস্ক!!শব্দটি শুনলেই কিছু বিষয় মনের স্ক্রীণে অজান্তেই  ভেসে উঠে। পর্যায়ক্রমিক কিছু শব্দবিন্যাস আপনা-আপনিই তৈরী হয়ে যায়।

যেমন: খিলাফাত, ইসলামি শক্তি, সুফি স্বর্গ, উসমানী সম্রাজ্য,যোদ্ধা জাতী,বিশ্বযুদ্ধ,কামাল আতাতুর্ক, স্যেকুলারিজম, আদনান মেন্দেরেস সাথে বর্তমানের হালের এরদোয়ান।

তুরস্ক, আমাদের দেশের মানুষের দৃষ্টিগোচরে আসে বছর দশেক আগে।বিশ্ব রাজনীতি,  বিভিন্ন দেশে মানবিক সহায়তা ও অন্যান্য কিছু প্রাসঙ্গিক কারণে।আমাদের চোখে তা হয়তো নতুন লাগছে,  কেননা পূর্বে আমাদের কাছে তথ্য ছিল না। 

অনেক কথা, অনেক অজানা তথ্য পড়ে আছে ইতিহাসের তলানীতে। সেই ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চমক জাগানো সব তথ্য এবং চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া অনেক ঘটনা। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, আজকের তুরস্কের মুসলিম সমাজের উত্থান গল্পের শুরু সেই চল্লিশের দশকে। নব তুর্কির এই উত্থান গল্পের নায়কেরা সর্বদা আড়ালেই থেকে গিয়েছেন। স্বয়ং তার্কিতে খুব কম লোকই তাদের আলোচনা করে।

চল্লিশের দশক!!!

খিলাফাতের পতনের দুই দশক পর তুর্কিতে মুসলিমদের উত্থানের গল্প তৈরী হয়েছিলো। ইতিহাসের চলচিত্রের প্লট তৈরী হয়েছিলো।

সেই প্লট তৈরী করছিলেন দুজন সুফি মানুষ।

১:: শায়েখ আব্দুল_আজিজ_বাক্কানীঃ (১৮৯৫-১৯৫২)

–উনার পরিবার কাজানের বাসিন্দা। উসমানী আমলে বিখ্যাত হালিল এফেন্দির কাছ থেকে কুর’আন ও হাদীসের শিক্ষাগ্রহণের পর তিনি কাজান চলে যান।বাবার মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালে তিনি বুখারায় গমণ করেন। সেখানে ৫ বছর অবস্থানকালে সেসময়ের বিখ্যাত স্কলারের কাছ থেকে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করেন। বলশেভিক বিপ্লবের পর তিনি ইস্তাম্বুল ফিরে আসেন।

২::  শায়েখ মেহমেত_জাহিদ_কতকুঃ (১৮৯৭-১৯৮০)

— উসমানী ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের পর তার পরিবার বুরসায় অভিবাসী হিসেবে আসেন। তিনি তার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বুরসা থেকে সম্পন্ন করেন। বয়স যখন ১৮ তখন ১ম বিশ্বযুদ্ধের দরূণ সেনাবাহিনী থেকে তার ডাক আসে। যুদ্ধে উসমানী বাহিনীর পক্ষে সিরিয়ান ফ্রন্টে তিনি যুদ্ধ করেন। উনার বড় ভাই ‘আহমেদ শাকির’ জেরুজালেম এবং বিখ্যাত চানাক্কালেতে যুদ্ধের পর ২৮ বছর বয়সে শহীদ হন সম্মুখযুদ্ধে। যুদ্ধের পর তিনি ইস্তাম্বুল ফিরে আসেন।

দুজনেই ছিলেন #সুফী_নকশাবন্দী তরিকার বিখ্যাত শায়েখ ও দরবেশ। তারা ছিলেন একে অপরের বন্ধু। একই সাথে পড়ালেখা করেছিলেন। একই সাথে তুরস্কের মাটিতে ইসলামকে পুনরায় উজ্জীবিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেজন্য এমন কিছু যোগ্য ছাত্র ও শিষ্য তৈরী করেছিলেন যারা পুরো তার্কির চেহারা পালটে দিয়েছিলো।

তৎকালীন তুর্কিতে সুফিদের যে ধারা ছিলো,

সে ধারার ভিতর থেকেও এই দুজন ছিলেন ব্যতিক্রম। সুফিদের অন্যতম বৃহত তরিকার প্রধান (পীর/শায়েখ) হওয়ার পাশাপাশি মুসলিমদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের গুরুত্ব সম্পর্কে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বুঝাতেন।

দুজনই ছিলেন তার্কির রাজনীতির ইতিহাসের অমর ব্যক্তিত্ব, ইসলামী আন্দোলন “মিল্লি গুরুশ” এর প্রতিষ্ঠাতা প্রফে.ড.নাজমুদ্দীন এরবাকানের উস্তাদ।

শায়েখ মেহমেত জাহিদ প্রফে: এরবাকানের ব্যক্তিগত মেন্টর (পীর/মুরশিদ) হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৯-৫২ সালে তিনি শায়েখ আব্দুল আজিজ বাক্কানীর দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হন। তার কাছ থেকে ইসলামের যে আধ্যাত্মিক শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তা তার পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল।সুফি শায়েখ বাক্কানী তার বন্ধু শায়েখ মেহমেদ জাহিদকে সাথে নিয়ে তুরস্কের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী জযবা সম্পন্ন ছাত্রদেরকে একত্র করে শিক্ষা দিতেন। তাদের শিক্ষার প্রভাবে ছাত্ররা এতোবেশি উজ্জীবিত হয়েছিল যে তারা পুরো তুরস্কে ইসলামী পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য একধরণের নিরব গণদাবী তৈরী করেছিল। একধরণের বিপ্লবের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল তার্কির আকাশে বাতাসে।

মসজিদ প্রতিষ্ঠাঃ

তখন ১৯৪৪ সাল!!

সেক্যুলার সরকারের স্বর্ণযুগ।তার্কিশে আযান  দেয়া বাধ্যতামূলক করেছিলো।অনেক মসজিদকে  জেলখানায় পরিণত করেছিলো।এই দুই সুফির  প্রচেষ্টায় মানুষ জেগে উঠেছিল, বিশেষ করে যুবকেরা। মানুষের মধ্যে একধরণের বিপ্লবী আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। তাদের সাহসের লাভায় একটু উদগীরণের প্রয়োজন।

সে উদগীরণের বিস্ফোরক হয়ে তার্কির মানুষের সামনে আসেন তাদের যোগ্য ছাত্র প্রফেসর এরবাকান। সে সময় তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। সেক্যুলারদের সেই স্বর্ণযুগে সেক্যুলারদের প্রাণকেন্দ্র ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র এরবাকান ভার্সিটির ইসলামী জযবা সম্পন্ন ছাত্রদের নিয়ে ভার্সিটিতে মসজিদ নির্মাণের দাবী আদায়ে নেমে পড়েন। শেষমেশ কর্তৃপক্ষ তার দাবী মেনে নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মসজিদ নির্মাণ করে। ১৯৪৪ সালে নতুন একটি মসজিদ নির্মাণ পুরো তুর্কি সমাজকে নাড়িয়ে দেয়। মুসলিমদের আপন পরিচয় সম্পর্কে সজাগ করে তোলে।

সুফি শায়েখ বাক্কানী আধ্যাত্মিক শিক্ষার পাশাপাশি দেশ ও জাতির জন্য কিছু করার প্রেরণা দিতেন সর্বদা। ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের উপর তিনি বেশী জোর দিয়েছিলেন। প্রাইভেট সেক্টরে নিজেদের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ভার্সিটিতে পড়ার চেয়ে দেশ জাতি ও ইসলামের জন্য নিজেদেরকে যেন যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয় সে বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন।

সুফি শায়েখ আব্দুল আজীজ বাক্কানী ১৯৫২ সালে ইন্তেকালের পর, তরিকতের প্রধান হোন শায়েখ মেহমেত জাহিদ।শায়েখ জাহিদ পূর্ব থেকেই প্রফেসর এরবাকানের পীর ছিলেন। পরবর্তীতে এই মহান শায়েখের শিষ্য হওয়ার সৌভাগ্য হয় রেজাই কুতান, কুরকুত ওজাল, তেমেল কারামোল্লাওলু, তুরগুত ওজাল সহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের।

শায়েখ জাহিদ এবং তুরস্কের ১ম কারখানাঃ:: শায়েখ জাহিদ সর্বদা আক্ষেপ করতেন এই বলে,  “আজ আমার সামনে যে গাড়িগুলো চলছে, তা যদি আমরা নিজেরাই তৈরী করতে পারতাম তাহলে কতই না ভাল হতো। দেশের টাকা দেশের ভেতরেই থাকতো। বাইরে থেকে কেনার কোন প্রয়োজন হত না আর।” তাই তিনি তার সেরা ছাত্র নাজমুদ্দিন এরবাকানকে প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনা ও মোটিভেশন দিতেন। পরবর্তীতে তার প্রেরণায় এবং ৩০ বছরের তরুণ প্রফেসর এরবাকানের উদ্যোগে তুরস্কের মাটিতে ১ম মোটর উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম দেয়া হয় গুমুশ মোটর। ১৯৫৬ সালে শায়েখ  জাহিদ তার বাসায় সে সময়ের তরুণ ইঞ্জিনিয়ার, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সহ প্রায় ২০ জন অতিথিকে আমন্ত্রণ করেন। তিনি তাদের সামনে ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব, দেশের উন্নয়ন ও দেশের মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য উৎপাদন ব্যতীত অন্য কোন পথ যে নেই তা তুলে ধরেন। অতঃপর তিনি গুমুশ মোটরের প্রথম শেয়ার ১,০০০ লিরা দিয়ে কিনে নেন।

একজন সুফী দরবেশ, দরবারের পীর হয়ে  দেশের বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ীদেরকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের গুরুত্ব বুঝাচ্ছেন; তার উপর দেশে তৈরীকৃত ১ম মোটর ফ্যাক্টরীর ১ম শেয়ারটিও তিনি নিজে কিনে নিচ্ছেন!!

(কল্পনা করে দেখা যাক কেমন সেই মজলিশ)

অতঃপর অতি অল্প সময়ের মধ্যে “গুমুশ ফ্যাক্টরী” ইউরোপের চেয়েও উন্নত ইঞ্জিন তৈরী করতে সক্ষম হয়। ইউরোপের জ্বালানি খরচের স্ট্যান্ডার্ড ছিল ঘন্টায় ৫.৬ লিটার।১মে গুমুশ ফ্যাক্টরী যে ইঞ্জিন বানায় তার জ্বলানি খরচ ছিল ঘন্টায় ৫.৭ লিটার।এক বছরের মাথায় গুমুশ ফ্যাক্টরীর তৈরীকৃত ইঞ্জিনের জ্বালানী খরচ ছিল ঘন্টায় ৫.৫ লিটার!! কিন্তু তার্কি সরকার (তৎকালীন ইসলামপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী সুলেমান দেমিরেল) তা প্রত্যাখ্যান করে এই বলে যে- ইঞ্জিনটি নাকি ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ডএ হয়নি।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- যে তুরস্কে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই, সেই তুরস্কের মাটিতে ৩০ বছরের এক যুবক ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ডের কাছাকাছি একটি ইঞ্জিন (৫.৭ জ্বালানী ব্যয়) তৈরী করার পর তাকে যেখানে বাহবা দেয়ার কথা, সম্মান দেয়ার কথা, সহযোগিতা করার কথা, যেখানে তাদের উচিৎ ছিল এই প্রচেষ্টাকে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরে দেশের কোটি যুবককে উৎসাহিত করা, সেখানে উল্টো তা বাতিল করে  দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হল।

যুক্তির বিচারে ১ম তৈরীকৃত ইঞ্জিন মানঃসম্মত হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার কারণ ছিলো তাদের শর্তানুসারে গ্রহণযোগ্য,(যদিও তা অযৌক্তিক)।কিন্তু জ্বালানী ব্যয় যখন ৫.৫ লিটার করা হল অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রে বসা লোকদের আদর্শ ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ডকে যখন ছাড়িয়ে গেল তখন এই আবিষ্কারকে তো মাথায় তুলে নাচার কথা ছিল, কিন্তু তা না করে অজানা কারণে এটাকেও মানঃসম্মত হয়নি বলে, স্বীকৃতি দেয়া হল না!!

মিল্লি গুরুশ মুভমেন্টঃ

(ইসলামী আন্দোলন)

রাজনীতির এই মারপ্যাচের কাছে গুমুশ ফ্যক্টরী বারবার পরাজিত হচ্ছিলো।তখন শায়েখ জাহিদ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক শক্তি।তিনি সুফি মানুষ তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন রাজনীতির বাইরে থেকে কিছু করার। কিন্তু সম্ভব হয়নি। সেজন্য তার্কির বিভিন্ন সুফি তরিকার শায়েখদের(পীর)  সাথে আলোচনা করলেন। তৎকালীন সময়ে ইসলাম প্রচার যে হতো না, তা না। ব্যক্তিজীবনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করছিল কয়েকটি দল। তাদের দাওয়াতের লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আমল-আখলাক। কিন্তু সামাজিকভাবে কারও কোন চিন্তা-ভাবনা ছিল না আর রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু চিন্তা-ভাবনা করা কল্পনারও অতীত। 

তখন পর্যন্ত তিনটি দল বড় আকারে ইসলামের  প্রচার ও প্রসার নিয়ে কাজ করতোঃ

১- তরীকত পন্থিরা। এই আদি দলটি বরাবর ধারাবাহিক কাজ করে গেছে। এরা একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে গোপনে কাজ করতো। তাদের কাজগুলো ছিল চিন্তার গন্ডীর ভেতরে। বাস্তবে  পদক্ষেপ নিতে পারতো না।

২- নুরসীর অনুসারীরা। তারাও গোপনে গোপনে ইসলামের প্রচার করতো। তবে তারা কুর’আন ও হাদীসের পরিবর্তে অতিমাত্রায় বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী রচিত “রিসালায়ে নূর” এর উপর নির্ভরশীল।

৩- অপরটি ছিল বুলগেরিয়া থেকে আগত আলেম সুলেয়মান হিলমী তুনাহান এর অনুসারীরা।তারা এখনো বিশ্বাস করেন যে, শুধুমাত্র কুর’আন তেলাওয়াতের মাধ্যমে দেশ ও বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে!

তাদের প্রত্যেকের কাজই ছিল গোপনে এবং তারা তাদের পরিচিত গন্ডীর ভেতরেই কাজ করতে পছন্দ করতো। সামাজিক বা রাজনৈতিক ভাবে কিছু করার সুযোগ ও চিন্তা ভাবনা তাদের মধ্যে ছিল না। তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টিতে সংকীর্ণতার পরিচয় দেন। 

কিন্তু রাষ্ট্রীয় শক্তি জনগণের ইসলামের কথা বলে দেশের ভেতরের সকল কিছু একটি নির্দিষ্ট গোষ্টীর কাছে হস্তান্তর করছিলো । ৬০ এর দশকে সাইপ্রাস নিয়ে সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস দেখা দেয়। সেখানকার মুসলিমদের উপর গণহত্যা তুরস্কের ইসলামপন্থীদের বিচলিত করে তুলে। ওরা না কোন কথা বলতে পারছিল, না পারছিল কিছু করতে। রাষ্ট্র কয়েকবার মেকি অভিযানের নাম করে আবার ফিরে আসে। সেরকম সত্যিকারের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি। যদিও সাইপ্রাস ইস্যুতে লৌহ কঠিন কথা বলে জনগণের আস্থা অর্জন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুলেমান দেমিরেল। তিনি শুধু ওই কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, বাস্তবে কিছু করে দেখাতে পারেন নি। দেশের ইসলামপন্থিরা তাদের ইসলামপ্রিয় নেতা সুলেয়মান দেমিরেলকে চিনতে দেরী করলেও প্রফেঃ এরবাকান ঠিকই তাকে পরখ করে নিয়েছিলেন গুমুশ ফ্যাক্টরী ও পরবর্তী কিছু ঘটনার মাধ্যমে। তিনি তার শায়েখকে সকল বিষয়ে অবহিত করার পর প্রস্তাব দেন আমাদের এখন রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সকলের মধ্যেই এক ধরণের ভিন্ন চাওয়া-পাওয়া ও নতুন এক আন্দোলন শুরুর ইংগিত পাওয়া যাচ্ছিলো। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য আলেমদের সহযোগীতার দরকার ছিল খুব বেশি।

সেই প্রেক্ষিতে শায়েখ জাহেদ আহমেদের ডাকে ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে ৪০ জন শায়েখে   তরিকত নিয়ে তুরস্কের বিখ্যাত শহর কোনিয়াতে একত্রিত হন। তারা প্রায় এক সপ্তাহ ব্যাপি সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। অতঃপর সকলে সিদ্ধান্তে উপনীত হোন যে- “তুরস্কে একটি ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজন”।

শায়েখ জাহিদ আহমেদ প্রস্তাব রাখেন- “তুরস্কের জনগণের নিকট আলেমদের গ্রহণযোগ্যতা এতোটা হয়নি যে লোকজন আমাদেরকে রাজনীতির ময়দানে ভালোভাবে গ্রহণ করবে। জনগণের মনঃমানসিকতা এখনো সেভাবে গড়ে উঠে নি। আমাদের প্রয়োজন কিছু যুবক যারা বর্তমান যুগের তুলনায় সবচেয়ে আধুনিক, বর্তমান টেকনোলোজি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ওয়াকিবহাল, যাদের বেশ-ভূষা, আচার-আচরণ সর্বোত্তম। আমাদের দরকার ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, দেশের উচ্চপদে আসীন কিছু যোগ্য লোক যাদের কাবিলিয়াত সম্পর্কে যেন কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে, সেই সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়- তাদের সকলেই যেন ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান রাখে।”

অতঃপর শায়েখ জাহিদ আহমেদ সকল আলেমদের সামনে মিল্লি গুরুশ আন্দোলনের প্রধান হিসেবে প্রফেঃ ড.নাজমুদ্দিন এরবাকানের নাম প্রস্তাব করেন। কেননা শায়েখ জাহিদ আহমেদ যেসকল গুণের বর্ণনা করেছিলেন তার সবকটিই এরবাকানের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। 

প্রফেঃ এরবাকান একই সাথে বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, গণিতবীদ, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সফল সভাপতি ছিলেন। অপরদিকে তিনি ছোটবেলা থেকেই শায়েখ  জাহিদের তত্ত্ববধানে কুর’আন, হাদীস, ফিকহ, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক দক্ষতা লাভ করেছিলেন। উপরি পাওনা হিসেবে যোগ হয়েছিল নাজমুদ্দিন এরবাকানের উসমানী ভাষায় দক্ষতা ও উসমানীদের বিশাল সাহিত্য তার নখদর্পনে থাকা। সকল আলেমগণ শায়েখ  জাহিদের ইলম সম্পর্কে ভালোভাবেই জ্ঞাত ছিলেন। তাই তার প্রস্তাবে সকলের একমত হতে দেরী হয় নি। একমত হওয়ার পর প্রফেঃ  এরবাকানকে সম্মেলনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। উস্তাদের কথায় এতবড় গুরুদায়িত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন প্রফেঃ এরবাকান। কিছু সময় চেয়ে নেন সকলের কাছ থেকে। আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এই আন্দোলনের ভবিষ্যত প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে তিনি ভালোই অনুধাবন করতে পারছিলেন। প্রফেঃ এরবাকান সম্মেলনের ৪০ জন সুফির সাথে আলাদাভাবে ব্যক্তিগত যোগাযোগ করেন। এরপর তিনি তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে মিল্লি গুরুশ আন্দোলনের গুরুদায়িত্ব নিজ কাধে নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করেন। ১০ জন জানবাজ সহযোদ্ধা নিয়ে নতুন তুর্কি দেশ তৈরীর সংগ্রামে নেমে পড়েন। তাদের উপর ভিত্তি করেই আজ তুরস্ক নিজের পায়ের তলার মাটিতে শক্তভাবে অবস্থান করতে পারছে। পরবর্তীতে তাদের কাজগুলোই স্বর্ণালী ইতিহাস হয়ে টিকে আছে তার্কির ইতিহাসে।

পরিশেষে…

সুফি শায়েখ আব্দুল আজিজ বাক্কানী এবং সুফি শায়েখ মেহমেত জাহিদ কতকুর তৈরীকৃত এই ছাত্ররাই তুরস্কের ইসলামী জাগরণের পথিকৃত হিসেবে সকলের কাছে সমাদৃত হয়ে আছে। তাদের শিষ্যরাই তুরস্কে শিল্প বিপ্লব সঙ্ঘটিত করেছে। তাদেরই একজন ছাত্র ১ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিগত শতাব্দীর মুসলিমদের একমাত্র বিজয়াভিযান “সাইপ্রাস বিজয়-১৯৭৪” এর প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিল। ওরা পুরো তুরস্কের মানুষকে তথা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে জায়োনবাদীদের বিরুদ্ধে এক করেছিল। তাদের ছাত্ররাই বুক ফুলিয়ে আমেরিকাকে হুংকার দিয়ে বলেছিলে- “আমেরিকা!! তো আমার কী??

(অর্থাৎ আমেরিকাকে আমরা গণায় ধরি না)

ইতিহাসের পাতায় হয়তো শায়েখ আব্দুল আজীজ এবং শায়েখ জাহিদের নাম তেমন জোরালোভাবে শোনা যাবে না। কিন্তু পর্দার আড়ালের এই দুই কারিগরই তুরস্কের মাটিতে এক সাহসী প্রজন্ম তৈরী করেছিলেন যে প্রজন্ম তার্কিসহ, পুরো ইউরোপ, আরব বিশ্ব এবং মধ্য-এশিয়ায় আলোড়ন তৈরী করেছিল। ৭০ এর দশকের পর থেকে তাদের ছাত্ররাই তার্কির রাজনীতির মাঠ দখল করে আছে। এ দুই মহান শিক্ষক নীরবে-নিভৃতে যোগ্য মানুষ তৈরীর কাজে নিয়োজিত ছিলেন। শায়েখ বা শিক্ষক  হিসেবে তারা সফল।সুফি শায়েখরা কখনোই লাইমলাইটে আসেন না। তারা পর্দার আড়ালের কারিগর! তাদের শিষ্যরা প্রকাশিত হয়।

এই দুই মহান শায়েখকে আল্লাহ বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুণ। আমীন…

————

*তুরস্কের খিলাফত পরবর্তী রাজনীতির ইতিহাস জানতে পড়তে পারেন:- নাজমুদ্দিন এরবাকানঃ নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রস্তাবক ও মহান মুজাহিদ।

©কালেক্টেড (মিম্বার)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment