আবু রায়হান আল বিরুনি বা আবু রায়হান মোহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮), ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত আরবীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। তাঁর পূর্ণ নাম আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-বিরুনি। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন ৩৬২ হিজরির ৩ জিলহজ মোতাবেক খ্রিস্টিয় ৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রাচীন ইরানের খারেজম প্রদেশের কাস শহরে। বর্তমানে এ অঞ্চলটি মূলত উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের অংশ।
বলা হয় গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতে হামলার সময় আল বিরুনিকে নিজ সেনাদলের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এইসব সফরে বিরুনি ভারতীয় পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বা তাদের সম্পর্কে জানতে পারেন। বিরুনি বেশ কয়েক বছর বা অন্তত এক যুগের এক বড় অংশ ব্যয় করেছেন ভারত সম্পর্কিত গবেষণায়। এ সময় তিনি সংস্কৃত সহ ভারতের নানা ভাষাও রপ্ত করেন। এ ছাড়াও এ সময় দর্শনসহ ভারতীয়দের নানা জ্ঞান সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করেন বিরুনি।
আর এইসব অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি লিখেছেন তাঁর অমর কীর্তি, ভারত সম্পর্কিত বিশ্বখ্যাত বই ‘তাহকিকে মেলালে হেন্দ বা ভারতীয় জাতি সম্পর্কিত গবেষণা’। ভারত সম্পর্কিত মূল্যবান নানা তথ্য তিনি তুলে ধরেছেন এ ঐতিহাসিক বইয়ে। এ বইটি সমাজবিজ্ঞানে মুসলিম গবেষকদের বিস্ময়কর অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে। সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে তাদের এই দক্ষতা গড়ে উঠেছিল নানা দেশ সফরের সুবাদে। বিরুনি এই বইয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত বিষয়ে ভারতীয়দের মতামত এবং হিন্দুদের নানা ধর্ম-বিশ্বাসের পাশাপাশি ভারতের ভৌগলিক ও ভূতাত্ত্বিক নানা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন যে পশ্চিমা পণ্ডিতরা মূলত এ বইয়ের মাধ্যমেই ভারত সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। বিরুনির এই বই ভারতীয়দের ধর্ম, প্রথা, ইতিহাস ও নানা জ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বই হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বিরুনিকে তুলনামূলক নৃতত্বের অগ্রপথিকও বলা যায়। বিরুনির এ বইটি লেখা সম্পন্ন হয়েছিল ৪২১ হিজরিতে। এ বছরই মারা যান গজনির সুলতান মাহমুদ।
ভারত সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা চালাতে গিয়ে নানা বিপত্তির শিকার হতে হয়েছিল বিরুনিকে। কারণ, সে যুগের ভারতীয়রা মুসলমানদের সঙ্গে সখ্যতা রাখত না। আর ভারতীয়দের ভাষা শেখাও ছিল বিরুনির জন্য বেশ কঠিন ব্যাপার। তা সত্ত্বেও জীবনের ৫০ বছর বয়েসে বিরুনি সংস্কৃতি ভাষা শিখেছিলেন। ২,৫০০-৩,০০০ সংস্কৃত শব্দ তিনি অনায়াসে মুখস্ত করে নেন। তিনি এর মাধ্যমে ভারত সফরের সময় নানা অঞ্চলের ভারতীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
‘তাহকিক মালাল আল হিন্দ’ বইয়ে বিরুনি হিন্দুদের নানা প্রথা এবং আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিরপেক্ষ মতামত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ বইয়ে তিনি হিন্দু জাতিগুলোর চিন্তা ও বিশ্বাসের সঙ্গে অন্যান্য জাতির চিন্তা-বিশ্বাসের পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে এ বিষয়ে চমৎকার তুলনামূলক গবেষণা আর বিশ্লেষণ উপহার দিয়েছেন। যেমন, বিরুনি খ্রিস্ট-পূর্ব যুগের গ্রিকদের চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের সঙ্গে ভারতীয় হিন্দুদের চিন্তা-বিশ্বাসের তুলনা করেছেন। বইটির অন্য অংশে ভারতের জাতিভেদ প্রথার সঙ্গে শাসানিয় যুগের ইরানিদের জাতিভেদ প্রথার তুলনা করেছেন বিরুনি।
১৮৮৭ সালে লন্ডনে প্রথম এডওয়ার্ড জাকাউ দ্বারা সম্পাদিত মূল আরবি গ্রন্থটি প্রকাশ হয়। এর পর তার ইংরেজি সংস্করণ বের করা হয় ১৮৮৮ সালে। ‘কিতাবুল হিন্দ’ বা ‘ভারততত্ত্ব’ নামেও সুপরিচিত বইটি। এটি মূল আরবি (১০৩১ সালে লিখিত) থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ঐতিহাসিক সুপণ্ডিত জনাব আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশ হয় এটি। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতে, আল-বিরুনী ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকোষ, তার প্রত্যেকটি গ্রন্থ ছিল জ্ঞানের আঁধার। ভারতীয় পণ্ডিতরা আল-বিরুনীকে বলতেন জ্ঞানের সমুদ্র।




Users Today : 152
Users Yesterday : 767
This Month : 14574
This Year : 186445
Total Users : 302308
Views Today : 3187
Total views : 3579930