জামাতের সময় ইমাম ও মুসল্লিগণ কখন দাঁড়াবে?

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

এই বিষয়ে আমি বিভিন্ন হাদিস ও বিভিন্ন ফিকহের কিতাব থেকে যতটুকু পেয়েছি , তা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ

মসজিদের ইমাম ও ময়াজ্জিনকে ইকামতের পূর্বে এই ঘোষণা দিতে শুনা যায়- আপনারা দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করুন। মুক্তা দীগণকে দাঁড় করিয়ে তারপর ইকামত শুরু করা হয়। হানাফী মাযহাব মতে কখন দাঁড়াতে হবে তা অনেক ইমাম এবং মুয়াজ্জিন হয়তো জানেন না। ইকামতের সময় কখন ইমাম ও মুসল্লীগণের দাঁড়ানো সুন্নত- সে সম্পর্কে নিন্মে হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য ফিকাহ ও ফতোয়ার ইবারত পেশ করা হলো।

দলীল সমূহ-

১। আইনী শরহে বুখারীতে (৪র্থ খন্ডের ৩৫৭ পৃষ্টায়) উল্লেখ আছে-

قال ابو حنيفة ومحمد (رح) يقومون فى الصف اذا قال حى علي الصلوة ]

অর্থাৎ- ইমাম আবু হানিফা [ رحمه الله عليه ] ও তার ছাত্র ইমাম মুহাম্মদ [ رحمه الله عليه ] বলেছেন – যখন মুয়াজ্জিন ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ বলবে তখন মুসল্লীগণ দাঁড়াবেন।

২। ফতহুল বারী শরহে বুখারীতে (২য় খন্ডের ১৪০ পৃষ্ঠায়) উল্লেখ আছে-

عن ابى حنيفة يقومون اذا قال حى علي الفلاح]

অর্থাৎ- ইমাম আবু হানিফা [ رحمه الله عليه ] হতে বর্ণিত আছে যে- যখন মুয়াজ্জিন ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলবে তখন মুসল্লিগণ দাঁড়াবেন।

৩। আল্লামা নববী [ رحمه الله عليه ] শরহে মুসলিমের মধ্যে (১ম খন্ডের ২২১ পৃষ্ঠায়) উল্লেখ করেছেন-

قال ابو حنيفة رح والكوفيون – يقومون فى الصف اذا قال حى علي الصلوة]

অর্থাৎ- ইমাম আবু হানিফা রহঃ এবং কুফার ফকিহগণ বলেছেন- যখন মুয়াজ্জিন ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ বলবে তখন মুসল্লীগণ দাঁড়াবেন।

৪। আউনুল মা’বুদ শরহে আবু দাউদ -এ (২য় খন্ডের ১২৮ পৃষ্ঠায়) উল্লেখ আছে-

عن ابى حنيفة يقومون اذا قال حى علي الفلاح]

অর্থাৎ- ইমাম আবু হানিফা [ رحمه الله عليه ] হতে বর্ণিত, যখন মুয়াজ্জিন ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ বলবে তখন মুসল্লীগণ দাঁড়াবেন।

বিঃ দ্রঃ উপরের দুইটি প্রদ্ধতি ইমাম আবু হানিফা [ رحمه الله عليه ] থেকে বর্ণিত হয়েছে। দুইটি বর্ণনায় “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত বর্ণনার ফয়সালা বা সমন্বয় মুফতীগণ এভাবে করেছেন “হাইয়্যা আলাস সালাহ” বলার সময় দাঁড়ানো শুরু করবে “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” বলার সময় পূর্ণভাবে দাঁড়াবে।

৫। তাহতাভী আলা মারাকিল ফালাহ’ তে (২য় খন্ডের ২২০ পৃষ্ঠায়) উল্লেখ আছে-

اذا اخذ المؤذن فى الاقامة ودخل رجل فى المسجد فانه يقعد ولا ينتظر قائما فانه مكروه كما فى المضمرات قهستانى ويفهم منه كراهة ابتداء الاقامة – والناس عنه غافلون ]

অর্থাৎ- যখন মুয়াজ্জিন ইকামত শুরু করবে, এমন সময় যদি কোন মুসল্লী মসজিদে প্রবেশ করে তা হলে তাকে বসে যেতে হবে। দাঁড়িয়ে (হাইয়্যা আলাস সালাহ বা ফালাহ) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না কেননা উহা মাকরুহ।

ফতোয়ায়ে আলমগীরী রচিত হয়েছে। বাদশাহ আলমগীর ৭০০ বিজ্ঞ আলেম দিয়ে তৎকালীন ষোল লক্ষ টাকা ব্যয় করে উক্ত ফতোয়া রচনা করেছেন যাদের মধ্যে শাহ্ আব্দুর রহীম দেহলভী [ رحمه الله عليه ] অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তখন দেওবন্দ মাদ্রাসা ছিল না। উক্ত ফতোয়ায় মুসল্লিগণের দাঁড়ানোর একটি মাত্র পদ্ধতিই বর্ণনা করা হয়েছে তা হল “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” তে দাঁড়ানো শেষ করা। নিন্মে আলমগীরীর ইবারত দেখুন।)

৬। (ফতোয়ায়ে) আলমগীরীতে উল্লেখ আছে-

[ اذا دخل رجل عند الاقامة يكره له الانتظار قائما – ولكن يقعد ثم يقوم اذا بلغ المؤذن قوله حى علي الفلاح كذا المضمرات ان كان المؤذن غير الامام وكان القوم مع الامام فى المسجد فانه يقوم الامام والقوم اذا قال المؤذن حى علي الفلاح عند علمائنا الثلاثة وهو الصحيح]

অর্থাৎ- ইকামতের সময় কোন মুসল্লী মসজিদে প্রবেশ করলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা মাকরুহ বরং সে বসে যাবে। মুয়াজ্জিন যখন “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” বলবে তখন সে পূর্ণভাবে দাঁড়াবে। মুজমিরাত গ্রন্থে এরুপ ফতোয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরুপভাবে ইমাম ও মুসল্লীগণ একসাথে মুয়াজ্জিনের “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” বলার সময় দাঁড়াবে, যদি তারা ইকামতের পূর্ব হতেই মসজিদে বসা থাকেন। হানাফী মাযহাবের প্রথম তিন ইমাম আবু ইউসূফের ইহা ঐক্যমত। ফতোয়ার নীতিমালা অনুযায়ী ইহাকে বিশুদ্ধ সহীহ্ একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য ফতোয়া বলা হয়। (ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ১ম খন্ড ৫৭ পৃঃ)

অন্য তিন মাযহাবের মতামতঃ

১। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল [ رحمه الله عليه ] এর মতামত সম্পর্কে ইমাম নববী শরহে মুসলিমে (মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড ২২১ পৃষ্ঠায়) বলেন-

وكان انس رضى الله عنه يقوم اذا قال المؤذن قد قامت الصلوت وبه قال احمد]

অর্থাৎ- রাসূলে পাক [ﷺ] এর খাদেম হযরত আনাস [ رضى الله عنه ] ইকামতের সময় তখন দাঁড়াতেন যখন মুয়াজ্জিন বলতেন ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ। ইহাই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের অভিমত।

২। আল্লামা আইনী শরহে বুখারীতে (৪র্থ খন্ড ৩৫৭ পৃষ্ঠায়) ইমাম আহমদের অভিমত এভাবে উল্লেখ করেছেন-

قال احمد اذا قال المؤذن قد قامت الصلوت يقوم الامام]

অর্থাৎ- ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল [ رحمه الله عليه ] এই অভিমত দিয়েছেন যে, যখন মুয়াজ্জিন বলবে ” ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ” তখন ইমাম দাঁড়াবে।

৩। ইমাম শাফেয়ী [ رحمه الله عليه ] এর অভিমত সম্পর্কে আল্লামা কাস্তুলানী বলেন-

واختلف فى وقت القيام الى الصلوة فقال الشافعئ والجمهور عند الفراغ من الاقامة وهو قول ابى يوسف]

অর্থাৎ- নামাযের জামাতে দাঁড়ানোর সময়ের ব্যাপারে ইমামগণের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী এবং অধিকাংশ উলামাগণের মতে ইকামত সমাপ্ত হওয়ার পর ইমাম ও মুসল্লীগণ দাঁড়াবে। হানাফী মাযহাবের ইমাম আবু ইউসুফ [ رحمه الله عليه ] তাঁর পৃথক একটি মতে ইমাম শাফেয়ীর ন্যায় অভিমত দিয়েছেন। [মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড ২২১ পৃষ্ঠা এবং শরহে মুসলিম শরীফেও রয়েছে]

৪। ইমাম মালেক [ رحمه الله عليه ] এর অভিমত সম্পর্কে আউনুল মা’বুদ শরহে আবু দাউদ (২য় খন্ড ১২৮ পৃষ্ঠায়) এবং ফতহুল বারী শরহে বুখারী গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখ রয়েছে-

وقال مالك فى الامؤطا لم اسمع فى قيام الناس حين تقام الصلوة بحد محدود الا انى ارى زلك على طاقه الناس فان فيهم الثقيل والضعيف وذهب الاكثرون الى انهم اذا كان الامام معهم فى المسجد لم يقوموا حتى يفرغ من الاقامة]

অর্থাৎ- ইমাম মালেক [ رحمه الله عليه ] বলেছেন- নামাযের ইকামতের কোন পর্যায়ে মুসল্লীগণকে দাঁড়াতে হবে- এ সম্পর্কে আমি কোন চুড়ান্ত হাদীছ এ পর্যন্ত শুনিনি। তবে আমি মুসল্লীগণের শারীরিক শক্তির উপর দাঁড়ানোর বিষয়টি ন্যস্ত করছি। কেননা, মুসল্লীদের মধ্যে কেউ আছে শারীরিকভাবে দূর্বল এবং কেউ আছেন হালকা পাতলা। তবে অধিকাংশ আলেমগণ (মালেকী) অভিমত দিয়েছেন যে, ইকামত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইমাম ও মুসল্লীগণ দাঁড়াবে না।

বিঃ দ্রঃ ইমাম মালেক [ رحمه الله عليه ] কর্তৃক পরিষ্কারভাবে দাঁড়ানোর সীমারেখা না দেওয়ার কারণ হলো – এ সম্পর্কিত কোন চুড়ান্ত হাদীস তাঁর নিকট তখনও পৌঁছেনি। তাই তিনি সুনির্দিষ্টভাবে সীমারেখা না দিয়ে মুসল্লীদের শারীরিক অবস্থার উপর ন্যস্ত করেছেন। কিন্তু মালেকী মাযহাবের উল্লেখযোগ্য একজন ইমাম আল্লামা যোরকানী [ رحمه الله عليه ] শরহে মোয়াত্তা ইমাম মালেক – এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে, অধিকাংশ মালেকী উলামা এবং ফতোয়া বিশারদগণের মতে ইকামত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইমাম ও মুসল্লীগণ বসে থাকবেন।

পর্যালোচনাঃ

চার মাযহাবের মতামত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-

১। হানাফী মাযহাব মতে “হাইয়্যা আলাছ ছালাহ” বা “হাইয়্যা আলাল ফালাহ” বলার সময় ইমাম ও মুসল্লীগণের দাঁড়ানো সুন্নাত। এর পূর্বে দাঁড়ানো – মাকরুহ।

২। হাম্বলী মাযহাব মতে “ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ” এর সময় দাঁড়ানো সুন্নাত। [মুসলিম শরীফ ১ম খন্ড ২২১ পৃ.]

৩। শাফেয়ী মাযহাব মতে ইকামত শেষ হওয়ার পর দাঁড়ানো সুন্নাত।

৪। মালেকী মাযহাব মতে শারীরিক শক্তিভেদে ইকামত সমাপ্তির পর দাঁড়ানো সুন্নাত। অথবা ইকামত শেষ হলে দাঁড়ানো সুন্নাত। কোন মাযহাব মতেই ইকামত শুরুর পূর্বে বা “হাইয়্যা আলাস সালাহ” এর পূর্বে দাঁড়িয়ে থাকার কোন প্রমাণ বা বিধান নেই। যারা কাতার সোজা করার দোহাই দিয়ে মুসল্লীদেরকে পূর্বে দাঁড় করিয়ে রাখেন – তাদেরকে সুন্নাত তরকের দায়দায়িত্ব নিতে হবে। অপরদিকে যারা লোপ পেয়ে যাওয়া এই সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করবেন- তারা একশত শহীদের সওয়াব পাবেন। [মিশকাত শরীফ, ৩০ পৃষ্ঠা, বায়হাকী শরীফ ‘কিতাবুল জিহাদে’ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে]

কাতার কখন সোজা করবেন?

কাতার সোজা করা ওয়াজিব। ওয়াজিব কখন আদায় করবেন? এর দুটি পদ্ধতি রয়েছে।

একঃ হযরত ওমর [ رضى الله عنه ] কাতার সোজা করতেন ইকামতের পরে। তিনি হযরত আলী [ رضى الله عنه ] কে দিয়ে কাতার সোজা করে তারপর তাকবীরে তাহরীমা বাঁধতেন (মিশকাত)।

দুইঃ বর্তমানে প্রায় সকল মসজিদেই কাতার চিহ্ন দেয়া থাকে। কোন মুসল্লী যদি কাতার ভঙ্গ করে বসে থাকেন- তাহলে ইমাম সাহেব ইকামতের পূর্বে সকল মুসল্লীকে দাঁড় করিয়ে কাতার সোজা করে বসিয়ে দিয়ে মুয়াজ্জিনকে ইকামতের নির্দেশ দিলে ওয়াজিব এবং সুন্নাত উভয়টিই পালন করা সহজ হয়। এটা ইমামের সতর্কতার উপর নির্ভরশীল।

তবে ইকামতের পূর্বে ইমাম সাহেব যদি নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যান, তাহলে মুক্তাদিদের আদব হলো তারাও ইমামের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যাবে।কারন তারা ইমামের অনুসরণ করবে।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা ভালো জানেন।

✍️:- সেক সাবির আলি।
সুপারিনটেনডেন্ট
বনপুরা সিনিয়র মাদ্রাসা
পশ্চিম মেদিনীপুর ।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment