*জান্নাতী দল তথা সুন্নী জামা’আত কারা?* [পোষ্ট-২৬]

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

লেখক: অধ্যক্ষ মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম নঈমী

সম্পাদনা: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

ইসলামের দাবিদারদের বহু রাস্তা বিদ্যমান। সকল দাবিদারই দৃঢ় একীন ও নিশ্চয়তার সাথে আপন মাযহাবকে সিরাতুল মুস্তাকীম বলে থাকে এবং এর উপর চলে খোদা পর্যন্ত পৌঁছার নিশ্চয়তা প্রদান করে। এমতাবস্থায় অবুঝ সরল-সোজা মানুষের ক্ষেত্রে বড় অসুবিধা হয় যে, পরিশেষে তাঁর করণীয় কী? কোন্ পথ গ্রহণ করবেন তিনি? এই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ওই মুসাফিরের মতোই, যিনি পথের অবস্থা সম্পর্কে অবগত নন এবং যিনি মঞ্জিলে মকসূদে পৌঁছুতে চান। মঞ্জিল বা গন্তব্য স্থানের খোঁজ-খবর নেবার জন্যে তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছেন চৌরাস্তার উপর। চারদিক থেকে আহ্বানকারীরা ডাকাডাকি করছে, প্রত্যেক আহ্বানকারীই আপন রাস্তাকে সঠিক বলছে এবং গন্তব্য স্থানে পৌঁছার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এ অবস্থায় মুসাফিরের শুধু এটাই দেখা দরকার যে ওই সব রাস্তার মধ্যে এমন কোনো রাস্তা আছে কি-না, যার উপরে চলে নির্বিঘ্নে গন্তব্য স্থানে পৌঁছুনো যেতে পারে। মঞ্জিলে মকসূদে নিরাপদে যাওয়ার কথা অবগত হয়ে তিনি উক্ত পথই অবলম্বন করবেন এবং আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেবেন; ফলে নিশ্চয় মঞ্জিলে মকসূদে গিয়ে পৌঁছুবেন। অতএব, সত্যান্বেষী ব্যক্তির লক্ষ্য করা উচিত সেই মাযহাব কোনটি, যার অনুসরণকারীবৃন্দ খোদাতায়ালা পর্যন্ত পৌঁছুতে সক্ষম হয়েছেন এবং এ সাফল্যের সুসংবাদও প্রাপ্ত হয়েছেন, আর সেটাই তিনি অবলম্বন করবেন।

সেই মাযহাব যাকে অনুসরণ করে অনুসরণকারীবৃন্দ খোদা পর্যন্ত পৌছুতে পেরেছেন এবং এ সম্পর্কে অবগতও হতে পেরেছেন, তা হচ্ছে স্রেফ, আর স্রেফ মাযহাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। বিশ্বজগৎ জানে এবং বিশ্ব-ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এই সুন্নী মাযহাবের অনুসারীবৃন্দই আল্লাহওয়ালা হয়েছেন; গাউস-কুতূব হয়েছেন – আরো হয়েছেন এই হক্বপন্থী মাযহাবে অসংখ্য অগণিত আবদাল-আওতাদ, আহবার, আখইয়ার! সুতরাং তালেবে হক্ব তথা সত্যপন্থা অন্বেষণকারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো মাযহাবে আহলে সুন্নাত অবলম্বন করা। উপরে উল্লেখিত হাদীস দ্বারা প্রতিপন্ন হলো যে, সিরাতুল মুস্তাকীম কেবল একটাই পথ এবং এটাই মাযহাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত।

যুক্তি-জ্ঞানের বিচারেও প্রতীয়মান হয় যে কেবল একটি পথই সিরাতুল মুস্তাকীম তথা সোজা পথ। তা এ কারণে যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যতোগুলো রেখা বের হতে পারে তার মধ্যে কেবল একটিই হবে সোজা রেখা। এ ছাড়া সমস্ত রেখাই হবে আঁকাবাঁকা। কাজেই জানা গেলো যে সিরাতুল মুস্তাকীম শুধুমাত্র একটি হতে পারে। এতদ্ভিন্ন সমস্ত রাস্তাই বক্র। পার্থক্য শুধু এতোটুকু যে, কোনো স্থানকে অন্তত উদ্দেশ্য স্থির করে বাঁকা পথগুলোর সাহায্যে সেখানে পৌঁছুনো সম্ভব হলেও তা প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ ও বিপদসঙ্কুল। কিন্তু বাঁকা পথ তথা রদ-মাযহাব অবলম্বন করে খোদা পর্যন্ত পৌঁছুনো কিছুতেই সম্ভবপর নয়। জায়গা/স্থানের উপর মাযহাবকে অনুমান বা কিয়াস করা কোনোক্রমেই ঠিক নয়। কেননা সমস্ত বাঁকা পথ পরিণামে গন্তব্যস্থল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। কিন্তু মাযহাবের ক্ষেত্রে যে বাঁকা পথই হোক না কেন, তা আদৌ খোদার পথ নয়। এ কারণে পবিত্র হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে:

عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ.

অর্থ: উক্ত বাঁকা পথসমূহের প্রতিটি পথের উপর একটি করে শয়তান দাঁড়িয়ে আছে। সে লোকদেরকে নিজের দিকে আহ্বান করছে (যাতে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করা যায়)।

কাজেই জানা গেলো যে মাযহাবের ব্যাপারে (সিরাতুল মুস্তাকীম ছাড়া) প্রতিটি বাঁকা পথই হলো শয়তানের পথ, যা শয়তান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে থাকে। কিন্তু রহমান পর্যন্ত যাওয়ার পথ মাত্র একটি – তা হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীম। ধোঁকা, প্রতারণা এবং কুপথে পরিচালিত করা শয়তানের কর্ম। এ জন্যে সেও রহমানী রাস্তা ও ইসলামী পথ বলে থাকে এবং নিজের পথকে সেও ইসলামেরই বলে দাবি করে। এ কারণেই ইসলামে বহু ফের্কার আবির্ভাব ও মুসলিম সমাজ শতধাবিভক্ত হয়েছেন। তাই সত্য-সংবাদদাতা হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক আগেই বলেছিলেন:

وتفترق أمتي على ثلاث وسبعين ملة كلهم في النار إلا ملة واحدة، قالوا: من هي يا رسول الله؟ قال: ما أنا عليه وأصحابي (رواه الترمذي).

অর্থ: “আমার উম্মত ৭৩ দলবিভক্ত হবে। সব ফেরকাহ দোযখী হবে, কেবল একটি বেহেশতী দল ছাড়া।” সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ওই বেহেশতী দলটি কারা?” তিনি উত্তর দিলেন, “যার উপর আমি ও আমার আসহাব (প্রতিষ্ঠিত), (তারাই বেহেশতী)।” [তিরমিযী]

এ হাদীসের মর্মে উম্মত বলতে বোঝানো হয়েছে উম্মতে এজাবত (মানে যাঁরা নবী করীম ﷺ-এর ডাকে সাড়া দিয়েছেন); আর হাদীসে উক্ত ‘এফতেরাক’ (বিভক্তি)-এর মর্ম হচ্ছে মৌল বিষয় ও আকায়েদ তথা আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে এখতেলাফ/মতপার্থক্য। যেমন – হযরতে শায়খে মুহাক্কেক্কে মতলক্ব মওলানা আবদুল হক্ক মুহাদ্দিসে দেহেলভী (রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর কৃত – أشعة اللمعات – আশআতুল লুমআত (উজ্জ্বলতার রশ্মি) গ্রন্থে হাদীসটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন:

جدامی شوند امت من از اهلی كه ايمان اورده رو بقبله دارند بر هفتادرسه مذهب در اصول عقايد ـ الخ

অর্থ: যারা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান এনেছে, (অতঃপর) তাঁর (শেখানো) কলেমা পাঠ করে, ইসলামের দাবি করে এবং কেবলামুখী হয়ে নামাজ পড়ে, উক্ত আহলে কেবলা-বর্গ ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে। আকায়েদের বিভিন্নতা ও ইখতেলাফের দরুন তাদের মধ্যে ৭২ ফের্কা হবে পথভ্রষ্ট – যারা সবাই জাহান্নামী। শুধুমাত্র একটি ফের্কা/দল জান্নাতী। তাঁরাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-এর পদাঙ্ক অনুসারী এবং আকায়েদ ও আমলে তাঁদের অনুগামী। এঁরাই আহলে সু্ন্নাত ওয়াল জামা’আত। এতদ্ভিন্ন ৭২ ফের্কা নিজেদের বদ-আকীদার দরুন গোমরাহ ও জাহান্নামী। পথভ্রষ্ট লোকদের ৭২ দলের উৎপত্তি এভাবে যে, তারা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-মণ্ডলীর আকায়েদের খেলাফ নতুন নতুন আকীদা-বিশ্বাস বানিয়ে এবং দলাদলি করে দল-উপদল সৃষ্টি করেছে। যেমন – ওয়াসেল বিন আতা একটি নতুন আকীদা বানিয়েছিলো যে, কুফর/অবিশ্বাস ও ইসলামের মাঝখানে আরেকটি তৃতীয় স্তর আছে যা কুফরী নয়, আবার ঈমানও নয়। আর সে এ কথা হযরতে ইমামে খাজায়ে হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহি)-কে বল্লো এভাবে:

من ارتكب الكبيرة فهو ليس بمؤمن ولا كافر.

অর্থ: যে ব্যক্তি কবীরা গুনাহ করেছে, সে মু’মিন নয়, আবার কাফেরও নয়।

বস্তুতঃ ওয়াসেলের এরকম আকীদা ছিলো হুজূর আকদস (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-এর আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী। এ কারণে হযরত ইমাম হাসান বসরী (রহমতুল্লাহি আলাইহ) বলেন:

اعتزل عنّا

অর্থ: ওয়াসেল বিন আতা আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেলো।

(চলমান)

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment