লেখক: অধ্যক্ষ মওলানা মুহাম্মদ আবদুল করীম নঈমী
সম্পাদনা: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
এখানে একটি প্রতিবাদের উত্তর দেয়া নেহাত জরুরি। প্রতিবাদ বা আপত্তিটি এই যে, হাদীস মোবারকে উল্লেখিত হয়েছে, ‘আমার উম্মতের মধ্যে ৭২ ফেরকা হবে জাহান্নামী এবং এক ফেরকা হবে জান্নাতী।’ অথচ এ সকল ফের্কার প্রতি দৃকপাত করলে যারা আমাদের কাছে জাহান্নামী বলে প্রতিপন্ন হয়, তাদের সংখ্যা শতকও ছাড়িয়ে গেছে। উপরন্তু, আহলে সুন্নাত একক ফের্কা যাঁরা আমাদের দৃষ্টিতে জান্নাতী, তাঁদের মধ্যেও বিভিন্ন দল-উপদল দেখা যাচ্ছে – যেমন হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী। তদনুরূপ সূফীয়ায়ে কেরাম (রহ.) ও কালাম-শাস্ত্রবিদ উলামার মাঝেও বহু দলের অস্তিত্ব রয়েছে। অথচ এঁদেরকে আমরা সকলেই নাজী বা মুক্তিলাভকারী দল বলে থাকি। কিন্তু এই হাদীস শরীফ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে নাজী ফের্কা কেবল একটি।
এই আপত্তির উত্তর এ যে, হাদীসে পাকে ৭২ দোযখী ফের্কার মর্মে বোঝানো হয়েছে সে সব দলকে, যারা হলো কুফরী, ধর্মদ্রোহিতা, গোমরাহী/পথভ্রষ্টতা ও বে-দ্বীনীর উৎস – তথা গোড়া মূল। তেমনিভাবে এক নাজী ফের্কার মর্ম হলো সেই নাজাত লাভকারী দল, যাঁরা ইসলাম, ঈমান, হেদায়াত ও রহমতের উৎপত্তিস্থল ও মূল বুনিয়াদ। এ কথা সুস্পষ্ট যে, একটি বৃক্ষের গোড়া হতে কয়েকটি করে শাখা উদ্গত হয়, কিন্তু সেগুলোর উৎস-মূল হচ্ছে সেই গোড়া যা থেকে তাদের উৎপত্তি। শাখা-প্রশাখার আধিক্যে গোড়া একাধিক হওয়া অবধারিত হয় না। যেমন মনে করুন, একটি গোত্রের কয়েকটি করে খান্দান হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক খান্দানে হয় কয়েকটি করে পরিবার, আর প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে থাকে কয়েকজন করে সদস্য। তেমনিভাবে গোমরাহীর ৭২ শাখা ও গোমরাহীর ৭২ গোত্র হতে শত শত কী সহস্র সহস্র, বরং লাখ লাখ সংখ্যায়ও যদি শাখা, বংশ, পরিবার ও পরিবারভুক্ত লোক সৃষ্টি হতে থাকে, তবুও এতে লাযেম ও আবশ্যিক হয় না যে ওদের মূল গোত্রও ৭৩ সংখ্যানুপাতে হবে।
মুখতাসার/সংক্ষিপ্তসার এই যে, গোমরাহীর ৭২ গোড়া মূল হতে যেমন শত শত ও সহস্র সহস্র শাখা উৎপন্ন হয়েছে (যারা ফের্কাসমূহ বলে পরিগণিত), তেমনি হেদায়াতের এক মূল গোড়া থেকেও কয়েকটি শাখা বের হয়েছে। কিন্তু এ কথা স্মরণীয় যে, গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার প্রতিটি শাখা গোমরাহীতে পূর্ণ হবে এবং হেদায়াতের মূল গোড়া থেকে যেসব শাখা উদ্গত হবে, সেগুলো হেদায়াতরূপেই চূড়ান্তভাবে বিবেচিত হবে।
এ কারণেই আল্লাহতায়ালা কুর’আন মজীদে ঘোষণা করেছেন:
وَٱلَّذِينَ جَاهَدُواْ فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلْمُحْسِنِينَ.
অর্থ: যারা আমার (মানে আল্লাহর) পথে জিহাদ করলো (উক্ত জিহাদ হোক জান বা মাল দ্বারা, শারীরিক বা আর্থিক, ছোট/আসগর কিংবা বড়/আকবর জিহাদ) আমি তাদেরকে আপন পথসমূহের দিকে পরিচালিত করবো (মানে আমি তাদেরকে আপন পথসমূহ প্রদর্শন করবো)। [কুর’আন, ২৯/৬৯; লেখকের অনুবাদ]
এ পাক আয়াতে আল্লাহতায়ালা – سَبِيْلٌ – ‘পথ’ শব্দটির এক বচনের স্থলে – سُبُل – তথা বহবচনে ’পথসমূহ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তিনি এ কথা বলেন নি যে আমি তাদেরকে আমার আপন পথের দিকে পরিচালিত করবো, বরং তিনি বলেছেন, ‘আমি তাদেরকে আমার আপন পথসমূহের দিকে পরিচালিত করবো।’ এতে জানা গেলো যে, খোদার পথ একটি নয়, বরং একাধিক, আর এগুলোই হচ্ছে সে সমস্ত পথ যেগুলোর কেন্দ্র হলো ফের্কায়ে নাজীয়া – সওয়াদে আজম তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। যেমন হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী, চিশ্তী, কাদেরী, সুহরাওয়ার্দী, নকশবন্দী, মাতুরিদী, আশ’আরী প্রভৃতি হক্বপন্থী ফের্কা।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে এ মতবিরোধ ও এখতেলাফের যুগে নাজাত বা মুক্তি লাভের অবলম্বন হলো শুধু হাদীস মোবারক – عليكم بالسواد الأعظم – (অর্থ: তোমাদের প্রতি অত্যাবশ্যক বড় দলটির অনুসরণ) অনুযায়ী মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা বড় জামা’আত তথা আহলে সুন্নাতকে অপরিহার্য করে নেয়া এবং এই জামা’আত ছাড়া বাকি সমস্ত বাতিল ফের্কা যারা সুন্নী জামা’আতের বিরোধী ও দুশমন, তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া।
والله الموفق للهداية وهو الموصل إلى سبيل الرشاد.
অর্থ: আল্লাহই হেদায়াতের পথপ্রদর্শক এবং তিনি সঠিক পথে পরিচালিত করেন।
[সাপ্তাহিক ‘রেযায়ে মোস্তফা,’ গোজরানওয়ালা, পাকিস্তান; ২য় জিলদ্ – ২৩ নং সংখ্যা, ১৫ই আগস্ট, ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দ]