- প্রশ্নঃ জানাজা শেষে “লোকটি কেমন ছিলো” জিজ্ঞাসার উত্তরে “ভালো ছিলো” বললে কি মৃত ব্যক্তির কোন উপকার হয়?
===============📝==============
কৃতঃমুহাম্মদ ইমরান বিন বদরী
উত্তরঃ
নাহমাদুহু ওয়া নূসাল্লি ওয়া নুসাল্লিম আ’লা রাসুলিহীল কারীম।।আম্মা বা’দঃ-
কিছুদিন আগে করা এক ভাইয়ের প্রশ্নটির উত্তর লিখতে গিয়ে দেখলাম এই বিষয়টি নিয়ে আসলেই আমাদের সমাজে রয়েছে নানান বিতর্ক। কেউ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিলেও কেউ কেউ আবার এর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন। অনেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন ছূড়েদেন যে “কেন আমি একজন গুনাহগার ব্যক্তিকে ভালোর সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেবো”! ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আসলে সেই বিতর্কের কোন সমাধান কিংবা আলোচনা করে প্রজ্জ্বলিত করতে ইচ্ছুক নই বরং ক্ষুদ্রজ্ঞানে কয়েকটি কথাই বলছি এতে যদি কারো সামান্যতম উপকারও হয় সেটিই হবে অধমের পরম সার্থকতা। বক্রতাজনিত কারণে কারো বোধগম্য না হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আর্জি থাকলো।
🌓জন্ম মৃত্যু এটি সম্পূর্ণ মহান আল্লাহ পাকের দেয়া হায়াতের উপর নির্ভর করে। খোদাপ্রদত্ত হায়াতের পরিসমাপ্তি যে কবে হবে তা কারো জানা নেই। জন্মেছি যখন ভুবনে মরণের দরজা দিয়ে একদিন সবাইকে পার হতেই হবে। মৃত্যুর পর আমাদের জন্য পড়ে আছে অনন্তকাল, যে কালের কোনো পরিসমাপ্তি নেই।
মহান রাব্বুল আলামীন সূরা আলে ইমরানের ১৮৫ আয়াতে বলেন,
كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَما الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُورِ
অর্থাৎ, “প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়”।
উপরোক্ত আয়াতে কারিমায় মহাপরাক্রমশালী মালিক বলেন পার্থিব এই জীবনটি ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে এটাই প্রমাণিত যে এ জীবন শেষ নয় মরার পরেও অনন্তকালের একটি জীবন অপেক্ষমাণ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এ দুনিয়াবি জীবনটি ক্ষনস্থায়ী, এ জীবনকে স্থায়ী ভাবা ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। এছাড়াও আমাদের স্মরণ রাখা চাই দুনিয়া হচ্ছে পরকালের প্রস্তুতির পাঠশালা, যারা এখানে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরকালে প্রবেশ করবে তারাই বরং সফলকাম হবে। জীবন যেহেতু আমার তাই আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ এবং তার প্রিয় হাবিবের দেখিয়ে দেয়া পথেই পরিচালিত করতে হবে। যেহেতু ভালো আর মন্দের বিচারে ক্ষমতা আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন সেহেতু অমার্জিত বিচারের প্রতি সজাগ থাকা চাই। এর পরেও কোন মু’মিন বান্দা চাইবেনা কোন মুসলমান ভাই জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত আগুনে নিক্ষিপ্ত হোক। ঈমানের সহিত কালেমা পড়া প্রতিটি মুসলমান অন্তত এটা চাইবে যে কাল কিয়ামতের দিন বিচারের কাঠগড়া থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতিদের কাতারে শামিল হতে।
আসুন উম্মতের কাণ্ডারী রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস শরীফ দেখি, যেখানে গভীরভাবে চিন্তা করলে অনেক অজানা বিষয় চোখদর্পণে দেখা যাবে। আশাকরি এ হাদিস শরীফের একটি আমলই আমাদেরমত গুনাহগার বান্দার মুক্তির অন্যতম মাধ্যম হতে পারেন। একথা সত্য যে মৃত ব্যক্তির সমালোচনায় প্রকৃতপক্ষে আমাদের কারো কোন উপকারই হয়না। বরং আমরা একজন মুসলমান হিসেবে আরেক মুসলমানকে ক্ষমা করে উত্তম প্রশংসা করে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারি। আর আমাদের সেই উত্তম প্রশংসাই হতে পারে একজন মৃত মুসলমান ভাইয়ের শেষ ঠিকানা জান্নাতে।
আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহে ওয়াসাল্লাম এ গুনাহগার উম্মতের নাজাতের জন্য ইহ জগতের শেষ মুহূর্তেও –
‘রাব্বি হাবলী উম্মতি,রাব্বি হাবলী উম্মতি’
বলে বলে বিদায় নিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামিনও উম্মতে মুহাম্মদীর মুক্তির জন্য অনেক সুযোগ সুবিধার মাঝেও ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ মত রাত্রিও উপহার দিয়েছেন, যাতে গুনাহগার বান্দাগন ইবাদত করে গুনাহ মাফের মাধ্যমে পরকালের প্রস্তুতি নিতে পারেন। গুনাহ মাফের এতো এতো সুযোগ থাকার পরেও গুনাহগার উম্মতে মুহাম্মদীকে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহে ওসাল্লাম পৃথিবীতে মহান আল্লাহর দরবারে সাক্ষী করে দিলেন। এটা কিভাবে ?
রাসুলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«أنتم شهداء االله يفأرضه»
অর্থাৎ ”তোমরা জমীনে আল্লাহর সাক্ষী স্বরুপ”। সুবহানাল্লাহ!
মোটকথা, যে সাক্ষীদের সাক্ষীই হতে পারে আমাদের মত গুনাহগার বান্দাদের জন্য জান্নাত লাভের অন্যতম একটি উপায়। মৃত ব্যক্তির প্রশংসা করলে যে বান্দা আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যান সে সম্পর্কে হাদীস শরীফটি ইমাম নাসাঈ (রহ.) উনার সুনানে জানাজা অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন,
হজরত আনাস রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
“একটি জানাজা যেতে লাগলে তার উত্তম প্রশংসা করা হল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ওজাবাত) তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত হয়ে গেল। আর একটি জানাজা যাচ্ছিল, যার পাপের আলোচনা করা হচ্ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ওজাবাত) তার জন্য দোযখ সাব্যস্ত হয়ে গেল। তখন উমর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, আপনার উপর আমার মাতা-পিতা উৎসর্গ হোক; একটি জানাজা যাচ্ছিল যার ভাল প্রশংসা করা হল, আর আপনি বললেন যে, তার জন্য জানাত সাব্যস্ত হয়ে গেল। অন্য আর একটি জানাজা যাচ্ছিল তার পাপের আলোচনা করা হচ্ছিল আর আপনি বললেন যে, তার জন্য দোযখ সাব্যস্ত হয়ে গেল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা যার ভাল প্রশংসা কর তার জন্য জান্নাত সাব্যস্ত হয়ে যায় আর তোমরা যার পাপের আলোচনা কর তার জন্য দোযখ সাব্যস্ত হয়ে যায়। কারণ, তোমরা জমীনে আল্লাহর সাক্ষী স্বরুপ”।
প্রিয় পাঠক, এখন আপনিই বলুন মৃত ব্যক্তির প্রসঙ্গে আপনার ধারণাটা কেমন হওয়া উচিৎ। যার জানাজা পড়ে দোয়া করতে এসেছেন তাকে কিভাবে আপনি সমালোচনার মুখে নিক্ষিপ্ত করবেন! উল্লেখিত হাদিসের আলোকে স্পষ্ট বলতে পারি যে উম্মতে মুহাম্মদির প্রশংসার কারনে আল্লাহ পাক চাইলে একজন গুনাহগার বান্দাকেও জান্নাতের অধিকারী করতে সাহায্য করেন। সুতরাং জানাজার পর কেউ জিজ্ঞেস করলে আপনিই সিদ্ধান্ত নিন কেমন উত্তর দিবেন।
🌓 এছাড়াও অন্যত্রে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ايّما مسلم،شهد له اربعة بخير،ادخله اللّٰه الجنة
অর্থাৎ, চারজন মুমিন ব্যক্তি যদি একজন মুসলমানকে ভালো বলে সাক্ষ দেয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। বর্ণনাকারী বলেন, যদি তিনজন হয়? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন তাহলেও। যদি এতে দুজন হয়? রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তাহলেও। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন এরপরে একজনের ব্যপারে আমি আর প্রশ্নও করিনি।
(কিতাবুল জানাইয- সহিহ বুখারী)।
আসুন, ইসলামের রাহে উম্মতে মুহাম্মদীর মুক্তির পথ উম্মুক্ত করি। গুনাহমুক্ত জীবন গড়ার তাওফিক আল্লাহ আমাদের সবাইকে দান করুন। আমিন।