মূল আয়াত ঃ ………………….
সরল অর্থ ঃ ১৬১. নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে এবং কুফরী অবস্থায়ই মৃতু্যবরণ করেছে তাদের উপর আল্লাহ, ফিরিস্তা এবং সকল মানুষের লা’নত। ১৬২. তারা চিরকাল লা’নত অবস্থায় থাকবে। তাদের আযাব লাঘব করা হবে না এবং তাদের সময়ও দেয়া হবে না।
বর্ণনার ধারাবাহিকতা ঃ
পূর্ব আয়াতে সত্য গোপনকারী ইয়াহুদীদের ওপর লা’নতের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্তমান আয়াতে বলা হচ্ছে, এই লা’নত শুধু শিক্ষিত লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং তাদের কুপরামর্শে যারাই ফাঁদে পড়ে কুফরী করে ঐ অবস্থায়ই মৃতু্যবরণ করেছে তারাও লা’নতের উপযুক্ত হবে।
খোলাসা তাফসীরঃ
অত্র আয়াতে পাকে কুফরীর মধ্যে কোন শ্রেণীভেদ না করে সমস্ত কাফেরদের জন্য লা’নতের কথা বলেছেন। কুফরী হলো তৌহিদ ও রিসালাত অবিশ্বাস করা। রিসালাতের যুগ না পেলে শুধু তৌহিদ হবে ঈমানের মাপকাঠি ফিতরাতের যুগে (৩০০ খৃষ্টাব্দ হতে ৬১০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত) যারা নবীর যুগ পায়নি তাদের বলা হয় আহলে ফিতরাত। এদের মধ্যে যারা তৌহিদে বিশ্বাস থেকে মারা গিয়েছে তারা জান্নাতি। ৬১০ খৃষ্টাব্দের পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর রিসালাতের উপর ঈমান না এনে মারা গিয়েছে তারা সবাই জাহান্নামী চাই সে পাদ্রী হোক বা সাধারণ লোক হোক।
এমতাবস্থায়, যারা মৃতু্যবরণ করেছে- তারাই জাহান্নামী। তাদের উপর হামেশা আল্লাহর ফিরিস্তাদের এবং সাধারণ মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হতে থাকবে। লা’নতের মধ্যে কোন বিরতি হবে না। কবর থেকে আরম্ভ করে দোযখ
পর্যন্ত এই লা’নত হতেই থাকবে। আল্লাহ তাদের সাথে ৫ বার কথা বলে কথাও বন্ধ করে দিবেন। তারই ইঙ্গিত রয়েছে পবিত্র কোরআনে। তাদের বলা হবে “জাহান্নামী ধিকৃত অবস্থায় তোমরা পড়ে থাকো অমার সাথে আর কখনও কথা বলবে না।” মানুষের মধ্যে যারা জান্নাতী হবে তারা তো লা’নত করবেই- এমনকি পণ্ডিতদের দ্বারা বিভ্রান্ত অবশ্য কাফেরগণও তাদের নেতাদের প্রতি ধিক্কার জানাবে। তাদের আযাব সমান তালে চলতে থাকবে। বিরতি কিংবা হালকা হবে না। তাদের কোন সময়সুযোগও দেয়া হবে না। অতএব বিবেকবানদের উচিত কুফরী না করা এবং মৃতু্যর পূর্বে হলেও তাওবা করে মুসলমান হয়ে যাওয়া এই আয়াতের সারমর্ম।
শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১. সারাজীবন কুফরী করেও যদি মৃতু্যর পূর্বমূহুর্তে ঈমান আনে, তাহলেও অতীতের সব গুনাহ মাফ।
২. জীবনের নিশ্চয়তা নেই। তাই সব সময় তাওবার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে।
৩. কারো কুফুরী সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে তাকে কাফের বলা অথবা তার ওপর লা’নত করা অনুচিত। সুতরাং খাজা আবু তালেব যদিওবা প্রকাশ্যভাবে মুসলমান ছিলেন না, কিন্তু নবীজীর অ্রতি প্রিয় চাচা ছিলেন। তাই নবীজীর খাতিরে তাঁকে কাফির বলা বা তার উপর লা’নত করা জায়েয নয়। অনেকেই আবু তালেবকে নীরব মুমিন বলেছেন।
৪. নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পিতা-মাতা প্রথমে হানিফ অবস্থায় মৃতু্যবরণ করেছেন। পরে নবীজীর খাতিরে তাদের জীবিত করে পুনরায় ইসলাম
গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং সাহাবীর অন্তভর্ূক্ত করা হয়েছে (শামী)।
কিছু প্রশ্ন ও জবাবঃ
সামান্য কয়েকদিন কুফরীর বিনিময়ে চিরস্থায়ী শাস্তির ব্যবস্থা হলো কেন? যতদিন কুফরী করেছে ততদিন শাস্তি দেয়া সঙ্গত ছিলো।
উত্তরঃ একই প্রশ্ন জান্নাতীদের বেলাও তো প্রযোজ্য। কয়েকদিন ঈমানের বিনিময়ে তাদের চিরস্থায়ী জান্নাত দেওয়া হবে কেন? এটা বাজে তর্ক।
২. ৫৯৫ আয়াতে বুঝা যাচ্ছে- কাফেরদের আযাব হাল্কা হবে না। কিন্তু আবু লাহাবের কবরের আযাব তো প্রতি সোমবারে হালকা থাকে। উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য কিভাবে হতে পারে?
উত্তরঃ আযাব হালকা হওয়ার অর্থ হলো প্রথমে শক্ত আযাব পরে হালকা আযাব। আবু লাহাবের ব্যাপারটি অন্য রকম। শুরু থেকেই তার আযাব প্রতি সোমবারে হালকা ছিলো এবং ভবিষ্যতেও একই রকম থাকবে। হাতেমতাঈ এবং আবু তালেবের আযাব সব সময়ই হালকা থাকবে। কখনও হালকা কখনও ভারী এমন হবে না। সুতরাং উভয় ঘটনার মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
প্রশ্নঃ আয়াতে বলা হয়েছে কাফেরদের উপর সব মানুষের লা’নত। এটা কি করে সম্ভব? এক কাফের কি অন্য কাফেরকে খারাপ বলতে বা লা’নত দিতে পারে?
উত্তরঃ হাশরের দিনে অধঃস্তন কাফেরগণ ঊধর্্বতন কাফেরদের লা’নত দিয়ে বলবে- তোমাদের উপর লা’নত। তোমাদের কারণে আজ আমাদের এই দশা। সুতরাং বড় কাফেরগণ মোমিন-কাফের নির্বিশেষে সবার লা’নতের পাত্র হবে।
প্রশ্নঃ ইয়াজিদ হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতে খুশি হয়েছিলো। সুতরাং সেও কাফের এবং লা’নতের উপযুক্ত।
উত্তর ঃ নবীকে শহীদ করলে কাফের হয়ে যায়। অন্যকে শহীদ করলে কবিরা গুনাহে গুনাহগার হয়। ইয়াজীদ মারাত্মক গুনাগার ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার কুফরী নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি। তাই নাম ধরে তাকে কাফের বলতে ফোকাহায়ে কেরাম নিশ্চিত হতে পারে নি। তবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম গায্যালী ও ইমাম সুয়ূতি তাকে লা’নাতুল্লাহ বলার উপর একমত্য পোষণ করেছেন। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল। ভক্তির ক্ষেত্রে একরকম কিন্তু আদলতের বিষয় অন্যরকম। আদালত এ ব্যাপারে বিব্রত। ইমাম হোসাইনের মহব্বতে ইয়াজিদকে কাফের বলতে মন চায়। কিন্তু আদালতে তা প্রমাণ করা কার্যকর।
মূল আয়াতঃ ………………
সরল অর্থ ঃ ১৬৩. তোমাদের উপাস্য একজনই। তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি সবার জন্য দয়ালু এবং খাস মেহেরবাণ।
বর্ণনার ধারাবাহিকতা ঃ
পূর্ব আয়াতে বলা হয়েছে কাফেরদের শাস্তি চিরস্থায়ী হবে। এক আয়াতে তার প্রমাণস্বরূপ বলা হচ্ছে স্রষ্টা ও উপাস্য একজন। তাই অন্য কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না। পূর্ব আয়াতে তাঁর গযবের কথা বলা হয়েছে। অত্র আয়াতে রহমতের কথা বলা হচ্ছে। তিনি অবাধ্যকে গযবদাতা এবং বাধ্যদের রহমতদাতা। যারাই তাকে মাবুদ মানবে তারাই রহমতের অধিকারী হবে।
শানে নুযুলঃ
একবার কাফেরগণ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর কাছে আল্লাহর গুণাবলী জানতে চায়। অত্র আয়াত নাযিল হয়, এরকম তিনটি গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়। ১. ইলাহ, ২. রাহমান, ৩. রাহীম। এই তিনটি সিফাতি নাম নিয়েই তিনি সূরা ফাতেহা শুরু
করেছেন। রাহমান, রাহীম, মালিক ও মাবুদ
এগুলোই ইসলামের শিক্ষা।
খোলাসা তাফসীর ঃ
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, হে বিশ্ববাসী! তোমরা মনগড়া মাবুদের পুজা করছো কেন? তোমাদের মাবুদ ও ইলাহ তো একজনই। সুতরাং তারই ইবাদত করা কর্তব্য। এটার নামই ইসলাম। তিনিই তোমাদের ইহকাল ও পরকালে দয়া বর্ষণ করছেন এবং করবেন। সুতরাং যার খাও তাঁরই গুণ গাও।
শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১. আল্লাহর গযবের চেয়ে রহমত বেশি। তাই বিসমিল্লাহর শুরুতে এবং সূরা ফাতেহার শুরুতে রব, রহমান ও রাহীম নামের উল্লেখ করেছেন। তিনিই মূল রহমত ওয়ালা। নূরে মোহাম্মদী তার ফয়েজপ্রাপ্ত। ঐ নূরে মোহাম্মদীর মাধ্যমেই তিনি আপন ফয়েজ অন্যত্র বণ্টন করেন। যেমন আলোর ফয়েজ বিতরণ করেন সূর্য, চন্দ্র ও তারকার মাধ্যমে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন “আল্লাহু ইউতি, ওয়া আনাল কাছিমু?- অর্থাৎ আল্লাহ হলেন মূলদাতা এবং আমি হলাম তার বণ্টনকারী। (বুখারী) সুতরাং বণ্টনকরীর কাছে না গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না।
২. রাহমান ও রাহীম হলো মূল সিফাত। জাব্বার ও কাহ্হার হলো আমাদের গুনাহের কারণে। কারণ, দেখা দিলেই জাব্বারী কাহ্হারী সিফাতের বিকাশ হয় নতুবা নয়। মোটকথা_ রাহমান ও রাহীম স্থায়ী গুণ এবং জব্বার ও কাহ্হার ব্যবহারিক গুণ।
৩. কাফেরের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছানোর সময় আল্লাহর রাহমান ও রাহীম সিফাতের উল্লেখ করতে হবে।
সুফীগণের তাফসীর ঃ
আল্লাহ হলেন চির অস্থিত্ববান (মউজুদ) আর সব ক্ষণস্থায়ী এবং তাঁরই প্রতিবিম্ব এবং অনস্তিত্বস্বরূপ। ছায়াকে কায়া মনে করা ভুল। সুতরাং দুনিয়ার বাতিল ও উপাস্যেল কানাকড়ি মূল্যও
পারবে না। সুতরাং তাদের ইবাদত ও পূজা করার অর্থ নিজেকে বরবাদ করা।
২১ রুকু শুরু
মূল আয়াতঃ …………….
সরল অর্থ ঃ ১৬৪. “নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টি কৌশলে রাত ও দিনের বিবির্তনের এবং সাগরে নৌকাসহ মানুষের উপকারী বস্তু নিয়ে চলাচলের মাধ্যমে মৃত যমীনকে পুরুজ্জীবিত করার মধ্যে, জমীনের জীব-জন্তু ছড়িয়ে দেয়ার মধ্যে, আবহাওয়ার চক্করের মধ্যে এবং তাঁর হুকুমের অধীন মেঘমালা আসমান যমীনের মধ্যখানে চলাচলের মধ্যে রয়েছে জ্ঞানী লোকদের জন্য মহা নিদর্শন।”
বর্ণনার ধারাবাহিকতা ঃ ১৬৩ আয়াতে আল্লাহর একত্ববাদ ও রাহমান রাহীমের উল্লেখ ছিলো। বর্তমান আয়াতে তৌহিদ ও রহমতের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুতরাং ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে।
শানে নুযুল ঃ মক্কার মুশরিকগণ তৌহিদ বা এক আল্লাহর আয়াত শুনে বলাবলি করতে লাগলো এত বড় দুনিয়া এক আল্লাহ কি করে শামাল দেন। এটা তো আমাদের বুঝে আসে না। তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর কাছে এর শক্ত প্রমাণ দাবি করলো। তাদের জবাবে অত্র আয়াত নাযিল হয়। এতে বলা হয়, এত বড় দুনিয়া দেখে এক আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের বিবেকে ধরেনি। যেমন গ্রাম্য লোক রেলগাড়ি দেখে বলে থাকে এক ইঞ্জিন শত শত বগী ধরে টেনে নিতে পারে? তাদের বিশ্বাস ছিলো স্রষ্টা হলেন শুধু সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু
পরিচালনা করার অন্যান্য শরিক রেখেছেন। তারাই মূলতঃ বিভাগীয় পরিচালক।
খোলাসা তাফসীরঃ এক আয়াতে আল্লাহর ৮টি কুদরতি নিদর্শন রয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন যাদের বুদ্ধি আছে তারা নিশ্চয়ই বুঝতে সক্ষম হবে যে, এগুলোর পরিচালক একজন। তিনি আল্লাহ। এই ৮টি নিদর্শন হলো_ ১. আসমান
যমীন সৃষ্টি, ২. দিন রাতের পরিবর্তন, ৩. সাগরে নৌকা স্টিমারের চলাচল, ৪. আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ, ৫. শুষ্ক যমীন বৃষ্টি পেয়ে পুনরায় উর্বরা হওয়া, ৬. পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর বিচরণ, ৭, হাওয়ার চক্কর ও ৮. আসমান যমীনের বিশালত্ব। আকাশে ফিরিস্তাদের বাসস্থান খোদার কুদরতের নিশানা। যমীনে পাহাড় পর্বত, মাটির স্তরে স্তরে পানি প্রাণীকুলের বিচরণ, বিরাট বিরাট বনভূমি, সাগর ও মহাসাগরের অথৈ পানি এগুলোও একক স্রষ্টার প্রমাণবহ। যমীনের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোথাও ধান, কোথাও গম, কোথাও খেজুর, আবার কোথাও ফসলবিহীন বিরাণভূমি। কোথাও কয়লার খনি, কোথাও তেলের খনি, কোথাও লোহার খনি কোথাও গ্যাসের খনি লুকায়িত অবস্থায় রয়েছে। এই যমীনের মাটি দিয়ে হযরত আদম (আঃ) এর দেহ তৈরি। এই যমীনেই আওলাদে আদমের আবাদী, এই যমীনেই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর রওযা যা আরশ হতেও উত্তম। যমীন একটি, কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন।
দিবারাত্রি ঃ
দিবারাত্রির বৈশিষ্ট্যও পৃথক পৃথক। দিন হলো আলোময়। রাত হলো অন্ধকারময়। দিনে গরম, রাতে শীত। একটি আরেকটির বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও শীতকালে দিন তার কিছু অংশ রাতের জন্য ছেড়ে দেয়। আবার গরমকালে রাত কিছু অংশ দিনের জন্য ছেড়ে দেয়। কোথাও ছয় মাস একাধারে দিন এবং ছয় মাস একাধারে রাত। তারা খোদার বান্দাদের খেদমতে নিয়োজিত। রাত বান্দাকে ঘুম পাড়িয়ে মউতের নমুনা দেখায়। দিন সবাইকে সজাগ করে পুনরুত্থানের নমুনা দেখায়। মউত এবং পুনরুত্থানের দুটি দৃষ্টান্ত দিন রাত অহরহ দেখাচ্ছে যেন বান্দারা বুঝতে পারে মৃতু্যর পর তাদের পুনরুত্থান
হবে। এসব করা কি আল্লাহ ছাড়া অন্যের পক্ষে সম্ভব?
সাগরে ভারী জিনিস ডুবে যায়। কিন্তু কোথাও কোথাও স্টিমার বরং সাঁতার কাটে। লক্ষ লক্ষ মণ মাল নিয়ে পানির উপর দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করে। পৃথিবীতে উৎপন্ন দ্রব্যাদি এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার বড় মাধ্যম হলো সাগর ও স্টিমার। ভারত থেকে খাদ্যদ্রব্য আরবে যায়। আবার আরব থেকে খেজুর ভারতে আসে সাগরের মধ্য দিয়ে। এটাও আল্লাহর কুদরত।
বৃষ্টিঃ সাগরের এক অংশ লবণাক্ত, অন্য অংশে মিঠা পানি। একটি আরেকটির সাথে মিশানো। এই সাগরের লোনা পানি জলীয় বাষ্প হয়ে আকশে উড়ে যায় এবং মিষ্টি পানি হয়ে যমীনে, ক্ষেতে, গাছে পতিত হয়ে সবুজ করে তোলে। এই বৃষ্টির পা্িনই পাহাড় হতে নেমে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী বেয়ে মিষ্টি পানি যোগায় এবং পলি মাটি একস্থান হতে অন্য স্থানে বহন করে নিয়ে যায়। এটা আল্লাহর বিরাট কুদরতের নিদর্শন।
হাওয়া ও বাতাসের চক্কর ঃ বায়ু ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। উত্তরের হাওয়ায় ঠাণ্ডা, দক্ষিণের হাওয়ায় গরম। এই বায়ু আবার গযবী আকার ধারণ করে মানুষকে ধ্বংস করে। মাতৃগর্ভে বহু স্তর ভেদ করে বায়ু প্রবেশ করে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চার করে। আবার এই শিশুই জন্ম হয়ে যদি নাকে কাপড় রাখে, তাহলে বায়ু নাকে প্রবেশ করতে পারে না। বায়ুর বহুগুণ রয়েছে। ফুল বাগানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুগন্ধি চতুর্দিকে ছড়ায় আবার পায়খানার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। গাছের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অঙ্েিজন মানুষের জন্য সরবরাহ করে। আবার বিষাক্ত প্রাণীর মুখে লেগে বিষ ছড়িয়ে মানুষ ধ্বংস করে। এই বায়ু বুযুর্গের মুখ থেকে বের হয়ে রোগী ভাল করে। জিবরাঈলের মুখ থেকে বায়ু বের হয়ে বিবি মরিয়মের গর্ভে গিয়ে ঈসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ
করেন। ইসরাফিলের মুখ থেকে বের হয়ে দুনিয়া ধ্বংস করে।
বাদল বা মেঘমালাঃ সাগর হতে উত্থিত জলবায়ু শূন্যে লটকিয়ে থাকে এবং সময়মতো বৃষ্টি আকারে যমীনে পড়ে শস্য উৎপাদন করে। বিনা ভাণ্ডারে পানি সংরক্ষণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিন্তু স্রষ্টার পক্ষে অতি সহজ। এই পানি হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়। সময়মতো জমাট হয়ে শিলা আকারে পতিত হয়ে ঘরবাড়ি, গাছ-পালা ও ফসলাদির নষ্ট করে। এই বৃষ্টির মধ্যে বিদু্যৎ সৃষ্টি হয় এবং যমীনে পতিত হলে যমীনের উর্বরা বাড়ায়। লোহায় ও কষ্টিক পাথরে পড়লে মূল্যবান এনার্জি সৃষ্টি করে। এসবের পিছনে কি গোপন শক্তি কাজ করছে না? এগুলো উপলব্ধি করে কারা? যারা বিবেকবান তারাই। বিবেক খরচ করলে অতি সহজেই বুঝা যায় একজন পরিচালক আছেন। তিনিই আল্লাহ।
শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১. ভূগোল বিদ্যা এবং আকাশ বিদ্যা শিক্ষা করা উত্তম এই শর্তে যে, আল্লাহর অসীম’ ‘কুদরত সম্পর্কে এর মাধ্যমে ভাল করে জানা যাবে।
২. আল্লাহর কুদরতের নিদর্শণ অনেক রয়েছে। তন্মধ্যে এই আটটি হলো কুদরত এবং রহমতের নিদর্শন।
৩. সবচেয়ে বড় নেয়ামত আকল বুদ্ধি ও জ্ঞান। কেননা, জ্ঞানের মাধ্যমেই আল্লাহর কুদরত অনুধাবন করা যায়। এজন্যই নেয়ামতের কথা উল্লেখ করার পর জ্ঞান ও আকলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল আয়াতঃ …………….
সরল অর্থ ঃ ১৬৫. এমন কিছু লোক রয়েছে- যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে উপাস্য বানিয়ে নেয়। তাঁরা এদের আল্লাহর মতোই ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে তাদের অন্তরে রয়েছে আল্লাহর প্রতি কঠোর ভালবাসা। আর এই যালেমরা যদি ঐ সময়টি দেখতে পেতো যখন তাদের সামনে এসে উপস্থিত হবে তথন সত্যিই
উপলব্ধি করতো যে, শক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং আল্লাহই কঠোর শাস্তিদাতা।
এতক্ষণ বর্ণনা ছিলো আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর রহমতের বর্ণনা। এখন বর্ণনা করা হচ্ছে মুশরিকদের অবাধ্যতা ও আযাবের কথা। আর এখানে ওরা যদি ঐ সময়টি দেখতো যখন তাদের সামনে আযাব এসে উপস্থিত হবে তখন তারা বুঝতে পারতো নিশ্চয়ই সমস্ত শক্তির মালিক আল্লাহ এবং আল্লাহই একমাত্র কঠিন দাতা ।
খোলাসা তাফসীরঃ
যারা আল্লাহর নিদর্শনাদি দেখা সত্ত্বেও তাকে না মেনে আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপসনা করে তারা মুশরিক। কেউ মূর্তি পূজা করে, কেউ মানুষ পূজা করে, কেউ চন্দ্র সূর্য পূজা করে, কেউ তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা করে। তার ঐসব মিথ্যা উপাস্যকে আল্লাহর ন্যায়ই ভালবাসে কিন্তু মোমিনরা আল্লহকে ভালবাসে গভীরভাবে। আল্লাহর হুকুমের অনুগামী তারা। তারা শিরক করে না। আর যারা শিরক করে তাদের আত্মার উপরই তারা জুলুম করে। এই শিরকের শাস্তি হবে পরকালে। এখন যদি দেখতে পেতো তাহলে বুঝতে পারতো ঐ শাস্তি কত কঠিন। ঐ দিন কারো কাছেই কোন শক্তি থাকবে না তাদের বাঁচানোর জন্য। সবাই সেদিন এক আল্লাহর কাছে অসহায়ের মতো হয়ে যাবে। বানোয়াট উপাস্যরা সেদিন কোন সাহায্যই করতে পারবে না। তাদের উপাসনাকারীদের জন্য। সুতরাং উপাস্য ও উপাসনাকারী সবাই সেদিন আযাব ভোগ করবে এবং জান্নাত থেকে বঞ্চিত থাকবে।
অত্র আয়াতে মুমিন ও মুশরিকদের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। মুশরিকরা তাদের উপাস্য মূর্তি ও দেবদেবীকে আল্লাহর মতোই ভালবাসে। কিন্তু এই নিবের্াধেরা জানে না যে, যখন আযাব শুরু হবে তখন কেউ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। উপাস্য দেবদেরীরাও সেদিন আযাবে পতিত হবে। অপরদিকে মুমিনগণ এক আল্লাহকে
ভালবাসে। তাদের এই ভালবাসা নিখাদ ও নির্ভেজাল। তাদের ভালবাসা একক ও অখণ্ডিত। অপরদিকে মুশরিকদের ভালবাসা এক হতে পারে না। কাফেরদের ভালবাসা হলো মনগড়া। মুসলমানদের ভালবাসা হলো নবীর শিক্ষার মাধ্যমে। মুমিনরা আল্লাহকে ভালবাসে নিঃস্বার্থে। দেবদেবীকে বর্জন করে। মুসলমানরা সুখে দুঃখে এক আল্লাহর উপর ভরসা করে। আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা অত্যন্ত শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
মুশরিকরা শিরক করে এজন্য যে, আল্লাহ এবং পরকাল সম্পর্কে তারা একেবারেই অজ্ঞ ও অন্ধকারে পতিত। এরা এমন অজ্ঞ যে, আল্লাহর নিদর্শন দেখেও এরা পরিচালকের পরিচয় জানতে পারে না। আল্লাহর শাস্তি বড় কঠিন। একথা তাদের দেবীরাই জানেনা, তাদের জানাবে কোত্থেকে?
অপরদিকে মুসলমানরা জানে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মাধ্যমে যিনি আল্লাহর প্রতিনিধি। কাফেরগণ যদি নবীর স্পর্শে আসতো তাহলে কখনও শিরক করতে পারতো না।
শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১. আল্লাহর যাত, সিফাত ও কর্ম সৃষ্টি কারোর মত নয়। তিনি একক, মৌলিকগুণের অধিকারী এবং তাঁর কর্ম হলো অন্যের বিনা সাহায্যে। যারা অন্যকে আল্লাহর মত মৌলিক যাত, মৌলিক সিফাত মানবে তারা কাফের। আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নয়।
২. আল্লাহর প্রতি মহব্বত হলো মৌলিক। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর প্রতি মহব্বত হলো বিবেক প্রসূত ও প্রাকৃতিক। পৃথিবীর পিতা-মাতা, সন্তানাদি এবং সকল মানুষ থেকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বেশি ভাল না বাসলে মুমিন হওয়া যায় না বলে হাদীসে প্রমাণ। সুতরাং ইবাদতে আল্লাহ একক এবং মহব্বতে নবী
করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বপূর্ণস্থানের অধিকারী। নবীর প্রেমই আল্লাহর প্রেম বলে গণ্য। নবীর প্রেমের মধ্যেই আল্লাহর প্রেম নিহিত।
৩. অজ্ঞতাই শিরকের মূল। মুশরিকরা খোদা সমপর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
প্রশ্ন ও উত্তরঃ
১. দেওবন্দীরা অভিযোগ করে বলে সুন্নীরা অলি এবং নবীকে ভালবাসতে বাসতে খোদার উপরে নিয়ে যায়। তাঁদের হাজত পূরণকারী মনে করে। সুতরাং মুশরিক এবং সুন্নীদের মধ্যে পার্থক্য নেই।
উত্তরঃ আমরা নবীকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসি আল্লাহর হুকুম পালনের এবং তাঁকে পাওয়ার জন্য। আল্লাহ বলেন, “হে প্রিয় রাসূল! বলুন তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসতে চাও তাহলে প্রথমে আমাকে ভালবাসো এবং আমার অনুসরণ করো। আমরা নবী ও অলিগণকে নেক মকসুদ পূরণকারী হিসেবে এভাবে মানি যেভাবে দেওবন্দীরা চামড়ার মকসুদ পূরণের জন্য ধনীদের তাবত মকসুদ পূরণকারী হিসেবে মানে। ধনীদের টাকা-পয়সা তাদের মকসুদ পূরণ করে, ডাক্তার তাদের রোগ ভাল করে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন “তোমরা মকসুদ পূরণের জন্য উজ্জ্বল নূরানী চেহারা বিশিষ্ট অলিগণের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো (তাবরানীর মোজামে কবীর)।
২. আমরা পিতা-মাতাকে মহব্বত করি। পিতা-মাতাও আমাদেরকে মহব্বত করেন। আল্লাহ ছাড়া অন্যকে মহব্বত করা যদি শিরক হয় তাহলে মুসলমান থাকবে কই?
উত্তরঃ মুহব্বত চার প্রকার ঃ (ক) ঈমানী মুহব্বত, একমাত্র আল্লাহ ও রাসূলের জন্য খাস।
(খ) সাওয়াবের মুহব্বত ঃ পিতা-মাতা, পীর, ওস্তাদ ও বুযুর্গানে দ্বীনের মুহব্বত।
(গ) মুহব্বতে ফিতরী ঃ সন্তানাদি ও স্ত্রী-পুত্র বা বন্ধু-বান্ধবের মুহব্বত। এতে সাওয়াবও নেই গুনাহ নেই। এটা প্রকৃতিগত ও সামাজিক মুহব্বত।
(ঘ) দেব-দেবী ও মূর্তির মুহব্বত ঃ এ প্রকারের মুহব্বত কুফরী। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৩. কেউ কেউ বলে ……… এর মধ্যে মানুষ অর্থ সব মানুষ এবং …………. এর মধ্যে বুযুর্গও শামিল। অর্থাৎ যে কোন মানুষ আল্লাহ ছাড়া যে কোন পীর ফকিরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানায় তারাই মুশরিক। …….. অর্থ মকসুদ পূরণকারী। আল্লাহ ছাড়া অন্যকে মকসুদ পূরণকারী মনে করাই শিরক।
উত্তরঃ অত্র আয়াতের শানে নুযুল হলো মুশরিকদের বেলায়। তারা খোদার বিপরীতে দেব-দেবী ও মূর্তিগুলোকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসতো। অতএব আয়াতকে মুসলমানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা শানে নুযুলের খেলাফ। তদুপরি ঐ যুগ ছিলো সাহাবীর যুগ। যদি …………. অর্থ সব মানুষ হয় তাহলে বলুন সাহাবীগণ কোন পীর ফকিরকে খোদার ন্যায় ভালবাসতো। অন্যের কাছে সাহায্য চাইলেই যদি মুশরিক হয়ে যায় তাহলে হাকিম আদালতের শরণাপন্ন হওয়াও শিরক হবে। যারা আপত্তি করে তাদেরও আদালতের সাহায্য নিতে হয়। তাহলে তারাই বড় মুশরিক।