আমাদের পরিবার মোটামুটি ধর্মভীরু বলা চলে। খুব কড়াকড়ি নাথাকলেও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলা হয়। বিশেষ করে রোজার মাসটাকে উৎসব মুখর বলেই মনে হত। আকাশে বাতাসে ঘরের আঙিনায় রোজার আমেজ ছড়ানো থাকতো। আমি অল্প বয়সেই রোজা রাখা শিখেছি। রোজা রাখা খুব গর্বের কাজ বলে মনে করতাম। সমবয়সী মহলে গণনা চলতো কে কয়টা রোজা রাখতো। কিছু কিছু মুরুব্বী ছিলো আরেক কাঠি সরেস। তারা আমাদের বয়সী কাউকে দেখলেই ডেকে জিজ্ঞেস করতো আজ কয়টা রোজা হলো।
গার্ডিয়ানরা অনেকসময় চাইতো না যে আমরা রোজা রাখি। কত কি বুঝ দিত। পাশের বাসার খালাম্মা শিখিয়ে দিত যে রোজা রেখে গলা শুকিয়ে গেলে পুকুরে নেমে ডুব মেরে পানি খেলে কিচ্ছু হবে না। কেউ তো আর দেখতে পাচ্ছে না। আবার খুব বেশী খিদে লাগলে ঘরে দরজা লাগিয়ে চুপিচুপি ভাত খেয়ে নিলেই হলো। কেদেখতে যাচ্ছে।কে শুনতো কার কথা।
আমি তখন সহি শুদ্ধভাবে রোজা রাখায় ব্যস্ত। মুখে থুতু জমুক আর নাই জমুক থু থু করে থুতু ফেলে রোজার বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সদা সচেষ্টা থাকতাম। ওদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। আছরের পর সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। কিছুতেই আর এই সময়টুকু পেরোতে চায় না। মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। পায়ে গায়ে বল পাইনা। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকি। আম্মা বকা দেন। এত কষ্ট করে রোজা রাখারকি দরকার!
রোজা রাখার কি দরকার মানে! একটা রোজা না রাখলে যে পরে ষাইটটা রোজা রাখতে হবে। ওদিকে নামাজ না পড়লে যে দুই কোটি অষ্ট আশি লক্ষ বছরদোযখে পুড়তে হবে সেই হিসেব কিন্তু আর মনে থাকেনা। সেক্ষেত্রে আমি অংকে বড়ই কাঁচা। আম্মা বারবার জিজ্ঞেস করেন নামাজ পড়তে এত কিসের কষ্ট হয়!
নানী আমার মত বেনামাজী রোজাদারদেরকে বলে বাঁদুরে রোজাদার। বাঁদুর পাখি যেমন এক সন্ধ্যায় সেহেরী খায় আর অন্য সন্ধ্যায় ইফতারী করে। মাঝখানে নামাজ লাগেনা। শুধু গাছের ডালে উলটো হয়ে ঘুমায়। আমরাও নাকি বাঁদুরের মত। সন্ধ্যায় মসজিদ থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আজান বড়ই সুমধুর হয়ে কানে এসে আঘাত করে। হাপুস হুপুস ওযু সেরে এসে ইফতারীর সামনে বসে যাই। আব্বু মিলিয়ে দেখেন ঠিকমত ওযু করেছি কিনা। কপালের সব অংশ ভিজেছে কিনা। আযান হওয়ার সাথে সাথে ইফতারীর উপর হামলে পড়ি।
আম্মা বলেন পরদিন রোজা থাকার দরকার নেই। আমি গাল ফুলাই। সেহেরিতে ডাকেন না। সকালে উঠে পারলে তো কেঁদে ফেলি অবস্থা। আমার একটা বাজে রোগ আছে। অল্প কিছুতেই চোখ ছলছল করে। আম্মা আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য ভাত ঢেকে রেখেছেন। সকালে রাগ করে ভাত খাইনা। অবশ্য দুপুর না আসতেই রাগ শীতল হয়ে যায়। আস্তে আস্তে গিয়ে প্লেট নিয়ে খেতে বসি। আম্মা টের পেলেও কিছু বলেন না। তখন কিন্তু মনে হত আম্মাকে ফাঁকি দিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম। টেরই পেলো না। আমি কত্ত সাবধানী!
এখন সেহরীতে আমাকে কেউ ডাকে না। ডাকার দরকার হয় না। কি এক উদ্ভট জিনিস শিখেছি গত রমজান থেকে। একবারে সেহেরী খেয়ে ঘুমাই। আর উঠি সেইদুপুরে। তারপর গোছল সেরে নামাজ পড়ে ফেসবুক নিয়ে বসি। আজ একটা ম্যুভি দেখলাম। হোটেল রুয়ান্ডা। তুতসী জনগোষ্ঠীর উপর হুতু জনগোষ্ঠীর অত্যাচারের এক করুন চিত্র। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কিসের আসায়।
রোজা আমাদের ত্যাগের মহিমা শেখায়। সত্যিকারে আমরা যদি রোজা পালন করতে পারি তাহলে আমরা আমাদের মাঝের ক্ষুদ্র স্বার্থের বিভেদগুলি ভুলতে পারবো। নিজেদের স্বার্থপরতাকে কুরবানী দিয়ে মানুষকে ভালোবাসতে পারবো।