প্রশ্নঃ সমস্ত মানব ও জ্বীনের হিসাব-নিকাশ হবে কিয়ামত দিবসে। আম্বিয়ায়ে কেরামগণের হিসাব হবে কিনা? হলে কী ধরণের হিসাব হবে- উনাদের আমলের- নাকি শুধু স্বাক্ষ্য দেয়ার জন্য? তা জান্তে চাই।
উত্তরঃ কোরআন মজিদে শুধু এতটুকু উল্লেখ আছে যে, যাদের প্রতি আম্বিয়ায়ে কেরাম প্রেরিত হয়েছিলেন- তাদের যেমন হিসাব- নিকাশ হবে- তেমনিভাবে রাসুলগণেরও হিসাব হবে। এর বেশী কোন সরাসরি ইঙ্গিত কোরআন মজিদে উল্লেখ করা হয়নি। নবী করীম (ﷺ) তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন হাদীসের মাধ্যমে।
(১) আল্লাহ্পাক নবীগণের জিঙ্গাসাবাদ সম্পর্কে এরশাদ করেছেন,
فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ – فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِم بِعِلْمٍ ۖ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ
অর্থাৎ : “অতএব আমি অবশ্যই ঐসব লোকদেরকে প্রশ্ন করবো- যাদের প্রতি রাসুলগণকে প্রেরণ করা হয়েছে এবং অবশ্যই আমি প্রশ্ন করবো রাসুলগণকেও। ” (সূরা আ’রাফ ৬ ও ৭ আয়াত)।
ব্যাখ্যাঃ মানুষ এবং রাসুলগণের এই প্রশ্ন হবে শুধু তাবলীগে নবুয়ত ও তাবলীগে রিসালাত সম্পর্কে। এই প্রশ্ন অনুষ্ঠানকে হাদীসে বলা হয়েছে عرض للمعاذير অর্থাৎ নবীগণের পক্ষে সাফাই পেশ করা। অস্বীকারকারীরা বিনা হিসাবেই জাহান্নামবাসী হবে। কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে- “আমি তোমাদের কাছে আমার পক্ষ হতে রাসুলগণ ও কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছিলাম- তোমরা তাদের সাথে কি ধরণের আচরণ করেছো”?
আর রাসুল ও নবীগণকে প্রশ্ন করা হবে- “যেসব বিধান ও শরিয়ত দিয়ে আমি আপনাদেরকে প্রেরণ করেছিলাম- সেগুলো আপনারা নিজ নিজ উম্মতের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন কি না?” (মাযহারী)। এই জিজ্ঞাসাবাদ হবে নবীগণের পক্ষে সাফাই -এর জন্য।
(২) সহীহ্ মুসলিম শরীফে হযরত জাবের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে আছে- রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্বের ভাষনে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেছিলেন- কিয়ামতের দিন যখন তোমাদেরকে আমার দায়িত্ব পালন বা তাবলীগে রিসালাত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে যে, আমি সঠিকভাবে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়েছি- কিনা? তখন তোমরা কি বলবে? এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরাম সম্মিলিত কণ্ঠে বললেন- আমরা বলবো- আপনি যথাযথভাবে আল্লাহর পয়গাম আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। একথা শুনে রাসুল মকবুল (ﷺ) গদগদ কণ্ঠে ভাবগম্ভীর স্বরে বললেন- “হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন” اللھم اشھد
(৩) হাশরে নবীজীকে কি প্রশ্ন করা হবে?
=======
নবী করীম (ﷺ) কে হাশরের দিনে কি প্রশ্ন করা হবে- সেটিও তিনি ঐদিনই বলে দিয়েছেন। ইমাম আহমদ (রহঃ) তাঁর ‘মুসনাদে আহমদ’ হাদীসগ্রন্থে হুযুরের জওয়াব এভাবে উল্লেখ করেছেনঃ “বিদায় হজ্বের দিনে তিনি সাহাবীদের স্বাক্ষ্যদানের কথা শুনে বললেন- “কিয়ামতের দিনে আল্লাহ্পাক যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন- আমি তাঁর পয়গাম ঠিকমত পৌঁছিয়েছি কিনা! তখন আমি বলব- হ্যাঁ, পৌঁছিয়ে দিয়েছি”। কাজেই তোমরা সচেষ্ট হও যে, তোমরা যারা এখন উপস্থিত রয়েছো- তারা যেন অনুপস্থিত সাহাবীদের (লোকদের) কাছে আমার এই পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়”। (তাফসীরে মাযহারী)।
বিঃ দ্রঃ অত্র হাদীস দ্বারা বুঝা গেলো- হুযুর (ﷺ) সাহাবায়ে কেরামকে নিজ পয়গাম অন্য অনুপস্থিত সাহাবী বা তাবেয়ীনদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য যে নির্দেশ দিয়েছেন- ইহার নাম তাবলীগে ইসলাম- যার মূলনীতি বা অছুল হলো ৫টি। বর্তমান তাবলীগ জামায়াত যে ৬ অছুলের তাবলীগ করে- এগুলো নবীজীর পয়গাম নয়- বরং দিল্লীর মৌলভী ইলিয়াছের স্বপ্নেপ্রাপ্ত পয়গাম বা মলফুযাত। এটা ইসলামের নামে বা নবীজীর আদেশ বলে প্রচার করা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামী তাবলীগের সাথে স্বপেপ্রাপ্ত ছয় উছুলী দিল্লীর ইলিয়াছী তাবলীগের কোনই সম্পর্ক নেই। তাই মসজিদে মসজিদে এগুলো প্রচার করা ইসলামী দৃষ্টিতে নাজায়েয। (এম.এ. জলিল)।
(৪) আল্লাহ্পাক নিজের কসম করে কাফিরদেরকে জিজ্ঞাবাদের কথা এভাবে উল্লেখ করেছেন
الَّذِينَ جَعَلُوا الْقُرْآنَ عِضِينَ – فَوَرَبِّكَ لَنَسْأَلَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ
অর্থাৎ : “যারা কোরআনকে খন্ড খন্ড করেছে- আমি আপনার রবের (নিজের) কসম করে বলছি- আমি অবশ্যই ওদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো”। (সূরা হিজর ৯১ ও ৯২ আয়াত)।
ব্যাখ্যাঃ সাহাবায়ে কেরাম এই জিজ্ঞাসাবাদের ধরণ জানতে চাইলে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করলেন- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” কলেমা বা মূল বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ইমাম কুরতুবী বলেন- সাহাবায়ে কেরাম পূনঃ জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আন্তরিকভাবে আল্লাহ্-রাসুলকে বিশ্বাস করার অর্থ কী? তিনি বললেন- এই কালেমা যখন মানুষকে হারাম ও অবৈধ কর্ম থেকে বিরত রাখবে- তখনই বুঝা যাবে- সে আন্তরিকভাবেই আল্লাহ্-রাসুলকে বিশ্বাস করেছে” (কুরতুবী)।
(৫) হাশরের ময়দানে প্রথমে নবীগণকে দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তারপর তাঁদের উম্মতদেরকে ডাকা হবে, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন,
يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ ۖ قَالُوا لَا عِلْمَ لَنَا ۖ إِنَّكَ أَنتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ
অর্থাৎ : “ঐদিন সকল রাসুলগণকে একত্রিত করে আল্লাহ্পাক জিজ্ঞাসা করবেন- হে নবীগণ! বলুন, আপনারা তাদের পক্ষ থেকে কতটুকু সাড়া পেয়েছিলেন? তাঁরা বলবেন- হে প্রভূ! আমাদের কিছুই মনে নেই- আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে মহাজ্ঞানী”। (ছুরা মায়েদাহ্ ১০৯ আয়াত)
ব্যাখ্যাঃ ইমাম কুরতুবী বলেন- আল্লাহর কথা শুনে নবীগণ প্রথম প্রথম ঘাব্ড়ে যাবেন- কোন উত্তর দিতে পারবেন না। কেননা, জানা সত্বেও ঐ দিনের ভয়াবহ অবস্থা দেখে তাঁরা সাময়িকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন এবং বুঝে উঠতে পারবেন না- কি জওয়াব দিবেন।
তখন আল্লাহ্পাক তাঁদেরকে দুনিয়ার সব বিষয় পুনঃ স্মরণ করিয়ে দিবেন। অতঃপর নবীগণ এক এক করে সামনে আসবেন এবং নিজ নিজ উম্মতের কারা কারা অস্বীকার করেছে এবং কারা কারা ঈমান এনেছে- তা খুলে বলবেন। (তাযকিরাহ্ ৩১৬ পৃঃ)।
(৬) হাশরের দিনে প্রত্যেক নবীকে তাঁর উম্মতসহ ডাকা হবে –
ইবনে মাজাহ্ হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) থেকে একটি সংক্ষিপ্ত হাদীস এভাবে বর্ণনা করেছেন,
عن ابی سعید قال قال رسول اللّہ ﷺ یجی النبی یوم القیامۃ ومعہ الرجل ۔ ویجبی ومعہ الرجلان ویجئ النبی ومعہ الثلاثۃ واکثر من ذلک واقل فیقال لہ ھل بلغت قومک؟ فیقول نعم فیدعی قومہ ۔ فیقال ھل بلغکم؟ فیقولون لا فیقال من یشھد لک؟ فیقول محمد امتہ فتدعی امۃ محمد ﷺ فیقال ھل بلغ ھذا؟ فیقولون نعم۔ فیقول وما علمکم بذلک؟ فیقولون اخبرنا نبینا محمد ﷺ بذالک ان الرسل فدبلغوا فصدقناہ ۔ قال فذلک قولہ تعالی وکذلک جعلناکم امۃ وسطا لتکونوا شھداء علی الناس ویکون الرسول علیکم سھیدا ۔
অর্থাৎঃ “হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করেন- রাসুলকরিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- কিয়ামতের দিনে কোন কোন নবী মাত্র একজন ঈমানদার উম্মত নিয়ে হাযির হবেন। কোন কোন নবী দুজন, কোন কোন নবী তিনজন বা কম বেশী ঈমানদার উম্মত নিয়ে হাযির হবেন। ঐ নবীকে জিজ্ঞাসা করা হবে- আপনি কি আল্লাহর বাণী ও আপনার রিসালাত আপনার স্বজাতির কাছে পৌঁছিয়ে ছিলেন? তিনি বলবেন- হ্যাঁ। তখন তাঁর কাফের স্বজাতিকে ডেকে আনা হবে এবং জিজ্ঞাসা করা হবে- তিনি কি তোমাদের কাছে আমার বাণী পৌঁছিয়েছেন? তারা বলবে-না। তখন আল্লাহ্পাক ঐ নবীকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করবেন- আপনার পক্ষে সাক্ষী কে? তখন ঐ নবী বলবেন- “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর উম্মত আমার সাক্ষী। ” অতঃপর উম্মতে মোহাম্মদীকে ডাকা হবে এবং বলা হবে- ইনি কি পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন? তাঁরা বলবে- হ্যাঁ। আল্লাহ্পাক পূনঃ জিজ্ঞাসা করবেন- তোমাদেরকে একথা কে শিক্ষা দিয়েছেন? তারা বলবে- আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে উনাদের বিস্তারিত সংবাদ দিয়েছেন। এভাবেই আমরা জেনেছি যে, রাসুলগণ তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করেছিলেন। আমরা আমাদের প্রিয়নবীর কথা মনেপ্রানে বিশ্বাস করেছি। ” এ পর্য্যন্ত বলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন- হাশরের এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ্পাক সুরা বাক্বারার ১৪৩ আয়াতে এরশাদ করেছেন “এমনিভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী বা নির্ভরযোগ্য উম্মত করে পাঠিয়েছি- যাতে তোমরা সমগ্র মানব মন্ডলীর জন্য সত্য সাক্ষ্যদাতা হও এবং যাতে আমার এই রাসুল হন তোমাদের সকলের পক্ষে সহা সাক্ষ্যদাতা”। (সূরা বাক্বারা ১৪৩ আয়াত)।
ব্যাখ্যা : অত্র হাদীসে আমাদের প্রিয়নবীর শান কত সুন্দরভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেন আল্লাহ্পাক সুব্হানাহু ওয়া তায়ালা। নবীগণকে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হবে- উনাদেরকে সম্মানিত করা এবং অমান্যকারী সম্প্রদায়কে চুড়ান্তভাবে অপদস্ত করা। পূনরায় সমস্ত নবীগণের সাক্ষ্যকে পাকাপোক্ত করার জন্য উম্মতে মোহাম্মদী ও প্রিয়নবীর সাক্ষ্যের প্রয়োজন হবে। উম্মতে মোহাম্মদী সেদিন সম্মানিত হবে নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে। তাদের সাক্ষ্য সত্যায়ন করবেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। নবীজীর সাক্ষ্য হবে চুড়ান্ত সাক্ষ্য। এর উপরই ফায়সালা করা হবে- নবীগণের নাজাত ও অবাধ্য সম্প্রদায়ের শাস্তির বিষয়টি।
কতবড় সম্মান এটি! সুব্হানাল্লাহ্। এ মর্মে অনেক দীর্ঘ হাদীস সহীহ বুখারীসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের প্রিয়নবীজী পূর্ববর্তী নবীগণের মুক্তির সনদ। নবী করীম (ﷺ) -এর মন্তব্যের উপরে ঐদিন কোন কাফের জেরা করবে না। কেননা, “আমাদের সাক্ষ্য হবে শুনা সাক্ষ্য- কিন্ত নবীজীর সাক্ষ্য হবে দেখা সাক্ষ্য”। ইহাই মোহাদ্দেসীনে কেরামের অভিমত। কেননা, শুনা সাক্ষীর জেরা হয়- দেখা সাক্ষীর জেরা হয় না।
পূর্বযুগের ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী হওয়ার কারনেই আল্লাহ্পাক তাঁকে “শাহেদ ও শাহীদ” দুটি উপাধীতে ভূষিত করেছেন- যার বিস্তারিত প্রমাণ বিভিন্ন হাদীস ও তাফসীরগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। শাহেদ ও শাহীদ দুটি শব্দের তাহ্কিক ও বিশ্লেষনের জন্য “মুফ্রাদাতে রাগীব ইস্পাহানী” নামক তাফসীরগ্রন্থ দেখুন। (সামনের হাদীসে আরো বর্ণনা দেখুন)।
(৭) উম্মতে মোহাম্মদী ও পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের মধ্যে বাদানুবাদ হবে হাশরে-
আবদুল্লাহ্ ইবনে মোবারাক (হানাফী মাযহাবের বড় মাপের ফকিহ ও হাদীস বিশারদ) মুরসাল সূত্রে একটি দীর্ঘ হাদীস এভাবে বর্ণনা করেছেন- যার অনুবাদ হলো-
“নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- আল্লাহপাক যখন আপন বান্দাদেরকে কিয়ামতের দিনে একত্রিত করবেন, তখন সর্বপ্রথম ডাকা হবে ইসরাফীল ফিরিস্তাকে। আল্লাহ্পাক তাকে জিজ্ঞেস করবেন- আমার অঙ্গীকারনামা, প্রতিশ্রুতি ও বানী কি তুমি পৌঁছিয়ে দিয়েছো? ইসরাফীল বলবে- হ্যাঁ, আমি জিবরাঈলকে বুঝিয়ে দিয়েছি। জিবরাঈলকে আল্লাহ্ ডেকে বলবেন- ইসরাফীল কি আমার বানী তোমার কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে? জিবরাঈল বলবে- হ্যাঁ, আমিও তা পৌঁছিয়ে দিয়েছি সংশ্লিষ্ট আম্বিয়ায়ে কেরামের কাছে। নবীগণকে আল্লাহ্ ডেকে বলবেন- জিবরাঈল কি আপনাদের কাছে আমার উক্ত প্রতিশ্রুতিনামা পৌঁছিয়ে দিয়েছে? নবীগণ বলবেন- হ্যাঁ। আমরা তা আমাদের স্বজাতির কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি।
তখন আল্লাহ্ তাঁদের উম্মতগণকে ডাকবেন এবং বলবেন- তোমাদের স্ব-স্ব নবীগণ কি আমার বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন? তারা কেউ কেউ স্বীকার করবে- আবার কেউ কেউ অস্বীকার করবে। তখন নবীগণ বলবেন- আমরা যে পৌঁছিয়ে দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছি- তার পক্ষে আমাদের সাক্ষী আছে- আর তুমি তো নিজেই সাক্ষী। আল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করবেন- তোমাদের পক্ষে বড় সাক্ষী কে? নবীগণ বলবেন “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর উম্মতগণ”।
অতঃপর উম্মতে মোহাম্মদীকে (আমাদেরকে) ডাকা হবে। আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীকে জিজ্ঞাসা করবেন- আচ্ছা! এই নবীগণ যে দাবী করছেন- তাঁরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কাছে রিসালাতের বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন- তোমরা কি তা সাক্ষ্য দিচ্ছো? তারা বলবে- হ্যাঁ। হে প্রতিপালক, নবীগণ সত্যিই তোমার বাণী পৌঁছিয়ে দিয়ে তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন।
তখনই পূর্ববর্তী উম্মতেরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে এবং বলবে- তোমরা আমাদের পরে এসেছো। না দেখে না শুনে কিভাবে আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছো? আল্লাহ্কে উদ্দেশ্য করে তারা বলবে- যারা আমাদের যামানা পায়নি- তারা কি করে আমাদের কার্যক্রমের সাক্ষ্য দিচ্ছে? তখন আল্লাহ্পাক উম্মতে মোহাম্মদীকে জিজ্ঞাসা করবেন- তোমরা পূর্ববর্তী উম্মত এবং তাদের কার্যক্রম না দেখে কিভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছো? (মনে হয়- পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উম্মতের মধ্যে বিতর্ক লাগিয়ে দিয়ে আল্লাহ্পাক তামাশা দেখবেন এবং পরে আসল জিনিস প্রকাশ করবেন)।
উম্মতে মোহাম্মদীগণ বলবে- হে প্রভূ! তুমি আমাদের কাছে এমন মহান রাসুল প্রেরন করেছো- যিনি শাহেদ ও শাহীদ বা হাযির নাযির উপাধীধারী, যার মাধ্যমে তুমি আমাদের কাছে তোমার কিতাব পাঠিয়ে পূর্ব জামানার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছো এবং বলে দিয়েছো যে, পূর্ববর্তী নবীগণ তাঁদের দায়িত্ব পূর্নভাবে পালন করেছেন। আমরা তাঁর মুখে এইসব কথা শুনে বিশ্বাস করেছি।
নবী করীম (ﷺ) এ পর্য্যন্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে এবং বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু সূরা বাক্বারার ১৪৩ আয়াত তিলাওয়াত করলেন- যার অর্থ হচ্ছে- “এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী বা নির্ভরযোগ্য উম্মত বানিয়েছি- যাতে তোমরা সমগ্র মানবজাতির সাক্ষী হতে পারো এবং তোমাদের রাসুল যেন তোমাদের সাক্ষ্যর উপর সত্যায়নকারী মহাসাক্ষী হন”।
ইমাম কুরতুবী বলেন- আয়াতের মধ্যে أُمَّةً وَسَطًا শব্দের অর্থ হলো নির্ভরযোগ্য উম্মত”। (আত্ তাযকিরাহ্ ৩১৭ পৃষ্ঠা)।
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্পাক হাশরের ময়দানে এই বিতর্ক সৃষ্টি করে সমস্ত নবীগণকে আমাদের নবীজীর মুখাপেক্ষী বানিয়ে দিবেন এবং সমস্ত উম্মতকে মুখাপেক্ষী বানাবেন উম্মতে মোহাম্মদীর কাছে। আমাদেরকে আল্লাহ্পাক “ওয়াছাতান” বা মধ্যমপন্থী ও নির্ভরযোগ্য উম্মত উপাধীতে ভূষিত করেছেন। এর বিনিময়ে আল্লাহ্ ও নবীজীর কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ।
হুযুর (ﷺ) বলেছেন- انتم شهداء الله في الارض অর্থাৎ :“তোমরা হচ্ছো পৃথিবীতে খোদায়ী সাক্ষী। তোমরা যে সাক্ষ্য দিবে- তা আল্লাহর পক্ষ হতেই হবে এবং আল্লাহর কাছে গৃহীত বলে গণ্য হবে। তাই মুসলমানগণ সম্মিলিতভাবে যে কাজকে ভাল বলে- তা আল্লাহর কাছেও ভাল। যেমন- মিলাদ ও কিয়াম। (দেখুন- মক্কা মদিনার ফতোয়া- ফতুয়া আল হারামাঈন ১২৮৬ হিঃ) যা বারাহীনে কাতেয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে)।
(৮) ইমাম আবু হামেদ গাযালী (রহঃ) তাঁর “কাশ্ফু উলুমিল আখিরাহ্” গ্রন্থে দীর্ঘতম একটি হাদীস এভাবে বর্ণনা করেছেন- যার মর্মার্থ এইঃ
“আম্বিয়ায়ে কেরাম ও তাঁদের উম্মতদের এই বিতর্কের পূর্বে আল্লাহ্পাক চতুষ্পদ জন্তুদের ফয়সালা করে ফেলবেন। শিং বিহীন মযলুম পশুকে শিং দান করে বদলা নেয়ার ব্যবস্থা করবেন। এরপর তাদেরকে মাটিতে মিশিয়ে দেবেন। আর নবীবিদ্রোহী ও খোদাদ্রোহীরা সেদিন আফসোস করে বলতে থাকবে- “যদি তারাও মাটিতে মিশে যেতে পারতো”। (ছুরা নিসা ৪০ আয়াত)।
আর কাফেরগণ বলবে- “হায়! যদি আমরা মাটি হয়ে যেতাম- তাহলে কতই না ভাল হতো”। ছুরা নাবা ৪০ আয়াত।
এরপর আহ্বান শুনা যাবে- কোথায় লওহে মাহ্ফুয? লওহে মাহফুয কাঁপতে কাঁপতে হাযির হবে। আল্লাহ্পাক লওহে মাহ্ফুযকে জিজ্ঞেস করবেন- তোমার মধ্যে লিখিত তৌরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও ফুরকান কোথায়? লওহে মাহ্ফুয জওয়াব দিবে- হে আল্লাহ্! জিবরাঈল আমীন সেগুলো আমার থেকে লিখে নিয়ে গেছেন। জিবরাঈল হাঁটু কাঁপতে কাঁপতে আসবে। আল্লাহ্পাক জিজ্ঞাসা করবেন-লওহে মাহফুয বল্ছে- তুমি নাকি সব বাণী লিখে নিয়ে গিয়েছো- এটা কি সঠিক? জিবরাঈল বলবে- হ্যাঁ সঠিক, হে প্রভূ! আমি লওহে মাহ্ফুয থেকে লিখে নিয়ে হযরত মূছার কাছে তৌরাত, হযরত দাউদের কাছে যবুর, হযরত ইছার কাছে ইঞ্জিল এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোরআন পৌঁছিয়ে দিয়েছি। আর প্রত্যেক নবীর কাছে নবুয়তের দায়িত্ব, প্রত্যেক রাসুলের কাছে রিসালাতের দায়িত্ব এবং সহীফার মালিকদের কাছে সহিফাসমূহ পৌঁছিয়ে দিয়েছি”।
অতঃপর প্রথমে ডাক পড়বে হযরত নূহের। তিনি কাঁপতে কাঁপতে হাযির হবেন। আল্লাহ্ তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন হে নূহ্, জিবরাঈল বলছে- তুমি রাছুলগণের মধ্যে একজন অন্যতম রাসুল। হযরত নূহ্ (আঃ) আরয করবেন- হ্যাঁ, বারে এলাহী। তাঁকে পুনঃ জিজ্ঞাসা করা হবে- তুমি তোমার স্বজাতির সাথে কি আচরণ করেছো? হযরত নূহ্ (আঃ) বলবেন- আমি তাদেরকে দিনে রাত্রে, প্রকাশ্যে ও গোপনে বহু ডেকেছি। কিন্ত এর ফলাফল কিছুই পাইনি- বরং তারা আমার নিকট থেকে আরো দূরে সরে গিয়েছে।
এরপর ডাকা হবে নূহ্ নবীর স্বজাতিকে। তাদের সবাইকে একসাথে হাযির করা হবে এবং বলা হবে- তোমাদের স্বজাতি ভাই- তোমাদের এই সাথী নূহ্ (আঃ) বল্ছেন- তিনি তোমাদের কাছে তাঁর রিসালাতবানী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কী বলো? তারা বলবে- হে আমাদের প্রতিপালক! তিনি মিথ্যা বল্ছেন। আমাদের কাছে তিনি কিছুই পৌছাননি”। তারা তাঁর রিসালাতকেই অস্বীকার করে বসবে।
তখন আল্লাহ্পাক বলবেন- হে নূহ্! তোমার কি কোন প্রমাণ আছে? হযরত নূহ্ (আঃ) বলবেন- হে রব! আমার সত্যতার প্রমাণ হলেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর উম্মতগণ। একথা শুনে তারা এর প্রতিবাদ করে বলবে- এরা তো আমাদের পরে দুনিয়াতে গিয়েছিলো। আমরা হলাম বহু পূর্বের উম্মত- আর তারা হলো অনেক পরবর্তী উম্মত। (তারা না দেখে কিভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছে?)।
অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আনা হবে এবং উম্মতের সাক্ষ্য সত্যায়ন করা হবে নবীজীর সাক্ষ্য দ্বারা। তিনি হবেন চাক্ষুস রাজসাক্ষী। তাঁর উপরই ফাইনাল সিদ্ধান্ত হবে। ইমাম গাযালী (রঃ) বলেন- অতঃপর হুকুম করা হবে- তাদের সবাইকে বিনা ওজনে ও বিনা হিসাবে من غير وزن ولاحساب এক সাথে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো”।
তারপর ডাকা হবে হযরত হুদ্ আলাইহিস সালামকে। হযরত নূহের মতই হযরত হুদের উম্মতরা তাঁর সাথে ব্যবহার করেছিল। তিনিও আখেরী নবী এবং তাঁর উম্মতগণকে সাক্ষী মানবেন। অতঃপর নাফরমানদেরকে বিনা ওজনে- এবং বিনা হিসাবে জাহান্নামে পাঠানো হবে। এরপর এক এক করে হযরত সালেহ্ (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায় সামুদ জাতিকে ডাকা হবে। তিনিও আখেরী নবী এবং তাঁর উম্মতকে সাক্ষী মানবেন। তাঁর নাফরমান সম্প্রদায়কেও ঐভাবে বিনা হিসাবে জাহান্নামে প্রেরন করা হবে। এভাবে এক এক নবী ও তাঁর উম্মতকে ডাকা হবে। সবাই শেষ নবীও তাঁর উম্মতকে সাক্ষী মানবে। অপরাধীরা লা-জওয়াব হয়ে জাহান্নামে যাবে। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ্পাক কোরআন মজিদের ছুরা ফোরকান- এর ৩৮ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন- “আমি এভাবেই ধ্বংস করেছি আদ, সামুদ, আসহাবে রাছ এবং তাদের মধ্যবর্তী অনেক সম্প্রদায়কে”।
এছাড়াও অন্যান্য জাতি- যেমন কাওমে তারুখ, কাওমে তারূহ, কাওমে দোহা, কাওমে আস্রা এবং এ ধরণের অন্যান্য জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে- তাদের অবাধ্যতার কারণে। এভাবে হতে হতে ইয়ামেনের কাওমে তুববা, ইরাকের ও বাবেলের নমরূদ, মিশরের ফিরাউন, শাদ্দাদ- ইত্যাদি জাতিকে তাদের নাফরমানীর কারণে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং পরকালে তাদের যামানার নবীগণের অভিযোগের ভিত্তিতে ও আমাদের নবীজীর সত্যায়নের ফলে তারা বিনা ওজনে ও বিনা হিসাবেই জাহান্নামে যাবে। তাদের সাথে আল্লাহ্ সরাসরি কোন কালাম করবেন না- বরং আল্লাহর মুখপাত্র ফিরিস্তাগণই তাদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কেননা, “আল্লাহ্ যার দিকে নযর করবেন এবং যার সাথে কথা বলবেন- তাদের শাস্তি হবে না”।
শেষের দিকে হযরত মূছা (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), ও হযরত ইছা (আঃ) এবং তাঁদের উম্মতকে ডাকা হবে এবং মিম্বারে দাঁড়িয়ে তাঁদেরকে যথাক্রমে তৌরাত, যাবুর ও ইঞ্জিল পাঠ করার জন্য আহ্বান করা হবে। তাঁরা এমন সূরে তিলাওয়াত করবেন- যেন সদ্য ঐসব কিতাব নাযিল হয়েছে। হযরত দাউদ (আঃ) ৭০ সূরে যাবুর তিলাওয়াত করবেন। মনে হবে যেন বাদ্যযন্ত্র বাজানো হচ্ছে (গুনিয়াতুত ত্বালেবীন)। এই সূরকেই মাযামিরে দাউদ বলা হয়েছে হাদীসে। মূলতঃ উহা বাদ্যযন্ত্র ছিল না- ছিল কণ্ঠস্বর।
ইছা (আঃ) কে ডেকে আল্লাহ্পাক বলবেন- তুমি কি মানুষকে বলেছিলে যে, আমাকে এবং আমার মা মরিয়মকে তোমরা খোদার পরিবর্তে ইলাহ্ মানো? জবাবে ইছা (আঃ) বলবেন- হে আল্লাহ্! আমি তোমার গুনগান করি। আমার কি অধিকার আছে যে, আমি ঐসব কথা বলবো? আমি যদি বলে থাকি- তাহলে তুমিতো অবশ্যই জানো। “তুমি আমার অন্তরের কথা জানো- কিন্ত আমি তো তোমার অন্তরের কথা জানিনা”। (সুরা মায়েদা ১১৬ আয়াত)।
নবী করীম (ﷺ) বলেন- একথা শুনে আল্লাহ্ হেসে ফেলবেন এবং বলবেন- আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদীতা তাঁদের উপকারে আসবে”। (ছুরা মায়েদা ১১৮ আয়াত)।
সর্বশেষে আহ্বান করা হবে আমাদের প্রিয়নবী (ﷺ) কে। আল্লাহ্ বলবেন- হে প্রিয় হাবীব; জিবরাঈল বলছে- সে আপনার কাছে কোরআন পৌঁছিয়ে দিয়েছে। ইহা সঠিক কিনা? তিনি বলবেন- হ্যাঁ সঠিক। আল্লাহ্ বলবেন- আপনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে কোরআন তিলাওয়াত করুন। হুযুর (ﷺ) যখন তিলাওয়াত শুরু করবেন- তখন হরফ, মাখ্রাজ, সূর- ইত্যাদি মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব মিষ্টতা, আবেশ ও মাদকতা অনুভূত হবে। তখন মোত্তাকী বান্দারা খুশীতে বাগবাগ হয়ে যাবে এবং তাদের চেহারায় প্রস্ফুটিত হয়ে ফুটে উঠবে উজ্জলতার আভা। আর হুযুরের দুশমনদের চেহারা হয়ে যাবে কাল বর্ণের”। (ইমাম গাযালীর “কাশ্ফু উলুমিল আখিরাহ্” গ্রন্থ- এর বর্ণনা সমাপ্ত)। (তাযকিরাহ্ পৃঃ ১১৮, ১১৯, ১২০)।
বিঃ দ্রঃ উপরে বর্ণিত আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে ডাকা এবং তাঁদের সাক্ষ্যগ্রহণ করার মধ্যে নবী বিরোধীদেরকে চরম অপমান করাই উদ্দেশ্য। দুনিয়ার নিয়মে কারো বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করলে আসামীরা এই অপমান সহ্য করতে পারেনা। তদ্রুপ- পরকালে নবীগণ যখন সাক্ষ্য দিবেন, তখন তারা চরমভাবে অপদস্ত হবে। ইহাই নবীগণের সাক্ষ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য।
(৯) নবী করীম (ﷺ) উম্মতের যাবতীয় আমল সকাল সন্ধ্যায় দেখেন এবং তিনি হবেন “চাক্ষুস ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী” (হাযির নাযির),
عن سعید بن السیب یقول لیس من یوم الا تعرض علی النبی ﷺ امتہ غدوۃ وعشیۃ فیعرفھم بسماھم واعمالھم فلذلک یشھد علیھم یقول اللّٰہ تعالی ’’فکیف اذا حئنا من کل امۃ بشھید وجئنانک علی ھؤلاء شھیدا
অর্থাৎ : “তাবেয়ী হযরত সায়ীদ ইবনে মুসাইয়েব (রহঃ) বলেন- এমন কোন দিন নেই- যেদিন সকাল সন্ধ্যায় নবীজীর দরবারে উম্মতের আমল ও উম্মতকে পেশ করা হয়না। অতঃপর হুযুর (ﷺ) প্রত্যেক উম্মতকে তাদের নামে নামে চিনেন এবং তাদের আমল দেখেন। ” এ কারনেই আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন- “কাফেরগণ কিভাবে অস্বীকার করবে- যখন আমি প্রত্যেক উম্মতের ব্যাপারে একজন সাক্ষী (নবী) হাযির করবো এবং আপনাকে হাযির করবো সবার জন্য চাক্ষুস সাক্ষী হিসাবে”। (সুরা নিসা ৪১ আয়াত)।
রাগীব ইস্পাহানী “মুফরাদাত” তাফসীর গ্রন্থে বলেন- নবীজীর নাম “শাহেদ” রাখা হয়েছে এজন্য যে, তিনি উম্মতের আমল দেখেন এবং উম্মতের কাছে উপস্থিত থাকেন,
الشاهد من المشاهدة اومن الشهود
অর্থাৎ- “উপস্থিত ও প্রত্যক্ষদর্শীকে ‘শাহেদ’ বলা হয়। ” নবীজী উপস্থিত সাক্ষী।
বিঃ দ্রঃ- পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, উম্মতের আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয় প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবার এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম ও মা-বাপের কাছে পেশ করা হয় প্রতি জুমার দিনে। এতে মনে হতে পারে যে, অত্র হাদীসে তো প্রত্যেক দিন সকাল সন্ধ্যার কথা বলা হয়েছে- আবার অন্য হাদীসে সপ্তাহে একবারের কথা উল্লেখ করা হলো কেন?
উত্তর হলোঃ পিতামাতাকে যেদিন সন্তানের আমল দেখানো হবে- সেখানে নবীজীও দেখবেন। এটা হলো আম বা সাধারণ নিয়ম। কিন্তু নবীজীর কাছে খাস করে পেশকরা হয় প্রত্যেক দিন সকাল ও সন্ধ্যায়। এটা নবীজীর একক বৈশিষ্ট। সুতরাং উভয় হাদীসের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। (তাযকিরাহ্ পৃঃ ৩২১)।
১০। হাশরের ময়দানে স্বাক্ষীরূপে উপস্থিত থাকবে ফিরিস্তাগণ: (শাহেদ ও শাহীদের ব্যাখ্যা)
(ক) আল্লাহ্পাক কোরআন মজিদে ফিরিস্তাগণকে শাহেদ ও শুহাদা বলে উল্লেখ করেছেন। যথা, সূরা যুমার ৬৯ নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে,
وَوُضِعَ الْكِتَابُ وَجِيءَ بِالنَّبِيِّينَ وَالشُّهَدَاءِ وَقُضِيَ بَيْنَهُم
অর্থাৎ : “(ঐদিন) আমলনামা স্থাপন করা হবে, নবীগণ এবং সাক্ষ্যদাতা ফিরিস্তাগণকে আনা হবে এবং সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে”।
ব্যাখ্যাঃ এখানে শুহাদা বা সাক্ষীগণ দ্বারা দুই কাঁধের দুই ফিরিস্তা-কিরামান ও কাতিবীনকে বুঝানো হয়েছে এবং এটাই বাহ্যিক অর্থ। হাশরের ময়দানে প্রত্যেকের আমলনামা লেখক ফিরিস্তারা সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকবে। তাহলে বুঝা গেল- “শাহেদ” শব্দের অর্থই “উপস্থিত ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী। নবীজীও উপস্থিত সাক্ষী- শুধু শুনা সাক্ষী নন। ” তাই তিনি হাযির-নাযির।
(খ) হাশরের ময়দানে চাক্ষুস সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকবেন নবীগণঃ
আল্লাহ্পাক সূরা নিসা ৪১ আয়াতে এ প্রসঙ্গে আম্বিয়ায়ে কেরামকে “শাহীদ” বা উপস্থিত সাক্ষী বলে উল্লেখ করেছেন। যথা,
فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِن كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَىٰ هَٰؤُلَاءِ شَهِيدًا
অর্থাৎ : “কাফিরগণ কিভাবে অস্বীকার করবে বা তাদের অবস্থা কী হবে- যখন প্রত্যেক উম্মতের জন্য তাদের নবীগণকে চাক্ষুস সাক্ষীরূপে আমি উপস্থিত করবো এবং আপনাকে ডেকে আনবো তাদের সকলের উপর চাক্ষুস, প্রত্যক্ষ ও মহাসাক্ষী হিসাবে”। (সুরা নিসা ৪১ আয়াত)।
ব্যাখ্যাঃ অত্র আয়াতে আম্বিয়ায়ে কেরামকে “শাহীদ” বা উপস্থিত চাক্ষুসসাক্ষী বলা হয়েছে এবং রাসুলেপাক (ﷺ) কে বলা হয়েছে “চাক্ষুস মহাসাক্ষী”। তাহলে “শাহীদ” অর্থ-উপস্থিত সাক্ষী। যারা শুনা সাক্ষী বলে- তারা ভুল করেছে।
বুঝা গেল- “শাহেদ” এবং “শাহীদ” উভয় শব্দের অর্থ শুধু সাক্ষী নয়- বরং “উপস্থিত চাক্ষুস সাক্ষী”। এ প্রেক্ষাপটেই সূরা আহ্যাবে রাসুল (ﷺ) কে “নবী” এবং “শাহেদ” বলে দুটি অর্থ করা হয়েছে। “নবী” অর্থ- গায়েবের সংবাদদাতা এবং “শাহেদ” শব্দের অর্থ “উপস্থিত চাক্ষুস সাক্ষী”। আল্লাহর সিফাতী নাম শাহেদ- নবীজীর সিফাতী নামও শাহেদ এবং ফিরিস্তাদের সিফাতী নামও শাহেদ। তাঁরা উপস্থিত থেকে দেখেন- ফিরিস্তাগণের নাম سائق এবং شھید । দেখুন সূরা ক্বাফ আয়াত-২১।
سائق অর্থ- পেছন থেকে চালক ফিরিস্তা এবং شھید অর্থ উপস্থিত সাক্ষ্যদাতা ফিরিস্তা। যারা বলে- شھید শব্দের অর্থ শুধু “সাক্ষী”, তারা ভুল অর্থ করে। শাহেদ (شاھد) শব্দের মূল ধাতু হলো দুটি। একটি হলো مشاھدۃ বা পরিদর্শন করা। দ্বিতীয় অর্থ হলো شھود বা উপস্থিত থাকা। এই দুটি অর্থের সমন্বয়কে বলা হয় হাযির নাযির বা شھید (দেখুন- রাগেব ইস্পাহানীর ‘মুফরাদাত’। )
নবীজীকে হাযির নাযির বললে এক শ্রেণীর মৌলভী চিৎকার করে বলতে থাকে “শিরিক শিরিক”। তারা ‘শাহেদ’ শব্দের তাহ্কীক বা বিশ্লেষন না জানার কারনেই এরূপ বলে। তাদের মতানুযায়ী আমাদের রাসুল চাক্ষুস সাক্ষী নন- বরং “অন্ধ এবং শুনা সাক্ষী” (নাউযুবিল্লাহ্)। আল্লাহর কালাম বলছে- নবীজী হাযির নাযির। আর বিভ্রান্ত জ্ঞানপাপীরা বলছে- শিরিক। তাহলে শিরিকের ফতোয়া তাদের ভাষ্যানুযায়ী আল্লাহর উপরই প্রথম বর্তায়-যা একেবারেই অবাস্তব। কোরআন, হাদীস, ইজ্মা এবং কিয়াছের ৪ দলীল দ্বারা নবীজী হাযির ও নাযির প্রমাণিত। আলেমানা এই তথ্য ও তাহ্কীক ভাল করে পড়বেন।
(১১) হাশরের ময়দানে সাক্ষী হবে শরীর ও হাত পা- মুখ থাকবে সীলগালা করা
(ক) আল্লাহ্পাক সূরা নূর ২৪ আয়াতে এরশাদ করেন,
يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
অর্থাৎ : “সেদিন অবাধ্য লোকদের বিরূদ্ধে তাদের মুখ, তাদের হাত ও তাদের পা সাক্ষ্য দিবে ঐ কাজকর্মের- যা তারা দুনিয়াতে অর্জন করতো”। (সূরা নূর ২৪ আয়াত)।
(খ) সূরা ইয়াসীন- এ মুখে সীলগালা করে হাত পা থেকে সাক্ষ্য গ্রহণের কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-
الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَىٰ أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
অর্থাৎ : “আজকের দিনে (কিয়ামতের দিনে) আমি অবাধ্য লোকদের মুখ সীলগালা করে দিব এবং আমার সাথে কথা বলবে তাদের হাত। আর তাদের পা সমূহ সাক্ষ্য দিবে এগুলোর মাধ্যমে তাদের কৃতকর্মের”।
(১২) যমীন, দিবসসমূহ, রাতসমূহ এবং ধনসম্পদ সাক্ষী দিবে তাদের বিরুদ্ধেঃ
(ক) যমীনের সাক্ষ্য প্রসঙ্গে আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেনঃ
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
অর্থাৎ : “ঐ দিন যমীন তার মধ্যে সংঘটিত সব বিষয়ের খবর বলে দিবে”। (সুরা যিলযাল)।
নবীজী এরশাদ করেন “ঐ দিন যমিন বলবে- অমুক বান্দা, অমুক বান্দা আমার উপরে অমুক অমুক দিন এই এই অপকর্ম করেছে”।
(খ) অবৈধ উপায়ে অর্জিত মাল এভাবে সাক্ষ্য দিবে,
انہ م یأخذہ بغیر حقہ کالذی یأکل ولایشبع ویکون علیہ شھیدا ۔ خرج مسلم عن ابی سعید الخدری ۔
অর্থাৎ : হযরত আবু সায়ীদ খুদরী বর্ণিত এবং মুসলিম শরীফে সংকলিত হাদীসে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন- “যেব্যক্তি অবৈধভাবে অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, তার উপমা হলো ঐ ব্যক্তির ন্যায়- যে খায় কিন্ত অতৃপ্ত থেকে যায় এবং তার ক্ষুধা মিটেনা। ঐ সম্পদ হাশরের দিনে তার বিরূদ্ধে সাক্ষ্য দিবে”। (মুসলিম)।
মন্তব্যঃ বর্তমানের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়- দূর্নীতির মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠি ও তাদের দালালরা হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করলেও তাদের ক্ষুধা মিটেনা। তারা সবসময় খাম-খাম করে। অবশেষে সৎ শাসকগণের কাছে ধরা পড়ে জেলে যায়- ঘানি টানে। নবী করীম (ﷺ) ১৪০০ বৎসর পূর্বেই এদের দুনিয়ার অতৃপ্তি ও পরকালের শাস্তির কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন। এই অবৈধ সম্পদ তাদের উপকারী বন্ধু নয়- বরং চরম অপকারী শত্র“।
সারসংক্ষেপঃ পরকালে কয়েক প্রকারের সাক্ষী হবে। যথা (১) কিরামান কাতেবীন (২) যমীন (৩) দিন তারিখ (৪) গলায় পেঁচানো আমলনামা (৫) অবৈধ সম্পদ (৬) আমলনামার দৈনন্দিন ডায়েরী (৭) হাত, পা, মুখ ও অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। শত প্রকার সাক্ষীর কথা বহু হাদীসে এবং বহু আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তখন অস্বীকার করার উপায় থাকবে না। এই সাক্ষী হবে উপস্থিত ও চাক্ষুস সাক্ষী। একেই বলা হয় “হাযির ও নাযির”।