আমরা হতে পারি অনেক নামীদামী বংশের, কিন্তু কিয়ামতের মাঠে আমাদের এই বংশমর্যাদা কোন কাজে আসবে না। কিন্তু নবীবংশের মর্যাদা ব্যতিক্রম। জান্নাতে চলবে নবীবংশের সর্দারী। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “প্রত্যেক বংশীয় ও বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়তা কিয়ামতের দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, শুধু আমার বংশীয় ও বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়তা ব্যতিত।” {আল মু’জামুল কাবীর ৩:৪৫ (২৬৩৪), আল ফাওয়ায়েদ ২:৩৩৩ (১৬০৩), আস সুনানুল কুবরা, ৭:১০২ (১৩৩৯৫/১৩৩৯৬)}
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “কিয়ামতের দিন প্রত্যেক উপায় ও বংশীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, শুধু আমার উপায় ও বংশীয় সম্পর্ক ব্যতিত”। {মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ইমাম হাইছামী, ৯:১৭৩, আল মু’জামুল আওসাত, ৬:২৮২ (৫৬০২), আস সুনানুল বায়হাক্বী, ৭:১০২ (২৩২৯৪)/ ১৮৫ (১৩৬৬০)।}
আমাদের তেমন কোন আমল নাই যা কবুল হওয়ার নিশ্চিয়তা দিতে পারি। কিন্তু আমাদের একটা আশা আছে, আমরা নবীকে ভালবাসি, নবীবংশকে ভালবাসি, যাদের প্রতি ভালবাসাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেই আবশ্যক করে দিয়েছেন, নামাজের মধ্যে যাদের উপর দরুদ পড়াকেও আবশ্যক করে দিয়েছেন, যাদের ভালবাসা ব্যতিত অন্তরে ঈমান প্রবেশ করতে পারেনা এবং যাদের ভালবাসা ব্যতিত যাবতীয় আমল কোন কাজে আসবে না বলে সকল বনী আদমের সর্দার ঘোষণা দিয়েছেন। আমাদের এটাই আশা যে, আমরা জান্নাতী যুবকদের সর্দারদ্বয়কে ভালবাসি; তাঁদের সম্মানিত পিতা যাকে সমস্ত মুমিনের মাওলা ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের সম্মানিত মাতা যিনি সকল জান্নাতী রমনীদের সর্দারনী, উনাদের সবাইকে ভালবাসি, যাদের প্রতি ভালবাসা পোষণকারীরা কিয়ামতের দিন আমার নবীর সাথে থাকবে বলা হয়েছে।
আমাদের আশা এটাই যে, আমরা তাদেরকেও ভালবাসি যারা নবীগণ ব্যতিত সমস্ত জান্নাতী পূর্ণ বয়স্কদের সর্দার হবেন। এছাড়াও আমরা সমস্ত সাহাবাদের ভালবাসি যাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা কল্যাণ তথা জান্নাতের অঙ্গীকার করেছেন। যে যাকে ভালবাসে সে তার সাথেই থাকবে, এটা আমাদের মত গুনাহগারদের জন্য অনেক বড় এক আশার বাণী।
জান্নাতী যুবকদের সর্দারদ্বয়ের সম্মানিত পিতা মাওলা আলী রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বলেনঃ যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে এবং
এ দু’জন ও তাঁদের পিতা-মাতাকে ভালোবাসে, সে কিয়ামতের দিন আমার সাথেই থাকবে। (সূনান আত তিরমিজী ৩৭৩৩)
ইবনে উমার রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ হাসান ও হুসায়ন জান্নাতী যুবকদের সর্দার এবং তাঁদের পিতা তাঁদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ ১১৮)
মাওলা আলী (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর সাথে ছিলাম। সে সময় আবূ বকর (রা.) ও উমর (রা.) আবির্ভূত হন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ এরা দু’জন জান্নাতে নবী-রাসূলগণ ছাড়া পূর্বাপর (সৰ্বকালের) পূর্ণ বয়স্কদের নেতা হবেন। হে ‘আলী! (তাঁদের জীবদ্দশায়) এটা তাদেরকে জানাবে না। (সূনান আত তিরমিজী ৩৬৬৫, ৩৬৬৬, সূনানে ইবনে মাজাহ ৯৫)
প্রিয় নবী ﷺ ফাতিমাহ রাঃ কে বলেনঃ হে ফাতিমাহ! মু’মিন রমণীদের প্রধান ও এ উম্মতের সকল মহিলাদের নেত্রী হওয়া কি তুমি অপছন্দ করো? (সহীহ মুসলিম ৬২০৭)
একবার হুযাইফাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর নিকট এলে তিনি ﷺ জানানঃ একজন ফেরেশতা যিনি আজকের এ রাতের আগে কখনও পৃথিবীতে অবতরণ করেননি। তিনি আমাকে সালাম করার জন্য এবং আমার জন্য এ সুখবর বয়ে আনার জন্য আল্লাহ তা’আলার কাছে অনুমতি চেয়েছেনঃ ফাতিমাহ জান্নাতের নারীদের নেত্রী এবং হাসান ও হুসাইন জান্নাতের যুবকদের নেতা।(সূনান আত তিরমিজী ৩৭৮১, ইবনে আসাকির রহঃ সহীহুল জামে’ হা/৭৯)
উসামাহ্ ইবনু যাইদ (রাঃ) বলেন, এক রাতে আমার কোন দরকারে নবী ﷺ-এঁর কাছে গেলাম। অতএব নবী ﷺ এমন অবস্থায় বাইরে এলেন যে, একটা কিছু তার পিঠে জড়ানো ছিল যা আমি অবগত ছিলাম না। আমি আমার দরকার সেরে অবসর হয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনার দেহের সঙ্গে জড়ানো এটা কি? তিনি পরিধেয় বস্ত্র উম্মুক্ত করলে দেখা গেল তার দুই কোলে হাসান ও হুসাইন (রা.)। তিনি বললেনঃ এরা দু’জন আমার পুত্র এবং আমার কন্যার পুত্র। হে আল্লাহ! আমি এদের দু’জনকে মুহাব্বাত করি। সুতরাং তুমি তাদেরকে মুহাব্বাত কর এবং যে ব্যক্তি এদেরকে মুহাব্বাত করবে, তুমি তাদেরকেও মুহাব্বাত কর। (সূনান আত তিরমিজী ৩৭৬৯)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেনঃ এক ব্যক্তি (সাহাবী) রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! এমন ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি কী বলেন, যে ব্যক্তি কোন গোষ্ঠী বা দলকে ভালবাসে, কিন্তু (আমলের ক্ষেত্রে) তাদের সমান হতে পারেনি? তিনি বললেনঃ মানুষ যাকে ভালবাসে সে তারই সাথী হবে।(সহীহ বুখারী ৬১৬৯)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, আমি এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ উভয়ে মসজিদে নববী থেকে বের হচ্ছিলাম। তখন মসজিদের দরজায় এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ তুমি কিয়ামতের জন্য কি পাথেয় সঞ্চয় করেছ? রাবী বলেন, তখন লোকটি চুপ হয়ে গেল। এরপর সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি তো সে জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ নামাজ, রোজা ও সাদকা-খয়রাত সঞ্চয় করিনি। তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ কে ভালবাসি। তিনি বললেনঃ তুমি তার সঙ্গেই থাকবে যাকে তুমি ভালবাস। আনাস (রাঃ) বলেন, ইসলাম গ্রহণের পরে কোন কিছুতে আমরা এত বেশী খুশি হয়নি যতটা নবী ﷺ এঁর বাণীঃ “তুমি তার সঙ্গেই (থাকবে) যাকে তুমি ভালবাস” দ্বারা আনন্দ লাভ করেছি। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল, আবূ বকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) কে ভালবাসি। সুতরাং আমি আশা করি যে, কিয়ামত দিবসে আমি তাদের সঙ্গে থাকব, যদিও আমি তাদের মত আমল করতে পারিনি। (সহীহ মুসলিম ৬৬০৬, ৬৬০৭, ৬৬০৮) (সহীহ বুখারী ৩৬৮৮)
যারা আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা দেখাতে গিয়ে আবূ বকর রাঃ, উমর রাঃ সহ অন্যান্য সাহাবাদের শানে বেয়াদবী করে তারা তো নবীকেই ভালবাসতে পারেনি।
বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন রহঃ বলেন, আমি মনে করি না যে, এমন কোন ব্যক্তি আছেন যিনি নবী ﷺ-কে ভালবাসেন অথচ আবূ বকর রাঃ ও উমর (রাঃ) এঁর মর্যাদা খাটো করে দেখেন। (সূনান আত তিরমিজী ৩৬৮৫)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ (জান্নাতে) সর্বোচ্চ সম্মাননায় আসীন লোকদেরকে অবশ্যই তাদের নীচের মর্যাদার লোকেরা দেখতে পাবে, যেমন তোমরা আসমানের দিগন্তে উদিত তারকা দেখতে পাও। আবূ বকর ও উমর তাঁদেরই দলভুক্ত, বরং আরো বেশি রহমত ও মর্যাদার অধিকারী। (সূনান আত তিরমিজী ৩৬৫৮, সুনানে ইবনে মাজাহ ৯৬)
আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ হুঁশিয়ার (সাবধান)! আমার সাহাবীদের বিষয়ে আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় কর। আমার পরে তোমরা তাদেরকে (গালি, বিদ্রুপ, সমালোচনার) লক্ষ্যবস্তু বানিও না। যেহেতু যে ব্যক্তি তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করল, সে আমার প্রতি ভালোবাসার খাতিরেই তাদেরকে ভালোবাসল। আর যে ব্যক্তি তাদের প্রতি শক্রতা ও হিংসা পোষণ করল, সে আমার প্রতি শক্রতা ও হিংসাবশেই তাদের প্রতি শক্ৰতা ও হিংসা পোষণ করল। যে ব্যক্তি তাদেরকে কষ্ট দিল, সে আমাকেই কষ্ট দিল। যে আমাকে কষ্ট দিল, সে আল্লাহ তা’আলাকেই কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহ তা’আলাকে কষ্ট দিল, শীঘ্রই আল্লাহ তা’আলা তাকে পাকড়াও করবেন। (সূনান আত তিরমিজী ৩৮৬২)