খতমে নুবূয়ত ও ক্বাদিয়ানী ফির্ক্বা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

সূচীপত্র
 মুখবন্ধ/০৬
 খতমে নুবূয়ত ও ক্বাদিয়ানী ফির্ক্বা/০৭
 হাদীস শরীফ-১/০৯
 হাদীস শরীফ-২/০৯
 হাদীস শরীফ-৩/০৯
 হাদীস শরীফ-৪/১১
 হাদীস শরীফ-৫/১২
 হাদীস শরীফ-৬/১২
 হাদীস শরীফ-৭/১২
 হাদীস শরীফ-৮/১৩
 হাদীস শরীফ-৯/১৩
 হাদীস শরীফ-১০/১৩
 হাদীস শরীফ-১১/১৪
 পর্যালোচনা/১৫
 মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর কান্ড/১৭
 ক্বাদিয়ানী মতবাদ ও বৃটিশ সরকার/২১
 দেওবন্দ ও ক্বাদিয়ান/২৪
 ‘তাহযীরুন্ নাস’-এর ধোঁকাপূর্ণ ষড়যন্ত্রের কাহিনী/২৬
 একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ/৩১
 খতমে নুবূয়তকে অস্বীকার করার অশুভ পরম্পরা/৩৪
 ছবির সুন্দর অবয়ব/৩৮
 আরেকটি তাজা কিতাব ও পর্যালোচনা/৪১
 একটি আবেদন/৪৩
 খতমে নুবূয়ত: ক্বোরআন মজীদের আলোকে/৪৪
 খাতাম শব্দের বিশ্লেষণ/৪৭
 রসূল ও নবীর মধ্যে পার্থক্য/৪৯
 النبيين -এর الف لام -এর বিশ্লেষণ/৫০
 استغراق -এর প্রকারভেদ/৫০
 দ্বীনকে পরিপূর্ণ করা/৫২
 ক্বোরআনের হিফাযত/৫৫
 সরকার-ই দু’ আলমের পর খলীফা হবেন, নবী হবেন না/৫৫
 আল্লাহ, রসূল ও শাসকের আনুগত্য/৫৮
 রসূলে আরবী সর্বশেষ রসূল/৬০
 হাবীবে খোদা আখেরী উম্মতের আখেরী রসূল/৬২
 হাদীস শরীফের আলোকে খাতামুল আম্বিয়া (সর্বশেষ নবী)/৭৩
 মির্জা কাদিয়ানীর ধোঁকা/৮২
 হাবীবে খোদার আখেরী উম্মতের ইজমা’ প্রতিষ্ঠিত/৮৪
 সাহাবা কেরামের ইজমা’/৮৫
 সলফে সালেহীনের ইজমা’/৮৬
 মির্যাঈদের সন্দেহরাজি ও সেগুলোর অপনোদন/৮৮
 হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসের মর্মার্থ/৯৪
 খতমে নুবূয়ত সম্পর্কে দু’ধরনের আলোচ্য বিষয়/৯৯
 শায়খ-এর বাণীর সারকথা/১০২
 মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত/১০৪
 তার ভন্ড নুবূয়তের দাবী/১০৬
 ভন্ড নবীর আত্মপ্রকাশের পরম্পরা ও মির্যা গোলাম আহমদ/১০৭

প্রকাশকের কথা

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
نَحْمَدُ ه وَنُصَلِّىْ وَنُسَلِّمُ عَلى حَبِيْبِه الْكَرِيْمِ وَعَلى الِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ

আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাঁর ‘খতমে নুবূয়ত’ (সর্বশেষ নবী হওয়া)। তাঁর পরে অন্য কোন নবী আসবেনা। এটা ক্বোরআন, সুন্নাহ্ ও ইজমা’ সমর্থিত বিষয় ও আক্বীদা। এ বিষয় অস্বীকার করলে মানুষ কাফির হয়ে যায়। তখন সে ইহকালে হয় ধিক্কৃত আর পরকালে তার জন্য অবাধারিত রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
সুতরাং এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ আক্বীদার পক্ষে ক্বোরআন (কিতাব), সুন্নাহ্, ইজমা’ ও ক্বিয়াসে যে সব প্রমাণ রয়েছে, সেগুলো জেনে রাখা প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য অপরিহার্য। আলহামদু লিল্লাহ্! এ পুস্তকে ওইসব দলীল উল্লেখ করে, সেগুলোর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে, ভন্ড-নুবূয়তের দাবীদারদের কুফরী ও তাদের খন্ডন করা হয়েছে। এ পুস্তিকার বিশেষ করে গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর ভ্রান্ত ও কুফরী দাবীর প্রতি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, যাতে তার এ ভ্রান্ত আক্বীদার প্রচার বন্ধ হয় এবং মানুষের ঈমান-আক্বীদা রক্ষা পায়।
পুস্তকটি প্রণয়ন করেছেন জনাব মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, মহাপরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার। আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা এবং পুস্তকটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

ধন্যবাদান্তে

আলহাজ্ব মোহাম্মদ মহসিন-সেক্রেটারি জেনারেল আলহাজ্ব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন- সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট  আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট

মুখবন্ধ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী ওয়া নুসাল্লিমু আলা হাবীবিল কারীম,
খাতামিন্ নবিয়্যীন, ওয়া ‘আলা আ-লিহী ওয়া সাহবিহী আজমা‘ঈন।

নবী-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন্ নাবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী)। হুযূর-ই আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ গুণ ও পদ-মর্যাদা পবিত্র ক্বোরআন, বিশুদ্ধ হাদীস, ইজমা’ ও ক্বিয়াস ইত্যাদি দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। সুতরাং এর উপর ঈমান রাখাও ফরয।
সমস্ত সুন্নী মুসলমান হুযূর-ই আক্রামের খতমে নুবূয়তের আক্বীদা পোষণ করে থাকেন। পক্ষান্তরে, অতি দুঃখের হলেও সত্য যে, নবী করীমকে সর্বশেষ নবী জেনে বিশ্বাস থেকে সরে গিয়ে তাঁর পরে ‘যিল্লী নবী’ ‘বরূযী নবী’ ইত্যাদি মনগড়া তথাকথিত উপাধি রচনা করে ভন্ড নুবূয়তের দাবীদার হয়ে বসেছে- কুখ্যাত কাফির গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী। সে ইসলামের গন্ডি থেকে সিটকে পড়ে মুসায়লামা কায্যাব, আসওয়াদে আনাসী, তুলহায়হা ও শাজা প্রমুখ ভন্ড নবী তথা নিরেট কাফিরদের পথ ধরে মুসলিম সমাজে এগুতে চেয়েছিলো। কিন্তু হক্বপন্তীগণ তাকে নিরেট ভন্ড নবী ও কট্টর কাফির হিসেবে চিহ্নিত করে ছেড়েছেন।
এ পুস্তকে খতমে নুবূয়তের আক্বীদার পক্ষে অকাট্য প্রমাণাদি, পক্ষান্তরে, মির্যা গোলাম আহমদের পরিচয় ও কুফররূপী ভ্রান্তি-বিভ্রান্তিগুলোকেও অকাট্য প্রমাণাদি সহকারে সুস্পষ্ট করা হয়েছে।
পরিশেষে, পুস্তকটি অধ্যয়ন করলে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করে নিজের ঈমান-আক্বীদাকে দৃঢ়তর করা যাবে, পক্ষান্তরে উক্ত ভন্ডনবী মির্যা ক্বাদিয়ানী ও তার অন্ধ অনুসারীদের স্বরূপ উন্মোচন করা সহজ হবে। তাছাড়া এটা অন্যান্য বাতিলপন্থীদের মতো ক্বাদিয়ানীদের অপতৎপরতার কুফল- থেকে বাঁচার জন্য সহায়ক হবে। সুতরাং এসব গুরুত্বের আলোকে পুস্তকটির পাঠক সমাজে আশাতীত সমাদৃত হোক। এটাই একান্ত কাম্য।

শুভাচ্ছান্তে-
(মাওলানা) মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার,
ষোলশহর, চট্টগ্রাম।

খতমে নুবূয়ত ও ক্বাদিয়ানী ফির্ক্বা

بِسْمِ الله ِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمَ
اَلْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلواةُ وَالسَّلاَمُ عَلٰى خَاتَمِ النَّبِىِّيْنَ وَعَلٰى اٰلِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ

হামদ এবং সালাত ও সালাম-এর পর শিরোনামে উল্লিখিত বিষয়ে আলোচনার শুরুতে রঈসুল কলম হযরতুল আল্লামা আরশাদ আল-ক্বাদেরী, ‘জামেয়া নেযাম উদ্দীন, দিল্লী’র প্রতিষ্ঠাতা আলায়হির রাহমাহর এ প্রসঙ্গে গবেষণালব্ধ বক্তব্য উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা যদি আমাদের আশে পাশে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি, তবে আমাদের সামনে একটি অতি বাস্তব বিষয় সুস্পষ্ট হবে। তা হচ্ছে- প্রতিটি অস্তিত্ব বিশিষ্ট বস্তু বা বিষয়ের তিনটি অবস্থা অনিবার্যঃ শুরু, উন্নতি ও শেষ। মানুষ বলি কিংবা জীব-জন্তু বলি, তৃণলতা বলি কিংবা জড় পদার্থ বলি, সব ক’টিই এ তিন অবস্থার আবর্তেই সীমাবদ্ধ হিসেবে পরিলক্ষিত হবে। যেমন- মানুষ প্রথমে শিশু অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তারপর যুবক হয়, তারপর বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কলি প্রথমে ফুটে ও হাসে, তারপর ফুল হয়, পরিশেষে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চাঁদ প্রথম দিনে ‘হেলাল’ হয়ে আকাশে দেখা দেয়, তারপর বাড়তে বাড়তে পূর্ণিমার চাঁদ হয়, তারপর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একেবারে গায়ব হয়ে যায়। মোটকথা, সৃষ্টি জগতের সব কিছু এভাবে প্রারম্ভ, উন্নতি ও পরিসমাপ্তির সোপানগুলো অতিক্রম করতে থাকে। সুতরাং সবকিছুর সূরতে হাল যখন এমনিই, তখন কে বলতে পারে যে, ‘নুবূয়ত’ও যখন একেবারে এসে গেছে, তখন সেটার পরম্পরাও কোন মহান সত্তার উপর গিয়ে খতম হবে না?
অতঃপর শেষ পর্যন্ত সবাই এতটুকু তো মানবে যে, শুরুতে এ পৃথিবীতে কিছুই ছিলো না; কিন্তু পরবর্তীতে সব কিছু সৃষ্টি হলো। তারপর কিছুদিন সেগুলো অস্তিত্বে থাকার পর নিঃশেষ যায়। এ বিষয়কে কে অস্বীকার করতে পারে? নবূয়তের বিষয়টিও তেমনি। নবী-রসূলগণের শুভাগমনের ধারা যখন শুরু হয়েছে, তখন দীর্ঘদিন এ ধারা অব্যাহত রয়ে শেষ পর্যন্ত সেটার পরিসমাপ্তিও রয়েছে।
এ পরিজ্ঞাত বিষয়টিকে সরকার-ই আরদ্ব ও সামা, সাহেবে লাওলা-কা লামা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা নিজের দু’টি আঙ্গুল শরীফের দিকে ইঙ্গিত করে এ বলে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন- اَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَاتَيْنِ (অর্থাৎ আমি ও ক্বিয়ামত আমার এ দু’ আঙ্গুলের মতোই)। অর্থাৎ এ দু’ আঙ্গুলের মধ্যভাগে যেমন কোন ফাঁক নেই, তেমনি আমার ও ক্বিয়ামতের মধ্যবর্তীতে অন্য কোন নবী নেই। আমার নুবূয়ত সর্বশেষ নুবূয়তই।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয়- নুবূয়ত উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে কিনা? যদি পৌঁছে থাকে, তাহলে বুঝে নিন, সেটা শেষ প্রান্তেও পৌঁছে গেছে। যদি কেউ বলে যে, পৌঁছেনি, তাহলে সেতো নতুন নবীর জন্য অপেক্ষা করবে; কিন্তু প্রথমে এতটুকু তো বলে দিন যে, যিনি সর্বশেষ নবী হবার উপর সবার ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং এ কথাটার উপর অগণিত অকাট্য প্রমাণাদিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাঁর থেকে আজ পর্যন্ত যে আক্বীদা অনুসারে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ হিজরী সাল, খ্রিস্টীয় সাল অনুসারে দু’ হাজার বছরাধিক কাল, ইহুদী আক্বীদা অনুসারে এর কাছাকাছি কিংবা তদপেক্ষা বেশী যে সময়টুকু অতিবাহিত হয়েছে, এ সময়- সীমার মধ্যে কোন নতুন নবী কেন আসলোনা? যখন আসেনি, তখন তো এর অর্থ এ দাঁড়ালো যে, নবী প্রেরণকারীই এর দরজাটুকু চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন।
‘সর্বসম্মত নবী’ বলে আমি বুঝাচ্ছি এমন সম্মানিত নবী, যিনি নিজ দেশ ও জাতি ছাড়াও আপন পয়গাম্বরানা মহত্বের সত্যায়ন অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের থেকেও করিয়ে নিয়েছেন। যেমন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, যেখানে মুসলমানদের সব দল-উপদল তাঁর রিসালত ও নুবূয়তের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়, সেখানে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁর পয়গাম্বরানা জীবনের মহত্ব ও অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা অকপটে স্বীকার করে; যা বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের ইতিহাসবেত্তাদের নিকট মোটেই গোপন নয়।
বর্ণনার এ ধারাবাহিকতায় আরো একটি কথা গভীরভাবে অনুধাবনের উপযোগী। তা হচ্ছে- নুবূয়ত কার উপর খতম হয়েছে? এ কথা জানার উপায় আমাদের নিকট কি আছে? এ প্রসঙ্গে আমি বলবো, যিনি শেষ নবী বলে দাবী করেছেন, তিনিই বলবেন যে, তিনি কি শেষ নবী, না অন্য কেউ নবী হয়ে তাঁর পরে আসবে? যেমন পূর্ববর্তী নবীগণের ইতিহাসে আমরা জানতে পারি যে, প্রত্যেক পূর্ববর্তী নবী তাঁর ওফাতের সময় একথা বলে গেছেন, ‘‘আমাদের সবার পর একজন শেষ নবী হিসেবে তাশরীফ আনবেন।’’ যেহেতু ‘নবূয়ত’ একটি আক্বীদা-বিষয়ক ব্যাপার, সেহেতু এ গুরুত্বপূর্ণ ও বুনিয়াদী প্রশ্নকে সেটার পূর্ণাঙ্গ জবাব না দিয়ে রেখে দেওয়া যায় না।
সুতরাং নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর কাতারে যদি কাউকে একথার মহান বক্তা হিসেবে পাওয়া যায় যে, তিনি সর্বশেষ নবী, তাহলে বুঝে নিন যে, তিনিই সর্বশেষ নবী, তাঁর উপরই নবীগণের শুভাগমনের এ ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তাঁর এ ঘোষণার মধ্যে কোন ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা বাহানা-অজুহাত বর্ণনা বা তালাশ করার অবকাশ নেই। কেননা, কারো কথার ভিন্ন ব্যাখ্যা (তা’ভীল) তখনই প্রয়োজন হয়, যখন মৌলিক নিয়ম ও সর্বজন মান্য যুক্তির পরিপন্থী হয়; কিন্তু যদি ওই কথা যখন তা স্বয়ং ক্বুদরতের চাহিদার নিয়ম-কানূনের অনুরূপ হয়, তবে তাতে ভিন্ন ব্যাখ্যা তালাশের অযথা কষ্ট করার প্রয়োজনই বা কি? এজন্য ওই উক্তি ঠিক ওইভাবেই বুঝে নেওয়া হবে, যেভাবে তা ওই বচনের শব্দাবলী থেকে প্রকাশ পায়।
এখন আসুন! আমি আপনাকে ওইসব হাদীস শরীফের উদ্যানে ভ্রমণ করাবো, যাতে অতি স্পষ্টভাবে সরওয়ার-ই কাউনাঈন নবী-ই আরবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনিই সর্বশেষ নবী, তাঁর পরে কোন নবী নেই।

হাদীস শরীফ-১.
হযরত জুবাইর ইবনে মুত্ব‘ইম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন, হুযূর সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اِنَّ لِىْ اَسْمَآءً اَنَا مُحَمَّدٌ، اَنَا اَحْمَدُ، اَنَا الْمَاحِىُّ الَّذِىْ يَمْحُوْ اللهُ بِىَ الْكُفْرَ وَاَنَا الْحَاشِرُ الَّذِىْ يُحْشَرُ النَّاسُ عَلى قَدَمَىَّ وَاَنَا الْعَاقِبُ الَّذِىْ لَيْسَ بَعْدَه نَبِىٌّ – [مُسْلِم شَرِيْف ـ ج ـ ২, كتاب الفضائل] অর্থঃ আমার অনেক নাম আছে- আমি মুহাম্মদ, আমি আহমদ, আমি ওই মাহী (নিশ্চি‎হ্নকারী), যার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা ক্বুফরকে নিশ্চিহ্ন করেন, আমি হাশির (একত্রকারী), যার মাধ্যমে ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ আমার দু’ কদমের সামনে একত্রিত হবে, আমি ওই আক্বিব (সবশেষে আগমনকারী), যার পরে কোন নবী নেই। [মুসলিম শরীফ, ২য় খন্ড, কিতাবুল ফাযাইল] এ হাদীস শরীফে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের একটি নাম ‘আক্বিব’ (عاقب) বলেছেন, আর এ ‘আক্বিব’ শব্দের তাফসীর বা ব্যাখ্যাও নিজে দিয়েছেন। তা হচ্ছে- ‘আক্বিব’ তাঁকেই বলে, যাঁর পরে কোন নবী নেই। এখন এ হাদীস শরীফ এ অর্থে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, হুযূর-ই আক্রাম শেষ নবী, তাঁর পরে কোন নবী নেই।

হাদীস শরীফ-২.
হযরত আবূ মূসা আশ‘আরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, এক স্থানে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اَنَا مُحَمَّدٌ وَاَحْمَدُ وَالْمُقَفِّىْ وَالْحَاشِرُ وَنَبِىُّ التَّوْبَةِ وَنَبِىُّ الرَّحْمَةِ ـ
[مسلم شريف، جلد دوم ـ كتاب الفضائل صفحه : ২৬১] অর্থঃ আমি হলাম মুহাম্মদ, আহমদ, আখেরী নবী, হাশির, তাওবার নবী এবং রহমতের নবী। [মুসলিম শরীফ, ২য় খন্ড: কিতাবুল ফাযাইল, পৃ.-২৬১] এ হাদীস শরীফে হুযূর নবী-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের একটি নাম ‘আল-মুক্বাফ্ফী’ও বলেছেন; যার অর্থ হয় সবার শেষে আগমনকারী। যেমন- ইমাম নাওয়াভী মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থে, আল্লামা মানাভী ‘শরহে কবীর’-এ, মোল্লা আলী ক্বারী ‘মিরক্বাত শরহে মিশকাত’-এ, হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী ‘আশি’‘আতুল লুম‘আত’-এ ‘মুক্বাফ্ফী’ (مقفى)-এর অর্থ ‘সর্বশেষ নবী’ (اخر الانبياء) লিখেছেন।

হাদীস শরীফ-৩
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন, হুযূর শাফি‘ই ইয়াউমিন নুশূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
فُضِّلْتُ عَلَى الْاَنْبِيَآءِ بِسِتٍّ اُعْطِيْتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَاُحِلَّتْ لِىَ الْغَنَائِمُ وَجُعِلَتْ لِىَ الْاَرْضُ مَسْجِدًا وَطَهُوْرًا وَاُرْسِلْتُ اِلَى الْخَلْقِ كَآفَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّوْنَ ـ [مِشْكَوةُ الْمَصَابِيْحِ : كِتَابِ الْفِتَنِ : صَفْحَهْ : ৫১২] অর্থঃ আমাকে অন্যান্য নবী ও রসূলের উপর ছয়টি বিষয় দ্বারা প্রাধান্য ও বড়ত্ব দেওয়া হয়েছে-১. আমাকে ‘ব্যাপক বাণীগুলো’র গুণ দান করা হয়েছে, ২. আতঙ্ক ও দাপট দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে, ৩. গণীমতের মালগুলো আমার জন্য হালাল করা হয়েছে, ৪. সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠকে আমার জন্য মসজিদ এবং পবিত্র ও পবিত্রকারী করা হয়েছে, ৫. আমাকে সমগ্র জাহান (সকল সৃষ্টি)-এর রসূল বানানো হয়েছে এবং ৬. আমার স্বত্ত্বার উপর নবীগণের আগমনের পরম্পরা সমাপ্ত করা হয়েছে। [মিশকাত শরীফ: কিতাবুল ফিতান: পৃ.-৫১২]

হাদীস শরীফ-৪.
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন- এক সময় সৈয়্যদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
مَثَلِىْ وَمَثَلُ الْاَنْبِيَآءِ كَمَثَلِ قَصْرٍ اُحْسِنَ بُنْيَانُه وَتُرِكَ مِنْهُ مَوْضَعُ لَبِنَةٍ فَطَافَ بِه النَّظَّارُ يَتَعَجَّبُوْنَ مِنْ حُسْنِ بُنْيَانِه اِلاَّ مَوْضَعَ تِلْكَ اللَّبِنَةِ فَكُنْتُ اَنَا سَدَدْتُّ مَوْضَعَ اللَّبِنَةِ خُتِمَ بِىَ الْبُنْيَانُ وَخُتِمَ بِىَ الرُّسُلُ ـ وَفِىْ رِوَايَةٍ فَانَاتِلْكَ اللَّبِنَةُ وَاَنَا خَاتِمُ النَّبِّيِّيْنَ ـ [مسلم شريف: جلد ২ـ صفحه ـ ২৪৮,مشكوة المصابيح ـ صفحه ـ ৫২ـ باب فضائل سيد المرسلين] অর্থঃ আমার উদাহরণ ও অন্য সকল নবীর উদাহরণ ওই অট্টালিকার মতো, যার নির্মাণ কাজ অতি উত্তমরূপে সম্পন্ন হয়েছে; কিন্তু একটি ইটের জায়গা খালি রাখা হয়েছে। লোকেরা ওই ইমারতের সৌন্দর্য দেখে আশ্চর্যবোধ করে, শুধু এ অপূর্ণতার বিষয়টি ব্যতীত যে, ওই ইমারতে একটি মাত্র ইটের জায়গা খালি রাখা হয়েছে। সুতরাং আমি এসে ওই এক ইটের জায়গা পূর্ণ করে দিয়েছি। ওই অট্টালিকাও আমার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ হয়েছে, আর রসূলগণের শুভাগমনের ধারাও আমার মাধ্যমে পরিপূর্ণতায় পৌঁছেছে।
অন্য এক বর্ণনায় আছে- ‘ওই সর্বশেষ ইট হলাম আমি আর আমি হলাম নবীগণের আগমনের ধারা সমাপ্তকারী।
[মুসলিম শরীফ: ২য় খন্ড: পৃ.-২৪৮, মিশকাতুল মাসাবীহ্: পৃ. ৫২, বাবু ফাযাইলে সাইয়্যেদিল মুরসালীন]

হাদীস শরীফ-৫.
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করছেন, হুযূর-ই আন্ওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শাফা‘আতের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে এরশাদ করেছেন, ক্বিয়ামতের দিনে লোকেরা শাফা‘আতের আবেদন নিয়ে সকল নবীর নিকট যাবে। যখন তারা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর দরবারে হাযির হবে, তখন তিনি এরশাদ করবেন, ‘আজ শাফা‘আতের মুকুট মাহবূবে কিবরিয়া হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শির মুবারকে চমকাচ্ছে। তোমরা তাঁরই নিকট যাও।’ হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘অতঃপর লোকেরা আমার নিকট আসবে। আর আরয করবে-يَا مُحَمَّدُ اَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ وَخَاتِمُ الْاَنْبِيَآءِ অর্থাৎ হে সর্বাধিক প্রশংসিত (হযরত মুহাম্মদ) সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আপনি আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী। (আমাদের জন্য সুপারিশ করুন!…)

হাদীস শরীফ-৬
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
كَانَتْ بَنُوْ اِسْرَائِيْلَ تُسَوِّسُهُمْ الْاَنْبِيَآءُ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِىٌّ خَلَفَه نَبِىٌّ وَاَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ [مسلم شريف: كتاب الامارة :صفحه : ১২৬] অর্থঃ বনী ইসরাঈলের নবীগণ দেশের রাজনীতির কর্তব্যগুলোও পালন করতেন। যখন এক নবী দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিতেন, তখন অন্য নবী তাঁর পরবর্তীতে এসে যেতেন। আর আমার পর কোন নবী আসবে না। [মুসলিম শরীফ: কিতাবুল ইমারত: পৃ. ১২৬]

হাদীস শরীফ-৭
হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন, এক সময় তাজদারে কাউনাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اَنَا قَائِدُ الْمُرْسَلِيْنَ وَلاَ فَخْرَ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيّيْنِ وَلاَ فَخْرَ وَاَنَا اَوَّلُ شَافِعٍ وَمُشَفَّعٍ وَلاَ فَخْرَ [ مِشكوة : كتابُ الْفِتَنِ : صفحه : ৫১৪] অর্থঃ আমি রসূলগণের পেশ্ওয়া আর একথা আমি গর্ব-অহংকার করে বলছিনা, আমি নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ আর একথা আমি গর্ব-অহংকার করে বলছিনা, আমি সবার আগে সুপারিশ করবো এবং সবার আগে আমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে; একথাও গর্ব-অহঙ্কার করে বলছিনা। [মিশকাত শরীফ: কিতাবুল ফিতান, পৃ. ৫১৪]

হাদীস শরীফ-৮.
হযরত ইরবাদ্ব্ ইবনে সারিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণনা করেছেন, এক সময় হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اِنِّىْ عِنْدَ اللهِ مَكْتُوْبٌ خَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ وَاِنَّ اٰدَمَ لَمُنْجَدِلٌ فِىْ طِيْنَتِه
[ مشكوة شريف : صفحه ৫১৩] অর্থঃ ওই সময় থেকে আমার নাম ‘খাতামুন-নবিয়্যীন’ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার নিকট লিপিবদ্ধ রয়েছে, যখন হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম পানি ও মাটির স্তরে ছিলেন। [মিশকাত শরীফ: পৃ. ৫১৩]

হাদীস শরীফ-৯.
হযরত আবূ উমামা বাহেলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اَنَا اٰخِرُ الْاَنْبِيَآءِ وَاَنْتُمْ اٰخِرُ الْاُمَمِ
[سُنَنُ اِبْنِ مَاجَةَ : بَابُ فِتْنَةِ الدَّجَّالِ : صفحه : ২০৭] অর্থঃ আমি সমস্ত নবীর কাতারে সর্বশেষ নবী। আর তোমরা হলে সমস্ত উম্মতের মধ্যে সর্বশেষ উম্মত। [সুনানে ইবনে মাজাহ্: বাবু ফিতনাতিদ্ দাজ্জাল: পৃ. ২০৭]

হাদীস শরীফ-১০.
হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্বক্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, হুযূর-ই পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক সময় হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে সম্বোধন করে এরশাদ করেছেন-
اَنْتَ مِنِّىْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُوْسى اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ
[مسلم شريف: جلد دوم : صفحه ২৭৮] অর্থঃ তুমি আমার জন্য ওই স্তরে রয়েছো, যে স্তরে হযরত মূসার জন্য হযরত হারূন ছিলেন; কিন্তু আমার পর কোন নবী নেই। [মুসলিম শরীফ: ২য় খন্ড: পৃ. ২৭৮]

হাদীস শরীফ-১১.
হযরত সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, সাইয়্যেদে ‘আলামীন হুযূর-ই পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اِنَّه سَيَكُوْنُ فِىْ اُمَّتِىْ كَذَّابُوْنَ ثَلٰثُوْنَ كُلُّهُمْ يَزْعَمُ اَنَّه نَبِىُّ اللهِ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ [ مشكواة : كتاب الفتن : صفحه : ৪১৫] অর্থঃ আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন নুবূয়তের মিথ্যা দাবীদার (ভন্ডনবী) পয়দা হবে। তাদের মধ্যে প্রত্যেকের এ দাবী হবে যে, সে আল্লাহর নবী; অথচ আমি সর্বশেষ নবী, আমার পর কোন নবী নেই। [মিশকাত শরীফ: কিতাবুল ফিতান: পৃ. ৪১৫] এ হাদীস শরীফ থেকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুক্ষ্ম বিষয় প্রতীয়মান হয়ঃ
১. অত্যন্ত সত্য সংবাদদাতা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদত্ত খবর অনুযায়ী উম্মতের মধ্যে এমন এমন ব্যক্তি পয়দা হবে, যারা নুবূয়তের মিথ্যা দাবীদার হয়ে বসবে; বরং এমন বলা হলেও ভুল হবে না যে, নুবূয়তের মিথ্যা দাবীদারদেরকে দেখে আমাদের মধ্যে আমাদের সত্য নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যতার ইয়াক্বীন (দৃঢ় বিশ্বাস) তরুতাজা হয়ে যাবে।
২. নুবূয়তের এসব দাবীদার মিথ্যাবাদী হবে, তাদের দাবীর পক্ষে সত্যতা নেই; বরং ধোঁকা ও প্রতারণার ভিত্তিতেই হবে তাদের দাবী। এ অগ্রিম খবরের পর এখন কোন নবী বলে দাবীদার সম্পর্কে তার দাবীর সত্যতা যাচাইয়েরও কোন প্রয়োজন নেই, তা বৈধও নয়। কেননা, উম্মত প্রথম থেকেই জানে যে, এ (ভন্ডনবী) মিথ্যুক, জঘন্য মিথ্যাবাদী।
৩. কোন নতুন নুবূয়তের দাবীদারের মিথ্যাবাদিতা ফাঁশ করার জন্য এ দলীল অতিমাত্রায় যথেষ্ট যে, ‘‘হুযূর-ই পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী, খাতামুন্নাবিয়্যীন, তাঁর পরে আর কো নবী নেই।’’
পর্যালোচনা
এখন এসব অকাট্য দলীলের পর না কোন আলোচনা ও দলীল উপস্থাপনের অবকাশ আছে, না এটা দেখার প্রয়োজন আছে যে, নতুন নুবূয়তের দাবীদারের নিকট তার দাবীর পক্ষে কোন প্রমাণ আছে কিনা; বরং তার নিকট তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ চাওয়াও কুফরী।
উপরে উল্লিখিত হাদীস শরীফগুলোর আলোকে একথা মধ্যা‎হ্ন সূর্যের চেয়েও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সমস্ত নবী ও রসূলের মধ্যে সাইয়্যেদে আলম মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একমাত্র স্বত্ত্বা রয়েছেন, যিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, ‘‘আমি সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ নবী। আমার পর কোন নবী নেই।’’ এ ঘোষণার পর এখন না কোন নতুন নবীর জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে, না কোন নতুন নবী বলে দাবীদারের আহ্বান শোনার আমাদের প্রয়োজন আছে।
এখন এ প্রসঙ্গে আলোচনার একটি সর্বশেষ অংশ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। তাও উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি। তা হচ্ছে- ওই মহান আগমনকারীর ঘোষণা তো আমরা শুনেছি যে, তিনি সর্বশেষ নবী, তিনি নবীগণের আগমনের ধারা পরিসমাপ্তকারী হিসেবে তাশরীফ এনেছেন; তদ্সঙ্গে এটাও দেখতে হচ্ছে যে, এ ধরনের কোন ঘোষণা নবী প্রেরণকারী মহামহিম আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকেও আছে কি-না! এ প্রসঙ্গে যদি নবী প্রেরণকারী (আল্লাহ্ তা‘আলা)’র পক্ষ থেকে কোন ঘোষণা এসে থাকে তবে ‘খতমে নুবূয়তের’ আক্বীদার উপর প্রেরণকারী ও প্রেরিত উভয়ের দিক থেকে চূড়ান্ত মোহর লেগে যাবে। সুতরাং নিজেদের অন্তরগুলোর দরজা খুলে নবী প্রেরণকারী (আল্লাহ্ তা‘আলা)’র ঘোষণা শুনুন- তিনি ক্বোরআন মজীদে এরশাদ করেছেন-
مَاكَانَ مُحَمَّدٌ اَبَآ اَحَدٍ مِّنْ رِجَالِكُمْ وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيّيْنَ ـ
তরজমা: মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের মধ্য থেকে কোন (বয়োপ্রাপ্ত) পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ নবী। [সূরা আহযাব, আয়াত-৪০] হাদীস শরীফগুলোতে উপরোক্ত আয়াত শরীফের ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ خَاتَمَ النَّبِيّيْنَ বা (সর্বশেষ নবী) শব্দ দু’টির তাফসীর বা ব্যাখ্যা খোদ্ হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে এ শব্দগুলো দ্বারা উদ্ধৃত হয়েছে যে- اَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ (আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই)। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য হাদীসে اخِرُ الْاَنْبِيَآءِ (আখিরুল আম্বিয়া) দ্বারাও خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ (খাতামুন্নাবিয়্যীন)-এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ জন্য সাহাবা-ই কেরাম থেকে আরম্ভ করে উম্মতের সকল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও ‘সলফে সালেহীন’ (সুযোগ্য অগ্রণীগণ) পর্যন্ত সবাই একথার উপর ইজমা’ করেছেন (একমত হয়েছেন) যে, ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ মানে ‘আখিরুল আম্বিয়া’ (সর্বশেষ নবী)।
এসব ‘নাস’ (نصوص) বা ক্বোরআন-সুন্নাহর দলীল ও উম্মতের ইজমা’র ভিত্তির উপর ‘খতমে নুবূয়ত’-এর এ আক্বীদা প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর যাবৎ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের উপর ছাইয়ে আছে। এতদ্ব্যতীত, এ আক্বীদা বা ধর্ম-বিশ্বাসের এক আশ্চর্যজনক কারিশ্মা (চমৎকারিত্ব) এও আছে যে, দ্বীনের অগণিত শাখার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও এ আক্বীদার উপর সবাই একমত যে, সরওয়ার-ই কাউনাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে অন্য কোন নবী নেই। তাঁর পর প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর যাবৎ কোটি কোটি মানুষের চিন্তা-ভাবনার একই ধরন কোন কাকতালীয় শুভ ঘটনা হতে পারেনা; বিশেষ করে এমন অবস্থায়, যখন হুযূর-ই আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ মহান বাণীও সামনে রাখা যায় যে, ‘আমার উম্মত গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা)’র উপর কখনো একমত হবে না।’’
আলোচনা যদিও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি সহকারে সমাপ্ত হয়েছে, তবুও হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য একটু এ বিষয়েও গভীরভাবে চিন্তা করা যায় যে, সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবী আসার ধারাবাহিকতা (পরম্পরা) জারী থাকার কোন আলামত বা সম্ভাবনাও থাকছে কিনা। সুতরাং এ প্রসঙ্গে আমরা ‘ইলমে ইয়াক্বীন’ (নিশ্চিত বিশ্বাস সম্পর্কিত জ্ঞান)-এর সর্বোচ্চ চূড়ার উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছি যে, আজ থেকে অনেক দিন আগেই এ সম্ভাবনার দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে তাতে মজবুত তালা ঝুলে গেছে। আর আলামতও এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে, উভয় জাহানের কোথাও হাতে উজ্জ্বল প্রদীপ নিয়ে তালাশ-অন্বেষণ করলেও পাওয়া যাবে না।
এরপর সেটার যদি সম্ভাবনা থাকতো, তবে মহা সত্যবাদী পরম আমানতদার পয়গাম্বর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম, যিনি হযরত ঈসা মসীহ্ আলায়হিস্ সালাম-এর নাযিল হবার খবর দিয়েছেন, তিনি কখনোই একথা বলতেন না যে, ‘আমার উপর নবী আসার পরম্পরা (ধারা) সমাপ্ত হয়ে গেছে, ‘আমি সর্বশেষ নবী, আমার পর কোন নবী নেই।’ আর আমরা চূড়ান্ত নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, নবী-রসূলের পক্ষে মিথ্যা বলা ও সত্য গোপন করা কখনোই সম্ভবপর নয়। আর ‘ক্বরীনাহ্’ বা আলামত সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলবো যে, যদি তা থাকতো, তবে তা পাওয়ার সর্বোত্তম জায়গা ছিলো ‘আল্লাহ্ তা‘আলার কিতাব’ (ক্বোরআন মজীদ)। যখন ত্রিশটি পারা সম্বলিত এ বিরাটাকার গ্রন্থের একটি আয়াতও এমন নেই, যেখানে এ ‘আয়াত’ পাওয়া যায় যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরও কোন নবী আসবে; বরং এর সম্পূর্ণ বিপরীতে নিছক আলামতই নয়, বরং এ মর্মে একেবারে সুস্পষ্ট বর্ণনাই মওজূদ আছে যে, ‘হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী।’ যেমন-এরশাদ হয়েছে, وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ (কিন্তু তিনি হলেন আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী)।

পক্ষান্তরে, মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর জঘন্য কান্ড!
‘খতমে নুবূয়ত’-এর আক্বীদা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পর এখন আমি ‘খতমে নবূয়ত’-এর অস্বীকারকারীদের নেতা মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর দাবীগুলো(!)’রও পুংখানুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করতে চাই, যাতে যেসব লোক অজ্ঞতা ও কুফরের অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে, তারা ঈমান ও হিদায়তের আলোয় এসে যেতে পারে।
প্রথমে দেখুন মির্যা গোলাম আহমদের দাবীগুলো। সে দাবী করেছে, ‘‘১. আমি নবী, ২. খোদ্ খোদা আমার নাম নবী ও রসূল রেখেছেন, ৩. আমি যিল্লী নবী (ছায়ানবী), ৪. আমি বুরূযী নবী, ৫. আমি প্রতিশ্রুত মসীহ্ (মসীহ-ই মও‘ঊদ), ৬. আমি মাহদী, ৭. আমি মুজাদ্দিদ, ৮. আমি (হযরত) মুহাম্মদ-এর দ্বিতীয় প্রেরণ। (অর্থাৎ আমার দেহে খোদ্ হযরত মুহাম্মদ আত্মপ্রকাশ করেছেন), ৯. আমি হযরত ঈসা মসীহের সুসংবাদ এবং ‘ইসমুহূ আহমদ’ (হযরত ঈসা তাঁর পরে যে নবী ‘আহমদ’-এর শুভাগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন তিনি) আমিই। সেটা আমার নাম।’’ না‘ঊযু বিল্লা-হি মিন যালিকা। [ক্বাদিয়ানীর পুস্তক- পুস্তিকাদি থেকে সংকলিত] ওইগুলো হচ্ছে ওইসব দাবী, যেগুলো মির্যা গোলাম আহমদ করেছিলো। এ দাবীগুলো এক ধরনের পরস্পর বিরোধীও। কারণ, এগুলো এক ব্যক্তির মধ্যে এক সাথে প্রাপ্ত হওয়া সম্ভবপর নয়; কিন্তু তবুও তার এক মুখে এতসব দাবী উচ্চারিত হয়েছে।
এখন গোলাম আহমদের ওই দাবীগুলোর যাচাই-বাছাই করা যাক! তার কোন অপরিচিত মানুষ তার এসব দাবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হবে সেগুলো হচ্ছে-
১. অসম্ভব কল্পনায়, যদি সে খোদা তা‘আলার পক্ষ থেকে ওইসব অর্থে নবী ও রসূল হয়, যে সব অর্থে পূর্ববর্তী সকল নবী ও রসূল (আলায়হিমুস্ সালাম) ছিলেন, তাহলে সে ‘যিল্লী’ ও ‘বুরূযী’ নবী হবার মতো তালি-জোড়া দিলো কেন? যখন পূর্ববর্তী নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর মধ্যে প্রত্যেকে প্রকৃত ও আসলী নবী ছিলেন, কেউ তো নিজেকে ‘যিল্লী’ ও ‘বুরূযী’ নবী হবার দাবী করেননি!
২. যদি যিল্লী ও বুরূযী নবী ওইসব অর্থে নবীই না হয়, যেসব অর্থে পবিত্র ক্বোরআন ‘নবী’ শব্দ ব্যবহার করেছে, তাহলে ক্বোরআনী নবীর মতো, তার উপর ঈমান আনার জন্য আহ্বানই বা কেন করা হয়? আর এমন এক পরিভাষা, যা নবীগণের ইতিহাসেও পাওয়া যায় না, কেন বের করা হলো?
৩. মির্যা ক্বাদিয়ানী তার দাবী অনুসারে যদি প্রতিশ্রুত মসীহ্ হয়, তাহলে যিল্লী ও বুরূযী নবী হবার দাবী করাই ভুল। কেননা, প্রতিশ্রুত মসীহ্ তো একজন স্বতন্ত্র নবী; যিল্লী ও বুরূযী নবী নন। তাছাড়া, প্রতিশ্রুত নিছক মসীহই নন; বরং তিনি হলেন হযরত মসীহ্ ইবনে মরিয়াম। সুতরাং তার সম্পর্কে আরো একটি প্রশ্ন জাগে যে, এ ‘গোলাম ইবনে চাঁন্দ বিবি’ মসীহ ইবনে মরিয়াম হয়ে গেলো কিভাবে?
৪. যদি সে ‘মাহদী’ হয়, তবে তো ‘মসীহ্-ই মাও‘ঊদ’ হতে পারে না। কেননা, এ দু’ নামের নামীয় ব্যক্তি এক নন; পরস্পর পৃথক পৃথক। অর্থাৎ মাহদী এবং মসীহ-ই মাও‘ঊদ দু’জন পৃথক পৃথক ব্যক্তি। আর হাদীস শরীফসমূহের বর্ণনা মোতাবেক উভয়ের প্রকাশও পৃথক পৃথক যুগে। তাছাড়া, হযরত মসীহ্-ই মাও‘ঊদ আলায়হিস্ সালাম হবেন পয়গাম্বর। যখন হযরত ইমাম মাহদী পয়গাম্বর নন; বরং উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর এক ব্যক্তি, তখন এ কারণে দু’জন পৃথক পৃথক ব্যক্তিকে একজন লোক বলে সাব্যস্ত করা নিতান্তই প্রতারণা ও ডাহা মিথ্যা।
৫. যদি মির্যা ক্বাদিয়ানী ‘মুজাদ্দিদ’ হয়, তাহলে নবী হবার দাবী করা মারাত্মক ভুল। কেননা, হাদীস শরীফের স্পষ্ট বর্ণনানুসারে, মুজাদ্দিদ নবী হন না; বরং উম্মতের লোকদের মধ্যে তাঁর অবস্থান হচ্ছে শুধু একজন ধর্মীয় সংস্কারকেরই। সুতরাং ‘মুজাদ্দিদ’ হবার দাবী যদি শুদ্ধ বলে কিছুক্ষণের জন্য মেনেও নেওয়া হয়, তাহলে তার নবী হবার দাবীকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে মেনে নিতেই হবে। আর অসম্ভব কল্পনায়, যদি নবী ও রসূল হবার দাবীকে বিশুদ্ধ বলে মেনেও নেওয়া হয়, তবে তার ‘মুজাদ্দিদ’ হবার দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতেই হবে। কেননা, এ দু’টি দাবী এক সাথে করাই যেতে পারে না। সুতরাং ক্বাদিয়ানীর উভয় দাবীই ভিত্তিহীন ও অগ্রহণযোগ্য।
৬. যদি মির্যা ক্বাদিয়ানীর দাবী অনুসারে তাকে (হযরত) মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর দ্বিতীয়বার প্রেরণই বলা হয়, তাহলে তো, আল্লাহরই পানাহ্! সে মুহাম্মদই হলো, কেননা, ক্বিয়ামতের দিনে আদম সন্তানদের যেই পুনরুত্থান হবে, সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার মূল অস্তিত্বের সাথে উত্থিত হবে, ছায়ারূপে হবে না। সুতরাং এমতাবস্থায় হয়তো যিল্লী ও বুরূযী হবার দাবী ভুল অথবা (হযরত) মুহাম্মদ মোস্তফার দ্বিতীয়বার প্রেরিত হবার দাবীও মিথ্যা এবং অমূলক।
৭. বাকী রইলো মির্যা ক্বাদিয়ানীর এ দাবী- সে নাকি হযরত ঈসা মসীহ্ আলায়হিস্ সালাম-এর সুসংবাদ এবং ‘ইসমুহু আহমদ’-এর বাস্তবায়নও। সুতরাং মির্যা ক্বাদিয়ানীর এ দাবীর অসারতার কোন পর্যালোচনা করারও কোন দরকার নেই। কেননা, যদি হযরত মসীহ্ ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর সুসংবাদ ও তাঁর বাণী ‘ইসমুহূ আহমদ’ মীর্জা ক্বাদিয়ানীর বেলায় প্রযোজ্য হয়, তাহলে সে নিজেকে নিজে ‘গোলাম আহমদ’ বলে দাবী বা সাব্যস্ত করাও ভুল। কারণ, এ দাবী করে তো, আল্লাহরই পানাহ্’, সে নিজে ‘আহমদ’ ও ‘মুহাম্মদ’ হবার দাবীদার হলো। আর যদি তার নাম ‘গোলাম আহমদ’ হওয়াকে সঠিক মেনে নেওয়া হয়, তবে ‘তাঁর নাম আহমদ’ বাক্যটি তার বেলায় প্রযোজ্য বলা ভিত্তিহীন হবে, কারণ এর অর্থ ‘আহমদের গোলাম’।
মোটকথা, মির্যা ক্বাদিয়ানীর এ দাবীগুলোকে যদি দ্বীন ও যুক্তির নিরীখেও যাচাই করা হয়, তবে তার প্রতিটি দাবী অপর দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে বলে প্রতীয়মান হয়। তার কোন দাবী এমন নয়, যাকে মেনে নেওয়া যায়; বরং প্রতিটি দাবীই পর্যালোচনাকারীর হাত ধরে একথা বলবে- ‘আমাকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করুন!’
এসব অবস্থায় এ ফয়সালা করা সম্মানিত পাঠকদেরই কাজ যে, মির্যা ক্বাদিয়ানী আসলে কি? নবী হবার কথা তো তার একটি দুঃস্বপ্নই। এখন তো এ প্রশ্নটাই আলোচনা করা দরকার যে, তার বিবেক সুস্থ ছিলো কিনা? কেননা যার মাথা তথা বিবেক ঠিক থাকে, সে তো এ ধরনের পরস্পর বিরোধী দাবী করতেই পারে না। এ ধরনের কথা তো কোন পাগলই বলতে পারে অথবা একজন আস্ত নিলর্জ্জই বলতে পারে। এ কারণে মির্যা ক্বাদিয়ানীর এসব অবাস্তব দাবী দেখে স্বয়ং তার অনুসারীরাও লজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, একটি দল এমন আছে যারা তাকে নবী হিসেবে মেনে নেয় (মা‘আযাল্লাহ)। আরও একটি দল আছে, যারা তাকে নবী মানে না, বরং তার জন্য পূর্ণ রূপে মাথাও ঝুকায় না। সুতরাং একথা সুস্পষ্ট হলো যে, যখন যারা তাকে মানে, তারাও একথার উপর একমত নয়, তখন অন্যরা মানা, না মানার প্রশ্ন থাকছে কোথায়?
পরিশেষে, যেসব হতভাগা ও বিবেকের অন্ধ মির্যা ক্বাদিয়ানীকে নবী বলে মানে, তাদেরকে কয়েকটা প্রশ্ন করার প্রয়াস পাচ্ছি-
প্রায় দেড় হাজার বছরের দীর্ঘ সময়ে সর্বশেষ নবী সরওয়ার-ই কাওন ও মকান হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য ও ভালবাসার কল্যাণধারা থেকে উম্মত-ই মুহাম্মাদিয়াহ্ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) থেকে কোন নবী পয়দা হলে তার নাম ও ঠিকানা বলো! এর সাথে এ প্রশ্নেরও জবাব দাও যে, সহীহ্ হাদীস শরীফগুলোতে নবূয়তের ভন্ড দাবীদার ত্রিশজন দাজ্জাল ও মিথ্যাবাদী সম্পর্কে যেই খবর দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী থাকবেনা কেন? তাছাড়া, এ প্রশ্নের জবাবও চাই যে, হাদীস শরীফগুলোর আলোকে মসীহ্-ই মাও‘ঊদ (প্রতিশ্রুত মসীহ্) কি পুনরায় মায়ের গর্ভ থেকে পয়দা হবেন, না কি আসমান থেকে তিনি সোজাসুজি নাযিল হবেন। আর যদি তিনি নাযিল হন, তবে কি তিনি ক্বাদিয়ানে নাযিল হবেন, না দামেস্কের জামে মসজিদের মিনারার উপর তাশরীফ আনবেন?
প্রকাশ থাকে যে, এসব প্রশ্ন দ্বারা আমার উদ্দেশ্য কোন দীর্ঘ আলোচনা ও মুনাযারার দরজা উন্মুক্ত করা নয়; কেননা, আলোচনার প্রশ্ন ওখানে ওঠে যেখানে, মাঝখানে দলীল-যুক্তির হাত থাকে, বাতাসের উপর পুল নির্মাণের কল্পনাকারীদের সাথে আলোচনা করবে কোন্ পাগল? বরং আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধু এটাই যে, যেসব লোক ভুল বুঝে কিংবা তাদের বাপদাদার অন্ধ অনুসরণে একটি কাল্পনিক কিচ্ছা-কাহিনী অথবা এক উন্মাদের প্রলাপকে ‘ধর্ম’ মনে করে বিশ্বাস করে বসেছে, তাদেরকে বাস্তব ও সঠিক বিষয় অনুধাবনের দিকে আহ্বান করা। আর তারাও যেন এসব প্রশ্নের আলোকে সত্যের অনুসন্ধানের জন্য দাঁড়িয়ে যায়।

ক্বাদিয়ানী মতবাদ ও ব্রিটিশ সরকার

ঐতিহাসিকভাবে এ বাস্তবতা এতই স্পষ্ট হয়েছে যে, এখন তাতে এ মর্মে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ক্বাদিয়ানী মতবাদের জন্ম বৃটিশ সরকারের কোলেই হয়েছে। আর বৃটিশ সরকারেরই পৃষ্ঠপোষকতায় সেটা লালিত-পালিত হয়েছে। ইংরেজগণ তাদের করায়ত্বের তথাকথিত নবীকে দু’টি উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলোঃ
প্রথম উদ্দেশ্য এ ছিলো যে, খতমে নুবূয়তের যেই আক্বীদা ক্বোরআন মজীদ থেকে প্রমাণিত, সেটাকে এক নতুন নবী (!) পাঠিয়ে মিথ্যা ও ভুল বলে প্রমাণ করার অপচেষ্টা, আর সমগ্র দুনিয়ায় একথা প্রসিদ্ধ করে দেওয়া যে, ক্বোরআনে বর্ণিত কথা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। (না‘ঊযুবিল্লাহ্) আর এ অজুহাতে একথা প্রচার করার অপচেষ্টা যে, ক্বোরআন আল্লাহর কিতাব নয়; কেননা আল্লাহ্ তা‘আলার কথা ভুল হতে পারে না।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য এ ছিলো যে, নবীর মুখে ও লেখনী থেকে যে কথা বের হয়, দুনিয়া সেটাকে ‘ওহী’ মনে করে কোনরূপ আপত্তি ছাড়া গ্রহণ করে নেয়। সুতরাং এমন এক নবী প্রেরণ করা হোক, যে বৃটিশ সরকারের ক্বসীদা বা প্রশংসা গাঁথা কবিতা আবৃত্তি করতে থাকবে, ফলশ্রুতিতে তারা মুসলমানদেরকে মানসিকভাবে বৃটিশ সরকারের গোলাম বানিয়ে রাখবে আর মুসলমানদের মধ্য থেকে জিহাদের প্রেরণা ও উদ্দীপনা খতম করা যাবে। এ’তে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের দিক থেকে জিহাদ ও বিদ্রোহের সম্ভাবনা চিরতরে খতম হয়ে যাবে।
এসব কথার পক্ষে প্রমাণের জন্য আমাদেরকে বাইরে কোথাও গিয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ অন্বেষণ করার প্রয়োজন নেই, খোদ্ মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী তার কলম দ্বারা এসব কথার পক্ষে প্রমাণ সরবরাহ করেছে। কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব ছাড়া, সত্য অনুধাবনের মন-মানসিকতা নিয়ে মির্যা ক্বাদিয়ানীর নি¤œলিখিত লেখনী পড়ুন! আপন মুনিব বৃটিশ সরকারের প্রশংসা করে মির্যা ক্বাদিয়ানী লিখেছে-
میں اپنے کام کو نہ مکہ میں اچھی طرح چلا سکتا ہوں نہ مدینے میں نہ روم میں نہ شام میں
نہ ایران میں نہ کابل میں ـ مگر اس گورنمنٹ میں جس كے اقبال کیلئے دعا کرتاہوں –
(اشتہار مرزاجی مندرجہ تبلیغ رسالت;ج ৬: صفحہ৬৯)
অর্থঃ আমি আমার কাজ না মক্কায় উত্তমরূপে করতে পারি, না মদীনায়, না সিরিয়ায়, না ইরানে, না কাবুলে, কিন্তু এ (ইংরেজ) সরকারের দেশেই (একমাত্র তা উত্তমরূপে সমাধা করতে পারি), যার উন্নতির জন্য আমি দো‘আ করি। [সূত্রঃ মির্যাজীর রিসালত প্রচার : ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ.৬৯, এর বরাতে প্রচারপত্র] মির্যা ক্বাদিয়ানীর আরেকটি প্রচারপত্র পড়–ন! সে তাতে তার মদদদাতার অমনযোগিতার অভিযোগ সে কত দুঃখজনক সুরে করেছে-
بارہا بے اختیار دل میں یہ بھی خیال گزرا ہے کہ جس گورنمنٹ کی اطاعت اور خدمت گزاری کی نیت سے ہم نے کئ کتابیں مخالف جہاد اور گورنمنٹ کی اطاعت میں لکھ کر دنیا میں شائع کیں اور کافر وغیرہ اپنے نام رکھوائے اسی گورنمنٹ کو اب تک معلوم نہیں کہ ہم دن رات کیا خدمت کررہے ہیںـ میں یقین رکھتاہوں کہ ایک دن یہ گورنمنٹ عالیہ میری خدمات کی قدر کریگی (تبليغ رسالت ج- ১০ -صفحہ ২৮)
অর্থঃ অনেকবার আমার লাগামহীন হৃদয়ে এ ধারণা-কল্পনাও এসেছে যে, যে সরকারের আনুগত্য ও সেবার মানসে আমি কেয়কটা বই-পুস্তক জিহাদের বিরুদ্ধে ও সরকারের আনুগত্যের পক্ষে লিখে দুনিয়াব্যাপী প্রচার করেছি আর নিজের নাম ‘কাফির’ ইত্যাদি রাখিয়েছি, ওই সরকারের এখনো জানা নেই যে, আমি দিনরাত কত খিদমত করে যাচ্ছি! তবুও আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, একদিন এ মহান সরকার আমার খিদমতগুলোর মূল্যায়ন করবে।
[সূত্র. তাবলীগে রিসালত: ১০ম খন্ড, পৃ. ২৮] ষাট বর্ষপূর্তি উদ্যাপনের সময় মির্যা ক্বাদিয়ানী বৃটেনের রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতি এক অভিনন্দন/শুভেচ্ছাপত্র লিখেছিলো। সেটার জবাব না পেয়ে সে যেই মানসিক অস্থিরতায় ভুগেছিলো, তার বর্ণনা দেখুন-
اس عاجزکو وہ اعلی درجہ کا اخلاص اور محبت اور جوش اطاعت جو حضور ملکہء معظمہ اور اس کے معزز افسروں کی نسبت حاصل ہے جو میں ایسے الفاظ نہیں پاتا جن میں اس اخلاص کا اندازہ بیان کرسکوں اس سچی محبت اور اخلاص کی تحریک سے جشن شصت سالہ جو بلی کی تقریب پر میں نے ایک رسالہ حضرت قیصرۃ ہند (۱) اقبالہا کے نام سے تالیف کرکے اور اس کا نام تحفئه قیصریہ رکھ کر جناب ممدوحہ کی خدمت میں بطور درذیشانہ تحفہ کے ارسال کیا تھا اور مجھے قوی یقین تھا کہ اس کے جواب سے مجھے عزت دی جائیگی اور امید سے بڑھ کر میری سرفرازی کا موجب ہوگا مگر مجھے نہایت تعجب ہے کہ ایک کلمه شاہانہ سے بھی ممنون نہیں کیا گیا (ستارئه قیصرہ صفحہ ۲ مصنفہ مرزاغلام احمد قادیانی)
অর্থঃ এ অক্ষমের মধ্যে ওই উচ্চতর স্তরের নিষ্ঠা, ভালবাসা এবং আনুগত্যের জোশ, যা সম্মানিত রাণী ও তাঁর সম্মানিত অফিসারদের প্রতি অর্জিত হয়েছে, বর্ণনার জন্য আমি এমন শব্দাবলী পাচ্ছিনা, যেগুলোতে এ নিষ্ঠার পরিমাণ বর্ণনা করতে পারবো এবং ওই ভালবাসা, নিষ্ঠার অনুমান-আন্দাজ করা যেতে পারে। এ সাচ্চা ভালবাসা ও নিষ্ঠার উচ্ছ্বাস সহকারে ষাটতম জুবিলী উপলক্ষে আমি একটি পুস্তিকা হযরত ‘ক্বায়সারাহ্-ই হিন্দ’ (ভারতের স¤্রাজ্ঞী)’র নামে রচনা করে এবং সেটার নাম ‘তোহফা-ই ক্বায়সারিয়্যাহ্’ রেখে শ্রদ্ধেয়া রাণীর দরবারে তোহফা হিসেবে প্রেরণ করেছিলাম। আর আমার মধ্যে অতিমাত্রায় ইয়াক্বীন (বিশ্বাস) ছিলো যে, সেটার উত্তর দিয়ে আমার সম্মান করা হবে, আমার আশা অপেক্ষাও বেশী পুরস্কৃত করা হবে; কিন্তু আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম যে, আমাকে একটি রাজকীয় শব্দ দ্বারাও উপকৃত করা হয়নি। [সেতারাহ্-ই ক্বায়সারাহ্: পৃ. ২, লেখক মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী]

মির্যা ক্বাদিয়ানীর উপরিউক্ত লেখনী থেকে একথা অতি উত্তমরূপে স্পষ্ট হলো যে, ক্বাদিয়ানী মতবাদের সাথে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষক সুলভ সম্পর্ক কেমন ছিলো আর কেমন গভীর বিনয়ের প্রেরণার সাথে সে তার বানোয়াট ও বাতিল নুবূয়তকে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য ইংরেজ সরকারের থালা লেহন করেছিলো। এখন হতভম্ব নয়ন যুগল খুলে খতমে নুবূয়তের আক্বীদার বিরুদ্ধে ইংরেজদের নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের আরেক হৃদয় বিদারক কাহিনী দেখুন সেটার শিরোনাম নিম্নরূপঃ

দেওবন্দ ও ক্বাদিয়ান
ক্বাদিয়ান থেকে একজন ভন্ড নবী দাঁড় করানো এবং তার আহ্বানকে ব্যাপকতর করার জন্য যেখানে ইংরেজগণ তাদের সরকারী মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেছে, সেখানে জ্ঞানগত ও চিন্তাগতভাবে নতুন নুবূয়তের রাস্তা সুগম করার জন্য শীর্ষস্থানীয় দেওবন্দীদের জ্ঞানগত ও ধর্মীয় প্রভাবাদিকেও কাজে লাগিয়েছে। এ সংক্রান্ত কথার ব্যাখ্যা এযে, কোন নতুন নুবূয়তের রাস্তায় খতমে নুবূয়তের এ ক্বোরআনী আক্বীদা সর্বদা বাধা হয়ে এসেছে। আর এ প্রসঙ্গে সঠিক আক্বীদা হচ্ছে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী); তাঁর পরে কোন নতুন নবী পয়দা হতে পারে না।
এখন নতুন নুবূয়তের পথে ক্বোরআনের দিক থেকে যে বাধা দন্ডায়মান ছিলো, সেটাকে দূরীভূত করার জন্য দু’টি রাস্তা ছিলো, হয়তো ক্বোরআনের ওই আয়াতকে বদলে ফেলা, যা’তে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্টভাবে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর শব্দ দু’টি মওজূদ রয়েছে, যার অর্থ ‘আখেরী নবী’ অথবা অতঃপর ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর শব্দ দু’টি যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে, সেগুলোর অর্থ বদলে ফেলা।

প্রথম রাস্তাটি সম্ভব ছিলো না। কারণ ভূ-পৃষ্ঠের উপর পবিত্র ক্বোরআনের কোটি কোটি নোসখা (কপি) এবং লাখো হাফিযে ক্বোরআন মওজূদ ছিলো এবং আছে। শাব্দিক পরিবর্তন গোপন করলেও গোপন থাকবে না। এজন্য অর্থগত পরিবর্তনের রাস্তা অবলম্বন করা হয়েছে। আর তারা বসে সিদ্ধান্ত নিলো যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দ দু’টির অর্থ ‘আখেরী নবী’কে, যা সাহাবা-ই কেরামের যুগ থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত সমগ্র উম্মতে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত, বদলে ফেলা হবে আর ওই শব্দ দু’টির ওই অর্থ তালাশ করা হবে, যা কোন নতুন নবী আসার ক্ষেত্রে বাধা হবে না। সুতরাং পথ থেকে এ পাথর অপসারণের জন্য ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মৌঃ ক্বাসেম নানূতবীর তথাকথিত সেবাকর্ম হাসিল করা হয়েছে। আমি নিজ থেকে তার বিরুদ্ধে কোন দোষ চাপিয়ে দিচ্ছি না, বরং খোদ্ এক ক্বাদিয়ানী পুস্তক রচয়িতা তার পুস্তক ‘ইফাদাতে ক্বাসেমিয়াহ’য় পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিতভাবে ঘটনা বর্ণনা করেছে। এ পুস্তক বছরের পর বছর ধরে ছাপানো হচ্ছে; কিন্তু দেওবন্দ থেকে এ পর্যন্ত কোন খন্ডন প্রকাশ করা হয়নি, যা থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, ‘ক্বাদিয়ানীর দিক থেকে নানূতবী সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রচনা করা হয়েছে।’
এখন ক্বাদিয়ানী লেখক আবুল আত্বা জালন্ধরীর এ ইবারতের একেকটা লাইন গভীর মনযোগ সহকারে পড়–ন এবং মেধা ও চিন্তার সর্বনি¤œ স্তরে নেমে অতি গোপন ষড়যন্ত্রের হদিস বের করুন-
یوں محسوس ہوتاہے کہ چودھویں صدی کے سر پر آنے والا مجدد وامام مہدی اور مسیح موعود بھی تھا اور اسے امتی نبوت کے مقام سے سرفراز کیا جانے والاتھا -اس لئے اللہ تعالٰی نے اپنی خاص مصلحت سے حضرت مولوی محمد قاسم صاحب نانوتوی (بانی دار العلوم دیوبند ) کو خاتمیت محمدیہ کے اصل مفہوم کی وضاحت کے لئے رہ نمائی فرمائی اور آپ نے اپنی کتابوں اور اپنے بیانات میں آنحضرت صلی اللہ علیہ وسلم کے خاتم النبیین ہونے کی نہایت دل کش تشریح فرمائی-بلاشبہ آپ کی کتاب تحذیر الناس اس موضوع پر خاص اہمیت رکھتی ہے –
(افادات قاسمیہ صفحہ -۱ مطبوعہ ربوہ -پاکستان)
অর্থঃ এমন অনুভূত হচ্ছে যে, চতুর্দশ শতাব্দির মাথায় আগমনকারী মুজাদ্দিদ ইমাম মাহদী এবং প্রতিশ্রুত মসীহও ছিলো। আর তাকে ‘উম্মতী নুবূয়ত’-এর আসনে আসীন করে ধন্য করার ছিলো। এ জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা আপন বিশেষ স্বার্থে হযরত মৌলভী মুহাম্মদ ক্বাসেম সাহেব নানূতভী (প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলূম, দেওবন্দ)-কে ‘খাতামিয়াত-ই মুহাম্মাদিয়াহ্’ (হযরত মুহাম্মদ শেষ নবী হবার) আসল অর্থ সুস্পষ্ট করার জন্য পথ-প্রদর্শন করেছেন। আর তিনিও তাঁর কিতাবগুলো এবং বক্তব্যগুলোতে আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী) হবার হৃদয়গ্রাহী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তাঁর কিতাব ‘তাহযীরুন্ নাস’ এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব রাখে। [ইফাদাত-ই ক্বাসেমিয়্যাহ্: পৃ.-১, রাব্ওয়াহ, পাকিস্তান-এ মুদ্রিত] دیکھ رہے ہیں آپ ساحران افرنگ کا یہ تماشا!
অর্থঃ আপনারা দেখছেন তো ইংরেজ যাদুকরদের এ তামাশা! কতই চতুরতার সাথে এক অতি লজ্জাজনক ষড়যন্ত্রকে ‘ইলহাম’ (খোদায়ী প্রেরণা)’র রং দেওয়া হচ্ছে? তারা এমনভাবে দেখাচ্ছে যেন এসব ব্যবস্থাপনা সর্বশক্তিমান খোদা তা‘আলার পক্ষ থেকেই ছিলো! অর্থাৎ মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর ভন্ড নুবূয়তের দাবীর পূর্বে নানূতভী যেন ‘তাহযীরুন্ নাস’ নামের একটি পুস্তক লিখে আর তাতে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ ‘আখেরী নবী’ কে অস্বীকার করে এক নতুন নবীর আগমনের জন্য রাস্তা সুগম করে দেয়। নানূতভী তার কিতাব (পুস্তক) ‘তাহযীরুন্ নাস’-এ একথার পরিপূর্ণ চেষ্টা করেছে যেন ‘সাপও মরে যায়, লাঠিও না ভাঙ্গে’। অর্থাৎ ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দের অস্বীকৃতিও প্রকাশ না পায়; নতুন নবীর আগমনের জন্য রাস্তাও সুগম হয়ে যায়; যাতে ইংরেজদের নিমকের হক্বও আদায় হয়ে যায়, মুসলমানদেরকেও যেন ধোঁকা-প্রতারণার শিকার করে রাখা যায়। আর যাতে তারা একথাও বলতে পারে, ‘আমরা তো খতমে নুবূয়তের অস্বীকার করছিনা।’
পক্ষান্তরে, আল্লাহ্ তা‘আলা শুভ প্রতিদান দিন ওইসব সত্যপন্থী আলিমকে, যাঁরা ‘তাহযীরুন্ নাস’-এর ধোঁকার পর্দা ছিঁড়ে ফেলেন, ‘খতমে নুবূয়ত’ আর আক্বীদার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রকে সবসময়ের জন্য ফাঁশ করে দিয়েছেন।
সম্মানিত পাঠকগণ, আপনারা যদি একথা জানতে চান যে, ‘তাহযীরুন্ নাস’ নামক কিতাব বা পুস্তকে কি আছে? ক্বাদিয়ানী লেখকগণ এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ কেন? আর এ কিতাব দ্বারা নানূতভী নতুন নবীর আগমনের জন্য পথ কিভাবে সুগম করলো? তাহলে সব ধরনের পক্ষপাতিত্ব থেকে ঊর্ধ্বে উঠে, অতি সরল মন নিয়ে সামনে কৃত আলোচনা পড়–ন! ষড়যন্ত্রের এ কাহিনী অতি দীর্ঘ এবং অতি ধোঁকাপূর্ণ!

‘তাহ্যীরুন্ নাস’-এর ধোঁকাপূর্ণ ষড়যন্ত্রের কাহিনী
আমরা নিজেদের পক্ষ থেকে এ প্রসঙ্গে কিছুই না বলে এ পূর্ণ কাহিনী ক্বাদিয়ানী লেখকদের মুখ তথা লেখনী থেকে শুনুন/দেখুন! ভূমিকা স্বরূপ এক ক্বাদিয়ানী লেখক এ কাহিনীর সূচনা করেছে। তার বক্তব্য হচ্ছে-
بعض لوگ یہ خیال کرتے ہیں کہ احمدی (یعنی قادیانی) ختم نبوت کے قائل نہیں ہیں اور رسول کریم ﷺ کو خاتم النبیین نہیں مانتے – یہ مخص دھوکے اور ناواقفیت کا نتیجہ ہے -جب احمدی اپنے آپ کو مسلمان کہتے ہیں اور کلمهء شہادت پر یقین رکھتے ہیں تو یہ کیونکر ہوسکتاہے کہ وہ ختم نبوت کے منکر ہوں اور رسول کریم ﷺ کو خاتم النبیین نہ مانیں ؟
قرآن کریم میں صاف طور پر اللہ تعالٰی فرماتاہے -وَخَاتَمَ النَّبِیِّینَ – (سورہ احزاب : آیت ৩০) یعنی محمد رسول اللہ ﷺ تم میں سے نه کسی جوان مرد کے باپ ہیں نہ آئندہ ہونگے لیکن اللہ تعالٰی کے رسول اور خاتم النبیین هیں ـقرآن کریم پر ایمان رکھنے والا آدمی اس آیت کا انکار کس طرح کرسکتاہے -پس احمدیوں کا ہرگز یہ عقیدہ نہیں ہے کہ رسول کریم ﷺ (نعوذباللہ) خاتم النبیین نہیں تھے –
অর্থঃ কিছুলোক মনে করে যে, আহমদী (অর্থাৎ ক্বাদিয়ানী ফির্ক্বার লোকেরা) ‘খতমে নুবূয়তে’ বিশ্বাসী নয় বরং রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ মানে না। এটা অত্যন্ত ধোঁকা ও অজ্ঞতার ফলশ্রুতি। যখন আহমদীরা নিজেরা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করে এবং কলেমা-ই শাহাদতে বিশ্বাসী, তখন এটা কিভাবে হতে পারে যে, তারা খতমে নুবূয়তে বিশ্বাস করে না? আর রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ মানে না?
ক্বোরআন করীমে পরিষ্কার ভাষায় এরশাদ হয়েছে- ‘মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ তোমাদের মধ্যে কোন যুবক পুরুষের পিতা নন। (না আগামীতেও হবেন), কিন্তু তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার রসূল ও ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী)।
ক্বোরআন করীমের উপর ঈমান রাখে এমন মানুষ এ আয়াতে করীমাকে অস্বীকার কীভাবে করতে পারে? সুতরাং আহমদীদের মোটেই এ আক্বীদা নয় যে, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, না‘ঊযুবিল্লাহ্, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ ছিলেন না।
جو کچھ احمدی کہتے ہیں وہ صرف يه کہ خاتم النبیین کے وہ معنی جو اس وقت مسلمانوں میں رائج ہیں نہ توقرآن کریم کی مذکورہ بالا آیت پر چسپان ہوتے ہیں اورنہ ان سے رسول کریم ﷺ کی عزت اور شان اس طرح ظاہر ہوتی ہے جس عزت اور شان کی طرف اس آیت میں اشارہ کیا گیاہے – (پیغام احمدیت -صفحہ ۱۰ (
অর্থঃ যা কিছু আহমদিরা বলে, তা শুধু এ যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর ওই অর্থ, যা এ সময়ে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত আছে, না ক্বোরআনে করীমের উপরিউল্লিখিত আয়াতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, না তা থেকে রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইয্যাত ও শান এভাবে প্রকাশ পায়, যেই ইয্যাত ও শানের দিকে এ আয়াতে ইশারা করা হয়েছে। [পয়গামে আহমদিয়াত: পৃ. ১০]

উপরিউক্ত ইবারত বা বচনের লাইনগুলো সহকারে আরো একবার গভীরভাবে পড়–ন! আলোচনার এ অংশটাই ষড়যন্ত্রের বুনিয়াদ। এখন থেকেই ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর ওই অর্থের অস্বীকারের রাস্তা খুলেছে, যা নতুন নবীর পথে বাধা।
উপরোক্ত ইবারতের আলোকে ক্বাদিয়ানীদের এ দাবী অতি উত্তমরূপে আপনাদের হৃদয়ঙ্গম হবে যে, তারা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ হবার বিষয়টি অস্বীকার করছে না, বরং ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর ওই অর্থ অস্বীকার করছে, যা আম মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত। আর এ অস্বীকারের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে ‘খতমে নুবূয়তের’ অস্বীকারকারী বলা হয়।
এখন এটা দেখতে হবে যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর ওই কোন্ অর্থ, যা আম মুসলমানদের নিকট প্রচলিত? আর সর্বপ্রথম এ অর্থের অস্বীকার কে করেছে? এতটুকু বিস্তারিত আলোচনার পর এখন চতুর্দিক থেকে মনকে মুক্ত করে ‘তাহযীরুন নাস’-এর লেখক মৌং মুহাম্মদ কাসেম নানূতভীর কর্মকান্ড সম্পর্কে এক ক্বাদিয়ানী লেখকের এ বর্ণনা পড়–ন আর ‘খতমে নুবূয়ত’-এর আক্বীদার অস্বীকারের ধারাবাহিকতায় আসল অপরাধী কে তার হদিস বের করুন!
ওই ক্বাদিয়ানী লেখকের বক্তব্য হচ্ছে-
تمام مسلمان فرقوں کا اس پر اتفاق ہے کہ سرورکائنات حضرت محمد مصطفے ﷺ خاتم النبیین ہیں -کیونکہ قرآن مجید کی نص وَلَکِن رَّسُولَ اللہِ وَخَاتَمَ النَّبِیینَ میں آپ کو خاتم النبیین قرار دیاگیاہے -نیز اس امر پر بھی تمام مسلمانوں کا اتفاق ہے کہ حضور علیہ الصلواۃ والسلام کے لئے لفظ خاتم النبیین بطور مدح وفضیلت ذکر ہواہے -اب سوال صرف یہ ہے کہ لفظ خاتَمُ النَّبِیِّینَ کے کیا معنی ہیں- -یقینًا اسکے معنی ایسے هی ہونی چاہئے جن سے آنحضرت صلى الله عليه وسلم كي فضيلت اور مدح ثابت ہو-
اس بناپر حضرت مولوی محمد قاسم صاحب نانوتوی بانی مدرسہ دیوبند نے عوام کے معنوں کو نادرست قرار دیاہے- آپ تحریر فرماتے ہیں -عوام کے خیال میں تو رسول اللہ ﷺ کا خاتم ہونا بایں معنی ہے کہ آپ کا زمانہ انبیاء سابق کے زمانے کے بعد ہے اور آپ سب میں آخری نبی ہیں – مگر اہل فہم پر روشن ہوگا کہ تقدم اور تاخرزمانی میں بالذات کچھ فضیلت نہیں -پھر مقام مدح میں ولکن رسول اللہ وخاتم النبیین فرمایا – اس صورت میں کیونکرصحیح ہوسکتاہے -(تحذیر الناس صفحہ ۳اوررسالۃ خاتم النبیین کے بہترین معنی صفحہ ۴ شائع کردہ قادیانی)

অর্থঃ মুসলমানদের মধ্যে সকল দল উপদল একথার উপর একমত যে, সরওয়ার-ই কায়েনাত হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’। কেননা, ক্বোরআন মজীদের ‘নাস্’ (বর্ণনা) وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ -এর মধ্যে তাঁকে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাছাড়া একথার উপরও সমস্ত মুসলমানের ঐকমত্য রয়েছে যে, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর জন্য ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দ দু’টি প্রশংসা ও ফযীলতরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন শুধু এটাই যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দ দু’টির অর্থ কি? নিশ্চয় এ দু’টির অর্থ এমন হওয়া চাই, যা দ্বারা আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফযীলত ও প্রশংসা প্রমাণিত হয়।
এতদ্ভিত্তিতে হযরত মৌলভী মুহাম্মদ ক্বাসেম সাহেব নানূতভী, দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, সাধারণ লোকদের কৃত অর্থকে অশুদ্ধ সাব্যস্ত করেছেন, তিনি লিখেছেন- ‘আওয়াম (সাধারণ লোক)-এর ধারণায় তো রসূলুল্লাহ্ সাল‘আম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ হওয়া এ অর্থে যে, তাঁর যমানা (যুগ) পূর্ববর্তী নবীগণের পর আর তিনি সবার মধ্যে সর্বশেষ নবী; কিন্তু বিশেষ উল্লেখযোগ্য বুঝশক্তিসম্পন্নদের নিকট একথা সুস্পষ্ট হবে যে, যমানা (যুগ) আগে/পরে হবার মধ্যে স্বত্ত্বাগতভাবে কোন ফযীলত নেই। তারপর প্রশংসার স্থলে وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ এরশাদ করেছেন। এটা এমতাবস্থায় কীভাবে শুদ্ধ হতে পারে? [তাহযীরুন্ নাস: পৃ. ৩, রিসালা-ই খাতামুন্ নবিয়্যীন কে বেহতরীন মা’না: পৃ.৪, কাদিয়ান থেকে প্রকাশিত]

সহজ শব্দাবলীতে নানূতবী সাহেবের এ ইবারতের মর্মার্থ এ যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দ দু’টির অর্থ ‘আখেরী নবী’ সাব্যস্ত করা মুর্খ আওয়ামের ধারণা, যা কোন মতেই বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখার উপযোগী নয়। বুঝ শক্তি সম্পন্ন শ্রেণীর লোকেরা এ শব্দ দু’টির অর্থ ‘আখেরী নবী’ মনে করেন না। কেননা যমানা অনুসারে কারো পূর্বে আসা অথবা পরবর্তীতে আসা কোন বিশেষ প্রশংসা ও ফযীলতের বিষয় নয়। এ শব্দ দু’টির অর্থ ‘আখেরী নবী’ সাব্যস্ত করার মধ্যে যেহেতু হুযূর-ই আক্রামের কোন খাস ফযীলত বের হয় না, সেহেতু এ অর্থ যদি নেওয়া হয়, তবে প্রশংসার স্থলে وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ উল্লেখ করা নিষ্ফল হয়ে যাবে।
গভীরভাবে লক্ষ্য করুন! প্রায় দেড় হাজার বছরের দীর্ঘ সময়-সীমায়, সাহাবা-ই কেরামের যুগ থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে সমগ্র উম্মতের একথার উপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ আখেরী নবী। এ শব্দ যুগল দ্বারা যদি হুযূর-ই আক্রামকে ‘আখেরী নবী’ না মানা হয়, তবে নতুন নবীর আগমনের পথ কোন দলীল দ্বারা বন্ধ করা যাবে?
সমগ্র উম্মতের মধ্যে নানূতবী সাহেব ওই প্রথম ব্যক্তি, যে ইংরেজদের নিমক হালালী করার জন্য হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আখেরী নবী মানতে অস্বীকার করেছে; যাতে ক্বাদিয়ান থেকে এক নতুন নবীর আগমনের জন্য পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।
নানূতবী সাহেবের সমর্থকদের মুখ বন্ধ করার জন্য আমি এ মাসআলায় তারই ঘরের এক মজবুত সাক্ষ্য পেশ করার প্রয়াস পাচ্ছি। দেওবন্দী জমা‘আতের নির্ভরযোগ্য উকিল মৌং মনযূর নো’মানী তার পুস্তক ‘ইরানী ইনক্বিলাব’-এ লিখেছেন-
یہ عقیدہ کہ نبوت کا سلسلہ ختم نہیں ہوا ، رسول للہ ﷺ کے بعد بھی کوئی نبی آسکتاہے – ان آیات قرآنی اور احادیث متواتر ہ کی تکذیب هے جن میں رسول اللہ ﷺ کا خاتم النبیین اور آخری نبی ہونا بیان فرمایا گیا -(ايرانی انقلاب صفحہ۱ ۸)
অর্থঃ নবী আসার পরম্পরা (সিলসিলাহ্) খতম হয়নি, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরও কোন নবী আসতে পারে বলে বিশ্বাস করা ক্বোরআনের ওইসব আয়াত ও মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসসমূহকে অস্বীকার করার নামান্তর, যেগুলোতে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খাতামুন্ নবিয়্যীন বা আখেরী নবী হবার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। [ইরানী ইন্ক্বিলাব: পৃ.-৮১] এ ইবারত উচ্চস্বরে বলছে যে, যে ব্যক্তি হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আখেরী নবী মানে না, সে ক্বোরআনের বহু আয়াত ও মুতাওয়াতির পর্যায়ের বহু হাদীসকে অস্বীকার করে আর অন্য ভাষায় নতুন নবীর আগমনের দরজা খোলা রাখতে চাচ্ছে।
এটাও নাকি ওই মূল্যবান খিদমত, যার পুরষ্কার স্বরূপ ক্বাদিয়ানী জমা‘আতের দিক থেকে মৌং ক্বাসেম নানূতভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হচ্ছে! যেমন এক ক্বাদিয়ানী লেখক লিখেছে-
جماعت احمدیہ خاتم النبیین کے معنوں کی تشریح میں اسی مسلک پر قائم ہے جو ہم نے مسطور بالا میں جناب مولوی محمد قاسم نانوتوی کے حوالہ جات سے ذکر کیا ہے –
(افادات قاسمیہ صفحہ۶ ۱)
অর্থঃ আহমদিয়া জমা‘আত, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থের ব্যাখ্যায়, ওই মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আমি উপরোক্ত লাইনগুলোতে জনাব মৌলভী কাসেম নানূতভীর বরাতে উল্লেখ করেছি। [ইফাদাতে ক্বাসেমিয়াহ: পৃ.১৬] এক মা’মূলী মন-মানসিকতার মানুষও এতটুকু কথা সহজে বুঝতে পারে যে, কেউ তার বিরোধী মতবাদের উপর ক্বায়েম থাকার অঙ্গিকার মোটেই করতে পারে না। পেছনে পেছনে চলার নিষ্ঠাপূর্ণ প্রেরণা ওই ব্যক্তির অন্তরে সৃষ্টি হতে পারে, যাকে নিজের সফরসঙ্গী ও নেতা মনে করা হয়।

একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ
ইতোপূর্বে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থের পরম্পরায় ক্বাদিয়ানী লেখকদের ইবারতগুলো আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে আর মৌং কাসেম নানূতভীর ওই লেখনীও আপনারা পড়েছেন, যার সমর্থনে ক্বাদিয়ানী পুস্তক-প্রণেতা ‘তাহযীরুন্ নাস’- থেকে উদ্ধৃত করেছে। এখন ওই ফলাফলে গভীরভাবে দৃষ্টি দিন, যা ওই ইবারতগুলো বিশ্লেষণ করার ফলে সামনে আসে, যাতে এ বাস্তবাবস্থা ও আপনার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, দেওবন্দ ও ক্বাদিয়ানের মধ্যে চিন্তাও দলীল গ্রহণের মধ্যে কত গভীর মিল রয়েছে! আর দেওবন্দ শুধু ওহাবী মতবাদেরই নয় বরং ক্বাদিয়ানী মতবাদেরও ‘মুহসিন-ই আ’যম’ (বড় সমর্থক বরং পৃষ্ঠপোষক)ঃ
১. প্রথম কথা হচ্ছে- ‘‘মাওলানা ক্বাসেম নানূতভীর স্পষ্ট বর্ণনানুসারে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দ দু’টি থেকে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘শেষ নবী’ মনে করা মা‘আযাল্লাহ্, জ্ঞানহীন ও বুঝ শক্তিহীন সাধারণ লোকদেরই প্রথা। উম্মতের সমঝদার পর্যায়ের লোকেরা ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দ দু’টি দ্বারা ‘আখেরী নবী (সর্বশেষ নবী) অর্থ বুঝে না।’’ ওইসব সমঝদার লোকদের মধ্যে একজন মৌং ক্বাসেম নানূতবীও আছে।
২. দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর ঐকমত্যের অর্থকে পরিবর্তিত করে হুযূর-ই আক্রামের আখেরী নবী হওয়াকে অস্বীকার সর্বপ্রথম মৌং ক্বাসেম নানূতভী করেছে। কেননা, ক্বাদিয়ানীরা যদি অস্বীকারের সূচনা করতো, তবে তারা কখনো একথা ঘোষণা করতো না যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থের ব্যাখ্যার ধারাবাহিকতায় আহমদিয়া জামা‘আত (ক্বাদিয়ানী সম্প্রদায়) মৌং ক্বাসেম নানূতভীর মতবাদের উপর ক্বায়েম রয়েছে।
৩. তৃতীয় কথা হচ্ছে- ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ ‘আখেরী নবী’র অস্বীকার করার ধারাবাহিকতায় মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী ও মৌং নানূতভীর চিন্তার ধরণ ও দলীল গ্রহণে পূর্ণ ঐক্য রয়েছে।
সুতরাং ক্বাদিয়ানীদের এখানেও ‘খাতামুন নবিয়্যীন’-এর মূল মর্মার্থকে বিকৃত করার জন্য হুযূর-ই পূরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহা মর্যাদার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আর নানূতভী সাহেবও ‘প্রশংসার স্থান’ বলে আখেরী নবীর অর্থ অস্বীকার করার জন্য হুযূর-ই আক্রামের মহা মর্যাদাকেই বুনিয়াদ বানাচ্ছে।
ওখানেও বলা হয়েছে যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর শব্দ থেকে হুযূর-ই আক্রামকে ‘আখেরী নবী’ মনে করা সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত। আর এখানেও বলা হচ্ছে যে, ‘এ অর্থ সাধারণ মানুষের ধারণারই ফসল।’
এত বিরাট সামঞ্জস্য বা মিলগুলোর পর এখন কে বলতে পারে যে, এ মাসআলায় উভয়ের চিন্তা ও চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু পৃথক পৃথক? দুনিয়া থেকে ন্যায় বিচার যদি চিরতরে বিদায় না নিয়ে থাকে, তবে এ কথা অস্বীকারের অবকাশই নেই যে, ক্বাদিয়ানী ও দেওবন্দী একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ অথবা একই গন্তব্যস্থলের দিকে দু’জন মুসাফির; কেউ তাতে পৌঁছে গেছে, অন্যজন পথে আছে।
সুতরাং ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ মানে ‘আখেরী নবী’ অস্বীকারের ভিত্তির উপর যদি ক্বাদিয়ানী জমা‘আতকে ‘খতমে নুবূয়ত’-এর অস্বীকারকারী বলা বাস্তব হয়, তবে এ অস্বীকারের ভিত্তির উপর দেওবন্দী জামা‘আতকেও ‘খতমে নুবূয়ত’-এর অস্বীকারকারী সাব্যস্ত না করার কোন উপায় নেই।
যদি কেউ দেওবন্দীদের সাফাই গাইতে গিয়ে একথা বলে যে, ‘ক্বাদিয়ানী জামা‘আতের লোকেরাই যেহেতু হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরে কার্যতঃ এক নতুন নবীর অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে, সেহেতু তাদেরকেই ‘খতমে নুবূয়ত’-এর অস্বীকারকারী বলা একেবারে বাস্তব।’ তার জবাবে আমি বলবো, আক্বীদার ক্ষেত্রে এ মতবাদ তো দেওবন্দী জামা‘আতেরও। কারণ তাদেরই কিতাব ‘তাযীরুন্ নাস’-এ লেখা হয়েছে-
اگر بفرض آپ کے زمانے میں بھی کہیں اور نبی ہوجب
بھی آپ کا خاتم ہونا بدستور قائم رهتاہے -(تحذیر الناس صفحہ۲ ۱)
অর্থঃ যদি কল্পনা করা হয় যে, হুযূর-ই আক্রামের যমানায়ও কোথাও অন্য নবী এসে যায়, তবুও তাঁর ‘খাতাম’ (শেষ নবী) হওয়া নিয়ম মাফিক কায়েম থাকে।
[তাযীরুন্ নাস: পৃ.-১২] اگر بفرض بعد زمانئه نبوت صلعم بھی کو ئی نبی پیدا ہوتو پھر
بھی خاتمیت محمدی میں کوئی فرق نہ آئیگا (صفحہ۸ ۲)
অর্থঃ যদি কল্পনা করা হয় যে, নবী করীমের যমানার পরও কোন নবী পয়দা হয়, তবুও হযরত মুহাম্মদের ‘শেষ নবী’ হবার ক্ষেত্রে কোন ক্ষতি হবে না। [প্রাগুক্ত:পৃ.-২৮] গভীরভাবে লক্ষ্য করুন, যখন দেওবন্দী জমা‘আতের নিকটও কোন অসুবিধা ছাড়াই হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন নতুন নবী পয়দা হতে পারে, তখন শুধু ক্বাদিয়ানীদেরই অপরাধ হবে কেন? যে বিষয়টি দেওবন্দীদের মতে জায়েয ও সম্ভবপর ছিলো, তাতো ক্বাদিয়ানীদের দ্বারা সংঘটিত হয়। মূল কুফর তো নতুন নবী আসা বৈধ ও সম্ভবপর মানার সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। যখন তা কুফর থাকেনি, তখন কোন নতুন নবীর দাবীদারকে তার দাবী থেকে বিরত রাখার আমাদের নিকট উপায়ই বা কী রইলো?
কেননা, এ পথে আক্বীদার, যা সর্বাপেক্ষা মজবুত দেয়াল বা অন্তরায় ছিলো, তা তো এটাই ছিলো যে, ক্বোরআন ও হাদীসের ‘নুসূস’ (দলীলগুলো) এবং উম্মতের ইজমা’। যেহেতু হুযূর-ই আক্রাম আখেরী নবী, সেহেতু হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর আর কোন নতুন নবী কখনো পয়দা হতে পারে না; কিন্তু যখন দেওবন্দী জমা‘আতের মতে হুযূর-ই আক্রাম আখেরী নবীও নন, আর কোন নতুন নবী আসলেও হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘খাতামিয়াত’ (শেষ নবী হওয়া)’র মধ্যে কোন বাধা আসবে না, তখন আপনিই ইনসাফ করুন! এখন, বলুন, কোন্ ভিত্তির উপর কোন ভন্ড নুবূয়তের দাবীদারকে তার দাবী থেকে বিরত রাখা যাবে? আর কোন দলীল দ্বারা কোন নতুন ও ভন্ড নবীর উপর ঈমান আনা কুফরী সাব্যস্ত হবে? এ জন্য একথা মানতে হবে যে, বুনিয়াদী প্রশ্ন অনুসারে দেওবন্দী জমা‘আত ও ক্বাদিয়ানী জমা‘আতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আর উপরোক্ত সপ্রমাণ বর্ণনা ও মত প্রকাশের সাথে যদি দেওবন্দী ধর্মের আলিমদের বিরোধ বা দ্বিমত থাকে, তবে তারা যেন প্রকাশ্যে এ কথার ঘোষণা দেয় যে, ‘তাহযীরুন্ নাস’ তাদের পুস্তক (কিতাব) নয়। আর যদি এটা সম্ভবপর না হয়, তবে যেন ‘তাহযীরুন্ নাস’-এ কিতাব, সুন্নাহ ও ইজমা’-ই উম্মত দ্বারা প্রমাণিত যে দু’টি বুনিয়াদী আক্বীদাকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং যার ফলশ্রুতিতে হুযূর খাতেমে পয়গম্বরাঁ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন নতুন নবী (!) আসার দরজা খুলে যায়, সেটার বিরুদ্ধে ফাত্ওয়ার ভাষায় নিজেদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অসন্তুষ্টি বা সম্পর্কহীনতার পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়!
প্রকাশ থাকে যে, ওই দু’টি বুনিয়াদী আক্বীদা, যেগুলো ‘তাযীরুন্ নাস’-এ অস্বীকার করা হয়েছে, ‘নি¤œরূপঃ
প্রথম আক্বীদাঃ ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ মানে আখেরী নবী।
দ্বিতীয় আক্বীদাঃ কোন নতুন নবী আসলে হুযূর-ই আক্রামের ‘খাতামিয়াত’ (শেষ নবী হওয়া) অবশিষ্ট থাকতে পারে না।
কিন্তু আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আছে যে, দেওবন্দী আলিমগণ ‘তাহযীরুন্ নাস’-এর বিরুদ্ধে এ ঘোষণা কখনো দেবে না। কেননা, তারা ইসলামের এ দু’টি বুনিয়াদী আক্বীদা এখনো পোষণ করেনি। মোটকথা, কোন কারণে যদি তারা এমনটি করতে প্রস্তুত না হয়, তবে ইসলামী দুনিয়া ক্বাদিয়ানী জমা‘আতকে যে অপরাধে অপরাধী করছে, ওই অপরাধে দেওবন্দী জমা‘আতকেও অপরাধী সাব্যস্ত করবে।

খতমে নুবূয়তকে অস্বীকার করার অশুভ পরম্পরা!
‘খতমে নুবূয়ত’কে অস্বীকার করার যেই ভিত্তিপ্রস্তর মৌং ক্বাসেম নানূতভী স্থাপন করেছিলো, সেটাকে তাদের পরবর্তীতে আগমনকারীরা শুধু সংরক্ষণই করেনি বরং সেটার উপর দালানও নির্মাণ করে রেখেছে। এ ধারাবাহিকতায় দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাক্তন মুহতামিম ক্বারী ত্বাইয়্যেব সাহেবের কর্মকান্ড সবিশেষ প্রনিধানযোগ্য। তিনি তার দাদাজানের এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার-প্রসারে এমনভাবে সোচ্চার ছিলেন যে, তাকে ঘৃণা করা ও ধিক্কার দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না।
নমুনাস্বরূপ, তার বক্তৃতা-বক্তব্যের কয়েকটা উদ্ধৃতি লক্ষ করুন! যেগুলো দেওবন্দের মুফতীগণ ‘ইনকিশাফ’ নামক পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন। তার বক্তব্যগুলো নি¤œরূপঃ

।। এক।।

نبی کریم ﷺ اس عالم امکان میں سرچشمۃ علوم وکمالات ہیں حتی کہ انبیاء علیہم السلام کی نبوتیں بھی فیض ہیں خاتم النبین کی نبوت کا-درحقیقت حقیقی نبی آپ ہیں -آپ کی نبوت کے فیض سے انبیاء بنتے چلے گئے – (انکشاف مطبوعہ دیوبند صفحہ۴ ۲۶ (
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ নশ্বর জগতে জ্ঞান ও পূর্ণতার উৎস; এমনকি নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর নুবূয়তও ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর নুবূয়তের ফয়য (কল্যাণধারা)’র ফসল। বাস্তবিকপক্ষে প্রকৃত নবী তিনিই। তাঁর নুবূয়তের ফয়য থেকে অন্য নবীগণ হয়ে এসেছেন।
[ইনকিশাফ: দেওবন্দ থেকে মুদ্রিত, পৃ. ২৬৪]

পর্যালোচনা
উপরোক্ত বর্ণনা মতে, যখন প্রকৃত নবী তিনিই (হুযূর-ই আক্রাম), তখন একথা সুস্পষ্ট যে, অন্যান্য নবীগণ মাজাযী নবী (রূপক নবী) ও যিল্লী নবী (ছায়ানবী) হবেন। এটা হচ্ছে ওই ফর্মুলা, যা মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী ‘যিল্লী নবী’, ‘বরূযী নবী’, ‘উম্মতী নবী’ নামে নিজেকে আখ্যায়িত (!) করার জন্য আবিষ্কার করেছিলো।
উপরোক্ত নাপাক বক্তব্য ছাড়াও উক্ত ক্বারী ত্বাইয়্যেব ‘আফতাবে নুবূয়ত’ নামে এ বিষয়বস্তুর উপর একটি পুস্তকও রচনা করেছে, যা পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়। এ’তে এক স্থানে সে বক্তব্য রেখেছে-
حضور کی شان محض نبوت ہی نہیں نکلتی بلکہ نبوت بخش بھی نکلتی ہے کہ جوبھی نبوت کی استعداد پایا ہوافرد آپ کے سامنے آگیا -نبی ہوگیا-(آفتاب نبوت : صفحہ ۱۹)
অর্থঃ হুযূরের শান শুধু নুবূয়তই প্রকাশ পায় না, বরং ‘নুবূয়তদাতা’ও প্রকাশ পায়। সুতরাং নুবূয়তের যোগ্যতা পেয়েছে এমন যে কোন ব্যক্তি তাঁর সামনে এসে গেছে, সে নবী হয়ে গেছে। [আফতাবে নুবূয়ত: পৃ.১৯] এ ইবারতের উপর ‘তাজাল্লী’র সম্পাদক জনাব মাওলানা আমির ওসমানীর পর্যালোচনা দেখুন! বস্তুতঃ এটা পর্যালোচনা নয়; বরং দেওবন্দী জমা‘আতের পিঠের উপর আল্লাহর ক্বহর ও গযবের একটি দৃষ্টান্তমূলক আঘাত স্বরূপ। তিনি লিখেছেন-
قادیانیوں کو اس سے استدلال ملاکہ روح محمدی تو بہر حال فنانہیں ہوئی وہ آج بھی کہیں نہ کہیں موجود ہے -کوئی وجہ نہیں کہ پہلے اس نے ہزاروں انسانوں کو نبوت بخشي تواب نہ بخشے- (تجلی دیوبند : نقدونظر نمبر-৭)
অর্থঃ ক্বাদিয়ানীরা এ থেকে এ মর্মে দলীল পেশ করার সুযোগ পেয়েছে যে, ‘রূহে মুহাম্মদী’ তো কখনো বিলীন হয়নি; বরং সেটা আজও কোন না কোন স্থানে মওজুদ আছে। সুতরাং যেহেতু সেটা ইতোপূর্বে হাজারো মানুষকে নুবূয়ত দান করেছে, সেহেতু এখন কাউকে নুবূয়ত না দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
[সূত্র. তাজাল্লী-ই দেওবন্দ: নক্বদ ও নযর, সংখ্যা-৭] এখন এর সাথে ‘তাজাল্লী’র বরাতে মির্যা আহমদ ক্বাদিয়ানীর এ দাবীও পড়ে নিন, যাতে এ বাস্তবতাও একেবারে স্পষ্টভাবে সামনে এসে যায় যে, দেওবন্দের মুহতামিম সাহেব ‘আফতাবে নবূয়ত’ নামের পুস্তকটি লিখে নেপথ্যে কার নিমককে হালাল করতে চেয়েছেন। মির্যা ক্বাদিয়ানী লিখেছে-
اللہ جل شانہ نے آنحضرت ﷺ کو خاتم بنایا یعنی آپ کو افاضۃ کمال کیلئے مہردی جو کسی اور نبی کو نہیں دی گئی -اس وجہ سے آپ کانام خاتم النبیین ٹھہرا-یعنی آپ کی پیروی کمالات نبوت بخشی ہے اور آپ کی توجہ روحانی نبی تراش ہے اور یہ قوت قدسیہ کسی اور کونہیں ملی- (حقیقۃ الوحی سجوالۃ تجلی :نقدونظر نمبر :৩৭)
অর্থঃ আল্লাহ্ জাল্লা শানুহূ আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘খাতাম’ করেছেন। অর্থাৎ তাঁকে কাউকে পূর্ণতা প্রদানের জন্য মোহর দিয়েছেন, যা অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। এ কারণে তাঁর নাম ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ সাব্যস্ত হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর অনুসরণ ‘নুবূয়তের গুণাবলী দান করেছে’ এবং তাঁর রূহানী তাওয়াজ্জুহ্ (আত্মিক কৃপাদৃষ্টি) নবী বানায়। বস্তুতঃ এ পবিত্র ক্ষমতা অন্য কেউ পায়নি। [হাক্বীক্বতে ওহী: তাজাল্লী নক্বদ ও নযর, সংখ্যা-৭৩ এর বরাতে] এখন একেবারে মধ্যাহ্ণ সূর্যের আলোকে দেওবন্দের মুহতামিম সাহেবের আসল চেহারা দেখতে চাইলে উক্ত মুহতামিম সাহেব ও মির্যা সাহেবের লেখনীগুলোকে এক চৌকাঠের উপর রেখে ‘তাজাল্লী’র সম্পাদকের এ বিস্ফোরণ সম বর্ণনা দেখুন-
حضرت مہتمم صاحب نے حضور کو نبوت بخش کہاتھامیرزا صاحب نبی تراش کہہ رہے ہیں -حرفوں کا فرق ہے معنی کا نہیں-(تجلی نقدونظر نمبر ۷۸)
অর্থঃ হযরত মুহতামিম সাহেব হুযূরকে ‘নুবূয়তবখশ’ (নুবূয়তদাতা) বলেছিলেন, আর মির্যা সাহেব ‘নবীতরাশ (নবী হিসেবে প্রস্তুতকারী) বলছে। শুধু হরফ বা বর্ণের পার্থক্য, অর্থের নয়। [তাজাল্লী: নক্বদ ও নযর সংখ্যা-৭৮]

সম্মানিত পাঠক!
আপনি কি বুঝলেন? তারা বলতে চাচ্ছে, যেভাবে মির্যা সাহেবের আক্বীদা (বিশ্বাস) আছে যে, নুবূয়তের দরজা বন্ধ হয়নি, বরং আজও হুযূর-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ দৃষ্টি নুবূয়তের যোগ্যতাধারী যেকোন মানুষের উপর পড়–ক না কেন, তবে সে নবী হতে পারে।
এভাবে মুহতামিম সাহেবও হুযূরকে ‘নুবূয়ত বখশ’ (নবূয়তদাতা) বলে হুবহু ওই আক্বীদা বা ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি উচ্চারণ করেছেন। বর্ণনা ভঙ্গি ও শব্দাবলীর ব্যবহারে ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু দাবী উভয়ের এক ও অভিন্ন।
প্রকাশ থাকে যে, ‘তাজাল্লী’র সম্পাদকের এ পর্যালোচনা কোন নিছক সমালোচনা নয়; বরং বাস্তবাবস্থার বর্ণনাই। কেননা, উভয়ের চিন্তাধারায় ধরনের মধ্যে এমন বিরাট সামঞ্জস্য রয়েছে যে, উভয়ের মধ্যে কোন বিরোধ-রেখা অঙ্কন করা যায় না।
উদাহরণস্বরূপ, মির্যা ক্বাদিয়ানী তার ভন্ড নুবূয়তের দাবীর বৈধতা প্রকাশার্থে রূপক (মাজাযী), যিল্লী (ছায়া বিশেষ)ও ‘উম্মতী’ (উম্মতরূপী) নবী হবার ফর্মূলা তৈরী করেছিলো, আর মুহতামিম সাহেবের বক্তৃতার যে গুপ্ত মর্মার্থ দেওবন্দের মুফতীগণ ‘ইনকিশাফ’ নামক পুস্তকে পেশ করেছে, তাতে মুহতামিম সাহেবও ওই ফর্মূলার ভাষা ব্যবহার করেছেন যেমন ওই বক্তব্যের একটি প্যারা নি¤œরূপ-
درحقیقت حقیقی نبی آپ ہیں -آپ کی نبوت کے فیض سے انبیاء بنتے چلے گئے
অর্থঃ বাস্তবিকপক্ষে প্রকৃত নবী তিনিই (হুযূর-ই আক্রাম), তাঁর নুবূয়তের ফয়য (কল্যাণধারা) থেকে নবীগণ হয়েই এসেছে।
ভুল পক্ষপাতিত্ব থেকে ঊর্ধ্বে রয়ে ইনসাফ করুন, এটা একেবারে হুবহু মির্যা সাহেবের বক্তব্য (ভাষা) কিনা? ‘বাস্তবিকপক্ষে, প্রকৃত নবী তিনিই’-এর মর্মার্থ এটা ব্যতীত আর কি হতে পারে যে, ‘তিনি ব্যতীত অন্য সব নবী মাযাযী (রূপক) ও যিল্লী (ছায়া) নবী? এটাইতো মির্যা ক্বাদিয়ানী বারংবার বলেছে। আর একথাই মুহতামিম সাহেবও বললেন! উভয় বচনের মধ্যে শুধু শব্দের পার্থক্য হতে পারে, অর্থের নয়।
آپ کی نبوت کے فیض سے انبیاء بنتے چلے گئے
(হুযূর-ই আক্রামের নুবূয়তের কল্যাণ দ্বারা নবীগণ নবী হয়ে এসেছেন)- এ কথাটাও ক্বাদিয়ানীদের ওই দাবীর পক্ষে দৃঢ় সমর্থন যোগাচ্ছে যে, ‘যখন তাঁর নুবূয়তের ফয়য দ্বারা ইতোপূর্বেও নবী হয়ে এসেছেন, তখন এর কোন কারণই নেই যে, এখন এ সিলসিলাহ্ (ধারাবাহিকতা বা পরম্পরা) বন্ধ হয়ে যাবে!’

ছবির সুন্দর অবয়ব!
দেওবন্দ মাদরাসার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে ক্বাদিয়ানী ধর্ম কি পরিমাণ শক্তি পেয়েছে, এ বিষ বৃক্ষ পাতা-পল্লবে ভারী হবার কত সুযোগ তাদের হাতে এসেছে এবং তাদের মনে ভরসা যোগানের জন্য তারা কেমন কেমন ঈমান-বিধ্বংসী লেখনী উপস্থাপন করেছে, এর কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ ইতোপূর্বে আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, এখন বেরিলী শরীফের হিদায়ত বা সঠিক দিক নির্দেশনার একটা ঝলকও দেখে নিন।
ওই বৃটিশ সা¤্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, যার বিশাল পরিধিতে সূর্য অস্ত যেতোনা, না বেরিলী শরীফের ক্ষুরধার কলমকে ক্রয় করতে পেরেছে, না এ ফিৎনার মূলোৎপাটনের ধারাবাহিকতায় ইংরেজ সরকারের ক্ষমতার দাপটের কোন ভয়াতঙ্ক বাধা হতে পেরেছে। এদিকে ফিৎনা জন্ম নিয়েছে, ওদিকে সেনাধ্যক্ষের চলমান সুন্নাত বা নিয়ম হিসেবে মুজাদ্দিদে দ্বীন ও মিল্লাত আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযার অসিরূপী মসি সেটার খাপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এর পূর্ণাঙ্গ ঘটনা মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর ভাষায় দেখুন! এটাকে বস্তুতঃ বন্ধুর নয় বরং শত্রুর স্বীকারোক্তিই বলা যায়।
জনাব নদভী তার পীর ও মুর্শিদ শাহ্ আবদুল ক্বাদির রায়পুরীর এক ঘটনা উদ্ধৃত করতে গিয়ে লিখেছেন-
حضرت نے میرزا صاحب کی تصنیفات میں کہیں پڑھا تھا کہ ان کو خدا کی طرف سے الہام ہوا کہ اُجِیبُ کُلَّ دُعَاءِکَ اِلاَّ فِی شُرَکَاءِکَ ( میں تمهاری ہردعا قبول کرونگا سوا ان دعاؤں کے جو تمہارے شریک داروں کے بارمے ہیں ہو(-
حضرت نے میرزا صاحب کو اسی الہام اور وعدہ کا حوالہ دیکر افضل گڑھ سے خط لکھا – جس میں تحریر فرمایا کہ میري آپ سے کسی طرح كي کبھی شرکت نہیں ہے – اس لئے آپ میری ہدایت اور شرح صدر کے کیلئے دعا کریں -وہاں سے عبد الکریم صاحب کے ہاتھ کالکھاہوا جواب ملاکہ تمہارا خط پہنچا-تمہارے لئے خوب دعا کرائی گئی – تم کبھی کبھی اس کی یاددہانی کردیاکرو-حضرت فرماتے تھے که اس زمانے میں ایک پيسہ کا کارڈتھا- میں تھوڑےتھوڑے وقفے کے بعد ایک کارڑدعا کی ورخواست کا ڈال دیتا-
অর্থঃ হযরত (আবদুল ক্বাদির রায়পুরী) মির্যা সাহেবের লেখনীগুলোর এক জায়গায় পড়েছিলেন, ‘তাকে খোদার তরফ থেকে ইলহাম হয়েছে যে, ‘আমি তোমার প্রত্যেক দো‘আ কবূল করবো ওই দো‘আগুলো ব্যতীত, যেগুলো তোমার শরীকদারদের সম্পর্কে করা হবে’।
হযরত (আবদুল ক্বাদির রায়পুরী) মির্যা সাহেবকে ওই ইলহাম ও ওয়াদার বরাত দিয়ে আফযালগড় থেকে চিঠি লিখলেন। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘‘আপনার সাথে আমার কোনরূপ অংশীদারিত্ব নেই। এ কারণে, আপনি আমার হিদায়ত-প্রাপ্তি ও বক্ষ সম্প্রসারণের জন্য দো‘আ করুন!’’
ওদিক থেকে আবদুল করীম সাহেবের হাতে লিখিত জবাব পেয়েছেন- ‘তোমার চিঠি পৌঁছেছে। তোমার জন্য খুব দো‘আ করা হয়েছে। তুমি কখনো কখনো এটা স্মরণ করিয়ে দিও।’
হযরত (রায়পুরী) বলছিলেন, ‘ওই যুগে এক পয়সায় পোস্টকার্ড পাওয়া যেতো। আমি কিছুদিন পরপর দো‘আর আবেদন জানিয়ে একটি করে কার্ড ডাকবাক্সে ফেলতাম।’
একদা তিনি বলেছেন, মৌলভী আহমদ রেযা খান সাহেব একবার মির্যাঈদের কিতাবগুলো সংগ্রহ করলেন। তাও এ জন্য যে, সেগুলোর খন্ডন লিখবেন। আমিও দেখেছি যে, জনাব আবদুল কাদির সাহেবের হৃদয়ের উপর ক্বাদিয়ানীর চিঠিগুলো এমন প্রভাব ফেলেছিলো যে, তিনি সেদিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। আর এমন মনে হচ্ছিলো যে, তার মতে সে সত্যবাদী ছিলো।
[সাওয়ানিহে হযরত মাওলানা আবদুল ক্বাদির রায়পুরী, পৃ.৫৫-৫৬, লেখক-মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী] এ কিতাবে আরো লেখা হয়েছে যে, কিছুদিন শাহ্ আবদুল ক্বাদির সাহেব আ’লা হযরতের দরবারেও ছিলেন; কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারে আ’লা হযরতের দৃঢ় অবস্থান তার পছন্দ হয়নি। সুতরাং তিনি অন্যত্র চলে গেছেন।
উক্ত ইবারতে একদিকে মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর সাথে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর পীর-মুর্শিদের কর্মকান্ড দেখুন, একজন জঘন্য মিথ্যুক ও ভন্ড নুবূয়তের দাবীদারের সাথে তার কত ভক্তি ও ভালবাসা রয়েছে! আর অন্যদিকে আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাতের ঈমান ও ইয়াক্বীনের অন্তর্দৃষ্টি, সত্য অনুধাবন এবং বাতিল দমনে প্রশস্তমনের দৃঢ়তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ, তিনি বলেছেন যে, আ’লা হযরত দ্বীন-ইসলামের ওই শত্রু মির্যা ক্বাদিয়ানীর খন্ডনের জন্য তার লেখনীগুলো সংগ্রহ করেছিলেন।

—০—

।। দুই।।

আরেকটা তাজা কিতাব
‘খোৎবাতে হাকীমুল ইসলাম’ নামে মুহতামিম (ক্বারী ত্বাইয়্যেব) সাহেবের বক্তব্যগুলোর এক নতুন সংকলন অতি সাম্প্রতিককালে দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ ও ‘খতমে নুবূয়ত’ শিরোনামে মুহতামিম সাহেবের বক্তব্যগুলোর অবস্থা দেখুন! তিনি বলেন-
خاتم النبیین کا مطلب یہ ہے کہ نبوت ،علم اور اخلاق کے جتنے مراتب ہیں
وہ آپ کی ذات بابرکات کے اوپر ختم ہوچکے ہیں
অর্থঃ ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ এ যে, নবূয়ত, জ্ঞান ও চরিত্রের যত উচুঁ স্তর রয়েছে ওই সব ক’টি তাঁর বরকতময় সত্ত্বার উপর খতম হয়েছে।

পর্যালোচনা
তার মতে-
-ختم نبوت کا مفہوم اس اقتباس میں کتنی صفائی کے ساتھ مسخ کیا گیا ہے
(خطبات صفحہ -۴۶-قسط اول)
অর্থঃ খতমে নুবূয়তের মর্মার্থকে এ উদ্ধৃতিতে কতই পরিষ্কারভাবে বিকৃত করা হয়েছে, [খোৎবাত: প্রথম কিস্তি: পৃ. ৪৬] ختم نبوت کا معنی قطع نبوت کا نہیں کہ نبوت قطع ہوگئی ختم کے معنی تکمیل نبوت
یعنی نبوت کامل ہوگئی -(خطبات قسط اور صفحہ ۵۰ (
অর্থ: ‘খতমে নুবূয়ত’ মানে নুবূয়ত বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়, ‘খতম হওয়া’ মানে নুবূয়ত পরিপূর্ণ, অর্থাৎ নুবূয়ত কামিল হয়ে গেছে। [খোৎবাত: প্রথম কিস্তি, পৃ.৫০] আর এখানে পৌঁছে মুহতামিম সাহেব তার চেহারা থেকে মুখোশটুকু একেবারে উন্মুক্ত করে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন-
ختم نبوت کا یہ معنی لینا کہ نبوت کا دروازہ بند ہوگیا ،یہ دنیا کو دھوکا دینا ہے
-(خطبات حکیم الاسلام صفحہ۰ ۵(
অর্থঃ ‘‘খতমে নুবূয়তের এ অর্থ গ্রহণ করা যে, নবূয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, দুনিয়াকে ধোঁকা দেওয়ার সামিল।’’ [খোতবাতে হাকীমুল ইসলাম, পৃ. ৫০] এখন আপনিই ইনসাফ করুন যে, যখন নুবূয়তের দরজা, তাদের মতে উন্মুক্ত রয়েছে, তখন যত নবীই এসে যাক, তাদেরকে কে বাধা দিতে পারে? (না‘ঊযুবিল্লাহ্)

সম্মানিত মুসলিম সমাজ!
আল্লাহ্ তা‘আলার মহান দরবারে অগণিত অসংখ্য হামদ ও সানা এবং হাজারো শোকর যে, তিনি আপন হাবীব-ই পাক সাহেবে লাউলাক হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি আপন রিসালত ও নুবূয়তে বে-মেসাল, অনুপম এবং তাঁকে এমন সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন, যেগুলোতে আম ইনসান তো দূরের কথা, নবী ও রসূল পর্যন্ত শরীক নন। যেমন, সশরীর মি’রাজ তাঁকে দান করেছেন, যা কোন নবী ও রসূলকে দান করেননি। ‘শাফা‘আত-ই কুবরা’ (সর্ববৃহৎ সুপারিশ)-এর মুকুট তাঁরই শির মুবারকে রেখেছেন, খতমে নুবূয়তের মোহর তাঁরই দু’ স্কন্ধ মুবারকের মধ্যভাগে অংকন করেছেন। সুতরাং তাঁর পর কোন নবী কিংবা রসূল পয়দা হবে না। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁরই রিসালতের সূর্য চমকিত থাকবে এবং তাঁর কলেমাই সমস্ত সৃষ্টির মুখে উচ্চারিত হতে থাকবে।
আমাদের আক্বা ও মাওলা হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘খতমে নুবূয়ত’ (সর্বশেষ নবী হওয়া) এমন গুণ ও বৈশিষ্ট্য যে, নবী করীমের পবিত্র যুগ থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমানই এর উপর ঈমান রাখে যে, আমাদের পরম সম্মানিত রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন প্রকার ভিন্ন ব্যাখ্যা (তা’ভীল) ও বিশেষীকরণ ছাড়া শেষ নবী। আর সরকার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্য ক্বোরআন মজীদের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, আহাদীস-ই মুতাওয়াতিরাহ্ (মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীস শরীফসমূহ) ও ইজমা’-ই উম্মত দ্বারা প্রমাণিত। যে ব্যক্তি ‘খতমে নুবূয়ত’রূপী এ পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করবে, সে বাস্তবিকপক্ষে হুযূর মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যাত (সত্ত্বা) মুবারককেই অস্বীকার করে। সুতরাং সে অকাট্যভাবে কাফির। আর যে ব্যক্তি তার কুফরের মধ্যে (কাফির হবার মধ্যে) সন্দেহ করবে সেও কাফির।
এ ফিৎনাপূর্ণ যমানায় ক্বাদিয়ান অঞ্চলের এক হতভাগা, যে বিবেকভ্রষ্ট ও কান্ডজ্ঞানহীন হওয়া স্বত্ত্বেও আরবী ভাষায় একেবারে অজ্ঞ, নুবূয়তের ভন্ড দাবীদার হয়ে মুসলমানদের পরম শ্রদ্ধেয় রসূলের ‘খতমে নুবূয়ত’কে অস্বীকার করেছে আর কাফির হয়ে জাহান্নামে পৌঁছেছে। তার কোট-প্যান্ট পরিহিত ফ্যাশনী দাড়িবিশিষ্ট চেলা-চামুন্ডুরা এবং কিছুকিছু মুসলমান নামধারী ও ইসলামী আল-খেল্লা পরিহিত বে-ঈমানগণ ‘খতমে নুবূয়ত’-এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আল্লাহর ক্বহর ও গযবের অবতরণস্থল হয়েছে। না‘ঊযুবিল্লাহ্!
শেষ নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লামা ড. ইক্ববাল বলেছেন-
وہ دانائے سہل ختم رسل مولائے کل +جس نے غبارراہ کو بخشافروغ وادی سینا
نگاہ عشق مستی میں وہی اول وہی آخر+ وہی قرآن وہی فرقان وہی یس وہی طہ (اقبال(
অর্থঃ বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার তিনিই (হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম), সর্বশেষ রসূল, সমস্ত সৃষ্টির মুনিব, যিনি পথের ধূলিকণাকে দান করেছেন সীনা উপত্যকার আলো।
খোদা-প্রেমে বভোর দৃষ্টিতে তিনিই সর্বপ্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনি ক্বোরআন, তিনিই ফোরক্বান, তিনিই ইয়াসীন, তিনিই ত্বোয়াহা। [আল্লামা ইক্ববাল] —০—

একটি আবেদন
বেরাদরানে ইসলাম! ‘খতমে নুবূয়ত’ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটার গুরুত্বের অনুমান একথা থেকে অতি উৎকৃষ্টভাবে করা যেতে পারে যে, বিষয়টি ওই সব বুনিয়াদী ও মৌলিক আক্বীদাগুলোর অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো স্বীকার করে নেওয়া ব্যতীত কেউ ইসলামের গন্ডিতে প্রবেশ করতে পারে না। এ বিষয়বস্তু যদিও অত্যন্ত ব্যাপক; কিন্তু পরিসর দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ণাঙ্গভঙ্গিতে কয়েকটা অধ্যায়ে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছি-। যেমন-
১. খতমে নুবূয়ত ক্বোরআনে পাকের আলোকে,
২. খতমে নুবূয়ত হাদীস শরীফের আলোকে,
৩. খতমে নুবূয়ত ইজমা’-ই সাহাবার আলোকে,
৪. খতমে নুবূয়ত ইজমা’-ই সলফে সালেহীনের আলোকে এবং
৫. বিভিন্ন সন্দেহের অপনোদন।

খতমে নুবূয়ত ক্বোরআন মজীদের আলোকে

।। এক।।

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللّٰهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَؕ- وَ كَانَ اللّٰهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا۠ (۴۰)
তরজমাঃ মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন; হ্যাঁ, আল্লাহর রসূল হন এবং সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা সব কিছু জানেন। [সূরা আহযাব: আয়াত-৪০, কানযুল ঈমান]

আয়াতের শানে নুযূল
সাইয়্যেদুনা হযরত যায়দ ইবনে হারিসাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, যিনি আসলে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন, শৈশবে কেউ তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং গোলাম বানিয়ে তাঁকে মক্কা মুকাররামার বাজারে বিক্রি করে দেয়।
হযরত সাইয়্যেদাহ্ খদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হযরত যায়দকে কিনে নিলেন এবং কিছুদিন পর হুযূর সাইয়্যেদ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দান করে দিলেন। যখন সাইয়্যেদুনা হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সাবালক হলেন এবং ব্যবসার কাজে সিরিয়া গেলেন এবং নিজের পিতৃপুরুষদের ভূ-খন্ড অতিক্রম করছিলেন, তখন তাঁর নিকটাত্মীয়রা তাঁকে চিনতে পারলো। যখন তারা জানতে পারলো যে, তিনি হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর গোলাম (ক্রীতদাস) হয়ে আছেন, তখন তাঁর পিতা, চাচা ও ভাই হুযূর সাইয়্যেদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে হাযির হলো। আর আরয করলো, ‘‘হুযূর, আমাদের থেকে কিছু বিনিময় মূল্য নিয়ে যায়দকে আমাদের সাথে যেতে দিন!’’
হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করলেন, ‘‘বিনিময় মূল্যের তো কোন কথা নেই, অবশ্য আমি তাকে ইখতিয়ার দিচ্ছি, যদি সে চায় তবে তোমাদের সাথে চলে যেতে পারে আর যদি চায়, তবে আমার সাথে থেকে যেতে পারবে।’’
এ এরশাদ মুবারক শুনে হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকটাত্মীয়রা খুব খুশী হলো। আর বলতে লাগলো-
جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا لَقَدْ اَحْسَنْتَ يَارَسُوْلَ اللهِ
(আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! আপনি আমাদের বড় উপকার করেছেন।)
তখন বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদুনা হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ডেকে বললেন, ‘‘এরা হলো তোমার পিতা, চাচা ও সহোদর (ভাই)। এখন তোমার মর্জি! তাদের সাথে চলে যাও অথবা আমার সাথে থেকে যাও!’’
সাইয়্যেদুনা হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আরয করলেন, ‘‘এয়া রাসূলাল্লাহ্! (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কা ওয়াসাল্লাম) আমি আমার আক্বা (মুনিব) রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ছেড়ে আমার পিতা, চাচা ও সহোদর (ভাই)-এর সাথে চলে যাওয়া পছন্দ করছি না। কারণ, সরকার-ই দু’ আলম আমার বাপ, চাচা ও ভাই অপেক্ষা বেশী ¯েœহপরায়ণ ও দয়াবান।’’
এ কথা শুনে রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদুনা হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে আযাদ করে দিলেন এবং নিজের পালকপুত্র করে নিলেন। আর লোকেরাও তাঁকে ‘যায়দ ইবনে মুহাম্মদ’ বলতে লাগলো। এ প্রসঙ্গে এর পরবর্তী আয়াত শরীফ নাযিল হলো।
[তাফসীর-ই দুররে মানসূর: ৫ম খন্ড: ১৮১পৃ.] وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَآءَكُمْ أَبْنَآءَكُمْ ط ذٰلِكُمْ قَوْلُكُمْ بِأَفْوَاهِكُمْ ط وَاللهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِى السَّبِيلَ ড় اُدْعُوْهُمْ لِاٰبَآئِهِمْ هُوَ اَقْسَطُ عِنْدَ اللهِ ج
তরজমাঃ আর তোমাদের পোষ্য পুত্রদেরকে তিনি (আল্লাহ্) তোমাদের পুত্র করেননি। এতো তোমাদের মুখের কথা। আর আল্লাহ্ সত্য বলেন এবং তিনিই সৎ পথ দেখান। তাদেরকে তাদের প্রকৃত পিতারই বলে ডাকো। এটা আল্লাহর নিকট বেশী ঠিক। [সূরা আহযাব: আয়াত, ৪-৫, কান্যুল ঈমান] এ আয়াত শরীফ নাযিল হবার পর সাহাবা-ই কেরাম হযরত যায়দকে ‘যায়দ ইবনে মুহাম্মদ’ বলা পরিহার করলেন এবং যায়দ ইবনে হারিসাহ্ বলতে আরম্ভ করলেন। এরপর তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদুনা হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিবাহ্ আপন ফুফাত বোন সাইয়্যেদাহ্ হযরত যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার সাথে করিয়ে দিলেন; কিন্তু তাঁদের মধ্যে মিল-মুহাব্বতের কোন পন্থা সৃষ্টি হয়নি। শেষ পর্যন্ত সাইয়্যেদুনা যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সাইয়্যেদাহ্ হযরত যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে তালাক্ব দিয়ে দিলেন। সাইয়্যেদুনা হযরত যায়দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁকে তালাক্ব দিয়ে দেওয়ার পর সরওয়ার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশে সাইয়্যেদাহ্ হযরত যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে বিবাহ্ করে নিলেন।
এ দিকে হুযূর সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত যয়নাবকে বিবাহ্ করলেন, অন্যদিকে মূর্খ ও মুনাফিক্বরা সমালোচনা আরম্ভ করে দিলো- হুযূর সরওয়ার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ্ করেছেন। তখন সেটার খন্ডনে নি¤œলিখিত আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে-
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِّجَالِكُمْ وَلٰكِنْ رَّسُولَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ط وَكَانَ اللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا [سوره احزاب : ايت :৪০] তরজমাঃ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন। হ্যাঁ, তিনি আল্লাহ্ তা‘বারাকা ওয়া তা‘আলার রসূল হন এবং তিনি সমস্ত রসূলের পর এসেছেন (সর্বশেষ নবী হয়ে)। আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা সব কিছু জানেন। [সূরা আহযাব: আয়াত-৪০] মোটকথা, এ আয়াত শরীফে মুনাফিক্বদের সমালোচনার জবাব দেওয়া হয়েছে, যার সারকথা হচ্ছে- আমার মাহবূব, মাদানী চাঁদ, মক্কী সূর্য- সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন পুরুষের দৈহিক পিতা নন, বরং রূহানী পিতা। কোন এক বা দু’জনের নন; বরং সমগ্র বিশ্বের রূহানী পিতা। আর বিবাহ্ হারাম হওয়া নির্ভর করে দৈহিক পিতা হবার উপর; রূহানী পিতা হবার উপর নয়। রূহানী পিতা হবার উপর মহত্ব ও ¯েœহের বিধানাবলী বর্তায়। যেমন- ওস্তাদ ও মুর্শিদ রূহানী পিতা, আর শাগরিদ, মুরীদ হলো রূহানী সন্তান; কিন্তু বিবাহ্ হারাম হবার বিধানাবলী এখানে জরুরী ও কার্যকর হয় না; এখন দেখুন لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ (কিন্তু আল্লাহর রসূল হন) কেন এরশাদ করলেন? এর জবাব এ যে, ‘ইলমে নাহ্ভ’-এর ইমামগণ বলেছেন, لكن (লা-কিন) শব্দটি আসে استدراك (প্রতিকার)-এর জন্য। অর্থাৎ পূর্ববর্তী বাক্যে কোন অস্পষ্টতা সৃষ্টি হলে لكن (লা-কিন) শব্দ দ্বারা তা দূরীভূত করা হয়। বস্তুতঃ এখানেও অনুরূপ। পূর্ববর্তী বাক্য مَاكَانَ مُحَمَّدٌ اَبَا اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ (হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন)-এর মধ্যে পিতা হওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। আর পিতা হওয়ার অস্বীকৃতি থেকে এ অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়েছে যে, হয়তো যখন ‘পিতা হওয়া’র বিষয়টি অস্বীকার করা হলো, তখন পিতৃসূলভ ¯েœহকেও, যা পিতা হওয়ার অনিবার্য বৈশিষ্ট্য, অস্বীকার করা হয়ে গেছে।’ সুতরাং لكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ (কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল) দ্বারা ওই সন্দেহ দূরীভূত করে দিয়েছেন। তাও এভাবে যে, আমার হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর, তোমাদের সাথে যদিও দৈহিকভাবে পিতা হবার সম্পর্ক নেই, কিন্তু নুবূয়ত ও রিসালতের সম্পর্ক তো অবশ্যই রয়েছে। বস্তুতঃ রসূল আপন উম্মতের রূহানী পিতা হয়ে থাকেন; যিনি ¯েœহ ও বদান্যতায় দৈহিক পিতা থেকে বহুগুণ বেশী হয়ে থাকেন।
এবার দেখুন, ‘খাতামুন্নবিয়্যীন’ শব্দযুগল এরশাদ করার হিকমত। যখন একথা প্রমাণিত হলো যে, সরওয়ার-ই কাইনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের রূহানী পিতা, তখন এ সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে যে, পুত্র যেহেতু পিতার ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) হয়, সেহেতু উম্মতের মধ্যে কেউ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নুবূয়তের ওয়ারিস হয়ে নবী হয়ে যেতে পারে কিনা? এ কারণে আল্লাহ্ জাল্লা মাজদুহূ ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ উল্লেখ করে সন্দেহের অপনোদন করেছেন। অর্থাৎ যদিও মুসলিম উম্মাহ্ আমার মাহবূবের রূহানী সন্তান, কিন্তু নুবূয়তের পদ মর্যাদার ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী হবে না। কেননা, নুবূয়তের পদ মর্যাদার ধারা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে খতম হয়ে গেছে। উম্মত থেকে কেউই ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ পদ মর্যাদার ওয়ারিস হবে না।
নবূয়ত ও রিসালত আমার মাহবূবের উপর সমাপ্ত হয়ে গেছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ সর্বোচ্চ পদ মর্যাদা আর কাউকেও দেওয়া হবে না। আর এ পদ মর্যাদা অন্য কেউ কিভাবে পেতে পারে, যখন হুযূর-ই আক্রামের শরীয়ত পূর্ণাঙ্গভাবে মওজূদ রয়েছে। আর তিনি ও আপন উম্মতের নিকট হাযির-নাযির। সুতরাং তিনি মওজূদ থাকাবস্থায় কেউ নবূয়তের ভন্ড দাবীদার হওয়া তার চূড়ান্ত নির্লজ্জতা ও ইতরতাই।

خاتم (খাতাম) শব্দের বিশ্লেষণ
خَاتِمَ দু’ভাবে পড়া হয়েছে, ১. ت (তা) বর্ণে যবর সহকারে এবং ২. ت (তা)-তে যের সহকারে। শব্দটির মূল হচ্ছে خَتْمٌ (খাতমুন)। এর অর্থ ‘খতম করা’ অথবা ‘মোহর লাগানো’। আর মোহর লাগানোর অর্থ হয়-কোন জিনিষকে এমনভাবে বন্ধ করা যেন ভিতরের জিনিষ বাইরে আসতে না পারে এবং বাইরের জিনিষও ভিতরে যেতে না পারে। যেমন- আল্লাহ্ তা‘আলার এরশাদ-خَتَمَ اللهُ عَلى قُلُوْبِهِمْ (আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের হৃদয়গুলোর উপর মোহর ছেপে দিয়েছেন), ফলে তাদের কুফর ভিতরে আটকে গেছে। এখন তা ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। আর বাইরে থেকেও কোন হিদায়ত ভিতরে যেতে পারে না। অনুরূপ, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন- يُسْقُوْنَ مِنْ رَحِيْقٍ مَّخْتُوْمٍ অর্থাৎ জান্নাতবাসীদেরকে যে পানীয় পান করানো হবে, সেটার মুখে মোহর লাগানো থাকবে। ফলে ভিতরের খুশবু ও মজা বাইরে আসতে পারবেনা এবং বাইরের কোন জিনিষ সেটার ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না, যাতে সেটার মজা কমে যায়।
দিওয়ান-ই মুতানাব্বীতে আছে-
اَرُوْحُ وَقَدْ خَتَمْتَ عَلى فُوَادِىْ بِحُبِّكَ اَنْ يَّحُلَّ بِه سِوَاكَ
অর্থঃ আমি এমতাবস্থায় চলি যে, তুমি আমার হৃদয়ের উপর তোমার ভালবাসার মোহর এমনভাবে ছেপে দিয়েছো যে, ভিতর থেকে তো তোমার ভালবাসা বের হতেই পারে না, আর বাইরে থেকেও অন্য কারো ভালবাসা ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না।
সুতরাং যদি خَاتِمٌ (ت তে যের সহকারে) পড়া হয়, তবে অর্থ হবে- হুযূর পুরনূর শাফি‘ই ইয়াউমিন নুশূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র স্বত্ত্বা সম্মানিত নবীগণের আগমনের ধারা সমাপ্তকারী।
আর যদি خَاتَمٌ (ت যে যবর সহকারে) পড়া হয়, তবে অর্থ হবে- সাইয়্যেদুল মুরসালীন সালাওয়াতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ওয়া সালা-মুহূ হলেন নবীগণের মোহর। অর্থাৎ তাঁর পরে কেউ নবীগণের এ পরম্পরায় প্রবেশ করতে পারবে না। আর যেসব নবী আলায়হিমুস্ সালাম তাঁর পূর্বে নুবূয়তের ধারা বা পরম্পরায় প্রবেশ করেছেন, তারা এ ধারা থেকে বেরও হতে পারবেন না।
মোটকথা, এ দু’ প্রকারে পাঠ করার সারকথা হলো একটি। তা হচ্ছে- সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন নবী নতুনভাবে আসবে না।

‘রসূল’ ও ‘নবী’র মধ্যে পার্থক্য
‘জমহুর’ (প্রায় সব) আলিমের অভিমত হচ্ছে- রসূল ও নবীর মধ্যে عام خاص مطلق -এর সম্পর্ক বিদ্যমান। ‘নবী’ আম এবং ‘রসূল’ খাস। কারণ রসূল হবার জন্য নুবূয়ত ছাড়াও নতুন কিতাব ও নতুন শরীয়ত থাকা জরুরি; কিন্তু নবীর জন্য নতুন কিতাব ও নতুন শরীয়ত থাকা জরুরী নয়। সুতরাং প্রত্যেক রসূল নবী হন আর প্রত্যেক নবী রসূল হওয়াও জরুরী নয়।
এখন ‘আল্লাহর কালাম’-এর একটু মু’জিযা দেখুন! আয়াত শরীফে خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ এরশাদ হয়েছে, خَاتَمُ الْمُرْسَلِيْنَ এরশাদ হয়নি; অথচ প্রকাশ্য বক্তব্যের দাবী ছিলো خَاتَمُ الْمُرْسَلِيْنَ (খাতামুন্ মুরসালীন) বলা। এ জন্য প্রথমে وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ (কিন্তু আল্লাহর রসূল) উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এর উপযোগী ছিলো خَاتَمُ الْمُرْسَلِيْنَ; কিন্তু খাস শব্দ رَسُوْل (রসূল)-এর পরিবর্তে আম শব্দ نبى (নবী) উল্লেখ করেছেন। এরশাদ করেছেন خَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ (সর্বশেষ নবী) যাতে একথা প্রমাণিত হয় যে, তিনি শর্তহীনভাবে সমস্ত সম্মানিত নবী আলায়হিমুস্ সালাম-এর আগমনের ধারা সমাপ্তকারী। আর তাঁর নূবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়ে গেছে। তাই স্বতন্ত্র নবী হোক কিংবা অধীনস্থ নবী হোক, যিল্লী নবী হোক কিংবা বরূযী নবী হোক, প্রত্যেক প্রকারের নুবূয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আর যখন নুবূয়ত খতম হয়ে গেছে, তখন তো রিসালতও খতম হয়ে যাওয়া আরো উত্তমরূপে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ যখন ‘আম’কে অস্বীকার করা হয়, তখন ‘খাস’-এর অস্বীকার অনিবার্য হয়ে যায়।
সুতরাং মাদানী চাঁদ মাহবূবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেমন ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’, তেমনি ‘খাতামুল মুরসালীন’ও। (তিনি যেমন সর্বশেষ নবী, তেমনি সর্বশেষ রসূলও)।
এ অর্থ সম্মানিত তাফসীরকারকগণও বলেছেন। যেমন- ‘তাফসীর-ই ইবনে কাসীর’ এ বর্ণনা করা হয়েছে-
فَهذِهِ الْايَةُ نَصٌّ فِىْ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدَه وَاِذَا كَانَ لاَ نَبِىَّ بَعْدَه فَلاَ رَسُوْلَ بَعْدَه بِالطَّرِيْقِ الْاُوْلى وَالْاَحْرٰى لِاَنَّ مَقَامَ الرِّسَالَةِ اَخَصُّ مِنْ مَّقَامِ النُّبُوَّةِ ـ
অর্থঃ এ আয়াত এ মর্মে প্রকাশ্য দলীল যে, হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন নবী আসবে না। যখন তাঁর পরে কোন নবী হতে পারে না, তখন আরো উত্তমভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর পরে কোন রসূলও হতে পারে না। কারণ, রিসালতের স্তর নবূয়তের স্তর অপেক্ষা অধিকতর খাস।
অনুরূপ, ‘তাফসীর-ই খাযিন’-এ আছে- ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ হচ্ছে- خَتَمَ اللهُ بِهِ النُّبُّوَّةَ فَلاَ نُبُوَّةَ بَعْدَه অর্থাৎ আল্লাহ্ জাল্লা শানুহূ আপন হাবীব-ই পাক, সাহেবে লাউলাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাথে নুবূয়ত খতম করে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁর পর নুবূয়ত আর নেই। কেউ নবী হতে পারবে না।

اَلنَّبِيِّيْنَ -এর الف لام -এর বিশ্লেষণ
নাহ্ভ (আরবী ব্যাকরণ) বেত্তাগণ লিখেছেন- الف لام চার প্রকার-১. জিনসী, ২. ইস্তিগরাক্বী, ৩. আহদে খারেজী ও ৪. আহদে যেহনী।
اَلنَّبِيِّيْنَ -এর মধ্যে যে الف لام রয়েছে, তা استغراقى (ইস্তিগরাক্বী)। কারণ যে الف لام – বহুবচনের উপর আসে তা ‘ইস্তিগরাক্বী’ হয়। এটা আরবী ভাষাবিদগণের অভিমত। [কুল্লিয়াত-ই আবুল বাক্বা: পৃ. ৫৬২] তাছাড়া, আরবী ভাষায় স্বল্প জ্ঞান রাখে এমন ব্যক্তিও জানে যে, اَلنَّبِيّيْنَ -এর উপর الف لام টি عهدى হতে পারে না। যদি তা হয়, তবে অর্থ হবে সরওয়ার-ই দু’ জাহান সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্ট ও অনুমিত নবীগণের ধারা সমাপ্তকারী; সমস্ত নবীর ধারা সমাপ্তকারী নন। একথাও প্রকাশ পাবে যে, এমতাবস্থায় ইমামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষত্বটুকু অবশিষ্ট থাকে না। কারণ এ অর্থের ভিত্তিতে যে কোন নবী ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন; ‘আখেরুন্ নবিয়্যীন’ হতে পারবেন; কাজেই, তখন হুযূর সরওয়ার-ই কা-ইনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কি বিশেষত্ব বাকী থাকছে?

استغراق (ইস্তিগরাক্ব)-এর প্রকারভেদ
ইস্তিগরাক্ব আবার দু’ প্রকার-১. হাক্বীক্বী এবং ২. ইদ্বাফী বা ওরফী। এখানে خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ -এ ইদ্বাফী কিংবা ওরফী হতে পারে না। কারণ, ইস্তিগরাক্বে ওরফী মূলতঃ মাজায বা রূপকই। মাজায বা রূপক সেখানেই হয়, যেখানে হাক্বীক্বী হওয়া অসম্ভব হয়।
এখানে ‘ইস্তিগরাক্বে হাক্বীক্বী’র অর্থ গ্রহণে কোন যৌক্তিক বাধাও নেই; বরং বেশী উপকারীই। কেননা, এটা প্রশংসার স্থান। আর ‘ইস্তিগরাক্ব-ই হাক্বীক্বী’ প্রশংসার স্থানে বেশী উপযোগী। বস্তুতঃ ‘ইস্তিগরাক্ব-ই ওরফী’ হলে তাজেদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষত্ব বাকী থাকে না।
সুতরাং বুঝা গেলো যে, এখানে ‘ইস্তিগরাক্ব-ই হাক্বীক্বী’ই প্রযোজ্য। এখন আয়াত শরীফটির অর্থ দাঁড়ায় তিনি (হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) নুবূয়তের সমস্ত ব্যক্তি-স্বত্ত্বার আগমনের ধারাকেই সমাপ্তকারী। চাই স্বতন্ত্র হোক কিংবা অধিনস্থ হোক; হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন প্রকারের কোন নবী আসবে না। সুতরাং এ আয়াত শরীফ দ্বারা সকল প্রকারের নবীর দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আর এর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা বা অবকাশ বাকী থাকেনি। কারণ সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন স্বতন্ত্র নুবূয়তের ধারার সমাপ্তকারীই।

—০—

।। দুই।।

আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান-
اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ
نِعْمَتِىْ وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ [سوره مائده : ايت ৩] তরজমাঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন মনোনীত করলাম। [সূরা মা-ইদাহ্: আয়াত-৩, কানযুল ঈমান]

দ্বীনকে পরিপূর্ণ করা
পূর্ববর্তী কিতাবগুলো ও আসমানী সহীফাগুলোতে সংশ্লিষ্ট দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার উল্লেখ মোটেই করা হয়নি। কেননা, নুবূয়তের ধারা জারী বা অব্যাহত ছিলো। যেমন, হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম ঘোষণা করেছিলেন-
وَمُبَشِّرًا م بِرَسُوْلٍ يَأْتِىْ مِنْ بَعْدِى اسْمُه اَحْمَدُ
তরজমাঃ আমি এক মহান রসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসবেন, তাঁর নাম আহমদ। [সূরা সফ: আয়াত-৬] নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কোন নবী তাঁর দ্বীন পরিপূর্ণ হয়েছে মর্মে সুসংবাদ পাননি। শুধু শাহে কাওন ও মকান সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় স্বত্ত্বার জন্যই এ সুসংবাদ নির্দিষ্ট ছিলো। সুতরাং বিদায় হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে আরফাহ্ দিবসে জুমার দিনে আসরের সময় লক্ষাধিক সাহাবা-ই কেরামের মুবারক জমায়েতে তাঁদের সামনে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে দ্বীনের পরিপূর্ণতার এ ঘোষণা দেওয়া হয়-
اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ
وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًاؕ-
তরজমাঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নি’মাতকেই পূর্ণাঙ্গ করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন (হিসেবে) পছন্দ করলাম। [সূরা মা-ইদাহ্: আয়াত-৩]

আয়াত শরীফের ব্যাখ্যা
এ আয়াত শরীফের মর্মার্থ এ যে, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করছেন, আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে কামিল ও মুকাম্মাল করে দিয়েছি। আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত দ্বীনী ও দুনিয়াবী প্রয়োজনে একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান দান করেছি, যা’তে জ্ঞানগত, কর্মগত, রাজনীতিগত, নাগরিক, আক্বাইদগত, আমলগত, হালাল ও হারামের বিধানাবলী রয়েছে। এমন কোন বিধান তাতে বাদ পড়েনি, যা তাতে প্রকাশ্যভাবে কিংবা ইঙ্গিতে বর্ণনা করেননি।
আর যে সব জ্ঞান-বিজ্ঞান পূর্ববর্তী দ্বীনগুলোতে মওজুদ ছিলো, ওই সবের সারবস্তু এ মজবূত দ্বীনে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেসব বস্তু বা বিষয় প্রকাশ্যভাবে বর্ণনা করা উচিৎ ছিলো, সেগুলো প্রকাশ্যভাবে বর্ণনা করেছেন, আর যা ইঙ্গিতে বর্ণনা করা উচিৎ ছিলো, তা ইঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন। মোটকথা, কোন বস্তু এমনভাবে রাখা হয়নি, যার প্রয়োজন হয় অথচ বর্ণনা করা হয়নি।
সুতরাং এ মজবূত দ্বীনে না কোন পরিবর্দ্ধন, না কোন মেরামতের অবকাশ আছে, না এতে কোন হ্রাসবৃদ্ধি করা যেতে পারে। এ কারণে দ্বীন-ই মুহাম্মদী (‘আলা সাহিবিহিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম) সমস্ত পূর্ববর্তী ধর্ম অপেক্ষা উত্তম এবং সব ক’টির নাসিখ (রহিতকারী)। এ থেকে এ মাসআলা প্রমাণিত হলো যে, এ দ্বীন সর্বশেষ দ্বীন, এ উম্মত আখেরী উম্মত এবং এ নবী হযরত মুহাম্মদ-ই আরবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী। কেননা, নাসিখ ওটাই হবে, যা আখেরী হবে। সুতরাং ক্বিয়ামত পর্যন্ত দ্বীন-ই মুহাম্মদী (আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম)-এর বাহারই থাকবে। এরপর কোন নতুন দ্বীন আসবেনা, যা সেটাকে মানসূখ (রহিত) করতে পারে।

গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়
যখন এ মজবূত দ্বীন পূর্ণতার শিখরে পৌঁছেছে, এখন এ মর্মে একটু গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন যে, এখন আর কোন পথপ্রদর্শক ও নবীর কি প্রয়োজন আছে? মোটেই না। সুতরাং বে-দ্বীন ক্বাদিয়ানী মির্যাঈদের জিজ্ঞাসা করুন, যদি হুযূর সরকারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীকে নবী বলে মানা হয়; তবে ওই ভন্ড নবী কি করবে ও কি বলবে? কারণ, দ্বীন ইসলাম তো পরিপূর্ণতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছে; প্রয়োজন তো কিছুরই অবশিষ্ট থাকেনি।
অসম্ভব কল্পনায়, যদি সে নবী হয়, তবে তা হবে নিঃসন্দেহে অপ্রয়োজনীয় এবং সে হবে একেবারে অকেজো ও অপদার্থ। বস্তুতঃ প্রত্যেক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি জানে যে, অনর্থক ও অকেজো লোক, যার কোন প্রয়োজন নেই, সে কখনো নবী হতে পারে না।
হাফেয ইবনে কাসীর রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ আয়াতে পাকের তাফসীরে লিখেছেন-
هذَا اَكْبَرُ نِعَمِ اللهِ تَعَالى عَلى هذِهِ الْاُمَّةِ حَيْثُ اَكْمَلَ اللهُ تَعَالى لَهُمْ دِيْنَهُمْ فَلاَ يَحْتَاجُوْنَ اِلى دِيْنِ غَيْرِه وَلاَ اِلى نَبِىٍّ غَيْرِ نَبِيِّهِمْ صَلوَاتُ اللهِ وَسَلاَمُه عَلَيْهِ وَلِهذَا جَعَلَهُ اللهُ تَعَالى خَاتَمَ الْاَنْبِيَآءِ وَبَعَثَه اِلَى الْاِنْسِ وَالْجِنِّ ـ[تفسير ابن كثير : جلد ثانى : صفحه ১২] অর্থঃ আল্লাহ্ তা‘আলার, এ উম্মতের উপর সর্বাপেক্ষা বড় নি’মাত হচ্ছে- তিনি তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে কামিল (পূর্ণাঙ্গ) করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা না অন্য কোন দ্বীনের, না তাদের নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কোন নবীর মুখাপেক্ষী। এ জন্যই আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা হুযূর-ই পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘খাতামুল আম্বিয়া’ (সর্বশেষ নবী) করেছেন এবং তাঁকে সকল মানুষ ও সকল জ্বিনের প্রতি নবীরূপে প্রেরণ করেছেন। [তাফসীর-ই ইবনে কাসীর, ২য় খন্ড:পৃ. ১২] এ তাফসীর থেকেও মধ্যাহ্ণ সূর্যের মতো সুষ্পষ্ট হয়েছে যে, দ্বীন-ই মুহাম্মদী (আলা সা-হিবিহিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম) পূর্ণতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছে। সুতরাং শাহে আরব ও আজম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কোন নবীর প্রয়োজন বাকী থাকেনি; না আস্ওয়াদ-ই আনাসীর, না মির্যা ক্বাদিয়ানীর, না অন্য কোন আসলীর, না যিল্লীর, না নাফলীর। কারণ, ফখরে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই আখেরী নবী। আর কানা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর নুবূয়তের দাবী সম্পূর্ণরূপে বাতিল।

ক্বোরআনের হিফাযত
এ আখেরী কিতাব ক্বোরআন মজীদের পূর্বে যত কিতাব নাযিল হয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা কোনটার হিফাযত বা সংরক্ষণের যিম্মাহ-ই করম (বদান্যতার দায়িত্ব) নেন নি। এর কারণে প্রত্যেক রসূলের ওফাত শরীফের পর তাঁর কিতাবও হারিয়ে যেতো অথবা তাতে রদ্দ্ বদল হয়ে যেতো; কিন্তু ক্বোরআন-ই করীম যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলার সর্বশেষ কিতাব আর ক্বিয়ামত পর্যন্ত এর স্থায়িত্ব উদ্দেশ্য ছিলো, সেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা সেটার হিফাযত নিজের বদান্যতার দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছেন। আর ঘোষণা করেছেন-
اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَاِنَّا لَه لَحَافِظُوْنَ
তরজমাঃ আমি ক্বোরআন মজীদ নাযিল করেছি এবং আমি নিজেই সেটার হিফাযতকারী। [সূরা হিজর: আয়াত-৯] এ কারণেই আজ প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছরের এক দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু ক্বোরআন-ই করীমের প্রত্যেক কলেমা (পদ/শব্দ), প্রত্যেক যের, যবর, পেশ সেভাবেই সংরক্ষিত রয়েছে, যেভাবে সাইয়্যেদুল আনাম খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র মুখ থেকে বের হয়েছিলো। ক্বোরআন-ই করীমের শব্দ শব্দ সংরক্ষিত থাকা তাঁর খতমে নুবূয়তের সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। ক্বোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াত সংরক্ষিত রয়েছে। সুতরাং ক্বোরআন মজীদের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি আয়াত খতমে নুবূয়তের প্রমাণ।

সরকার-ই দু’ আলমের পর খলীফা হবেন, নবী হবে না
যেহেতু হুযূর নবী করীম রউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নুবূয়তের দরজা সব সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে, সেহেতু হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর তাঁর খলীফা প্রতিনিধিগণ তো এসেছেন ও আসবেন; কিন্তু কোন নবী আসবেনা। আল্লাহ্ তা‘আলা খোদ্ ক্বোরআন মজীদে এরশাদ ফরমাচ্ছেন-
وَعَدَ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِى الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ـ[سوره نور : ايت : ৫৫] তরজমাঃ আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা ওয়াদা দিয়েছেন তাদেরকে, যারা তোমাদের মধ্যে ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, অবশ্যই তাদেরকে খিলাফত দান করবেন, যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খিলাফত দিয়েছেন। [সূরা নূর: আয়াত-৫৫] এ আয়াত শরীফে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু উম্মতে মুহাম্মদিয়াহ্র উপর এক খাস পুরস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন। আর ওই পুরস্কার হচ্ছে নুবূয়তের খিলাফত ও প্রতিনিধেত্বেরই, যার প্রকাশ খোলাফা-ই রাশেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম দ্বারা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, খিলাফত মানে প্রতিনিধিত্ব সুতরাং এ আয়াত শরীফে মুসলিম উম্মাহর সাথে নুবূয়তের ওয়াদা করা হয়নি; বরং খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের ওয়াদা করা হয়েছে। (অর্থাৎ খলীফা পাঠানোর ওয়াদা করা হয়েছে, নবী পাঠানোর ওয়াদা করা হয়নি।) বস্তুত: এ মর্মে কোন আয়াত কিংবা হাদীস শরীফ আসেনি যে, খোদা তা‘আলা নবী করীমের পর অন্য কাউকে নুবূয়তও দান করেছেন।
অথচ এ আয়াত শরীফে এ কথা উল্লেখ করার সুযোগ ছিলো, কেননা, আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহু নিজের পুরস্কার ও উপকারের বর্ণনা করেছেন। সুতরাং যদি ভবিষ্যতে কাউকে নুবূয়ত প্রদানের ইচ্ছা থাকতো, তবে খিলাফত ও হুকুমতের স্থলে নুবূয়ত ও রিসালতের ওয়াদা করতেন। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, নুবূয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু খিলাফত অবশিষ্ট রয়েছে।
স্বয়ং খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘নুবূয়ত খতম হয়েছে, খিলাফত বাকী রয়েছে’। দেখুন- ইমাম বোখারী ও ইমাম মুসলিম (শায়খাঈন) সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
كَانَتْ بَنُوْآ اِسْرَائِيْلَ تَسُوْسُهُمُ الْاَنْبِيَآءُ ـ كُلَّمَا هَلَكَ نَبِىُّ خَلَفَه نَبِىٌّ وَاِنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ وَسَيَكُوْنُ خُلَفَاءَ فَيَكْثُرُوْنَ قَالُوْا فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ فُوْا بَيْعَةَ الْاَوَّلِ فَالْاَوَّلِ اعْطُوْهُمْ حَقَّهُمْ فَاِنَّ اللهَ سَائِلُهُمْ عَمَّا اسْتَرْعَاهُمْ ـ
[رواه البخارى ومسلم والمشكوة صفحه ـ ৩২০] অর্থঃ বনী ইসরাঈলের রাজনীতি ও ব্যবস্থাপনা খোদ তাদের নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম সম্পন্ন করতেন। যখন কোন নবীর ইনতিক্বাল হতো তখন অন্য নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। নিঃসন্দেহে আমার পর কোন নবী নেই। অবিলম্বে খলীফাগণ নিযুক্ত হবে। (যাঁরা কর্ম ব্যবস্থাপনা করবে।) আর তারা সংখ্যায় অনেক হবে। সাহাবা-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম আজমা‘ঈন আরয করলেন, ‘‘তখন আমাদের জন্য কি হুকুম?’’ হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করলেন, প্রথমে প্রথমের বায়‘আত পূর্ণ করো তারপর প্রথমে তাদের হক (আনুগত্য) আদায় করো। নিঃসন্দেহে খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে তাদের প্রজাদের সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। [বোখারী, মুসলিম, মিশকাত, পৃ. ৩২০]

এ হাদীস শরীফ থেকে একথা স্পষ্ট হয়েছে যে, শাহে কওন ও মাকান সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নুবূয়ত সমাপ্ত হয়েছে। তাঁর পর কোন নবী আসবে না। অবশ্য খলীফা ও আমীর-উমারা আসবেন। আর প্রত্যেক জ্ঞানী জানেন বনী ইসরাঈলের নবীগণের শরীয়ত স্বতন্ত্র ছিলোনা; বরং তাঁরা হযরত দাঊদ, মূসা এবং হযরত ঈসা আলায়হিমুস্ সালাম-এর শরীয়তের অনুগামী (অনুসারী) ছিলো। অতঃপর সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, বনী ইসরাঈলের নবীগণের উপমা দিয়ে এরশাদ করেছেন,اِنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ (আমার পর কোন নবী আসবে না।)
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, ফখরে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন অধিনস্থ, শরীয়তবিহীন ও যিল্লী নবীই আসবে না, যেভাবে বনী ইসরাঈলে নিজস্ব শরীয়তবিহীন নবী তাশরীফ আনতেন।
কিন্তু আফসোস! মির্যাঈরা মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীকে যিল্লী নবী (ছায়া নবী) ইত্যাদি মেনে নিয়ে উক্ত বরকতময় আয়াত ও হাদীস শরীফকে অস্বীকার করছে ইত্যাদি এবং আল্লাহর ক্বহর ও গযবের পাত্র হচ্ছে। আল্লাহ্ তা‘আলা এসব কাফিরকে ঈমান আনার তাওফিক্ব দিন! আ-মী-ন।

।। তিন।।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান-
يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِى الْأَمْرِ مِنْكُمْ ج فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ ط ذٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا ড় [سورة النساء : ايت ৫৯] তরজমা: হে ঈমানদারগণ, নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর, নির্দেশ মান্য করো রসূলের এবং তাদেরই, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মতভেদ ঘটে, তবে সেটাকে আল্লাহ্ ও রসূলের সম্মুখে রুজূ’ করো যদি আল্লাহ্ ও ক্বিয়ামতের উপর ঈমান রাখো। এটা উত্তম এবং এর পরিণাম সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। [সূরা নিসা: আয়াত-৫৯, কানযুল ঈমান]

আল্লাহ্, রসূল ও শাসকের আনুগত্য
উপরোল্লিখিত আয়াত শরীফে তিন সত্ত্বার আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেনঃ ১. মহামহিম রব্বুল ইয্যাতের, ২. রসূলে মু‘আয্যম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এবং ৩. উলিল আমরের।
প্রমাণিত হলো যে, সরওয়ার-ই কা-ইনাত হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর যাঁদের আনুগত্য করা জরুরী, তাঁরা উলিল আমর হবেন, নবী হবেন না।
যদি ধরে নেয়া হয় যে, শাহে আরব ও ‘আজম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন নবী আসা জরুরী হতো কিংবা এর অবকাশ থাকতো, তবে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু আগমনকারী কোন নবীর আনুগত্যের হুকুম দিতেন; কিন্তু তেমনটি করেননি।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, ইমামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন নবী তাশরীফ আনবে না। আর নুবূয়তের ধারা হুযূর পুরুনূর শাফে’-ই ইয়াউমিন নুশূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর সমাপ্ত হয়ে গেছে।
যদি গোঁয়ার ও আফিমখোর মির্যা ক্বাদিয়ানীকে, অসম্ভব কল্পনায়, নবী বলে মেনে নিয়ে ‘উলিল আমর’-এর মধ্যে গণ্য করে তার আনুগত্যকে জরুরী মনে করা হয়, তবে তা হবে বড় মূর্খতা। এর কয়েকটা কারণ নি¤েœ উল্লেখ করা হলো-
১. এ জন্য যে, সামনে এরশাদ হচ্ছে-فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِىْ شَيْءٍ (অর্থাৎ যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে ঝগড়া বা বিরোধ পয়দা হয়)। বুঝা গেলো যে, সাধারণ মানুষ ও উলিল আমরের মধ্যেও বিরোধ-ঝগড়া হবে, অথচ কোন নবীর সাথে ঝগড়া ও বিরোধ করা জায়েয বা বৈধ নয়; বরং কুফর। সুতরাং বুঝা গেলো যে, কানা ও আফিমখোর মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী উলিল আমরের মধ্যেও মোটেই সামিল নয়। সুতরাং না সে খোদা, না রসূল, না উলিল আমর হলো। কাজেই তার কথা মানা ওয়াজিব বা জরুরীও নয়।
২. এজন্য যে, উলিল আমর দ্বারাও নির্দেশ অমান্য করা সম্পন্ন হতে পারে। আর অন্য কাউকে নির্দেশ অমান্য করার নির্দেশ দেওয়ার মতো ত্রুটি-বিচ্যুতিও সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে; যখন খোদ্ শাহে কওন ও মাকান সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘উলিল আমর’ সম্পর্কে এরশাদ করেছেন-
اَلسَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيْمَا اَحَبَّ وَكَرِهَ مَالَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ فَاِذَا اُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ ـ
অর্থ: মুসলমান ব্যক্তির উপর তার প্রতিটি পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় বিষয়ে (আপন) ইমামের আনুগত্য করা ওয়াজিব- যতক্ষণ না তাকে (আল্লাহ্ ও রসূলের) নির্দেশ অমান্যের নির্দেশ দেওয়া না হয়। যদি তাকে পাপকার্যের নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন আনুগত্য করা ওয়াজিব বা অপরিহার্য নয়।
যদি গোলাম আহমদকে ‘উলিল আমর’-এর মধ্যে গণ্য বলে মেনে নেওয়া হয় এবং নবীও মেনে নেওয়া হয়, তবে একথা অনিবার্য হয়ে যাবে যে, না‘ঊযুবিল্লাহ্, নবীও নাফরমানী করার হুকুম দিতে পারেন! আর এ অনিবার্য বিষয়টি বাতিল হওয়া সুস্পষ্ট। অবশ্য মির্যায়ীদের জন্য সম্ভব যে, তারা তাদের বানোয়াট (ভন্ড) নবীর জন্য গুনাহ্ সম্পন্ন হওয়াকে অপরিহার্য বলে মেনে নেবে; কিন্তু আমরা মুসলমান। আমাদের এমন পাপী নবীর প্রয়োজন নেই। এমন ভন্ড নবী মির্যাঈদের ভাগ্যেই জুটেছে।

।। চার।।

রসূলে আরবী সর্বশেষ রসূল
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন-
وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَّحِكْمَةٍ ثُمَّ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِه وَلَتَنْصُرُنَّه ط قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلىٰ ذٰلِكُمْ إِصْرِىْ ط قَالُوا أَقْرَرْنَا ط قَالَ فَاشْهَدُوْا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ ড়فَمَنْ تَوَلّىٰ بَعْدَ ذٰلِكَ فَأُولٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَড়
[سورة ال عمران : ايت :৮২ـ-৮১-] তরজমা: ৮১।। এবং স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্ তা‘আলা নবীগণের নিকট থেকে তাদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের নিকট রসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করবে। এরশাদ করলেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে?’ সবাই আরয করলো, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ এরশাদ করলেন, ‘তবে (তোমরা) একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও এবং আমি নিজেও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম।’
৮২।। সুতরাং যে কেউ এর পরে ফিরে যাবে, তবে ওইসব লোক ফাসিক্ব। [সূরা আ-লে ইমরান, আয়াত-৮১-৮২, কানযুল ঈমান]

এ আয়াত শরীফে ওই অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা আল্লাহ্ তা‘আলা জাল্লা মাজদুহূ রূহ জগতে সমস্ত সম্মানিত নবী আলায়হিমুস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম থেকে আপন হাবীবে পাক সাহেবে লাউলাক হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নিয়েছেন, ‘আমার হাবীব-ই লাবীব মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, যিনি তোমাদের সবার পরে তাশরীফ আনবেন, যদি তোমাদের থেকে কেউ তাঁর যুগ পাও, তবে অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং তাঁর সাহায্য করবে।’ এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় যে, সাইয়্যেদুল ইনসে ওয়াল জা-ন্ন, সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমন সমস্ত সম্মানিত নবী আলায়হিমুস্ সালাম-এর পরে হবে। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত সম্মানিত নবী আলায়হিমুস্ সালাতু ওয়াস্ সালামকে সম্বোধন করে এরশাদ করেছেন-ثُمَّ جَآءَ كُمْ رَسُوْلٌ (তোমরা সবার পর এ রসূল তাশরীফ আনবেন) এটা একথার পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণবহ যে, এ মহান রসূলের শুভাগমন সমস্ত সম্মানিত নবী ও রসূলের পরে হবে। আর এ রসূল আখেরী নবী ও আখেরী রসূল হবেন।
যদি মির্যা ক্বাদিয়ানীকে, কাল্পনিকভাবে, নবী মেনে নেওয়া হয়, তবে সরওয়ারে কা-ইনাত তাজদারে মদীনা হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী থাকেন না। আর আল্লাহরই পানাহ্! সুম্মা মা‘আযাল্লাহ্ আল্লাহ তা‘আলার কালাম (বাণী শরীফ, ক্বোরআন শরীফ) মিথ্যা হয়ে যাবে।

—০—

।। পাঁচ।।

হাবীবে খোদা আখেরী উম্মতের আখেরী রসূল

আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান-
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ ط رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ط إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ড়رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَآ ط إِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُড় رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ ايٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ ط إِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيْمُড় [سوره بقره :ايت ـ ১২৭ـ১২৯] তরজমা: ১২৭।। এবং যখন উঠাচ্ছিলো ইব্রাহীম এ ঘরের ভিত্তিগুলো এবং ইসমাঈল, এ প্রার্থনারত অবস্থায়- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করো। নিশ্চয় তুমিই শ্রোতা, জ্ঞাতা।
১২৮।। হে প্রতিপালক আমাদের! এবং আমাদেরকে তোমারই সামনে গর্দান অবনতকারী এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে একটা উম্মতকে তোমারই অনুগত করো। আমাদেরকে আমাদের ইবাদতের নিয়ম-কানুন বলে দাও এবং আমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহ সহকারে দৃষ্টিপাত করো। নিশ্চয় তুমিই অত্যন্ত তাওবা কবূলকারী, দয়ালু।
১২৯।। হে প্রতিপালক আমাদের! এবং প্রেরণ করো তাদের মধ্যে একজন রসূল তাদেরই মধ্য থেকে, যিনি তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবেন এবং তাদেরকে তোমার কিতাব ও পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেবেন আর তাদেরকে অতি পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[সূরা বাক্বারা: আয়াত-১২৭-১২৯, কানযুল ঈমান] বেরাদরানে ইসলাম! এ আয়াত শরীফগুলোতে মহান ¯্রষ্টা সাইয়্যেদুনা হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ্ আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর কয়েকটা দো‘আর উল্লেখ করেছেন। ওইগুলোর মধ্যে একটা দো‘আ উম্মতে মুসলিমার আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে, যা দ্বারা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বুঝানো হয়েছে, যারা আখেরী উম্মত। আরেকটি দো‘আ সাইয়্যেদে দু’আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী শুভাগমন সম্পর্কে। এ থেকে বুঝা গেলো যে, মুসলিম উম্মাহ অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত সর্বশেষ উম্মত। আর তাদের রসূল ও সর্বশেষ রসূল। সুতরাং সরওয়ার-ই দু’ আলম মাহবূবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নুবূয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে। আর তাঁর পরে কোন নবী আসবে না। কেননা সাইয়্যেদুনা ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ্ আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর দো‘আর শব্দগুলো হচ্ছে-رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلاً (হে আমাদের রব! এ মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে এক মহান রসূল প্রেরণ করো) এবং একথা বলেননি, رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رُسُلاً (হে আমাদের রব! তাদের মধ্যে অনেক রসূল প্রেরণ করো!)
প্রমাণিত হলো যে, সাইয়্যেদুনা হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ্ আলায়হিস্ সালাওয়া-তু ওয়াস্ সালাম শুধু এমন একজন রসূলের শুভাগমনের দো‘আ করেছেন, যাঁর শুভাগমনের পর অন্য কোন নবী ও রসূলের প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকবে না। হাফেয ইবনে কাসীর রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর তাফসীরে লিখেছেন-
عَنْ اَبِى الْعَالِيَّةِ فِىْ قَوْلِه رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلاً مِّنْهُمْ يَعْنِىْ اُمَّةَ مُحَمَّدٍ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقِيْلَ لَه قَدْ اُسْتُجِيْبَ لَكَ وَهُوَ كَائِنٌ فِىْ اخِرِ الزَّمَانِ وَكَذَا قَالَ السُدِّىُّ وَقَتَادَةُ -[ابن كثير جلد اول :صفحه ১৮৪] অর্থঃ হযরত আবুল আলিয়া থেকে বর্ণিত, সাইয়্যেদুনা হযরত খলীলুল্লাহ্ আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম এ দো‘আ করেছেন, ‘হে আমাদের রব! তাদের মধ্যে প্রেরণ করো, এক মহান রসূল, অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যে। তখন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা‘আলার পক্ষ থেকে এ ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার দো‘আ কবূল হয়েছে।’ এবং তিনি হবেন শেষ যমানায়। ইমাম সুদ্দী ও ক্বাতাদাহ্ থেকে এমনটি বর্ণিত হয়েছে।
[ইবনে কাসীর: ১ম খন্ড, পৃ. ১৮৪] এ মহা মর্যাদাবান ব্যক্তিদের তাফসীরগুলো থেকে প্রমাণিত হলো যে, সরওয়ার-ই দু’ আলম তাজদারে মদীনা সাইয়্যেদুনা ওয়া মাওলানা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই আখেরী যুগে তাশরীফ আনবেন; যাঁর পরে অন্য কোন নবী আসবে না।

।। ছয়।।

আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন-
اَوَلَمْ يَكُنْ لَّهُمَ ايَةً اَنْ يَعْلَمَه عُلَمَآءُ بَنِىْ اِسْرَائِيْلَ ড়
[سورة شعراء : ايت ১৯৭] তরজমা: এবং এটা কি তাদের জন্য নিদর্শন ছিলো না যে, এ নবীকে জানে বনী ইসরাঈলের আলিমগণ? [সূরা শু‘আরা: আয়াত-১৯৭, কানযুল ঈমান] বুঝ ও জ্ঞান সম্পন্ন লোকদের জন্য, ইসলাম ও ইসলামের প্রবর্তক হুযূর-ই পুরনূর শাফে-‘ই ইয়াউমিন্ নুশূর হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যতার পক্ষে অন্যতম বড় দলীল এ যে, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এর সত্যতাকে স্বীকার করে। আমাদের রসূলে পাক সাহেবে লাউলাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যতা বনী ইসরাঈলের আলিমগণও স্বীকার করতো। সুতরাং কেউ কেউ তো তাঁর বিশেষ বিশেষ মজলিসেই এটা স্বীকার করতো; কিন্তু কোন পার্থিব স্বার্থে সত্যকে গ্রহণ করতো না। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যে তা স্বীকার করেছেন এবং ইসলাম কবূল করেছেন, যেমন সৈয়্যদুনা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে সালাম এবং তাঁর সাথীরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম। এর কারণ এ ছিলো যে, তাঁদের কিতাবে মাদানী চাঁদ আফতাবে রিসালত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের সুসংবাদ এবং উল্লিখিত গুণাবলী লিপিবদ্ধ ছিলো। যেমন- ক্বোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে-
اَلَّذِيْنَ يَتَّبِعُوْنَ الرَّسُوْلَ النَّبِىَّ الْاُمِّىَّ الَّذِىْ يَجِدُوْنَه مَكْتُوْبًا عِنْدَهُمْ فِى التَّوْرَاةِ وَالْاِنْجِيْلِ [سورة اعراف : ايت : ১৫৭] তরজমা: ওইসব লোক, যারা দাসত্ব করবে এ রসূল, পড়াবিহীন অদৃশ্যের সংবাদদাতার, যাঁকে তারা লিপিবদ্ধ পাবে নিজেদের নিকট তাওরীত ও ইনজীলের মধ্যে। [সূরা আ’রাফ: আয়াত-১৫৭, কানযুল ঈমান] এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাওরীত, ইন্জীল এবং অন্যান্য আসমানী কিতাবে শাহে কাউনাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসনীয় গুণাবলীর উল্লেখ ছিলো। আর ওইসব গুণের মধ্যে একটি ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ও লিপিবদ্ধ ছিলো। এ কারণে সরওয়ার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের পূর্বে বনী ইসরাঈলের সমস্ত আলিম শুধু শেষ যমানার নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অপেক্ষায় ছিলো। আর ওইসব আলিমের এটাই সর্বসম্মত আক্বীদা ছিলো যে, ফখরে কা-ইনাত রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর অন্য কোন নবী আসবে না।
তাবরানী শরীফে সাইয়্যেদুনা হযরত জুবাইর ইবনে মুত্ব‘ইম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, ‘আমি ব্যবসার কাজে সিরিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে এক ব্যক্তিকে পেলাম, যে কিতাবী সম্প্রদায়ের ছিলো। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমাদের দেশে কি কোন নবী আত্মপ্রকাশ করেছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, সে বললো, ‘‘তুমি কি তাঁর আকৃতি চিনো?’’ আমি বললাম, ‘‘হ্যাঁ, আমি তাঁকে চিনি।’’ তারপর ওই লোক আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলো। অতঃপর সাহাবী যা কিছু দেখেছেন, তা নি¤œলিখিত বচনে লিখেছেন-
فَسَاعَةَ مَا دَخَلْتُ نَظَرْتُ اِلى صُوْرَةِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاِذَا رَجُلٌ اٰخِذٌ بِعَقْبِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُلْتُ هذَا الرَّجُلُ الْقَابِضُ عَلى عَقْبِه قَالَ اِنَّه لَمْ يَكُنْ نَبِىٌّ اِلاَّ كَانَ بَعْدَه نَبِىٌّ اِلاَّ هذَا النَّبِىُّ فَاِنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدَه وَهذَا الْخَلِيْفَةُ بَعْدَه وَاِذَا صِفَةُ اَبِىْ بَكْرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ
[تفسير ابن كثير : جلد ثانى صفحه ـ ২৫৩] অর্থ: অতঃপর যখনই আমি প্রবেশ করলাম, তখন আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ছবি দেখতে পেলাম এবং আরো একজনের ছবি, যিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পা মুবারকের মুড়ি ধরে আছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কে, যিনি হুযূর-ই আক্রামের পা মুবারকের মুড়ি ধরে আছেন? সে বললো, এ পর্যন্ত এমন কোন নবী অতিবাহিত হননি কিন্তু তাঁর পরে নবী হয়েছেন; এ-ই নবী এমনি যে, তাঁর পরে কোন নবী নেই। আর এ ব্যক্তি তাঁর পরে খলীফা হবেন। আমি গভীরভাবে তাকালাম। দেখতে পেলাম, সেটা তো হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের ছবি ছিলো।
[তাফসীর-ই ইবনে কাসীর, ২য় খন্ড, পৃ. ২৫৩] সম্মানিত পাঠক! এ বর্ণনা থেকে বুঝা গেলো যে, কিতাবী সম্প্রদায়ের মতেও তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এরপর কোন নবী হবে না। কিন্তু হতভাগা মির্যাঈ প্রলাপ বকছে যে, হুযূর পুরনূর শাফি‘ই ইয়াউমিন্ নুশূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবী আসতে পারে। অথচ সে ক্বোরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ পাঠ করে এবং মুসলমান বলেও দাবী করে। কবি বলেন-
وه عبده ورسوله وه اسمه احمد ـ كتاب وحكم نبوت كا خاتم وخاتم
অর্থ: তিনি হলেন আল্লাহর খাস বান্দা, তিনি তাঁর রসূল এবং তাঁর সম্পর্কেই হযরত ঈসা (আলায়হিস্ সালাম) বলেছেন, ‘‘তাঁর নাম আহমদ! সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। কিতাব ও নুবূয়তের দিক দিয়ে তিনি খাতিম ও খাতাম (সর্বশেষ)।
—০—

।। সাত।।
সূরা-ই বনী ইসরাঈলে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমায়েছেন-
سُبْحَانَ الَّذِىْ أَسْرٰى بِعَبْدِه لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِىْ بَارَكْنَا حَوْلَه لِنُرِيَه مِنْ ايَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
[سورة بنى اسرائيل : ايت ـ১] তরজমা: পবিত্রতা তাঁরই, যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার আশে পাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই। নিশ্চয় তিনি শুনেন, দেখেন। [সূরা বনী-ইসরাঈল: আয়াত-১, কানযুল ঈমান] আর আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা নাজমে এরশাদ ফরমায়েছেন-
ثُمَّ دَنَا فَتَدَلّٰى ড় فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنٰى ড় فَأَوْحٰى إِلٰى عَبْدِه مَا أَوْحٰى ড়
তরজমা: ৮।। অতঃপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হলো। তারপর খুব নেমে আসলো। ৯।। অতঃপর ওই জ্যোতি ও এ মহাবূবের মধ্যে দু’ হাতের ব্যবধান রইলো; বরং তদপেক্ষাও কম। ১০।। তখন ওহী করলেন আপন খাস বান্দার প্রতি যা ওহী করার ছিলো। [সূরা আন্ নাজম: আয়াত, ৮-১০, কানযুল ঈমান] উপরোক্ত আয়াত ও অকাট্য দলীলাদিতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহূ ইসরা ও মি’রাজের ঘটনাকে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন, যা দ্বারা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওই শ্রেষ্ঠত্ব ও সরদারী প্রকাশ করা উদ্দেশ্য, যা ফরশ থেকে আরশ পর্যন্ত সাইয়্যেদুল আওয়ালীন ওয়াল আ-খিরীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কোন নবী ও রসূলের অর্জিত হয়নি। ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা তো হাদীস শরীফ ও সীরাতের কিতাবগুলোতে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিবন্ধেও কতিপয় রেওয়ায়ত বর্ণনা করার প্রয়াস পাচ্ছি, যেগুলো দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে, আমাদের আক্বা-ই রহমত হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী, তাঁর পরে আর কোন প্রকারের কোন নবী আসবে না।

রেওয়ায়ত-১
সাইয়্যেদুনা হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, যখন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বোরাক্বে আরোহণ করার পর সাইয়্যেদুনা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে রওনা হলেন, তখন এমন জমা‘আতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যারা তাঁকে নি¤œলিখিত বচনে সালাম আরয করলেন-
اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا اَوَّلُ ـ اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا ا خِرُ ـ اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا حَاشِرُ
অর্থ: সালাম আপনার উপর হে প্রথম, সালাম আপনার উপর হে সর্বশেষ, সালাম আপনার উপর হে একত্রকারী।
হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়কাস ওয়াসাল্লাম) আপনি তাদের সালামের জবাব দিন! তারপর হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম আরয করলেন, ‘‘যে সব হযরত আপনাকে সালাম বলেছেন তাঁরা হলেন, হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহ্, হযরত মূসা কলীমুল্লাহ্ ও হযরত ঈসা রূহুল্লাহ্ আলায়হিমুস্ সালাম।
[বাহয়হাক্বী-দালাইলুন নুবূয়ত, তাফসীর-ই ইবনে কাসীর: ৩য় খন্ড: পৃ. ৫, মাদারিজুন্ নুবূয়ত:২য় খন্ড, পৃ. ১৯৫] এ মহা মর্যাদাবান নবীগণ তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘প্রথম হওয়া’ ও ‘সর্বশেষ হওয়া’র দু’টি গুণও উল্লেখ করেছেন। বুঝা গেলো যে, সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর আক্বীদা এটাই ছিলো যে, সাইয়্যেদুল আউয়ালীন ওয়াল আখেরীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী, তাঁর পরে অন্য কোন নবী আসবে না।

রেওয়ায়ত-২
যখন শবে আসরার দুলহা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদে আক্বসায় পৌঁছেছেন, তখন সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম তাঁর অপেক্ষায় রত ছিলেন। সেখানে ফেরেশতাদের এক বিরাট দলও ছিলো। এক মুআয্যিন আযান দিলেন। তারপর ইক্বামত বলা হলো। সরদার-ই আম্বিয়া আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম সম্মানিত নবীগণ ও ফেরেশতাদের ইমামত করলেন। যখন নামায পরিপূর্ণ হয়ে গেলো, তখন ফেরেশতারা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে? তখন সাইয়্যেদুনা হযরত জিব্রাঈল বললেন-هذَا مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ অর্থ: আল্লাহর রসূল সর্বশেষ নবী।
[মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়ার বরাতে আনওয়ারে মুহাম্মাদিয়্যাহ্; পৃ. ৩৩৪] সম্মানিত মুসলিম সমাজ! একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন, সরকার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খতমে নুবূয়তের ঘোষণা কেমন মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে দেওয়া হচ্ছে। সমস্ত সম্মানিত নবী ও শীর্ষস্থানীয় ফেরেশতাদের মাহফিলে সাইয়্যেদুনা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম ঘোষণা করছেন যে, মাদানী চাঁদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী।

রেওয়ায়ত-৩
বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নামায শেষে প্রত্যেক নবী পালা পালা করে একেকটা সুন্দর বক্তব্য পেশ করেন, যা’তে প্রত্যেকে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা করেছেন এবং তাঁদের উপর আল্লাহ তা‘আলার বিভিন্ন অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন। সবার শেষে সাইয়্যেদুল ইন্সি ওয়াল জান্ন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খোৎবা পড়লেন (বক্তব্য পেশ করলেন)। তা নি¤œরূপ-
اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِىْ اَرْسَلَنِىْ رَحْمَةً لِّلْعَالِمِيْنَ وَكَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيْرًا وَّنَذِيْرًا وَاَنْزَلَ عَلَىَّ الْفُرْقَانَ فِيْهِ تِبْيَانٌ لِكُلِّ شَيْءٍ وَجَعَلَ اُمَّتِىْ خَيْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ وَجَعَلَ اُمَّتِىْ اُمَّةً وَّسَطًا وَّجَعَلَ اُمَّتِىْ هُمُ الْاَوَّلُوْنَ وَهُمُ الْاخِرُوْنَ وَشَرَحَ لِىْ صَدْرِىْ وَوَضَعَ عَنِّىْ وِزْرِىْ وَرَفَعَ لِىْ ذِكْرِىْ وَجَعَلَنِىْ فَاتِحًا وَّخَاتِمًا
[تفسير ابن كثير : جلد ثالث : صفحه ১৮ـ تفسير درمنثور ـ جلد رابع : صفحه ১৪৫] অর্থ: ওই আল্লাহ্ তা‘আলারই হামদ, যিনি আমাকে সমস্ত জগতের জন্য রহমত করে প্রেরণ করেছেন এবং সমস্ত মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করেছেন। আমার উপর ক্বোরআন মজীদ নাযিল করেছেন, যা’তে প্রত্যেক কিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। আর আমার উম্মতকে শ্রেষ্ঠতম উম্মত করেছেন, যাদেরকে লোকজনের জন্য বের করা হয়েছে। আমার উম্মতকে মধ্যবর্তী উম্মত করেছেন। আমার উম্মতকে এমন অবস্থায় (ধন্য) করেছেন যে, তারা প্রথমও শেষও। আমার পবিত্র বক্ষকে খুলে দিয়েছেন। আমার থেকে আমার বোঝা নামিয়ে ফেলেছেন। আমার জন্য আমার যিকরকে সমুন্নত করেছেন। আমাকে সূচনাকারী ও সমাপ্তকারী করেছেন।
হযরত আবূ জা’ফর রাযী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেছেন,فاتحًا (উন্মুক্ত বা সূচনাকারী) করেছেন মানে ‘হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ক্বিয়ামতের দিনে সুপারিশের দরজা খুলবেন’ আর خاتِمًا (সমাপ্তকারী) করেছেন মানে ‘নুবূয়তের ধারা সমাপ্তকারী’। গভীরভাবে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে-‘খতমে নুবূয়ত’-এর মাসআলা (বিষয়) এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, শাহে কাউনাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর বিশাল মজলিসে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি সর্বশেষ নবী এবং তাঁর উপরই নুবূয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে। সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম নিশ্চুপ ছিলেন, তখন তো সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালামের আক্বীদা এটাই যে, সরকারে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী।

রেওয়ায়ত-৪
সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে মি’রাজের দীর্ঘ হাদীস শরীফ বর্ণিত। তা হচ্ছে যখন আল্লাহ্ রব্বুল ইয্যাত আপন মাহবূবে পাক, সাহিবে লাওলাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নিজের নৈকট্য ও সরাসরি কথোপকথন দ্বারা ধন্য করেছেন, তখন তিনি এ ইরশাদ করেছেন-
وَجَعَلْتُ اُمَّتَكَ الْاَوَّلِيْنَ وَالْاخِرِيْنَ وَجَعَلْتُ مِنَ اُمَّتِكَ اَقْوَامًا قُلُوْبُهُمْ اَنَاجِيْلُهُمْ وَجَعَلْتُكَ اَوَّلَ النَّبِيِّيْنَ خَلْقًا وَاٰخِرَهُمْ بَعْثًا وَجَعَلتُكُ فَاتحًا وخَاتِمًا [تفسير ابن كثير جلد سوم صفحه ـ ২০ـ ] অর্থঃ এবং আমি আপনার উম্মতকে প্রথম উম্মত ও সর্বশেষ উম্মত করেছি; অর্থাৎ ফযীলত (মর্যাদা) অনুসারে সর্বপ্রথম, আর প্রকাশ পাওয়া অনুসারে সর্বশেষ উম্মত। আর আপনার উম্মতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় (জনগোষ্ঠী) তৈরি করেছি, যাদের হৃদয় ইনজীল হবে, অর্থাৎ ক্বোরআনকে হিফাযতকারী। আপনাকে সৃষ্টিতে সর্বপ্রথম নবী এবং প্রেরণ অনুসারে সর্বশেষ নবী করেছি। আপনাকেই সূচনাকারী ও সমাপ্তকারী করেছি। [তাফসীর-ই ইবনে কাসীর: ৩য় খন্ড, পৃ. ২০] এ বর্ণনা দ্বারা একথা মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মাদানী চাঁদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপরই নুবূয়তের সূচনা ও সমাপ্তি ঘটেছে; সুতরাং আপনার পরে কোন নবী আসবে না।

।। আট।।
খতমে নুবূয়ত সম্পর্কে এ নিবন্ধে উল্লেখিত সর্বশেষ আয়াতঃ
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমাচ্ছেন-
عَسى اَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا ـ [سورة بنى اسرائيل : ايت ৭৯] তরজমাঃ অবিলম্বে আপনার রব আপনাকে ‘মাক্বামে মাহমূদ’ (প্রশংসিত স্থানে) দন্ডায়মান করবেন। [সূরা বনী ইসরাঈল: আয়াত-৭৯] সাহাবা-ই কেরাম ও তাবে‘ঈন এ মর্মে একমত যে, ‘মাক্বামে মাহমূদ’ মানে এখানে ‘মাক্বামে শাফা‘আত’ (সুপারিশের স্থান)।
বর্ণিত আছে-
قَالَ اِبْنُ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا هذَا الْمَقَامُ الْمَحْمُوْدُ مَقَامُ الشَّفَاعَةِ
[تفسير ابن كثير:جلد سوم : صفحه : ৫৫] অর্থঃ সাইয়্যেদুনা ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেছেন, এ ‘মাক্বামে মাহমূদ’ মানে ‘মাক্বামে শাফা‘আত’। [তাফসীর-ই ইবনে কাসীর: ৩য় খন্ড, পৃ. ৫৫] عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالى عَنْهُ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اَلْمَقَامُ الْمَحْمُوْدُ الشَّفَاعَةُ ـ [درمنثور : جلد چهارم : صفحه : ১৯৭] অর্থঃ হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘মাক্বামে মাহমূদ’ হচ্ছে ‘শাফা‘আত’(মাক্বামে শাফা‘আত)। [তাফসীর-ই দুররে মানসূর: ৪র্থ খন্ড, পৃ. ১৯৭] আর একথাও ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, ক্বিয়ামত দিবসে শাফা‘আতের জন্য দরখাস্ত করার পরম্পরা সাইয়্যেদুনা হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে আরম্ভ হবে আর খাতিমুল আম্বিয়া আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর খতম হবে। অর্থাৎ সকল মাহশারবাসী (পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল উম্মত) হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর নিকট গিয়ে সুপারিশ করার জন্য দরখাস্ত করবে। তখন তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানাবেন। তারপর তারা অন্যান্য নবীর নিকট যাবে। আর সবার নিকট (একই ধরনের) জবাব পেয়ে সবশেষে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাযির হয়ে এভাবে আরয করবে-
يَا مُحَمَّدُ اَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ وَخَاتَمُ الْاَنْبِيَآءِ وَغَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ وَمَا تَأَخَّرَ اِشْفَعْ لَنَا اِلى رَبِّكَ -ـ
অর্থঃ হে মহান প্রশংসিত (মুহাম্মদ)! আপনি আল্লাহ্ তা‘আলার রসূল ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার কারণে পূর্ব ও পরবর্তী সকল উম্মতকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন!
এ হাদীস শরীফ থেকেও প্রমাণিত হলো যে, কাল ক্বিয়ামতের দিনে পূর্ব ও পরবর্তী সকলে দরবারে রিসালতে হাযির হয়ে হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘খতমে নুবূয়ত’-এর কথা স্বীকার করবে। মজার কথা এ যে, হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খতমে নুবূয়তের কথা স্বীকারকারীদের মধ্যে সেদিন মির্যা-ক্বাদিয়ানীও থাকবে। কিন্তু ওই সময়ের স্বীকারোক্তি সেদিন তাদের চূড়ান্ত মুক্তির ব্যাপারে কোন কাজে আসবে না, কোন উপকার করবে না।
তাই আজকের মির্যাঈদেরকে বলছি- কাল ক্বিয়ামতের দিনে কোন্ মুখে বলবেاَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ وَخَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ (আপনি আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী)? এবং শাফা‘আত করার জন্য দরখাস্ত করবে? যেহেতু তোমরা এ দুনিয়ায় তাঁর খতমে নুবূয়তকে স্বীকার করতে না? তোমাদের জন্য তো উচিৎ হবে এমন সময় তোমাদের বানোয়াট ও ভন্ড নবী মির্যা কাদিয়ানীকে তালাশ করা! তখন তার দ্বারা কি কোন কাজ হবে? ক্বাদিয়ানী সম্প্রদায়ের উচিৎ এর জবাব খুঁজে বের করা! (অর্থাৎ তাওবা করে খাঁটি অন্তরে শেষ যামানার নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান আনার বিকল্প পথ তাদের জন্য নেই।) ওয়ামা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগুল মুবীন। আমাদের উপর সঠিক বিষয়টি পৌঁছিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য ছিলো, তা আমরা করলাম। গ্রহণ করা তোমাদের দাযিত্ব।

—০—

হাদীস শরীফের আলোকে মাদানী চাঁদ
সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
খাতামুুল আম্বিয়া (সর্বশেষ নবী)

সম্মানিত পাঠক সমাজ!
মাদানী চাঁদ, আল্লাহর প্রিয়তম, আরশে মু‘আল্লার নক্ষত্র হযরত আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী। তাঁর পরে কোন প্রকারের কোন নবী (কিংবা স্বতন্ত্র, অধীনস্থ, বরূযী যিল্লী) আসতেই পারে না। এর অকাট্য প্রমাণ ক্বোরআনে মজীদ ফোরক্বানে হামীদ থেকে এবং প্রাসঙ্গিকভাবে হাদীস শরীফ থেকে এ নিবন্ধেও ইতোপূর্বে দেওয়া হয়েছে। এর উপর আরো বহু হাদীস শরীফও সাক্ষী রয়েছে। সংক্ষেপে ওইগুলো থেকে নি¤েœ আরো কয়েকটা হাদীস শরীফ উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-

হাদীস শরীফ-১
ইমাম তিরমিযী ও আবূ দাঊদ সাইয়্যেদুনা হযরত সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, সাইয়্যেদুল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
سَيَكُوْنُ فِىْ اُمَّتِىْ كَذَّابُوْنَ ثَلثُوْنَ كُلُّهُمْ يَزْعَمُ اَنَّه نَبِىُّ اللهِ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ –[مشكوة شريف : صفحه : ৪৬৫] অর্থ: নিশ্চয় আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মহামিথ্যাবাদী দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে। তাদের প্রত্যেকে মনে করবে যে, সে আল্লাহ্ তা‘আলার নবী; অথচ আমি হলাম আখেরী নবী। আমার পর কোন নবী আসবে না।

পর্যালোচনা
এ হাদীস শরীফে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে নি¤œলিখিত বিষয়গুলো প্রমাণিত হয়- প্রথমত, ফখরে দু’ আলম তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, তাঁর পর নিরেট মিথ্যা ও ভন্ড নুবূয়তের দাবীদারই আত্মপ্রকাশ করবে; কিন্তু কোন নবী পয়দা হবে না। নবূয়ত আমারই উপর সমাপ্ত করা হয়েছে।
অসম্ভব কল্পনায়, যদি কোন প্রকারের নুবূয়ত অবশিষ্ট থাকতো, তবে এভাবে এরশাদ হতো, ‘আমার পর নবীও আসবে, দাজ্জাল-কায্যাবও আসবে; যদি নবী তাশরীফ আনে, তবে তাঁর আনুগত্য করবে, আর যদি দাজ্জাল ও কায্যাব (মহামিথ্যুক) আসে, তবে তার খপ্পর থেকে বাঁচবে। কিন্তু সরকার-ই মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন উম্মতকে শুধু এ হিদায়ত করেছেন যে, ‘‘যে কেউ আমার পরে নুবূয়তের দাবী করবে, তাহলে নির্দ্বিধায় তোমরা তাকে দাজ্জাল ও কায্যাব মনে করবে।’’ এটা এ কথারই সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, এখন সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন প্রকারের নুবূয়ত অবশিষ্ট নেই। হুযূর-ই আক্রাম-ই সর্বশেষ নবী। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি সমস্ত জগতের মালিক, প্রতিপালক।
দ্বিতীয়ত, ওই দাজ্জাল ও কায্যাব শেষ যামানার নবীর উম্মত তথা মুহাম্মদী হবারও দাবী করবে। যেমনটি سَيَكُوْنُ فِىْ اُمَّتِىْ كَذَّابُوْنَ (অবিলম্বে আমার উম্মতের মধ্যে মহামিথ্যাবাদীগণ আত্মপ্রকাশ করবে) থেকে বুঝা যায়। বস্তুত ‘মুহাম্মদী’ ও ‘উম্মত’ হবার দাবীও এ জন্য করবে যে, যদি তারা হুযূর-ই আক্রামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের নুবূয়তের ঘোষণা দেয়, তবে কেউই তাদের ধোঁকা ও প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়বে না। এ কারণে, তারা নিজেদেরকে হুযূর-ই আক্রামের সাথে সম্পৃক্ত বলে দেখাবে। তারপর তারা এ ধোঁকা ও প্রতারণার সাথে লোকজনের সামনে তাদের মিথ্যা নুবূয়তের দাবী পেশ করবে; যেমন মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী দাহ্ক্বানী করেছে। প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের আক্বা ও মাওলা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র ইলমে ছিলো যে, মির্যা ক্বাদিয়ানী নিজে নিজেকে তাঁর দিকে সম্পৃক্ত করে লোকজনকে ধোঁকা দিয়ে নুবূয়তের দাবী করবে।
তৃতীয়ত, মাহবূবে রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওই কায্যাব বা মিথ্যা দাবীদার মির্যা ক্বাদিয়ানী ভন্ড নবী হবার প্রমাণ এটাও বর্ণনা করেছেন যে, ‘সে একথার ধারণা করবে যে, সে নবী; অথচ আমিই সর্বশেষ নবী।’ সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, দাজ্জাল ও কায্যাব হবার জন্য শুধু নুবূয়তের দাবীদার হওয়াই যথেষ্ট। অন্য কোন প্রমাণের প্রয়োজন হবে না। কাজেই, মির্যা ক্বাদিয়ানী মিথ্যাবাদী হবার জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নুবূয়তের দাবী করেছে।
চতুর্থত, لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ ইবারতটা اَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ-এর তাফসীর বা ব্যাখ্যা। আর لاَ পদটি نفى جنس -এর, যা نكره -এর উপর আসে; যার মর্মার্থ হয়, ‘আমার পরও এ جنس (জাতি)টাই খতম হয়ে গেছে। جنس نبى (নবী নামক জাতি)’র কোন ব্যক্তিই আমার পর মওজূদ থাকবে না। আর যেহেতু ‘নবী’ শব্দটি عام (ব্যাপকার্থক), চাই শরীয়ত বিশিষ্ট বলে দাবীদার হোক কিংবা কারো অনুগামী হোক আর رسول (রসূল) শব্দটি খাস, তাই রসূলে মু‘আয্যম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম مطلق نبى (শর্তহীনভাবে নবী)’র অস্বীকৃতি এরশাদ করেছেন, অর্থাৎ আমার পর কোন নবী আসবে না, চাই সে শরীয়ত বিশিষ্ট বলে দাবী করুক কিংবা শরীয়তবিহীন বলে দাবী করুক। কেননা, শরীয়ত বিশিষ্ট ও শরীয়তবিহীন مطلق نبى (শর্তহীন নবী) শব্দের বিভিন্ন প্রকার। আর যখন মৌলিকভাবে مُقَسَّمْ (যার প্রকারভেদ করা হয়)-এর অস্তিত্বই থাকবে না, তখন সেটার প্রকারগুলো কোত্থেকে আসবে? আর ‘মানতিক্ব’ বা যুক্তিশাস্ত্রের নিয়ম আছে যে, اقسام (প্রকারগুলোর)’র অস্তিত্ব مُقَسَّمْ (যার প্রকারভেদ করা হয়) ব্যতীত এবং افراد (ব্যক্তিগুলো)’র অস্তিত্ব كُلِّىْ (যার অধীনে ব্যক্তিগুলো আছে)-এর অস্তিত্ব ব্যতীত যুক্তিগত দিক (عقلاً) দিয়েও অসম্ভব। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী চাই স্বতন্ত্র নবী হবার দাবী করুক অথবা অধীন নবী, যিল্লী কিংবা বরূযী নবী হবার দাবী করুক, সরকারে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত হাদীস শরীফের আলোকে মহা মিথ্যুকই।
পঞ্চমত, এ হাদীস শরীফ থেকে এতটুকু সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, ‘খাতামুন্নবিয়্যীন’ মানে ‘আখেরী নবী’। এর এ অর্থ নয় যে, তিনি সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর নিছক মোহর ও সৌন্দর্য (শোভা)। এ জন্য হাদীস শরীফের এ বাক্য, তিনি নুবূয়তের দাবীদারগণ মিথ্যুক হবার দলীল হিসেবে এরশাদ করেছেন যে, ওইসব নুবূয়তের দাবীদার মিথ্যুক হবার দলীল এ যে, ‘‘আমি খাতামুন নবিয়্যীন’, আমার পরে কোন নবী নেই।’’ সুতরাং তাদের নবী হবার দাবীই তাদের মিথ্যুক হবার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
অতঃপর যদি ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ ‘মোহর’ কিংবা ‘শোভা’ নেওয়া হয়, তবে সেটাকে ওইসব ভন্ড দাবীদার মিথ্যুক হবার প্রমাণ কীভাবে দাঁড় করানো যাবে? বরং তখন হাদীস শরীফের অর্থ, ‘আমার পর অনেক মিথ্যুক (কায্যাব) ও দাজ্জাল নুবূয়তের দাবী করবে; অথচ আমি নবীগণের মোহর। আমার মোহর দ্বারা নবী হবে।’ সুতরাং একথা সুস্পষ্ট হলো যে, এ অর্থ অকেজো; ‘লা নবিয়্যা বা’দী’ (আমার পরে কোন নবী নেই)-এর সুস্পষ্ট বিরোধী ও এর সাথে সাংঘর্ষিক; বরং ‘আনা খাতামুন্ নবিয়্যীন’ (আমি সর্ব শেষ নবী)-এর পর ‘লা-নবিয়্যা বা’দী’ (আমার পর কোন নবী নেই) বর্দ্ধিত করা এ বিষয়ের পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, এখানে ‘খাতাম’ মানে ‘মোহর’ নয়; বরং ‘আখির’ (সর্বশেষ)। অতএব, মির্যা ক্বাদিয়ানী তার নবী হবার দাবীতে কায্যাব বা মহা মিথ্যুক।

হাদীস শরীফ-২
ইমাম বোখারী ও মুসলিম সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাতে বর্ণনা করেন-
مَثَلِىْ وَمَثَلُ الْاَنْبِيَآءِ كَمَثَلِ قَصَرٍ اُحْسِنَ بُنْيَانُه تُرِكَ مِنْهُ مَوْضَعُ لَبِنَةٍ فَطَافَ بِهِ النَّظَّارُ يَتَعَجَّبُوْنَ مِنْ حُسْنِ بُنْيَانِه اِلاَ مَوْضَعَ تِلْكَ اللَّبِنَةِ فَكُنْتُ اَنَا سَدَدْتُ مَوْضَعَ اللَّبِنَةِ خُتِمَ بِىَ الْبُنْيَانُ وَخُتِمَ بِىَ الرُّسُلُ وَفِىْ رِوَايَةٍ فَاَنَا اللَّبِنَةُ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيَّيْنَ –[رواهُ الْبخارى ومسلم والمشكواة صفحه ৫১১] অর্থঃ আমার ও পূর্ববর্তী নবীগণের উপমা এমন এক অট্টালিকার মত, যাকে অতি সুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছে; কিন্তু তাতে একটি মাত্র ইটের জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর পরিদর্শনকারীরা তা ঘুরে ঘুরে দেখে এবং সেটার সৌন্দর্য নিয়ে আশ্চর্যবোধ করে; কিন্তু ওই ইটের স্থান দেখে (হতবাক হয়)। সুতরাং আমি ওই ইটের জায়গাটুকু পূর্ণ করে দিয়েছি। আর ওই অট্টালিকা আমার দ্বারা সমাপ্ত হয়েছে এবং রসূলগণের আগমনের ধারাও আমার উপর সমাপ্ত হয়েছে। অন্য এক বর্ণনা এসেছে, (হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করেছেন) ‘‘আমি (নুবূয়তের অট্টালিকার সর্বশেষ) ইট, আমি নবীগণের আগমনের ধারা সমাপ্তকারী। [বোখারী, মুসলিম, মিশকাত-পৃ. ৫৫১]

হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা
প্রত্যেক বস্তুর একটা আরম্ভ আছে এবং একটি শেষ। এভাবে নুবূয়তরূপী ইমারতেরও একটি শুরু এবং একটি শেষ আছে। এ দুনিয়ায় ওই ইমারতের আরম্ভ হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর মাধ্যমে হয়েছে আর সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে এ ইমারত সমাপ্ত বা পূর্ণাঙ্গ হয়েছে। একটি মাত্র ইট নুবূয়তের অট্টালিকার পরিপূর্ণতার জন্য অবশিষ্ট ছিলো। তাঁর প্রশংসিত স্বত্তা ওই জায়গা পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। সুতরাং এভাবে নুবূয়তরূপী অট্টালিকা একেবারে পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেছে। এখন তাতে কোন ইট সংযোজনের জায়গা বাকী নেই যে, তাতে কোন শরীয়তধারী কিংবা শরীয়তবিহীন নুবূয়তের ইট প্রবেশ করতে পারবে। আফিমখোর গ্রাম্য অশিক্ষিত গোঁয়ার মির্যা ক্বাদিয়ানী ওই নুবূয়তরূপী অট্টালিকায় একটি ইট প্রবেশ করানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তাতে আর কোন জায়গায়ই নেই। সুতরাং যেহেতু মির্যা কাদিয়ানীরূপী ওই তথাকথিত ইটটি নুবূয়তরূপী অট্টালিকার অংশ হবার কোন সুযোগ নেই, সেহেতু সেটাকে অন্য কোথাও ছুঁড়ে মারা হবে বৈ-কি?
গভীরভাবে চিন্তার বিষয় যে, যখন মাহবূবে রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহেবযাদাগণ, সাইয়্যেদুনা হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর, হযরত ফারূক্বে আ’যম এবং সাইয়্যেদুনা হযরত ওসমান এবং হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর জন্য নুবূয়তরূপী অট্টালিকায় কোন প্রকারের অবকাশ খোঁজা হয়নি, তখন মুসায়লামাতুল হিন্দ ও আসওয়াদ-ই ক্বাদিয়ানীর জন্য কোত্থেকে জায়গা বের করা যাবে? অবশ্য কুফর ও দাজজাল (কাফির ও দাজ্জাল) রূপী বালাখানায় ওই আফীমী ক্বাদিয়ানীকে এক কোণে একটি ইটের মতো ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
আফসোস শত আফসোস যে, শাহে আরব ও আজম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তো সুস্পষ্ট ভাষায় এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ্ সুবহা-নাহু ওয়া তা‘আলা নুবূয়তরূপী অট্টালিকা (ইমারত)কে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন; কিন্তু মির্যা ক্বাদিয়ানী প্রলাপ বকছে যে, ‘না, এখনো নুবূয়তের অট্টালিকা অসম্পূর্ণ রয়েছে, তাতে আরো অনেক ইট সংযোজনের অবকাশ রয়েছে।’ না‘ঊযুবিল্লাহ্! সুম্মা না‘ঊযুবিল্লাহ্!

হাদীস শরীফ-৩
ইমাম মুসলিম সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, হুযূর সাইয়্যেদুল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
فُضِّلْتُ عَلَى الْاَنْبِيَآءِ بِسِتٍّ اُعْطِيْتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَاُحِلَّتْ لِىَ الْغَنَآئِمُ وَجُعِلَتْ لِىَ الْاَرْضُ مَسْجِدًا وَطُهُوْرًا وَاُرْسِلْتُ اِلَى الْخَلْقِ كَآفَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّوْنَ -থ[رَوَاهُ مُسْلِمٌ وَالْمِشْكواة ـ صفحه ৫১২] অর্থঃ আমাকে সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম-এর উপর ছয়টি জিনিস দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছেঃ ১. আমাকে ‘জামি‘ই কলেমাত’ (ব্যাপক অর্থ বিশিষ্ট বাণীসমূহ) দান করা হয়েছে, ২. আতঙ্ক দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে, ৩. আমার জন্য গণীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) হালাল করা হয়েছে, ৪. আমার জন্য গোটা যমীনকে মসজিদ ও পবিত্রকারী বানানো হয়েছে, ৫. আমাকে সমস্ত সৃষ্টির প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে এবং ৬. আমাকে সর্বশেষ নবী করা হয়েছে; নুবূয়তের ধারা আমার মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়েছে। [মুসলিম, মিশকাত, পৃ. ৫১২]

হাদীস শরীফ-৪
ইমাম দারেমী সাইয়্যেদুনা হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, মাহবূবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اَنَا قَائِدُ الْمُرْسَلِيْنَ وَلاَ فَخْرَ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ وَلاَفَخْرَ
وَاَنَا اَوَّلُ شَافِعٍ وَمُشَفَّعٍ وَلاَ فَخْرَ ـ [رواه الدرامىُ وَالْمِشْكواةُ صفحه : ৫১৪] অর্থঃ আমি সমস্ত রসূলের ক্বা‘ইদ (পরিচালনাকারী) আর একথা নিছক গর্বের নয় (বরং বাস্তব), আমি সমস্ত নবীর আগমনের ধারা সমাপ্তকারী। আর এটা নিছক গর্ব-অহংকারের কথা নয় এবং আমি প্রথম সুপারিশকারী ও আমার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য; আর এটাও নিছক গর্ব অংহকারের কথা নয়। [দারেমী, মিশকাত, পৃ. ৫১৪]

উক্ত হাদীস দু’টির সারকথা
উপরিউক্ত অতি উঁচু মানের দু’টি হাদীস শরীফ থেকে একথা মধ্যাহ্ণ সূর্যের মতো স্পষ্ট হয়েছে যে, মানব-দানবের সরদার, মাহবূবে রব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন খাতামুল আম্বিয়া আর নবীগণের শুভাগমনের সিলসিলা (ধারা) তাঁরই দ্বারা সমাপ্ত হয়েছে। এখন তাঁরই নুবূয়ত ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে।
আশ্চর্যবোধ হয় মির্যাঈ ফির্ক্বার উপর, এতগুলো স্পষ্ট বর্ণনার পরও গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীকে তারা তাদের নবী বলে মান্য করে। হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুস্পষ্ট অর্থবোধক হাদীস শরীফগুলোকে অস্বীকার করছে। আরো আশ্চর্যের কথা হচ্ছে তারা সরকার-ই মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হবারও দাবীকে বহাল রাখছে। لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَاذِبِيْنَ (মিথ্যা দাবীদারদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত অবধারিত)।

হাদীস শরীফ-৫
হুযূর সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমায়েছেন-
لَوْكَانَ بَعْدِىْ نَبِىٌّ لَكَانَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ
অর্থ: ‘যদি আমার পরে কোন নবী হতো, তবে অবশ্যই ওমর ইবনে খাত্তাবই হতো।’ [তিরমিযী, মিশকাত, পৃ. ৫৫৮]

হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা
এ হাদীস শরীফ থেকে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রিসালাতের সূর্য হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী। অর্থাৎ তাঁর পরে আর কোন নবী পয়দা হবে না। কেননা, হাদীস শরীফে لو শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর ‘বালাগাত’ ও আরবের পরিভাষায় لَو শব্দটি অসম্ভব বিষয়াদি বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন নি¤œলিখিত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান-
لَوْكَانَ فِيْهِمَا الِهَةٌ اِلاَّ اللهُ لَفَسَدَتَا
তরজমা: যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ্ ব্যতীত আরো ইলাহ্ থাকতো, তবে সে দু’টি ধ্বংস হয়ে যেতো। [সূরা আম্বিয়া: আয়াত-২২] অন্য আয়াতে এরশাদ করেন-
قُلْ لَوْكَانَ مَعَه الِهَةٌ كَمَا يَقُوْلُوْنَ اِذًا لاَ بْتَغَوا اِلى ذِى الْعَرْشِ سَبِيْلاً
তরজমা: আপনি বলুন, ‘যদি তাঁর সাথে আরো খোদা থাকতো যেমন এরা বকছে, তবে তারা আরশ অধিপতির দিকে কোন পথ খুঁজে বের করতো।’
[সূরা ইসরা: আয়াত-৪২, কানযুল ঈমান] পক্ষান্তরে, সম্ভব বিষয়াদির জন্য اِنْ (যদি) এবং اِذَا (যখন) ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এ হাদীস শরীফে لو শব্দের ব্যবহার বুঝায় যে, হুযূর আপদমস্তক শরীফ নূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবী আসা অসম্ভব (محال)। এ কারণে এগুলো অসম্ভব কল্পনায় (بطور فرض محال) বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ যদি আমার পর নবী আসা সম্ভবপর হতো, তবে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)ই হতো; কিন্তু আমার পর কোন প্রকারের নবী হতে পারে না।
সুতরাং যদি মাহবূবে রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন প্রকারের নুবূয়ত বাকী থাকতো, তবে সাইয়্যেদুনা হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্য তা অবশ্যই সাব্যস্ত হতো। কারণ, খোদ সরওয়ার-ই দু’ আলম তাজদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সাইয়্যেদুনা ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ‘ফারূক্ব’, ‘মুহাদ্দিস মিনাল্লাহ্’ এবং ‘মুতাকাল্লিম বিস্ সাওয়াব’-এর মতো সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করেছেন। সুতরাং যদি নুবূয়তের ধারা জারী থাকতো তবে সাইয়্যেদুনা হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অবশ্যই নবী হতেন। যখন এমন বুযুর্গ ব্যক্তি নবী হতে পারেননি, তখন এক কাদিয়ানী ও গ্রাম্য মুর্খ ব্যক্তি কিভাবে নবী পেতে পারে?

হাদীস শরীফ-৬
ইমাম বোখারী ও ইমাম মুসলিম সাইয়্যেদুনা হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্বক্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণনা করেন, সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাইয়্যেদুনা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে এরশাদ করেছেন-
اَنْتَ مِنِّىْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُّوْسى اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ
[بخارى ـ مسلم ـ مشكوة ـ صفحه ـ ৫৬৩] অর্থঃ তোমার সাথে আমার ওই সম্পর্ক রয়েছে, যা (সাইয়্যেদুনা) হযরত হারূনের হযরত মূসার সাথে ছিলো; কিন্তু আমার পরে কোন নবী নেই। (আলায়হিমুস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম)

হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা
সব জ্ঞানীই জানে যে, সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম স্বতন্ত্র নবী ছিলেন না বরং হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর উজির ও তাঁর অনুগামী ছিলেন; যেমন ক্বোরআন মজীদে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- (হযরত মূসা ফরিয়াদ করছিলেন)
وَاجْعَلْ لِىْ وَزِيْرًا مِّنْ اَهْلِىْ هَارُوْنَ اَخِىْ [سورة طه : ايت ـ২৯-ـ৩০] তরজমাঃ ২৯।। এবং আমার জন্য আমার পরিবারবর্গের মধ্য থেকে একজনকে উযীর করে দাও। ৩০।। সে কে? আমার ভাই হারূন।
[সূরা ত্বোয়াহা: আয়াত-২৯-৩০, কানযুল ঈমান] এ কারণে সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম তাওরীত ও হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর শরীয়তের অনুসারী ছিলেন; যদিও মূল নুবূয়তের মধ্যে উভয়ে শরীক ছিলেন। মোটকথা, সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম দু’টি জিনিষের অধিকারী ছিলেনঃ ১. তিনি হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে নুবূয়তে শরীক ছিলেন এবং ২. তিনি তাঁর উজীর ও নায়েব (প্রতিনিধি) ছিলেন। শাহানশাহে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাবূকে তাশরীফ নিয়ে যাবার সময় যখন সাইয়্যেদুনা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে একথা বলেছিলেন, ‘‘আমি চলে যাবার পর তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে, যেমনিভাবে সাইয়্যেদুনা হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন, যখন হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম তূর পর্ব্বতে তাশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, কেউ যেন ভুল না বুঝে, তজ্জন্য সাথে সাথে একথাও বলেছিলেন- اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ(তবে আমার পরে কোন নবী নেই)। অর্থাৎ তুমি শুধু আমার প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হয়েছো, নবী হওনি। হযরত হারূন আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে তোমার শুধু স্থলাভিষিক্ত ও নায়েব হবার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে; কিন্তু নুবূয়তের মধ্যে কোন সাদৃশ্য নেই। কারণ, আমার পরে কোন নবী আসতে পারে না। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ -এর মধ্যে হযরত আলী অধীনস্থ নবী হওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। কারণ হযরত আলী মুরতাদ্বার জন্য স্বতন্ত্র নবী হবার কথা বিন্দুমাত্র কল্পনাও করা যায় না। আবার বিশেষত সাইয়্যেদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপস্থিতি ও জীবদ্দশায় কার মধ্যে এ সন্দেহ বা আশঙ্কা থাকতে পারে যে, সাইয়্যেদুনা হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল করীমকে আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র কিতাব ও স্বতন্ত্র শরীয়ত দান করা হবে? এবং স্বাধীনভাবে তাঁর উপর আল্লাহ তা‘আলার ওহী আসতে শুরু করবে? তাছাড়া স্বতন্ত্র নবীর কারো স্থলাভিষিক্ত হওয়া তো তাঁর স্বতন্ত্র হবার পরিপন্থী (বিরোধী)!
এখন এ বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্ট হলো যে, اِلاَّ اَنَّه لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ (তবে আমার পরে কোন নবী নেই)-এর মধ্যে অধীনস্থ নবী হবার কথাও অস্বীকার করা হয়েছে মর্মে বুঝা যায়, যার মির্যা ক্বাদিয়ানী দাবী করছে। সুতরাং ক্বাদিয়ানী কর্তৃক ‘অধীনস্থ নবী’ হবার দাবী করাও সম্পূর্ণ বাতিল ও অনর্থক হলো।

মির্যা ক্বাদিয়ানীর ধোঁকা
মির্যা ক্বাদিয়ানী কখনো নিজেকে ‘যিল্লী নবী’ (ছায়া নবী) বলে দাবী করেছিলো, কখনো ‘বরূযী নবী’ বলে দাবী করতো, যাতে সাধারণ ও সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে এ ধোঁকায় ফেলতে পারে যে, তার নুবূয়ত তো খাতামুন্ নবিয়্যীন সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধী নয়! অথচ যিল্লী (ছায়া), রূপক ও বরূযী নুবূয়তের পরিভাষাগুলো নিছক মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীরই আবিষ্কার; কিতাব, সুন্নাহ, সাহাবা-ই কেরামের অভিমতগুলো এবং সলফে সালেহীনের মধ্যে কোথাও এর নাম-নিশান পর্যন্ত নেই। কোন প্রকারের নুবূয়তেরও যদি কোন দরজা খোলা থাকতো, তবে ওইসব পবিত্র মনের ব্যক্তিদের জন্য খোলা হতো, যাঁরা নুবূয়তের প্রদীপের উপর পতঙ্গের ন্যায় গিয়ে পড়তেন এবং তাঁর ইশক্ব ও মুহাব্বতের মধ্যে এমনই নিমজ্জিত ও বিলীন ছিলেন যে, পূর্ব ও পরবর্তীদের মধ্যে কোথাও এর নযীর নেই। সুতরাং যেভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নুবূয়তের ধারা সমাপ্ত হয়েছে, তেমনি তাঁর উপর মাহবূবিয়াত (আল্লাহর খাস বন্ধু হবার মর্যাদা) সমাপ্ত হয়েছে। সুতরাং না আসমান ও যমীন এমন ‘মাহবূব’ দেখেছে, না এমন আশিক্ব ও প্রাণ উৎসর্গকারী দেখেছে, না এমন নুবূয়ত-প্রদীপ দেখেছে, না এমন পতঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
যদি কোন প্রকার নুবূয়তের দরজাও খোলা থাকতো, তবে ওই ইয়ারে গার, রফীক্বে জাঁ-নেসার হযরত আবূ বকর, যাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা আপন কিতাবে মুবীনে ‘সানী-ই ইসনা‘ঈন’ (দু’জনের দ্বিতীয়), ‘আত্বকা’ ও উলুল ফদ্বল’-এর মতো উপাধিতে ভূষিত করেছেন, এর জন্য খোলা থাকতো। তখন তিনি তথাকথিত ‘যিল্লী’ কিংবা ‘বরূযী’র মতো কোন না কোন নুবূয়ত তো অবশ্যই পেয়ে যেতেন। অথবা হযরত ওমর ফারূক্বের জন্য নবূয়তের দরজা খুলে যেতো। কেননা, সরওয়ারে দু’ আলম সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁরা দু’জনকেই নিজের উজির বলেছেন। যেমন হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলে খোদা সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
مَامِنْ نَبِىٍّ اِلاَّ وَلَه وَزِيْرَانِ مِنْ اَهْلِ السَّمَآءِ وَوَزِيْرَانِ مِنْ اَهْلِ الْاَرْضِ فَاَمَّا وَزِيْرَاىَ مِنْ اَهْلِ السَّمَآءِ فَجِبْرَائِيْلُ وَمِيْكَائِيْلُ وَاَمَّا وَزِيْرَاىَ مِنْ اَهْلِ الْاَرْضِ فَأَبُوْ بَكْرٍ وَعُمَرُ ـ [ترمذى : مشكوة صفحه ـ ৫৬০] অর্থঃ এমন কোন নবী নেই, যাঁর দু’জন উজির আসমান থেকে এবং দু’জন উজির যমীনবাসীদের থেকে নেই। সুতরাং আসমানগুলো থেকে আমার দু’জন উজির হচ্ছে- হযরত জিব্রাঈল ও হযরত মীকাঈল (আলায়হিমাস্ সালাম) আর যমীনবাসীদের থেকে আমার দু’জন উজির হচ্ছেন (হযরত) আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও (হযরত) ওমর ফারূক (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা)।
এ হাদীস শরীফ থেকে বুঝা গেলো যে, সাইয়্যেদুনা সিদ্দীক্বে আকবার ও সাইয়্যেদুনা ফারূক্বে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা হলেন যমীনে হযরত জিব্রাঈল ও হযরত মীকাঈলের নমুনা এবং হুযূর-ই আক্রামের কর্ম ব্যবস্থাপনার উজিরদ্বয়; কিন্তু কোন প্রকারের নবী নন। যদি, অসম্ভব কল্পনায়ও তাঁরা নবী হতেন, তবে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুগামী ও উম্মতই হতেন; কিন্তু এ দু’জন হযরতকে তো নবী বলেন নি; কেননা, নুবূয়তের ধারা একেবারে খতমই হয়ে গিয়েছিলো। মোটকথা, যখন হযরত জিব্রাঈল ও মীকাঈলের ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বদ্বয় নবী হননি, তখন কি মির্যা ক্বাদিয়ানীর মতো শয়তান আযাযীলের দোসর নবী হতে পারে? মোটেই না।
—০—

খতমে নুবূয়তের উপর সাহাবা-ই কেরাম
এবং সলফে সালেহীনের ইজমা’ প্রতিষ্ঠিত

সাহাবা-ই কেরামের নিকট খতমে নুবূয়তের গুরুত্ব
খতমে নুবূয়তের মাসআলায় সমস্ত সম্মানিত সাহাবী আলায়হিমুর রিদ্বওয়ান একমত। কোন সাহাবীর এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। অনেক নির্ভরযোগ্য শীর্ষস্থানীয় সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম খতমে নুবূয়তের অগণিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)-এর খিলাফতামলের শুরুতে অনেক লোক ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ্দ্ হয়ে গিয়েছিলো। এ নাজুক সময়ে কিছুলোক এ অবস্থাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে ভন্ড নুবূয়তের দাবীদার হয়ে বসেছিলো। যেমন-সাজাহ্ বিনতে হারিস, যে এক ইহুদী গণক নারী ছিলো। সে নুবূয়ত দাবী করেছিলো। একটি জনগোষ্ঠী তার এ মিথ্যা দাবীকে সত্য বলে বিশ্বাসও করেছিলো। এভাবে আস্ওয়াদ আনাসী, যে ইয়ামনের বাসিন্দা ছিলো, ভন্ড নুবূয়তের দাবীদার হয়ে বসেছিলো, অনুরূপ মুসায়লামা কায্যাবও, যে ইয়ামামাহর বাসিন্দা ছিলো, নবী বলে দাবী করেছিলো এবং তার খুব চর্চাও হচ্ছিলো।
খলীফাতুল মু’মিনীন সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুকুম জারী করলেন যেন সর্বপ্রথম ওই বানোয়াট ও ভন্ড নবীদের দমন করা হয়। তখন আস্ওয়াদ আনাসী, মতান্তরে তাওবা করে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়; কিন্তু মুসায়লামা কায্যাব ততদিনে যথেষ্ট সংখ্যক লোককে পথভ্রষ্ট করে নিয়েছিলো এবং এক বিরাট সৈন্যবাহিনীও গঠন করেছিলো। তার মূলোৎপাটনের জন্য প্রথমে সাইয়্যেদুনা হযরত ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলেন।
এরপর সাইয়্যেদুনা হযরত শারজীল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যান; কিন্তু তিনিও সফল হননি। পরিশেষে, হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সৈন্যদল নিয়ে যুদ্ধে গেলেন। তুমুল যুদ্ধ হয়েছিলো। একুশ হাজার মুরতাদ্দ্ জাহান্নামে পৌঁছেছিলো। আর এক হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন; যাঁদের একটি বিরাট অংশ পবিত্র ক্বোরআনের হাফেয ছিলেন।
এ যুদ্ধে মুসায়লামা কায্যাবের গর্দান উড়ানোর মতো বাহাদুরীর মুকুট হযরত ওয়াহ্শীর মাথায় শোভা পেলো। তিনি তাকে জাহান্নামে পৌঁছিয়ে উহুদ যুদ্ধে হযরত হামযাহ্কে শহীদ করার প্রায়শ্চিত্ত (কাফ্ফারা) করেছিলেন। এ যুদ্ধের নাম ইতিহাসে ‘ইয়ামামাহ্র যুদ্ধ’। মোটকথা, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কারো নুবূয়ত দাবী করা হযরত সাহাবা-ই কেরাম সহ্য করেননি। সাজাহ্ ও তুলায়হারও একই ধরনের পরিণতি হয়েছিলো। তারাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।

সাহাবা-ই কেরামের ইজমা’ (ঐকমত্য)
যেসব হযরত নিজ নিজ শির হাতে নিয়ে ইয়ামামার যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন, যাঁরা শাহাদাতের সুধা পান করে তৃপ্ত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই সাহাবী ছিলেন এবং নবী করীমের দরসপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁদেরকে মুসায়লামা কাযযাবের মোকাবেলায় পাঠানো এবং তাঁদেরও যুদ্ধ করা ও শহীদ হওয়া একথা প্রমাণ করে যে, সম্মানিত সাহাবীদের সবার মতে হুযূর সাইয়্যেদুল ‘আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী। তাঁর পরে কোন প্রকারের নবী হবার দাবী করা কুফরী ও মুরতাদ্দ হয়ে যাওয়াই। আর নুবূয়তের ওই মিথ্যা দাবীদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জরুরী। প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত সম্মানিত সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম খতমে নুবূয়তের মাসআলায় একমত ছিলেন। আর আজ পর্যন্ত সত্যপন্থীদের এই মসলক (মতাদর্শ)ই চলে আসছে যে, রাব্বুল আলামীনের মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী।

—০—

খতমে নুবূয়তের উপর সল্ফে সালেহীন
(ইসলামের অগ্রণী বুযুর্গগণ)-এর ঐকমত্য (ইজমা’)
প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছরের দীর্ঘ সময়ে আজ পর্যন্ত মুসলমানগণ ‘খতমে নুবূয়ত’-এর মাসআলায় একমত হয়েছেন; এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে সলফে সালেহীনের কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির ‘খতমে নুবূয়ত’ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি ও আক্বীদা সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি-

ইমাম গাযালী
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘‘সুতরাং এ কারণেই হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে নুবূয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আর তিনি এরশাদ করেছেন-لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ (আমার পরে কোন নবী নেই।) [ত্বিব্বে জিসমানী ও ত্বিব্বে রূহানী, কৃত. ইমাম গাযালী]

ইমাম রাব্বানী
হযরত ইমাম রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী ক্বুদ্দিসা র্সিরুহু বলেন, ‘‘খাতামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ হাস্ত ওয়া ঈসা নুযূল খা-হাদ নমূদ ওয়া আমল বশরী‘আতে ঊ-খাহাদ করদ।’’ অর্থাৎ ‘‘হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসূল, সর্বশেষ নবী, হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম অবশ্যই অবতরণ করবেন এবং তাঁর (হুযূর-ই আক্রাম)-এর শরীয়ত অনুসারে কাজ করবেন।’’
তিনি অন্য এক জাযগায় বলেছেন, اول ایشاں آدم است وخاتم ایشاں محمد رسول اللہ ﷺ অর্থাৎ নবীগণের মধ্যে দুনিয়ার সর্বপ্রথম হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম তাশরীফ এনেছেন এবং সব শেষে তাশরীফ এনেছেন আল্লাহর রসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। [মাক্বতূবাত শরীফ]

মাওলানা রূমী
জনাব মাওলানা রূমী কুদ্দিসা র্সিরুহুল আযীয বলেছেন-
یارسول اللہ رسالت را تمام -تونمودي سمچو شمس بے گماں [مثنوی شریف] অর্থ: হে আল্লাহর রসূল! আপনি রিসালতের ধারাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। একথা আপনি মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন। [মসনভী শরীফ]

হযরত মাহবূবে সুবহানী
হযরত পীরানপীর দস্তগীর সাইয়্যেদুনা মাওলানা হযরত আবদুল ক্বাদের জীলানী ক্বুদ্দিসা সিররুহুল আযীয এরশাদ ফরমান-
سب اہل اسلام کا عقیدہ ہے کہ محمد بن عبد اللہ بن عبد المطلب بن ہاشم (ﷺ) خداوند تعالی کے رسول اور رسولوں کے سردار اور نبوت ان پر ختم ہے -[غنیہ الطالبین صفحہ ۱۱۴] অর্থ: সকল মুসলমানের আক্বীদা বা দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে- হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার রসূল, রসূলগণের সরদার এবং নুবূয়ত তাঁরই উপর সমাপ্ত হয়েছে। [গুনিয়াতুত্ ত্বা-লেবীন, পৃ. ১১৪]

বেরাদরানে ইসলাম!
সাইয়্যেদুনা ওয়া মাওলানা ক্বুত্ববুল আক্বতাব ওয়া শায়খুশ্ শুয়ূখ হযরত আবদুল ক্বাদির জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কতই উৎকৃষ্ট ফয়সালা শুনিয়েছেন! তিনি বলেছেন, ‘খতমে নুবূয়ত’ মুসলমানদের ইজমা’ বা ঐকমত্য বিশিষ্ট মাসআলা। যেসব লোক খতমে নুবূয়তের আক্বীদা পোষণ করে না এবং নবী আসার পরম্পরা জারী রয়েছে বলে বিশ্বাস করে ও বলে তারা ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে গেছে।’’ এটা কতই স্পষ্ট কথা!
হে মির্যাঈ ক্বাদিয়ানীরা! আল্লাহকে ভয় কর! খতমে নুবূয়তের উপর ঈমান এনে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নে! অন্যথায় জাহান্নামে প্রবিষ্ট হবার জন্য প্রস্তুতি নে!

সাইয়্যেদুনা ইমাম আ’যম
ইমামুল আইম্মাহ্ কাশিফুল গুম্মাহ্ সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতে, নুবূয়তের ধারা হাবীবে রব্বে আনাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া বারাকা ওয়াসাল্লাম-এর উপর খতম হয়েছে। তাঁর মতে, নুবূয়তের ভন্ড দাবীদাররা নিশ্চিত কাফির। যারা এমন ভন্ড নবীর নিকট তার নুবূয়তের পক্ষে দলীল তলব করবে সেও কাফির।
সুতরাং তাঁর যুগে এক ব্যক্তি নুবূয়ত দাবী করেছিলো এবং তার নুবূয়তের পক্ষে দলীলাদি পেশ করার জন্য সময় ও সুযোগ চাইলো। তখন সাইয়্যেদুনা ইমাম আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ফাতওয়া আরোপ করলেন, যে ব্যক্তি তার নুবূয়তের দলীল চাইবে সেও কাফির। কারণ, সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এরশাদ মুবারক (বাণী শরীফ) لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ(আমার পরে কোন নবী নেই)-কে অস্বীকার করে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।
[খায়রাতুল হিসান, কৃত. ইবনে হাজর হায়তামী, পৃ. ৫০] মোটকথা, সমস্ত মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদগণ), মুতাকাল্লিমীন (ইসলামী দার্শনিকগণ), ফোক্বাহা (ফিক্বহ্ বিশারদগণ) ও মাশা-ইখের মধ্যে এ মর্মে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, হাবীবে রব্বে আনাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নুবূয়তের দরজা বন্ধ। আর যে ব্যক্তি নবী আসার পরম্পরা জারী রয়েছে বলে বিশ্বাস করবে সে ইসলামের গন্ডি থেকে সম্পূর্ণ খারিজ।

মির্যাঈদের সন্দেহরাজি ও সেগুলোর অপনোদন
আমরা মুসলমান-মু’মিনরা তো আয়াতাংশ ‘খাতামুন নবিয়্যীন’ দ্বারা, নির্ভরযোগ্য তাফসীরগুলোর বরাতে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, মাহবূবে রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নুবূয়ত খতম হয়েছে। আর এ মাসআলায় কোন প্রকারের সন্দেহের অবকাশ নেই।
কিন্তু মির্যাঈরা সত্য সুস্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সন্দেহের অন্ধকাররাশিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। সুতরাং মির্যাঈদের সন্দেহগুলো উল্লেখ করে সেগুলোর অপনোদন করা প্রয়োজন; তখন হয়তো তারা, আল্লাহ্ সার্মথ্য দিলে সত্য বিষয়টি বুঝে সঠিক পথে এসে যাবে।

মির্যাঈদের সন্দেহ-১
যদি ‘খাতামুন নবিয়্যীন’-এর এ অর্থ হয় যে, হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন নবী আসবে না, তাহলে শেষ যুগে সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণ, মুসলমানদের সর্বসম্মত আক্বীদা, কিভাবে শুদ্ধ ও সঠিক হতে পারে?

জবাব (খন্ডন)
‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ এ যে, হুযূর-ই আক্রামের পর কোন নবী পয়দা হবে না; যেমন- ‘আখেরী আওলাদ’ এবং ‘আখেরী পুত্র’-এর অর্থ এ-ই হয় যে, তার পরে আর কোন সন্তান কিংবা পুত্র পয়দা হয়নি। বাকী রইলো হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণের কথা। তিনি হুযূর-ই আক্রামের পূর্বে দুনিয়ায় পয়দা হয়েছিলেন এবং তাঁর শুভাগমনের পূর্বে নবী হয়েছিলেন।
অবশ্যই মির্যা ক্বাদিয়ানী, সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরে পয়দা হয়েছে। সুতরাং মির্যা ক্বাদিয়ানীর অস্তিত্ব খতমে নুবূয়তের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণ খতমে নুবূয়তের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। কারণ, সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম হুযূর-ই আক্রামের অনেক পূর্বে পয়দা হয়েছেন এবং পূর্বে নবী হয়েছেন তারপর তাঁকে আসমানের উপর জীবিত তুলে নেয়া হয়েছে, এখনো জীবিত আছেন, শেষ যমানায় উম্মতে মুহাম্মদীর একজন মুজাদ্দিদ হিসেবে নাযিল হবেন, তাঁর অবতরণও নবী হিসেবে হবে না, নাযিল হবার পর নিজের নুবূয়ত ও রিসালত এবং নিজের কিতাব ইনজীল এবং নিজের শরীয়তের দিকে কাউকে দাওয়াতও দেবেন না; বরং ইমামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিনিধি (নায়েব) হয়ে লোকজনকে নিরেট ক্বোরআন ও হাদীসের বিধানাবলী অনুসারে চালাবেন এবং নিজেও শরীয়ত-ই মুহাম্মাদিয়ার অনুসরণ ও পায়রভীকে নিজের জন্য শত গর্বের কারণ মনে করবেন, আর সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শরীয়তের ঢঙ্কা বাজাবেন। যেমন তাফসীরকারকগণ বলেছেন-
فَاِنْ قُلْتَ قَدْ صَحَّ اَنَّ عِيْسى عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَنْزِلُ فِىْ اخِرِ الزَّمَانِ بَعْدَه وَهُوَ نَبِىٌّ قُلْتُ اِنَّ عِيْسَى عَلَيْهِ السَّلاَمُ مِمَّنْ نُبِّئَ قَبْلَه وَحِيْنَ يَنْزِلُ فِىْ اخِرِ الْزَّمَانِ يَنْزِلُ عَامِلاً بِشَرِيْعَةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمُصَلِّيًا اِلى قِبْلَتِه كَأَنَّه بَعْضُ اُمَّتِه ـ
[تفسير خازن : جلد سوم صفحه ـ৪৭১ـ مدارك صفحه ৪৭১] অর্থ: যদি তুমি এ আপত্তি করো যে, একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, নিশ্চয় সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম শেষ যামানায় হুযূর-ই আক্রামের পরে তাশরীফ আনবেন (নাযিল হবেন) অথচ তিনি নবী, তবে আমি এর জবাবে বলছি, নিশ্চয় সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম তাঁর পূর্বে নবী হয়েছেন, আর যখন শেষ যমানায় নাযিল হবেন, তখন শরীয়তে মুহাম্মদিয়াহ্ অনুসারে আমল করবেন, তাঁর ক্বেবলার দিকে মুখ করে নামায পড়বেন, তাঁরই একজন উম্মত হবেন। [তাফসীর-ই খাযিন: ৩য় খন্ড, পৃ. ৪৭১, মাদারিক: পৃ. ৪৭১]

সন্দেহ-২
মির্যাঈরা বলে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর অর্থ এ যে, তিনি নবীগণের মোহর। তাঁরপর তাঁর মোহর ও সত্যায়ন এবং অনুসরণ দ্বারা নবী হতে থাকবে।’’

জবাব (খন্ডন)
মির্যাঈদের এ সংশয় ও সন্দেহ একেবারে অনর্থক ও অকেজো। আরবী ভাষা এবং আরবী ব্যাকরণের নিয়মাবলীর পরিপন্থী। অন্যথায় একথা অনিবার্য হয়ে যাবে যে, ‘খাতামুল ক্বওম’-এর অর্থ হবে ওই ব্যক্তি, যার মোহর দ্বারা সম্প্রদায় হতে থাকবে। আর ‘খাতামুল মুহাজিরীন’ মানে হবে ওই ব্যক্তি, যার মোহর দ্বারা ‘মুহাজির’ হবে। অনুরূপ ‘খাতামুল আওলাদ’ মানে হবে ওই ব্যক্তি যার মোহর ও সত্যায়ন-প্রত্যয়ন দ্বারা এবং অনুসরণ দ্বারা ‘আওলাদ’ (সন্তান-সন্তুতি) হবে।
সুবহানাল্লাহ্! মির্যাঈদের নিকট কেমন কেমন আশ্চর্যজনক হাক্বীক্বত ও মা‘আরিফ (জ্ঞান-বিজ্ঞান) রয়েছে! তাছাড়া, ‘খাতামুন নবিয়্যীন’-এর তাদের কৃত এ অর্থ আল্লাহর কালামের উদ্দেশ্যের একেবারে বিপরীতও। কেননা, মহান রবের উদ্দেশ্য এ শব্দযুগল দ্বারা এ’যে, হুযূর-ই আক্রামকে এজন্য ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ করে পাঠিয়েছেন যেন নুবূয়তের ধারা তাঁর মাধ্যমে খতম হয়ে যায়। কিন্তু মির্যাঈ বলে, ‘হুযূর-ই আক্রামকে এজন্য প্রেরণ করা হয়নি যে, নুবূয়তের ধারা তাঁর মাধ্যমে খতম হবে, বরং তাঁকে নবী বানানোর জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, যেন ভবিষ্যতেও তাঁর পরে নবী হতে থাকে।’ এ অর্থ আল্লাহ্ তা‘আলার উদ্দেশ্যের একেবারে বিপরীত। সুতরাং এটা প্রত্যাখ্যানযোগ্য ও বাতিল বা ভিত্তিহীন।
তাছাড়া, এ অনর্থক ব্যাখ্যা (তা’ভীল) সাইয়্যেদুনা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ‘ক্বিরাআত’ وَلكِنْ نَبِيَّنا خَتَمَ النَّبِيِّيْنَ (কিন্তু আমার নবী নবীগণের ধারাকে খতম করে দিয়েছেন) এবং ওইসব বরকতময় হাদীসের মধ্যে, যেগুলোতে ‘আ-খিরুল আম্বিয়া’ (اخِرُ الْاَنْبِيَآءِ) ও ‘লা-নাবিয়্যা বা’দী’ (আমার পরে কোন নবী নেই)-এর বচনগুলো এসেছে, এর মোকাবেলায় চলতে পারে না। তাছাড়া, ‘খা-তিম’ (خاتم) মানে খতমকারী, সমাপ্তকারী, সুতরাং যদি তাঁর মোহর ও অনুসরণ দ্বারা নবী হতে থাকে, তবে তো তিনি নবীগণের শুভাগমনের ধারা সমাপ্তকারী (সর্বশেষ নবী) হবেন না!

সংশয়-৩।।
মির্যাঈ বলে (خَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ)বিশিষ্ট আয়াত শরীফে (النَّبِيِّيْنَ)-এর উপর যেই (الف لام) রয়েছে তা (عهد خارجى) অর্থে ব্যবহৃত। এর অর্থ হবে তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্ট কতিপয় শরীয়ত বিশিষ্ট নবীর খাতাম (সমাপ্তকারী), শর্তহীনভাবে সকল সম্মানিত নবী, আলায়হিমুস্ সালাম-এর ‘খাতাম’ (সমাপ্তকারী) নন।

খন্ডন
আমরা ইতোপূর্বে একথা প্রমাণ করেছি যে, (النَّبِيِّيْنَ)-এর মধ্যে الف لام -استغراقى; যা সব নবী আলায়হিমুস্ সালাম বুঝানোর জন্যই। আরবী ভাষা ও পরিভাষা অনুসারে خَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ মানে ‘আখেরুন নবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী)। অর্থাৎ সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম-এর আগমনের ধারা সমাপ্তকারী। সুতরাং الف لام عهدى বলা মারাত্মক ভুল। কারণ الف لام عهدى হবার জন্য পূর্বশর্ত হলো (معهود) (আলিফ-লাম দ্বারা যাকে বুঝানো উদ্দেশ্যে)-এর উল্লেখ ইতোপূর্বেকার বাক্যে স্পষ্টভাবে কিংবা ইঙ্গিতে করা। বস্ততঃ এ আয়াত শরীফের পূর্বাপর কোন বাক্যে কোন শরীয়তসম্মত নবীর উল্লেখ নেই; বরং শর্তহীনভাবে নবীগণের উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং এরশাদ হচ্ছে-
سُنَّةَ اللهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلُ وَكَانَ أَمْرُ اللهِ قَدَرًا مَّقْدُورًا ط الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالاتِ اللهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ ط وَكَفَى بِاللهِ حَسِيبًا [سوره احزاب : ايات :৩৮ـ৩৯] তরজমা: আল্লাহর বিধান চলে আসছে তাদের মধ্যে, যারা পূর্বে অতীত হয়েছে এবং আল্লাহর কাজ সুনির্দ্ধারিত; তারাই, যারা আল্লাহর বাণী প্রচার করে এবং তাঁকে ভয় করে আর আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না এবং আল্লাহ যথেষ্ট হিসাব গ্রহণকারী। [সূরা আহযাব: আয়াত-৩৮-৩৯, কানযুল ঈমান] এখানে اَلَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ (যাঁরা পূর্বে গত হয়েছে)-এর মধ্যে সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম শামিল রয়েছেন আর খোদা তা‘আলার পয়গাম পৌঁছানো এবং আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় না করা মূল নুবূয়তের জন্য অপরিহার্য ও জরুরী। অন্যথায় الف لام কে عهدى ধরা হলে আয়াত শরীফের অর্থ হবে আল্লাহর বিধানাবলীর প্রচার ও আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় না করা শুধু শরীয়তসম্মত নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর উপর ফরয, যারা শরীয়ত সমর্থিত নবী নয়, তাদের জন্য এসব বিষয় জরুরী নয়; অথচ এটা আয়াতের মর্মার্থের পরিপন্থী, বাতিল ও ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, মির্যাঈদের একথা বলা যে, خَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ-এর উপর আলিফ-লাম عهدى (বিশেষ কতিপয় নবী বুঝানো) মারাত্মক ভুল ও না-দুরস্ত।

সংশয়-৪।।
মিযাঈ আরেক সংশয় এটা পেশ করে যে, ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’-এর মর্মার্থ তেমনি যেমন কাউকে ‘খাতিমুল মুহাদ্দিসীন’ অথবা ‘খাতিমুল মুফাস্সিরীন’ লেখা হয়; অথচ তখন কারো মতে এর অর্থ এ নয় যে, এখন তাঁর পরে কোন মুহাদ্দিস কিংবা মুফাস্সির পয়দা হবে না; বরং একথা অতিশয় উক্তি হিসেবে (بطور مبالغه) বলা হয়। মির্যাঈদের এটা বড় গৌরবজনক সংশয়। আর তারা এর সমর্থনে এ বর্ণনা পেশ করে যে, সাইয়্যেদুল আরব ওয়াল ‘আজম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন চাচাজান হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বলেছিলেন-
اِطْمَئِنَّ يَاعَمِّ فَاِنَّكَ خَاتَمُ الْمُهَاجِرِيْنَ فِى الْهِجْرَةِ كَمَا اَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ فِى النُّبُوَّةِ ـ[كنز العمال جلد ششم ـ صفحه ـ ১৭৮] অর্থ: হে আমার চাচাজান! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! কারণ হিজরতের ক্ষেত্রে আপনি এমন ‘খাতামুল মুহাজিরীন’, যেভাবে আমি নবূয়তের ক্ষেত্রে ‘খাতামুন্নবিয়্যীন’। [কানযুল উম্মাল: ষষ্ঠ খন্ড, পৃ. ১৭৮]

খন্ডন
এ সংশয়ের জবাব এ যে, খাতামুল মুহাদ্দিসীন, খাতামুল মুফাস্সিরীন এবং খাতামুল মুহাক্বক্বিক্বীন-এর মধ্যেও ‘খাতাম’ মানে আখেরী’ই। কেননা, মানুষের যেহেতু ভবিষ্যতের খবর থাকে না, সেহেতু সে আপন ধারণানুসারে এটা মনে করে যে, ইনিই আখেরী মুহাদ্দিস, ইনিই আখেরী মুফাস্সির। তাঁকে সে খাতামুন্ মুহাদ্দিসীন ও খাতামুল মুফাস্সিরীন বলে দেয়। এ পরিভাষা ওই স্থানে ব্যবহৃত হয়, যেখানে কারো শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা উদ্দেশ্য হয়। প্রকাশ থাকে যে, শ্রেষ্ঠত্ব তখনই প্রমাণিত হতে পারে, যখন শ্রেষ্ঠত্বের আখেরী সর্বশেষ স্থানটি তাঁর জন্য প্রমাণ করা যায়। যেহেতু এ ধরনের শব্দাবলী নিজের জ্ঞানানুসারে ব্যবহার করে, সেহেতু এ ধরনের শব্দাবলীকে ‘মাজায’ ও ‘মুবালাগাহ্’ (রূপক ও অতিশয়তা) বলে ধরে নেওয়া হয়। কেননা, প্রত্যেকে জানে যে, ‘মুহাদ্দিস হওয়া’, ‘মুহাক্বক্বিক্ব হওয়া’ এবং অন্যান্য গুণাবলী নিজ নিজ উপার্জনই। অর্থাৎ এগুলো বান্দার উপার্জন ও ইচ্ছা দ্বারাই অর্জিত হতে পারে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের জন্য দরজা খোলা থাকবে। কাউকে ‘খাতামুল মুহাদ্দিসীন’ বলার পর কারো তো দূরের কথা, স্বয়ং যে বলেছে তারও এ ধারণা হয় না যে, এখন তার পরে কোন মুহাদ্দিস পয়দা হবে।
সুতরাং এতটুকু জেনে নেয়ার পর, এ পরিভাষা হয়তো মুবালাগাহ্ বা অতিশয়তা বশতঃ বলা হয় অথবা তা’ভীল বা ভিন্ন ব্যাখ্যা যোগ্য হিসেবে বলা হয় যে, ইনি তাঁর যুগের আখেরী মুহাক্বক্বিক্ব, আখেরী মুফাস্সির, আখেরী মুহাদ্দিস, অন্যথায় যদি এ ধরনের ভিন্ন ব্যাখ্যা (তা’ভীল) করা না হয়, তবে এ কথা অকেজো ও অনর্থক বরং স্পষ্ট মিথ্যা হয়ে যাবে।
সারকথা হলো এ যে, এ যুক্তি বা কথা এমন এক মানুষের, যার এ খবর নেই যে, আগামীকাল কোন মুহাদ্দিস, কোন মুফাস্সির ও কোন মুহাক্বক্বিক্ব পয়দা হবে। এতদ্সত্ত্বেও নিজের খেয়াল অনুসারে কাউকে ‘খাতামুল মুহাদ্দিসীন’ অথবা ‘খাতামুল মুফাস্সিরীন’ বলে ফেলে, পক্ষান্তরে সমস্ত অদৃশ্যজ্ঞাতা হলেন খোদা তা‘আলা। একটা অনু-পরামণু পর্যন্ত তাঁর ইলমের বাইরে নেই। তিনি বলেছেন যে, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা খাতামুন্নবিয়্যীন। তাঁর কথা তো বাস্তব ও প্রকৃত সত্য। সুতরাং ওই অজ্ঞ বান্দার বেশীর ভাগ ধারণ প্রসূত, আন্দাযকৃত ও অতিশয়তা মিশ্রিত কথা ক্বিয়াস বা অনুমান কীভাবে গ্রহণা করা যেতে পারে?
কখনো না; বরং ওই সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময় সত্তার কালামকে ‘হাক্বীক্বত’ (প্রকৃত) হিসেবে ধরে নেয়া হবে। কাজেই ওই সর্বজ্ঞ সর্ব বিষয়ে অবগত সত্তা, যিনি ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শব্দ যুগল এরশাদ করেছেন, তা অবশ্যই হাক্বীক্বত বা প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হবে। আল্লাহ্ তা‘আলার কালামকে কোন মতে মাজায (রূপকার্থে) ও কবিত্বপূর্ণ অতিশয়তার অর্থে ব্যবহার করা যাবে না। বিনা প্রয়োজনে হাক্বীক্বতকে বাদ দিয়ে মাজায (রূপক)কে ইখতিয়ার করা আরবী ভাষার মূলনীতিবিদদের মতে জায়েয নয়। তাছাড়া, যখন ক্বোরআনের আয়াতসমূহ, হাদীসসমূহ, সাহাবা-ই কেরামের অভিমতগুলো, তাবে‘ঈন এবং সমস্ত মুফাস্সির ও মুহাদ্দিসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে একথা প্রমাণিত হলো যে, ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ মানে আখেরী নবী, তখন এরপরে কারো এর বিপক্ষে মুখ খোলার বা কথা বলার কোন সুযোগই বাকী থাকেনি।
বাস্তব কথা হচ্ছে- যেই বরকতমন্ডিত সত্তার উপর ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-সম্বলিত আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে, ওই পবিত্র যাতের বর্ণনাকৃত অর্থই গ্রহণযোগ্য হবে।
যদি কিছুক্ষণের জন্য কাল্পনিকভাবে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’-এর এ ওরফী, রূপক ও ভিন্ন ব্যাখ্যাকৃত অর্থ ধরে নেওয়া হয়, তাহলে হযরত আপাদমস্তক নূর, রোজ হাশরে সুপারিশকারী, মাহবূবে রব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বৈশিষ্ট্যই বা কি থাকবে? বরং কেউ সাইয়্যেদুনা হযরত মূসা ও সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস সালামকেও এ ওরফী অর্থে ‘খাতামুন নবিয়্যীন’ বলে বসবে।

হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাদীসের মর্মার্থ
বাকী রইলো সাইয়্যেদুনা হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাদীসের মর্মার্থ। হ্যাঁ, ওখানেও ‘খাতাম’ আখেরী- অর্থে ব্যবহৃত। এর প্রমাণ এ যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে হিজরত ফরয ছিলো। মক্কা মুকাররামাহ্ বিজয়ের পর হিজরত ফরয থাকেনি। যেমন বোখারী শরীফের হাদীসে আছে لاَ هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتَحْ অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের পর হিজরত নেই। হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বে হিজরত করেছিলেন। ‘ইসাবাহ্’ তে আছে-
هَاجَرَ قَبْلَ الْفَتْحَ بِقَلِيْلٍ وَشَهِدَ الْفَتْحَ —[اصابة : جلد سوم ـ صفحه ـ ৬৬৮] অর্থঃ হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বে হিজরত করেছিলেন এবং মক্কা বিজয়ে হাযির ছিলেন। [ইসাবাহ্: ৩য় খন্ড, পৃ. ৬৬৮] এ কারণে সাইয়্যেদুনা আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মনে এ দুঃখ ও বেদনা ছিলো যে, তিনি হিজরতে প্রথম বা অগ্রণী হননি বরং অগ্রণীদের (سابقين) মধ্যে প্রথম (اولين) হওয়ার ফযীলত তিনি অর্জন করতে পারেননি। সুতরাং সাইয়্যেদে দু’ আলম রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত¦না দেওয়ার জন্য এরশাদ করেছিলেন, যদিও আপনার প্রথম অগ্রণী হবার ফযীলত হাতছাড়া হয়েছে; কিন্তু ‘খাতেম’ হবার ফযীলত তো আপনার জন্য রয়েছে। সুতরাং তিনি এরশাদ ফরমায়েছেন- ‘আপনি খাতামুল মুহাজিরীন’ যেভাবে আমি ‘খাতামুন নবিয়্যীন’। অর্থাৎ আপনি আখেরী মুহাজির, যেমন আমি আখেরী নবী। সুতরাং মির্যাঈদের দলীল গ্রহণ ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সংশয় (সন্দেহ)-৫
ভ্রান্ত ক্বাদিয়ানী বলে- উম্মুল মু’মিনীন সাইয়্যেদাহ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন,
قُوْلُوْا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ وَلاَ تَقُوْلُوْا لاَ نَبِىَّ بَعْدَه
অর্থ: তোমরা বলো, তিনি ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী), কিন্তু ‘লা নবিয়্যা বা’দাহু’ (তাঁর পরে কোন নবী নেই) বলোনা, সুতরাং বুঝা গেলো যে, সাইয়্যেদাহ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্র হাদীস শরীফ অনুসারে হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরে নবী আসতে পারবে; নুবূয়তের ধারা এখনো শেষ হয়নি।

খন্ডন
সাইয়্যেদাহ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার এরশাদ বা বাণী পূর্ণাঙ্গরূপে ‘মাজমা‘উল বিহার’-এ উল্লেখ করা হয়েছে। মির্যাঈরা এটাকে অসম্পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করেছে। সুতরাং আমি বর্ণনাটা পূর্ণাঙ্গরূপে উল্লেখ করছি। আর সেটা নি¤œরূপ-
وَفِىْ حَدِيْثِ عِيْسى اَنَّه يَقْتُلُ الْخِنْزِيْرَ وَيَكْسِرُ الصَّلِيْبَ وَيَزِيْدُ فِى الْحَلاَلِ اَىْ يَزِيْدُ حَلاَلَ نَفْسِه بِاَنْ يَتَزَوَّجَ وَيُوْلَدَ لَه وَكَانَ لَمْ يَتَزَوَّجْ قَبْلَ رَفْعِه اِلَى السَّمَآءِ فَزَادَ بَعْدَ الْهُبُوْطِ فِى الْحَلَالِ فَحِيْنَئِذٍ يُؤْمِنْ كُلَّ اَحَدٍ مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ يَتَيَقَّنُ بِاَنَّه بَشَرٌ وَعَنْ عَآئِشَةَ قُوْلُوْا اِنَّه خَاتَمُ الْاَنْبِيَآءِ وَلاَ تَقُوْلُوْا لاَ نَبِىَّ بَعْدَه وَهذَا نَاظِرٌ اِلى نُزُوْلِ عِيْسى وَهذَا اَيْضًا لاَيُنَافِىْ حَدِيْثَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ لِاَنَّه اَرَادَ لاَ نَبِىَّ يَنْسَخُ شَرْعَه [تكمله مجمع الْبحار ـ صفحه ـ ৮৫] অর্থ: সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম সম্পর্কিত ক্বিসসায় আছে, তিনি নাযিল হবার পর শূয়রকে হত্যা করবেন, ক্রুশ ভাঙ্গবেন, নিজের নাফসের হালাল জিনিসগুলো বৃদ্ধি করবেন অর্থাৎ বিবাহ্ করবেন, তাঁর সন্তান হবেন। কেননা সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলা-নাবিয়্যিনা ওয়া আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম আসমানের উপর উঠিয়ে নেয়ার পূর্বে বিবাহ্ করেননি; আসমান থেকে নেমে আসার পর বিবাহ করবেন। সুতরাং ওই সময় আহলে কিতাবের প্রত্যেকে তাঁর নুবূয়তের উপর ঈমান আনবে আর এ কথায় বিশ্বাস করবে যে, তিনি মানুষ (খোদা নন), আর হযরত সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে এ-ই যা বর্ণনা করা হয়েছে, ‘‘তাঁকে ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ বলো, ‘এটা বলো না যে, তাঁর পরে কোন নবী আগমনকারী নেই’ তাঁর এ বাণী হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণকে সামনে রেখেই ছিলো। বস্তুত: হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পুনরায় দুনিয়ায় আসা হাদীস-‘লা নবিয়্যা বা’দী’ (আমার পরে কোন নবী আসবে না)-এর সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কেননা, হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম নাযিল হবার পর হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শরীয়তেরই অনুসারী হবেন। আর ‘লা নবিয়্যা বা’দী’ মানে এমন কোন নবী আসবে না, যে হুযূর-ই আক্রামের শরীয়তকে রহিত করবে; নিজের শরীয়তকে জারী করবে।
এ ইবারত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় যে, সাইয়্যেদাহ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার এ উদ্দশ্য মোটেই ছিলোনা যে, হুযূর-ই আক্বদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ নন; না তিনি হুযূর-ই আক্রামের পরে কোন প্রকার নবী আসা বৈধ মনে করেন; বরং মর্মার্থ এ যে, ‘লা-নবিয়্যা বা’দী’ বাক্যটার বাহ্যিক ব্যাপকতা থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, তাঁরপর পূর্ববর্তী, পরবর্তী, নতুন, পুরাতন কোন নবীই আসবে না; অথচ সহীহ্ হাদীসগুলো থেকে সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম আসমান থেকে নাযিল হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত। এ কারণে সাইয়্যেদাহ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার এ খেয়াল এসেছে যে, কখনো এ প্রকাশ্য ব্যাপক অর্থের কারণে সাধারণ মানুষ হাদীসাংশ ‘লা-নবিয়্যা বা’দী’কে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণের বিরোধী (পরিপন্থী) ও সেটার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করে বসে কিনা। এ কারণে, সতর্কতা স্বরূপ এ বাক্যাংশ বলতে নিষেধ করেছেন।
এ কথার উদ্দেশ্য এটা মোটেই নয় যে, হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হুযূর পুরনূর, শাফি‘ই ইয়াউমিন্ নুশূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর কোন প্রকারের নুবূয়তকে বৈধ মনে করতেন। কেননা এ-ই হযরত সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَآئِشَةَ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّه قَالَ لاَ يَبْقى بَعْدَه مِنَ النُّبُوَّةِ اِلاَّ الْمُبَشِّرَاتُ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا الْمُبَشِّرَاتُ؟ قَالَ اَلرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ يَرَاهَا الْمُسْلِمُ اَوْ تُرى لَه ـ [رَوَاهُ الْبُخَارِىُّ وَالْمِشْكَواةُ صفحه ـ ৩৯৪] অর্থ: হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সরওয়ার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন, তিনি এরশাদ করেছেন, আমার পর নুবূয়তের অংশগুলো থেকে ‘মুবাশশিরাত’ ব্যতীত কোন অংশ অবশিষ্ট থাকবে না। সাহাবা-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম আরয করলেন, ‘‘ইয়া রসূলাল্লাহ্! ‘মুবাশশিরাত’ কি?’’ তিনি এরশাদ করলেন, ‘ভাল স্বপ্ন, যা মুসলমান নিজে দেখে অথবা অন্য কেউ তার জন্য দেখে।’’
সুতরাং যখন সাইয়্যেদাহ্ আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা খোদ মাহবূব-ই রাব্বিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করছেন যে, নুবূয়তের ধারা সমাপ্ত হয়ে গেছে, তখন একথা কিভাবে বলা যেতে পারে যে, হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ‘লা-নবিয়্যা বা’দাহূ’ বলতে এ জন্য নিষেধ করেছেন যে, তিনি নবী-ই আক্রামের পর নুবূয়তের ধারা জারী আছে বলে মনে করতেন? তাছাড়া, ‘লা- নবিয়্যা বা’দী-’ এবং ‘খাতামুন্ নাবিয়্যীন’-এর মর্মার্থ বা ভাবার্থের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আর ‘লা-নাবিয়্যা বা’দাহূ’র হুবহু ওই মর্মার্থই, যা- ‘খাতামুন্ নাবিয়্যীন’-এর-ই। নুবূয়তের ধারা খতম হবার ক্ষেত্রে উভয় শব্দ সমানভাবে প্রযোজ্য।
বুঝা গেলো যে, নিষেধের কারণ ওটা নয়, যা মির্যা ক্বাদিয়ানী বর্ণনা করছে, বরং মূল কারণ হচ্ছে- ‘লা- নাবিয়্যা বা’দাহূ’ বচনটির মধ্যে ব্যাপকতার কারণে বাহ্যতঃ সাধারণ মানুষের জন্য এ সন্দেহের আশংকা ছিলো যে, কেউ আবার ভুল বুঝে সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণকেও অস্বীকার করে কিনা। এ কারণে সাধারণ লোকজনের আক্বীদার হিফাযতের জন্য সাইয়্যেদাহ্ হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা একথা বলেছেন যে, শুধু ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ শব্দযুগল বলে ক্ষান্ত হও; কেননা এ শব্দযুগলই রিসালত ও নবূয়তের ধারা খতম হয়েছে বুঝানোর জন্য যথেষ্ট। আর এ দু’টি শব্দ তাঁর ফযীলত ও সর্দারীকেও প্রকাশ করে। তাই ‘লা- নাবিয়্যা বা’দী’ শব্দযুগল ব্যবহার করোনা; যা’তে সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণের বিরুদ্ধে সন্দেহ সৃষ্টি না হয়।
সাইয়্যেদাহ্ হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা যদি ‘খতমে নুবূয়ত’-এর বিষয়টি অস্বীকার করতেন, তবে ‘খাতামুন্ নাবিয়্যীন’ বলতে কেন নির্দেশ দিতেন, যা প্রকাশ্যভাবে ‘খতমে নুবূয়ত’-এর অর্থ প্রকাশ করে?

সন্দেহ-৬।।
মির্যাঈরা বলে, ‘‘শায়খ মুহি উদ্দীন ইবনে আরবী এবং অন্যান্য বুযুর্গের কথায় বুঝা গেল যে, সরওয়ার-ই কা-ইনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নুবূয়তের ধারা সমূলে বন্ধ করা হয়নি বরং ‘তাশরী‘ঈ নুবূয়ত’ (শরীয়তসম্মত নুবূয়ত) তুলে নেওয়া বা বন্ধ করা হয়েছে। আর হাদীস ‘লা-নাবিয়্যা বা’দী’র মর্মার্থ এ’যে, আমার পর এমন কোন নবী হবে না, যা আমার শরীয়তের বিরোধী হবে; বরং তাঁর শরীয়তের অধীনে হবে। শায়খ ইবনে আরবীর ইবারত নি¤œরূপঃ
اِعْلَمْ اَنَّ النُّبُوَّةَ لَمْ تُرْفَعْ مُطْلَقًا بَعْدَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاِنَّمَا اِرْتَفَعَ نُبُوَّةَ التَّشْرِيْعِ فَقَطْ —-থ[اليواقيت والجواهير : جلد دوم ـ صفحه ৩৯] অর্থ: ‘‘জেনে রাখুন যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নুবূয়তকে সম্পূর্ণরূপে (শর্তহীনভাবে) তুলে নেওয়া হয়নি; নিঃসন্দেহে ‘তাশরী‘ঈ নুবূয়ত’-ই শুধু তুলে নেওয়া হয়েছে।’’ এ থেকে বুঝা গেলো যে, ‘গায়র তাশরী‘ঈ নুবূয়ত’ এখনো বাকী আছে। সুতরাং মির্যা ক্বাদিয়ানীও ‘গায়র তাশরী‘ঈ’ নবী ছিলো।

খন্ডন
হযরত শায়খ মুহি উদ্দীন ইবনে আরবী ক্বুদ্দিসা সিররুহ, সমস্ত সম্মানিত ওলী এবং সমস্ত সম্মানিত সূফী এ মাসআলার উপর একমত যে, নুবূয়ত একেবারে সব ধরনেরই খতম হয়ে গেছে। আর সাইয়্যেদুনা মাদানী তাজদার হাবীবে কির্দগার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুল আম্বিয়া’ বা আখেরী নবী। আর যে ব্যক্তি সরওয়ার-ই দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নুবূয়তের দাবী করে বসে সে কাফির ও মুরতাদ্দ্। তাকে কতল করা ওয়াজিব। হাক্বীক্বত (বাস্তবাবস্থা) এ যে, নুবূয়তের ধারা একেবারে খতম হয়ে গেছে, তাঁর পর কোন প্রকারের নুবূয়ত অবশিষ্ট থাকে নি।
অবশ্য নুবূয়তের কিছু প্রভাব, কিছু পূর্ণতা (গুণ) কোন কোন উম্মতের মধ্যে বাকী থাকে। যেমন হাদীস শরীফে আছে-ذَهَبَتِ النُّبُوَّةُ وَبَقِيَتِ الْمُبَشِّرَاتُ অর্থাৎ নুবূয়ত তো খতম হয়েছে, সুসংবাদদাতা স্বপ্ন অবশিষ্ট রয়ে গেছে। অন্য হাদীস শরীফে আছে- ‘‘ভাল স্বপ্ন নুবূয়তের চল্লিশ কিংবা ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ।’’ [মিশকাত-পৃ. ৩৯৪] উল্লেখ্য, শায়খ ইবনুল আরবী আলায়হির রহমাহর ইবারতটির মর্মার্থও এটাই; মির্যাঈদের বর্ণিত অর্থ-মোটেই নয়। উল্লেখ্য, নুবূয়তের গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত হওয়াকে ‘নবী হওয়া’ বলা যাবে না। যেমন মাথা মানুষের একটি অঙ্গ বা অংশ; কিন্তু নিছক মাথাকে মানুষ বলা যাবে না। অনুরূপ, ভাল স্বপ্ন নুবূয়তের (ছেল্লিশ ভাগের এক) ভাগ বা অংশ; কিন্তু সেটাকে নুবূয়ত বলা যাবে না। সুতরাং নিছক সত্য স্বপ্নদ্রষ্টাকেও নবী বলা যাবে না। সম্মানিত সূফীগণের একথা একেবারে শরীয়তের অনুরূপ; শরীয়তের কোন আলিম সেটার অস্বীকারকারী নন।

‘খতমে নুবূয়ত’ সম্পর্কে দু’ ধরনের আলোচ্য বিষয়
‘খতমে নুবূয়ত’ সম্পর্কে ক্বোরআন ও হাদীসে দু’ ধরনের বিষয়বস্তু এসেছেঃ
এক. এ পদবী সব সময়ের জন্য খতম (বিলুপ্ত) করে দেওয়া হয়েছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কেউই ‘নবী’ পদে ভূষিত হবে না। এ বিষয় নি¤œভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَبْقَ مِنَ النُّبُوَّةِ اِلاَّ الْمُبَشِّرَاتُ قَالُوْا وَمَا الْمُبَشِّرَاتُ قَالَ الرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ ـ رَوَاهُ الْبُخَارِىُّ فِى كِتَابِ الْتَعْبِيْرِ ـ وَزَادَ مَالِكٌ بِرَوَايَةِ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ يَرَاهَا الْمُسْلِمُ اَوْ تُرى لَه
[مشكوة شريف : صفحه ৩৯৪] অর্থ: সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, নুবূয়ত থেকে ‘মুবাশ্শিরাত’ ব্যতীত আর কিছু অবশিষ্ট থাকেনি। সাহাবা-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম আরয করলেন, ‘‘মুবাশ্শিরাত’ কি?’’ তিনি এরশাদ করেন, ‘‘উত্তমস্বপ্ন, যা খোদ্ মুসলমান দেখে অথবা তার জন্য অন্য কেউ দেখে।’’ [মিশকাত শরীফ: ৩৯৪ পৃষ্ঠা] অন্য এক হাদীস শরীফে আছে-ذَهَبَتِ النُّبُوَّةِ وَبَقِيَتِ الْمُبَشِّرَاتُ অর্থাৎ: নুবূয়তের ধারা খতম হয়ে গেছে, মুবাশ্শিরাত বাকী রয়েছে। এ ধরনের হাদীস শরীফগুলো দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ‘নবী’ পদবীটা সব সময়ের জন্য খতম হয়ে গেছে। এখন এ পদটি আর কাউকে দেওয়া হবে না।
দুই. মাহবূবে রব্বে আনাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। নবীগণের আগমনের ধারা সমাপ্তকারী। এটাকে ক্বোরআন-ই করীম ‘খাতামুন্ নবিয়্যীন’ শিরোনামে এবং হাদীস শরীফ ‘খাতামুল আম্বিয়া’, ‘আখেরুল আম্বিয়া’ এবং ‘লা-নাবিয়্যা বা’দী’ শিরোনামে বর্ণনা করেছে। প্রকাশ থাকে যে, এ শিরোনামগুলো প্রথমোক্ত শিরোনামের পরিপন্থী নয়; বরং সেটার সমর্থক।
হযরত শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী ক্বুদ্দিসা র্সিরুহুল আযীয একথা বুঝিয়েছেন যে, নুবূয়ত তো খতম হয়ে গেছে; কিন্তু নুবূয়তের কিছু অংশ, কিছু গুণ ও কিছু প্রভাব, মুবাশ্শিরাত অবশিষ্ট রয়েছে। সুতরাং শায়খ মুহি উদ্দীন ক্বুদ্দিসা সিররুহু তাঁর ‘ফুতূহাত’ শরীফে লিখেছেন-
اَخْبَرَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّ الرُّؤْيَا جُزْءٌ مِنْ اَجْزَاءِ النُّبُوَّةِ فَقَدْ بَقِىَ لِلنَّاسِ فِى النُّبُوَّةِ هذَا وَمَعَ هذَا لاَ يُطْلَقُ اِسْمُ النُّبُوَّةِ وَلاَ النَّبِىُّ اِلَّاَعَلَى الْمُشَرِّعِ خَاصَّةً فَحُجِزَ هذَا الْاِسْمُ لِخُصُوْصِ وَصْفٍ مُعَيَّنٍ فِى النُّبُوَّةِ
[فتوحات : جلد : ২: صفحه ৪৯০] অর্থ: রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সত্য স্বপ্ন নুবূয়তের অংশগুলোর মধ্যে একটি অংশ। সুতরাং নিঃসন্দেহে লোকজনের জন্য এ অংশই বাকী রয়ে গেছে; কিন্তু এতদসত্ত্বেও ‘নুবূয়ত’ ও ‘নবী’ শব্দের ব্যবহার ‘মুশাররি’ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে শরীয়তের বিধানাবালী আনয়নকারী ব্যতীত অন্য কারো উপর হতে পারে না। এ নামকে নুবূয়তের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ গুণের র্ভিত্তিতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
এ-ই শায়খ ইবনে আরবী ক্বুদ্দিসা সিররুহুল আযীয অন্য এক স্থানে বলেছেন-
فَمَا تُطْلَقُ النُّبُوَّةُ اِلاَّ لِمَنِ اتَّصَفَ بِالْمَجْمُوْعِ فَذلِكَ النَّبِىُّ وَتِلْكَ النُّبُوَّةُ الَّتِىْ حُجِزَتْ عَلَيْنَا وَانْقَطَعَتْ فَاِنَّ مِنْ جُمْلَتِهَا التَّشْرِيْعُ بِالْوَحْى الْمَلَكِىِّ وَذلِكَ لاَ يَكُوْنُ اِلاَّ لِلنَّبِىِّ خَاصَّةً ـ [فتوحات : جلد سوم : صفحه ৫৬৮] অর্থ: নবী শব্দটি তখনই প্রযোজ্য হতে পারে, যখন কেউ নুবূয়তের সমস্ত অংশ দ্বারা গুণান্বিত হন। সুতরাং তেমনি ‘নবী’ এবং ‘নুবূয়ত’, যা তার সমস্ত অংশের ধারক হয়, আমাদের জন্য, (অর্থাৎ ওলীগণের জন্যও) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সেটার ধারা সমাপ্ত হয়ে গেছে। এ কারণে নুবূয়ত হচ্ছে সেটার সমাস্ত অংশ সহকারে শরীয়তসম্মত বিধানাবলীই; যা ফেরেশতা কর্তৃক আনীত ‘ওহী’ থেকে পাওয়া যায়। আর এ বিষয়টি নবীর সাথেই খাস; অন্য কারো জন্য হতে পারে না। [ফুতূহাত:৩য় খন্ড:পৃ.৪৬৮] হযরত শায়খ ইবনুল আরবী ক্বুদ্দিসা সিররুহু অন্য এক স্থানে বলেছেন, ‘‘এর উদাহরণ হচ্ছে তেমনি, যেমন হুযূর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اِذَا هَلَكَ كِسْرى فَلاَ كِسْرى بَعْدَه وَاِذَا هَلَكَ قَيْصَرُ فَلاَ قَيْصَرَ بَعْدَه –
-[اليواقيت والجواهير : جلد دوم : صفحه ـ ৩৯] অর্থ: যখন ইরানের বাদশাহ্ কিসরা মারা যাবে, তারপরে আর কোন কিসরা হবে না, আর যখন রোমের বাদশাহ্ কায়সার মারা যাবে, তার পরে আর কোন কায়সার হবে না। [আল ইয়াওয়াক্বীত ওয়াল জাওয়াহীর: ২য় খন্ড, পৃ. ৩৯] সুতরাং যেভাবে কিসরা ও ক্বায়সার মারা যাওয়ার পর ক্বায়সার ও কিসরার নাম শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু পারস্য ও রোম সা¤্রাজ্য মওজূদ রয়েছে, তেমনি আরব ও অনারবের বাদশাহ্ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর তিনি ছাড়া অন্য কারো জন্য ‘নবূয়ত’ ও ‘নবী’ নামও উঠে গেছে; কিন্তু নুবূয়তের কিছু অংশ মুসলমানদের মধ্যে অবশিষ্ট রয়ে গেছে; আর তাও হচ্ছে শুধু ‘মুবাশশিরাত’ (উত্তম স্বপ্ন), ক্বোরআন, হাদীস ও গুণাবলী।

‘শায়খ’-এর বাণীর সারকথা
হযরত শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী ক্বুদ্দিসা সিররুহুর কথা বা বাণীর সারকথা হচ্ছে- ‘নুবূয়ত’ তো খতম হয়ে গেছে, অবশ্য নুবূয়তের কিছু অংশ, গুণাবলী ও মুবাশশিরাত অবশিষ্ট রয়েছে, যেমন হাদীস শরীফ-ذَهَبَتِ النُّبُوَّةُ وَبَقِيَتِ الْمُبَشِّرَاتُ (নুবূয়ত খতম হয়ে গেছে, মুবাশশিরাত বাকী আছে) থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পাচ্ছে যে, ‘নবী’ ও ‘নুবূয়ত’-এ শব্দযুগলের ব্যবহার ততক্ষণ পর্যন্ত হতে পারে না, যতক্ষণ না নুবূয়তের সমস্ত অংশ, যেগুলোর মধ্যে শরীয়তের বিধানাবলী ফেরেশতার মাধ্যমে আসা ওহীও সামিল রয়েছে, পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যাবে। আর শরীয়তের বিধানাবলী ফেরেশতার ওহী দ্বারা ‘নবী’ ও ‘নুবূয়ত’-এর মর্যাদার জন্য আবশ্যকীয়। এ ধরনের শরীয়তের বিধানাবলী ছাড়া নুবূয়ত পাওয়া যেতে পারে না; বস্তুত: শায়খ-ই আকবার (হযরত ইবনুল আরবী)-এর বক্তব্য দ্বারা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর অবতরণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম যদিও অবতরণের পর নবী থাকবেন; কিন্তু তিনি তখন শরীয়ত বিশিষ্ট নবী হবেন না। অর্থাৎ তাঁর পূর্ববর্তী শরীয়ত অনুসারে তিনি আমলকারী হবেন না, বরং তিনি ‘শরীয়তে মুহাম্মদিয়াহ’ (হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার শরীয়ত)-এর অনুসারী হবেন।
এতদ্ব্যতীত, যখন শত শত ‘নাস’ বা (ক্বোরআনী দলীল) ও বরকতময় হাদীস এবং সাহাবা-ই কেরামের বাণী, তাবে‘ঈদের বাণী আর শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের সমস্ত আলিমের স্পষ্ট বর্ণনাদি দ্বারা একথা প্রমাণিত হলো যে, ‘খতমে নুবূয়ত’ ‘উম্মতে মুহাম্মাদিয়াহ্’ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর ইজমা’ বিশিষ্ট আক্বীদা, আর খোদ্ শায়খ-ই আকবার ক্বুদ্দিসা র্সিরুহুর অগণিত বর্ণনা তাঁর ‘ফুসূসুল হিকাম’ ও ‘ফুতূহাত-ই রব্বানিয়াহ্’য় এ মর্মে মওজূদ রয়েছে যে, ‘নুবূয়ত’ শাহানশাহে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর খতম হয়ে গেছে। আর তিনিই সর্বশেষ নবী। সুতরাং এসব সুস্পষ্ট বর্ণনা সত্ত্বেও শায়খ ইবনে আরবীর একটি ‘মুজমাল’ (সংক্ষিপ্ত) ইবারত পেশ করা এবং খতমে নুবূয়ত সম্পর্কে শায়খের সুস্পষ্ট ইবারতকে উপেক্ষা করা, শরীয়তের নাস (দলীল)গুলো এবং ‘ইজমা’-ই উম্মতের বিপরীত পথ বের করা কোন ধরনের দ্বীন ও যুক্তি হলো? আল্লাহ্ হক্ব বুঝা এবং তদনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দান করুন। আ-মী-ন।
তদুপরি, হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর পর নুবূয়তকে তাঁর আওলাদের সাথে খাস করে দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-
وَجَعَلْنَا فِىْ ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ
(এবং আমি তার বংশধরদের মধ্যে নুবূয়ত ও কিতাব নির্দ্ধারণ করে রেখেছি। [২৯:২৭, কানযুল ঈমান] সুতরাং মির্যা ক্বাদিয়ানী নবী নয়; কেননা সে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর বংশধর নয়। [তাফসীর-ই নুরুল ইরফান] এ আয়াত দ্বারা বুঝা গেলো যে, হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর পর যত নবী হয়েছেন সবই তাঁর বংশ থেকে হয়েছেন। [তাফসীর-ই খাযাইনুল ইরফান] অতএব, মির্যা ক্বাদিয়ানী’ যে নবী নয়, বরং নুবূয়তের ভন্ড দাবীদার তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, সে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর বংশধর না হওয়াও একথার অকাট্য প্রমাণ। সে এমন জঘন্য দাবীটি করে নিরেট কাফির, মুরতাদ্দ্ ও চির জাহান্নামী হয়েছে, এতে সন্দেহ কিসের? সুতরাং তার অনুসারীরা এবং তাকে যারা নবী বলে বিশ্বাস করে তারাও কাফির, মুরতাদ্দ এবং নির্ঘাত জাহান্নামী।
আল্লাহ্ তা‘আলা এমন জঘন্য ফির্ক্বা থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করুন। আ-মী-ন। বিরহুমতে খাতামিন্নবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর
সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত

ভন্ডনবী মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী যে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর বংশধর নয় তা সুস্পষ্ট করার জন্য ওই হতভাগার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত উল্লেখ করা প্রয়োজন। উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম এবং তার জীবনী-পুস্তকাদি থেকে জানা যায় যে, মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ খ্রিস্টান্দ, মোতাবেক ১৪ শাওয়াল, ১২৫০ হিজরীতে ভারতের পাঞ্জাবের তদানীন্তনকালীন শিখ রাজা রনজিৎ সিংহের রাজত্বকালে, এক মুঘল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। ১৮৬৮ইংরেজির পর সে পাঞ্জাব থেকে ১৭ মাইল দূরে অবস্থিত ক্বাদিয়ানে তার পিতার ইচ্ছানুসারে চলে আসে। এখানে তার পিতার জমিদারী ছিলো। সেটার দেখাশুনা করার জন্য তার পিতা তাকে সেখানে পাঠিয়েছিলো।

পিতৃপুরষ ও ক্বাদিয়ান
১৬শ শতাব্দির শেষ ভাগে মির্যা ক্বাদিয়ানীর পূর্বপুরুষ মির্যা হাদী বেগ সমরকন্দ (বর্তমান নাম উজবেকিস্তান) থেকে ভারতে আসে। তখন ছিলো মুঘল বাদশাহ্ বাবরের অব্যবহিত পরবর্তী সময়। ‘মির্যা’ ফার্সি শব্দ, মীরযাদা’-এর সংক্ষিপ্তরূপ। এটা তার ফ্যামিলী নাম। মির্যা হাদী বেগ পাঞ্জাব থেকে সতের মাইল দূরে বিয়াস নদীর তীরে এসে ‘ইসলামপুর ক্বাদি’ নামক গ্রামে বসবাস করতে থাকে। এ ‘ইসলামপুর ক্বাদি’ পরবর্তীতে সংক্ষেপে ‘ক্বাদিয়ান’ নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য, পাঞ্জাবে শিখ-শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও কাদিয়ানে মির্যা হাদী বেগের কর্তৃত্ব বহাল থাকে। অবশ্য পাঞ্জাব পরবর্তীতে ইংরেজদের (ব্রিটিশ শাসন) হাতে চলে গেলে ক্বাদিয়ানও মির্যা হাদী বেগের বংশধরদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। মির্যা গোলাম আহমদ ওই হাদি বেগের ১৩শ বংশধর।
মির্যা গোলাম আহমদের পিতার নাম মির্যা গোলাম মুরতাদ্বা, মাতার নাম- চেরাগ বিবি, মির্যা গোলাম আহমদের ছিলো- দু’ই স্ত্রী ও কতিপয় সন্তান-সন্তুতি। তার বংশের ছক নি¤œরূপ-

মির্যা সুলতান আহমদ মির্যা ফযল আহমদ মির্যা বশীর উদ্দীন আহমদ মির্যা বশীর আহমদ মির্যা শরীফ আহমদ মুবারাকা বেগম আমাতুল হাফীয বেগম

২২ জন ছেলে মেয়ে তন্মধ্যে

শৈশব ও লেখাপড়া
মির্যা ক্বাদিয়ানী সামাজিক নিয়মানুসারে ৬ বছর থেকে তার পিত্রালয়ে লেখাপড়া করতে শুরু করে। তার পিতা তার জন্য বিভিন্ন মতবাদের কতিপয় শিক্ষককে তাকে শিক্ষা দানের জন্য নিয়োগ করে। সুতরাং তার ৬ বছর বয়সে শিক্ষক ফজলে ইলাহী তাকে ক্বোরআন পঠন ও ফার্সী ভাষার প্রাথমিক বই পুস্তক পড়ায়। তার ১০ বছর বয়সে শিক্ষক ফজল আহমদ তাকে আরবী ব্যাকরণ (নাহভ-সরফ) ইত্যাদি শিক্ষা দেয়। এরপর তার তৃতীয় শিক্ষক গুলে আলী শাহ্ তাকে মানতিক্ব (তর্কশাস্ত্র) শিক্ষা দেয়। তদুপরি, তার পিতা মির্যা গোলাম মুরতাদ্বা ছিলো এক প্রসিদ্ধ ফিজিশিয়ান। পিতা তার এ পুত্রকে ন্যাচরাল মেডিসিনের শিক্ষা প্রদান করেছে। তাছাড়া, মির্যা গোলাম আহমদ ক্বোরআন ও হাদীসের উপর যৎ সামান্য লেখা পড়া করেছে। তারপর সে খ্রিস্ট ও হিন্দু ইত্যাদি ধর্মের বই-পুস্তকও অধ্যয়ন করতে থাকে। মোটকথা আঠার বছর বয়সে তার শিক্ষা জীবন সমাপ্ত হয়।

কর্মজীবন
ক্বাদিয়ানে পিতার জমিদারী দেখাশুনা করার জন্য মির্যা গোলাম আহমদকে পাঠানো হলেও সে বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের কতিপয় স্থানে চাকুরীর জন্য গমন করে ও সময় অতিবাহিত করে। ভারত বিভক্তির পর গোলাম আহমদ তার কিছু অনুসারীকে নিয়ে পাকিস্তানে চলে আসে এবং রাবওয়া নামক অঞ্চলে বসবাস আরম্ভ করে।

ভন্ড নুবূয়তের দাবী
১৬ই মে ১৯০৮ইংরেজীতে পাকিস্তানের লাহোরে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। জীবনের এক পর্যায়ে তার মাথায় শয়তান চড়ে বসে এবং সে নিজেকে ‘মুজাদ্দিদ’, ‘প্রতিশ্রুত মসীহ্’ ইত্যাদি ঘোষণার পর এক পর্যায়ে নিজেকে ‘নবী’ বলে দাবী করে বসে; অথচ পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীস, ইজমা’ ও ক্বিয়াস এবং ইসলামের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের কিতাবাদিতে অকাট্যভাবে বর্ণিত হয় যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই সর্বশেষ নবী ও রসূল, এটার অস্বীকারকারী অকাট্য কাফির। এতদ্ভিত্তিতে গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী ও তার অনুসারীরা অকাট্যভাবে কাফির বলে সাব্যস্ত হলে, সেটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সে নিজেকে যিল্লী বা ছায়ানবী, বরূযী নবী ইত্যাদি বলে দাবী করে এবং ‘খাতামুন্নবিয়্যীন’-এর নানা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস চালাতে থাকে। কিন্তু তাতে সে সফলকাম হয়নি। বিশ্ব মুসলিম তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং ভন্ড নবী ও অকাট্য কাফির হিসেবে ধিক্কার দিতে থাকে। তার ও তার সমথর্কদের ভ্রান্ত বইপুস্তক, বক্তব্য ইত্যাদি এবং তার নানা ধরনের ইসলামী চরিত্র বিবর্জিত কর্মকান্ড, নিজে কাফির হয়ে এবং ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে শরীয়তবিরোধী সমর্থন, ফাত্ওয়া ইত্যাদি প্রকাশ-প্রচার করে ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আর্থিকসহ নানা ধরনের পার্থিব মদদ কামনা করা ও অর্জন করা ইত্যাদি জন সমক্ষে মধ্যাহ্ণ সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে, সে থেকে এ পর্যন্ত বরং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাকে মুসলিম সমাজ লা’নত ও সর্বান্তকরণে ঘৃণা করতে থাকে ও থাকবে।

‘ভন্ডনবী’র আত্মপ্রকাশের পরম্পরা
ও মির্যা গোলাম আহমদ

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ও রসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সার্বিক সাফল্য দেখে হুযূর-ই আকরামের পবিত্র জীবদ্দশায় ও এর পরবর্তীতে কিছুলোক নুবূয়তের ভন্ড দাবীদার হয়ে বসে। যেমন- মুসায়লাম কায্যাব, আসওয়াদ আনাসী, ত্বোলায়হা ও সাজাহ্ প্রমুখ। হাদীস শরীফেও ক্বিয়ামতের পূর্বে আরো অনেক হতভাগা নুবূওয়ত দাবী করবে বলে হুযূর-ই আক্রাম ভবিষ্যদ্বাণী করে সতর্ক করে দেন।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ নবী হুযূর-ই আক্রামের পর কেউ নিজেকে নবী বলে দাবী করা ধর্মীয় ও প্রচলিত আইনে এমন জঘন্য অপরাধ যে, এমন জঘন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয। এ কারণে হযরত সিদ্দীক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর যুগের প্রত্যেক ভন্ড নবীর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন এবং সাময়িক অভিযান পরিচালনা করে তাদের প্রত্যেককে চিরতরে দমন করে যান। সুতরাং গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী একই অপরাধে অপরাধী বলে সাব্যস্ত। সুতরাং তার জীবদ্দশায় এবং এর পরবর্তীতে সত্যপন্থীরা (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, সংক্ষেপে সুন্নী জমা‘আত) এ মুরতাদ্দ্-কাফির ও তার সমর্থক হতভাগা -ফিৎনাবাজদের বিরুদ্ধে সময়োচিতভাবে জিহাদ, ফাত্ওয়া আরোপ, প্রতিবাদ ও চ্যালেঞ্জ ঘোষণা এবং তর্ক-মুনাযারা ইত্যাদি করে আসছেন। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী, পীর মেহের আলী গোলড়ভী আলায়হিমার রাহমাহ্ প্রমুখ ক্বাদিয়ানীকে চ্যালেঞ্জ করে খন্ডন-পুস্তাকাদি লিখেছেন এবং তর্ক মুনাযারার জন্য তাকে আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য যে, একবার এ শর্তে পীর মেহেরআলী শাহ্ গোলড়ভী আলায়হির রাহমাহ্র সাথে তর্ক-মুনাযারার আয়োজন করা হয় যে, উভয় পক্ষের হাতে কাগজ-কলম থাকবে লিখিত দলীলাদির মাধ্যমে উভয় পক্ষ মুনাযারাহ্ করবে। ক্বাদিয়ানী পরাজয়ের ভয়ে আসেনি। হযরত গোলড়ভী আলায়হির রাহমাহ্ যথাসময়ে উপস্থিত হন এবং বিজয়ী বেশে সারগর্ভ বক্তব্য ও ওয়ায-নসীহত পেশ করেন। তিনি এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘‘ক্বাদিয়ানী তো আসলোনা। আসলে আমার পক্ষে খোদ্ কলমই লিখতো আর এর মাধ্যমে খতমে নুবূয়তের সত্যতা সচক্ষে দেখে সবাই ধন্য হতো।’’ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ মহাভ্রান্ত ক্বাদিয়ানীর ফিৎনা দমনের পরম্পরায় অনেক মারাত্মক দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলোকেও শান্তি-শৃঙ্খলা বহাল করার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ব্যবহার করতে হয়েছে। অনেককে জেলে যেতে হয়েছে।
পাকিস্তানে, আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন ও ধর্মীয় পেশোয়া, রাজনীতিবিদ ও সাংসদ আল্লামা নূরানী ক্বাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য বিভিন্ন অকাট্য প্রমাণাদি সহকারে সংসদে দাবী উত্থাপন করেছিলেন। তখন পাকিস্তানের সরকার প্রধান ছিলেন মরহুম যুলফিকার আলী ভুট্টু। তিনি আল্লামা নূরানীকে বলেছিলেন, ‘‘কারো কাফির হওয়া কিংবা মুসলমান হবার ফয়সালা তো দ্বীনী মাদরাসাগুলোতে করা উচিৎ, পার্লামেন্টে কেন বিষয়টা আনা হলো?’’ তদুত্তরে আল্লামা নূরানী বলেছিলেন, ‘‘ক্বাদিয়ানীরা শুধু ধর্মীয়ভাবে অপরাধীন নয়, রাজনৈতিকভাবেও জঘন্য অপরাধী।’’ এরপক্ষে বিভিন্ন দলীল প্রমাণ উপস্থাপনের সাথে সাথে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘‘ভুট্টু সাহেব! আপনি দেশে এখন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এখন যদি কেউ এসে আপনার ক্ষমতার চেয়ারে বসে যায় এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা করে, তবে তাকে আপনি কি বলবেন এবং তার বিরুদ্ধে কি নির্দেশ জারী করবেন?’’ ভুট্টু সাহেব বলেছিলেন, ‘‘সে হয়তো দেশদ্রোহী, নতুবা পাগল সাব্যস্ত হবে। তার বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ নূরানী সাহেব বলেছিলেন, ‘‘সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র আসনের মর্যাদা দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনের চেয়ে অনেক বেশী। মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানী নিজেকে আল্লাহর সর্বশেষ নবীর পর নবী বলে দাবী করছে।’’ সুতরাং সেদিন সর্বসম্মতিক্রমে ওই সংসদেই ক্বাদিয়ানীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়েছে। আজও তারা অন্যান্য অমুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতো পাকিস্তানে বসবাস করছে। প্রত্যেকটা মুসলিম দেশেও এ জঘন্য কাফির সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করার দাবী উত্থাপিত হচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে এ দাবী যুক্তিযুক্ত ও পূরণ করার একান্ত উপযোগী।

মৃত্যু
ক্বোরআন (কিতাব), সুন্নাহ, ইজমা’ ও ক্বিয়াসের আলোকে নিরেট কাফির মির্যা গোলাম আহমদ ক্বাদিয়ানীর মৃত্যু এবং দাফনও হয়েছিলো অতি ঘৃণ্যভাবে। মারাত্মক আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে সে পাকিস্তানের লাহোর শহরে মৃত্যু মুখে পতিত হয় এবং তার অন্তিম ইচ্ছানুসারে ভারতে পাঞ্জাবের অদূরে ক্বাদিয়ানেই তাকে কবরস্থ করা হয়। তার মৃত্যুতে চতুর্দিক থেকে লা’নত-অভিশাপ এবং ঘৃণার বাণ নিক্ষেপ করা হয়। সর্বোপরি, তার শবযাত্রা যেসব রাস্তা দিয়ে হয়েছিলো ওই সব রাস্তার পাশে ও দালানের উপর থেকে ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করে তার ঘৃণ্য শব দেহকে ঢেকে ফেলা হয়েছিলো। খাসিরাদ্দুনিয়া ওয়াল আ-খিরাহ্। তার উভয় জাহান বরবাদ।
সহীহ হাদীস শরীফের আলোকে কাফিরের কবর যে জাহান্নামের একটি গর্ত হবে, তা এ হতভাগার মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।
আল্লাহ্ তা‘আলা বিশ্বের সকল মানুষকে ক্বাদিয়ানী ফিৎনা থেকে রক্ষা করুন। আর যারা এ জঘন্য ফিৎনার সাথে জড়িয়ে গেছে তাদেরকেও তা থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে ঈমান এনে সরল-সঠিক পথে গমনের তাওফীক্ব দিন।
আ-মী-ন। সুম্মা আ-মী-ন।

-সমাপ্ত-

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment