ক্বোরআন সুন্নাহর আলোকে লায়লাতুল বরাত

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ক্বোরআন সুন্নাহর আলোকে লায়লাতুল বরাত

তরজুমান ডেক্স:-

মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছেন তাঁরই ইবাদতের জন্য। তিনি পবিত্র ক্বোরআনে ইরশাদ করেন- ‘আমি জিন ও মানব জাতি সৃষ্টি করেছি শুধু আমার ইবাদতের জন্য।’ তিনি ইবাদতের জন্য বার মাসের মধ্যে কিছু সময়কে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ করেছেন। এসব সময়ের মধ্যে শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত অন্যতম। এ রাতের ফযিলত সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন- নিশ্চয় আমি একে (ক্বোরআন) নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, অবশ্য আমি সতর্ককারী।’ [সূরা আদ্ দুখান: ৩]

এ আয়াতে বরকতময় রাত বলতে ‘লায়লাতুল বরাত’কে বুঝানো হয়েছে। এটি প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত ইকরামাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ এক দল মুফাসসিরীনে কেরামের অভিমত। সকল তাফসীরকারক এ মতটি তাঁদের স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন।

এ রাতের তাৎপর্য সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস শরীফ পাওয়া যায়। তা থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘‘আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ঘরে পাইনি। অতঃপর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁেক জান্নাতুল বাক্বীতে পেয়েছি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি ভয় কর যে, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তোমার উপর অন্যায় করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মূলত তা নয়; বরং আমি মনে করেছি যে, আপনি আপনার কোন স্ত্রীর নিকট গিয়েছেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে কুদরতিভাবে প্রথম আসমানে আসেন আর কাল্ব নামক গোত্রের ছাগলের সমুদয় পশমের চেয়েও বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন।’’ [তিরমিযী শরীফ, খণ্ড ৩য়, পৃ. ১১৬; শুয়াবুল ঈমান, খণ্ড: ৩য়, পৃ. ৩৭৯]

এ হাদিস শরীফ থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়। এক. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইলমে গায়ব জানতেন। কারণ হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর অন্তরে জাগ্রত প্রশ্ন তিনি বলার পূর্বেই বলে দিয়েছেন। এ ইন্দ্রিয় অগ্রাহ্য বিষয়ে পূর্বে জানাকে ইলমে গায়ব বলা হয়।

দুই. এ রাতে পিতা-মাতার কবর, আউলিয়ায়ে কেরামের মাযার ও আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করা সুন্নাতে রাসূল। কারণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ রাতে জান্নাতুল বাক্বীতে জিয়ারত করতেন। তিন. আল্লাহ্ তা’আলা এ রাতে কাল্ব নামক গোত্রের ছাগলের সমুদয় পশমের চেয়েও বেশি সংখ্যক ব্যক্তিদেরকে এ রাতে ক্ষমা করে দেন। তিনি আরবের কালব গোত্রের ছাগলের পশমের উদাহরণ দিয়েছেন। কারণ কালব গোত্রের ছাগলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল।

হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘‘রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত উপনীত হলে তোমরা ইবাদতের মাধ্যমে রাত উদ্যাপন কর এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা, মহান রাব্বুল আলামীন সূর্য অস্তমিত হবার পর কুদরতিভাবে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে আমি ক্ষমা করব, রিযিক প্রার্থনাকারীকে রিযিক প্রদান করব, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ মুক্ত করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বিভিন্ন কিছু প্রার্থনার জন্য বলতে থাকেন।’’

[সুনানু ইবনে মাজাহ, খ. ১ম, পৃ. ৪৪৪, শুয়াবুল ঈমান, খ. ৫ম, পৃ. ৩৫৪]

এ হাদিস শরীফ থেকে বুঝা যায় যে, লায়লাতুল বরাতের রাত ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে উদযাপন করা আল্লাহ্ তা’আলারই কামনা। এ জন্য তিনি কুদরতিভাবে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে স্বীয় বান্দাদেরকে আহ্বান করেন।

হযরত মুয়ায বিন জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি চন্দ্র বছরের পাঁচটি রাত তথা শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আযহার রাত, আরাফার রাত এবং জিলহজ্ব মাসের আট তারিখ দিবাগত রাত উদযাপন করবে, সেই জান্নাতের হক্বদার হয়ে যাবে।

[ইমাম মুনযিরী, আত তারগীব ওয়াত তারহীব, খ. ১ম, পৃ.২৪৮, কানযুল উম্মাল, খ.৮, পৃ. ৪৪৮]

তবে অন্য বর্ণনা মতে রজব মাসের প্রথম তারিখের দিবাগত রাতের কথাও উল্লেখ রয়েছে। লায়লাতুল বরাতের রাতটি তাৎপর্যপূর্ণ হবার কারণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইবাদতের মাধ্যমে এ রাত উদ্যাপন করেছেন। যেমন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়সাল্লাম এ রাতে নামায পড়ছিলেন এবং সিজদায় দীর্ঘ অবস্থানের কারণে আমি মনে করলাম যে, তিনি ওফাত লাভ করেছেন। তাঁর অবস্থা জানার জন্য আমি তাঁকে নাড়া দিলে তিনি নড়ে উঠেন এবং আমি তাঁকে সিজদায় বলতে শুনেছি ‘হে আল্লাহ্ আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে আপনার শাস্তি থেকে পানাহ্ চাই, আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আপনার রাগ থেকে আশ্রয় চাই, আর আপনার যথাযথ প্রশংসা আমি করতে পারব না; এজন্য আমি আপনার সেই প্রশংসা করছি, যা আপনি আপনার জন্য করেছেন।’ এরপর সিজদাহ থেকে মাথা উত্তোলন করছেন। অতঃপর নামায শেষ করে আমাকে বললেন, হে আয়েশা আল্লাহর রাসূল কি তোমার সাথে কোন ধরনের খিয়ানত করেছেন? আমি বললাম, আল্লাহর শপথ করে বলছি, এ ধরনের কোন কিছু নয়; বরং সিজদায় আপনাকে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারণে আমি মনে করেছি যে, আপনি ওফাত লাভ করেছেন। এ কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি কি জান এটি বরাতের রাত? আমি বললাম, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল ভাল জানেন। এরপর তিনি বললেন, আজ শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। এ রাতে মহান রাব্বুল আলামীনের ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন। রহমত প্রার্থনাকারীদের রহমত প্রদান করেন এবং বিদ্বেষীদের অবকাশ দেন তাওবা করার মাধ্যমে।’’ [শুয়াবুল ঈমান, খ. ৫ম, পৃ. ৩৬১; মুনাভী, আত্-তারগীব ওয়াত্-মুবারক পুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী শরহু সুনানে তিরমিযী, খ. পৃ.৩৬৬]

অনেকে শবে বরাত উদযাপনের কথা ক্বোরআন-সুন্নাহে খুঁজে পায় না; আবার কেউ কেউ বলে থাকে ‘শবে বরাত’ শব্দটি ক্বোরআন-সুন্নাহের কোথাও নেই। মূলত ‘শবে বরাত’ শব্দটি ফারসি আর ক্বোরআন-হাদিস’র ভাষা হলো আরবি। ‘নামায’ শব্দটি যেমনিভাবে ক্বোরআন-হাদিসে নেই তেমনিভাবে ‘শবে বরাত’ শব্দটিও ক্বোরআন হাদিসে নেই। সুতরাং নামাজকে যেভাবে ‘সালাত’ শব্দ দ্বারা খুঁজতে হবে তেমনি ‘শবে বরাত’কেও তার আরবি নাম ‘লায়লাতুম মিন নিসফি শা’বান’ দ্বারা খুঁজতে হবে। এ রাতের বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে, যা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন উপমহাদেশে এটি ‘শবে বরাত’ নামে অধিক পরিচিত; তবে ‘লায়লাতুল বরাত’ নামটিও অধিকাংশ মানুষ জানে। ‘লায়লাতুল বরাতের’ কতিপয় নাম হল- ১. ‘লায়লাতুল মুবারাকাহ্’ তথা বরকতময় রাত, কেননা এতে নেককারদের ওপর অধিক পরিমাণে বরকত অবতীর্ণ হয়। এ বরকত ‘আরশ’ থেকে ‘তাহতাস্ সারা’ পর্যন্ত পৌঁছে। ২. ‘লায়লাতুর রহমত’ বা রহমতের রাত; কেননা এ রাতে আল্লাহর বিশেষ রহমত অবতীর্ণ হয়, ৩.‘লায়লাতুল বরাত’ বা মুক্তির রাত; কেননা এ রাতে মুমিন ব্যক্তির মুক্তি লেখা হয় এবং অসংখ্য জাহান্নামীদের মুক্তি দেয়া হয়। এ নামের ফারসি অনুবাদ হলো ‘শবে বরাত’ যা হাদিস শরীফের ভাবার্থ থেকে নেয়া হয়েছে। কারণ হাদিসে পাকে এসেছে ‘হুম উতাকা উল্লাহ্’ বা তারা মুক্তিপ্রাপ্ত। ৫.লায়লাতুল ক্বিসমাহ্ ওয়াত্-তাক্বদীর বা বন্টনের রাত; কেননা, এ রাতে মানুষের রিযিক বন্টন করা হয়, ৬. ‘লায়লাতুত্ তাগফীর’ বা ক্ষমার রাত। ইমাম সুবকি বলেন, এ রাতে অপরাধীদের অপরাধ ক্ষমা করা হয়, ৭. ‘লায়লাতুল ইজাবা’ বা দোয়া কবুলের রাত, কেননা এ রাতে দোয়া কবুল হয়। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা বলেন, এ রাতটি দোয়া কবুল হয় এমন পাঁচ রাতের একটি, ৮.‘লায়লাতুল হায়াত’ বা অমৃত্যুর রাত; এর কারণ সম্পর্কে হযরত ইসহাক বিন রাহবিয়াহ্ হযরত ওহাব বিন মুনাব্বাহ্ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, এ রাতে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের দফতর সংগ্রহে ব্যস্ত থাকার কারণে মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত কেউ আল্লাহর হুকুমে মৃত্যুবরণ করে না। ৯. ‘লায়লাতু ঈদিল মালায়িকা’ বা ফেরেশতাদের খুশির দিন; কেননা ফেরেশতাদের দুটি ঈদের দিন এটি একটি আর অপরটি হলো লায়লাতুল ক্বদর। ১০. ‘লায়লাতুত্ তাজীম’ বা সম্মানিত রাত, ১১. ‘লায়লাতুল গুফরান ওয়াল ইতকি মিনান নিরান’ বা ক্ষমা করার রাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত।১২. ‘লায়লাতুল ক্বদর’ বা নির্ধারণের রাত; কেননা এ রাত মানুষের হায়াত-মৃত্যু ও রিযিক নির্ধারণের রাত। ১৩. ‘লায়লাতুস্ সক্’ বা দফতর লিপিবদ্ধের রাত। কেননা এ রাতে আমলের দফতর লিপিবদ্ধ করা হয়। ১৪. ‘শবে বরাত’ বা মুক্তির রাত। এটি উপমহাদেশে প্রচলিত।

[আল্লামা আইনী, উমদাতুল ক্বারী, খ. ২য়, পৃ. ৪১৬]

ক্বোরআন-সুন্নাহ্ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, লায়লাতুল বরাত ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে উদযাপন করা শরিয়ত সম্মত। তাই চার মাযহাবের ফোকাহায়ে কেরাম নামায, ক্বোরআন তিলাওয়াত, দুরূদ শরীফ পাঠ, যিকির-আযকার, কবর জিয়ারত, সদকা প্রদান, দোয়া-ইস্তিগফার চাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে এ রাত উদ্যাপন করা মুস্তাহাব হবার পক্ষে মত দিয়েছেন। এমনকি দেওবন্দ-গুরু ইবনে তাইমিয়া, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ আলেমগণ এ রাত ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব হবার পক্ষে মত দিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও কতিপয় ব্যক্তি এ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।

আরবি মাসের মধ্যে শা’বান মাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘শা’বান আমার মাস, আর রমযান আল্লাহর মাস।

[ইমাম সুয়ূতী, আল্ জামেঊস সগীর, খ.২, পৃ. ৮; ইমাম সাখাভী, আল্ মাক্বাছিদুল হাসানাহ্ খ. ১ম, পৃ.৪০৫]

আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে লায়লাতুল বরাতের যথাযথ ইবাদত-বন্দেগী, ফুয়ূজাত আর বরকাত হাসিল করার তাওফীক দান করুন এবং শা’বান মাসের ফযিলত আমাদেরকে নসিব করুন। আমিন।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment