কুরবানী সম্পর্কিত জরুরি মাসয়ালাসমূহের সংকলন।
সওয়াল: কুরবানী কার উপর ওয়াজিব?
জাওয়াব: যিলহজ্জ মাসের দশ, এগার, বার অর্থাৎ দশ তারিখের সুবহে সাদিক হতে বার তারিখের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি কেউ মালিকে নিসাব হয় অর্থাৎ হাওয়ায়েজে আসলিয়াহ্ (নিত্যপ্রয়োজনীয় ধন-সম্পদ) বাদ দিয়ে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা বা তার সমপরিমাণ মূল্যের মালিক হয়, তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। উল্লেখ্য যে, যদি কারো নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকে এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয়, যেমন- কারো পাঁচটি ঘর আছে, একটির মধ্যে সে থাকে আর তিনটির ভাড়া দিয়ে সে সংসার চালায় আর একটি অতিরিক্ত, যার মূল্য নিসাব পরিমাণ। এ ক্ষেত্রে তার উপরে কুরবানী ওয়াজিব হবে।
সওয়াল: ওয়াজিব ও নফল কুরবানী, ওলীমা ও আক্বীকা এক সাথে জায়িয হবে কিনা?
জাওয়াব: হ্যাঁ, জায়িয হবে।
সুওয়াল: আইয়ামে নহর বা কুরবানীর দিনে কুরবানীর পশু কুরবানীকরার পূর্বে অথবা কুরবানী করার সময়ে হাঁস, মুরগী, কবুতর ইত্যাদি যবেহ্ করা জায়িয আছে কি?
জাওয়াব: মুসলমানদের আইয়ামে নহর বা কুরবানীর দিনে যারা মজুসী বা অগ্নী উপাসক তারা তাদের ধর্মীয় বিধান মুতাবিক হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে থাকে। এখন যদি কোন মুসলমান তাদের সাথে মুশাবা বা সাদৃশ্য রেখে কোরবানীর দিন হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে, তাহলে সেটা কুফরী হবে। কারণ আল্লাহ্ পাক উনার রসূল, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ: “যে, যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।”আর যদি কোনো মুসলমান সাধারণভাবে উক্ত সময়ে হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে, তাহলে সেটা মাকরূহ্ তাহ্রীমী হবে, যেহেতু এটাও মোশাবাহ্ হয়ে যায়। আর যদি কোনো মুসলমান খুব জরুরতে হাঁস-মুরগী ইত্যাদি যবেহ্ করে, তাহলে সেটাও মাকরূহ্ তান্যিহী হবে। আর এমন কোনো মুসলমান, যার উপর কুরবানী ওয়াজিব অথবা ওয়াজিব নয়, তারা যদি কুরবানীর দিন হাঁস, মুরগী ইত্যাদি খেতে চায়, তাহলে তারা যেন সুব্হে সাদিকের পূর্বেই সেটা যবেহ্ করে, কেটে, পাক করে রেখে দেয় অথবা শুধু যবেহ্ করে, কেটে রেখে দিবে পরে পাক করলেও চলবে।
সুওয়াল: কুরবানীর পশু যবেহ করার পূর্বে চামড়া বিক্রি করা জায়িয আছে কি?
জাওয়াব: কুরবানীর পশু অথবা অন্য যে কোনো হালাল পশুই হোক, তা যবেহ করার পূর্বে চামড়া বিক্রি করা জায়িয নেই। এমনিভাবে বাঁটে দুধ থাকতে, ঝিনুকে মুক্তা থাকতে, মেষের পিঠে লোম থাকতে, সে দুধ, মুক্তা, লোম বিক্রি করা নাজায়িয।
সওয়াল: হালাল পশুর কোন কোন অংশ খাওয়া নিষিদ্ধ?
জাওয়াব: কুরবানী বা হালাল পশুর ৮টি জিনিস খাওয়া যাবে না। (১) দমে মাছফুহা বা প্রবাহিত রক্ত হারাম, (২) অন্ডকোষ, (৩) মুত্রনালী, (৪) পিত্ত, (৫) লিঙ্গ, (৬) গুহ্যদ্বার, (৭) গদুদ বা গুটলী মাকরূহ্ তাহ্রীমী, (৮) শিরদাড়ার ভিতরের মগজ, এটা কেউ মাকরূহ্ তাহ্রীমী, আবার কেউ মাকরূহ্ তান্যিহী বলেছেন।
সুওয়াল: কুরবানীর কিছুদিন আগে নাকি হাত ও পায়ের নখ কাটা, মোছ ছাঁটা এবং মাথার চুল ইত্যাদি কাটা যায় না? কুরবানী করার পর কাটতে হয়! কথাটা কতটুকু সত্য? বিস্তারিত জানাবেন।
জাওয়াবঃ হ্যাঁ, যারা কুরবানী দেয়ার নিয়ত রাখেন, তাদের পক্ষে যিলহজ্জের চাঁদ ওঠার পর থেকে এই চাঁদের দশ তারিখ কুরবানী করা পর্যন্ত মাথার চুল, হাতের ও পায়ের নখ ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব। যেমন হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে,
عن ام سلمة عليهاالسلام قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من راى هلال ذى الحجة و اراد ان يضحى فلا ياخذ من شعره ولا من اظفاره.
অর্থঃ- “হযরত উম্মে সালামা আলাইহাস সালাম থেকে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখলো এবং কুরবানী করার নিয়ত করলো, সে যেন (কুরবানী না করা পর্যন্ত) তার শরীরের চুল, নখ ইত্যাদি না কাটে।” (মুসলিম শরীফ)মূলত, ছহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো এই যে, যারা কুরবানী করবে এবং যারা কুরবানী করবে না, তাদের উভয়ের জন্যই উক্ত আমল মুস্তাহাব ও ফযীলতের কারণ। আর এ ব্যাপারে দলীল হলো এ হাদীছ শরীফ।
যেমন হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত আছে,
عن عبد الله بن عمرو رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم امرت بيوم الاضحى عيدا جعله الله لـهذه الامة قال له رجل يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ارايت ان لم اجد الا منيحة انثى افاضحى بـها قال لا ولكن خذ من شعرك واظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك فذلك تمام اضحيتك عند الله.
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, মহান আল্লাহ্ পাক উনার রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “আমি কুরবানীর দিনকে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। মহান আল্লাহ পাক তিনি উক্ত দিনটিকে এই উম্মতের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি যদি একটি মাদী মানীহা (উটনী) ব্যতীত অন্য কোন পশু কুরবানীর জন্য না পাই, তাহলে আপনি কি (আমাকে) অনুমতি দিবেন যে, আমি উক্ত মাদী মানীহাকেই কুরবানী করবো। জবাবে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, না। তুমি উক্ত পশুটিকে কুরবানী করবে না। বরং তুমি কুরবানীর দিনে তোমার (মাথার) চুল ও হাত-পায়ের নখ কাটবে। তোমার গোঁফ খাট করবে এবং তোমার নাভীর নিচের চুল কাটবে, এটাই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট তোমার পূর্ণ কুরবানী অর্থাৎ এর দ্বারা তুমি মহান আল্লাহ্ পাক উনার নিকট কুরবানীর পূর্ণ ছওয়াব পাবে।” (আবু দাউদ শরীফ)উক্ত হাদীছ শরীফ-এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে যে, যারা কুরবানী করবে না, তাদের জন্যও যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত নিজ শরীরের চুল, নখ ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব। আর যে ব্যক্তি তা কাটা থেকে বিরত থাকবে, সে একটি কুরবানীর ছওয়াব পাবে।
সুওয়াল: বর্তমান সময়ে কোনো ব্যক্তি যদি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নামে ছাগল, বকরী, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি কুরবানী দেয় অথবা গরু, মহিষ, উটের সাত নামের মধ্যে যদি এক নাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারকে দেয়, তবে উক্ত নামের গোশ্তের হুকুম কী? এটা কি সকলে খেতে পারবে? অথবা এ গোশ্ত অছিয়তকৃত গোশ্তের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে কি-না?
জাওয়াব: হ্যাঁ, উক্ত কুরবানীকৃত গোশ্ত সকলে খেতে পারবে। আর এটা অছিয়তকৃত গোশ্তের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা হাদীছ শরীফ-এ আছে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে বিশেষভাবে কুরবানী করার জন্য যে নির্দেশ দিয়েছেন এটা উনার জন্যই খাছ।বর্তমান সময়ে কোনো ব্যক্তি যদি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তরফ থেকে কুরবানী দেয়, তবে এটা তার ফযীলত, তথা বারাকাত, ফুয়ুজাত, নিয়ামত, রহ্মত, মাগফিরাত, নাজাত সর্বোপরি মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টি লাভ করা ও তার কুরবানী কবুল হওয়ার একটি উসীলা হবে।
কাজেই মহান আল্লাহ্ পাক উনার রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তরফ থেকে যদি কেউ কুরবানী দেয়, তবে উক্ত কুরবানীকৃত গোশ্ত সকলেই খেতে পারবে।
সুওয়াল: কুরবানী করার সুন্নতী পদ্ধতি এবং নিয়ত জানালে খুশি হবো।
জাওয়াব: কুরবানীর পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে এবং পা পশ্চিম দিকে রেখে অর্থাৎ ক্বিবলামুখী করে শোয়ায়ে পূর্ব দিক থেকে চেপে ধরতে হবে, তারপর কুরবানী করতে হবে। আর কুরবানী করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, সীনার উপরিভাগ এবং কণ্ঠনালীর মাঝামাঝি স্থানে যেন যবেহ করা হয়। আরো উল্লেখ্য যে, গলাতে চারটি রগ রয়েছে, তন্মধ্যে গলার সম্মুখভাগে দুটি- খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী এবং দু’পার্শ্বে দুটি রক্তনালী। এ চারটির মধ্যে খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং দুটি রক্তনালীর মধ্যে একটি অবশ্যই কাটতে হবে। অর্থাৎ চারটি রগ বা নালীর মধ্যে তিনটি অবশ্যই কাটতে হবে, অন্যথায় কুরবানী হবে না। যদি সম্ভব হয়, তবে ছুরি চালানোর সময় বেজোড় সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
কুরবানীর নিয়ত: (যবেহ করার পূর্বে)
انى وجهت وجهى للذى فطر السموت والارض حنيفا وما انا من المشركين ان صلاتى ونسكى ومحياى ومماتى لله رب العلمين لا شريك له وبذلك امرت وانا من المسلمين. اللهم منك ولك. উচ্চারণ: ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বা হানিফাঁও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না ছলাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহ্ইয়া ইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রব্বিল আলামীন। লা শারীকালাহু ওয়া বি যালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা। এ দোয়া পড়ে বিস্মিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবেহ করতে হবে। যবেহ করার পর এ দোয়া পড়বে-
اللهم تقبله منى كما تقبلت من حبيبك سيدنا رسول الله صلى الله عليه وسلم وخليلك سيدنا حضرت ابراهيم عليه السلام
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বালহু মিন্নী কামা তাক্বাব্বালতা মিন হাবীবিকা সাইয়্যিদিনা রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খলীলিকা হযরত ইবরাহীমা আলাইহিস সালাম।যদি নিজের কুরবানী হয়, তবে মিন্নী বলতে হবে। আর যদি অন্যের কুরবানী হয়, তবে মিন শব্দের পর যার বা যাদের কুরবানী, তার বা তাদের নাম উল্লেখ করতে হবে। আর যদি অন্যের সাথে শরীক হয়, তাহলে মিন্নী ও বলবে, অতঃপর মিন বলে অন্যদের নাম বলতে হবে।কেউ যদি উপরোক্ত নিয়ত না জানে, তাহলে জবেহ করার সময় শুধু বিস্মিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে কুরবানী করলেও শুদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ নিয়ত অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে অবশ্যই প্রত্যেক যবেহকারীর উচিত উপরোক্ত নিয়ত শিক্ষা করা। কেননা উপরোক্ত নিয়ত পাঠ করে কুরবানী করা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।
সুওয়াল: মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করা জায়িয কিনা?
জাওয়াব: কুরবানী মহান আল্লাহ পাক উনার নাম মুবারক-এ করতে হবে। যেমন- بسم الله الله اكبر
উচ্চারণ: “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলে কুরবানী করতে হবে।এখন যদি কেউ কোনো ব্যক্তির নামে, হোক সে জীবিত অথবা মৃত-এর নামে করে, যেমন- “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” এর পরিবর্তে আব্দুর রহীম, আব্দুল করীম, বকর, যায়িদ, আমর ইত্যাদি নামে কুরবানী করে, তাহলে কুরবানী অশুদ্ধ হবে। উক্ত পশুর গোশ্ত খাওয়াও হারাম হবে ও সাথে সাথে কুফরী ও কবীরা গুনাহ হবে। মূলত, কুরবানী একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার নাম মুবারক-এই করতে হবে। তবে পশুতে সাত নাম ও এক নাম দেয়ার কথা যে উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলো- সাতজন অথবা একজন (চাই তারা জীবিত হোক অথবা মৃত হোক)-এর তরফ থেকে বা পক্ষ থেকে আল্লাহ পাক উনার নাম মুবারক-এ কুরবানী করা।
এ মাসয়ালাটি না বুঝার কারণে অনেকে সরাসরি বলে থাকে, কুরবানীর পশুতে মৃত পূর্ব পুরুষদের নাম দেয়া যাবে না। নাউযুবিল্লাহ!
সুওয়াল: যে সকল মাদরাসার লিল্লাহ্ বোডিংয়ে যাকাত, ফিতরা ও কুরবানীর চামড়া তোলা হয়, সে লিল্লাহ বোডিংয়ে উক্ত মাদরাসার শিক্ষকগণ খেতে পারবে কিনা? এবং সে টাকা দ্বারা শিক্ষকদের বেতন দেয়া ও ছাত্রদের থাকা ও পড়ার জন্য মাদরাসা ঘর তৈরি করা জায়িয হবে কিনা? বিস্তারিত জানিয়ে উপকৃত করবেন।
জাওয়াব: যাকাত, ফিতরা, কুরবানীর চামড়া বা তার মূল্য ইত্যাদি গরিব, মিস্কীন ও ইয়াতীমদের হক্ব অর্থাৎ ওয়াজিব ছদ্কা (আদায় হওয়ার জন্য) গরিব, মিস্কীন ও ইয়াতীমদেরকে তার (ছদ্কার) মালিক করে দেয়া শর্ত। তাই যে সকল মাদাসায় লিল্লাহ বোডিং অর্থাৎ গরিব, মিস্কীন ও ইয়াতীম ছাত্র রয়েছে, সে সকল মাদরাসায় যাকাত, ফিতরা ও কুরবানীর চামড়া বা তার মূল্য দেয়া যেরূপ জায়িয, তদ্রƒপ মাদরাসা কর্তৃপক্ষের জন্য তা লিল্লাহ্ বোডিংয়ে গ্রহণ করাও জায়িয।উল্লেখ্য, উক্ত ছদ্কার টাকা দিয়ে শুধুমাত্র ছাত্রদেরকে খাওয়ালেই চলবে না; বরং ছাত্রদেরকে তা’লীম দেয়ার জন্য ওস্তাদ বা শিক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে ও ছাত্রদের থাকার জন্য ঘরের দরকার রয়েছে, আর তার জন্যে টাকা-পয়সারও জরুরত রয়েছে। তাই সম্মানিত ফক্বীহ্গণ এরূপ ছদ্কার ব্যাপারে একটি সুন্দর সমাধান বা ফায়সালা দান করেছেন। অর্থাৎ উনারা বলেছেন, “ছদ্কার টাকা হিলা করা হলে, তা দ্বারা ওস্তাদদের বেতন দেয়া, খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও মাদরাসার জন্য ঘর তৈরি করা সবই জায়িয।”
আর হিলার পদ্ধতি হলো- মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কোনো গরিব, মিস্কীন বা ইয়াতীমকে উক্ত ছদ্কার টাকাগুলোর মালিক করে দিবে। অতঃপর উক্ত গরিব, মিস্কীন ও ইয়াতীম সে টাকাগুলো মাদরাসায় দান করে দিবে।
অতএব, শুধুমাত্র উক্ত ছূরতেই ছদ্কার টাকা দিয়ে ওস্তাদদের বেতন দেয়া, খাওয়ার ব্যবস্থা করা ও মাদরাসার জন্য ঘর তৈরি করা জায়িয ও শরীয়তসম্মত।
সুওয়াল : অনেকে বলে থাকে, সন্তানের নামে যে পশু আক্বীকা দেয়া হয়, তার গোশ্ত পিতা-মাতা খেতে পারবে না, এটা শরীয়তসম্মত কী-না? জানালে খুশি হবো।
জাওয়াব: যারা বলে, সন্তানের নামে যে পশু আক্বীকা দেয়া হয় তার গোশ্ত পিতা-মাতা খেতে পারবে না তাদের সে কথা শরীয়তসম্মত নয়। শরীয়তের মাসয়ালা হলো, আক্বীকার পশুর গোশতের হুকুম কুরবানীর পশুর গোশতের হুকুমের মতো। কাজেই, সন্তানের নামে যে পশু আক্বীকা দেয়া হবে তার গোশত পিতা-মাতাসহ সকলেই খেতে পারবে। এটাই শরীয়তসম্মত মাসয়ালা বা ফতওয়া।
সুওয়াল : যে ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব, সে তার নিজের নামে কুরবানী না দিয়ে মৃত বা জীবিত পিতা-মাতার নামে কুরবানী দিলে তার নিজের কুরবানী আদায় হবে কিনা?
জাওয়াব: আমাদের হানাফী মাযহাব মতে মালিকে নিছাব প্রত্যেকের উপর আলাদাভাবে কুরবানী করা ওয়াজিব। যার উপর কুরবানী ওয়াজিব তার পক্ষ থেকেই কুরবানী করতে হবে। যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে তার নামে কুরবানী না করে মৃত বা জীবিত অপরের নামে কুরবানী করলে ওয়াজিব তরকের কারণে সে কঠিন গুনাহে গুনাহগার হবে। যদিও বাবা মা-এর নামে কুরবানী করে; যাদের প্রতি কুরবানী ওয়াজিব নয়।
সুওয়াল : কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করে সে টাকা মসজিদ কিংবা ঈদগাহের ইমামকে দেয়া জায়িয হবে কিনা?
জাওয়াব: মসজিদ ও ঈদগাহে ইমামতি করা বাবদ উক্ত টাকা ইমাম ছাহেবকে দেয়া জায়িয হবে না। অবশ্য ইমাম ছাহেব যদি ফিতরা ও কুরবানীর ছাহিবে নিছাব না হন, তাহলে দান হিসেবে উক্ত টাকা নিতে পারেন। কিন্তু ছাহিবে নিছাব হলে, তা নিতে পারবেন না। আর চামড়া বিক্রয় না করে পুরো চামড়াটিই যদি ইমাম সাহেবকে হাদিয়া হিসেবে দেয়া হয়, তবে ইমাম ধনী হলেও তা নিতে পারবেন। তবে চামড়া বিক্রি করলে তার মূল্য গরিব-মিসকীনদেরকে দিয়ে দিতে হবে।
সুওয়াল : যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় তাদেরকে দেখা যায় যে, তারা ঈদ বা কুরবানীর দিনে কিছু লোক মিলে গরু বা ছাগল ইত্যাদি কিনে যবেহ করে গোশ্ত বণ্টন করে উক্ত দিনে খেয়ে থাকে, আবার কেউ কেউ হাটবাজার থেকে গোশ্ত কিনে উক্ত দিনে খেয়ে থাকে। এ সকল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কুরবানীর ছওয়াব লাভের কোনো উপায় আছে কি?
জাওয়াব: হ্যাঁ, যে সকল লোক এককভাবে কুরবানী দিতে অক্ষম বা যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় অথচ তারা কুরবানীর দিনে কিছু লোক মিলে গরু, ছাগল ইত্যাদি কিনে গোশ্ত বণ্টন করে অথবা হাটবাজার থেকে গোশ্ত কিনে খেয়ে থাকে এ সকল লোকেরা যদি ইচ্ছে করে তবে তারাও কুরবানীর ফযীলত ও ছওয়াব লাভ করতে পারে। উল্লেখ্য, যারা কুরবানী দেয় না, তাদের অনেকেই সাধারণভাবে হাঁস-মুরগি ইত্যাদি রান্না করে থকে। আবার যারা কুরবানী দেয়, তাদের অনেকেও হাঁস-মুরগি ইত্যাদি যবেহ ও রান্না করে থাকে। সেক্ষেত্রে সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, মুসলমানদের আইইয়ামে নহর বা কুরবানীর দিনে যারা মজূসী বা অগ্নি উপাসক তারা তাদের ধর্মীয় বিধান মুতাবিক হাঁস, মোরগ ইত্যাদি যবেহ করে থাকে। এখন যদি কোনো মুসলমান তাদের সাথে মুশাবা বা সাদৃশ্য রেখে কুরবানীর দিন হাঁস, মোরগ ইত্যাদি যবেহ করে, তাহলে সেটা কুফরী হবে। কারণ মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন-“যে ব্যক্তি, যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (আবূ দাউদ শরীফ)
আর যদি কোনো মুসলমান সাধারণভাবে উক্ত সময়ে হাঁস, মোরগ ইত্যাদি যবেহ করে, তাহলে সেটা মাকরূহ তাহরীমী হবে, যেহেতু এটাও মোশাবাহ হয়ে যায়।
আর যদি কোনো মুসলমান খুব জরুরতে হাঁস, মোরগ ইত্যাদি যবেহ করে, তাহলে সেটাও মাকরূহ তানযীহী হবে। আর এমন কোনো মুসলমান, যার উপর কুরবানী ওয়াজিব অথবা ওয়াজিব নয়, তারা যদি কুরবানীর দিন হাঁস, মুরগি ইত্যাদি খেতে চায়, তাহলে তারা যেনো ছুবহে ছাদিকের পূর্বেই সেটা যবেহ করে কেটে পাক করে রেখে দেয় অথবা শুধু যবেহ করে কেটে রেখে দিবে, পরে পাক করলেও চলবে। অপরদিকে যারা কুরবানী দেয় না, তাদের অনেকে বাজার থেকে গরু, মহিষ ইত্যাদির গোশ্ত ক্রয় করে থাকে।
অতএব, এ সকল ব্যক্তিদের করণীয় হচ্ছে- তারা হাটবাজার থেকে গোশ্ত না কিনে বরং কিছু লোক মিলে গরু বা ছাগল ইত্যাদি কিনে এক বা একাধিক নামে কুরবানী করা। কুরবানীর পশু গরু, মহিষ ও উটে সাত নাম এবং দুম্বা, মেষ বা ভেড়া, বকরী, খাসিতে এক নাম দেয়ার হুকুম রয়েছে। গরু, মহিষ, উটে সাত নামের বেশি দিলে কুরবানী দুরুস্ত হবে না। আর সাত নামের কমে কুরবানী করলে দুরুস্ত হবে। আর ছাগল, দুম্বা, ভেড়া এক নামের বেশী নামে কুরবানী করলে কারো কুরবানী দুরুস্ত হবে না। যেমন- যদি ৪০ জন ব্যক্তি ৫০০ টাকা করে ২০,০০০ টাকা দিয়ে একটা গরু কিনে সাত নামে বা তার থেকে কম নামে কুরবানী করে গোশ্ত বণ্টন করে নেয়, তাতেও কুরবানী শুদ্ধ হবে। তদ্রƒপ একটা খাসি তিনজনে মিলে পয়সা দিয়ে খরীদ করে, যদি এক নামে কুরবানী করে গোশ্ত বণ্টন করে নেয়, তবে সে কুরবানী শুদ্ধ হবে। তবে স্মরণীয় যে, যারা শরীক হয়ে এ ধরনের কুরবানী দিবে তারা প্রত্যেকে চাইবে যে, নিজেদের নামে কুরবানী দিতে তখন অবশ্যই ফিতনা ও সমস্যার সৃষ্টি হবে। সেজন্য নাম দেয়ার ক্ষেত্রে আফযল ও উত্তম তরীক্বা হচ্ছে এই যে, যদি ছাগল কিংবা গরু এক নামে কুরবানী করা হয়, তাহলে তা মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নামে কুরবানী করে সকল শরীক সমানভাবে গোশ্ত বণ্টন করে নিবে। এতে যেমন তাদের কুরবানী নিশ্চিতরূপে মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুল ও মঞ্জুর হবে, সাথে সাথে তা তাদের জন্য ফযীলত, বারাকাত, ফুয়ুজাত, নিয়ামত, রহ্মত, মাগফিরাত, নাজাত সর্বোপরি মহান আল্লাহ্ পাক ও উনার রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের খাছ সন্তুষ্টি লাভ করার উসীলাও হবে। জানা আবশ্যক যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সকল উম্মতের তরফ থেকে কুরবানী করেছেন। সুতরাং উম্মতেরও দায়িত্ব ও কর্তব্য যে, সামর্থ্য থাকলে উনার পক্ষ হতে কুরবানী দেয়া। মূলত, এ ব্যাপারে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশবাণীও পাওয়া যায়।
যেমন- হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে খাছভাবে এ নির্দেশ দিয়ে যান যে, তিনি যেনো প্রতি বছর উনার নাম মুবারকে কুরবানী দেন। উল্লেখ্য, এ সকল শরীকী কুরবানীর ক্ষেত্রে যে সকল প্রাণীতে শুধু এক নামে কুরবানী করা যায়, তাতে অবশ্যই মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারকে কুরবানী দেয়া উচিত এবং তা উত্তম ও ফযীলতের কারণ বটে। কিন্তু যে সকল প্রাণীতে সাত নামে কুরবানী দেয়ার বিধান রয়েছে, তাতে প্রথমতঃ এক নাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারকে এবং বাকী ছয় নামের মধ্যে পর্যায়ক্রমে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম, হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম, হযরত হাজেরা আলাইহাস সালাম, হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম, হযরত উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম, হযরত আহলে বাইত আলাইহিমুস সালাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের নাম মুবারক থেকে ইচ্ছে মুতাবিক কুরবানী দিতে পারে। তাহলে এতে কোনো ফিতনা পয়দা হবে না। সাথে সাথে কুরবানীর দিন মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হচ্ছে- কুরবানী করা, তাও আদায় হলো। আর কুরবানীর বরকতময় গোশতও লাভ হলো। সাথে সাথে গুনাহর কাজ থেকেও বেঁচে গেলো।