সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ওয়াজিব। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সামর্থ্যবান মুসলমানগণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিভিন্ন পশু কোরবানি করে থাকেন।
এখন কোরবানি অর্থাৎ পশু জবাইয়ের মধ্যে নির্মমতা, নৃশংসতা ইত্যাদি ‘মানবাধিকার-বিরোধী’ কিছু বিষয় নাস্তিক, মুক্তমনা নামধারী ইসলামবিদ্বেষীগণ খুঁজে পান। এখানে মুসলমানদের প্রশ্নটা হচ্ছে: সারাবিশ্বে প্রতিদিন বিভিন্ন পশু জবাই হচ্ছে— জবাইয়ের পদ্ধতি খুঁজে দেখলে মুসলমানদের জবাইয়ের পদ্ধতির তুলনায় কয়েকগুণ বেশি কষ্টদায়ক পন্থায়ও জবাইয়ের রীতি বিশ্বের অনেক জায়গায়ই প্রচলিত আছে— এখন এই কথিত মুক্তমনা, মানবতাবাদীরা বিশ্বব্যাপী হররোজ গণহারে পশু জবাইয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেন না কেন? কেন তারা সারাবছর অঘোরে ঘুমিয়ে কেবল মুসলমানদের কোরবানি ঈদের সময়ই জেগে উঠেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর তাঁরা দিতে পারেন না বলে স্পষ্ট হয়ে যায়, মূলত পশু জবাইয়ের মধ্যে তাঁদের কোনো সমস্যা নয়, তাঁদের মূল সমস্যা ইসলামী শরীয়তে, ইসলাম ধর্মে।
কেউ যদি সত্যিকার-অর্থেই মানবতাবাদী হয়ে থাকেন তাহলে তার কোরবানি উপলক্ষে আনন্দিত হওয়া উচিত। কারণ, ইসলামী শরীয়ত কোরবানির জন্য নির্ধারিত পশুর সাথে কোরবানিদাতার আচরণে এমন বিধিমালা তৈরি করেছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল— মানবতাবাদিদের পক্ষে এমন কিছু ইসলাম ব্যতীত অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
১. কোরবানির জন্য নির্ধারিত পশুকে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে গণ্য করে ইসলাম। (কুরআন, ২২ : ৩৬) আর কোরআন বলে: আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান করা তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত। (২২ : ৩২) বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোরবানির জন্য নির্ধারিত পশুর সাথে ইসলাম উপযুক্ত ইতিবাচক আচরণের নির্দেশ দেয়; কষ্টদায়ক কোনো আচরণ ইসলাম একেবারেই সমর্থন করে না। (মুসলিম হয়ে কেউ যদি আল্লাহর নিদর্শনকে তথা কোরবানির পশুকে সম্মান না করে, উল্টো কষ্টদায়ক আচরণ করে তাহলে এর দায় ইসলাম কেন নিবে?)
২. হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক ব্যক্তির নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। ব্যক্তিটি তখন একটি বকরিকে কান ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। রাসূল বললেন: “তুমি তার (বকরির) কান ছেড়ে দাও, ঘাড় ধরো।” (ইবনে মাজা শরীফ, ৩১৭১) রাসূল কান ছেড়ে ঘাড় ধরতে বললেন কেন? কারণ, কান ধরে টানা-হেঁচড়ার ফলে বকরিটির বেশি কষ্ট হচ্ছিল, ঘাড় ধরে টানলে অতো কষ্ট হবে না। কোরবানির পশুর সাথে তো কোরবানিদাতার এর চেয়েও ভালো আচরণ করা উচিত, যেহেতু কোরবানির পশু কেবল পশু নয়, আল্লাহর নিদর্শন।
৩. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি ধারালো করে তা পশুর দৃষ্টির অগোচরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন: “তোমাদের কেউ জবাই করার সময় যেন দ্রুত জবাই করে।” (ইবনে মাজা শরীফ, ৩১৭২)
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বস্তুর প্রতি ইহসান (সহানুভূতি, দয়া) করা ফরজ করেছেন। … যখন কোনো জন্তু জবাই করবে তখন অতি উত্তম পন্থায় তাকে জবাই করবে এবং ছুরি ধার করে নেওয়া উচিত। জবাইকৃত পশুকে ঠাণ্ডা হতে দিবে।” (আবু দাউদ শরীফ, ২৮০৫)
উক্ত দু’টি হাদিস শরীফ থেকে চারটি বিষয় স্পষ্ট:
ক. পশু ধারালো ছুরি দেখলে পশুর জন্য তা কষ্টকর হবে। সেজন্য রাসূলের নির্দেশ, ধারালো ছুরি পশুর দৃষ্টির আড়ালে রাখা।
খ. যত সময় নিয়ে জবাই করবে, জবাইয়ে ছুরি যতক্ষণ চলমান থাকবে ততক্ষণ পশুর চূড়ান্ত পর্যায়ের কষ্ট হবে— এমন কষ্ট যেন পশুর কম হয় সেজন্য রাসূল তাড়াতাড়ি জবাইয়ের এবং ছুরি ধার করে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
গ. ‘উত্তম পন্থা’ বলতে বোঝানো হয়েছে, যেভাবে জবাই করতে সুবিধা হয়, যেভাবে জবাই তাড়াতাড়ি করা যায়, যেভাবে জবাই করলে পশুর কষ্ট তুলনামূলক কম হয়।
ঘ. একটি পশু জবাইয়ের পর অনেকক্ষণ রক্ত প্রবাহিত হয়, ততক্ষণ তার শরীর গরম থাকে— একটি পশুকে জবাইয়ের পরও তার কষ্টের কথা, তার শরীরের কথা ইসলাম চিন্তা করেছে। আর সেজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পশুকে ঠাণ্ডা হবার মতো সময় দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
কোরবানির জন্য যতগুলো পশু পৃথিবীব্যাপী নির্ধারিত হবে, প্রতিটি পশুকে ‘আল্লাহর নিদর্শন’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া— আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে যথাযথ ইতিবাচক আচরণের নির্দেশ দেওয়া— পশুর কষ্টের কথা চিন্তা করে ধারালো ছুরি পশুর দৃষ্টির আড়ালে রাখার নির্দেশ দেওয়া— পশুর চূড়ান্ত পর্যায়ের কষ্ট লাঘব করার জন্য ছুরি ধার করা এবং তাড়াতাড়ি জবাইয়ের নির্দেশ দেওয়া— পশুর কষ্ট লাঘবের জন্য উত্তম পদ্ধতিতে জবাইয়ের নির্দেশ দেওয়া এবং পশুকে জবাইয়ের সাথে সাথে তার চামড়া না কাটতে বলা অর্থাৎ পশুর ঠাণ্ডা হবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে কি একজন মানবতাবাদির আনন্দ নেই? এখানে কি ইসলামের নিকট একজন মানবতাবাদির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সূত্র নেই? এখানে কি একজন মানবতাবাদির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা নেই?
এভাবেই খুলে যায়, প্রকৃত ইসলামবিদ্বেষীদের মুক্তমনা বা মানবতাবাদি মুখোশ।
গরিব মানুষ তো সচরাচর গরুর গোশত খেতে পায় না— এমন লক্ষ পরিবার পাওয়া যাবে যারা বছরে কোরবানি ছাড়া একবারও গরুর গোশত খেতে পায় না, তারা বছরে একবার কোরবানির উসিলায় গরুর গোশত খেতে পারে। এটা চিন্তা করেও কি একজন মানবতাবাদী কোরবানিকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করতে পারেন না? কেন পারেন না? সমস্যাটা কোথায়? বিশ্বাসে।
তাদের সমস্যা পশুতে নয়, ইসলামে; মানবতাবাদ তাদের মুখোশ কেবল, প্রকৃতিতে ইসলামবিদ্বেষ।
©️ আবু সাঈদ নয়ন