কুরবানির হুকুম ও কুরবানির নেসাব।

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

কুরবানির হুকুম ও কুরবানির নেসাব।
সংকলকঃ Mahmud Hasan

হানাফী মাযহাবের মত অনুযায়ী মুকীম, বালেগ, সুস্থ মস্তিস্কের মুসলমানের জন্যে যদি তার কাছে কুরবানির দিন সমূহে নেসাব পরিমান সম্পত্তি  থাকে তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
[সূরা কাওছার আয়াত ২, ইবনে মাযাঃ ২/১০৪৪ মাজমাউল আনহুরঃ ৪/১৬৭]।

কুরবানির নেসাব
____________
শুধু স্বর্ণ হলে সাড়ে সাত ভরি আর শুধু রুপা হলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি অথবা তার সমপরিমান হাজতে আসলিয়া তথা প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ থাকা।
[সূত্রঃ ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ৫/৩৯৩ বাদায়েউস সানায়েঃ ৬/২৭০ শামীঃ ৬/৩১২]।

হাজতে আছলিয়া বলতে বুঝায়, মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান পেশায় ব্যবহারিত সম্পদ, দ্বীনি শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিতাবসমূহ এবং যে সকল বস্তু মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে প্রয়োজন হয়। আর যে সকল জিনিস মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে প্রয়োজন হয় না তা হাজতে আছলিয়ার অন্তর্ভ্ক্তু নয়। যেমন, টিভি, রেডিও, প্রয়োজোন অতিরিক্ত একাধিক মোবাইল, তিন সেটের অতিরিক্ত কাপড় (ফাতওয়ায়ে শামী), প্রয়োজন অতিরিক্ত ঘর বা প্লট, বড় বড় ডেগ যা সব সময় কোন প্রয়োজনে আসে না এবং ঘরের ঐ সমস্ত জিনিস যা ঘরের সুন্দর্যের জন্য রাখা হয়েছে। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
[সূত্রঃ আল মাওসূয়াতুল ফেকহিয়্যাহঃ ৬/৩৫ কাওয়াইদুল ফিকহিয়্যাঃ ২৫৭ ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৬/৩১২ ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ৫/৩২৬]।

কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।
[সূত্রঃ বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২]।

নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে।
[সূত্রঃ বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬]।

নাবালেগের পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া অভিভাবকের উপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব।
[সূত্রঃ রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৫; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫]।

মুসাফেরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
[সূত্রঃ হেদায়াঃ ৪/৪৪৩; মাবসূতে সারাখসীঃ ৮/১২]।

রাতে কুরবানী করা-
১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতেও কুরবানী করা জায়েয। তবে দিনে কুরবানী করাই ভালো।
[সূত্রঃ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৪৯২৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, কাযীখান ৩/৩৪৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩]।

কুরবানীর উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু সময়ের পর যবাই করলে-
কুরবানীর দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে।
[সূত্রঃ বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১]।

কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে-
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়।
[সূত্রঃ কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫]।

নর ও মাদা পশুর কুরবানী-
যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়।
[সূত্রঃ কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫]।

কুরবানীর পশু বাচ্চা দিলে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেওয়া উত্তম। যদি সদকা না করে তবে কুরবানীর পশুর সাথে বাচ্চাকেও জবাই করবে এবং গোশত সদকা করে দিবে।
[সূত্রঃ কাযীখান ৩/৩৪৯, আলমগীরী ৫/৩০১, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩]।

কুরবানীর পশুর বয়সসীমা-
উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।
উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না।
[সূত্রঃ কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬]।

ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির যদি তার সম্পদের তুলনায় ঋণ বেশী হয় বা সমান হয়, অথবা ঋণ আদায় করার পর তার কাছে নেসাব পরিমান সম্পদ বাকি না থাকে তাহলে এমন ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
[সূত্রঃ ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ৫/৩৯২]।

যদি কোন মহিলার কাছে কিছু স্বর্ণ এবং অল্প কিছু টাকা থাকে আর উভয়টা মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমান টাকা হয় তাহলে সে মহিলার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। তার স্বামীর কুরবানী দ্বারা তার পক্ষ থেকে ওয়াজিব কুরবানী আদায় হবে না।
[সূত্রঃ ফাতওয়ায়ে শামীঃ ২/২৯৮]।

স্বামী আর স্ত্রীর কাছে যদি আলাদা আলাদাভাবে নেসাব পরিমান সম্পদ থাকে তাহলে তাদের উভয় জনকে স্বতন্ত্র কুরবানী করতে হবে।
[সূত্রঃ বুখারীঃ ৭/৯৯ তাতারখানিয়াঃ ১৭/৪০৫; মুলতাকাতুল আবহুরঃ ৪/১৬৬]।

এমন ব্যক্তি যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় সে যদি কুরবানির দিনগুলোতে কুরবানির নিয়তে কোন পশু ক্রয় করে তাহলে তার উপর সেটি কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
[সূত্রঃ ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়াঃ ৫/৩৯১ বাদায়েউস সানায়েঃ ৬/২৬৪]।

যৌথ পরিবারের সবাই যদি আলাদা আলাদা ভাবে নিসাব পরিমান সম্পত্তির মালিক হয় তাহলে সকলের পক্ষ থেকে একটা কুরবানী করলে কিংবা এই বছর এক জনের নামে আরেক বছর আরেক জনের নামে আরেক বছর আরেক জনের নামে কুরবানী করলে কুরবানী আদায় হবে না। বরং সবাইকে স্বতন্ত্র কুরবানী করতে হবে।
[সূত্রঃ আদ দুররুল মুখতার মায়া শামীঃ ২/২৩১ মাজমাউল আনহুরঃ ৪/১৬৬]।

জিবিকা নির্বাহের জন্য যতটুকু ফসলের জমির প্রয়োজন শুধুমাত্র ততটুকু জমি ও তার ফসল হাজতে আছলিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এর অতিরিক্ত জমি ও তার ফসলের মূল্য হিসাব করে নেসাব পরিমান সম্পদের মালিক হলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব।
[সূত্রঃ ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৬/৩১২]।

যদি কোন ব্যক্তির কাছে প্রয়োজন অতিরিক্ত জমি থাকে, কিন্তু তার কাছে কুরবানী করার মত নগদ টাকা না থাকে তাহলে তার উপর ঋণ করে হলেও কুরবানী করা ওয়াজিব।
[সূত্রঃ ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৬/৩১২]।

এমন ব্যক্তি যার উপর কুরবানী ওয়াজিব তার শশুর বাড়ি থেকে কিংবা অন্য কোন জায়গা থেকে কোন পশু হাদিয়া আসে তাহলে সে যদি অন্য পশু ক্রয় না করে সে পশু দ্বারা কুরবানী করে তাহলে তার ওয়াজিব কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। কেননা, তাকে হাদীয়া দেয়ার মাধ্যমে সে পশুটার মালিক হয়ে যায় বিধা সে যে কোন কাজে সেটা ব্যবহার করতে পারবে।
[সূত্রঃ বাদায়েউস সানায়েঃ ৫/৭৭]।

যদি কোন ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব কুরবানী করে আর এতে করে কোন মৃত ব্যক্তির জন্য শুধুমাত্র সাওয়াব পৌঁছানোর নিয়ত করে তাহলে তা জায়েয হবে। তার কুরবানী আদায় হবে। আর যদি সে ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে না করে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নফল কুরবানী করে তাহলে তার ওয়াজিব কুরবানী আদায় হবে না।
[সূত্রঃ ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৬/৩৫]।

যদি কোন ব্যক্তির সকল টাকা হারাম পন্থায় উপার্জিত হয় এবং তার আর কোন হালাল উপার্জন না থাকে তাহলে এমন ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব না। তার সাথে কেউ যদি কুরবানীতে শরীক হয় তাহলে শরীকদারের কুরবানীও আদায় হবে না।
[সূত্রঃ বজলুল মজহুদঃ ১/৩৮]।

কোনো অংশীদারের গলদ নিয়ত হলে-
যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে।
[সূত্রঃ বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯]।

কয়েকজন মিলে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার
স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে।
[সূত্রঃ বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫১]।

কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।
[সূত্রঃ তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২]।

কুরবানীর পশু হারিয়ে যাওয়ার পরে যদি আরেকটি কেনা হয় এবং পরে হারানোটিও পাওয়া যায় তাহলে কুরবানীদাতা গরীব হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) দুটি পশুই কুরবানী করা ওয়াজিব। আর ধনী হলে কোনো একটি কুরবানী করলেই হবে। তবে দুটি কুরবানী করাই উত্তম।
[সূত্রঃ সুনানে বায়হাকী ৫/২৪৪, ইলাউস সুনান ১৭/২৮০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৯, কাযীখান ৩/৩৪৭]।

কুরবানির পশু ক্রয় করার পর যদি তা হারিয়ে যায় কিংবা চুরি হয়ে যায় তাহলে ক্রেতা যদি এমন ব্যক্তি হয় যার উপর কুরবানী ওয়াজিব ছিলো তাহলে তাকে আরেকটা পশু ক্রয় করে কুরবানী করতে হবে। আর যদি ক্রেতা এমন ব্যক্তি যার উপর কুরবানী ওয়াজিব ছিলো না তাহলে তার জন্য আরেকটা ক্রয় করে কুরবানী করা জরুরী নয়।
[সূত্রঃ বাদায়েউস সানায়েঃ ৫/৬৬]।

কুরবানীর পশু বাচ্চা দিলে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেওয়া উত্তম। যদি সদকা না করে তবে কুরবানীর পশুর সাথে বাচ্চাকেও জবাই করবে এবং গোশত সদকা করে দিবে।
[সূত্রঃ কাযীখান ৩/৩৪৯, আলমগীরী ৫/৩০১, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩]।

যদি কোন ধনী ব্যক্তি মান্নত করে, আমার যদি অমুক কাজটা হয় তাহলে আমি আল্লাহর ওয়াস্তে একটা পশু কুরবানী দেবো। তাহলে তার উপর দুইটা কুরবানী ওয়াজিব হবে। একটা মান্নত কারণে আরেকটা ধনী হওয়ার কারণে।
[সূত্রঃ আদ দুররুল মুখতার মায়া শামীঃ ৬/৩৩২ কেফায়াতুল মুফতীঃ ৮/১৯৭]।

যদি কোন ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তার হুকুম হলো, যদি মৃত ব্যক্তি ওসীয়ত করে যায় এবং তার রেখে যাওয়া সম্পদের একতৃতীয়াংশ থেকে তা আদায় করা সম্ভব হয় তাহলে মৃতের পক্ষ থেকে ওয়ারিসদের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। তখন সমস্ত গোশ্ত সদকা করে দিতে হবে। আর যদি ওসীয়ত না করে যায় অথবা করেছে কিন্তু তার রেখে যাওয়া সম্পদের একতৃতীয়াংশ থেকে কুরবানী করা সম্ভব না। তাহলে এমতাবস্থায় মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। তখন সে কুরবানির গোশ্তগুলো অন্য কুরবানির মত ধনী গরীব এবং কুরবানী দাতা সহ সবাই খেতে পারবে।
[সূত্রঃ খানিয়া মায়া হিন্দিয়াঃ ৩/৩৫২ ফাতওয়ায়ে শামীঃ ৬/৩৩৫]।
______________

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment