নিশ্চয় প্রত্যেক জ্ঞানী এবং সত্যিকার নবী প্রেমিকের একান্ত কর্তব্য যে, মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষ্যে মুসলমানদের জামাতের ব্যবস্থা করা এবং হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমনকে সামনে রেখে আনন্দ ও সম্মান প্রদর্শন করা। যা শরীয়তের অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা সাব্যস্ত। এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ পোষণ করার মোটেও সুযোগ নেই। কেননা এটাই প্রধান স্তম্ভ ও মূল ভিত্তি। মহান আল্লাহ পাক স্বীয় নবীর সম্মান জগতবাসীকে স্বয়ং শিক্ষা দিয়েছেন। সাথে সাথে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সৃষ্টির রহস্য, পবিত্র নাম, পৃথিবীতে প্রেরণ, অবস্থান এবং পদমর্যাদার ব্যাপারে খুবই চমৎকারভাবে জ্ঞাত করেছেন। তাঁর শুভাগমনে সমস্ত সৃষ্টি জগত আনন্দিত ও খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সৃষ্টিকুলের জন্য আল্লাহর জ্যোতি, ভালবাসার আধার, পূর্ণাঙ্গ নেয়ামত, সৌভাগ্যের পরশ এবং দলীল স্বরূপ শুভাগমন করে জগতকে ধন্য করেছেন। পবিত্র মহাগ্রন্থ কোরআনুল করীমে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসিত গুণাবলীর বর্ণনা অনেক স্থানে বিদ্যমান তবে কোথাও সংক্ষিপ্ত আর কোথাও বিস্তারিত। যেমন- ইমাম আবু ছাঈদ আল্ খারকুশী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) নবীজীর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন-
◆ অন্তরের প্রশংসাঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র অন্তর সম্পর্কে পবিত্র কোরআন মজীদে রয়েছে-
“আল্লাহ তায়ালা এই কোরআন আপনার অন্তঃকরণে অবতীর্ণ করে থাকেন।” -(সূরা বাক্বারা, ৯৭)
অন্য স্থানে রয়েছে-
“তা দ্বারা আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় করব”-(সূরা নজম, ৩২)
আরেক স্থানে রয়েছে-
“অন্তর মিথ্যা বলেনি যা দেখেছে”-(সূরা নজম, ১১)
◆ চরিত্রের প্রশংসাঃ চরিত্রের প্রশংসায় এরশাদ হয়েছে-
“নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত”-(সূরা ক্বলম, ৪)
◆ পবিত্র চেহারা মোবারকের প্রশংসাঃ
চেহারা পাকের বর্ণনায় রয়েছে- “(হে হাবীব!) আপনার বারবার আসমানের দিকে তাকানো আমি লক্ষ্য করছি।” -(সূরা বাক্বারা , ১৪৪)
◆ চোখ মোবারকের প্রশংসায় কালামুল্লাহ্ শরীফে রয়েছে-
“চক্ষু না কোনদিকে ফিরেছে না সীমাতিক্রম করেছে।” -(সূরা নজম, ১৭)
◆ বক্ষ মোবারকের প্রশংসাঃ বক্ষ মোবারকের প্রশংসায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান-
“যেন আপনার মনে এটা সম্পর্কে কোন সঙ্কোচ না থাকে।” -(সূরা আ’রাফা, ২)
◆ পবিত্র জীবনের প্রশংসাঃ কালামে পাকে নবীজীর পবিত্র জীবনের প্রশংসায় বর্ণিত হয়েছে-
“(হে মাহবুব) আপনার প্রাণের শপথ নিশ্চয় তারা আপন নেশায় উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করছে।” -(সূরা হাজর, ৭২)
◆ পবিত্র চক্ষুদ্বয়ের প্রশংসাঃ অন্যত্র চক্ষুদ্বয়ের প্রশংসায় এরশাদ হয়েছে-
“এবং হে শ্রোতা, তোমার চক্ষুদ্বয় কখনো প্রসারিত করোনা সেটার দিকে, যা আমি কাফিরদের জোড়াগুলোকে ভোগ করার জন্য দিয়েছি পার্থিব জীবনের সজীবতা স্বরূপ।” -(সূরা ত্ব-হা , ১৩১)
◆ পবিত্র নাম মোবারকের মাহাত্মঃ এ সম্পর্কে কালামে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
“এবং যেসব লোক ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং সেটার প্রতি ঈমান এনেছে যা মুহাম্মদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে আর সেটাই তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সত্য।” -(সূরা মুহাম্মদ , ২)
অন্য আয়াতে রয়েছে-
“এবং মুহাম্মদতো একজন রাসূল, তাঁর পূর্বে আরো রাসূল গত হয়েছেন।” -(সূরা আল্ ইমরান , ১৪৪)
অন্যত্র তাঁর নাম মোবারকের বর্ণনা রয়েছে এভাবে-
“মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; এবং তাঁর সঙ্গে যারা আছে কাফিরদের উপর কঠোর এবং পরস্পরের মধ্যে দয়াশীল।” -(সূরা ফাত্হ , ২৯)
◆ পবিত্র জন্মস্থানের বর্ণনাঃ মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র স্থানের মর্যাদা জ্ঞাপনার্থে আয়াত অবতীর্ণ করেন-
“এ শহরের শপথ, যেহেতু (মাহবুব!) আপনি এ শহরে তাশরীফ রেখেছেন।” -(সূরা বালাদ, ২)
◆ পুতঃ পবিত্র স্ত্রীগণের বর্ণনাঃ আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর প্রিয় রাসূলের পুতঃ পবিত্র স্ত্রীগণের বিশেষত، বর্ণনা করে আয়াত অবতীর্ণ করেন-
“হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্যান্য নারীদের মত নও।” -(সূরা আহযাব , ৩২)
◆ কথোপকথনের গুরত্বঃ আল্লাহ্ পাক তাঁর প্রিয় হাবীবের কথোপকথনের ব্যাপারে কালামে পাকে বর্ণনা করেন-
“এবং তিনি কোন কোন কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেন না। তাতো নয়, কিন্তু‘ অহীই, যা তাঁর প্রতি (নাযিল) করা হয়।”-(সূরা নজম , ৩)
◆ ধবনি প্রতিধবনির বিধানঃ হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মুখে কিভাবে শব্দ করতে হবে তার বিধান কোরআনুল করীমে পাওয়া যায়-
“নিজেদের কন্ঠস্বরকে উঁচু করোনা ঐ অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)’র কন্ঠস্বরের উপর এবং তাঁর সামনে চিৎকার করে কথা বলোনা।”-(সূরা হুজরাত , ২)
◆ নিস্পাপ প্রসঙ্গেঃ আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিস্পাপের নিশ্চয়তা প্রদান করে কালামে পাকে এরশাদ ফরমান-
“আর আল্লাহ্ আপনাকে রক্ষা করবেন মানুষ থেকে।” -(সূরা মায়েদা , ৬৭)
◆ অনুসরণ প্রসঙ্গেঃ আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণের গুরত্ব، সম্পর্কে কালামে মজীদে বর্ণিত হয়েছে-
“যে ব্যক্তি রাসূলের নির্দেশ মান্য করেছে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর নির্দেশ মান্য করেছে।” -(সূরা নিসা , ৮০)
মহান দয়ালু খোদা তাঁর প্রিয় বস্তুর মান-সম্মান ও মর্যাদা বিশ্ববাসীকে উপলব্ধি করানোর লক্ষ্যে এরশাদ ফরমান-
“আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।” -(সূরা ইনশারাহ্ , ৪)
বিশ্ব বিখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর রচিত “তাফসীরে কবীর” নামক গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে বলেন- “উক্ত আয়াতে এতই ব্যাপকতা রয়েছে যে, নবুওয়তের যতই মর্যাদা থাকতে পারে সবগুলোই এতে অন্তর্ভূক্ত, ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলে তাঁর শান-মান বি¯স্তৃতি রয়েছে। আরশ্ আজীমে তাঁর নামে পাক লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ ছাড়াও কলেমা-এ-শাহাদাত এবং তাশাহুদে তাঁর পবিত্র নামের উচ্চারণ স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালার নামের সাথেই বিদ্যমান, শুধু তাই নয়, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহসহ সমগ্র জগতে তাঁর যিকির সর্বদা চলছে এবং তাঁর নবুওয়াতের মাধ্যমেই নবুওয়তের সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি এমন মর্যাদার অধিকারী যিনি খোৎবায়, আযানে, কিতাবের প্রারম্ভে ও সমাপ্তিতে বিরাজমান। এমনকি আল্লাহ্ তায়ালা কালামে তাঁর নামে পাকের সাথে সাথে তাঁর প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর নামও উল্লেখ করেছেন। যেমন, এরশাদ হয়েছে-
“আল্লাহ ও রাসূলের এ হক্ব، অধিক ছিল যে, তাঁকে সস্তুষ্ট করবে।” -(সূরা তাওবা , ৬২)
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
“আর যে নির্দেশ মান্য করে আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের।” -(সূরা নিসা , ১৩)
একই সূরার অন্য আয়াতে হয়েছে।-
“আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর এবং রাসূলের নির্দেশ মান্য কর।” -(সূরা নিসা , ৫৯)
এটাই লক্ষ্যনীয় ব্যাপার যে, যখনই তিনি তাঁর অন্যান্য নবী-রাসূলের সম্বোধন করতেন তাঁদের নাম সহকারে সম্বোধন করতেন। যেমন- “ইয়া ঈসা” , “ইয়া মূসা” বলেই সম্বোধন করতেন। অপরদিকে তাঁর পরম বস্তুকে সম্বোধন করার ভিন্ন পন্থা পরিলক্ষিত হয় “আন্নাবী” “আর্ রাসূল” ইত্যাদি গুণবাচক নাম সহকারে। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর প্রেমপ্রীতি ও ভালবাসা মানুষের অন্তরে এমন সুগভীরভাবে প্রদান করেছেন, যার ফলশ্রুতিতে তাঁরা সর্বদা তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্মরণ করে থাকেন। এর প্রমাণ-
“পরম দয়াময় (পরস্পরের মধ্যে) ভালবাসা সৃষ্টি করে দেবেন।” -(সূরা মারয়াম , ৯৬)
এতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ পাক (তাঁর প্রিয়নবীর প্রতি এমন সন্তুষ্ট) এক পর্যায়ে ঘোষণা দেন- আমি সমগ্র জগত আপনার অনুসারীতে পরিপূর্ণ করব, যারা সর্বদা আপনার প্রশংসায় লিপ্ত থাকে, আপনার উপর সদা দরূদ পাঠ করে এবং আপনার রেখে যাওয়া সুন্নাতের সংরক্ষণ করে; শুধু তাই নয়, এমন কোন ফরজ নামায নেই যার সাথে সুন্নাতের সম্পৃক্ততা নেই। যাতে করে তারা ফরজের মাধ্যমে আমার হুকুম মান্য করে এবং সুন্নাতের মাধ্যমে আপনার আদেশ মান্য করে। আপনার আনুগত্য মানেই আমার আনুগত্য আর আপনার বশ্যতা স্বীকার করা আমার বশ্যতা স্বীকারেরই নামান্তর। যেমন- কালামে পাকে রয়েছেঃ
“যে রাসুলের নির্দেশ মান্য করেছে নিঃসন্দেহে সে আল্লাহর নির্দেশ মান্য করেছে।” -(সূরা নিসা , ৮০)
অন্যস্থানে রয়েছে-
“ঐসব লোক যারা আপনার নিকট বায়আত গ্রহণ করে তারাতো আল্লাহরই নিকট বায়আত গ্রহণ করেছে।” (সূরা ফাত্হ ঃ ১০)
হে হাবীব! আপনার আনুগত্য ব্যতিরেকে কোন ক্ষমতাধর রাজা-বাদশাহ্ও বাঁচার উপায় নেই, বরং এমন কোন মূর্খ বাদশাহ্ ও সাহসিক উদ্যমী হবেনা যে, আপনার গোত্র ব্যতিরেকে অন্য কাউকে খলীফা নির্বাচিত করবে। এমনকি সমস্ত পাঠক আপনার বিস্তৃত বাণীর সংরক্ষণ করে থাকেন, তাফসীর কারকগণ আপনার উপর নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ কোরআনুল করীমের ব্যাখ্যা করে থাকেন আর সুবক্তাবৃন্দ আপনার অমূল্য স্বর্ণাক্ষরের বাণী সকলের কাছে পৌঁছে দেন। এমনকি জগত বিখ্যাত জ্ঞানী-গুণী, মহামনীষী ও রাজা-বাদশাহ্গণ আপনার খেদমতে দরূদ-সালাম পাঠ করে থাকেন। শুধু তাই নয়, আপনার দ্বারস্থ হয়ে বিনয়ের সাথে আপনার উদ্দেশ্যে সালাম পেশ করেন। আর ভক্তি সহকারে আপনার রওজায়ে পাকের ধুলো-মাটি তাদের চেহারায় মালিশ করতে থাকেন সাথে সাথে আপনার সুপারিশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে থাকেন। উল্লেখ্য যে, এই মর্যাদা ক্ষণিকের জন্য নয়, এটা মহা প্রলয়ের দিন পর্যন্ত স্থায়ী।
মুফাচ্ছির জগতের অন্যতম নক্ষত্র আল্লামা খাযেন (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে’র ৪র্থ খন্ডের ৪১৭পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
“হুজুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর শান মর্যাদা এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়, পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলাইহিমুস্ সালাম) থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নেয়া হয়; যেন- সকলেই তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করেন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকারোক্তি ব্যক্ত করেন।”
এভাবে ইবনুল জওযী হাম্বলী (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর রচিত ‘যাদুল মাছীর’ নামক গ্রন্থের ৯ম খন্ড ১৬৪পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন-
“হে হাবীব! আপনার যিকির তথা শেষ্ঠত্ব, আমি উর্দ্ধ জগতে ফেরেশতাদের মাঝেও সমুন্নত রেখেছি।”
তেমনিভাবে ইমাম শওকানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত “তাফসীরে ফাত্হুল ক্বদীর” নামক গ্রন্থের ৫ম খন্ড ৪৬২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন-
“মোট কথা হলো মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা আপন হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর মাহাত্ম আসমান-যমীন পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন, এছাড়াও তাঁকে সত্যবাদিতা, সৌন্দর্য আচরণ ও উত্তম প্রশংসা দ্বারা ভূষিত করেছেন, যা তাঁর অন্য কোন বান্দাহ্কে প্রদান করেন নি। এর ইঙ্গিত কালামে পাকে এভাবেই রয়েছে- “এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে চান দান করেন এবং আল্লাহ্ মহা অনুগ্রহশীল।” -(সূরা হাদীদ , ২১)
হযরত হা’ছান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কতই চমৎকার প্রশংসা করেছেন-
“আল্লাহ্ পাক খতমে নুবুওয়তের তাজ দ্বারা আপনাকে ভূষিত করেছেন, যা উজ্জ্বলতা সহকারে শোভা পায় এবং স্বাক্ষ্য সহকারে অম্লান থাকবে।
মহান দয়ালু আল্লাহ্ পাক আপন নামের সাথে প্রিয় মাহবুবের নামও সংযুক্ত করেছেন, যখন মুয়াজ্জিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযানে “আশহাদু” বলে প্রতিধ্বনি তোলেন তখনই তা শোভা পায়।
তিনি স্বীয় নামের সাথে তাঁর প্রিয় হাবীবের নাম এমনভাবে মিশ্রণ করেছেন যার সম্পর্ক খুবই নিগূঢ়, এর প্রমাণ মিলে এভাবে যে, আরশে যিনি রয়েছেন তিনি “মাহমুদ” আর ইনি হচ্ছেন “মুহাম্মদ”(অর্থাৎ যার মূল অক্ষরে খুবই সাদৃশ্য রয়েছে)।”
বলা বাহুল্য যে, নবীয়ে দো’জাহাঁ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর সৌভাগ্য পূর্ণ মীলাদ উপলক্ষে খুশী ও আনন্দ প্রকাশ করার মত উত্তম আমল তাঁর প্রতি ভালবাসা বহিঃ প্রকাশের উল্লেখযোগ্য পন্থা, যা শরীয়তের দৃষ্টিকোণে উত্তম বা মুস্তাহাব বলে পরিগণিত। একে অপছন্দনীয় বা অবৈধ বলার ক্ষমতা কারো নেই। বরং এটা শরীয়তের মূল বিধানের দৃষ্টিকোণে একটি মঙ্গলজনক আমল। কেননা বিজ্ঞ আলেমগণ মীলাদ শরীফ উদ্যাপনের ক্ষেত্রে শর্তারোপ করেছেন। যেন, এই ধরণের বরকতময় মাহফিলে পারদর্শী আলেম অথবা যোগ্য ছাত্র দ্বারা পরিচালিত হয়, যাতে করে আত্মতৃপ্তি ও প্রশান্তি অর্জিত হয়। এর প্রতিও দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন মাহফিলে যেন নারী পুরুষ একত্রিততভাবে জমায়েত না হয়।
সুতরাং উল্লিখিত শর্তাবলী সহকারে মানবতার মুক্তির দিশারী হুজুরে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর মীলাদ পালন করা শরীয়ত সম্মত। সুপ্রসিদ্ধ মূলনীতি “সাদ্দুয্ যারা-এ” নাম সুপ্রসিদ্ধ কায়েদার ভিত্তিতেও উক্ত মাহফিলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যায় না। কেননা “সাদ্দুয্ যারা-এ” র উপর ততক্ষণ আমল করা যাবে যতক্ষণ এতে কোন ধরণের ত্রুটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত না হয়। এর উপর সকলেই একমত পোষণ করে থাকেন, মুসলমানদের বিশুদ্ধতা রক্ষায় এটা প্রয়োজন। যেন এটা তাদের কাছ থেকে বিলীন হয়ে না যায়,কিন্তু অশালীন ও ধর্মীয় বিরোধী কার্যক্রমে বাধা প্রদানের দ্বারা সর্বদা উম্মুক্ত থাকবে।
এর উদাহরণ এভাবে দেয়া যায়। খেজুর ও গমের উৎপাদন করা, যা থেকে মদ্য বা নেশা জাতীয় উত্তেজক পানীয় তৈরী করা হয়। শুধুমাত্র একদিকে দৃষ্টি রেখে ঐ সমস্ত (হালাল)বস্তুর উৎপাদন নিষিদ্ধ করা যায় না। কোন জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি এ ধরণের (অযৌক্তিক) মন্তব্য করতে পারেনা।
এই কারণেই আমরা উক্ত বরকতময় মাহফিলে বাধাসৃষ্টি করতে পারিনা যাতে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর প্রিয় হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর স্মরণ হয় এবং তাঁর নেক বান্দাহ্গণের জীবন চরিত আলোচনা হয়, শুধু তাই নয়, এ ধরণের মাহফিল উদ্যাপনের মাধ্যমে আত্মার উন্নতি সাধিত হয়, মানবতার মুক্তি কান্ডারী সৃষ্টিকুলের রহমত সাইয়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্পর্ক স্থাপনেও এর গুরুত্ব، অপরিসীম। এটা এমন এক সম্পর্ক যা দ্বারা ঈমান সুদৃঢ় হয়, অনুগ্রহের উচ্চশিখরে পৌঁছার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয় এটা পূণ্য অর্জনের এমন একটি উত্তম পন্থা ও শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, যে ব্যাপারে মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অমরবাণী প্রণিধান যোগ্য। তিনি এরশাদ ফরমান-
“নিশ্চয় সত্যবাদীতা পূণ্যের দিকে পথ প্রদর্শন করে, আর পূণ্যবান ব্যক্তি বেহেশ্তে প্রবেশকরার যোগ্যতা অর্জন করেন। পক্ষান্তরে সারওয়ারে কায়েনাত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকল পূণ্য ও মঙ্গলের মূল তথা উৎপত্তি স্থল, যা ঈমানদার ব্যক্তিকে ঈমানের উচ্চাসনে আসীন করতে সাহায্য করে। তাই নির্দিষ্ট কতেকস্থানের শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপকে পূঁজি করে এই ধরণের পূণ্যময় মাহফিলে বাঁধা সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো নেই। বরং বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী সমস্ত কার্যক্রম কঠোরহস্তে দমন করতঃ এই ধরণের ধোঁকাবাজী থেকে সমাজকে মুক্ত রাখতে হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই পূর্ণ নিরাপত্তা ও দীপ্তি অর্জনের মাধ্যমে শান্তিতে জীবন যাপন করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বস্তুতঃ অনেকেই আমাকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর কলম ধরার অনুরোধ করেছেন। তাই আমি এই কিতাব রচনা করতে মনোনিবেশ করলাম এবং এর নাম করণ করলাম “বুলুগুল মামূল ফিল ইহতিফা ওয়াল ইহতিফাল বি মাওলিদির রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম”
আমার পূর্বেও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভরযোগ্য জ্ঞানতাপসগণ গ্রন্থ রচনা করে নিজকে ধন্য করেছেন। তম্মধ্যে আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষাগুর ডঃ আল্লামা মুহাম্মদ বিন আলভী আল্ মালিকী আল্ হাসানী অন্যতম। তিনি এই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে খুবই চমৎকার লিখেছেন। উল্লেখ্য যে, মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর বিষয়বস্তুর উপর তিনি “হাওলাল ইহতিফাল বিল মাওলিদিন নাবওয়ী শরীফ” নামে এমন গুরুত্ব،পূর্ণ কিতাব রচনা করেছেন, যা সর্ব প্রকারের মতানৈক্য ও সন্দেহ দূরীভূত করণের মাধ্যমে অকাট্যভাবে সাব্যস্থ করতে সক্ষম। এই বিষয়ের উপর তিনি যেহেতু কলম ধরেছেন, এর চেয়ে আরো লিখা আমি প্রয়োজন মনে করছিনা। এতদসত্তেও অনেক চিন্তাভাবনার পর তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে এ ব্যাপারে সাহসী ও উদ্যমী হই। অবশেষে সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা লাভের আকাঙ্খা পোষণ করে পূর্ববর্তী হযরাতে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই মহৎকাজে অগ্রসর হওয়ার মনোনিবেশ করলাম।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করার সমর্থনে কোরআনে পাকে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তবে কোথাও সরাসরি আর কোথাও ইঙ্গিত দ্বারা সাব্যস্থ রয়েছে। নিম্নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আয়াতে পাকের ব্যাখ্যা সহকারে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব।
১ম দলীল
মহান দয়ালু খোদা তাঁর কালামে পাকে এরশাদ ফরমান-
ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থাৎ – “আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত।” (সূরা ইউনুসঃ ৫৮) তাই স্পষ্ট হয়ে গেল আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের উপর যে বিশেষ করুণা করেছেন তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে খুশী ও আনন্দিত হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর ঐ রহমত বা করুণাই হচ্ছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যেমনিভাবে তিনি কালামে পাকে এরশাদ করেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
“এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের রহমত ব্যতীত।” (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭) আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত “আদ্ দূররুল মনছুর” নামক বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডে ৩৬৭পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-
– আরবী ইবারত –
“ফাদ্বলুল্লাহ” দ্বারা জ্ঞান এবং “রহমত” দ্বারা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ কে বুঝানো হয়েছে। যেমনিভাবে অন্য আয়াতে পাকেও তাঁকে রাহ্মাতুল্লিল আলামীন দ্বারা ভূষিত করেছেন। উপরোল্লিখিত আয়াতে পাকে “রহমত” শব্দটি “ফাদ্বল” শব্দের পরে উল্লেখ রয়েছে। যা ব্যাপকতার পর নির্দিষ্ট করণের হেকমত পূর্ণ পন্থার আওতায় পড়েছে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য গুরত্ব، সঠিকভাবে অনুধাবন করা। এ ছাড়াও আয়াতে পাকে ইঙ্গিত সূচক শব্দটি খুশী ও আনন্দ প্রকাশে উৎসাহিত করার প্রতি ইঙ্গিত বহনের খুবই দৃঢ় দলীল। কেননা, উক্ত স্থানে সর্বনামের স্থলে প্রকাশ্য ইঙ্গিতসূচক বাক্য ব্যবহার দ্বারা রহমত বা করুণার প্রতি গুরুত্বশীল হবার কথা বুঝানো হয়েছে। তাই আল্লামা মাহমুদ আলছী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “রূহুল মায়ানী” নামক নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থের ১ম খন্ড ১৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
– আরবী ইবারত –
অর্থাৎ,আয়াতে পাক দ্বারা এরই দৃঢ়তা বুঝানো হয়েছে যে, “রহমত”নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে “রাহমাতুল্লিল আলামীন” তাঁর গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি গুণ। পবিত্র কোরআনে পাকে এর স্বাক্ষ্যস্বরূপ বর্ণিত হয়েছে-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
আরো বিস্তারিত জানার জন্য “তাফসীরে আবিস সা’উদ” নামক গ্রন্থে’র ৪র্থ খন্ডে ১৫৬পৃষ্ঠা দেখে নেয়ার পরামর্শ রইল। আল্লামা ইমাম রাযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রচিত “তাফসীরে কবীর” নামক বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থের সপ্তদশ খন্ডের ১২৩পৃষ্ঠায় আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন এটা আরবী ব্যাকরণের একটি পরিভাষা এর উপকারিতা প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ জগৎবাসী শুধুমাত্র একে কেন্দ্র করে আনন্দিত হওয়া বাঞ্চনীয়।
২য় দলীল
মহান আল্লাহ্ কোরআন মজীদে এরশাদ ফরমান-
وَكُلًّا نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ الرُّسُلِ مَا نُثَبِّتُ بِهِ فُؤَادَكَ وَجَاءَكَ فِي هَذِهِ الْحَقُّ وَمَوْعِظَةٌ وَذِكْرَى لِلْمُؤْمِنِينَ
অর্থাৎ – এবং সবকিছু আমি আপনাকে রাসূলগণের সংবাদই শুনাচ্ছি, যা দ্বারা আমি আপনার হৃদয়কে দৃঢ় করবো। (সূরা হুদ ঃ ১২০) উক্ত আয়াতে পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী বর্ণনা করার একমাত্র কারণ হচ্ছে যে, এর দ্বারা অন্তরের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে নবীকুল সম্রাট এবং শ্রেষ্ঠ রাসূল হলেন আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর সেই মিলাদ মাহফিলে তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণাবলী বর্ণনার সুযোগ ঘটে, আর তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্মরণের মাধ্যমে মুমিনদের অন্তর দৃঢ় হয়। তাই এটা মানুষের জীবনে বারংবার গুরত্ব সহকারে উদযাপনে উৎসাহ্ সৃষ্টি হয়। তাই আমি আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলবো-
– আরবী ইবারত –
অর্থাৎ – “হে মাহবুব! আমি আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী আপনার নিকট এ কারণেই পেশ করলাম, যেগুলো স্মরণের মাধ্যমে আমি আপনার নূরানী অন্তর দৃঢ়তার শেষ স্তরে পৌঁছে দিয়ে থাকি।” হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তরের দৃঢ়তার বেলায় যেরূপ ঐ সমস্ত ঘটনাবলী ভিত্তি স্বরূপ, তদ্রুপ তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রশংসা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি স্বরুপ।”
তৃতীয় দলীল
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে কালামে পাকে এরশাদ ফরমান-
قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
অর্থাৎ – হে প্রতিপালক! আমাদের উপর আকাশ থেকে একটা (খাদ্য) খাঞ্চা অবতরণ করুন, যা আমাদের জন্য ঈদ (আনন্দ উৎসব) হবে আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য এবং আপনারই নিকট থেকে নিদর্শন এবং আমাদেরকে রিযিক দান করুন, আর আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। (সূরা মায়েদাহ্ ঃ ১১৪) বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীরকারক আল্লামা ইছমাঈল হক্কী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ “রূহুল বয়ান” গ্রন্থের ২য় খন্ড ৪৪৬ পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেন-
– আরবী ইবারত –
অর্থাৎ – “অবতীর্ণের দিন ঈদ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে তাই আমরা এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। খাদ্য খাঞ্চার প্রতি এজন্য সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে, যাতে এর বদৌলতে এদিনের মর্যাদা বৃদ্ধি হয়।” অন্য আয়াতে করীমায় এর চেয়ে আরো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যা হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর বাণী কালামুল্লাহ্ শরীফে এভাবে শোভা পায়-
وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا
অর্থাৎ “এবং শান্তি আমার প্রতি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং যেদিন আমার মৃত্যু হবে আর যেদিন জীবিত অবস্থায় পুনরত্থিত হবো।” (সূরা মারয়ামঃ ৩৩) উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতসহ অন্যান্য আরো আয়াতে পাকে (যেমন সূরা আল ইমরানের ৩৫-৪৪নং আয়াতে) হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর মিলাদ তথা জন্মবৃত্তান্তের বিস্তারিত বর্ণনা স্থান পায়। সাথে সাথে এ সমস্ত আয়াতে করীমায় তাঁর প্রশংসা ও গুরত্ব ফুটে উঠে, যা আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রতি বিশেষ অনুগ্রহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাস্তবিক পক্ষে কোরআন মজীদের এই সমস্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে মাহফিল মিলাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদ শরীফের গুরত্ব হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর মিলাদ শরীফের গুরত্বের চেয়ে কম নয়, বরং সায়্যিদুল মুরসালীন রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিলাদে পাকের মর্যাদা ও গুরত্ব সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ও অধিক। কেননা তিনিই হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাই তাঁর মিলাদ শরীফও অত্যন্ত ফজিলত মন্ডিত। মহান সৃষ্টিকর্তার অমীয়বাণী-
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللَّهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ
অর্থাৎ – “এবং নিশ্চয় আমি মূসাকে আমার নিদর্শনাদি সহকারে প্রেরণ করেছি আপন সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে আলোতে আনয়ন কর এবং তাদেরকে আল্লাহ্র দিবস সমূহ স্মরণ করে দাও।” (সূরা ইবরাহীমঃ ৫) অপর বাণীতে রয়েছে-
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ إِبْرَاهِيمَ
“এবং তাদের নিকট পাঠ করো ইবরাহীমের সংবাদ” (সূরা শু’আরাঃ ৬৯) উক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য তাঁদের স্মরণ এবং ঐ সমস্ত নেয়ামতের স্মরণ যা আল্লাহ্ তায়ালা তাঁদের দান করেছেন। আর ঐ সমস্ত নেয়ামতরাজির স্মরণ যেগুলো তাঁরা পৃথিবীর বুকে শুভাগমনের সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। যেমন- হেদায়ত, নূর বা আলো, শরীয়ত, হুকুম-আহকাম, উত্তম নছিহত এবং অলৌকিক ঘটনাবলী। যে সমস্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করার মাধ্যমে বান্দাহর উপর আল্লাহ্ প্রদত্ত করুণার দিকে অন্তর ও জ্ঞান ধাবিত হয়। যা দ্বারা আল্লাহ তায়ালার হক্ব আদায়ের প্রতি সচেষ্ট হওয়া যায়, যার ফলে তাঁর করুণা প্রত্যাশী হওয়া যায় এবং ভয়ানক শাস্তির ব্যাপারে ভীতির সঞ্চার হয়। সাথে সাথে সর্বাবস্থায় তাঁকে ডাকার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। এ ধরণের উত্তম গুণাবলী আম্বিয়ায়ে কেরামের শুভ পদার্পন থেকে পরজগতে পাড়ি জমানো পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলন ঘটে। যাতে মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা রয়েছে আর যা দ্বারা মহান আল্লাহ্ পাক মানুষের অন্তর সুদৃঢ় করেন, হৃদয়সমূহ আলোকিত করেন, আত্মামূহকে উচ্ছাসীন করেন, হৃদয়চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দান করেন, ধর্মীয় বিষয়াদিতে সুগভীর চিন্তাভাবনা ও ত্যাগ করার জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অন্তর পবিত্র করণের সহায়তা প্রদান করে অবাধ্য আত্মাসমূহ সহজে আয়ত্বে এসে পৌঁছেছে যা মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার দিকে এগিয়ে আসে সাথে সাথে এর উপর মনোবল সৃষ্টি হয় ও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় এবং অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। উপরোল্লিখিত নেয়ামত-রাজির বর্ণনা ঐ সমস্ত মিলাদ মাহফিলে খুবই চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়, যাতে বার বার ঐগুলোর কথা স্মরণে আসে। তাই এই ধরণের বরকত মাহফিলে সকলকে আহবান করা খুবই পূণ্যের কাজ। এভাবে আহবানের মাধ্যমে সকলকে জমায়েত করা এবং এর প্রতি উৎসাহ্ প্রদানের মাধ্যমে ধাবিত করাও খুবই উত্তম আমল। এ ধরণের মাহফিলে এমন সব সত্ত্বার আলোচনা স্থান পাওয়া উচিত যাঁদের আলোচনা শুনতে লোকেরা অধিক আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব ও সুমহান আদর্শের আলোকপাত করার দিকে মনোনিবেশ করা যে সমস্ত উত্তম আদর্শ তাঁদের জীবনে প্রতিফলন ঘটেছে। অধিকাংশ লোক এই ধরণের ব্যক্তিত্বের জীবনী শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁদের অন্তরে এর প্রভাব পড়ে। কারণ, ঐ ধরণের ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁদের পরিচিতি নিবিড়। আর তাঁদের প্রতি ভালবাসাও রয়েছে অকৃত্রিম। তাই ঐ সমস্ত মহা মনীষী তাঁদের অন্তরে খুবই সমুন্নত এবং শ্রদ্ধার সাথে স্থান পায়। আর যখনই তাঁদের সুনাম শুনা যায় তখনই তাঁদের বাস্তবজীবনের চিত্র চোঁখে ভেসে উঠে। ঠিক সে মুহুর্তে তাঁদের কর্মজীবন সম্পর্কে আরো জ্ঞান হওয়া যায়, যাতে করে তাঁদের অমীয়বাণী এবং বাস্তবমুখী কর্মাদি নিয়ে বিস্ময়াভিভূত হতে হয়। বাস্তবিক পক্ষে তাঁদের অনুসরণ-অনুকরণ সকলেরই চাওয়া আর পাওয়া অধীর আগ্রহ ও আনন্দচিত্তে তাঁদের জীবনী আলোচনা করা হয়। হায় বর্তমানে কতেক মুসলমানের কী দুর্ভাগ্যের ব্যাপার! তারা তাদের পূর্ববর্তী মহা মনীষীদের আদর্শভরা জীবনী ভুলে যেতে বসেছে। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই- এমন লোকেরও আবির্ভাব ঘটেছে যারা সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হুজুর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র জীবনী আলোচনা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে। অথচ পবিত্র কোরআনে পূর্ববর্তী শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের আলোচনা অনেকস্থানে শোভা পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের জন্মলগ্ন থেকে পরজগতে পাড়ি জমানো পর্যন্ত সুবিশাল জীবনের বিভিন্ন গুরুত্ব পূর্ণ দিক এতে খুবই গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে।
চতুর্থ দলীল
হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম এর মিলাদ শরীফের ঘটনা কোরআনে করীমে সুবিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আলাইহিমাস্ সালাম)এর জন্ম বৃত্তান্ত এতে রয়েছে। এছাড়া অসংখ্য আয়াতে পাকের মাধ্যমে হযরত মারয়াম আলাইহাস্ সালাম এর জন্মের (অলৌকিক) ঘটনাবলীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এভাবে উম্মে রউমের দোয়ার স্মরণ পক্ষান্তরে যা মিলাদ শরীফের অন্তর্ভুক্ত, যাতে ভয়-ভীতির সাথে হযরত মারয়াম (আলাইহাস্ সালাম)এর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন হযরত যাকারিয়া (আলাইহিস্ সালাম) কে হযরত মারয়াম আলাইহাস্ সালাম এর অভিভাকত্ব প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন অমৌসুমী ফলফলাদি প্রদানের মাধ্যমে তাঁর অভিভাকত্বের আকর্ষণ এমনভাবে বৃদ্ধি করেছেন, সমাজের অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা এক পর্যায়ে লটারী দ্বারা তাঁর অভিবাভক নির্ণয়ের পন্থা নির্ধারণ করেছেন। উক্ত ঘটনা সূরা আল্ ইমরানের ৩৪ – ৪৪ নং আয়াতে বিদ্যমান। উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহর প্রেরিত নবী হযরত ইয়াহিয়া আলাইহিস্ সালাম ও হযরত যাকারিয়া আলাইহিস্ সালাম এর শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের কথাও আলোকপাত হয়েছে। তাছাড়া সূরা আল্ ইমরান, সূরা মায়েদাহ্ ও সূরা মারয়ামে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ্ ও রাসূল হযরত ঈসা ইবনে মারয়াম (আলাইহিস্ সালাম)এর মিলাদ শরীফের বিভিন্ন ঘটনা প্রতীয়মান হয়। এখন আমি বলবঃ উপরোক্ত অকাট্য দলীলাদি মহা নেয়ামতের স্মরণ তথা মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বৈধতার প্রমাণ নয় কি? আর ওটা ঐ নবীকুল সম্রাটের (মিলাদের ক্ষেত্রে) তাকিদ সহকারে প্রযোজ্য যা সর্বসম্মতভাবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিগণিত।