কিতাবঃ হযরত গাউসুল আ’যম ও গিয়ারভী শরীফ

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

হযরত গাউসুল আ’যম

গিয়ারভী শরীফ

প্রণয়নে
মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী
অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী)
মধ্য হালিশহর, বন্দর চট্টগ্রাম।

নিরীক্ষণে
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান
অধ্যক্ষ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।

সম্পাদনায়
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

প্রথম প্রকাশ : ১১ জমাদিউল উলা ১৪৪২ হিজরি
১১ পৌষ, ১২২৭ বাংলা
২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ইংরেজি

প্রচ্ছদ : সৈয়দ মুহাম্মদ মনছুরুর রহমান

সর্বস্বত্ত্ব প্রকাশকের :

বর্ণসাজ : মুহাম্মদ ইকবাল উদ্দীন

হাদিয়া : ৬০/- (ষাট) টাকা মাত্র।

প্রকাশনায়
আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট
[প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ]

সূচিপত্র
 প্রকাশকের কথা ৫
 অবতরণিকা ৬
প্রথম অধ্যায়
 বরকতময় জন্ম ৭
 বংশীয় শাজরা ৮
 গাউসে পাকের উপাধি ৯
 ইলমে দ্বীনের খিদমত ১০
 বেলায়তের স্তরে গাউসুল আ’যম ১০
 মাতৃগর্ভের কারামাত ১১
 জন্মদিনে শরীয়তের বিধান পালন ১২
 গাউসে পাকের বেলায়তের ব্যাপকতা ১৩
 ওফাত ১৪
 গাউসিয়াতের মর্যাদা ১৪
 উপদেশাবলী ১৫
 মা’রিফাতের বর্ণনা ১৬
 শিক্ষকমণ্ডলী ১৭
 গাউসের পাকের রচিত গ্রন্থাবলী ১৯
 গাউসে পাকের ওয়াজ নসীহত ২১
 তরিকতের প্রয়োজনীয়তা ২৪
 আউলিয়ায়ে কেরাম তথা পীর মুর্শিদের প্রয়োজন কেন? ২৭
 ইসলামের দৃষ্টিতে বায়‘আতের গুরুত্ব ২৯
 বায়‘আতের সংজ্ঞা ৩১
 মাওলানা রুমীর দৃষ্টিতে বায়‘আতের হাক্বীকত ৩২
 আল-ক্বোরআনের আলোকে বায়‘আত ৩৩
 হাদীস শরীফের আলোকে বায়‘আত ৩৪
 বায়‘আত অস্বীকারকারীর বিধান ৩৭
 বায়‘আতের শর্তাবলী ৩৭
 গাউসে বাগদাদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর প্রতি আ’লা হযরতের ভক্তিমূলক কাব্য ৩৮
 মর্যাদার শীর্ষে গাউসে পাক ৪০
 গাউসে পাকের বংশধারা ৪০
 সম্পর্কই মর্যাদার সোপান ৪১
 গাউসে পাক বিপদে সাহায্যকারী ৪১
 বিরুদ্ধবাদীদের স্বীকারোক্তি ৪২
 গাউসে পাকের বেলায়ত চিরস্থায়ী ৪২
 সকল আউলিয়ায়ে কেরাম গাউসে পাকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ৪৩
 কা’বাও গাউসে পাককে সম্মান জানায় ৪৪
 গাউসে পাক শরীয়ত ও তরীক্বতের কাণ্ডারী ৪৪
 গাউসে পাক জান্নাতের দুলহা ৪৫
 গাউসে পাক বেলায়তের সমুদ্র ৪৬
 সালাতুল গাউসিয়ার ফযীলত ৪৭
দ্বিতীয় অধ্যায়
 ক্বাদেরিয়া তরীক্বার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ৪৮
 গিয়ারভী শরীফ: আল-ক্বোরআনের আলোকে গিয়ারভী শরীফ ৫৩
 আল হাদীসের আলোকে গিয়ারভী শরীফ ৫৪
 ঈসালে সাওয়াব সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের অভিমত ৫৫
 গিয়ারভী শরীফ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের অভিমত ৫৫
 গিয়ারভী শরীফ সম্পর্কে দেওবন্দী আলেমগণের অভিমত ৫৮
 সলফে সালেহীনের অভিমত ৬১
তৃতীয় অধ্যায়
 দরুদ ই- তাজ শরীফের উচ্চারণ অর্থ ও ফযীলত ৬৩
 দরুদ ই- তাজ শরীফের বরকতে রাওযায়ে আক্বদাসে হাযিরা ৬৬
 দেওবন্দী আলেমদের দৃষ্টিতে দরুদ-ই তাজ ৬৭
 সন্দেহের অপনোদন ৬৮
 আক্বীদার স্ববিরোধিতা ৬৮
 দুরুদ শরীফের উপর লিখিত গ্রন্থসমূহ ৭০

প্রকাশকের কথা

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
نَحْمَدُ ه وَنُصَلِّىْ وَنُسَلِّمُ عَلٰى حَبِيْبِه الْكَرِيْمِ وَعَلٰى اٰلِه
وَصَحْبِه وَعَلٰى غَوْثِنَا الْاَعْظَمِ اَجْمَعِيْنَ

ইসলামী দর্শনে সূফীতত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সূফীবাদে বিশ্বাসী সত্যান্বেষী মুসলমানরা ইসলামের দলীল চতুষ্টয় কুরআন (কিতাব), সুন্নাহ, এজমা’ ও কিয়াসের আলোকে এর প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন। যাদের ক্বলব জাগ্রত তারাই সুফী সাধক। আল্লাহর ওলীগণের অবদান তাঁরাই মূল্যায়ন করতে পারেন। একশ্রেণীর মুসলমানদের জীবন-দর্শনে আউলিয়ায়ে কেরামের আদর্শ ও শিক্ষা উপেক্ষিত। ‘হযরত গাউসুল আ’যম ও গিয়ারভী শরীফ’ শরীয়ত ও তরীক্বতপন্থী মুসলিম সমাজের জন্য অতীব উপকারী পুস্তক। এ জাতীয় প্রকাশনার দৈন্য দীর্ঘদিনের। ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম রিজভী কর্তৃক লিখিত এ পুস্তক প্রকাশ করা আমরা সময়ের দাবী ও প্রয়োজন বলেই মনে করি। আশা রাখি বইটি তাসাওফ চর্চা ও তরীক্বতের স্বাদ আস্বাদনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তরীক্বতপন্থী ভাই ও বোনেরা পুস্তকটি সংগ্রহে অনুপ্রাণিত হবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

ধন্যবাদান্তে-

আলহাজ্ব মুহাম্মদ মহসিন-সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট

আলহাজ্ব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন- সেক্রেটারি জেনারেল
আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট

অবতরণিকা
বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম

আল্লাহ্ তা‘আলার ওলীগণ আল্লাহর বন্ধু, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উত্তরসূরি বা নায়েবে রাসুল, তথা আল্লাহর ওলীগণ যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন।
সুফীসাধক, পীর মুর্শিদ ও হক্কানী ওলামায়ে কেরাম, উন্নত চরিত্র, আত্মশুদ্ধিচর্চা ও কুরআন সুন্নাহর আদর্শ ও শিক্ষা সমুন্নত রেখে মানবতার মুক্তির পথ সুগম করেছেন। সকল প্রকার অনৈসলামিক ফিতনা উৎখাতে ও ভ্রান্ত আক্বিদা-বিশ্বাসের মুলোৎপাটনে তাঁদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ওলীকুল সম্রাট ক্বাদেরিয়া তরিক্বার প্রবর্তক, গাউসুল আ’যম হযরত আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র জীবন-কর্ম, শিক্ষা ও দর্শন বিভ্রান্ত মানবজাতিকে দিয়েছে মুক্তির সঠিক নির্দেশনা। ইসলাম ও মুসলমানদের পূণর্জাগরণে ধরাধামে হুযূর গাউসে পাকের শুভাগমন ছিলো মহান স্রষ্টার আর্শীবাদ। আরবী উর্দু, ফার্সী, ইংরেজী ভাষায় তাঁর জীবনের ওপর অসংখ্য গ্রন্থাবলী রচিত হয়েছে, অথচ আমাদের মাতৃভাষায় তাঁর জীবন দর্শনের উপর প্রকাশনা নিতান্ত সীমিত। মহামনীষী ও আল্লাহর ওলীগণের চিন্তা চেতনা ও আধ্যাত্মিক ভাবধারাকে যারা নিজেদের জীবনে রূপায়িত করতে পেরেছেন তারা অন্তরাত্মায় ঈমানের স্বাদ ও অনুভূতি লাভে সক্ষম হয়েছেন।
গাউসে পাক মর্যাদার শীর্ষে অধিষ্ঠিত, তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া অথচ আমাদের মুসলিম সমাজে অনেকেই তাঁর অবদানকে স্বীকার করতে কার্পণ্য করে। তারা ওলীদ্রোহী। মুসলিম সমাজ যাতে সকল প্রকার বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ওলীগণের অনুসৃত আদর্শে তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনে তৎপর হন, সেই মহৎ উদ্দেশ্যেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। পুস্তিকাটি অধ্যয়নে সম্মানিত পাঠক সমাজ ‘হযরত গাউসুল আ’যম ও গিয়ারভী শরীফ’ প্রসঙ্গে তথ্য ভিত্তিক ধারণা পাবেন। পুস্তিকাটি ইতিপূর্বে আমার লিখিত ও প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধের সমন্বিত সংকলন, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম পুস্তকটি প্রকাশ করে আমাকে কৃতার্থ করেছেন। প্রকাশনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ। পুস্তিকাটি বহুল প্রচার একান্ত কাম্য। আল্লাহ আমাদের এ ক্ষুদ্র খিদমত কবুল করুন। আমীন।

মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী

প্রথম অধ্যায়

হযরত গাউসুল আ’যম ও গিয়ারভী শরীফ

‘বেলায়তের উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন আল্লাহর পূন্যাত্মা বান্দাগণ আউলিয়ায়ে কেরাম হিসেবে স্বীকৃত। ক্বোরআন ও সুন্নাহ তথা আল্লাহ ও রসূলের যথার্থ অনুসরণ, ইসলামী আদর্শের যথার্থ বাস্তবায়ন সর্বোপরি আল্লাহ ও রসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের কারণেই তাঁরা মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। তাঁদের ব্যবহারিক জীবনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অগণিত অমুসলিমও স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম দ্বীন আল-ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের অক্লান্ত ত্যাগ ও শ্রমের বিনিময়ে সত্যিকার ইসলামের মর্মবাণী হেদায়তের সঞ্জীবনী ধারা পৃথিবীর দিগদিগন্তে প্রচারিত প্রসারিত। খোদাদ্রোহী, নবীদ্রোহী, তাগুতী বাতিল অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে কালজ্বয়ী আদর্শ আল ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে যারা সক্ষম হয়েছিলেন, অলীকুল সম্রাট, বেলায়তের পরশমনি, আধ্যাত্মিক সাধক, সত্যের প্রচারক, সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার প্রবর্তক, গাউসুল আ’যম হযরত শেখ সৈয়দ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁদের শীর্ষস্থানীয়। এ পুস্তকে এ মহান ব্যক্তির কর্মময় জীবনের কিঞ্চিৎ আলোচনার মানসে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

বরকতময় জন্ম
হযরত গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ৪৭০, মতান্তরে ৪৭১ হিজরি মোতাবেক ১ রমজান (২৯ শাবান দিবাগত রাত) ১০৭৮ খৃষ্টাব্দে আল্লাহর শতসহস্র ওলী স্মৃতি বিজড়িত পূণ্যভূমি জিলান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন।

পিতা মহোদয়
তাঁর সম্মানিত পিতার নাম হযরত সাইয়্যেদ আবু সালেহ্ মুসা জঙ্গী দোস্ত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি ইসলামী জিহাদকে জীবনের প্রধান ভূষণ হিসেবে গ্রহণ করায় জঙ্গী দোস্ত বা ‘যুদ্ধ প্রিয়’ উপাধিতে ভূষিত হন।

মহীয়সী মাতা
হযরতের মাতার নাম হযরত সাইয়্যেদা ‘ফাতেমা বিনতে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ সাউমা‘ঈ যাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।

বংশীয় শাজরা
হযরত গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর পিতা হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর ছিলেন। আম্মাজান ছিলেন হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর। পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয় দিক দিয়ে তিনি সায়্যিদ তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা-এর বংশধর ছিলেন।

পিতৃকুলের বংশীয় শাজরা নিম্নে প্রদত্ত হলো
১. হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু
২. হযরত সৈয়দ ইমাম হাসান মুজতাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু
৩. হযরত সৈয়দ হাসান মুসান্না রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৪. হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ্ মাহ্দ্ব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৫. হযরত সৈয়দ মুসা আলজওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৬. হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ্ সালেহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৭. হযরত সৈয়দ মূসা সানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৮. হযরত সৈয়দ আবু বকর দাঊদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৯. হযরত সৈয়দ সামসুদ্দিন যাকারিয়া রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১০. হযরত সৈয়দ ইয়াহিয়া যাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১১. হযরত সৈয়দ আবদুল্লাহ্ জিবিল্লী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১২. হযরত সৈয়দ আবু ছালেহ মূসা জঙ্গী দোস্ত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১৩. হযরত গাউসুল আ’যম শায়খ সৈয়দ আবদুল ক্বাদের জীলানী
রাহমাতুল্লাহি আলায়হিম আজমা‘ঈন।

মাতার দিক থেকে হুযূর গাউসে পাকের বংশধারা
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে মিলিত হয়। যা নিম্নরূপ
১. হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
২. হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা
৩. সায়্যিদুনা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু
৪. সায়্যিদুনা ইমাম যায়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু
৫. সায়্যিদুনা ইমাম বাক্বির রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৬. সায়্যিদুনা ইমাম জাফর সাদিক্ব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৭. সায়্যিদুনা ইমাম মূসা কাযিম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৮. সায়্যিদুনা ইমাম আলী রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
৯. সৈয়্যদ আবু আলাউদ্দিন মুহাম্মদ আল-জাওয়াদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১০. সৈয়্যদ কামাল উদ্দিন ঈসা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১১. সৈয়্যদ আবুল ‘আতা আবদুল্লাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১২. সৈয়্যদ মাহমূদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১৩. সৈয়্যদ মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১৪. সৈয়্যদ আবূ জামাল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১৫. সৈয়্যদ আবদুল্লাহ্ সাউমা‘ঈ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
১৬. সায়্যিদাহ্ উ¤মুল খায়র আমাতুল জব্বার ফাতিমাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হা
১৭. হযরত শায়খ সৈয়্যদ মুহিউদ্দীন আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।

গাউসে পাকের উপাধি
গাউসে পাকের বেলায়তের পরিধি পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত। এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় তিনি বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত। যথাঃ গাউসুল আ’যম, মাহবূবে সুবহানী, গাউসে সমদানী, ক্বুত্ববে রব্বানী, মা’শুক্বে হক্কানী, নূরে রহমানী, শায়খুল মাশায়িখ, গাউসুস্ সাক্বালাঈন, সাইয়েদুল আউলিয়া, ইমামূল আউলিয়া, শায়খুল ইনসে ওয়াল জিন্নে, ইমামুত ত্বরীক্বত, মুহিউস্ সুন্নাত, কামেউল বিদ্‘আত, জামে‘ঊল কামালাত, শায়খুস্ সাা-ই ওয়াল আরদ্বে, নূরে ইয়াযদানী, গাউসে গীলানী, পীরান-পীর দস্তগীর, শায়খ মহিউদ্দিন আবূ মুহাম্মদ সাইয়্যেদ আবদুল ক্বাদের জীলানী, আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
ইলমে দ্বীনের খেদমত
হযরত গাউসুল আ’যম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ৯১ বছর বয়সের মধ্যে একাধারে ৫০ বৎসর আল্লাহর সান্নিধ্যে ইবাদত-বন্দেগী, যিক্র-আযকার, মোরাক্বাবা, মোশাহাদা এবং যাহের ও বাতেন উভয়দিকে কামালাত বা পূর্ণতা অর্জনে ব্রতী ছিলেন অবশিষ্ট ৪১ বৎসরের মধ্যে একাধারে ৩৩ বৎসর ইলমে দ্বীনের প্রচার প্রসারকল্পে শিক্ষকতার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি স্বয়ং বলেছেন
دَرَسْتُ الْعِلْمَ حَتّی سِرْتُ قُطُبًا -وَنِلْتُ السَّعَدِ مَنْ مَوْلَی الْمَوَالِ
অর্থাৎ ইলমে দ্বীন অর্জন করতে করতে আমি বেলায়তের উচ্চ মর্যাদা কুত্ববিয়তের সোপানে উন্নীত হয়েছি এবং মহামহিম স্রষ্টার সৌভাগ্য তথা কল্যাণ অর্জন করেছি।
কাব্যানুবাদ ঃ জ্ঞান সাধনায় মগ্ন ছিলাম- তৎপরেতে কুতুব হলাম,
সকল প্রভুর প্রভু থেকে খোশ নসীবীর এ দান পেলাম।

বেলায়তের স্তরে গাউসুল আ‘যম
সুবিখ্যাত গ্রন্থ আক্বাইদে নসফীতে আছে ‘কারামাতুল আউলিয়ায়ে হাক্ব্ক্বুন’ অর্থাৎ অলীগণের কারামত সত্য। আল্লাহর ওলীগণের কারামতে বিশ্বাস করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদার অন্তর্ভুক্ত বিষয়। যারা অলীগণের কারামাত স্বীকার করে না তারা পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত। পৃথিবীতে অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরামের আগমন হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত আরো আউলিয়া কেরামের শুভাগমন হবে। আল্লাহর পূণ্যাত্মা বান্দা আল্লাহর ওলীগণের মধ্যে বিভিন্ন স্তর রয়েছে- এমন অনেক ওলী রয়েছেন, যাঁদের নিয়ন্ত্রণে দুনিয়ার শাসনভার খোদায়ী রাজত্বের শৃংখলা বিধানের দায়িত্ব ন্যস্ত। এমন ওলীগণের সংখ্যা তিনশত তেরজন, সুফিতাত্বিক পরিভাষায় তাঁদেরকে ‘আখইয়ার’ বলা হয়। যেসব ওলীর ওসীলায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও রহমতের বারিধারা বর্ষিত হয়। সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা, ফুলে-ফলে ধান্যভরা জমিন হয়। তাঁদের সংখ্যা চল্লিশজন। তাঁদেরকে ‘আবদাল’ বলা হয়। আরো সাতজন ওলী আছেন, যাঁদেরকে ‘আবরার’ বলা হয়। পাঁচজনকে ‘আওতাদ’ বলা হয়, এ পাঁচজন আওতাদের ওসীলায় এ পৃথিবী স্থির থাকে। তিনজন এমন ওলী আছেন, যাঁদেরকে ‘নক্বীব’ বলা হয়। একজন এমন ওলী আছেন, যাঁকে ‘ক্বুত্বব’ এবং ‘গাউস’ বলা হয়। গাউসগণের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত বেলায়তে ‘ওয্মা ও গাউসিয়াতে কোবরার সুমহান আসনে যিনি অধিষ্ঠিত তিনি হলেন গাউসুল আ’যম। শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হলেন সর্বসম্মতিক্রমে ‘গাউসুল আ’যম’।
‘ইরগামূল মুরীদীন’ নামক গ্রন্থে ‘গাউস’ শব্দের সংজ্ঞায় নিম্নোক্ত বর্ণনা ব্যক্ত হয়েছে।
الغوث هو القطب الذی یستغاث به
অর্থাৎ গাউস এমন ক্বুুত্ব্বকে বলা হয়, যাঁর কাছে কোন বৈধ জিনিষ প্রার্থনা করা যায় এবং যার ওসীলায় প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে ক্ববূল হয়।

‘গাউস’ শব্দের অর্থ সাহায্যকারী।
খোদা প্রদত্ত ক্ষমতাসম্পন্ন মহান আধ্যাত্মিক সাধক হলেন, হযরত গাউসে পাক শায়খ আব্দুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি মহান স্রষ্টা প্রদত্ত ক্ষমতায় সৃষ্টিকুলের সাহায্য ও কল্যাণ সাধনে সক্ষম। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় গ্রন্থ ‘নুজহাতুল খাতির’-এ হযরত গাউসে পাকের একটি উদ্ধৃতি পেশ করেন।
من استغاث بی فی کربۃ کشفت عنہ ومن نادانی باسمی فی شدۃ فرجت عنہ ومن توسل بی الی اللہ فی حاجۃ قضیت
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন বিপদের সময় আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে, তার বিপদ দুর হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি কঠিন বিপদের মুহূর্তে আমার নাম ধরে আমাকে আহবান করবে, তার সঙ্কট দুরীভূত হবে। যে ব্যক্তি কোন প্রয়োজনে আমাকে আল্লাহর দরবারে ওসীলা বানাবে তার প্রয়োজন পূর্ণ হবে।

মাতৃগর্ভের কারামত
গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি দুনিয়ায় আগমনের পূর্বে মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় ও জন্মের পর অসংখ্য অলৌকিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় যেগুলো কারামাতের অন্তর্ভুক্ত। গাউসে পাকের কারামাত বর্ণনাতীত। শুধু তাঁর কারামাতের বর্ণনা দিতে একটি স্বতন্ত্র পুস্তক প্রকাশের প্রযোজন হবে। এখানে তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ব্যাপকতা অনুধাবনে পাঠক মহলের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি কারামাত বর্ণিত হলোঃ
স্বয়ং গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর আম্মাজান সৈয়্যদা উম্মুল খায়র ফাতেমা বলেন, যেদিন আমার নবজাত নুরানী শিশু ভূমিষ্ঠ হয় সেদিন আমার স্বামী সৈয়্যদ আবু সালেহ মুসা জঙ্গী দোস্ত স্বপ্নে দেখেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর বহু সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আমাদের ঘরে তাশরীফ আনলেন এবং আমার স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেন-
باابا صالح اعطاک اللہ ابنا صالحا وهو ولدی ومحبوبی ومحبوب اللہ سبحانہ وتعالٰی وسیکون لہ شان فی الاولیاء والاقطاب کشانی بین الانبیاء والمرسلين
অর্থাৎ: হে আবু সালেহ! আল্লাহ পাক তোমাকে একজন সৎ ও নেক্কার সন্তান দান করেছেন। সে আমার বংশধর আমার প্রিয় এবং আল্লাহ পাক সুবহানাহু তা‘আলারও প্রিয়। সে শীঘ্রই আউলিয়া ও ক্বুত্বগণের মধ্যে এমন মর্যাদা লাভ করবে যেমন আম্বিয়ায়ে কেরাম ও রসুলগণের মধ্যে আমার মর্যাদা।

জন্মদিনে শরীয়তের বিধান পালন
গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জন্মদিনে শরীয়তের হুকুম পালন করে দিশেহারা জনগোষ্ঠীকে সঠিকপথের সন্ধান দিলেন। দিনটি ছিল শা’বান মাসের ২৯ তারিখ। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। জীলানবাসীরা কেউ চাঁদ দেখেনি, সকলে রোযা রাখা না রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। এমতাবস্থায় রাতের শেষাংশে সুবহে সাদিক্বের পূর্বেই ধরাধামে শুভাগমন করেন উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় নুরানী চেহারার শিশু সন্তান, মুসলিম মিল্লাতের রাহনুমা, হেদায়তের উজ্জ্বল রবি, মুক্তির দিশারী, হযরত আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। জন্মের পর সুবহে সাদিক্বের পর থেকে তাঁকে কিছু খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। এদিকে জীলানবাসীরা রোজা রাখা না রাখার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এতদসংক্রান্ত শর‘ঈ ফয়সালা জানার জন্য গাউসে পাকের পিতার নিকট গমন করেন, পিতাকে না পেয়ে পর্দার আড়ালে থাকা আম্মাজানের নিকট মাসআলা জিজ্ঞেস করেন। বিচক্ষণ আম্মা বললেন, ‘‘আমার সদ্য প্রসূত নবজাত শিশুর অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সে রোযা রেখেছে, কারণ আজকে সুবহে সাদিক্বের পর থেকে তাঁকে দুধ বা অন্য কিছু পান করানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমার মনে হয় আজকে রমজানের প্রথম তারিখ বিধায় সে রোজা রেখেছে।’’ আম্মাজানের বর্ণনা শুনে উপস্থিত জনতা আশ্চর্য হয়ে গেল এবং সংশয়ের অবসান হলো, সকলে রোযা রাখার সিদ্ধান্ত নিল। পরবর্তিতে জীলানের পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে জানা গেলো যে, গত সন্ধ্যায় আকাশে রমযান শরীফের নূতন চাঁদ উদিত হয়েছে।
এতে প্রতীয়মান হলো যে আল্লাহর ওলীগণের গোটা জীবন ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক পরিচালিত হয়। এ বিষয়ে গাউসে পাক নিজেই একটি ক্বাসীদায় উক্ত ঘটনা উল্লেখ করেন। কবিতাটি পংক্তি নিম্নরূপঃ
به آیة امری ذکرہ ملاء الفضا – وصومی فی مهدی به کان
অর্থাৎ আমার শৈশবকালের যিকর-আযকারে সমগ্র সৃষ্টিজগত পূর্ণ হয়ে আছে। আর শৈশবকালে দোলনায় আমার রোযা পালনের ব্যাপারটিতো প্রসিদ্ধিই লাভ করেছে। [তারগীবুল মানাযির]

গাউসে পাকের বেলায়তের ব্যাপকতা
হযরত শায়খ আবুল কাশেম ইবনে আবু বকর ইবনে আহমদ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন আমি শায়খ খলীফা থেকে শুনেছি, তিনি বলেন-
رَاَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ لَهٗ يَا رَسُوْلَ اللهِ لَقَدْ قَالَ الشَّيْخُ عَبْدُ الْقَادِرِ قَدَمِىْ هٰذِه عَلٰى رَقَبَةِ كُلِّ وَلِىِّ اللهِ فَقَالَ صَدَقَ الشَّيْخُ عَبْدُ الْقَادِرِ وَكَيْفَ لَا وَهُوَ الْقُطْبُ وَاَنَا اَرْعَاهُ
অর্থাৎ আমি স্বপ্নযোগে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম এবং হুযূর পুরণূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম- ইয়া রাসুলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়কা ওয়াসাল্লাম হযরত আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যে বলেছেন, ‘আমার পা পৃথিবীর সমস্ত ওলীর গর্দানের উপর;- একথা কি সত্য? হুযুর পুরণূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উত্তরে এরশাদ করলেন ‘‘এ কথা সত্য। আর তা বলবেনও না কেন? তিনি যুগের ক্বুত্বব, আমি নিজেই তাঁর নেগাহবানী করে থাকি।’’
হযরত শায়খ কুতুব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন তিনশত তেরজন অলী সারা পৃথিবীতে একই সাথে হযরত গাউসুল আযমের পা মোবারকের নীচে মাথানত করেন, তন্মধ্যে মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে ১৭ জন, ইরাকে ৬০ জন, ইডেনে ৪০ জন, সিরিয়াতে ৩০ জন, মিশরে ২০ জন, পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্যান্য দেশে ২৭ জন, পূর্বাঞ্চলীয় দেশে ২৩ জন, আবিসিনিয়াতে ১১ জন এয়াজূজ মাজূজের প্রাচীর এলাকাতে ১৭ জন সরন্ধীপে অর্থাৎ শ্রীলংকাতে ১৭ জন কুহে ক্বাফে ৪০ জন বাহরে মুহীত্বে ৪০ জন।

ওফাত
ইসলামের এ মহান সাধক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব অলীকুল সম্রাট হযরত আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ৫৬১ হিজরি সনে ১১ রবিউস্ সানী সোমবার ৯১ বৎসর বয়সে তাঁর মওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে গমন করেন। তাঁর আবির্ভাব ও তিরোধান সম্পর্কে আরবী ভাষায় রচিত নিম্নোক্ত পংক্তি দু’টি উল্লেখ যোগ্য-
ان باز اللہ سلطان الرجال -جاء فی العشق توفی فی الکمال
কাব্যানুবাদঃ আল্লাহর রাজপাখি মানবকুলের সুলতান,
এশক নিয়ে এসেছেন পূর্ণতায় তিরোধান।
উল্লিখিত পংক্তিতে আবজাদ হিসাবানুযায়ী عشق (ইশক্ব) শব্দের মানগত সংখ্যা হচ্ছে ৪৭০ আর ৪৭০ হিজরীতে তাঁর জন্ম। ৯১ বৎসর বয়সে ৪৭০+৯১=৫৬১ হিজরী সালে তাঁর ওফাত।

গাউসিয়াতের মর্যাদা
হযরত গাউসুল আ‘যম বেলায়তের সুমহান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, তাঁর অপরিসীম আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, আল্লাহর কুদরত ও প্রিয়নবীর মু’জিযার বাস্তব প্রতিফলন। তাঁর মর্যাদার কথা তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেনঃ
وَکُلُّ وَلِیٍّ عَلٰی قَدَمٍ وَاِنِّىْ – عَلٰی قَدَمِ النَّبِیِّ بَدْرِ الْکَمَال
কাব্যানুবাদঃ সব ওলী মোর পথেই চলে, আর যে আমি চলছি ওরে,
কামালাতের পূর্ণ শশী, মোর নবীজির কদম পরে।
হযরত শায়খ আদি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, যেদিন হযরত গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছিলেন,
قَدَمِیْ هٰذِہ عَلٰی رَقَبَۃِ کُلِّ وَلِیِّ اللهِ
অর্থাৎ ‘আমার এ পা আল্লাহর প্রত্যেক ওলীর কাঁধের উপর সেদিন তিনশ’ জন ওলী যমীনে এবং সাতজন ওলী আসমান থেকে হযরতের পায়ের নিচে শির ঝুঁকিয়ে রাখেন।
হযরত শায়খ আবূ মুহাম্মদ ক্বাসেম বসরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যেদিন এ উক্তি করেছিলেন সেদিন আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি দেখলাম, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য মাশরিক্ব-মাগরিব তথা পৃথিবীর অলীগণ তাঁর সম্মানে শির নত করে দিয়েছেন। একজন আজমী ওলী মস্তক নত করে নি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বেলায়ত চলে গেলো। এতে প্রতীয়মান হল আউলিয়ায়ে কেরামের প্রতি অসম্মান ও অশ্রদ্ধা রহমত লাভের অন্তরায়, উপরন্তু অর্জিত নি’মাত হাতছাড়া হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

উপদেশাবলী
আউলিয়ায়ে কেরাম আল্লাহর নি’মাত প্রাপ্ত মনোনীত পুণ্যাত্মা বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা বিভ্রান্ত দিশেহারা মানব-গোষ্ঠীর মুক্তির দিশারী। তাঁদের অনুসরণ অনুকরণ ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির মাধ্যম। তাঁদের অমূল্য উপদেশাবলী মুসলিম জাতির দিক-নির্দেশিকা। হুযূর শাহানশাহ-ই বাগদাদের সহস্র অমূল্য বাণী তাঁর রচনাবলীতে সংরক্ষিত। কুরআন, সুন্নাহ্, এজমা’ ক্বিয়াসের ভিত্তিতে ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ জটিল সমস্যাদির সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়ে তিনি যুক্তি ও তথ্য নির্ভর সমাধান পেশ করেন। তিনি ঈমান, আক্বীদা, আমল, আখলাক্ব, তাওহীদ, রিসালত, আখেরাত, খেলাফত, ইমামত, বেলায়ত ও সিয়াসত ইত্যাদি বিষয়ে তাত্বিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন।
তাঁর অমূল্য উপদেশাবলীর কতিপয় নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
সবর বা ধৈর্য মু’মিনের জীবনের একটি মহৎ গুণ। সবর সম্বন্ধে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন-
اَلصَّبْرُ هُوَ الْوَقُوفُ مَع َالْبَلَاءِ بِحُسْنِ الْاَدَبِ وَالثبات مَعَ اللهِ
অর্থাৎ বিপদে স্থির থাকা, পূর্ণ আদব রক্ষা করে এবং দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত থাকার নামই সবর।
খাওফ বা ভয় সম্বন্ধে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিম্নোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
فَقَالَ الْخَوْفُ عَلی اَنْوَاعٍ فَالْخَوْفُ لِلْمُذْنِبِیْنَ وَالْوَهْبَۃُ لِلْعَارِفِیْنَ -فَخَوْفُ الْمُذْنِبِیْنَ عَنِ الْعُقُوْبَاتِ وَخَوْفُ الْعَابِدِیْنَ مِنْ فَوْتِ الْعِبَادَاتِ وَخَوْفُ الْعَالَمِیْنَ مِنَ الشِّرْکِ الْخَفِیِّ فِی الطَّاعَاتِ وَخَوْفُ الْمُحِبِیْنَ فَوْتُ اللِّقَاءِ وَخَوْفُ الْعَارِفِیْنَ الْہَیْبَۃُ وَالتَّعْظِیْمُ وَهُوَ اَشَدُّ الْخَوْفِ لِاَنَّہٗ لَایَزَالُ اَبَدًا
অর্থাৎ তিনি বলেন, খাওফ বা ভয় কয়েক প্রকারঃ
১. ‘খাওফে মুযনেবীন’ বা গুনাহগারদের ভয়। তাদের ভয় হচ্ছে আল্লাহর আযাবের ভয়।
২. ‘খাওফে আবেদীন’ বা ইবাদতকারী বান্দাগণের ভয় তাঁদের ভয় হচ্ছে ইবাদত নষ্ট হয়ে যাওয়া বা ছুটে যাওয়ার ভয়।
৩. ‘খাওফে আলেমীন’ বা আলেমদের ভয় তাঁদের ভয় হচ্ছে ইবাদতে শিরকে খফীর ভয়।
৪. ‘খাওফ মুহেব্বীন’ বা খোদা প্রেমিকদের ভয় তাঁদের ভয় হচ্ছে, আল্লাহর দর্শন বা দিদার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়।
৫. ‘খাওফে আরেফীন’, তাঁদের ভয় হচ্ছে আল্লাহ পাকের আযমত ও হায়বতের ভয়। এটাই সবচেয়ে কঠিন। এ ভয় সব সময় তাঁদের অন্তরে বিরাজ করে।

মা’রিফতের বর্ণনা
وَسُئِلَ رَضِیَ اللهُ عَنْہُ عَنِ الْمَعْرِفَۃِ فَقَالَ هِیَ الْاَطَاعَۃُ عَلٰی مَعَانِیْ حَفَایَاہُ عَنِ الْمَکْنُوْنَاتِ وَشَوَاهِدِ الْحَقَّ فِیْ جَمِیْعِ السیئات تبامیح کل شئ منہا علی معانی وحدانیۃ مع النظر الی الحق القلب
অর্থাৎ মা’রিফত সম্বন্ধে জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি বলেন, সৃষ্টিরাজির গোপন তথ্যাদির উপর আস্থা স্থাপন করা। প্রতিটি প্রামাণ্য বিষয়ে সত্যের সাক্ষ্য দেয়া। একত্ববাদের অর্থবহ প্রতিটি বস্তুর মধ্যে অন্তর চোখে দৃষ্টিপাত করা।
উল্লেখ্য সৃষ্টির প্রতিটি বস্তু স্রষ্টার অস্তিত্বের দলীল স্বরূপ। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কবি আবুল আতাহিয়া বলেন-
وَکُلُّ شَئْ ٍلَهُ اَیَةٌ -تَدُلُّ عَلَی اَنَّهُ الْوَاحِدُ
অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুর মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন বিদ্যমান, যা তিনি একক, অদ্বিতীয় হবার প্রমাণ বহন করে।
এভাবে তিনি শরীয়ত তরীক্বত, হাক্বীকত ও মা’রিফতের নিগূঢ় তত্ত্ব উদঘাটন করে অগণিত সমস্যার সমাধান পেশ করেন, মুসলিম মিল্লাতের রাহনুমা বা দিশারীর ভূমিকা পালন করে একটি চিরঞ্জীব পরিপূর্ণ অম্লান আদর্শ রেখে তাঁর মওলায়ে হাক্বীক্বীর সান্নিধ্যে গমন করেন।
এককালে পূণ্যভূমি ইরাকের বাগদাদ নগরী ছিল ইসলামী তাহযীব-তমদ্দুন, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সর্বপ্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ। তাঁর শুভাগমনকালে বাগদাদ নগরী ছিল ইসলামী জগতের খ্যাতনামা চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, দার্শনিক, পণ্ডিত, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফ্তী ও ধর্মীয় পণ্ডিত বিশেষজ্ঞদের পদচারণায় মুখরিত। বাগদাদের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ‘নিযামিয়া মাদরাসা’র সুনাম-খ্যাতি তখন শীর্ষে। হযরত শায়খ আবদুল ক্বাদির জীলানীও শরীয়তের সার্বিক বিষয়ে পূর্ণতা লাভের জন্য ইলমে দ্বীনের অতলান্ত সুবিস্তৃত মহাসমুদ্রের অমূল্য রতœ, জ্ঞান-সম্পদ আহরণের জন্য এ মাদ্রাসাকে মনোনীত করেন।

শিক্ষকমণ্ডলী
এক দল আদর্শবান, নিষ্ঠাবান, চারিত্রিক বলিষ্ঠতার সর্বোচ্চ সোপানে অধিষ্ঠিত জাহের-বাতেন ইলমে দ্বীনের অধিকারী সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলীর তত্ত্বাবধানে তিনি জ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর শিক্ষকমন্ডলীর মধ্যে যথাক্রমে- আল্লামা শায়খ আবুল ওয়াফা, আল্লামা আলী বিন তোফাইল, আল্লামা আবূ গালিব মুহাম্মদ বিন হাসান বাক্বিল্লানী, আল্লামা আবু যাকারিয়া ইয়াহ্য়া ইবনে আলী তাবরিযী, আল্লামা আবূ সা‘ঈদ ইবনে আবদুল করীম, আবুল গানাইম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ও আবূ সা‘ঈদ ইবনে মুবারক মাখযূমী রহমাতুল্লাহি আলাইহিম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর সম্মানিত শিক্ষকদের অনেকেই অসংখ্য ধর্মীয় গ্রন্থাবলীর প্রণেতা। বিশেষতঃ আল্লামা আবূ যাকারিয়া তাবরিযী ও আল্লামা বাক্বিল্লানী রহমাতুল্লাহি আলায়হিমা ইসলামী আদর্শ ও আরবী সাহিত্যের উপর তাঁদের রচিত গ্রন্থাবলী সর্বজন স্বীকৃত। দীর্ঘ আট বৎসর পর্যন্ত তিনি এসব বিখ্যাত শিক্ষকমণ্ডলীর সার্বিক নির্দেশনায় নিজেকে প্রস্তুত করেন। ৪৯৬ হিজরীতে তিনি দ্বীনী জ্ঞানার্জনে পুর্ণতা লাভ এবং সমাপনী সনদ অর্জন করেন। এমনকি ইসলামী বিশ্বে তখনকার সময়ে তাঁর সমকক্ষ আলেম ছিলই না। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানার্জনের পর স্বীয় শিক্ষকের নির্দেশানুসারে তিনি দ্বীনী শিক্ষার আলো বিতরণে, উপরন্তু শরীয়ত ও তরীক্বত তথা জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয়দিকের সমন্বয়পূর্বক খোদাভীরু আশেক্বে রসূল আদর্শবান সুনাগরিক সৃষ্টির মহান প্রয়াসে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। সুনিপুণ পাঠদান, নিখূঁত উপস্থাপনা, বিশুদ্ধ অধ্যাপনা ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে স্বল্প সময়ে তাঁর সুনাম-খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
তাঁর সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান অর্জনের অভিপ্রায়ে শিক্ষার্থী জ্ঞান পিপাসুরা দূর দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে ছুটে আসত। ক্রমান্বয়ে ছাত্র সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেল।
দ্বীনের প্রচার-প্রসারের মহান খিদমত আঞ্জাম দেয়ার নিমিত্তে তিনি তাঁর কার্যক্রমকে শিক্ষকতা বা অধ্যাপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর খিদমতের পরিধি সম্প্রসারিত হল, গোটা জগৎ তাঁর অবদানে উপকৃত হলো। ইহকাল ও পরকালে মুক্তির সার্বিক নির্দেশনা লাভে জাতি এক মহান নি’মাত লাভে ধন্য হলো। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিনিয়তই ফাত্ওয়াসমূহ বা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে দ্বীনী ও দুনিয়াবী বিষয়াদির নির্ভুল জবাব বা সমাধান প্রদানে তিনি অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন। লিখিতভাবে সকল জিজ্ঞাসার জবাবদানের ফলে সর্বসাধারণ ব্যাপকহারে উপকৃত হতে লাগল। শুধু এতটকু নয়, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ, পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত কর্তাব্যক্তি, মন্ত্রীবর্গ, শাসকবর্গ, আমীর-উমরা, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা কর্তৃক যখনই কোন প্রকারের ইসলাম বিরোধী, শরীয়ত বিরোধী ও অনৈতিক কার্যকলাপ তাঁর দৃষ্টিগোচর হত, তখনই অকুণ্ঠচিত্তে প্রতিবাদ করতেন, অপকর্ম সম্পর্কে সজাগ করতেন, কঠোর হুশিয়ারী বাণী উচ্চারণ করতেন, সত্য ও আদর্শের পয়গাম নির্ভীকচিত্তে তাঁদের সম্মুখে তুলে ধরতেন। বিভ্রান্তির পথ পরিহার করে সত্যের পথ অনুসরণ করার আহবান জানাতেন। জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় খোদায়ী শাস্তির করুন পরিণতি সম্পর্কে কঠোরভাবে সতর্ক করতেন। এক কথায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে প্রচলিত নানাবিধ অপব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তির প্রতিরোধে তিনি ছিলেন নির্ভীক সাহসী কণ্ঠ। খোদাদ্রোহী জালিম অত্যাচারী শাসক-গোষ্ঠীর জন্য তিনি ছিলেন আতঙ্ক। সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সমালোচনাকারীর কোন প্রকার বিন্দুমাত্র পরওয়া করতেন না। অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, জুলূম-নির্যাতন, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বদা কঠোর বাক্য উচ্চারণ করতেন। তাঁর রচিত অমূল্য গ্রন্থাবলীতে আমীর-উমরাদের প্রতি তাঁর প্রদত্ত ধর্মীয় উপদেশাবলী লিপিবদ্ধ রয়েছে।

গাউসে পাকের রচিত গ্রন্থাবলী
বেলায়তের সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন গাউসুস্ সাক্বালাঈন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ৯১ বৎসরের বিশাল কর্মময় জীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও বহু গ্রন্থ পুস্তক রচনার মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতকে সঠিকপথে পরিচালিত করার ব্যাপক প্রয়াস পেয়েছেন।
তাঁর অমূল্য গ্রন্থাবলীর আলোতে ইসলামী জ্ঞানভাণ্ডার আজ উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ। তাঁর রচনাবলী ইসলামী জগতের অমূল্য সম্পদ। নিম্নে তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর কতিপয় নাম তুলে ধরা হলোঃ

১. আল গুনিয়াহ্ লিত্বালিবিল হক্ব
গ্রন্থটি ‘গুনিয়াতুত্ তালিবীন’ নামে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। ইসলামী শরীয়তের সত্যিকার স্বরূপ বিশেষণ ও বাতিল মতবাদসমূহের পরিচিতি ও তাদের ভ্রান্তনীতি এবং আক্বীদার খণ্ডনে এ গ্রন্থ মুসলিম মিল্লাতের জন্য দিশারীর ভূমিকা পালন করে আসছে। সম্প্রতি গ্রন্থটি ইসলামী গবেষক মসলকে আ’লা হযরতের উজ্জ্বল নক্ষত্র আল্লামা শামস্ সিদ্দীকী বেরলভী মুদ্দাযিল্লুহুল আলী (সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ফার্সী বিভাগ, দারুল উলূম মানযারুল ইসলাম, বেরলভী, ভারত) কর্তৃক উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়ে সর্বত্র সমাদৃত হয়েছে। ৭১০ পৃষ্ঠা সম্বলিত এ গ্রন্থ সুন্নিয়তের এক অখণ্ডনীয় দলীল।

২. হিযবু বাশায়েরিল খায়রাত
এ গ্রন্থে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উপর অধিকহারে দরূদ পাঠের বৈধতা, ফযীলত ও বিভিন্ন পদ্ধতির উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
৩. আল্-ইযাওয়াক্বীত ওয়াল হিকাম
৪. আল ফুয়ূযাতুর রব্বানিয়্যাহ্
৫. আল্-মাওয়াহিবুর রহমানিয়্যাহ
হযরত আল্লামা শায়খ তাহের আলাউদ্দিন আল জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উপরোক্ত গ্রন্থাবলী ছাড়াও নিম্নোক্ত রচনাবলীর নাম উল্লেখ করেছেন।
৬. আল্ ফুতূহাতুর রহমানিয়্যাহ্
৭. জালাউল খাতির
৮. সিররুল আসরার- হাজী খলীফা কাশফুয্যুনূন গ্রন্থে উপরোক্ত গ্রন্থাবলীর নাম উল্লেখ করেন।
৯. রদ্দুর রাফাদ্বাহ্- তৎকালীন অন্যতম বাতিল ফিরক্বাহ্ রাফেযী সম্প্রদায়ের ভ্রান্তনীতির খণ্ডনে এ গ্রন্থ রচিত। বাগদাদের ‘মাদরাসা-এ ক্বাদেরিয়া’তে এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি মওজুদ রয়েছে।
১০. দিওয়ানে গাউসুল আজম- গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি রচিত ফার্সী কাব্য। এটা সাহিত্য জগতেও অনন্য সংযোজন। এ গ্রন্থে তাঁর ৮৩ টি কবিতা স্থান পেয়েছে।
১১. ‘ক্বসীদাতুল গাউসিয়া’- আলোড়ন সৃষ্টিকারী আরবী কাব্যগ্রন্থ, এতে তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বিশদ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে।
কসীদাতুল গাউসিয়ার প্রথম পংক্তি নিম্নরূপ-
سَقَانِی الْحُبُّ کَأْسَتِ الْوِصَال -فَقُلْتُ لِخَمْرَتِیْ نَحْوِیْ تَعَال
কাব্যানুবাদ: পাত্র ভরা মিলন সুরা পান করালো প্রেম আমায়,
কহিনু তাই মোর মদিরায় মোর পানে তুই আয়রে আয়।
১২. ‘মারাতিবুল’ ওয়াজূদ-এ গ্রন্থে মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে তথ্যনির্ভর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা স্থান পেয়েছে। উপরন্তু খোদাদ্রোহী নাস্তিক্যবাদীদের ভ্রান্ত ধারণার অসারতা প্রমাণ করা হয়েছে।
১৩. তাফসীরুল কোরআনিল কারীম- মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা সম্বলিত তাঁর নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ। এ মহামূল্যবান তাফসীর গ্রন্থের হস্তলিখিত কপি ত্রিপলীর গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে। ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকায় উল্লেখ রয়েছে যে, এ তাফসীর গ্রন্থ ছয় খণ্ডে লিবিয়ায় ত্রিপলীর জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে।
১৪. ‘রিসালায়ে গাউসে আ’যম’-এ পুস্তিকা বিশিষ্ট সাহিত্যিক সূফী সৈয়দ নাসির উদ্দিন হাশেমী ক্বাদেরী রিযভী বরকাতী, কৃতঃ ‘মাযহারে জামালে মুস্তাফায়ী’ গ্রন্থে উর্দু ভাষায় ভাষান্তর হয়ে ভারত ও পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
১৫. ‘ফুতূহুল গায়ব’-এ গ্রন্থে সূফীতত্ত্ব ও মারিফাতের নিগূঢ় রহস্যাদি এবং মূল্যবান উপদেশ সম্বলিত ৭৮টি ভাষণসহ সর্বমোট ৮০টি ভাষণ স্থান পেয়েছে। শেষ দু’টি অর্থাৎ ৭৯তম ও ৮০তম ভাষণ গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সাহেবযাদা হযরত সৈয়্যদ আবদুল ওয়াহ্হাব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক রচিত, যা পরবর্তীতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
গ্রন্থটি সর্বপ্রথম ১২৮১ হিজরীতে মিশর থেকে প্রকাশিত হয়। ভারতবর্ষে হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় মুর্শেদে কামেলের নির্দেশানুসারে গ্রন্থটি ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করেন। প্রফেসর ড. আফতাব উদ্দীন আহমদ কর্তৃক গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
১৬. আল-ফাতহুর রব্বানী- এটা গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজ নসীহত ও উপদেশাবলীর সংকলন। বিশেষতঃ তিনি অত্যাচারী শাসকবর্গের অন্যায়-অনাচার জুলুম-নির্যাতন ও লৌকিকতা ইত্যাদি অপকর্মকে এতে কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন। বিশাল জনসমাবেশে প্রদত্ত গাউসে পাকের ৬২টি সমাবেশের ৬২টি বৃক্তৃতা ও ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। ৫৪৫ হিজরি সনের শাওয়াল মাস থেকে ৫৪৬ হিজরী সন পর্যন্ত ১ বৎসর ব্যাপী তাঁর প্রদত্ত ৬২টি ভাষণের এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সংকলন গ্রন্থ। ১২০২ হিজরী সনে গ্রন্থটি সর্বপ্রথম মিশর থেকে প্রকাশিত হয়। উর্দু, ফার্সী, ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে গ্রন্থটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।
এ ছাড়া তাঁর আরো গ্রন্থাবলী রয়েছে বলে তাঁর জীবনী লিখকগণ উল্লেখ করেছেন। ভবিষ্যতে তাঁর জীবন-কর্মের ব্যাপক গবেষণায় বহু অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে নিঃসন্দেহে।

গাউসে পাকের ওয়াজ-নসীহত
মানবাত্মার উন্নতি ও পরিশুদ্ধির জন্য উপরন্তু মানবিক গুণাবলীর বিকাশ মানবতাবোধে মুসলিম জাতিকে উজ্জীবিত করার মহান প্রয়াসে বিভ্রান্ত, দিশেহারা, পথভ্রষ্ট, লক্ষ্যচ্যুত ও বিপথগামীদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার নিমিত্তে হুযূর গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নসীহত-হেদায়তকে অন্যতম অবলম্বন মনে করে ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে মানব মণ্ডলীকে ইসলামের পথে, কল্যাণের পথে, শান্তির পথে আহবান জানাতেন। তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণে মানবজাতির চরম উন্নতি সাধিত হয়। তাঁর অনুসৃত কর্মসূচী বাস্তবায়নে সমাজ জীবনে এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সূচিত হয়। রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্টিত কর্তা ব্যক্তিরা তাঁর উপদেশ বাণীর যথার্থ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন করে দেশ ও জাতির প্রভূত কল্যাণ সাধন করেন।
তাঁরই আদর্শের সৈনিক ক্রুসেড বিজয়ী মর্দে মুজাহিদ অকুতোভয় সিপাহসিলার গাযী সালাহ উদ্দীন আয়ূবী, নুরুদ্দীন যঙ্গী প্রমুখ মুসলিম সেনাপতি মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাসের মহা নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর স্বর্ণালী আদর্শের যাঁরা অনুসারী তাঁরা আজ বিশ্বব্যাপী স্মরণীয়-বরণীয়। সর্বত্র তাঁরা আজ নন্দিত।
পক্ষান্তরে তাঁর আদর্শের শত্র“রা আজ ঘৃণিত, নিন্দিত, ইতিহাসে কলঙ্কিত। গাউসে পাকের ওয়াজ নসীহত মুক্তির পাথেয়, মুসলিম জাতির সঠিক দিক নির্দেশিকা ক্বোরআন-সুন্নাহ্, ইজমা’ ও কিয়াসের ভিত্তিতে ঈমান-আক্বীদা, আমল-আখলাক্ব, তাওহীদ, রিসালত, আখেরাত, খিলাফত, ইমামত, বেলায়ত, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বাণিজ্যনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, ধর্মতত্ত্ব, সূফীতত্ত্ব, কালেমা, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, মানবসেবা, সমাজসেবা, পিতা-মাতার আনুগত্য, শরীয়ত-তরীক্বত ইত্যাদি বিষয়ে তিনি তাত্ত্বিক ওয়াজ নসীহত করে মুসলিম মিল্লাতের আমল আখলাক্বকে হিফাজত করতেন।
এভাবে গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করতেন। সাপ্তাহিক অন্ততঃ তিনবার গাউসে পাকের ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হত। তাঁর মাহফিল জনসমুদ্রে রূপলাভ করতো। অনেক দর্শক-শ্রোতা ওয়াজ মাহফিলে ভাবের জগতে আত্মহারা হয়ে যেত। তাঁর মাহফিলের দর্শক-শ্রোতা কেবল মানবজাতি ছিল তা নয়, জ্বিন-ফেরেশতা পর্যন্ত ব্যাপকহারে তাঁর মজলিসে অংশ নিত। সবে মিলে কমপক্ষে এর সংখ্যা ৭০ হাজারে উপনীত হতো। তাঁর মাহফিলে আগত জনতা দূরবর্তী ও নিকটবর্তী সকলে সমানভাবে তাঁর তাক্বরীর শুনতে পেতেন। দূরদূরান্তের অসংখ্য মাশায়েখে হযরাত তাঁর মাহফিলে হাযির হতেন। মাহফিল চলাকালে অসংখ্য কারামত প্রকাশ পেত। তাঁর মাহফিল অনুষ্ঠিত হত বাগদাদের কেন্দ্রস্থলে। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক ওলী-আওতাদ, যথাক্রমে-হযরত শায়খ আবদুর রহমান তফসুনূযী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি শায়খ এবং আদি বিন মুসাফির রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখ নিজ নিজ শহরে একই সময়ে স্বীয় ভক্ত-অনুরক্তদের সাথে নিয়ে বৃত্তাকারে গাউসে পাকের ওয়াজ শ্রবনের জন্য বসে যেতেন। অনেক দূর থেকেও খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতায় তাঁরা গাউসে পাকের ওয়াজ শুনতে পেতেন শুধু তাই নয়, বরং গাউসে পাকের তাক্বরীরসমূহ লিখেও নিতেন। তাঁদের যখন বাগদাদে আসার সুযোগ হত, তখন লিখিত তাক্বরীরগুলো সাথে নিয়ে আসতেন।
গাউসে পাকের মজলিসে উপস্থাপিত তাক্বরীরের সাথে মিলিয়ে দেখলে বিন্দুমাত্র তারতম্য পরিলক্ষিত হতো না।
হযরত সৈয়দ আহমদ কবীর রেফায়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এত উচ্চ মর্যাদার ওলী ছিলেন যে, যাঁর জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম রওযায়ে আক্বদাস থেকে স্বীয় নূরানী হাত মোবারক বের করে দিয়েছিলেন। হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে তিনি সালামের জবাবও শুনেছেন এবং হাত মুবারকে চুম্বনও করেছেন।
তিনিও ছিলেন হুজূর গাউসে পাকের সমসাময়িক মহান আল্লাহর ওলী। হযরত আহমদ কবীর রেফায়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ওলী মর্যাদার শীর্ষে তাঁর অবস্থান, তবুও গাউসে পাকের সমান খ্যাতি অর্জন করেননি।
ইমাম সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, শায়খ আহমদ রেফায়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি রওজায়ে আক্বদাসে উপস্থিত হয়ে প্রিয় রসূলের নূরানী হাত মোবারকে চুম্বন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে তৎক্ষণাৎ রওজায়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে হাত মোবারক বেরিয়ে আসে। তিনি তাতে চুমু খেয়ে সৌভাগ্য অর্জন করেন।
আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ্ আহমদ রেযা খান ব্রেলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি রচিত কবিতার দু’টি চরণ উল্লেখ পূর্বক গাউসে পাকের কৃপাদৃষ্টি কামনা করছি-
গাউসে আ’যম আপ সে ফরয়াদ হ্যায়,
জিন্দা ফের ইয়ে পাক মিল্লাত কিজিয়ে
অর্থ: ওহে গাউসে আ’যম। আপনার দরবারে ফরিয়াদ করছি।
এ পাক মিল্লাত (পবিত্র দ্বীন)-কে পুনরায় জীবিত করে নিন।
আল্লাহ! আমাদের গাউসে পাকের ফুয়ূজাত নসীব করুন, আমীন।

তরীক্বতের প্রয়োজনীয়তা
আরবী ‘তরীক্বুন’ শব্দ থেকে ‘ত্বরীক্বত’ (তরীক্বাহ) শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ পথ বা রাস্তা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতই ইসলামের সঠিক রূপরেখা। আল্লাহর নির্দেশিত, প্রিয় নবীর প্রদর্শিত এবং সাহাবা-ই কেরামের অনুসৃত বিধিমালার যথার্থ অনুসরণের নাম ত্বরীক্বত। আরো পরিস্কাররূপে বলা যায় যে, যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ক্বোরআন-সুন্নাহর আলোকে সৎ পথের নির্দেশ নিয়ে মুক্তিকামী মানুষের পরিত্রাণের জন্য, অন্ধকার থেকে আলোর পথে পৌঁছার যে নিয়ম পদ্ধতির নির্দেশনা দিয়ে গেছেন সেটাই ত্বরীক্বত বা তরীক্বাহ।
তরীক্বতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তরীক্বত অবলম্বনের অপরিহার্যতার প্রমাণে ক্বোরআন সুন্নাহর নির্দেশনাই মূলভিত্তি। নিম্নে এ বিষয়ে ক্বোরআন-হাদীস ভিত্তিক প্রমাণ্য আলোচনা উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
তরীক্বতের মূলনীতি প্রসঙ্গে সূরা ফাতিহা-এ এরশাদ হচ্ছে-
اِهْدِنَا الصِّرَاطِ الْمُسْتَقِیْم صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْمْرَ
অনুবাদ: আমাদের সরল পথে পরিচালিত করুন, তাদের পথে, যাদেরকে আপনি অনুগ্রহ করেছেন।
উপরোক্ত আয়াতের বিশদ বর্ণনায় নিম্নোক্ত আয়াতে চার শ্রেণীর নি’মাত প্রাপ্ত বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে-
وَ مَنْ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ الرَّسُوْلَ فَاُولٰٓىٕكَ مَعَ الَّذِیْنَ اَنْعَمَ اللّٰهُ عَلَیْهِمْ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَ الصِّدِّیْقِیْنَ وَ الشُّهَدَآءِ وَ الصّٰلِحِیْنَۚ-
তরজমা: যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা ওইসব লোকের সাথে থাকবে, যাদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন অর্থাৎ নবীগণ, সত্যনিষ্ঠগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মপরায়ন ব্যক্তিগণ।
আল্লাহর মনোনীত বুযুর্গ বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণের প্রয়োজনীয়তার কথা ক্বোরআনুল করীমের বহু স্থানে বিঘোষিত হয়েছে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ كُوْنُوْا مَعَ الصّٰدِقِیْنَ
তরজমা: হে মু’মিনগণ আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ অবলম্বণ করো।
আল্লাহর নির্দেশিত পথে যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, দ্বীনী খিদমত, সত্য প্রতিষ্ঠা, মানবতার কল্যাণ, ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায়- যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টির সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন তাঁদের অনুসরণে মানব জাতির মুক্তি নিশ্চিত। তাঁদের জীবনাদর্শ মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। একটি শান্তিময় পবিত্র সুন্দর জীবনের অধিকারী হওয়ার জন্য তাঁদের পূণ্যময় জীবন প্রণালী একটি উত্তম আদর্শ। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন এ শ্রেণীর বান্দাদের অনুসরণ প্রসঙ্গে নির্দেশ দিয়েছেন-
وَ اتَّبِـعْ سَبِیْلَ مَنْ اَنَابَ اِلَیَّۚ-
তরজমা: যে ব্যক্তি আমার দিকে রুজু হয়েছে তার পথকে অনুসরণ করো।
আরো এরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ ابْتَغُوْۤا اِلَیْهِ الْوَسِیْلَةَ
তরজমা: হে মু’মিনগণ আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁর দিকে ওসীলা অšে¦ষণ করো।
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রহুল বয়ানে উল্লেখ আছে-
اَلْوُصُوْلُ لاَیَحْصِلُ اِلاَّ بِالْوَسِیْلَۃِ وَهِیَ عُلَمَاءُ الْحَقِیْقَۃِ وَمَشَائِخُ الطَّرِیْقَۃِ
অর্থাৎ ওসীলা ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা যায় না, ওসীলা হচ্ছে হক্কানী ওলামা-ই কেরাম, ত্বরীক্বতপন্থী মাশায়েখ বা কামিল পীর-মুর্শিদগণ। সত্যিকার ত্বরীক্বতপন্থী, দ্বীনের অনুসারী, মুত্তাক্বী-পরহেযগার বান্দারা হচ্ছেন হিদায়তপ্রাপ্ত। তরীক্বতের আদর্শহীন ও শিক্ষাচ্যুত বান্দা গোমরাহ্ ও পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত।
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-
مَنْ یَّهْدِ اللّٰهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِۚ-وَ مَنْ یُّضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهٗ وَلِیًّا مُّرْشِدًا۠
তরজমা: আল্লাহ পাক যাকে হিদায়ত করেন সে হিদায়ত পায় এবং যাকে পথভ্রষ্ট করেন আপনি তার জন্য কোন ওলী (কামিল) মুর্শিদ পাবেন না।
ঈমান-ইসলামের হিফাযতের জন্য সকল মুজতাহিদ ইমামগণ কামিল পীর-মুর্শিদের পদাঙ্ক অনুসরণকে অপরিহার্য মনে করেছেন। হুযূর গাউসুল আ’যম শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ‘সিররুল আসরার’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে-
وَلِذَالِکَ طَلَبُ اَهْلِ التَّلْقِیْنِ لِحَیَاۃِ الْقُلُوْبِ فَرْضٌ
অর্থাৎ অন্তরাত্মাকে যিন্দা করার জন্য আহলে তালক্বীন তথা কামিল মুর্শিদের শরণাপন্ন হওয়া অপরিহার্য।
আলিমকুল শিরোমণি, হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমামূল আইম্মাহ্ হযরত ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-لَوْ لاَ الثِّنْتَانِ لَهَلَکَ نُعْمَانْ
অর্থাৎ আমি আবূ হানীফা যদি আমার পীর মুর্শিদ ইমাম জা’ফর সাদেক্ব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র হাতে বায়‘আত গ্রহণপূর্বক তাঁর সান্নিধ্যে দু’বৎসর না থাকতাম, তবে আমি ধবংস হয়ে যেতাম।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ‘কীমিয়া-ই সা‘আদাত’ গ্রন্থে, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ‘মকতুবাত শরীফে, সৈয়দুল আউলিয়া হযরত ইমাম আহমদ কবীর রেফা‘ঈ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ‘আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ’ গ্রন্থে, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা ফাযেলে বেরলভী ক্বুদ্দিসা সিররুল আযীয প্রণীত ‘নিক্বাউস সালাফাহ্ ফী আহকামিল বায়’আতি ওয়াল খিলাফাহ্’ (১৩১৯) পুস্তকে ইলমে তাসাউফ অর্জন তথা পীর-মুর্শিদের বায়‘আত গ্রহণ করাকে অপরিহার্য বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এমন কোন মুজতাহিদ, ইমাম, মুহাদ্দিস, ফক্বীহ্, মুফতী, মুফাস্সির, জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত, ইসলামী দার্শনিক নেই, যিনি তরীক্বতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। প্রত্যেকে স্ব-স্ব যুগের প্রখ্যাত মাশায়েখ-ই এযামের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। তরীক্বতের দীক্ষা অবলম্বন করেছেন। এক্ষেত্রে বিশ্বখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও তাঁর পীর-মুর্শিদ হযরত শামসুদ্দীন তাবরীযীর ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। মাওলানা রুমী বলেন-مولانا ہرگز نشد مولائے روم – تاغلام شمس تبریزنشد
অর্থাৎ আমি মাওলানা রুম কখনই মাওলানা রুমী হতে পারতাম না
যদি না আমার পীর শামসে তাবরীযের গোলামী করতাম।
এ কারণে যত বড় জ্ঞানী হোক না কেন, শর‘ঈ জ্ঞানের পাশাপাশি তরীক্বত তথা তাসাওফের জ্ঞান না থাকলে গোমরাহ্ তথা পথভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। হযরত ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি এতে বর্ণনা করেন-
مَنْ تَفَقَّہَ وَلَمْ یَتَصَوَّفْ فَقَدْ تَفَسَّقَ وَمَنْ تَصَوَّفَ وَلَمْ یَتَفَقَّہْ فَقَدْ تَزَنْدَقَ وَمَنْ جَمَعَ بَیْنَہُمَا فَقَدْ تَحَقَّقَ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বহ তথা শর‘ঈ জ্ঞান অর্জন করলো এবং ইলমে তাসাওফ তথা তরীক্বতের জ্ঞান অর্জন করলো না সে ফাসিক্ব হলো। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাসাওফ শিক্ষা করলো অথচ ইলমে ফিক্বহ্ শিক্ষা করলো না সে যিন্দিক্ব হলো। আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার ইলম অর্জন করলো, সে প্রকৃত সত্যের সন্ধান লাভ করলো।

আউলিয়া-ই কেরাম তথা পীর-মুর্শিদ প্রয়োজন কেন?
আউলিয়া-ই কেরামের অনুসৃত তরীক্বতের দিশারী পীর-মুর্শিদ কেন প্রয়োজন এ প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো-
১. ধরাধামে প্রত্যেকে একে অপরের মুখাপেক্ষী। কেউ ফয়য গ্রহণকারী কেউ বিতরণকারী। যেমন সূর্য এবং বৃষ্টি হচ্ছে প্রদানকারী, যমীন তথা ভূখণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্র ও ফসল-বাগান হচ্ছে গ্রহণকারী। একইভাবে রুহানী জগতের সম্মানিত নবীগণ এবং তাঁদের মাধ্যমে সকল ওলী, গাউস, ক্বুুত্ব্ব, আবদাল, ওলামা-মাশায়েখ ফয়য প্রদানকারী, সমগ্র পৃথিবীবাসী তাঁদের মুখাপেক্ষী ও ফয়য গ্রহণকারী।
২. যেমনিভাবে পৃথিবীর জন্য সূর্য ও বৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, একইভাবে জগতবাসীর জন্য শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের দিশারী তথা আলিম ও ওলীগণের অপরিহার্যতা অনিবার্য।
৩. আম্বিয়া-ই কেরাম যাহের-বাতেনকে পরিশুদ্ধ করার জন্য তাশরীফ এনেছেন। তাঁদের তিরোধানের পর আলিম ও ওলীগণের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয়। বাহ্যিক সংশোধনের দায়িত্ব আলিমগণের উপর। বাতেনী পরিশুদ্ধির দায়িত্ব ওলীগণের উপর অর্পিত।
নামাযের জন্য শরীর পাক, কাপড় পাক ও নামাযের জায়গা পাক, সতর ঢাকা, কেবলামুখী হওয়া ইত্যাদি এবং সূরা ক্বিরআত শিক্ষা দেয়া আলিমগণের দায়িত্ব আর নামাযের মধ্যে হুযূরী ক্বলব তথা ইখলাস-আন্তরিকতা তথা আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা ও ধ্যানমগ্নতা ওলীগণের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। মূলতঃ ওলামায়ে কেরাম নামায আদায় করার শর্ত পূর্ণ করে দেন, আর আউলিয়ায়ে কেরাম নামায ক্ববূল হওয়ার শর্তাদি পূর্ণ করে দেন।
৪. তরীক্বত চর্চা ও অনুশীলন তথা ওলীগণের সোহবত অর্জন বড় উপকারী।
কা’বা শরীফের যিয়ারতকারী সাহাবী নয়, কিন্তু ঈমানের সাথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একনজর দর্শনকারী সাহাবী। প্রমাণিত হলো আমলের চেয়ে সোহবত অধিকতর প্রভাব বিস্তারকারী। মাওলানা রুমী বলেন- এক যামানা সোহবতে বা আউলিয়া -বেহতর আয সদ সা-লাহ্ তা‘আত বে-রিয়া। অর্থাৎ শত বৎসরের বে-রিয়া (খাঁটি) ইবাদতের চেয়ে ওলীগণের সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ বসা অনেক উত্তম।
৫. শারীরিক ব্যাধির জন্য যেভাবে চিকিৎসক রয়েছেন, অনুরূপ অন্তরের ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের জন্য ঈমানী ডাক্তার রয়েছেন। তরীক্বতের দীক্ষায় পীর-মুর্শিদের সোহবতে অন্তরাত্মা আলোকিত হয় এবং গোমরাহী মুক্ত হয়। পীর-মুর্শিদের প্রদত্ত সবক চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মার উন্নতি সাধিত হয়, কলুষিত অন্তর আলোকিত হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
اِنَّ الْمُؤْمِنَ اِذَا اَذْنَبَ کاَنَتْ نَقَطَةُ سَوْدَآءُ فِیْ قَلْبِہ فَاِذَا تَابَ وَاسْتَغْفَرَ صَقَلَ قَلْبَہٗ
অর্থাৎ মু’মিন বান্দা যখন পাপ করে ফেলে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যখন সে তাওবা করে ও ক্ষমা চায় তখন সে ময়লা দূরীভূত হয়ে অন্তর পরিস্কার হয়ে যায়।
৬. জীবন চলার পথে দুনিয়ার যমীনে মুসাফিরের জন্য যেমন একজন পথ প্রদর্শকের প্রয়োজন, তদ্রƒপ পরকালের সফরের কামিয়াবী বা সফলতার জন্য একজন রাহনুমায়ে শরীয়ত ও রাহবরে তরীক্বত, হক্বক্বানী পীর-মুর্শিদ প্রয়োজন।
৭. ঈমান ও আমল অমূল্য সম্পদ। শয়তান মানুষের চিরশত্র“, মৃত্যুকালে ঈমান ছিনতাইকারী ডাকাত। সত্যিকার আউলিয়ায়ে কেরাম তথা পীর-মুর্শিদ হচ্ছেন বিপদের মুহূর্তে ঈমানের হিফাযতকারী।
৮. নাফ্স হচ্ছে কুকুর। যে কুকুরের গলায় বেল্ট থাকে না সে কুকুর মানুষের জন্য নিরাপদ নয়, ভয়ঙ্কর। সুতরাং নাফসের গলায় হক্কানী পীর-মুর্শিদের সিলসিলার বেল্ট বেঁধে দাও। নাফসের গলায় বেল্ট বাঁধা থাকলে এবং বেল্টের কড়া শায়খের মাধ্যমে প্রিয়নবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূরানী হাতে থাকলে ওই নাফ্স কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।
৯. তরীক্বতের সম্পর্ক নাজাতের ওসীলা, তরীক্বতের সিলসিলা হচ্ছে রেল লাইনের উপর বগির মত। বিভিন্ন শ্রেণীর বগি রয়েছে। বগির অবস্থা যত নিম্নমানের হোক না কেন, সম্পর্ক যদি ইঞ্জিনের সাথে থাকে, তবে তা যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। তদ্রƒপ সিলসিলা-পরস্পরার সম্পর্ক যদি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পীর-মুর্শিদের মাধ্যমে অক্ষুন্ন ও অবিচ্ছেদ্য থাকে, তাহলে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছা সম্ভব হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে বা‘য়আতের গুরুত্ব
আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারে যুগে যুগে এ পৃথিবীতে অসংখ্য সম্মানিত নবী-রাসূল আলাইহিমুস্ সালাম শুভাগমন করেছেন। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম আদর্শ ইমামুল আম্বিয়া সৈয়্যদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শুভ আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে নবী ও রাসূল আগমনের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে। মহান রাব্বুল আলামীন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ঘোষণা করেছেন। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পর ইসলাম প্রচারের এ শুরু দায়িত্ব অর্পিত হয় সাহাবা-ই কেরাম, তাবে‘ঈন, তব‘ই তাবে‘ঈন, বুযুর্গানে দ্বীন, আউলিয়া-ই কামেলীন এবং হক্কানী আলিম-ওলামা, মাশাইখ-ই ইযামের উপর। তাঁদের রূহানী প্রভাব, ব্যবহারিক আদর্শ, উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী ও ইসলামী আদর্শের মডেলে উত্তম কর্মপদ্ধতির যথার্থ বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী ইসলাম আজ প্রতিষ্ঠিত। এরপর ক্রমশঃ মহান আউলিয়া-ই কেরামের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অকৃত্রিম ক্বোরবানীর বিনিময়ে মুসলমানদের অন্তরাত্মা ঈমানী চেতনা ও ইসলামী ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়েছিলো।
পরবর্তীতে তাঁদের স্বর্ণালী যে ইতিহাস গৌরবময় হয়েছিলো তা চরমভাবে উপেক্ষিত হতে থাকে।
ইসলামী দর্শনে স্বীকৃত সূফীতত্ত্ব তথা আধ্যাত্মিকতা নিয়েও ক্রমশঃ বিতর্কের সৃষ্টি হতে থাকে। অথচ ইসলামী বিশ্ব তথা ইরাক, ইরান, আরব, সিরিয়া, মিশর, স্পেন, তুর্কীস্তান, মধ্য এশিয়া ও পাক-বাংলা-ভারত তথা সমগ্র বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসারে সম্মানিত সূফীগণের ভূমিকা ও অবদান ইতিহাসে এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়; অথচ দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে, আজ এক শ্রেণীর কপট সূফী ও তাদের উপর ভিত্তি করে ভ্রান্ত মতবাদীদের অপপ্রচারে তাঁদের ভূমিকা ও অবদান ম্লান হতে চলেছে। এ জন্য আমাদের কর্মতৎপরতাও কম দায়ী নয়। আজ সুন্নী নামধারী কপট অসাধু ভণ্ড সূফীদের অশুভ পদচারণা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বাতিল পন্থীরা, সত্যিকার সূফী-দরবেশ পীর-মাশায়েখ, ওলী-বুযুর্গদের বিরুদ্ধে বিষেদগার করার সুযোগ গ্রহণ করছে। হাজারো পীর-মাশায়েখ আউলিয়ায়ে কেরামের আদর্শ ও চেতনা বিরোধী বাতিল অপশক্তিরা আজ প্রতিনিয়ত তাদের ভ্রান্তনীতি ও ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠায় তৎপর। প্রকৃতপক্ষে যারা ইসলামের সুফীতত্ত্ব ও আধ্যত্মিকতাকে স্বীকার করে না, ইসলামে পীর-মুরিদী ও বায়’আতের গুরুত্ব যারা উপলব্ধি করে না, তারাও কিন্তু বর্তমানে সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা বিনষ্ট করার সুদূর প্রসারী চক্রান্তে মেতে উঠেছে। পক্ষান্তরে, আরেক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী ভণ্ড পীর-মুরিদীর রমরমা ব্যবসা অব্যাহত রেখে সত্যিকার পীর-মুরীদি ও বায়‘আতের তাৎপর্য ও গুরুত্বের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। তাই সত্যিকার অর্থে ইসলামের দৃষ্টিতে ত্বরীক্বত ও বা‘আয়তের গুরুত্ব সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা হলো-
বায়’আত কি? কোন্ বিষয়ের নাম বায়‘আত, বায়‘আত কেন করা হয়? বায়আতের উপকারিতা কি? শরীয়তে বায়’আতের ভিত্তি কতটুকু? বায়‘আত কি কোরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত? বায়’আত কখন থেকে প্রচলিত? এখন দেখুন এগুলোর জবাব!

বায়’আতের সংজ্ঞা
বায়’আত-এর সংজ্ঞা বর্ণনায় সৈয়্যদুল আউলিয়া হযরত মীর সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ বিলগেরামী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, বায়’আত হচ্ছে মুরীদ পীরের হাতে হাত রেখে দৃঢ় অঙ্গীকারের নাম। পীর-মুর্শিদ স্বীয় হাত মুরীদের হাতের উপর রাখবেন এবং কলেমা পাঠ, এস্তেগফার ও তওবা করাবেন
মুরীদ থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার নেবেন-
وَ مَاۤ اٰتٰىكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُۗ-وَ مَا نَهٰىكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْاۚ-
অর্থাৎ: রসূল যা তোমাদের দিয়েছেন তা গ্রহণ করো, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।
উল্লেখ্য, আমাদের মুর্শিদে বরহক্ব শাহানশাহে সিরিকোটও বায়‘আত গ্রহনের সময় বায়‘আত গ্রহণকারীদের সংখ্যা কম হলে হাতে হাত রেখে, অন্যথায় রুমালের মাধ্যমে সকলের হাত নিজের বরকতময় হাতে নিয়ে যা বলে অঙ্গীকার নেন তাও এ অভিমতটির একেবারে অনুরূপ। যেমন- তখন বলা হয় ‘‘ইয়া আল্লাহ! হাম তাওবা করতে হ্যাঁয় তামাম গুনাহোঁ সে, ছোটে বড়ে, জেতনে গুনাহ্ হামনে কিয়ে হ্যাঁয় সব সে তাওবা করতে হ্যাঁয়। আয়েন্দাহ্ কে লিয়ে উয়হ্ কাম করেঙ্গে, জিস সে আল্লাহ ও রাসূল রাযী হোঁ, আওর উয়হ্ কাম নেহী করেঙ্গে জিস সে আল্লাহ্ রসূল না-রায হোঁ।’’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তওবা করছি সমস্ত গুনাহ্ থেকে ছোট বড় যত গুনাহ্ আমি করেছি সব গুনাহ্ থেকে তাওবা করছি। আগামীতে ওই কাজ করবো, যাতে আল্লাহ-রাসূল রাজী হন, ওই কাজ করবো না, যাতে আল্লাহ-রাসুল নারাজ হন।’’

মাওলানা রুমীর দৃষ্টিতে বায়’আতের হাক্বীক্বত
বায়’আতের হাক্বীক্বত ব্যাখ্যায় মাওলানা রুমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
مریدی چیست توبہ از گناہاں -شدن تقصیر ہاراعذرخواہاں
مریدی عقدتوبہ بستن آمد -زاخلاق ذمیمہ رستن آمد
چوں دین بے توبہ در نقصان وشین ست- مریدی عین نص وفرض عین ست
অর্থাৎ ১. মুরিদী কি? নিজ গুনাহ্সমূহ থেকে তওবা করা। নিজের ত্র“টি-বিচ্যুতি, ভুলভ্রান্তিতে অনুতপ্ত ও অনুশোচনা (তাওবা) করা।
২. মুরিদী হচ্ছে তওবা করা ও মন্দ কথা থেকে নিষ্কৃতি লাভের অঙ্গীকার।
৩. যেহেতু তওবা ছাড়া দ্বীন ত্র“টিযুক্ত ও কলুষিত থাকে, সেহেতু মুরীদ হওয়া ক্বোরআন-সুন্নাহ্ সম্মত, প্রত্যেকের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
এ বায়‘আতকে যারা অস্বীকার করে তাদেরও পীর রয়েছে। বিশুদ্ধ সুন্নী আক্বিদাপন্থী পীর অনুসরণ না করলেও তাদের একজন পীর আছে তার নাম শয়তান। مَنْ لَیْسَ لَه شَیْخٌ فَشَیْخَہ شَیْطَانٌ (যার কোন পীর নেই তার পীর হলো শয়তান)

বায়’আত ঈমান হেফাযতকারী
ঈমান এক অমূল্য সম্পদ, পাথির্ব জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। ঈমানের চেয়ে মূল্যবান কোন বস্তু নেই। এমন মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কি নেই? কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি তার সম্পদের সংরক্ষণ না করে কি থাকতে পারেন? অবশ্যই না। সুন্নী মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে বড় দৌলত হচ্ছে ঈমান, যা পৃথিবীর কোন কিছুর বিনিময়ে বিক্রয় করা যায় না। ওলী-ই কামেল, পীর-মুর্শিদের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে সুন্নী মুসলমানগণ নিজেদের মূল্যবান ঈমান-আক্বিদার হেফাযত করেন, যেন ঈমান হরণকারী কোন বাতিলপন্থী ও নবীর কোন শত্র“ তার ঈমান ছিনিয়ে নিতে না পারে। মুরীদ হওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে মাওলানা রুমী আরো বলেন-
مریدی ہر گناہے راپناہ ست -سراپائوجود ماگناہ ست
مریدی شد حصاردین -وایماں خورد مردمسلمان
অর্থাৎ ১. আমাদের আপাদমস্তকে গুনাহ্ বিদ্যমান। মুরীদ হওয়া সকল গুনাহ্ থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থল।
২. মুরিদী হচ্ছে দ্বীন ঈমান হিফাযতের বেষ্টনী। প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে নিজ ঈমানের চিন্তা থাকা বাঞ্ছনীয়।

আল ক্বোরআনের আলোকে বায়‘আত
কুরআন করীমের আয়াতে করীমাহ্ বায়’আত শরীয়ত সম্মত হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। নিম্নে কয়েকটি আয়াত উল্লেখপূর্বক এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হচ্ছেঃ
এরশাদ হচ্ছে-
اِنَّ الَّذِیْنَ یُبَایِعُوْنَكَ اِنَّمَا یُبَایِعُوْنَ اللّٰهَؕ-یَدُ اللّٰهِ فَوْقَ اَیْدِیْهِمْۚ-فَمَنْ نَّكَثَ فَاِنَّمَا یَنْكُثُ عَلٰى نَفْسِهٖۚ-وَ مَنْ اَوْفٰى بِمَا عٰهَدَ عَلَیْهُ اللّٰهَ فَسَیُؤْتِیْهِ اَجْرًا عَظِیْمًا
তরজমা: ওই সব লোক, যারা আপনার নিকট বায়’আত গ্রহণ করছে, তারা তো আল্লাহরই নিকট বায়আত গ্রহণ করছে। তাদের হাতগুলোর উপর ‘আল্লাহর হাত’ রয়েছে। সুতরাং যে কেউ অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, সে নিজেরই অনিষ্টার্থে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আর যে কেউ পূরণ করেছে ওই অঙ্গীকারকে, যা সে আল্লাহর সাথে করেছিলো, তবে অতিসত্ত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।
২. কোরআন মজীদে আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে অন্য আয়াতে এরশাদ করেন-
لَقَدْ رَضِیَ اللّٰهُ عَنِ الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ یُبَایِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِیْ قُلُوْبِهِمْ فَاَنْزَلَ السَّكِیْنَةَ عَلَیْهِمْ وَ اَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِیْبًا
তরজমা: নিশ্চয় আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন ঈমানদারের প্রতি যখন তারা এ বৃক্ষের নীচে আপনার নিকট বায়’আত গ্রহণ করেছিলো। সুতরাং আল্লাহ জেনেছেন যা তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে, অতঃপর তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ করেছেন এবং তাদেরকে শীঘ্র আগমনকারী বিজয়ের পুরস্কার দিয়েছেন।
ক্বোরআন মজীদের আর এক আয়াতে বায়আত প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেনঃ
یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ اِذَا جَآءَكَ الْمُؤْمِنٰتُ یُبَایِعْنَكَ عَلٰۤى اَنْ لَّا یُشْرِكْنَ بِاللّٰهِ شَیْــٴًـا وَّ لَا یَسْرِقْنَ وَ لَا یَزْنِیْنَ وَ لَا یَقْتُلْنَ اَوْلَادَهُنَّ وَ لَا یَاْتِیْنَ بِبُهْتَانٍ یَّفْتَرِیْنَهٗ بَیْنَ اَیْدِیْهِنَّ وَ اَرْجُلِهِنَّ وَ لَا یَعْصِیْنَكَ فِیْ مَعْرُوْفٍ فَبَایِعْهُنَّ وَ اسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللّٰهَؕ- اِنَّ اللّٰهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ
তরজমা: হে নবী! যখন আপনার সম্মুখে মুসলমান নারীরা হাযির হয় আপনার নিকট বায়’আত গ্রহণের জন্য এ মর্মে যে, তাঁরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক স্থির করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, আপন সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, না তারা অপবাদ আনবে, যাকে আপন হাত ও পা গুলোর মধ্যখানে অর্থাৎ জন্মের স্থানে (রচনা করে) রটায়, এবং কোন সৎকাজে আপনার নির্দেশ অমান্য করবে না, তখন তাদের নিকট থেকে বায়‘আত গ্রহণ করুন এবং আল্লাহর নিকট তাদের ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।
ক্বোরআনুল করীমের উপরোল্লেখিত আয়াতগুলো দ্বারা বায়’আতের বৈধতা সুস্পষ্টরূপে ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো।

হাদীস শরীফের আলোকে বায়’আত
সিহাহ সিত্তাহ্ (ছয়টি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ)’র বরাতে বহু বর্ণনাকারী সাহাবা-ই কেরাম কর্তৃক প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নুরানী হাতে বায়’আত গ্রহণ করেছেন মর্মে সুস্পষ্টরূপে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্নে এতদসংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করা হলো-
وَعَنْ عُبَادَۃَ بْنِ الصَّامِتِ رَضِیَ اللهُ تَعَالٰی عَنْہُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّی اللهُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ وَحَوْلَہٗ عِصَابَۃٌ مِّنْ اَصْحَابِہ بَایَعُوْنِیْ عَلٰی اَنْ لَّا تُشْرِکُوْا بِااللهِ شَیْئًا وَّلاَ تَسْرِقُوْا وَلَاتَزْنُوْا وَلَا تَقْتُلُوْا اَوْلاَدَکُمْ وَلاَ تَأْتُوْا بِبُہْتَانٍ تَفَتْرُوْنَہٗ بَیْنَ اَیْدِیْکُمْ وَاَرْجُلِکُمْ وَلَا تَعْصُوْافِیْ مَعْرُوْفٍ فَمَنْ وَفّٰی مِنْکُمْ فَاجْرُہٗ عَلٰی الله وَمَنْ اَصَابَ مِنْ ذَالِکَ شَیْئًا فَعُوْقِبَ بِہ فِی الدُّنْیَا فَہُوَ کَفَّارَۃٌ لَہٗ وَمَنْ اَصَابَ مِنْ ذَالِکَ شَیْئًا ثُمَّ سَتَرَہُ اللهُ عَلَیْہِ فَہُوَ اِلَی اللهِ اِنْ شَاءَ عَفَاعَنْہُ وَاِنْ شَاءَ عَاقَبَہٗ فَبَایَعْنَاہُ عَلی ذَالِکَ [متفق علیہ[
অর্থাৎ হযরত ওবাদাহ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন সাহাবা-ই কেরামের একটি দল রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে বসেছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি তাঁদেরকে বললেন, আমার হাতে এ মর্মে বায়আত গ্রহণ করো যে, তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা বা ব্যভিচার করবে না, তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, কারো প্রতি ঐ মিথ্যা অপবাদ দেবে না, যা তোমরা তোমাদের হাত ও পা গুলোর মধ্যখানে অর্থাৎ জন্মের স্থানে রটাও, কোন পুণ্যের কাজে অবাধ্য হবে না। যে ব্যক্তি এসব অঙ্গীকার পূর্ণ করবে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কার রয়েছে। আর যে ব্যক্তি এসব অপরাধের কোন একটিতে লিপ্ত হবে এবং সেজন্য পৃথিবীতে তার শাস্তিও হবে, তখন তা হবে ওই অপরাধের কাফ্ফারা স্বরূপ। আর যে ব্যক্তি এসব অপরাধের কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো, অথচ আল্লাহ তা‘আলা তা গোপন করে রেখেছেন, (যে কারণে, সেটার শাস্তি হতে পারে নি) তখন তা হবে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তিনি ইচ্ছা করলে সেটা ক্ষমা করবেন, ইচ্ছা করলে অপরাধীকে শাস্তিও দিতে পারে। ওবাদাহ্ ইবনে সামেত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, অতঃপর আমরা এসব কথার উপর তাঁর হাতে বায়’আত করলাম।
عَنْ جَرِیْرٍ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ بَایَعْتُ النَّبِیَ صَلَّی اللهُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ اِقَامَ الصَّلَوۃٍ وَاِیْتَاءَ الزَّکٰوۃِ وَالنُّصْحِ لِکُلِّ مُسْلِمٍ
অর্থাৎ হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নামায আদায় করার, যাকাত প্রদানের এবং প্রত্যেক মুসলমানকে নসীহত করার বায়’আত গ্রহণ করেছি।
হযরত ওবাদা ইবনে সামিত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে এরশাদ হয়েছে-
بَایَعْنَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّی اللهُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ عَلَی السَّمْعِ وَالطَّاعَۃِ فِی الْعُسْرِ وَالْیُسْرِ وَالْمِنْشَطِ وَالْمُکْرَہِ وَعَلٰی اِثْرَہٗ عَلَیْنَا وَعَلٰی اَنْ لَا نُنَازِعَ الْاَمْرَ اَهْلَہٗ وَعَلٰی اَنْ نَقُوْلَ بِالْحَقِّ اَیْنَمَا کُنَّا لَا نَخَافُ فِی اللهِ لَوْمَۃَ لَائِمٍ
অর্থাৎ আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ মর্মে বায়’আত গ্রহণ করেছি যে, আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, পছন্দ-অপছন্দ তথা সর্বাবস্থায় তাঁর কথা শুনবো ও আনুগত্য করবো। আনুগত্যের শপথের সময় আমরা আমাদের নিজেদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয়া এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে কখনো বিবাদে লিপ্ত না হওয়ার উপরও অঙ্গীকার করেছি। আর তখন আমরা এ মর্মেও অঙ্গিকার করেছি যে, যেখানেই থাকি সদা সত্য কথা বলবো। এ ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবো না।
বোখারী শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে যে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ بَایَعْنَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّی اللهُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ عَلَی السَّمْعِ وَالطَّاعَۃِ
অর্থাৎ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ মর্মে বায়’আত গ্রহণ করেছি যে, আমরা তাঁর কথা শুনবো ও আনুগত্য করবো।
সুতরাং কামিল শাইখ/পীরের নিকট বায়‘আত গ্রহণ করা ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সুন্নাত।

বায়’আত অস্বীকারকারীর বিধান
যে বায়’আতকে অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক ধারণা করবে এবং তা অস্বীকার করবে সে পথভ্রষ্ট ও বে-দ্বীন। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, যে অস্বীকারবশতঃ বায়’আত বর্জন করলো, সে নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট ও শয়তানের মুরীদ হলো।

বায়’আতের শর্তাবলী
ইসলামী শরীয়তে বায়‘আতের ক্ষেত্রে চারটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। ওই চারটি শর্তের মধ্যে একটিও কম হলে ওই ব্যক্তি পীর হবার ও বায়‘আত গ্রহণের যোগ্য নয়। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন-
১. আলেমে দ্বীন হওয়া, কমপক্ষে এতটুকু ইলম থাকা আবশ্যক যেন নিজ যোগ্যতায় কিতাবাদি হতে অত্যাবশ্যকীয় মাসআলাসমূহ বের করতে সক্ষম হন। আক্বায়েদে আহলে সুন্নাত সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবগত হওয়া। ইসলাম, কুফর, হিদায়ত ও গোমরাহী সম্পর্কে পার্থক্য নির্ণয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া।
২. বিশুদ্ধ সুন্নী আক্বিদার অনুসারী হওয়া, বাতিল মতাদর্শী কোন অবস্থাতেই পীর হওয়ার উপযুক্ত নয়। যেমন ওহাবী, দেওবন্দী, ক্বাদিয়ানী, রাফেযী, খারেজী প্রমুখ। ভ্রান্ত মতবাদীদের হাতে বায়‘আত নেয়া হারাম।
৩. সুন্নাতের অনুসারী ও শরীয়তের পাবন্দ হওয়া। কবীরা গুনাহ্ হতে বেঁচে থাকা আবশ্যক। সগীরা গুনাহ্ যেন বারংবার না হয়। দাড়ি মুণ্ডানো ব্যক্তি, নামায, রোযা ও শরীয়তের বিধান পরিত্যাগকারী, প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি কোনোভাবেই পীর হবার যোগ্য বা উপযুক্ত নয়। (শরীয়ত বিরোধী আমলকারী ব্যক্তি পীর হবার যোগ্য নয়।) তাদের হাতে বায়’আত হওয়া সম্পূর্ণরূপে না-জায়েয ও ক্ষতিকর।
৪. পীরের সিলসিলা ধারাবাহিকভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সম্পৃক্ত থাকা, কোথাও যেন ছিন্ন না হয়।
উপরোক্ত শর্তাবলীর আলোকে তরীক্বতের হক্কানী সুন্নী পীরের নিকট বায়’আত গ্রহণ সুন্নাত ও ইবাদত। শর্তাবলীর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিবেচনায় না এনে ত্বরীক্বতের নামে পীর-মুরিদী প্রথার অপব্যবহার শরীয়তের বিধান লংঘনের শামিল, যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
মুসলিম মিল্লাতকে এ জাতীয় ভণ্ড প্রতারক চক্রের দূরভিসন্ধি থেকে অমূল্য সম্পদ ঈমান-ইসলামের হেফাযত করাও ঈমানী দায়িত্ব। পক্ষান্তরে, সত্যিকার হক্বক্বানী পীরানে তরীক্বতের সান্নিধ্যে সিলসিলাভুক্ত হয়ে ঈমান-আক্বিদার হেফাযতের গুরুত্ব অনুধাবন করা বর্তমান সময়ে অপরিহার্য। আল্লাহ পাক প্রত্যেককে সহীহ মুর্শিদের মাধ্যমে আউলিয়ায়ে কেরামের রূহানী ফুয়ূযাত লাভের তাওফীক্ব নসীব করুন। আ-মী-ন।
অবশ্য, শাহ্ ওলী উল্লাহ্ ছাহেব তার ‘আল-ক্বাওলুল জামীল’-এ পীরের জন্য আরো কিছু শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। ওই শর্তগুলোর মূল বক্তব্য উপরোক্ত চারটি শর্তের মধ্যে এসে গেছে। আলহামদু লিল্লাহ্! আমাদের সিলসিলা-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার মুর্শিদে বরহক্বের মধ্যে এ শর্তগুলো পুরোপুরিভাবে রয়েছে। যেমন ত্বরীক্বাহ্-ই আলিয়া সিরিকোটিয়ার প্রত্যেক মুর্শিদে বরহক দক্ষ আলিম, ইলমে দ্বীনের পৃষ্ঠপোষক, সুন্নী আক্বীদার ক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ, আমলের দিক দিয়ে শরীয়তের পূর্ণ পাবন্দ এবং সিলসিলাহ্ খাঁটি সুন্নী মাশাঈখের মাধ্যমে হুযূর গাউসে পাক হয়ে ধারাবাহিকভাবে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এ কারণে, ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাযী সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হিও শাহানশাহে সিরিকোটের হাতে বায়‘আত গ্রহণের জন্য মুসলিম সমাজকে উৎসাহিত করতেন। সুতরাং উপমহাদেশের ওলামা-মাশাইখের মতে বরেণ্য এ মুর্শিদে বরহক্বের হাতে বায়আত হয়ে কাদেরিয়া সিলসিলাহ্ ভুক্ত হওয়া বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তাওফীক্ব দিন! আ-মী-ন!!

গাউসে বাগদাদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি -এর
প্রতি আ’লা হযরতের ভক্তিমূলক কাব্য
যাঁদের চরণধূলিতে জগত ধন্য হয়েছে, মুক্তিকামী মানুষ অরাজকতার অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে, যাদের ত্যাগ শ্রম ও সাধনার বদৌলতে ইসলামী আদর্শ বিশ্বব্যাপী আজো অবিকৃত ও অক্ষত রয়েছে। অলীকুল সম্রাট গাউসিয়াতের রাজাধিরাজ গাউসে বাগদাদ হযরত আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁদের অন্যতম। যুগে যুগে অনেক জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত লেখক গবেষক ও কবি সাহিত্যিক তাঁর সুমহান শান মান মর্যাদা ও খোদা প্রদত্ত অসাধারণ গুণাবলীর স্তুতি গান গেয়ে কত কবিতা ও সাহিত্য রচনা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তবে চতুর্দশ শতাব্দীর মহান মুজাদ্দিদ, কলম সম্রাট, সহস্রাধিক গ্রন্থ রচয়িতা, ইমামে আহলে সুন্নাত, আ’লা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা খান বেরলভী গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র শানে নিবেদিত কাব্য রচনায় যে সশ্রদ্ধ ভালবাসা, ভক্তি ও প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়। আ’লা হযরতের রচনাবলী ইসলামী জ্ঞান ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ, তাওহীদ, রিসালত, নুবুয়্যত, খিলাফত, ইমামত, বিলায়ত, শরীয়ত, তরীক্বত, হাক্বীক্বত, মা’রিফত, ক্বোরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিক্বহ্, উসূল, বালাগাত, মান্তিক, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তাঁর বিস্ময়কর অবদান। তাঁর বিষয় বৈচিত্রও অনন্য। আ’লা হযরত রচনা করেন কাব্য সাহিত্যের অপূর্ব গ্রন্থ ‘‘হাদায়েক্বে বখশীশ’’ (রচনাকাল ১৩২৫ হিজরি)। তিনি এ কাব্যগ্রন্থে সরকারে দো‘আলম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শানমান মর্যাদা, নবী রাসূল, আহলে বায়ত, সাহাবায়ে কেরামের শানে হৃদয়গ্রাহী কবিতা রচনার পাশাপাশি গাউসে বাগদাদের শানে রচনা করেন অসংখ্য কবিতা১ আরবীতে কবিতার চরণ বা পংক্তিকে মিসরা’ বলা হয়। দু’টি মিসরা’ নিয়ে গঠিত হয় একটি বয়াত বা শ্লোক, ‘হাদায়েক্বে বখশীশ’ ১ম খণ্ডে গাউসে পাকের শানে রয়েছে চারটি অধ্যায়, ১ম অধ্যায়ে রয়েছে ২৫ শ্লোক বিশিষ্ট একটি সুদীর্ঘ কবিতা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে ২৫ শ্লোক বিশিষ্ট মর্মস্পর্শী কবিতা। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে অপর ২৫টি শ্লোক, চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে ৬০ শ্লোক বিশিষ্ট একটি চমৎকার কবিতা। প্রতিটি পংক্তির ছত্রে ছত্রে গাউসে পাকের প্রতি আ’লা হযরতের ভক্তি অনুরাগ প্রতিফলিত হয়েছে। গাউসে পাকের প্রতি ইমাম আহমদ রেযার গভীর মমতা ও অকৃত্রিম আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ক্বসীদাগুলো আজ দেশ-বিদেশের সর্বত্র সমাদৃত। ওলামায়ে কেরামের তাক্বরীরের শোভাবর্ধক এ কবিতাগুলো সুধী মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সুললিত কণ্ঠে উচ্চারিত কবিতাগুলো দর্শক শ্রোতাদের অন্তরাত্মায় ঈমানী চেতনা সঞ্চার করে। ওলী প্রেমিক আশেক্বীন শ্র“তিমধুর কবিতা শ্রবণে অনেক সময় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। মহান আউলিয়ায়ে কেরামের রূহানী ফুয়ূজাত লাভে ধন্য হয়ে পরিতৃপ্ত হন। নিম্নে গাউসে বাগদাদের শানে আ’লা হযরত রচিত কতিপয় কবিতার আলোকে গাউসে পাকের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকপাত করার প্রত্যয়ে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

মর্যাদার শীর্ষে গাউসে পাক
وہ کیا مرتبه اے غوث ہے بالاتیرا – او نچے اونچوں کے سروں سے قدم اعلٰی تیرا
ওয়হ্ কেয়া মরতবা আয় গাউস হ্যায় বালা তেরা
উঁচে উঁচূ কী সরো সে ক্বদমে আ’লা তেরা।
অর্থাৎ হে গাউসুল আ’যম! আপনার মর্যাদা কতই সুউচ্চ! মহান শিরধারীদের চেয়েও আপনার মোবারক পদযুগল বহু উর্ধ্বে উন্নীত। বেলায়তের সুউচ্চ আসনে আপনি অধিষ্ঠিত, অসংখ্য ওলী গাউস ক্বুত্বব এবং আবদালের চেয়েও আপনার অবস্থান বহুগুণে উন্নীত কারণ প্রত্যেক সম্মানিত ওলী আপনার রূহানী ফয়য লাভে ধন্য।

গাউসে পাকের বংশধারা
গাউসে পাকের পিতা হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধর আর আম্মাজান হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধর ছিলেন। পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয় দিক দিয়ে তিনি সায়্যিদ তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বংশধর ছিলেন। আ’লা হযরত বলেন-
توحسینی حسنی کیوں نہ محی الدین ہو- اے خضر مجمع بحرین ہے چشمہ تیرا
তু হুসাইনী হাসানী কেঁউ নাহ্ মহিউদ্দীন হো
আয় খিদ্ব্রে মাজমায়ে বাহরাইনে হ্যায় চশমা তেরা।
অর্থাৎ ওহে গাউসুল আ’যম! আপনি তো হোসাঈনী ও হাসানী, আপনি মহিউদ্দীন দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী কেন হবেন না, যেহেতু আপনার বেলায়তের ঝর্ণাধারা দু’ সমুদ্রের মোহনায়। আপনার কারণেই ইসলামের বাগান আজ সতেজ ও আলোকিত।
গাউসে পাককে ‘নাজীবুত ত্বরফাঈন’ বলা হয়। গাউসে পাক খোদা প্রদত্ত শক্তিতে শক্তিমান। আ’লা হযরত বলেন-
کیوں نہ قاسم ہو کہ تو ابن ابی القاسم ہے-کیوں نہ قادر ہو کہ مختار ہے بابا تیرا
কেঁউ নাহ্ কাসেম হো কেহ্ তূ ইবনে আবিল কাসেম হ্যায়
কেঁউ নাহ্ ক্বাদির হো কেহ্ মুখতার হ্যায় বাবা তেরা।
অর্থাৎ আপনিতো নবীকুল সদরার আবুল কাসেম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নূরানী সন্তান। আপনার উপাধি (কাসেম) বণ্টনকারী কেন হবে না?
আপনার সম্মানিত দাদাজান হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তো খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা সম্পন্ন মহান যাত আপনি যখন তাঁরই সন্তান তখন কেনই বা (ক্বাদির) শক্তিশালী হবেন না? আপনি অসাধারণ মর্যাদাসম্পন্ন ক্ষমতাবান।

সম্পর্কই মর্যাদার সোপান
تجھ سے دردرسے سگ اور سگ سے ہے مجھ کو نسبت
میری گردن میں بھی ہے دور کاڈورا تیرا
اس نشانی کے جو سگ ہیں نہیں مارے جاتے
حشرتک میرے گلے میں رے پٹاتیرا
তুঝসে দর দরসে সগ আউর সগছে হ্যায় মুঝকো নিসবত
মেরে গরদন মে ভী হ্যায় দওর কা ডোরা তেরা।
ইস নিশানী কি জো সগ হ্যাঁয় নেহী মারে যাতে
হাশর তক মেরে গলে মে রহে পাট্টা তেরা।
অর্থাৎ হে শাহে আউলিয়া! আপনার মহান দরবারের কুকুরের সাথে আমার সম্পর্ক। আমার গলায় আপনার দরবারের বেল্ট লাগানো আছে, আমি আপনার আনুগত্যের বেল্ট পরিহিত এমন এক চিহ্নিত কুকুর, যাকে কেউ প্রহার করবে না। যেহেতু আসমান ও জমিনবাসী আমাকে দেখা মাত্রই চিনতে পারবে যে, আমি আপনার গোলাম। সম্পর্কের এ পবিত্র বন্ধন হাশরের দিন পর্যন্ত সকল প্রকার বিপদাপদ থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায়।

গাউসে পাক বিপদে সাহায্যকারী
توہے وہ غوث كه کے ہر غوث ہے شیدا تیرا-توہے وہ غیث کہ ہر غیث ہے پیاسا تیرا
তু হ্যায় উয়হ্ গউস কেহ্ হার গউস হ্যায় শায়দা তেরা
তু হ্যায় উয়হ্ গায়স কেহ্ হার গায়স হ্যায় পিয়াসা তেরা।
অর্থাৎ আপনিতো মানব মণ্ডলীর সাহায্যকারী, সর্বস্তরের সাহায্যকারী আউলিয়া কেরাম আপনারই প্রেমে উৎসর্গিত। আপনিতো করুণার এমন শ্রোতস্বিনী যার অনুগ্রহ ও বদান্যতার পিপাসু প্রত্যেক ফয়য প্রত্যাশী ক্বুত্বব, আবদাল ও ওলীগণ।

‘গউস’ শব্দের অর্থ সাহায্যকারী।
ইরগামুল মুরিদীন গ্রন্থে রয়েছে-اَلْغَوْثُ هُوَ الْقُطْبُ الَّذِیْ یُسْتَغَاثُ بِہ
অর্থাৎ ‘‘গাউস হলেন এমন ক্বুত্বব যাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে উপকার পাওয়া যায়।’’

বিরুদ্ধবাদীদের স্বীকারোক্তি
আহলে সুন্নাতের পরিপন্থী ছাড়া অন্য মতাবলম্বী ওহাবী-দেওবন্দী শীর্ষ ওলামা স্বীয় রচনাবলীতে গাউসে পাককে গাউসুল আ’যম, গাউসুস্ সাক্বালাঈন উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁকে মানব-দানব উভয় শ্রেণীর সাহায্যকারী উপাধিতে আখ্যায়িত করেছেন।

গাউসে পাকের বেলায়ত চিরস্থায়ী
سورج اگلوں کے چمکتے تھے چمک کرڈوبے – افق نورپہ ہے مہر ہمیشہ تیرا
সুরজ আগলূঁ কে সমকতে থে সমক কর ডুবে
উফকে নূর পেহ্ হ্যায় মেহর হামীশাহ্ তেরা।
অর্থাৎ পূর্বেকার ওলীগণ আকাশ জগতে সূর্যের ন্যায় দ্বীপ্তিমান ছিল, পরে অস্তমিত হলো; কিন্তু আপনার হেদায়তের উজ্জ্বল প্রদীপ আকাশের দিগন্তে সর্বদা দোদীপ্যমান।
গাউসে পাক নিজেই বলেন-
اَفَلَتْ شُمُوْسُ الْاَوَّلِیْنَ وَشَمْسُنَا -اَبَدًا عَلٰی اُفُقِ الْعٰلی لاَتَغْرُبُ
অর্থাৎ আমার পূর্ববর্তীদের বেলায়তের সূর্য অস্তমিত হয়েছে কিন্তু আমার বেলায়তের সূর্য চিরকাল আকাশ দিগন্তে উড্ডীন থাকবে, অস্তমিত হবে না।

সকল আউলিয়া কেরাম গাউসে পাকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
جوولی قبل تھے یا بعدہوئے یاہونگے – سب ادب رکھتے ہیں دل میں میرا آقاتیرا
জো অলী কবল থে এয়া বা’দ হুয়ে এয়া হোঙ্গে
ছব আদব রাখতে হ্যাঁয় দিল মে মেরা আক্বা তেরা।
অর্থাৎ যত আউলিয়া কেরাম আপনার পূর্বে ছিল এবং পরে হবেন; হে আমার আক্বা! সকল সম্মানিত ওলী অন্তর দিয়ে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখেন।
হযরত খাদ্বির আলাইহিস্ সালাম গাউসে পাকের শানে বলেন-
اِتَّخَذَ اللهُ وَلِیًّا کَانَ اَوْ یَکُوْنَ اِلَّا وَهُوَ مُتَادِّبٌ مَّعَکَ اِلٰی یَوْمِ الْقِیَامَۃِ
অর্থাৎ আল্লাহ পাক যাঁকে অলী বানিয়েছেন যিনি অতীত হয়েছেন বা আগমন করবেন, কিয়ামত পর্যন্ত সকলেই আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

গাউসে পাক ওলীকুল সম্রাট
بقسم کہتے ہیں شاہان صریفیں وحریم- کہ ہوا ہے نہ ولی ہو كوئي ہمتاتیرا
বক্বসম কেহতে হ্যাঁয় শাহা-নে সরীফাঈন ও হারীম
কেহ্ হুয়া হ্যায় নাহ্ ওলী হো- কুয়ী হামতা তেরা।
অর্থাৎ ‘সরীফাঈন ও হারীম’র বাদশাহ্ অর্থাৎ দু’স্থানে বসবাসকারী আউলিয়া কেরাম যথাক্রমে শায়খ আবু আমর ওসমান সরীফাঈন এবং আবু মুহাম্মদ আবদুল হক ইবনে আবু বকর হারীমী’র শপথ করে বলছি যে, হে গাউসে পাক! আপনার সমকক্ষ কোন ওলী অতীতে হয়নি আর ভবিষ্যতেও কখনো হবে না। আপনি তো একক ও অতুলনীয়। শ্লোকে দু’জন মহান ওলীর নাম মোবারক বরকত স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যথায় সকল আউলিয়া কেরামের চেয়ে তাঁর মর্যাদা সুউচ্চ।

গাউসে পাক অতুলনীয়
تجھ سے اور دہر کے اقطاب سے نسبت کیسی- قطب خود کون ہے خادم ترا چیلا تیرا
তুঝসে আউর দাহর কে আক্বত্বাব সে নিসবত কায়সী
ক্বুত্বব খোদ কউন হ্যায় খাদেম তেরা ছেলা তেরা।
অর্থাৎ আপনার সাথে যুগের ক্বুত্ববগণের তুলনা কিভাবে হয়! যেহেতু সকল ক্বুত্বব আপনারই খাদেম। সাধারণতঃ কোন শিষ্য স্বীয় পীরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন। পীর হচ্ছেন পথিকৃৎ, পথের দিশারী, আর মুরীদ হচ্ছেন তাঁর পদাঙ্ক অনুসারী।
কা’বাও গাউসে পাককে সম্মান জানায়
سارے اقطاب جہاں کرتے ہیں کعبے کا طواف-کعبہ کرتاہے طواف دروالا تیرا
সারে আক্বতাবে জাহাঁ করতে হ্যাঁয় ক্বাবে কা তাওয়াফ
ক্বা’বা করতে হ্যায় তাওয়াফে দরে ওয়ালা তেরা।
অর্থাৎ বিশ্বের সকল ক্বুত্বব মর্যাদা ও বরকতের প্রত্যাশায় কা’বা শরীফের তাওয়াফ করেন; কিন্তু আপনার মহান দরবার এত অধিক সম্মানিত যে, স্বয়ং কা’বা আল্লাহর নির্দেশে আপনার দরবার তাওয়াফ করে থাকেন-
اور پروانے ہیں جو ہوتے ہیں کعبہ پہ نثار-شمع اک توہے کہ پروانہ ہے کعبہ تیرا
আউর পরওয়ানে হ্যাঁয় জো হোতে হ্যাঁয় ক্বা’বা পেহ্ নেসার
শম‘আ একতো হ্যায় কেহ্ পরওয়ানা হ্যায় কা’বা তেরা।
অর্থাৎ মানবজাতির সকলে পতঙ্গতুল্য, যারা ক্বা’বার জ্যোতিতে উৎসর্গিত। ক্বা’বার চতুর্দিকে তারা প্রদক্ষিণ করে কিন্তু আপনি এমন আলোক রশ্মি যে, স্বয়ং কা’বা শরীফ পতঙ্গতুল্য হয়ে আপনার তাওয়াফ করছে।
নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সূত্রে প্রতীয়মান হয় যে, মহান ওলীগণের সাথে সাক্ষাৎ ও তাঁদের দরবারে উপস্থিতির জন্য স্বয়ং কা’বা শরীফ স্থানান্তরিত হয়; এটা নিছক কল্প কাহিনী নয় বরং এর বাস্তবতা যথার্থ সত্য। বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ রুহুল বয়ান ৪র্থ খণ্ডের ৪৭৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে-
وَمِنْہُ زِیَارَۃُ الْکَعْبَۃِ بِبَعْضِ الْاَوْلِیَآءِ
অর্থাৎ কতেক ওলীর যিয়ারতে কা’বা শরীফের গমন মহান ওলীগণের কারামতের পর্যায়ভুক্ত।

গাউসে পাক শরীয়ত-ত্বরীক্বতের কান্ডারী
شجروسروسہی کس کے اگائے تیرا-معرفت پھول سہی کس کا کھلا یاتیرا
শাজর ও ছর ও সহী কিছকে উগায়ে তেরে
মা’রিফাত ফুল সহী কিস কা খেলায়া তেরা।
অর্থাৎ হেদায়তের বৃক্ষতো আপনিই বপন করেছেন, তরীক্বত ও মা’রিফাতের পু®পরাজি অতি উত্তম পন্থায় বিকশিত। আপনিই তো তরীক্বতের বাগানকে সুসজ্জিত করেছেন। ইলম ও আমলের সমন্বয়ে শরীয়ত তরীক্বতের এমন পন্থা নির্দেশ করেছেন- আপনার প্রদর্শিত পথে অসংখ্য মানব সন্তান গন্তব্যের সন্ধান লাভে ধন্য হয়েছেন।

গাউসে পাক জান্নাতের দুলহা
توہے نوشاہ براتی ہے یہ سارا گلزار-لائی ہے فصل سمن گوندھ کے سہر اتیرا
তূ হ্যায় নওশাহ্ বরাতী হ্যায় ইয়ে সারা গুলযার
লা-ঈ হ্যায় ফসল সমন গোন্ধ কে সাহরা তেরা।
অর্থাৎ আপনিই তো বেহেশতের দুলহা, আপনার প্রেমে উৎসর্গিত ভক্ত অনুরক্ত পদাঙ্ক অনুসারী প্রেমিকরা বরযাত্রী তুল্য। স্রষ্টার কৃপায় বসন্ত ঋতু চামেলী ফুলের সুঘ্রাণ আপনারই জন্য নিবেদিত।

বৃক্ষরাজি গাউসে পাককে সালাম জানায়
صف ہر شجرۃ میں ہوتی ہے سلامی تیری- شاخیں جھک جھک کے بجالاتی ہیں مجر اتیرا
সফ হার শাজরাহ্ মে হূতি হ্যায় সালামী তেরী
শাখেঁ ঝুক ঝুক কে বজা লাতী হ্যাঁয় মুজরা তেরা।
অর্থাৎ হে গাউসুল আ’যম! ভূপৃষ্ঠে সারি সারি দণ্ডায়মান বৃক্ষরাজি, যা দৃশ্যমান; মূলত তা আপনার প্রতি সালাম ও অভিবাদন উৎসর্গ করছে এবং বৃক্ষরাজির শাখা-প্রশাখা অবনত চিত্তে আপনার সমীপে সম্মান জানাচ্ছে।

সকল সিলসিলায় গাউসে পাকের ফয়য বহমান
کس گلستاں کو نہیں فصل بہاری سے نیاز-کون سے سلسلہ میں فیض نہ آیاتیرا
কিস গুলিস্তাঁ কো নেহীঁ ফছল বাহারী সে নিয়ায
কউন সে সিলসিলাহ্ মে ফয়য নাহ্ আয়া তেরা।
অর্থাৎ হে গাউসুল আ’যম! বেলায়তের উদ্যানের এমন কোন সুরভিত ফুল নেই, যিনি আপনার কৃপাদৃষ্টির অমুখাপেক্ষী। আপনি বসন্ততুল্য সকল সিলসিলায় আপনার ফয়য বহমান।

সর্বত্র গাউসে পাকের নূর বিস্তৃত
نہیں کس چاند کی منزل میں ترا جلوہ نور-نہیں کس آئینہ کے گھر میں اجلاتیرا
নেহী কিস চান্দ কী মনযিল মে তেরা জলওয়ায়ে নূর
নেহীঁ কিস আয়না কে ঘরমে উজলা তেরা।
অর্থাৎ চাঁদের কোন স্তরে আপনার নূরের কিরণ নেই? এমনকি আয়নার গৃহও আপনার আলোতে উদ্ভাসিত। অর্থাৎ এমন কোন স্বচ্ছ পবিত্র অন্তর নেই যেখানে আপনার দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটেনি, বেলায়তের উৎসমূল থেকে সকলেই আলোকপ্রাপ্ত।

গাউসে পাক বেলায়তের সমুদ্র
راج کس شہر میں کرتے نہیں تیرے خدام-باج کس نہر سے لیتانہیں دریاتیرا
مزرع چشت وبخاراوعراق واجمیر-کون سی کشت پہ برسانہیں جھالاتیرا
রাজ কিস শহরমে করতে নেহীঁ তেরে খোদ্দাম
বাজ কিস নহর সে লে-তা নেহীঁ দরয়া তেরা
মাযরাই চিশত ও বুখারা ও ইরাক ও আজমীর
কউন সি কশ্ত পেহ্ বরসা নেহীঁ ঝালা তেরা।
অর্থাৎ ১।। হে বেলায়তের পরশমনি! এমন কোন শহর নেই যেখানে আপনার সেবকগণ রাজত্ব করছে না। আপনার বেলায়তের সমুদ্র থেকে (উর্বরতা) নিচ্ছেনা এমন কোন নদনদী নেই।
২।। চিশত্, বুখারা, ইরাক ও আজমীর এমন কোন বাগান নেই যেখানে আপনার বেলায়তের বারিধারা বর্ষিত হয়নি।
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি গাউসে পাকের প্রতি এমন ভক্তি ও প্রেম নিবেদন করেন যে, তাঁর রচিত কবিতাগুলো বিন্দুমাত্র শরীয়তের গন্ডি অতিক্রম করেনি। ভাবাবেগে বিভোর হয়ে ক্বোরআন সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়তের পরিপন্থী একটি শব্দও কবিতায় সংযোজন করেননি। শরীয়তের বিধিমালার যথার্থ অনুসরণ করেও যে গীতিকাব্য রচনা করা সম্ভব তা সার্থকরূপে প্রমাণ করলেন ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
পৃথিবীর সকল সম্মানিত ওলীর উপর গাউসে বাগদাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আ’লা হযরত স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন। নিম্নোক্ত দু’টি গ্রন্থেও আ’লা হযরত গাউসে পাক সম্পর্কে গবেষণাধর্মী আলোচনা করেনঃ
১. ‘আয যামযামাতুল ক্বমরিয়্যা ফিযযাতি আনিল খমরিয়্যা।’
২. ‘মুসীরে মুয়াজুম শরহে কসীদা মদহিয়্যা ইকসিরে আজম।’
আ’লা হযরত সকল ওলীর উপর গাউসে পাকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে স্বতন্ত্র ফাতওয়াও জারী করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে ‘ফাতাওয়ায়ে রিযভীয়া’ ৯ম খণ্ড, ১২৪-১২৫ পৃষ্ঠা সম্বলিত এক বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন। আ’লা হযরত প্রদত্ত ২০ পৃষ্ঠা ব্যাপী বিশদ আলোচনা ফাতাওয়া রিযভিয়া ৯ম খণ্ড ১৩০-১৫১ পৃষ্ঠায় দেখুন।

সালাতুল গাউসিয়ার ফযীলত
আ’লা হযরত ‘সালাতুল গাউসিয়া’র বৈধতা প্রমাণের নিমিত্তে আরবী ভাষায় দু’টি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ্য গ্রন্থ রচনা করেনঃ
১. ‘আনহারুল আনওয়ার মান যুম্মা সালাতুল আসরার।’
২. ‘আযহারুল আনওয়ার মানছাবা সালাতুল আসরার’ এ দু’টি গ্রন্থে গাউসে পাকের ভক্ত প্রেমিক আশিক্বীনের জন্য সালাতুল গাউসিয়ার নিয়মাবলী সম্পর্কে আলোকপাত করেন যা অত্যন্ত উপকারী ও ফলপ্রসু।
ছালাতুল গাউসিয়া বা ছালাতুল আছরার সম্পর্কে গাউসে পাক নিজেই বলেন-
‘‘নফলের নিয়্যতে দু’রাকআতের প্রত্যেক রাকআতে ১ বার সূরা ফাতিহা ও ১১ বার সূরা ইখলাস, সালাম ফিরানোর পর নিম্নোক্ত দরূদে গাউসিয়া ১১ বার পাঠ করবেঃ
اَللّٰہُمَّ صَلِّ عَلٰی سَیِّدِنَا مَوْلاَنَا مُحَمَّدٍ مَعْدِ نِالْجُوْدِ وَالْکَرَمِ مَنْبَعِ الْعِلْمِ وَالْحِلْمِ وَالْحِکَمِ وَبَارِکْ وَسَلَّمَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা মাল্লি আ’লা সায়্যিদিনা ওয়া মাওলানা মুহাম্মাদিন মাদিনিল জূদে ওয়াল করমি মামবায়িল ইল্মি ওয়াল হিলমি ওয়াল হিআমি ওয়া বারিক ওয়াসাল্লিম। এরপর বাগদাদ শরীফের দিকে মুখ করে সামনের দিকে ১১ কদম এগিয়ে যাবেন প্রত্যেক কদমে আমার নাম পড়বেন (গাউসে পাকের নাম) নিম্নরূপ-
یاشیخ الثقلین یا قطب الربانی یا غوث الصمدانی یا محبوب السبحانی یا محی الدین یا ابا محمد الشیخ السید عبد القادر الجیلانی اغثنی وامددنی فی قضاء حاجاتی یاقاضی الحاجات
অথবা یا غوث الاعظم الشیخ عبد القادر شیئا للہ
মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যাকার মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, সালাতুল আসরার নামাযের উপকারিতা আমার নিকট পরীক্ষিত।
পরিশেষে, আ’লা হযরতের মুনাজাতের মাধ্যমে প্রার্থনা করি।
ক্বাদিরী কর, ক্বাদিরী রাখ, ক্বাদিরিয়ূ্যঁ মে উঠা
ক্বদরে আবদুল ক্বাদির ক্বুদরত নুমাকে ওয়াস্তে।
অর্থ: ক্বাদিরী করো, ক্বাদিরী রাখো, রোজ হাশরে ক্বাদিরীদের সাথে শামিল কর। হযরত আবদুল ক্বাদির রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মর্যাদা হচ্ছে তাঁর মাধ্যমে আল্লাহর ক্বুদরত দেখা যায়। আল্লাহ্ গাউসে পাকের ওসীলায় আমাদের কামিয়াবী দান করুন; আ-মী-ন।

দ্বিতীয় অধ্যায়

ক্বাদেরিয়া ত্বরীক্বার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ইসলামই একমাত্র আল্লাহর মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন, কালজ্বয়ী জীবনাদর্শ। ইসলামের মর্মবাণী প্রচারের লক্ষ্যে ধরাধামে শুভাগমন করেন অসংখ্য নবী-রাসূল। নবীকুল সরদার হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে নবী রাসূল প্রেরণের ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জাহেরী জীবদ্দশার পর আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের প্রচার-প্রসারের দায়িত্ব অর্পিত হয় সাহাবায়ে কেরাম, তাবে‘ঈন, তাব‘ই-তাবে‘ঈন, ওলামায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কামেলীনের উপর। তাঁদের অক্লান্ত ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারিত। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে রাজা-বাদশাদের ভূমিকা ছিল নগণ্য; বরং সুফী সাধক আউলিয়া কেরামরাই ইসলামের সুমহান আদর্শ ও সাম্যের বাণী বহন করে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ শান্তি-সাম্য ভ্রাতৃত্বের অনুপম শিক্ষায় মুগ্ধ হয়ে এতদ্ঞ্চলের জনসাধারণ ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়।
ঐতিহাসিকদের পরিবেশিত তথ্য মতে হিজরী প্রথম শতাব্দী তথা খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফতকালে কয়েকজন ইসলাম প্রচারক এদেশে আসেন। হযরত মামুন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হযরত মোহায়মিন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন এ দলের নেতা। তারপর আসেন হযরত হামেদ উদ্দিন, হযরত হুমায়নুদ্দিন, হযরত মুরতাজা, হযরত আবদুল্লাহ ও হযরত আবু তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রমুখ। এরপর একাধিক ইসলাম প্রচারক দল এ ভুখন্ডে আগমন করেন। যাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধনার বদৌলতে ইসলামের সুবিশাল ইমারত বিনির্মিত হয়।
আরবী ‘‘তরীকুন’’ শব্দ থেকে তরীকা শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ পথ বা রাস্তা। অর্থাৎ যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সৎপথের নির্দেশ দিয়ে মুক্তিকামী মানুষের পরিত্রাণের জন্য অন্ধকার থেকে আলোর পথে পৌঁছার যে নিয়ম পদ্ধতির নির্দেশনা দিয়ে গেছেন সেটাই তরীক্বত বা তরীক্বা। হক্কানী সিলসিলার মাশায়েখ তাঁদের প্রচারিত সিলসিলা ও তরীক্বতের বিভিন্ন ধারায় বিশ্বমানব গোষ্ঠীকে হেদায়তের পথে আহবান করেন। কতেক সিলসিলা এমন রয়েছে যেগুলো একাধিক সিলসিলার একত্রীকরণে একটি সিলসিলার রূপপরিগ্রহ করেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসারে যুগে যুগে যেসব সিলসিলা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণে মতানৈক্য বিদ্যমান। কারো কারো মতে তরীক্বতের সিলসিলার সংখ্যা চৌদ্দটি, কারো কারো মতে বারটি, কারো মতে দশটি। প্রধানত চারটি তরীক্বার ভূমিকা সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এগুলো হচ্ছে- ক্বাদেরিয়া, চিশতিয়া, মোজাদ্দেদীয়া ও নকশবন্দীয়া। তবে অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মোজাদ্দেদীয়া তরীক্বা নামে স্বতন্ত্র কোন তরীক্বা নেই। এটি নক্শবন্দিয়া তরীক্বারই একটি শাখা হিসেবে অভিজ্ঞ মহল মত ব্যক্ত করেন। আবার অনেকে মোজাদ্দেদীয়া এর স্থলে সোহ্রোওয়ার্দিয়া তরীক্বা উল্লেখ করেন। এ পর্যায়ে চারটি তরীক্বা হলো ক্বাদেরীয়া, চিশতীয়া, নক্শবন্দীয়া ও সোহরোওয়ার্দিয়া। এছাড়া অন্যান্য সিলসিলা উপরোক্ত চারটি সিলসিলার শাখা-সিলসিলা। এ ধরনের অনেক সিলসিলাহ যুগে যুগে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এগুলো মূল সিলসিলার শাখা সিলসিলাহ হিসেবে পরিচিত। সিলসিলাগুলো হচ্ছে যায়েদিয়্যাহ, আয়্যাজিয়াহ্, আওহামিয়াহ্, ওয়ারেসিয়া, গারদফিয়্যাহ, জামে‘ইয়্যাহ্, আকবরিয়্যাহ্, কিবরুরিয়্যাহ্, ওয়ারেসিয়াহ্, সাত্তারিয়্যাহ্ প্রভৃতি। উপরোক্ত সিলাসিলাগুলোরর মাশায়েখের অক্লান্ত ত্যাগের ফলশ্র“তিতে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বোত্তম জীবনাদর্শ ইসলামের বিজয় নিশান দিগ-দিগন্তে উড্ডীন হয়েছে, কালেমার আওয়াজ উচ্চারিত হয়েছে, ক্বোরআন, সুন্নাহর শাশ্বত পায়গাম জনসাধারণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। তাঁদের সান্নিধ্যে মানব জাতি ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির মহান নি’মাত অর্জন করেছে, কলুষিত আত্মার পবিত্রতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নৈতিকতা, মানবতা, উদারতা, শালীনতা ও অনুপম গুণাবলীর শিক্ষালাভে নিজেদেরকে ধন্য করেছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সর্বাধিক প্রভাবশালী সুফী-তরীক্বা হচ্ছে ক্বাদেরিয়া সিলসিলা বা ক্বাদেরিয়া তরীক্বা।
অলীকুল সম্রাট হযরত আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হচ্ছেন ক্বাদেরিয়া তরীক্বার প্রবর্তক। তাঁর মাতা হযরত সাইয়্যেদা ফাতেমা বিনতে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ সাওমে‘ঈ। তাঁর উপাধি পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়দিক দিয়ে তিনি সাইয়্যেদ তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বংশধর। চতুদর্শ শতাব্দির মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি গাউসে পাকের বংশীয় মর্যাদাকে তাঁর রচিত ক্বসীদায় এভাবে তুলে ধরেছেন-
তু হোসাইনী হাসানী কেউ না মহিউদ্দীন হো,
আয় খাদ্বিরে মাজমা‘ই বাহারাঈন হে চশমা তেরা।
অর্থাৎ ওহে গাউছুল আ’যম! আপনি তো হাসানী ও হোসাইনী, আপনি মহিউদ্দীন বা দ্বীনের পূনরুজ্জীবিতকারী কেন হবেন না? যেহেতু বেলায়তের দুই সমুদ্রের মিলন মোহনায় আপনার উৎসধারা। আপনার কারণে ইসলামের বাগান আজ সবুজ, সতেজ ও আলোকিত।
বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচারে এ সিলসিলার পীর-মাশায়েখের অসামান্য অবদান অগ্রগণ্য। বিশেষতঃ ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বীন প্রচার-প্রসারে এ তরীক্বার মহান শায়খগণ অক্লান্ত সাধনার বদৌলতে যে নজীর বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঐতিহাসিকদের পরিবেশিত তথ্যমতে প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল হযরত আবদুল করীম ইবনে ইব্রাহিম আল-জীলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ক্বাদেরীয়া তরীক্বার প্রসার ঘটে। ১৩৮৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন। ক্বাদেরিয়া সিলসিলার প্রসারে এ মহান ওলীয়ে কামেল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পরবর্তীতে গাউসুল আ’যমের ভাবাদর্শে উজ্জীবিত রূহানী সন্তানদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও বহুমুখী কর্ম ও অবদানের নিরীখে বিশ্বব্যাপী ইসলামী জাগরণের সূত্রপাত হয়। আবদুল করিম ইবনে ইব্রাহিম আল-জীলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে জীলান বা গীলান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সম্ভবতঃ ৬-১৫ বৎসরকাল ভারতের কাশীতে অবস্থান করেন। এরপর ইয়ামনে চলে যান। ১৪০৬-১৪০৭ ইংরেজি সালের মধ্যে সৈয়্যদ নিয়ামত উল্লাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর মাধ্যমে ভারতবর্ষে ক্বাদেরিয়া তরীক্বা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। জীলান নিবাসী হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ গাউস নামক এক প্রখ্যাত অলী ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন এবং তিনি হযরত নিয়ামত উল্লাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে অক্লান্ত ত্যাগ স্বীকার করেন। ১৪৮২ ইংরেজি সালে এ মহান আধ্যাত্মিক সাধক তরীক্বার প্রচারণা শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বল্প সময়ে ইসলাম প্রচারে সফল হয়েছিলেন, ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁর অসংখ্য ভক্ত অনুরক্ত ছড়িয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে হযরত শায়খ মীর মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর নাম উল্লেখযোগ্য, মায়ানমার নামে তিনি সর্বত্র প্রসিদ্ধ। তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভ্রাতা দারা-শিকোর ধর্মীয় ও আধ্যত্মিক উপদেষ্টা ও গুরু ছিলেন, ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর গুরু সৈয়্যদ মুহাম্মদ গউস রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে উচ নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। এছাড়া হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি রচিত তাফসীরে নঈমীতে সূরা আন‘আম এর তাফসীরের এক পর্যায়ে ভারতবর্ষে ক্বাদেরীয়া তরীক্বার প্রচারক হিসেবে হযরত সৈয়্যদ কবির উদ্দীন শাহ্ দুলাহ্ দরিয়ায়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র নাম উল্লেখ করেন। তিনি আনুমানিক ১০৬১ হিজরি মুতাবিক ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের গুজরাটে ইন্তেকাল করেন। ষোড়শ শতাব্দির দিকে বাংলাদেশে ক্বাদেরিয়া তরীক্বা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হযরত শাহ্ কাযিম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এতদ্অঞ্চলে সর্বপ্রথম ক্বাদেরিয়া-ত্বরীক্বার প্রচারক ছিলেন। তিনি ছিলেন গাউসে বাগদাদ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বংশধর। বাংলার মা’লার বা মালোরা নামক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেন। হযরত সৈয়্যদ আবদুর রায্যাক্ব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন তাঁর প্রধান খলীফা, ক্বাদেরিয়া তরীক্বার প্রচারে এ মনীষীর নাম অনস্বীকার্য।
মোঘল সম্রাট আওরঙ্গযেবের শাসনামলে (১৬৫৬-১৭০৭ইংরেজি) উত্তর ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্বাদেরিয়া তরীক্বা প্রসার লাভ করে। এভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষরূপে গাউসে পাক হযরত সৈয়্যদুনা আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অসাধারণ বেলায়তের ফয়যপ্রাপ্ত মাশায়েখদের কর্ম ও সাধনার বদৌলতে ইসলাম বিশ্বব্যাপী প্রসারতা পেয়েছে। এক্ষেত্রে উপমহাদেশের অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরামের পাশাপাশি ক্বাদেরিয়া সিলসিলার তিনজন মহান ওলীর জীবন-কর্ম সুন্নীয়তের আকাশে ধ্র“তারার মতো চির অম্লান হয়ে থাকবে। এদের একজন খাজায়ে খাজেগান খলিফায়ে শাহে জীলান গুপ্ত রহস্যাবলীর অন্তর্দ্রষ্টা মায়ারেফে লাদুন্নিয়ার প্র¯্রবন হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। ১২৬২ হিজরি মুতাবিক ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এবোটাবাদ জিলার হরিপুর চৌহর শরীফে প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল হযরত ফক্বীর মুহাম্মদ খিদ্বরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ঔরশে এ মহান ওলী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরই প্রধান খলিফা প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ৩৯তম বংশধর হযরত হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন সিলসিলায়ে আলীয়া ক্বাদেরিয়ার একজন সফল প্রচারক। পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ এবোটাবাদ শেতালু (হাজারা) সিরিকোট গ্রামের সৈয়্যদাবাদ শরীফের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে হযরত সৈয়্যদ খানী যামান শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সাহেবযাদা হযরত সৈয়্যদ সদর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ঔরশেই ১২৭১/৭২ হিজরি মুতাবিক ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুল আউলিয়া হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরই ঔরশে হিজরি ১৩৩৬ মুতাবিক ১৯১৬ সনে জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল মাতৃগর্ভের ওলী গাউসে জামান আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
তিনি ছিলেন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ঊন চল্লিশতম অধঃস্তন পুরুষ এবং আল্লামা সৈয়দ আহমদ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সাহেবজাদা। ১৯৯৩ ইংরেজির ৭জুন, ১৫ জিলহজ্ব ১৪১৩ হিজরি সোমবার সকাল ৯টায় এ মহান সাধক ইন্তেকাল করেন। পরদিন মঙ্গলবার আপন বুযুর্গ পিতা ও মুর্শিদ ক্বিবলা হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর পাশে হুযূর ক্বিবলা পেশোয়ায়ে আহলে সুন্নাত আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (ম.জি.আ.)’র ইমামতিতে বৃহত্তম নামাজে জানাযার পর রওজা মুবারকে শায়িত হন।
১৯৭৭ সালে হুযূর ক্বেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর দুই সাহেবজাদা যথাক্রমে মাখদূমে মিল্লাত, পেশোয়ারে আহলে সুন্নাত, মোর্শেদে বরহক আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেব (মু.যি.আ.) ও রওনাক্বে আহলে সুন্নাত সাহেবযাদা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ্ (মু.যি.আ.)’কে সিলসিলায়ে আলীয়া ক্বাদেরিয়ায় খিলাফত দ্বারা ভূষিত করেন। ওই দুই মহান ব্যক্তিত্ব বর্তমানে শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ট ও সুচারুরূপে পালন করে যাচ্ছেন। শরীয়ত, তরীক্বত, মাযহাব-মিল্লাত, সুন্নীয়ত ও আদর্শ রাজনীতির বৃহত্তর পরিমন্ডলে তাঁরা নিরলসভাবে ব্যাপক খিদমত আনজাম দিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে তাঁরা আজ ব্যাপক জনপ্রিয়তার শীর্ষে ও মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। তরীক্বায়ে আলীয়া ক্বাদেরিয়ার অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারে দিশেহারা মানব-জাতিকে সত্যের পথে, সুন্নিয়তের পথে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। মূলত: আল্লাহর এসব মহান ওলী ও পীর-মাশায়েখের অক্লান্ত সাধনার ফলশ্রুতিতে ক্বাদেরিয়া সিল্সিলার প্রসারতা আজ দিগদিগন্তে বিস্তৃত।

আল-ক্বোরআনের আলোকে গিয়ারভী শরীফ

গিয়ারভী শরীফ প্রকৃতপক্ষে মনগড়া ভিত্তিহীন কোন আবিষ্কার নয়; বরং ক্বোরআন-সুন্নাহর অকাট্য প্রমাণাদি হচ্ছে- এর বৈধতার সুদৃঢ় ভিত্তি। মহান ওলী হযরত মাহবূবে সোবহানি শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র রুহ মুবারকে সওয়াব পৌঁছানার শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি হলো- গিয়ারভী শরীফ। ঈসালে সাওয়াবের বৈধতা ক্বোরআন, হাদীস ও বুযুর্গানে দ্বীনের নির্ভরযোগ্য কিতাবে উল্লেখিত অসংখ্য বর্ণনার আলোকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল পেশ করা হলঃ
পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
وَ الَّذِیْنَ جَآءُوْ مِنْۢ بَعْدِهِمْ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا
وَ لِاِخْوَانِنَا الَّذِیْنَ سَبَقُوْنَا بِالْاِیْمَانِ
তরজমা: যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রণী ভ্রাতাদের ক্ষমা কর’।
পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে-
اَلَّذِیْنَ یَحْمِلُوْنَ الْعَرْشَ وَ مَنْ حَوْلَهٗ یُسَبِّحُوْنَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَ یُؤْمِنُوْنَ بِهٖ وَ یَسْتَغْفِرُوْنَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْاۚ-رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَیْءٍ رَّحْمَةً وَّ عِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِیْنَ تَابُوْا وَ اتَّبَعُوْا سَبِیْلَكَ وَ قِهِمْ عَذَابَ الْجَحِیْمِ
তরজমা: যারা আরশ বহন করে আছে এবং যারা এর চর্তুপাশে ঘিরে আছে তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মু’মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে- হে আমাদের প্রতিপালক, তোমার দয়া ও গুণ সর্বব্যাপী। অতএব, যারা তাওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা করো এবং তাদেরকে দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা করে নাও।
পবিত্র ক্বোরআনের উল্লেখিত দু’টি আয়াত দ্বারা পরবর্তী ও পূর্ববর্তীদের পরকালীন মঙ্গল ও কল্যাণার্থে উত্তম আমল দান, সর্বদা ক্বোরআন খানি, ফাতেহাখানি ও ঈসালে ছওয়াব ইত্যাদি বরকতময় আমল করা শরীয়ত সম্মত।

আল-হাদীসের আলোকে প্রমাণ
মৃত ব্যক্তির প্রতি ঈসালে সাওয়াব -এর বৈধতা প্রমাণে হাদীস শরীফে অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে দু’টি উদ্ধৃতি পেশ করা হল-
এক. হযরত আবূ উসাইদ যায়েদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রালুসুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসা ছিলাম, বনী-সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি এসে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও কি তাদের প্রতি সদাচরণ করার মত কোন পথ অবশিষ্ট আছে? অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় তো আমার মাতা-পিতার খেদমত ও সদাচরণ করেছি তাদের মৃত্যুর পরও কি এমন পন্থা আছে যে, তাঁদের সাথে সদাচরণ করব? হুযূর বললেন, ‘‘হ্যাঁ আছে, তাদের জন্য দো‘আ করা, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের মৃত্যুর পর তাদের অপূর্ণ ওয়াদা পূর্ণ করা, তাদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা, তাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
দুই. একদা প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহান দরবারে আরয করা হল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আমাদের মৃতদের পক্ষ থেকে সদক্বা ও হজ্ব আদায় করছি এসব কি তাদের নিকট পৌঁছবে? প্রিয় রসূল এরশাদ করেন, ‘‘হ্যাঁ নিশ্চয় সে সব আমলে তারা খুশী হয়, যেমনিভাবে তোমরা পরস্পরকে উপঢৌকন প্রদান করলে খুশী হয়ে থাক।

ঈসালে সওয়াব সম্পর্কে বুযুর্গ ওলামায়ে কেরামের অভিমত
হযরত শেখ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘ইবাদতে মালি’ বা আর্থিক ইবাদত তথা সদক্বা-খয়রাত প্রভৃতি দ্বারা মৃত ব্যক্তির কল্যাণ ও সাওয়াবের অধিকারী হওয়াতে সকলে ঐকমত্য পোষণ করেন।
হযরত ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা, ইমাম আহমদ এবং সালেহীনের অভিমত হলো, প্রত্যেক প্রকার ইবাদতের সাওয়াব মৃতের রূহে পৌঁছে থাকে।
হযরত কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, অধিকাংশ ফোক্বাহায়ে কেরামের অভিমত হলো, প্রত্যেক ইবাদতের সওয়াব মৃতের নিকট পৌঁছে থাকে।
হযরত শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ফাতেহা পাঠ করা এবং এর সওয়াব মৃতের রূহে পৌঁছানো প্রকৃত অর্থে জায়েজ ও সঠিক।

গিয়ারভী শরীফ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের অভিমত
অলীকুল সম্রাট হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ গাউসুল আ’যম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র যথার্থ মর্যাদা, শান-মান ও ব্যক্তিত্ব যেমনিভাবে মুসলিম বিশ্বের সাধারণ লোক থেকে আরম্ভ করে সর্বস্তরের আউলিয়ায়ে কেরামের নিকট পরিচিত ও সমাদৃত তেমনিভাবে তাঁর স্মরণে আয়োজিত মাসিক গিয়ারভী শরীফ তাঁর প্রতি ভক্তিÑশ্রদ্ধার এক অনুপম বহিঃপ্রকাশ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নজদী- ওহাবী বাতিল পন্থীরা গাউসে পাকের সুমহান মর্যাদা ও বেলায়তের অসাধারণ ক্ষমতাকে অস্বীকার করার সাথে সাথে গাউসুল আ’যম কর্তৃক প্রবর্তিত গিয়ারভী শরীফ ও মৃত ব্যক্তির কল্যাণ কামানার্থে ইসালে সাওয়াব-এর মাহফিল ও ফাতেহাখানির বিরুদ্ধে হারামও নাজায়েয ইত্যাদি ভিত্তিহীন ফাতওয়াবাজি এবং অপপ্রচারে লিপ্ত।
তাদের দাবী হলো গিয়ারভী শরীফে যেহেতু আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো নাম উল্লেখ করা হয় বিধায় তা হারাম। ক্বোরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা ও বিকৃতকারী বাতিলপন্থীদের ভিত্তিহীন দাবীর অসারতা প্রমাণিত বিধায় ক্বোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত ইসলামী শরীয়ত অনুমোদিত ও বরকতময় আমল, গাউসিয়া শরীফ, গিয়ারভী শরীফ, ফাতেহাখানি ইসালে সাওয়াবের বৈধতা প্রমাণে ইসলামী পন্ডিত বিশেষজ্ঞদের প্রমাণ্য উদ্ধৃতি নিম্নে পেশ করা হলো-
এক. মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনে উল্লেখিত ‘‘ওয়ামা ওহিল্লা বিহী লেগায়রিল্লাহ’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীর’র শিক্ষক মোল্লা আহমদ জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ‘তাফসীরাত-ই আহমদিয়া’ কিতাবে বলেন- আল্লাহ ছাড়া কারো নামে যদি পশু যবেহ করা হয় যেমন কাফেরগণ তাদের প্রতিমার নামে উৎসর্গ করে থাকে তা হারাম।
তবে যদি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে পশু জবেহের পূর্বে বা পরে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নাম উল্লেখ করাতে কোন দোষ নেই। যেমন হেদায়া কিতাবে উল্লেখ আছে। এতে প্রতীয়মান হলো- আউলিয়া কেরামের ইসালে সাওয়াবের জন্য যে গরু, ছাগল হালাল জন্তু মান্নত করা হয় যেমন- আমাদের দেশের মুসলমানগণ এ ধরনের মান্নত করে থাকেন তা ভক্ষণ করা হালাল ও পবিত্র। কারণ যবেহের সময় এ ক্ষেত্রে গায়রুল্লাহর নাম নেয়া হয়নি।
হযরত মোল্লা জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সুযোগ্য ছাহেবজাদা মোল্লা মুহাম্মদ গিয়ারভী শরীফের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে একথার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, অন্যান্য মাশায়েখের ওরশ শরীফ বৎসরান্তে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গাউসে পাকের অনন্য মর্যাদার বৈশিষ্ট্য এ যে, বুযুর্গানে দ্বীন তাঁর স্মরণে গিয়ারভী শরীফ প্রতি মাসের ১১ তারিখ পালন করে থাকেন।
দুই. হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও হযরত মোল্লা জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অনুরূপ ক্বোরআনুল করীমের উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, যবেহকালে যদি আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য কারো নাম নেয়া হয় তা হারাম হবে।
তিনি আরো বর্ণনা করেন যে, হযরত মির্যা মাজহার জানে জানাঁ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এরশাদ করেন যে, একদা আমি আউলিয়া কেরামের একদলকে ধ্যানমগ্ন মোরাক্বাবারত অবস্থায় একটি উচুস্থানে উপবিষ্ট দেখলাম। মাঝখানে হযরত খাজা নক্শবন্দ দোজানু অবস্থায় এবং হযরত জোনাইদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ঠেঁস দিয়ে বসে আছেন। অতঃপর তাঁরা সবাই চলতে লাগলেন আমি তাঁদেরকে কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। একজন উত্তর দিলেন- হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে অভিবাদন জানানোর জন্য অগ্রসর হচ্ছেন। এদের সাথে আমি হযরত ওয়াইসুল করণী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকেও দেখলাম। অতঃপর একটি কক্ষ প্রত্যক্ষ করলাম, যেখানে নূরের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে। সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরাম ঐ গৃহে প্রবেশ করতে শুরু করলেন, আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে একজন উত্তর দিলেন- ‘ইমরোজ ওরসে হযরত গাউসুস সাকালাইন আস্ত, বতক্বরীবে ওরস তাশরীফ বরন্দ’ অর্থাৎ আজকে গাউসুল আ’যমের ওরস মুবারকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে যাচ্ছে।
তিন. শাহ আবদুল আযীয দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমার পিতা শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বাগদাদ শরীফে সরকারীভাবে গিয়ারভী শরীফ উদ্যাপনের কথা অধিক গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। গাউসে পাকের রওযা শরীফে মাসের এগার তারিখে দেশের বাদশাহ্, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ও মন্ত্রীবর্গ উপস্থিত হতেন, আসরের নামাযের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ক্বোরআন তিলাওয়াত, ক্বসীদা পাঠ ও জীবনী আলোচনা করা হতো। এতে এক ধরণের ধ্যানমগ্নতা ও প্রচন্ড ব্যাকুলতা সৃষ্টি হতো। অতঃপর খাদ্য-দ্রব্য তাবাররুক, শিরনী বিতরণ করা হতো। এশার নামায আদায়ের পর লোকজন বিদায় গ্রহণ করতো।
চার. হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইমামে আরেফ শায়খে কামিল আবদুল ওহাব ওরসে গাউসিয়া শরীফ নিয়মিত উদ্যাপন করতেন। মূলতঃ গিয়ারভী শরীফ আমাদের শহরসমূহে প্রসিদ্ধ এবং আমাদের মাশায়েখ হযরাতের মধ্যে পরিচিত। কতেক পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম বলেন, আউলিয়ায়ে কেরামের ওফাতের দিন কল্যাণ, মর্যাদা ঈমানী আলো ও বরকত লাভের প্রত্যাশা অন্য দিনসমূহের তুলনায় অধিক হয়ে থাকে।
এ কারণে বুযুর্গানে দ্বীনের ওফাত দিবসে খতম শরীফ আয়োজন, ওরসে গিয়ারভী শরীফ, ফাতেহা খানি ও ইসালে সাওয়াবের ব্যবস্থাপনা অতীব গুরুত্ব ও যতœ সহকারে আয়োজন করা হয়।
শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রখ্যাত অলীয়ে কামেল হযরত শায়খ আমান পানিপথি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সম্পর্কে বলেন, তিনি রবিউস সানির এগার তারিখে পীরান পীর গাউসুস সাক্বালাঈনের ওরস উদযাপন করতেন।
শাহ্জাদা দারাশিকো, ‘সফীনাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে, হযরত শাহ্ আবদুল মায়ালী ‘তোহফায়ে ক্বাদেরিয়া, গ্রন্থে এবং মুফতি গোলাম সরওয়ার লাহোরী, ‘খজীনাতুল আসফিয়া’ গ্রন্থে গিয়ারভী শরীফের ওরস ও বরকতময় অনুষ্ঠানকে পূণ্যময় আমল বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

গিয়ারভী শরীফ সম্পর্কে দেওবন্দী-আলেমগণের অভিমত
পাঁচ. আহলে হাদীস ও দেওবন্দীদের কর্ণধার মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী লিখেছেন, চিশতিয়া, তরীক্বার বুযুর্গদের নামে ফাতেহা পাঠ করে দো‘আ করুন।
চিশতিয়া তরীক্বার বুযুর্গদের ফাতেহার মতো গাউসুল আ’যমের নামে গিয়ারভী শরীফের ফাতেহা বা ইসালে সাওয়াবে অসুবিধা কি? অথবা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? গিয়ারভী শরীফের শাব্দিক উচ্চারণ মৌখিক স্বীকৃতি পাওয়া না গেলেও অভিন্ন আমলের বৈধতা তো স্বীকার করে নিয়েছেন। বিরুদ্ধবাদীদের এতটুকু স্বীকৃতি স্বপক্ষীয়দের জন্য যথেষ্ট।
ছয়. দেওবন্দী আলিমদের সম্মানিত পীর হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজের মক্কী সাহেব বলেন এরশাদ করেন- গিয়ারভী শরীফের আয়োজন গাউসে পাকের প্রতি ইসালে-সাওয়াবের পদ্ধতিগত ভিত্তি।
সাত. দেওবন্দী মৌলভী হোসাইন আহমদ মদনীর অভিমত হলো, গিয়ারভী শরীফের জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে যদি নিয়ত করা হয় যে, এর এক অংশ ইসালে সাওয়াবের জন্য, অপর অংশ পরিবার-পরিজনের জন্য, বন্ধু বান্ধবদের জন্য, তবে এ খাদ্য গরীব ফকির ছাড়া অন্যদের জন্যও জায়েয হবে।
আমরা প্রত্যেক বৃহস্পতিবার রাতে উচ্চস্বরে যিক্র করার পূর্বে এগার বার সূরা এখলাস পাঠ করে হুযূর গাউসুল আ’যমের রূহ মোবারকে এর সওয়াব পৌঁছিয়ে থাকি। এটাই আমাদের গিয়ারভী শরীফ। (দেওবন্দী সাপ্তাহিক পবিত্র হুসামুদ্দীন লাহোর ১৭ ফেব্র“য়ারী ৯জুন ১৯৬১ সন) দেওবন্দী মতাদর্শীদের মতে জন্তুর প্রবাহিত রক্ত ভিন্ন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কোন অংশ অপবিত্র নয়, হারামও নয়।
দুঃখের বিষয় যে, গিয়ারভী শরীফের ফাতেহা খানী ও তবাররুক বা শরীয়ত সম্মত হওয়া সত্ত্বেও দেওবন্দীদের মতে নাজায়েয; শুধু তা নয় তাদের মতে কাক খাওয়াও হারাম নয় বরং এতে সাওয়াবও আছে।
ইসালে সওয়াবের প্রমাণ ক্বেরআনুল করীম, হাদীসে নববী, সলফে সালেহীন বুযুর্গদের উদ্ধৃতির আলোকে উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। এখন এ বিষয়ে অস্বীকারকারী শীর্ষ আলিমদের আরো কতিপয় উদ্ধৃতি পেশ করা হলঃ
১. মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী বলেন, মৃতের কল্যাণ বা উপকার পৌছানো যখন কারো উদ্দেশ্য হয় তখন কাউকে খাদ্য খাওয়ানো যেন একমাত্র অবলম্বন মনে না করে, এরূপ খাবারের আয়োজন করলে ভাল, অন্যথায় সূরা ফাতেহা, সূরা এখলাসের ছওয়াব অনেক উত্তম।
২. মৌলভী আশরাফ আলী থানভী ছাহেব লিখেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ আমলের সওয়াব মৃতকে বা জীবিতকে দান করার ক্ষমতা রাখে। যেভাবে মৃতের রুহে সওয়াব পৌঁছে থাকে তেমনিভাবে জীবিতদের নিকটও পৌঁছতে থাকে।
৩. মৌলভী রশিদ আহমদ গাঙ্গু’হী ছাহেব বলেন, হাদীসের আলোকে মৃতের রূহে উপকার পৌঁছার বিষয় প্রমাণিত। মশহুর সাহাবা ও ইমামগণের একই অভিমত।
ইসালে সওয়াব গুনাহের কাফ্ফারা এবং মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ। হাদীস শরীফে অদৃশ্যের সংবাদদাতা নবীয়ে আকরাম হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘যখন আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে স্বীয় বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন তখন বান্দা আরয করেন, ‘হে আমার রব! কি কারণে আমার এ মর্যাদা নসীব হয়েছে? তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমার জন্য তোমার পুত্রের ক্ষমা প্রার্থনার বদৌলতে তুমি এ মর্যাদা লাভ করেছো।’
নিঃসন্দেহে জীবিতদের দো‘আ মৃতের জন্য এবং মৃতের জন্য সাদক্বা করা, মৃতের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বড় উপকারী।
মুসলিম মিল্লাতের উপর গাউসুল আ’যম দস্তগীর এবং অন্যান্য বুযুর্গানে দ্বীন ও আউলিয়ায়ে কেরামের দয়া ও অনুগ্রহ অপরিসীম। এ কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শীরা গিয়ারভী শরীফ, ওরস মাহফিল ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে ইসালে সাওয়াবের মাধ্যমে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওসীলায় মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে থাকেন। আল্লাহর ওলীর নামের প্রতি সম্পর্ক করে দো‘আ করার সময় আল্লাহর ওলীর নামের প্রতি সম্পর্ক করার বৈধতা হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একদা এক কাফেলাকে এক মসজিদে দু চার রাক‘আত নামাজ পড়তে বলেন, আরো বলেন যে, এ নামাযের সওয়াব যেন হযরত আবু হুরায়রা পায়।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের দরবারে হযরত সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর আম্মাজানের ইন্তেকালের কথা উল্লেখ করলে তাঁর জন্য উত্তম সাদকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানির ব্যবস্থা করতে বললেন, হযরত সাদ কুপ খনন করলেন। প্রিয় নবী বললেন, এটা উম্মে সা’দ তথা সা’দ-এর মাতার মাগফিরাতের জন্য।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দু’টি ক্বোরবানী করলেনঃ একটি নিজের পক্ষ থেকে অপরটি উম্মতের পক্ষ থেকে।
উপরোক্ত হাদীস সমূহের আলোকে কারো প্রতি সম্পর্ক করার বিষয়টি সুস্পষ্ট রূপে উজ্জ্বল দিবালোকের মতো প্রমাণিত হলো।

সলফে সালেহীনের অভিমত
১. হযরত শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, কোন ওলী বুযুর্গদের ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে শিরনী দুধ চাউল রন্ধন করে ফাতেহা পাঠ করাতে কোন অসুবিধা নেই বরং জায়েয।
২. হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন রাহমাতুল্লাহি আলায়হিমার ফাতেহার উদ্দেশ্যে রান্নাকৃত খানাপিনা, এতে সূরা ফাতেহা, সূরা এখলাস দরুদ শরীফ পড়ার দরুন এসব খাবার বরকতময় হয়ে যায় এবং এ ফাতেহার খাদ্য অত্যন্ত উত্তম।
৩. হযরত শাহ্ ওলী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর বুযুর্গ পিতা হযরত শাহ্ আবদুর রহীম মুহাদ্দিস দেহলভী প্রতি বৎসর ১২ রবিউল আউয়াল শরীফে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা’র নামে ফাতেহার আয়োজন করতেন।
৪. ওহাবী মতাদর্শী মৌলভী ঈসমাঈল দেহলভী একথা লিখেছে যে, নামাযের ন্যায় দোজানু হয়ে বসে চিশতীয়া-তরীক্বার বুযুর্গ যথাক্রমে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন সনজরী, খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী প্রমুখের নামে ফাতেহাখানি করে মহান আল্লাহর দরবারে এসব বুযুর্গের ওসীলায় প্রার্থনা করুন।
৫. আউলিয়া কেরামের প্রতি সম্পর্ক করার উদ্দেশ্যে হচ্ছে- তাঁদের মুবারক রূহ সমূহে সওয়াব পৌঁছানো। জ্ঞানী ও বিবেকবান লোকদের জন্য গিয়ারভী শরীফ, ফাতেহাখানি ও কোন ভালকাজের সওয়াব মৃতের রূহে পৌঁছানোর বৈধতা সম্পর্কে উপরোল্লিখিত আলোচনা ও প্রমাণাদি যথেষ্ট বলে মনে করি।
সরকারে বাগদাদ হুযূরে গাউসুল আ’যমের স্মরণে আয়োজিত গিয়ারভী শরীফের মুবারক অনুষ্ঠান কেবল ভারত পাকিস্তানে প্রচলিত নয় বরং সুদীর্ঘ কাল থেকে বুযুর্গানে দ্বীন অতীব গুরুত্ব ও সম্মানের সাথে এটার ব্যবস্থা করে আসছেন। ভারতবর্ষে ইলমে হাদীসের অন্যতম সফল প্রচারক হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘‘নিশ্চয়ই বর্তমানে আমাদের দেশ ভারতে গাউসে পাকের ওরসে গিয়ারভী শরীফের জন্য এগার তারিখই প্রসিদ্ধ। এ তারিখই ভারতবর্ষের আউলিয়া, পীর-মাশায়েখের মধ্যে প্রসিদ্ধ।
এভাবে শায়খ আবুল মহসিন সৈয়দ শেখ মূসা আল-হোসাইন লিখেছেন। হযরত শেখ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভীর ওস্তাদ ও পীর ইমাম আবদুল ওহাব মুত্তাক্বী মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি একই তারিখে গিয়ারভী শরীফ পালন করতেন, তাদের পীর সাহেবরাও এভাবে পালন করতেন।’’
এভাবে আওরঙ্গযেব আলমগীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ওস্তাদ মোল্লা আহমদ জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং তাঁর পুত্র ‘তাফসীরাতে আহমদিয়া’: ২৯ পৃ. আল্লামা গোলাম সরওয়ার লাহোরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কৃত ‘ওয়াজীযুস্ সিরাত’ গ্রন্থে, ‘খযীনাতুল আসফিয়া’ ১ম খন্ড ৯৯পৃষ্ঠায়, দারা শিকো কৃত ‘সফীনাতুল আউলিয়া’ ৭২ পৃষ্ঠায়, হযরত শায়েখ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কৃত ‘‘আখবারুল আখইয়ার’’ ২৪ পৃষ্ঠায়, হযরত শাহ্ আবু আয়ালী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কৃত তোহফায়ে ক্বাদেরিয়া ৯০পৃষ্ঠায়, গিয়ারভী শরীফ উদ্যাপনের বৈধতার প্রমাণ আলোকপাত করেছেন। এভাবে গিয়ারভী, বারভী, দশভী, বিশভী, চেহলাম, ওরস, ফাতেহা, তেলাওয়াতে ক্বোরআন, খাবার পরিবেশন প্রভৃতি অনুষ্ঠান উদ্যাপন জায়েয, মৃতের জন্য উপকারী, বুযুর্গানে দ্বীনের মর্যাদা বৃদ্ধির কারণও বটে। এ প্রসঙ্গে খলীফায়ে আ’লা হযরত সদরুল আফাযিল আল্লামা নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কৃত ‘‘কাশফুল হিজাব আন্ মাসায়েলে ইসালিস সওয়াব’’ কিতাবে নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হলো- গিয়ারভী শরীফ বর্তমান যুগের নতুন কোন আবিষ্কার নয়, বরং আবহমানকাল ধরে মুসলিম সমাজের প্রচলিত পূণ্যময় ও বরকতময় আমল। বুযুর্গানে দ্বীনের সমর্থিত আমলের ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘মা-রাআহুল মুসলিমুনা হাসনান, ফাহুয়া ইনদাল্লাহি হাসানুন’’ অর্থাৎ মুসলমানগণ যা উত্তম মনে করেন, আল্লাহর নিকটও তা উত্তম। গিয়ারভী শরীফ ও মুসলিম বিশ্বে একটি বরকতমন্ডিত ও খতম হিসেবে স্বীকৃত।

তৃতীয় অধ্যায়

দুরূদ ই-তাজ শরীফের উচ্চারণ
‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সৈয়্যেদিনা ওয়া মাওলানা মুহাম্মদিন সাহেবিত তাজে ওয়াল মে’রাজে ওয়াল বোরাক্বে ওয়াল ‘আলাম, দাফি‘ঈল বালায়ে ওয়াল ওবায়ে ওয়াল ক্বাহত্বে ওয়াল মারাদ্বে ওয়াল আলাম, ইসমুহু মাকতূবুন, মারফুউন মাশফুউন, মানকূশুন ফিল্ লাওহে ওয়াল ক্বালাম, সাইয়্যেদিল আরবে ওয়াল আজম, জিসমুহু মুক্বাদ্দাসুন, মু‘অত্তারুন, মোতাহ্হারুন, মুনাওয়ারুন, ফিল বাইতি ওয়াল হারাম, শামসিদ্দোহা, বাদরিদ্দোজা, সদরিলউলা, নুরিলহুদা, কাহফিল ওয়ারা মিসবাহিয যুলাম, জামি-লিশ শিয়াম, শাফিউল উমাম, সাবিহিল জূদি ওয়াল কারাম, ওয়াল্লাহু ‘আসিমুহু, ওয়া জিবরুলু খাদিমুহু, ওয়াল বোরাক্বু মারকাবুহু, ওয়াল মি’রাজু সাফারুহু, ওয়া সিদরাতুল মুনতাহা মাক্বামুহু, ওয়া ক্বা-বা ক্বাওসাইনি, মাতলূবুহু, ওয়াল মাতলূবু, মাক্বছুদুহু ওয়াল মাক্বসূদু, মওজূদুহু, সাইয়্যেদিল মুরসালীন খাতামিন নবীয়্যীনা, শফি‘ইল মুযনেবিনা, আনিসিল গারিবী-না, রাহমাতাল্লিল ‘আলামিনা, রা-হাতিল ‘আশেক্বী-না, মুরাদিল মুশতা-ক্বীনা, শামসিল আরেফিনা, সিরাজিস সালেক্বিনা, মিসবাহিল মুক্বাররাবী-না, মুহিব্বিল ফুকারায়ে ওয়াল গোরবায়ে ওয়াল মাসা-কিন, সাইয়্যেদিল সাক্বালাইন, নবীয়্যিল হারামাইন ইমামিল ক্বিবলাইতন, ওয়াসী-লাতিনা ফিদ্দারাইন, সাহেবে ক্বাবা ক্বাউছাইন, মাহবুবে রাব্বিল মাশরিক্বাইন, ওয়াল মাগরিবাইন, জাদ্দিল হাসানে ওয়াল হোসাইন মাওলানা ওয়া মাওলাস সাক্বালাইন, আবিল ক্বাসেমে মুহাম্মদি ইবনে আবদুল্লাহ্ নূরীম মিন নুরীল্লাহ্ ইয়া আইয়্যুহাল মুশতাকূনা বি নূরি জামালিহি সাল্লূ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লিমূ তাসলী-মা।’’ক্স

দুরূদ-ই তাজ শরীফের বঙ্গানুবাদ
আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়। হে আল্লাহ, আমাদের আক্বা ও মাওলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের উপর রহমত নাযিল করুন। যিনি তাজ, মে’রাজ বোরাক ও ঝান্ডার (সবুজ পতাকার) ধারক, যিনি (আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতায়) বালা মুসিবত মহামারি, দুর্ভিক্ষ, রোগ ও দুঃখ কষ্ট অপসারণকারী। তাঁর নাম মুবারক লিখিত উন্নত (আল্লাহর নামের সাথে সংযোজিত) এবং লওহ ও ক্বলমে খোদিত। তিনি আরব ও অনারবদের সরদার। তাঁর নাম খানায়ে ক্বাবা ও হেরমে পাকের মধ্যে আলোকিত। তিনি মধ্যাহ্ন সূর্য, আঁধার রাতে চাঁদনী, উন্নত মর্যাদার শীর্ষে সমাসীন, হেদায়াত-পথের আলো, সৃষ্টি জগতের আশ্রয়স্থল, অন্ধকার রাতের প্রদীপ। তিনি সুন্দরতম আচরণের ধারক, উম্মতের সুপারিশকারী, দান ও বদান্যতার গুণে গুণান্বিত, আল্লাহ তাঁর রক্ষণাবেক্ষণকারী, জিব্রাইল আলায়হিস্ সালাম তাঁর খাদেম, বোরাক তাঁর বাহন, মি’রাজ তাঁর সফর, সিদরাতুল মুনতাহা তাঁর মক্বাম, (মানযিল বা আল্লাহর নৈকট্যের ক্ষেত্রে) ‘‘ক্বাবা ক্বাউসাঈন’’ (দু’মিলিত ধনুকের মতো সান্নিধ্য)-এর মর্যাদা তাঁর কাঙ্খিত উদ্দেশ্য, এ কাক্সিক্ষত বস্তুই তাঁর কাম্য এবং কাম্য বস্তুই তাঁর অর্জিত, তিনি রসুলকুল সরদার, সর্বশেষ নবী, পাপীদের সুপারিশকারী, মুসাফিরদের প্রতি সহানুভূতিশীল, বিশ্ববাসীদের জন্য রহমত, আশেকদের শান্তি, অনুরাগীদের উদ্দেশ্যস্থল, খোদা-পরিচিতি সম্পন্নদের সূর্য, খোদার পথের পথিকদের, আলোক বর্তিকা, আল্লাহর নৈকট্য ধন্যদের রাহনুমা, অভাবী ও মিসকীনদের প্রতি স্নেহশীল, তিনি জ্বিন ও ইনসানের সরদার, দু’হেরমের নবী, উভয় ক্বিবলার পেশওয়া, দুনিয়া আখিরাতে আমাদের ওসীলা, ক্বাবা ক্বাউসাইনের মহামর্যাদায় আসীন, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের প্রতিপালকের প্রিয়, হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মহান নানাজান, আমাদের (সমস্ত) জ্বিন ও ইনসানের আক্বা অর্থাৎ হযরত আবুল ক্বাসেম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ, যিনি আল্লাহর নূর। হে নূরে মুহাম্মদীর সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগীরা, তোমরা তাঁর উপর এবং তাঁর বংশধর ও সাহাবীদের উপর দুরূদ ও সালাম প্রেরণ করো যেভাবে প্রেরণ করা কর্তব্য। (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

দুরূদ -ই তাজ শরীফের ফজিলত
দরুদে তাজ শরীফ বিশ্ববিখ্যাত ওলী হযরত ইমাম শাযলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর রচিত এক মহা বরকতময় দুরূদ শরীফ। এ দরুদ শরীফ রচনার পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের দরবারে আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্ এ দুরূদ শরীফের মঞ্জুরী দান করুন, যেন এটা ইসালে সওয়াবের সময় পাঠ করা যায়। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তা মঞ্জুর ফরমালেন, খতমে গাউসিয়া শরীফের সাথে দুরূদে তাজ শরীফ পাঠ করা অতীব বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ।
ওলামায়ে কেরামের বর্ণনা মতে দুরূদ-ই- তাজ এর মধ্যে অনেক ফজিলত রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে বর্ণনা করা হল-
১. প্রতি চান্দ্র মাসের প্রথম জুমার রাত থেকে পরবর্তী আরো এগার রাত লাগাতার পবিত্র জামা-কাপড় পরিধান করে সুগন্ধি লাগিয়ে ক্বিবলামুখি হয়ে ১৭০ বার এ বরকতময় দরুদ শরীফ পাঠ করে শয়ন করলে ইনশাআল্লাহ্ হুজুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর দিদার লাভে ধন্য হওয়া যায়।
২. প্রত্যেক দিন ফজর নামাজান্তে নিয়মিত পাঠ করলে রিযক প্রশস্ত হয়।
৩. গর্ভবতী মহিলার গর্ভ জনিত কোন অসুবিধা দেখা দিলে সাত দিন যাবৎ সাতবার করে লাগাতার পানির উপর ফুঁক দিয়ে তা পান করানো হলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
৪. মহামারী ও বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য এগার বার এ দুরূদ শরীফ পাঠ করে ফুঁক দিলে উপকার পাওয়া যায়।
৫. একুশটি খোরমার প্রত্যেকটিতে সাতবার এ দুরূদ শরীফ পাঠ করে ফুঁক দিয়ে প্রতিদিন বন্ধ্যা-স্ত্রীকে খাওয়ালে অতঃপর স্ত্রী হায়য থেকে পবিত্রতা অর্জন ও গোসল করার পর সহবাস করলে আল্লাহর নিকট থেকে সুসন্তান লাভের আশা করা যায়।
৬. পবিত্র কাপড় পরিধান করে ওযূ সহকারে সুগন্ধি লাগিয়ে নিদ্রার পূর্বে যে ব্যক্তি এগারবার দরুদ-ই তাজ শরীফ পড়বে অতঃপর একবার করে সূরা ইয়াসিন শরীফ ও সূরা মুজ্জাম্মিল শরীফ পাঠ করে পুনরায় পাঁচবার দরুদ-ই তাজ শরীফ পাঠ করবে এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার দয়া অনুগ্রহ প্রার্থনা করবে ইনশাআল্লাহ্ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে দিদার দানে ধন্য করবেন।

দুরূদ-ই তাজ শরীফের বরকত
জনাব সুফী খুরশিদ আলম সাহেব ‘‘কাতিব’’ লিপিকার লাহোর নিবাসী বলেন, একদা হযরত সৈয়দ আলী হাজভীরি দাতাগঞ্জ বখশ লাহোরী ক্বুদ্দিসা সিররুহুর দরবারের সাজ্জাদানশীন মিঞা জুবাইর আহমদ ক্বাদেরী যিয়ায়ী ‘দুরূদ-ই তাজ শরীফ লিখার কাজ সম্পাদনের জন্য আমার নিকট আসেন এক পর্যায়ে দুরূদ-ই তাজ শরীফের বরকত সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। এ প্রসঙ্গে আমিও সামান্য স্মৃতিচারণ করলাম যে, আমার শ্রদ্ধেয় হযরত খাজা গোলাম সদীদ উদ্দিন সাহেব সাজ্জাদানশীন মুয়াজ্জম আবাদ (জিলা সরগোদা) একদিন আমাকে বললেন যে, আমার এক মুরীদ শেখপুরা জিলায় বসবাস করতেন, তিনি সুমধুর কণ্ঠে দরুদ-ই তাজ শরীফ তিলাওয়াত করতেন, তাঁর ইন্তেকালের পর অনেক লোকে তাঁর কবর থেকে দুরূদ-ই তাজ শরীফ পাঠের আওয়াজ শুনেছেন।

দুরূদ-ই তাজ শরীফের মু’জিযা
গুজরাট (পাঞ্জাব) এর বলটকা নামক গ্রামে মুহাম্মদ ওমর নামে নয় বৎসর বয়সের এক ছেলে, কঠিনরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত। সকল প্রকার চিকিৎসার পরও সুস্থতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণের পরামর্শ মতে অপারেশন ছাড়া তার আরোগ্য লাভ প্রায় অসম্ভব। এক বুযুর্গ মুহাম্মদ ওমরকে দুরূদ-ই তাজ দম করে পানি পান করিয়ে দিলেন, এরপর ওমর বিস্ময়করভাবে পূর্ণমাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠলো। চিকিৎসকগণ হতবাক হলেন মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট মতে অপারেশন ছাড়া ওই রোগের সুস্থতা কল্পনাতীত। আল্লাহ তা‘আলার অশেষ রহমতে দুরূদ-ই তাজ শরীফের বরকতে মুহাম্মদ ওমর পূর্ণরূপে সুস্থতা ফিরে পেয়েছেন।

দুরূদ-ই তাজ শরীফের বরকতে রওজায়ে আকদাসে হাজিরা
তাফসীর ফয়ূজুল কুরআন প্রণেতা প্রফেসর ড. সৈয়দ হামেদ হাসান বলগেরামী সৌদি আরবের আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটির ইসলামী শিক্ষা বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ইসলামী ইউনিভার্সিটি ভাওয়ালপুর, ‘‘দুরূদ শরীফ কী ফাজায়েল ওয়া বরাকাত’’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেন।
এক বুজুর্গ নিয়মিত গভীর ভক্তি ও নিষ্ঠার সাথে দুরূদ-ই তাজ পাঠ করতেন, সৌভাগ্যক্রমে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রাওযায়ে আক্বদাসে তাঁর হাযিরা হল, সবুজ গম্বুজের ছায়াতলে দীদারে মোস্তফা তাঁর নসীব হল এবং তাঁকে নির্দেশ করা হলো যে, এ দুরূদ শরীফের সাথে শায়খ সাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির রচিত নিম্নোক্ত দরুদ শরীফ পাঠ করো।
بَلَغَ الْعُلٰى بِكَمَالِه ـ كَشَفَ الدُّجٰى بِجَمَالِه
حَسُنَتْ جَمِيْعُ خِصَالِه ـ صَلُّوْا عَلَيْهِ وَالِه
সেদিন থেকে এটা তাঁর নিয়মিত ওযীফা ছিল, অবশ্য অধম (হামেদ হাসান বলাগেরামী) সেসব পরম সম্মানিত বুযুর্গদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও কৃতজ্ঞ, যাঁরা আমাকে দুরূদ-ই তাজ শরীফ পড়ার (ইযাযত) অনুমতি দিয়েছেন।

দেওবন্দি আলিমদের দৃষ্টিতে দুরূদ-ই তাজ
মাওলানা মুহাম্মদ আমীর শাহ্ ক্বাদেরী গীলানী সাজ্জাদানশীন, ‘ইক্কাতুত পেশোয়ার’ তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের একজন শীর্ষ বুযুর্গ আলিম। ২০০০ সনে দেওবন্দি ওলামাদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি ইশতেহার, তথ্যসূত্রসহ পুস্তিকাকারে পেশোয়ার থেকে প্রকাশ করেন, উক্ত ইশতেহারে হীলা, ইসকাত, মীলাদ, মৃত ব্যক্তির ঘর থেকে সাদক্বা করা, দুই ঈদের পর মুসাফাহা করা, মাযারের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা, দুরূদ-ই তাজ পাঠ করা, ওরস উদ্যাপন করা, জানাযা নামাযের পর দুআ করা, আজানে হুযূর পূরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নাম শ্রবণে বৃদ্দাঙ্গুলি চুম্বন করা ইত্যাদি বৈধ ও শরীয়ত সম্মত বলে মত প্রকাশ করেছেন, দুরূদ-ই তাজ সম্পর্কে লিখেছেন-
‘‘দরুদ-ই তাজ যদিও বিধিভাবে উদ্ধৃত, কিন্তু এতে মন্দ বা খারাপ কিছু নেই, যেহেতু যেসব বাক্য সংকলন কুরআন ও হাদীসের বিষয়বস্তুর বিপরীত নয় তাই তা নিন্দনীয় নয়।’’
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম دافع البلاءতথা বালা মুসিবত দুরকারী আক্বিদা পোষণ করা শরীয়ত বিরোধী নয়। রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ওসীলা ও বরকতে পূর্ববর্তী নবীগণ (আলাইহিমুস্ সালাম) এর বালা মুসীবত দূরীভূত হয়েছে। নবীগণ ছাড়া অন্যান্য পূণ্যাত্মাবান্দাদের ক্ষেত্রেও دافع البلاء শব্দের প্রয়োগ জায়েজ।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্ত্বার বরকতে শির্ক, কুফর, বালা মুসিবত, মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও রোগ ব্যাধি দূরীভূত হয়েছে।
উক্ত ইশতেহারে ২৭ জন দেওবন্দি আলেমের স্বাক্ষর রয়েছে।

সন্দেহের অপনোদন
মুহাম্মদ জাফর শাহ্ পাহলওয়ারভী নদভী (করাচি) দুরূদ-ই তাজ সম্পর্কে এমর্মে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে, এতে আভিধানিক ও শাব্দিক ত্র“টি রয়েছে, এ অভিযোগ সর্বপ্রথম মাসিক ফারান করাচি, জুন-জুলাই সংখ্যা ১৯৮০ এ – প্রকাশিত হয়, অতপর সাপ্তাহিক ‘আহলে হাদীস’ (উর্দু) লাহোর ১৭ শাওয়াল ১৪০০ হিজরি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এ ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো সর্বসাধারণের নিকট ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে ‘আদঈয়া পর এক নজর’ নামে লিফলেট আকারে ১৯৮০ সনে প্রকাশ করা হয়, অভিযোগকারীদের ধারণা ছিলো দরুদ-ই তাজ সম্পর্কিত তাঁদের অভিযোগ নামার জবাব দান কারো পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না। আল্লাহর রহমতে তাঁদের স্বরূপ উম্মোচিত হলো, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সিংহ পূরুষ গাযালীয়ে যামান আল্লামা সৈয়দ আহমদ সাঈদ কাযেমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাদের সকল প্রকার ভিত্তিহীন অভিযোগের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিলেন, এ প্রসঙ্গে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ্য তথ্যনির্ভর পুস্তক রচনা করলেন, এটা ছিলো গাযালীয়ে যামানের সর্বশেষ রচিত কিতাব। এর নাম ‘দুরূদে তাজ পর এ’তেরাযাত কে জওয়াবাত’।

আক্বিদার স্ববিরোধিতা
গায়রে মুকাল্লিদ আলেমগণ দুরূদে ইবরাহীমি ব্যতীত সকল প্রকার দুরূদ ভিত্তিহীন, বিদআত, সুন্নাহ সমর্থিত নয় বলে মন্তব্য করেন।
অবশ্য দুরূদে ইবরাহীমি মসনূন দুরূদ শরীফ صلى الله عليه وسلم নিঃসন্দেহে এর অনেক ফজিলত রয়েছে, দুরূদে ইবরাহীমি ছাড়াও আরো অনেক দরুদ মসনুন রয়েছে, যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
এখন দেখুন গায়রে মুকাল্লিদগণ দুরূদে ইবরাহীমি ছাড়াও তাদের দাবী মতে অন্যান্য রচিত দরুদ লিখা জায়েজ মনে করেন কিনা?
গায়রে মুকাল্লিদ মৌলভী মুহাম্মদ ইকবাল কিলানী স্বীয় রচিত ‘দরুদ শরীফ মাসায়েল’ কিতাবের যে পৃষ্ঠায় দুরূদে তাজ ও অন্যান্য দুরূদ প্রসঙ্গে লিখেছেন এ জাতীয় দুরূদ মসনুন নয়, একই পৃষ্ঠায় কিন্তু দশবার দরুদ শরীফ صلى الله عليه وسلم লিখেছেন।
মাওলানা সানাউল্লাহ্ অমৃতসরী গায়রে মুকাল্লিদের প্রথম ফাতওয়া তার রচিত ফাতাওয়া-ই সানাইয়া’র যে পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ হয়েছে, একই পৃষ্ঠায় দু’বার صلى الله عليه وسلم লিখা হয়েছে। এছাড়াও তিনি তাঁর ফাতাওয়ার ১ম খণ্ড ২২১ পৃষ্ঠায় দুরূদ শরীফ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘নামাযে পঠিত দুরূদ শরীফই উত্তম দুরূদ শরীফ। সংক্ষেপে পড়তে চাইলে صلى الله عليه وسلم পড়–ন।

ইসলামী দুনিয়ার সকল গায়রে মুকাল্লিদের প্রতি আমাদের চ্যালেঞ্জ
তারা صلى الله عليه وسلم যে দুরূদ শরীফ লিখেছে তা মসনুন দুরূদ শরীফ হিসেবে প্রমাণ করুক। যদি মসনুন ও হাদীস সমর্থিত প্রমাণ করতে না পারে তাহলে দরুদ তাজকেও তারা জায়েজ হিসেবে স্বীকার করে নিক। গ্রহণ করুক, দুরূদ শরীফের প্রতি তাদের ঘৃণা পরিত্যাগ করুক। প্রকৃতপক্ষে তারা সেটাকে দুরূদ হিসেবে মেনে নিয়ে দরুদ-ই তাজকেও দরুদ হিসেবে মেনে নিয়েছে, কিন্তু হটকারিতার চিকিৎসা তো নেই। صلى الله عليه وسلم দরুদ শরীফও তো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর কয়েকশত বৎসর পর মুহাদ্দেসীন কেরাম প্রবর্তন করেছন, তাঁরা যখন হাদীস শরীফ লিখতেন, قال قال رسول الله -এর পর দুরূদে ইবরাহীমি লিখার পরিবর্তে সংক্ষেপে صلى الله عليه وسلم লিখতেন এ দুরূদ শরীফ তো হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে শিক্ষা দেন নি, না সাহাবায়ে কেরাম পড়েছেন, অথচ আজ পর্যন্ত কেউ এ দুরূদ শরীফ নাজায়েয, বিদআত, বানোয়াট বলেননি বরং অভিযোগকারীরাও এ দুরূদ শরীফ নিজেদের কিতাবে লিখেছেন, পড়েছেন ও বলেছেন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা এ দরুদ শরীফ নাজায়েয, বিদআত, বানোয়াট, ইত্যাদি উক্তি করে না। অথচ দুরূদ-ই তাজ এর আলোচনা আসলেই তাদের যতসব আপত্তি। এরই নাম আক্বীদার স্ববিরোধিতা। ক্বিয়ামতের দিবসে অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে।

দুরূদ শরীফের উপর লিখিত গ্রন্থসমূহ
১. আবু আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ বিন সোলাইমান যাযুলী (৮৭০হি.) ‘দালায়িলুল খায়রাত’ পাক পটন, পাকিস্তান, প্রকাশনায়: দরবারে আলীয়া নক্বশবন্দিয়া আকবরিয়া।
২. সুবকী : তকিউদ্দীন আবুল হাসান আলী বিন আবদিল কাফি ইবনে আলী ইবনে তামিম ইবনে ইউসুফ ইবনে মুসা ইবনে তামীম আনসারী, (৬৮৩-৭৫৬হি./১২৮৪-১৩৫৫খ্রি.) ‘‘শিফাউস সিক্বাম ফী যিয়ারাতি খায়রিল আনাম’’ হায়দ্রাবাদ, ভারত, দায়িরায়ে মায়ারেফে নিজামিয়া ১৩১৫ হি.।
৩. সূয়ূতী: জালালুদ্দীন আবুল ফদ্বল আবদুর রহমান ইবনে আবি বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর ইবনে ওসমান (৮৪৯-৯১১হি./১৪৪৫-১৫০৫খ্রি.) ‘‘হুসনুল মাকসদ ফী আমলিল মাওলাদ’’ বৈরুত, লেবনান, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া (১৪০৫হি.১৯৮৫খ্রি.)।
৪. ফিরোজ আবাদী: আবু তাহির মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে ওমর ইবনে আবি বকর ইবনে আহমদ ইবনে মাহমুদ (৭২৯-৮১৭হি/১৩২৯-১৪১৪খ্রি.) ‘‘আসসালাত ওয়াল বশর ফীস্ সালাত আলা খায়রিল বশর’’ লাহোর, পাকিস্তান, মাকতাবা এশায়াতুল কুরআন।
৫. নাবহানী: ইউসুফ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইউসুফ নাবহানী (১২৬৫-১৩৫০হি.) ‘‘জাওয়াহেরুল বিহার ফী ফাজায়িলিন নবীয়্যিল মুখতার।’’ বৈরুত, লেবানন, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া (১৪১৯হি/১৯৯৮খ্রি.)।
৬. নাবহানী: নাবহানী: ইউসুফ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইউসুফ নাবহানী (১২৬৫-১৩৫০হি.) ‘‘সালাতুস্ সানা আলা সৈয়্যদিল আম্বিয়া’’ হালব, সিরিয়া, দারুল কলম আল আরবী (১৪১৯হি/১৯৯৯খ্রি.)।
৭. নওয়াব সিদ্দিক হাসান কুনুযী, ‘‘আস্ সামামাতুল আম্বরিয়া মিন মাওলিদি খায়রিল বরিয়্যাহ্’’ দিল্লী আল-মাকতাবাতুল আনসারী (১৩০৫ হি.)।
৮. সাহাভী: আবূ আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর ইবনে ওসমান ইবনে মুহাম্মদ (৮৩১-৯০৬হি./১৪২৮-১৪৯৭খ্রি.) ‘‘আল-কাউলুল বদী‘ঈ ফিস সালাতি আলাল হাবিবিস্ শফী’’ মদীনা মুনয়ারা, আল মাকতাবাতুল ইলমিয়া (১৩৯৭হি./১৯৭৭খ্রি.)।
৯. ইবনে হাজর মক্কী, আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে হাজর (৯০৯-৯৭৩হি./১৫০৩-১৫৬৬খ্রি.) ‘‘আদ্ দুররুল মানকুদ ফিস্ সালাতি ওয়াস্ সালামি আলাল হাবিবিস্ শফী’’ মদীনা মুনওয়ারা, দারুল মদীনা আল-মুনওয়ারা (১৪১৬হি./১৯৯৫খ্রি.)।
১০. ইমাম ইবনে হাজর মক্কী (৯৭৪হি.), (ক.) ‘‘তাহরীরুল কালাম ফিল ক্বিয়াম ইনদা যিকরে মাওলিদি সৈয়্যদিল আনাম’’, (খ.) ‘‘তোহফাতুল আখ্ইয়ার ফী মাওলিদিল মুখতার’’।
১১.আবদুল করীম আল বরজঞ্জী (১১৭৭হি.) ‘‘ইক্বদুল জাওহার ফী মাওলিদিন নবীয়্যিল আযহার।’’
১২. ইমাম আহমদ রেযা (১৩৪০হি.) ‘‘আল মানযূমাতুস্ সালামিয়্যাহ্ ফী মাদহি খায়রিল বারিয়্যাহ্’’, মিশর, কাব্যানুবাদ: ড. হুসাইন মুজীব আল মিসরী।
১৩. ইমাম আহমদ রেযা (১৩৪০হি.) ‘‘হাদায়েকে বখশিশ’’।
১৪. খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (১৮৪৩-১৯২৩খ্রি.) ‘‘মুহায়য়্যিরুল উকুল ফী বয়ানে আওসাফ-ই আক্বলিল উক্বূল মাজমুওয়ায়ে সালাওয়াতির রসুল’’ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment