হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর প্রশংসিত উদ্যোগ
➖➖➖➖
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে খারেজীদের নিকট পাঠালেন। অতঃপর তিনি তাদের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ফলে এদের অনেকেই হযরত ইবনে আব্বাসের সাথে চলে আসল। অতঃপর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু এদের নিকট গেলে তারা তাঁর আনুগত্য মেনে নেয় এবং তাদের শীৰ্ষ স্থানীয় দুই নেতা আবদুল্লাহ ইবনে কাওয়া আল ইয়াশকুরী ও শাবাছ আত্তামীমীকে নিয়ে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহর সাথে কুফায় প্রবেশ করে। তৎপর তারা অপপ্রচার চালায় যে, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হুকুমত থেকে তওবা করেছেন। এ কারণে তারা তার নিকট ফিরে এসেছে একথা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু জানতে পেরে তিনি কুফার জামে মসজিদে এ অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করে ভাষণ প্রদান করেন। তখন তারা মসজিদের চারপার্শ্বে শ্লোগান দিচ্ছিলো “লা হুকমু ইল্লাল্লাহ”। (অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন হাকেম বা মীমাংসাকারী নাই)। এ ধ্বনি শুনে খারেজীদের উদ্দেশ্যে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহ তিন দফা আচরণ বিধির ঘোষণা করেন।
(১) তোমাদেরকে মসজিদে প্রবেশে বাধা দেয়া হবে না,
(২) তোমাদের খাদ্য বন্ধ করা হবে না এবং
(৩) তোমরা যদি ফাসাদ সৃষ্টি না কর তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে না। (ফতহুল বারী শরহে বোখারী পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১১ )।
➖➖➖➖➖
খারেজীদের কুফা ত্যাগ
খারেজীরা যখন কুফা ত্যাগ করে মাদায়েনে গিয়ে সমবেত হলো, তখন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু তাদেরকে হেদায়ত করার উদ্দেশ্যে হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত আবু আইয়ুব আনসারী ও হযরত কায়স ইবনে সায়াদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমকে পাঠালেন কিন্তু এ উদ্যোগ ফলপ্রসু হলো না; বরং তারা জেদ ধরল এবং সালিশ নিয়োগের কারণে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে কাফের ঘোষণা দেয় এবং তাকে তাওবার আহবান জানায়। অতঃপর আলী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু পুনরায় দূত পাঠালে তারা হত্যার ষড়যন্ত্র করে।
➖➖➖➖➖
খারেজীদের প্রথম ভ্রান্ত আক্বীদা
“যে ব্যক্তি তাদের আকীদা পোষণ করবে না সে কাফের। তার জানমাল এবং পরিবার-পরিজন তাদের জন্য হালাল।” অতঃপর তারা এ ভ্রান্ত আকীদা প্রচার করতে লাগলো এবং ঐসব মুসলমানদেরকে হত্যা করতে আরম্ভ করলো যারা তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে খাব্বাব ইবনে আরত, যিনি হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পক্ষে ঐ এলাকার গভর্ণর ছিলেন, তাদের পাশ অতিক্রম করায় ও হযরত ওসমান এবং হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমার প্রশংসা করার কারণে হত্যা করে এবং তাঁর অন্তঃসত্বা স্ত্রীর পেট কেটে ফেলে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য হারেস ইবনে মুররাহ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে পাঠালে তারা তাকেও শহীদ করে ফেলে।
➖➖➖➖➖
তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উভয় পক্ষের মনোনীত সালিশ- হযরত মুসা আশয়ারী ও হযরত আমর ইবনে আস রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমার মীমাংসা প্রস্তাবনা যথার্থ অর্থাৎ কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক না হওয়াতে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উক্ত ফয়সালা মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতির লক্ষ্যে কুফার জামে মসজিদে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন এবং পুনরায় সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন।
এমতাবস্থায় খারেজীদের অশুভ তৎপরতা এবং হত্যাযজ্ঞ দেখে বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ সিরিয়া আক্ৰমণ মূলতবী করে খারেজীদের মূলোৎপাটনের উপর জোর দেয়।খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সকল সাহাবা কেরামদের নিকট পছন্দনীয় ছিল। কারণ,হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ফিতনার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে এরশাদ করেছিলেন,“ঐ ব্যক্তির জন্য শুভ সংবাদ, যে খারেজীদের সাথে যুদ্ধ করে আর যুদ্ধ করতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করে” (মিশকাত শরীফ)।
অপর হাদিসে এরশাদ করেন, তাদেরকে হত্যা কর । কেননা, তাদের হত্যা করাতে মুজাহিদের জন্য কেয়ামত দিবসে বড় সওয়াব রয়েছে । (বোখারী শরীফ)।
➖➖➖➖➖
খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু সাহাবা কেরামের পরামর্শক্রমে খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি সৈন্য বাহিনী নিয়ে নাহরাওয়ান পৌছেন। প্রথমে তিনি নসিহত এবং হুমকির মাধ্যমে যুদ্ধের কাজ শুরু করেন।তিনি প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিলেন, “যে ব্যক্তি কুফা চলে যাবে, সে নিরাপদ”।
এ ঘোষণা তীরের মত কাজ করলো। ফলে পাঁচশ জনের মত খারেজী হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর দলে প্রবেশ করলো; আর কিছু সংখ্যক কুফা গমন করলো। তখন খারেজীদের সংখ্যা দাড়ালো চার হাজারে। হযরত আলী
রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সৈন্য বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। এ যুদ্ধে যদিও তাদের শক্তি হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু তারপরও তারা বিভিন্ন স্থানে ফেতনা-ফাসাদে লিপ্ত ছিল। তারা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেয়নি। অবশেষে তাদেরই একজন আবদুর রহমান ইবনে মলজুম বা বলজম ফজরের নামাযরত অবস্থায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে শহীদ করল। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া-ইন্না-ইলাইহে রাজেউন)। (তারিখে ইসলাম কৃতঃ মুফতি আমীমুল ইহসান)।
➖➖➖➖➖
খারেজীদের কুফরি সম্পর্কে ইমামদের অভিমত
হযরত আমীরে মুয়াবীয়া, ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ এবং ইয়াযিদের নানা আক্রমণের কারণে খারেজীরা কিছুদিন গোপনভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।
অতঃপর মারওয়ানের সময়কালে খারেজীগণ ইরাকে নাফে ইবনে আযরাক এবং ইয়ামামায় নাজদা ইবনে আমেরের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে। আর নজদী খারেজী মতবাদে নিম্ন বর্ণিত ভ্রান্ত আকীদাগুলো সংযোজন করে-
(১) যে মুসলমানদের (অর্থাৎ যারা খারেজী নয়) বিরুদ্ধে যুদ্ধে বের হবে না সে কাফের। যদিও সে অপরাপর খারেজী আকীদাসমূহ পোষণ করে।
(০২) বিবাহিত ব্যক্তি যেনা করলে শরীয়ত মোতাবেক পাথর নিক্ষেপের বিধানের রহিতকরণ।
(০৩) চোরের হাত বগল পর্যন্ত কর্তন।
(০৪) ঋতুস্রাব চলাকালীন মেয়েদের উপর নামায ফরয।
(০৫) শক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে ভাল কাজের নির্দেশ এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ পরিহার করবে সে কাফের। আর যদি সামৰ্থ না থাকে তাহলে সে কবীরা গুণাহ করল।
(০৬) কবীরা গুণাহকারী কাফের।
(০৭) যে ব্যক্তি ছগিরা গুণাহ করবে তাকে আগুন ছাড়া অন্যসব শাস্তি দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি সর্বদা ছগিরা গুণাহ করবে সে কবীরা গুণাহকারীর মত এবং সর্বদা জাহান্নামে থাকবে।
(০৮) খারেজীদের অনেকে নামায পাঁচ ওয়াক্ত হওয়াকে অস্বীকার করে এবং বলে বেড়ায়-নামাজ দুই ওয়াক্ত ফরয, (১) ফজর ও (২) এশা।
(০৯) কেউ কেউ আবার ছেলে-মেয়ে, নাতনী, ভাতিজী ও ভাগিনী বিয়ে করাকে জায়েজ মনে করে।
(১০) সুরা ইউসুফ কোরআনের অন্তর্ভুক্ত নয়।
(১১) যে ব্যক্তি শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলল সে আল্লাহর নিকট মুমিন হিসেবে পরিগণিত। যদিও আন্তরিকভাবে কুফরী আক্বীদা পোষণ করে। (ফতহুল বারী শরহে বোখারী, পঞ্চদশ খণ্ড পৃষ্ঠা ৩১২)।
➖➖➖➖➖
কাযী আবু বকর ইবনে আরবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন_খারেজীগণ দুই ভাগে বিভক্ত-
(১) একদল বিশ্বাস করে যে, হযরত ওসমান, হযরত আলী, আমীরে মুয়াবিয়া, আমর ইবনে আ’স এবং জমল’ ও সিফফিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীগণ ও সালিশ নির্ধারণে সন্মতি প্রদানকারী সকলেই কাফের।
(২) অপরদল বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেক কবীরা গুণাহকারী চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।
আবুল মানছুর বাগদাদীর মতে _খারেজীগণ বিশ ভাগে বিভক্ত। (ফতহুল বারী) ।
➖➖➖➖➖
খারেজীদের ভ্রান্ত আক্বীদার সম্প্রসারণ
হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, “তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে যেমন তীর শিকারকৃত প্রাণী থেকে বেরিয়ে যায়। এবং এদের হত্যার পেছনে হুযুর সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়াব ঘোষণা দ্বারা মুজতাহিদ ইমামগণ এদেরকে কাফির সাব্যস্ত করেছেন। ইমাম বোখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, কাযী আবু বকর ইবনে আরবী,ইমাম তল্লীউদ্দিন ছুবকী, ইমাম কোরতাবী ও আল্লামা কাজী আয়ায প্রমুখ প্রখ্যাত ইমামগণ উল্লেখিত হাদিস সমূহের আলোকে খারেজীদেরকে কাফির বলে ফতোয়া দিয়েছেন। যদিও তারা নামায পড়ে, রোযা রাখে, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি ইসলামী বিধি-বিধান পালন করে।
খারেজীদের কুফরীর পেছনে আর একটি সূত্র হলো হুযুর সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে কুফরীর অপবাদ দেবে , কুফরী তার প্রতিই প্রত্যাবর্তন করবে। (মুসলিম শরীফ)। একথা প্রমাণিত সত্য যে, খারেজীগণ সাহাবা কেরামের এক জামাআতকে কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছিল (নাউযুবিল্লাহ)। যার মধ্যে হযরত আলী এবং হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমার নাম উল্লেখযোগ্য। (ফতহুল বারী শরহে বোখারী, পঞ্চদশ খণ্ড পৃষ্ঠা ৩২৯, ৩৩০)। সুতরাং আলোচ্য হাদিসের আলোকেও খারেজীগণ কাফির সাব্যস্ত হয়।
➖➖➖➖➖
খারেজী, ওহাবী, তাবলিগী ও মওদুদী মতাবলম্বী
কোন কোন বিষয়ে খারেজীদের সাথে ওহাবী মওদুদী মতাবলম্বীদের মিল রয়েছে হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তারা সত্য কথা বলবে যা তাদের গলদেশ অতিক্রম করবে না।” অন্যত্র ইরশাদ করেছেন,”এরা সুন্দর কথা বলবে এবং খারাপ কাজ করবে”
একথা প্রমাণিত সত্য যে, মিথ্যা,অপকর্ম ও খারাপ চরিত্রকে মাধ্যম করে কখনো কাউকে গোমরাহ করা যাবে না। কারণ, এদের বাহ্যিক চাল-চলন দেবেই মানুষ তাদেরকে চিনে নেয় এবং তাদের থেকে সর্তক হয়ে যায়। সুতরাং কোন মুসলমানকে পথভ্রষ্ট করতে হলে ইসলামকেই হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা যায়। নিজেদের ভ্রান্তিকে গোপন রেখে সরলপ্রাণ মুসলমানকে সুন্দর সুন্দর কথা বলে মোহিত করবে। অতঃপর তাদেরকে আপন করে নিয়ে নিজেদের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার মাধ্যমে ঈমান হার করবে।
আজকের ঐসব বাতিল ফিরকার কথাবাৰ্তা কতো সুন্দর । মানুষকে কোরআনের কথা বলছে! নামাযের আহ্বান জানাচ্ছে! সুন্নাতের প্রতি উৎসাহিত করছে। কিন্তু এদের কর্মের দিকে তাকালে এমন জঘন্যতম দিকটিও পাওয়া যায়, যা কোন কাফির কিংবা মুশরিকদের জন্য শোভা পায়না বরং এর চেয়েও জঘন্য। দলীয় স্বার্থের জন্য জামাত-শিবির চক্রের মুসলিম হত্যা নীতি। এদের কর্ম-কাণ্ড থেকে প্রমাণ হয়, তাদের তথাকথিত ইসলামী আন্দোলনে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদেরকে যেন হত্যা করা বৈধ বরং সাওয়াবের কাজ। এ কারণেই তারা প্রতিপক্ষ মুসলমানকেও হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী অসংখ্য সুন্নী ওলামাকে হত্যা করিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মূসলমান এদের বাহ্যিক বেশ-ভূষা ও বক্তব্য শুনেই এদের পেছনে নাজাতের পথ খুঁজে।অপরদিকে সুন্নী ওলামা কেরাম এদের মৌলিক নীতিমালা ও ভ্রান্ত আক্বীদা সমূহ সাধারণ মুসলমানদের সামনে তুলে ধরে বক্তব্য রাখতে দেখলে এক শ্রেণীর মানুষ এ বলে মন্তব্য করে যে, দেখুন- “যারা কোরআনের কথা বলছে, নামাযের দিকে আহান করছে ও ভাল কথা বলছে তাদেরকে সুন্নী আলেমগণ ওহাবী, তাবলিগী, জামাত-শিবির বলে আখ্যায়িত করছেন।” এদের ভেবে দেখা উচিত, আলোচ্য খারেজী সম্প্রদায়ের ভাল কথা কোরআনের দিকে আহবান, নামায, রোযা ইত্যাদি
ইসলামী আচার-আচরণ সত্ত্বেও স্বয়ং রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন তাদের সম্পর্কে ঐ মন্তব্য করেছেন। এর একটি মাত্র কারণ ছিল,তারা ইসলামের মৌলিক আক্বীদা থেকে সরে পড়ে নিজেদের মনগড়া আক্বীদাকে ইসলামের নামে চালাতে চেয়েছিল। প্রথমে আক্বীদা দেখতে হবে, অতঃপর আমল। কিন্তু আজকের সাধারণ মুসলমান আমল দেখেই ভাল, মন্দ মন্তব্য করে চলছে। আক্বীদার কোন খোজই নিচ্ছে না। অন্যত্র হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম খারেজীদের সম্পর্কে বলেছেন, “ঈমান ও তাদের তেলাওয়াত কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না।” এর ব্যাখ্যায় মুহাদ্দেসীন কেরাম বলেছেন, এদের ঈমান ও কোরআন তেলাওয়াত শুধু মৌখিক এবং প্রতারণা স্বরূপ। এগুলো তাদের আন্তরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়। কারণ, যারা আন্তরিকভাবে ঈমান গ্রহণ করবে এবং কোরআন তেলাওয়াত সহ অপরাপর পূণ্য কাজ করবে তাদের পক্ষে কোনদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবা কেরাম সম্পর্কে জঘন্য মন্তব্য করা অসম্ভব। তাদের ঈমানী চেতনা বাধা দেবে। কেননা, ঈমান, ইসলাম, কোরআন ইত্যাদি তো তাঁদের তাদের মাধ্যমেই এসেছে। দেখতে হবে এখানেও খারেজীদের সাথে কাদের মিল পাওয়া যায়। মওদুদী বলেছেন, “সাহাবা কেরাম সত্যের মা নয়” সুতরাং তারা সমালোচনার উর্ধেও নয়। তাই তিনি হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহুকে জালিম বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি। (খেলাফত ও মুলুকিয়াত কৃতঃ মওদুদী)।
হযরত ওসমান গণি রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মত খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্যতম একজনকে “খেলাফতের নূ্ন্যতম যোগ্যতার অধিকারীও ছিলেন না” বলে মন্তব্য করেছেন। অনুরূপভাবে ওহাবীগণও সাহাবা কেরামের মহান শানকে খাট করার অপচেষ্টা চালিয়ে বলেছে, “এ উম্মতের কোন কোন বুযর্গ কোন কোন সাহাবা থেকে নিঃসন্দেহে শ্ৰেষ্ঠ ।”
(সিরাতে মুস্তাকিম, কৃত: মৌং ইসমাইল দেহলভী।)।
সাহাবা কেরাম যাঁদের উপর আল্লাহ তা’আলা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, যাদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে; সে ক্ষেত্রে কোন কোন বুযর্গকে সাহাবা কেরাম থেকে শ্ৰেষ্ঠ বলা তাঁদের প্রতি কতো বড় অবমাননা! কারো অবমাননা করা তার প্রতি হিংসারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সুতরাং,
এটা সাহাবা কেরামের প্রতিহিংসারই বহিঃপ্রকাশ; আর এদের প্রতিহিংসা নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হিংসারই নামান্তর। হযুর সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যে তাঁদেরকে (সাহাবা কেরাম) হিংসা করবে, আমার প্রতি হিংসার কারণেই করবে”। (মিশকাত শরীফ)।
অতএব, সাহাবা কেরামের সমালোচনা ও তাদের প্রতি হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো পরোক্ষভাবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমালোচনা ও হিংসারই অন্তর্ভুক্ত।সুতরাং যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমালোচক বা বিদ্বেষী সাব্যস্ত হবে তার পক্ষে ঈমানের কথা ও কোরআনের তেলাওয়াত, তাফসীর ইত্যাদি ধোকাবাজি ছাড়া আর কি-ই বা হবে। যেহেতু রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম খারেজীদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তাই তিনি এরশাদ করেছেন, ‘এদের ঈমান ও তেলাওয়াত তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না’। আজকের ওহাবী-মওদুদীদের ঈমানী শ্লোগান ও কোরআনের আলোচনাকে সুন্নী ওলামা কেরাম তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার কারণে ধোকাবাজী বা প্রতারণা বলে সরল প্ৰাণ মুসলমানদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করলে এক শ্রেণীর মানুষ বলে, সুন্নী আলেমগণ কি এদের মনের খবর জানে।এটা তো গায়েবের বিষয়। এখানে জিজ্ঞাসা,আচ্ছা! হয়তো এটা সুন্নী আলেমদের বেলায় বলছে কিন্তু রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলায় কি বলবে, যিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিলেন, “এদের ঈমান ও তেলাওয়াত কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না”? এখানে যদি রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষণাকে অমূলক বলে তাহলে নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থ বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের বর্ণিত হাদিসকে অস্বীকার করা হবে। অপরদিকে যদি উক্ত ঘোষণাকে যথার্থ এবং সত্য বলে স্বীকার করে তাহলে হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের “এলমে গায়েব” বা অদৃশ্য জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেয়া হলো-যা ওহাবীদের মতে শিরক । (বারাহীনে কাতেয়া, কুতঃ মৌং খলীল আহমদ আম্বিটবী)
মওদুদীর মতেও “রাসুল অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী নন” ।(লণ্ডনের ভাষণ)।
উপরোক্ত হাদিসে খারেজীদের ঈমান এর আলোচনা ও কোরআন তেলাওয়াতকে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার কারণে হুযুর সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিতান্ত মৌখিক; আন্তরিক নয় বলে বর্ণনা দিয়েছেন। আর আজকাল একশ্রেণীর মানুষ ওহাবী-মওদুদী মতাবলম্বীদের ভ্রান্ত আক্বীদা সমূহের প্রতি চোখবন্ধ করে শুধু এদের ঈমানের শ্লোগান ও কোরআনের আলোচনাকে ইসলাম দরদী ও আসল
মুসলমান হবার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখানে হক ও বাতিল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নবী আর উম্মতের মধ্যে কতো ব্যবধান হয়ে গেল! এমতাবস্থায় সিরাতে মুস্তাকীম’ খুঁজে পাওয়া বড় কষ্টসাধ্যই হবে। অন্যত্র হযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম খারেজীদের নিদর্শন বর্ণনা করে বলেছেন- ‘এরা সুন্দর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করবে” । (ফতহুল বারী শরহে বোখারী, পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২২)।
আলোচ্য নিদর্শনটির ক্ষেত্রেও খারেজীদের সাথে আজকের ওহাবী-মওদুদী মতাবলম্বীদের বহুলাংশে সাদৃশ্য বিদ্যমান। এটিই আজকে সাধারণ মানুষকে পথ ভ্রষ্ট করার পেছনে মৌলিকভাবে কাজ করছে। কারণ, মানুষ মধুর কঠের প্রতি আকৃষ্ট । তাই আজকে তারা, নিজেদের জাতির বেড়াজালে সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে আটকানোর জন্য মধুর কণ্ঠকেই হাতিয়ার করেছে। তাফসীরুল কোরআন’ নামে নিজেদের দলীয় ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্যে কোরআন হাদিসের মৌলিক জ্ঞানশূন্য এক কন্ঠ সর্বস্ব ব্যক্তিকে তথাকথিত আন্তর্জাতিক মুফাচ্ছেরে কোরআন উপাধিতে ভূষিত করেছে। যার কণ্ঠে কোরআনের আলোচনা শুনার জন্য মানুষের ভিড় জমে। এটাকেই অনেকে এদের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ তাদের কি আদৌ জানা নেই, “সুমধুর কণ্ঠ কখনো সত্যতার প্রমাণ হতে পারে না। তারা কি জানেনা যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমধুর কষ্ঠে কোরআন তেলাওয়াতকারী একটি দলকে বেদ্বীন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন?
সুতরাং শুধুমাত্র সুললিত কন্ঠের কারণে কাউকে বুযর্গ, ইসলামী চিন্তাবিদ, আল্লাহর প্রিয় ও আসল মুসলমান ইত্যাদি নির্ণয় করা মারাত্মক ভূল হবে। বরঞ্চ সর্বাগ্রে দেখতে হবে তার আক্বীদাকে।
➖➖➖➖➖
জটিলতার নিরসন
প্রশ্নঃ কলেমা পড়া, ঈমানের প্রকাশ, কোরআন এর তেলাওয়াত ও আলোচনা সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াতে কোরআন, কপালে সেজদার চিহ্ন, অধিক এবাদত, নম্রতাসহকারে নামায রোষা ইত্যাদি যদি বাতিলের নিদর্শন হয় তাহলে হকের প্রমাণ কি ?
এর যথার্থ ও সঠিক উত্তর হলঃ কোন ব্যক্তি বা দলের সত্যতা ও নিতান্ত ইসলামী হবার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র এগুলোকে মাপকাঠি হিসেবে দাঁড় করা যাবে না; বরঞ্চ প্রথমে যাচাই করতে হবে তার মৌলিক আক্বীদা ও বিশ্বাসকে। তারপর অপরাপর বিষয়াবলি দেখেই তার সমর্থন করতে হবে। কিন্তু, বর্তমানে এর সম্পূর্ণ বিপরীতই পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ মুসলমান শুধুমাত্র উল্লেখিত বিষয়গুলোকে পরিপূর্ণ ইসলামী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য মাপকাঠি দাঁড় করছে। ফলে প্রতিনিয়ত সাধারণ মুসলমান বাতিলের শিকার হয়ে জাহান্নামের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
কিন্তু মুসলমানদের একটি শ্রেণী কারো ইসলামী বুলিতে সহজে বিশ্বাস করে না; বরং যাচাই করে এদের ঈমান-আক্বীদাকে, পর্যবেক্ষণ করে তাদের বক্তব্যকে, খুঁতে দেখে এদের মূল কোথায়, পাঠ-পর্যালোচনা করে এদের সমূদয় লিখনী। এভাবে আরো অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ অথবা বর্জন করেন। তারাই হলেন-সুন্নী মুসলমান। যদি কেউ বলে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচ্য বাণীগুলো শুধু খারেজীদের উদ্দেশ্যে, যারা ঐ যুগে ফিতনা-ফাসাদ করেছে। এদের সাথে আজকের কাউকে তুলনা করা নীতিসিদ্ধ হবে না। তার উত্তরে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষণাকে পেশ করা যায়; যা তিনি খারেজীদের আলোচনাকালে বলেছেন,এভাবে (মুসলিম সমাজে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রূপে) তারা বের হতে থাকবে।অবশেষে, তাদের শেষ দলটি দাঙ্গালের সাথে বের হবে।
খারেজীদের পরবর্তীতে যতো বাতিল দলের আবির্ভাব হয়েছে তারা সবাই খারেজীদের উত্তরসুরী। সুতরাং, আজকের ওহাবীদেরকে খারেজী নামে অভিহিত করা অত্যুক্তি হবে না। আর ব্যাপক অর্থে তাবলিগী, মওদুদী,কাদিয়ানী সবাইকেও ‘খারেজী” বলা যেতে পারে। কারণ, এরা সবাই রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা কেরাম, তাবেয়ীন, তবই তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহেদীন ও আউলিয়া কেরামের দল “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত” হতে খারেজ বা বহির্ভূত। যদিও বা এরা মৌখিকভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত দাবী করে। খারেজীদের ঈমান ও কোরআন তেলাওয়াতের মত নিতান্ত মৌখিক, আন্তরিক নয়।
➖➖➖➖➖
শিয়া ফিরকা
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তোমার দৃষ্টান্ত কিছুটা ঈসা আলাইহিস সালামের মত। ইয়াহুদীগণ তার প্রতি শক্ৰতা পোষণ করত।তাঁর মা (হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম) এর প্রতি অপবাদ দিয়েছে। আর নাসারাগণ তাকে অধিক ভালবেসে তাকে ঐ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলো, যা তার জন্য শোভনীয় নয়। অর্থাৎ (তাকে ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র বলে আীদা পোষণ করে)। অতঃপর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন,আমাকে কেন্দ্র করে দু’ব্যক্তি (অর্থাৎ দু’ধরণের মানুষ ধ্বংস হবে)
*প্রথমতঃ আমাকে সীমাতিরিক্ত মুহাব্বতকারী, যে আমার এমন প্রশংসা করবে যা আমার মধ্যে বিদ্যমান নেই।
*দ্বিতীয়তঃ আমার প্রতি শক্ৰতা পোষণকারী; এটা তাকে আমার প্রতি অপবাদ দিতে উৎসাহিত করবে। (মাসনাদে আহমদ)
আলোচ্য হাদিসে হযরত মাওলা আলী মুশকিল কোশা রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহুকে সীমাতিরিক্ত মুহাব্বতকারী বলতে শিয়াদেরকে বুঝানো হয়েছে। আর তার প্রতি শক্ৰতা পোষণকারী বলতে খারেজীদেরকে বুঝানো হয়েছে। উভয় দল হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে কেন্দ্র করে চরম লাগামহীনতার পরিচয় দিয়েছে। একমাত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতই হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মর্যাদার যথাযথ সংরক্ষণ করেছে।