কিতাবঃ ইসলামের মূলধারাঃ (পর্ব ১৪) হক ও বাতিল ফির্কা পরিচিতি

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

সুন্নাত ও সুন্নী জামাআত
‘সুন্নাত’ শব্দটি এক বচন, বহু বচন- ‘সুনান’। ‘সুন্নাত’ শব্দ আভিধানিক দিক থেকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়- তরীকা, পথ, পদ্ধতি, নিয়ম, চরিত্র, আদর্শ, রীতিনীতি ও স্বভাব। এ সবকটি সুন্নাত এর অর্থ। এটি ভাল-মন্দ উভয় বিশেষণে ব্যবহৃত হয়। পবিত্র হাদিসে বর্ণিত –

من سن سنة حسنة

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ভাল তরীকা প্রচলন করল। অতঃপর বর্ণিত আছে –

من سن سنة سیئة…

অর্থাৎ যে ব্যক্তি মন্দ তরীকা প্ৰচলন করল। সুন্নাত শব্দের বিপরীত শব্দ হলো বিদআত’ বা নব আবিস্কৃত। ইসলামের মূলধারা ও একমাত্র রূপরেখা সঠিক “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের” শাব্দিক ব্যাখ্যা হবে আহলে সুন্নাত অর্থাৎ হুযুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত বা তরীকা অর্থাৎ আকীদা ও আমলের অনুসারীগণ। আর ‘আল জামা’আত’ দ্বারা সাহাবায়ে কেরামকে বুঝায়।অতএব, যেসব মুসলমান আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে হুযুর করিম সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের অকৃত্রিম অনুসারী তাঁরাই”আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত”। উল্লেখ্য যে, হাদিস শরীফে বর্ণিত ‘সুন্নাত’ দ্বারা রাসুলে মাকবুল সাল্লাল্লাহ তা’আলা আপাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকাকে বুঝানো হয়েছে। আর তরীকা শুধুমাত্র বাহ্যিক আমলের নাম নয়, বরং আক্বীদা ও আমল উভয়ের সমষ্টি গত নাম।আর এক সুন্নাত হলো ‘ফিকহী সুন্নাত’ অর্থাৎ ফিকাহ শাস্ত্রের দৃষ্টিতে আমলের পর্যায়গত একটি অবস্থান। যেমন মেসওয়াক করা, পাগড়া ব্যবহার ইত্যাদি সুন্নাত। হাদিস শরীফে উল্লেখিত সুন্নাত দ্বারা ফিকহী সুন্নাত উদেশ্য নয়, বরং তরীকাই উদেশ্য।

‘ফিকহী সুন্নাত’ দু’প্রকারঃ-

(১) সুন্নাতে মোয়াক্কাদা,
(২) সুন্নাতে যায়েদাহ।

আর ‘সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বা রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা বলতে- ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, মোস্তাহাব মানদুব ও মোন্তাহসানা, সবই অন্তর্ভুক্ত।
➖➖➖
বাতিলপন্থীদের এক ঘৃণ্য ধোকাবাজি
বাতিলপন্থী ওহাবী, তাবলিগী ও মওদুদী মতাবলম্বী আলেমগণ সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে সহজে ধোকা দেয়ার উদ্দেশ্যে বলে বেড়ার- “যারা সুন্নাত পালন করে তারাইতো সুন্নী”। অর্থাৎ যারা দাড়ি রাখে, মিছওয়াক করে, পাগড়ী বাঁধে, ঢিলা করে, তার সবইতো সুন্নী। অথচ ‘সুন্নাত আমল’ ও ‘সুন্নী এক নয়। যদি কেবলমাত্র সুন্নাত পালনের মাধ্যমে সুন্নী হয়, তাহলে কোন বাতিল ফিরকাকেই অন্য নামে চিহ্নিত করা যাবে না। কারণ, এ যাবৎ মুসলমানদের মধ্যে আবির্ভুত সকল বাতিল ফিরকা বাহ্যিক আমল তথা সুন্নাত পালনে বেশ যত্নবান দেখা গেছে। আর এভাবেই তারা সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে সহজে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করে ঈমান-আকীদা ধ্বংস করে চলছে।তাইতো বিশুদ্ধ হাদিস শরীফে বাতিল দলসমূহের আকর্ষণীর আমল দর্শনে ধোকায় না পড়ার জন্য হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সতর্ক করেছেন। পূর্বোল্লেখিত  ‘হাদিস শরীফের আলোকে বাতিল ফিরকা সমূহ’ অধ্যায় দেখুন।যদি শুধুমাত্র সুন্নাত পালনের মাধ্যমে সুন্নী হয় তাহলে খারেজী, শিয়া, রাফেযী, মো’তাযিলা, কদরীয়া, জবরীয়া, মোশাবেহা প্রভৃতি সবাইকেই সুন্নী বলতে হবে। কারণ, প্রত্যেকের মধ্যেই সুন্নাত আমলের বেশ উপস্থিতি বিদ্যমান। সুতরাং, এটা বাতিলপন্থীদের চরম ধোকাবাজি ও কোরআন হাদিসের ঘূণ্য অপব্যাখ্যা। প্রকৃতপক্ষে সুন্নী হলো তারা, যাঁরা ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা সমূহে বিশ্বাসী।

ইসলামী ফিকাহর দৃষ্টিতে যেসব বিষয় সুন্নাত হিসেবে স্বীকৃত ঐগুলোর আমল নিঃসন্দেহে ঈমানদারের জন্য সাওয়াব জনক এবং আল্লাহ তা’আলা ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেযামন্দি হাসিলের অনন্য মাধ্যম এবং নবী প্রেমের স্বাক্ষর।যে ক্ষেত্রে আক্বীদা বিশুদ্ধ না হলে অধিক নামায, রোযা ও অপরাপর আমল নাজাতের উসিলা হতে পারে না, সে ক্ষেত্রে জঘন্য আক্বীদাপোষণ করে সুন্নাতের আমল বৃথা; বরং ধোকাবাজির নামান্তর। সুন্নাত আমল উপকারে আসবে সুন্নীদের জন্য। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মোতাবেক তাদের জন্যই ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত ইত্যাদি কাজে আসবে এবং নাজাতের উসিলা হবে।যারা নবীকুল শিরোমনি হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান শানে জঘন্য বেয়াদবী করে তাদের সুন্নাত’ পালনের কিইবা গুরুত্ব থাকতে পারে? এদের সুন্নাত পালন সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে ধোকায় ফেলে ঈমান-আকীদা ধ্বংস করার অপকৌশল মাত্র।
➖➖➖
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত -এর নামকরণ
বর্ণিত হাদীসে ‘নাজাত প্রাপ্ত একমাত্র দল’ -এর নামকরণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত’ কখন হয়, তা ঠিক করে বলা মুশকিল।তবে এতটুকু জানা যায় যে, আব্বাসীয় খলীফা মুতাওয়াক্কিল-এর শাসনামলে ইমাম আবুল হাসান আশআরী কর্তৃক পেশকৃত আক্বাঈদ প্রকাশিত হবার পর ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ নামটি মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রসার লাভ করে। এই সময় জমহুর উম্মাহ, জামাআত এবং আহলুস সুন্নাহ এই জাতীয় নামের স্থলে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ এই পরিভাষাটি অধিকতর প্রচারিত হয়। মুহাম্মদ আলী যাবী আল ফিরাকুল ইসলামীয়া” গ্রন্থে লেখকের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, এই সময় মুসলিমগণ সাধারণত আবুল হাসান আল আশআরীর মাযহাব অবলম্বন করেন, যা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ সংক্ষেপে সুন্নী নামে অভিহিত হয়। (মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস, পৃষ্ঠা ২৩০)

ইমাম আবুল হাসান আশয়ারী হলেন,হযরত আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহুর অধঃস্তন সপ্তম পুরুষ। তিনি ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের’ দুই মহান ইমামের অন্যতম একজন। তাঁর অনুসারীদেরকে আশায়েরা বলা হয়। ‘কাশ’- এর অধিকারী জনৈক অলি হুযুর করিম সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইমাম আবুল হাসান আশআরী সম্পর্কে স্বপ্নে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তখন হযুর সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমিই বলেছি, আমার উক্তি নিঃসন্দেহে সত্য আর তা হলো-

الايمان أمان والحكومة ايمانيه-

ইমাম আবুল হাসান আশআরী প্রথমে প্রখ্যাত মো’তাযেলী আবু আলী জুব্বায়ীরের শিষ্য ছিলেন। অতঃপর তিনি ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতে’ ফিরে আসেন। অতঃপর তিনি ও তার অনুসারীগণ মোতাযেলা সম্প্রদায়ের।ভ্রান্ত আক্বীদা খণ্ডনে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম আবুল হাসান মাযহাবের দিক থেকে শাফেয়ী ছিলেন। তিনি ২৬০ হিজরী সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৩৩০ হিজরী পরবর্তী সময়ে ইন্তেকাল করেন।

ইমাম আবুল মনসুর মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ সমরকন্দি মাতুরিদী তাঁর উপাধি আলামুল হুদা (হিদায়তের চিহ্ন)। তিনি হলেন ওলামা-এ-আহলে সুন্নাতের ইমাম। তিনি মাযহাবের দিক থেকে হানাফী ছিলেন। ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শিষ্য ইমাম মুহাম্মদের ছাত্র হযরত ইমাম আবু বকর জউযানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ছাত্র হলেন হযরত আবু নসর আয়ায। তাঁর শিষ্য হলেন ইমামে আহলে সুন্নাত হযরত আবুল মনসুর মাতুরিদী। আকাঈদ বিষয়ে তাঁর অনুসারীগণ মাতুরিদী হিসেবে পরিচিত। তিনি বাতিল ফিরকা সমূহের খণ্ডনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব লিখে গেছেন। কিতাবুত তাওহীদ, কিতাবুল মাকালাত, আওহামুল মোতাযিলা, রদ্দুল উসুলিল খামাসা লে-আবি মুহাম্মদ, হাবী ইত্যাদি। হানাফীগণ আকাঈদের ক্ষেত্রে তাঁকেই অনুসরণ করেন। এ মহান ইমাম ৩৩৫ হিজরী সনে জাকারদিস নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন।তাঁর রওযা শরীফ জিয়ারত করে যিয়ারতকারীগণ সর্বদা বরকত হাসিল করেন।(নিধুরাস, পৃষ্ঠা ২৯৯)।

এ দু’জন মহান ইমাম তাঁদের সমকালীন সকল ভ্রান্তআকীদা খণ্ডন করেছেন কোরআন-সুন্নাহর আলোকে। যা ‘হক ও বাতিল’ আক্বীদার পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছে। পরবর্তী সময়ে নতুন নতুন বাতিল দল-উপদলের আবির্ভাব হলে, প্রত্যেক যুগে তাঁদের অনুসারীগণ এসব বাতিল আক্বীদা সমূহের খণ্ডন করেছেন এবং যেসব মুসলমান ঐসব বাতিল আক্বীদা হতে বিরত থেকে সেসব ওলামা কেরামের পদাংক অনুসরণ করেছেন, তারাই হলেন সুন্নী মুসলমান।কেউ কেউ নিজেদের ভ্রান্ত আক্বীদা গোপন করে বলে বেড়ায়, আমরা তো ইমাম আবুল হাসান আশআরী ও ইমাম আবুল মনসুর মাতুরিদীর প্রকৃত অনুসারী, সুতরাং আমরাও সুন্নী। এটা তাদের চরম ধোকাবাজী। কারণ, এ দু’মহান ইমামের পরবর্তী যুগে এমন সব ভ্রান্তির আবির্ভাব ঘটেছে যা তাদের যুগে ছিল না। বিধায় সেসব নিয়ে তারা কোন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত দেননি।অথচ ঐসব নতুন ভ্রান্ত আক্বীদা নিঃসন্দেহে কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী। যেমন “আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন; কিন্তু বলেন না।” (ওহাবীদের আক্বীদা)। “হযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেয়ালের পেছনে কি আছে, তাও জানেন না।” (বারাহিনে ক্বাতেয়া, কৃত: মৌং খলীল আহমদ আডেটভী)। এ ধরণের অনেক ভ্রান্তআক্বীদা আছে যা আকাঈদ পর্বে আলোচিত হবে। অতএব এ ধরণের জঘন্য আকীদা পোষণ  করে শুধুমাত্র অনুসারী হবার বাহানা দিয়ে নিজেদেরকে সুন্নী দাবী করা প্রহসন নয় কি?

অনুরূপভাবে বাতিল ফিরকার আলেমগণ “বাহরুর রায়েক” কিতাবের একটি হাদিসের আশ্রয়ে নিজেদের অসংখ্য ভ্রান্ত আক্বীদাসত্ত্বেও সুন্নী বলে দাবী করে। বলে বেড়ায়, নিম্নোক্ত ১০টি নিদর্শন বা চিহ্ন থাকলেই সে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা আতের অনুসারী বা সুন্নী।

(১) পাঁচওয়াক্ত নামায জামা’আত সহকারে আদায় করা,

(২) সাহাবা কেরামের সমালোচনা ও তাদের কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা থেকে বিরত থাকা,

(৩) ন্যায়পরায়ন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা,

(৪) স্বীয় ইমামে সন্দেহ মুক্ত হওয়া

(৫) দ্বীনের ব্যাপারে কোন প্রকার বাড়া-বাড়ী না করা,

(৬) তাক্বদীরের (ভাল-মন্দ) উপর ঈমান রাখা,

(৭) তাওহীদবাদ কাউকে কাফির আআখ্যায়িত না করা,

(৮) কোন আহলে কিবলার জানাজার নামায পড়া থেকে বিরত না থাকা,

(৯) সফরে কিংবা বাড়ীতে (শরীয়ত সমর্থিত) মোজার উপর মসেহ করাকে বৈধ মনে করা এবং

(১০) নেকার ও বদকার নির্বিশেষে প্রত্যেক লোকের পেছনে নামায পড়াকে যায়েয মনে করা। (তামালাতুল বাহরীর রায়েক, কৃতঃ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হুসাইন ইবনে আলী আতাউরী)।

অতঃপর “হারী” কিতাবের উদ্বৃতি দিয়ে আরো বর্ণিত হয় যে, ঐ মুসলিম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অনুসারী হবে যার মধ্যে এ দশটি বিষয় বিদ্যমান।

(১) আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে এমন কোন উক্তি না করা, যা আল্লাহ তা’আলার গুণাবলীর ক্ষেত্রে শোভা পায়না। (যেমন আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন বিশ্বাস বলে করা),

(২) আল কোরআন আল্লাহর কালাম, সৃষ্টি নয় বলে বিশ্বাস করা,

(৩) জুমা এবং দু’ঈদের নামায প্রত্যেক নেককার বা বদকারের পেছনে যায়েয মনে করা,

(৪) তাকদীর (ভাল-মন্দ) আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বাস করা,

(৫) দু’মোজার উপর মসেহ বৈধ মনে করা,

(৬) ন্যায়পরায়ন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা,

(৭) খোলাফায়ে রাশেদীনকে সকল সাহাবা কেরামের শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করা,

(৮) গুনাহের কারণে কোন আহলে কিবলাকে (অর্থাৎ কিবলার দিকে নামায আদয়কারী) কাফির না বলা,

(৯) আহলে কিবলার জানাযার নামায  বৈধ মনে করা এবং ,

(১০) সুন্নী জামা’আতকে রহমত ও অন্যান্য ফেরকাকে আযাব মনে করা। (তাকমালতুল বাহরীর রায়েক, পৃষ্ঠা ১৮২)

আহলে সুন্নাত এর পরিচয় সম্বলিত হাদিসের উদ্দতি শরহে আরো একটি আক্বাঈদ-এ-নাসাফীতেও বর্ণিত আছে। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নিকট ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের’ পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন শেখাইন অর্থাৎ হযরত আবু বকর সিদ্দিক ও হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমাকে মুহাব্বত করা। খাতানাইন অর্থাৎ হযরত ওসমান ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহুমা সম্পর্কে সমালোচনা না করা এবং দু’মোজার উপর মসেহ করা। (শরহে আক্ৰাঙ্গদ-এ-নাসাফী)।

এখানে লক্ষ্যনীয় যে, শুধুমাত্র উপরোক্ত বিষয়গুলোর ভিত্তিতে কাউকে সুন্নী বলার অবকাশ নেই। কারণ

*প্রথমতঃ এগুলো নির্দশন বা চিহ্ন। স্বরণযোগ্য যে, কোন কিছুর চিহ্ন তার বাস্তব নয় বরং চেনার উপায় মাত্র। গোফ, দাড়ি পুরুষের চিহ্ন কিন্তু হরমোনগত জটিলতার কারণে অনেক নারীরও গোঁফ-দাঁড়ি দেখা যায়। তখন শুধুমাত্র পুরুষের চিহ্নের ভিত্তিতে নারীকে পুরুষ বলা যাবে না। কারণ এগুলো পুরুষের বাস্তব নয়। অনেক পুরুষের গোফ-দাড়ি গজায় না তাকে এ কারণে নারী বলাও যাবে না। কারণ কেবলমাত্র গোঁফ-দাড়ি না থাকা নারীর বাস্তব নয়।

*দ্বিতীয়তঃ এ হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়েও আপত্তি রয়েছে, কারণ এ হাদিস সনদ বিহীন এবং সংকলক কোন কিতাব থেকে সংকলন করেছেন তারও উল্লেখ নেই।

*তৃতীয়তঃ নিদর্শন বা চিহ্ন সমূহের বর্ণনায় মিল নেই। কোন কোন চিহ্ন এক বর্ণনায় আছে অপর বর্ণনায় নেই। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে,
এগুলো তখনকার যুগের পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্ন হিসেবে প্রযোজ্য ছিল; বর্তমানে এসব চিহ্ন যথেষ্ট নয়।বর্তমানে শুধুমাত্র এসব চিহ্নের ভিত্তিতে সুন্নী বলার অবকাশ নেই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে,বর্ণিত চিহ্নসমূহের মধ্যে রয়েছে পাঁচওয়াক্ত
নামাজ জামা’আত সহকারে আদায় করা। এখন কেউ পাঁচওয়াক্ত নামাজ জামাআত সহকারে আদায় করলো। সাথে সাথে এ আক্বীদাও পোষণ করলে যে, “নামাযে রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধ্যান গরু-গাধার খেয়াল থেকে অনেক বেশী খারাপ। “(সিরাতে মোস্তাকিম, কুতঃ মৌং ইসমাইল দেহলভী)”

বলুন, এ ধরণের ঈমান বিধংসী আকীদা নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়কারীকে কিভাবে সুন্নী বলা যাবে। বরং তাকে সুন্নী বলাতো দূরের কথা মুসলমানও বলা যাবে না। এখানে আরো কয়েকটি নিদর্শন নিয়ে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজনীয়। যেমন, নেককার-বদকার নির্বিশেষে সকল মুসলিমের পেছনে নামায পড়াকে বৈধ মনে করা। কিন্তু ফকীহগণ এটাকে সহজভাবে দেখেননি। তারা ফাসিকের পেছনে নামায পড়াকে মাকরুহে তানজীহ বলেছেন। অতঃপর ফাসিককে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন।

    (১) ফাসিকুল আমল,
    ‎(২) ফাসিকুল আক্বীদা। (কবীর, শরহে মুনিয়াতুল মুসল্লী)।

ফাসিকুল আক্বীদা অর্থাৎ ভ্রান্তআক্বীদা পোষণ কারীর পেছনে নামায পড়াকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। অতঃপর কোন মুসলমানকে গুনাহের কারণে কাফির না বলা; কারণ গুনাহের কারণে মুসলমানের ঈমান ধ্বংস হয় না। কিন্তু কোন মুসলমানের কুফরী প্রমাণিত হলে তাকে কাফেরই বলতে হবে, অন্যথায় নিজের ঈমান ধ্বংস হয়ে যাবে।

‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত-এর নামকরণ ঐতিহাসিকদের মতে খলীফা মুতাওয়াক্কিলের খেলাফত কালে অনুমেয় হলেও “বাহরুর রায়েক” কিতাবের বর্ণনা সূত্রে এটা হযুর করিম সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র যবান থেকেই প্রমাণিত। যেমন-

عن عبد الله بن عمر عن النبى صلى الله عليه وسلم أنه قال من كان على السنة والجماعة استجاب الله دعاءه وكتب له بكل خطوة يخطو ها عشر حسنات ورفع له عشر درجات-

অর্থাৎ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহ তা’আলা আনহমা হযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহ তা’আলা তার দোয়া কবুল করেন। তার প্রত্যেক কদমের জন্য দশটি পূণ্য লিপিবদ্ধ করা হবে ও তার দশ দরজা পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে (বাহরুর রায়েক ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২)।

عن على بن أبى طالب رضى الله تعالى عنه أنه قال المؤمن اذا اوجب السنةوالجماعة استجاب الله دعاءه وقضى حواءجه غفر له الذنوب جميعا وكتب له براءة من النار وبراءة من النفاق-

অর্থাৎ হযরত মাওলা আলী রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহ হতে বর্ণিততিনি বলেন, ঈমানদার যখন আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অনুসরণকে নিজের উপর অপরিহার্য করে নেয়, তখন আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। তাঁর চাহিদাগুলো পূর্ণ করেন। গুণাহসমূহ মাফ করেন এবং তাকে জাহান্নাম ও নিফাক (মোনাফেকী থেকে মুক্তি দান করেন। (বাহরুর রায়েক ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২)।

সচেতন পাঠক বৃন্দ! এবার আপনাদের খেদমতে মুসলিম বিশ্বে বিদ্যমান বাতিল দলসমূহের ভ্রান্ত আকীদা গুলো ঐ সব ভ্রান্তদলের কিতাবাদি থেকে উপস্থাপন করছি। পাশা পাশি ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত’ -এর আকীদাগুলোও তুলে ধরছি। যাতে মুসলমানদের মধ্যকার বিভেদের মূল কারণ সমূহ সহজেই অনুধাবন করতে পারে। এবং বাতিল দলগুলোর ভ্রান্ত আীদার সাথে ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা গুলোকে তুলনামূলক যাচাই করে নিজ ঈমান আকীদা শুদ্ধ ও মজবুত করতে সহজ হয়। প্রত্যেক ভ্রান্তদলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রথমে উপস্থাপন করা হবে অতঃপর তাদের ভ্রান্ত আকীদা সমূহ।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment