কিতাবঃ ইসলামের মূলধারাঃ (পর্ব ১৩) চার মাযহাব ও চার তরিকা

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

ইখতেলাফ (মতানৈক্য) ও তার প্রকারভেদ
এ পথিবীতে যতো ধর্মমত রয়েছে প্রত্যেক ধর্মেই মতানৈক্য বিদ্যমান। মৌলিক নীতিবিধান থেকে শুরু করে সামান্য বিষয় পর্যন্ত এ মতভেদ বিস্তৃত। কিন্তু, মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলামে আকাঈদ বা মৌলিক বিশ্বাসে।ইখতেলাফ বা মতানৈক্যের কোন অবকাশ নেই। এতদসত্ত্বেও মুসলমানদের মধ্যে আক্বাঈদ বা মৌলিক বিশ্বাস বিষয়ে যতো মতভেদ এযাবৎ হয়ে আসছে অভিশপ্ত শয়তান, ইয়াহুদী-নাসারা ও অমুসলমানদের ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই হয়েছে। সাধারণ মুসলমানদের নিকট বড়ো প্রশ্ন হলো, আল্লাহ-এক, রাসুল (সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর, কোরআন এক, কেবলা এক; এতদসত্ত্বেও মুসলমানদের মধ্যে এতো মতভেদ কেন? আক্বীদাগত দিক থেকে সুন্নী, ওহাবী তাবলিগী, মওদুদী ইত্যাদি। আমলের দিক থেকে-হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্লবী।তরীকতের দিক থেকে কাদেরী, চিশতী, সোহরাওয়ার্দীয়া ও নকশবন্দীয়া ইত্যাদি। এ বিষয়ে বুঝতে হলে ইসলামী বিধানের প্রকারভেদ ও তার স্বরূপ জানতে হবে।আকাঈদের নির্ভরযোগ্য কিতাব শরহে আত্ত্বাঈদ-এ-নাসাফীর ভূমিকায় বর্ণিত-

ان الأحكام الشرعية منها ما يتعلق بكيفية العمل وتسمى فرعية وعمليةومنهامايتعلق بالاعتقادوتسمى اصلية واعتقادية-

অর্থাৎ শরীয়তের বিধানসমূহের মধ্যে অনেক গুলোর সম্পর্ক আসল পদ্ধতি ও পর্যায়ের সাথে রয়েছে । (যেমন ফরয, ওয়াজিব, মোস্তাহাব, হারাম ও মাকরূহ ইত্যাদি)। এগুলোকে বলা হয় আমল সংক্রান্ত ও শাখা-প্রশাখা বিষয়। (এসব বিষয় যে শাস্ত্রে আলোচিত হয় তাকে বলা হয়- ফিকাহ শাস্ত্র)। শরীয়তের অনেকগুলো বিষয় আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে সম্পূক্ত। এগুলোকে বলা হয় মৌলিক বা বিশ্বাস সম্পর্কিত বিধান। আমল সংক্রান্ত বিধানসমূহ তার বিস্তারিত দলীল সহকারে জানার নাম ‘ইলমুল ফিকহ, আকাঈদ সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার দলীল দ্বারা জানার নাম ইলমে কালাম’।

এক কথায় ইসলামের বিধান দু’প্রকারঃ

(১) আক্বাঈদ বা বিশ্বাস সম্পর্কিত বিধান। যেমন আল্লাহ তা’আলা একক অদ্বিতীয়, তিনি চিরন্তন, তার কোন সমকক্ষ নেই। নবী রাসুলগণ মাসুম বা নিস্পাপ। কবরের আযাব সত্য ইত্যাদি।
(২) আমল সম্পর্কিত বিধান। যেমন নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত, সদকায়ে ফিতর ও কোরবানী ইত্যাদি। প্রথম প্রকার হলে আসল ও মূল ভিত্তি।দ্বিতীয় প্রকারের যাবতীয় বিধান গ্রহণযোগ্য হবার জন্য আক্বাঈদ বিশুদ্ধ হওয়া পূর্বশর্ত।এ জন্য ইমামগণ বলেছেন-

ان كثرةالصلوةوالصيام لا ينفع مع العقيدة ألفا سدة-

অর্থাৎ আকীদা ভ্রান্ত হলে অধিক নামায ও রোযা কোন উপকারে আসবে না। এ জন্য কোরআন পাকে প্রথমে ঈমান, অতঃপর আমলের কথা বলা হয়েছে। যেমন-

وااعصرانلانسان فئة خسر الا الذين امنواوعملوالصالحة-

ঐ মাহবুবের যুগের শপথ, নিশ্চয় মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, কিন্তু যারা ঈমান-এনেছে এবং সৎকাজ করেছে।

অর্থাৎ প্রথম প্রকরের গুরুত্ব বর্ণনা করে ইমামগণ বলেন, যে ব্যক্তি ইলমে কালাম বা আক্বাঈদ সম্পর্কে জানলো না, সে আম্বিয়া কেরাম, কোরআন, হাদিস, উসূলে ফিকাহ ও ফিকাহ কিছুই জানলো না। (নিবরাস শরহে আকাঈদ-এ-নাসাফী,পৃষ্ঠা ১৩)।

ইসলামী বিধানের প্রকারান্তরে ইখতেলাফও দু’প্রকার।
(১) উসুলী ইখতেলাফ বা মৌলিক বিষয়ে মতভেদ,
(২) ফুরোয়ী ইখতেলাফ বা আমল সম্পর্কিত বিষয়ে মতভেদ। অতঃপর পবিত্র কোরআন ও হাদিসে যে ইখতিলাফ ও মতভেদকে উম্মতের ধ্বংস বা ভ্ৰষ্টতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো প্রথম প্রকার মতভেদ। এ প্রকার ইখতেলাফ থেকে দূরে থাকার জন্য পবিত্র হাদিসে হুযুর পুর নুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে বার বার সর্তক করেছেন। হযরত এরবায ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে আছে, তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জিবীত থাকবে, তারা অদূর ভবিষ্যতে অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তোমরা আমি ও আমার
হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের তরীকাকে অবলম্বন করো এবং মজবুতভাবে আকড়ে ধরো। (আংশিক) (ইবনে মাজা, আবু দাউদ, তিরমীযী, আহমদ)। অনুরূপভাবে হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে হযুর করিম সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণ ধ্বংস হয়েছে তাদের নবীগণ সম্পর্কে ইখতেলাফ বা মতভেদের কারণে’। (ইবনে মাজা শরীফ)। আক্বাঈদ সম্পর্কিত বিষয়ে ইজতেহাদ জায়েয নেই। এ বিষয়ে ইজতেহাদ ভ্ৰষ্টতা ও আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে পড়ার কারণ। নিশ্চয়ই এটা জঘন্য পাপ। আক্বাঈদ সম্পর্কিত বিষয়ে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের’ আক্বীদা হলো সবচেয়ে নিরাপদ ও একমাত্র সঠিক পথ ।  (আল ঈমান ওয়াল ইসলাম,পৃষ্ঠা ৭৬,ইস্তাম্বুল, তুরষ্ক)।

ইসলামে এ যাবৎ যতো ভ্রান্ত দল-উপদলের আবির্ভাব ঘটেছে, তারা মূলতঃ আক্বাঈদ বিষয়ে মতানৈক্যের ফলে ইসলামের মূল  ধারা “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত” থেকে বহির্ভূত হয়ে পড়েছে। ওহাবী, তাবলিগী, কাদিয়ানী, শিয়া এবং মওদুদী ইত্যাদি আকীদাগত মতভেদ।নিঃসন্দেহে এগুলো গোমরাহী; বরং এদের অনেক আকীদা কুফুরী। আক্বাঈদ পর্বে তা বিস্তারিত আলোচিত হবে।

দ্বিতীয় প্রকার ইখতেলাফ অর্থাৎ আমল সম্পর্কিত বিষয়ে মতভেদকে হাদিস শরীফে “রহমত” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ের উপর হযরত আল্লামা আবদুর রহমান জাযরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি “রহমতুল উম্মা আলা ইখতেলাফিল আইম্মা” নামক একটি কিতাবও লিখেছেন, যা ইমাম আবদুল ওহাব শা’রানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখিত এতদসম্পর্কিত কিতাবের সাথে মুদ্রিত হয়েছে।এ সম্পর্কে ইমামগণ বলেন, ‘আমাদের ইমামদের মতভেদ হলো শরীয়তের মাসআলাসমূহ ইজতেহাদ ভিত্তিক। তাদের মধ্যে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াবলী ও আক্বাঈদ সম্পর্কিত বিষয়ে কোন মতভেদ নেই।অনুরূপভাবে তাদের মধ্যে শরীয়তের ঐসব বিষয়েও কোন মতানৈক্য নেই যা দ্বীনের মৌলিক বিষয় হিসেবে হাদিসে মুতাওয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে শরীয়তের কিছু কিছু আমল সম্পর্কিত বিধান নিয়ে মতভেদ রয়েছে।এর কারণ হলো তাদের খোদাপ্রদত্ত বোধশক্তি ও দলিলের শক্তির তারতম্য।এ প্রকার ইখতেলাফকে পবিত্র হাদিসে উম্মতের জন্য “রহমত” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।অতঃপর হুযুর সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইচ্ছানুসারে এটা উম্মতের জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। (আল ঈমান ওয়াল ইসলাম পৃষ্ঠা ৭৬)
➖➖➖
চার মাযহাব
কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কেয়াস দ্বারা শরীয়তের বিধানসমূহ নির্ণয় করার পদ্ধতি ও নীতিমালা নিয়ে মুজতাহিদগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও দলীলের অবস্থানুসারে শরীয়তের আমল সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে ঈমামগণের মধ্যে ইখতেলাফ বা মতানৈক্য বিদ্যমান। ইমামের পেছনে সূরা ফাতেহা পাঠ, মোকতাদিগণ উচ্চস্বরে ‘আমিন’ বলা, রুকু থেকে উঠে রফে ইয়াদাইন বা দু’হাত উঠানো ইত্যাদি। এমন অনেক বিষয় নিয়ে মুজতাহিদগণের মধ্যে মতভেদের ফলে হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী হতে অনেক মাযহাবের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মহান চার ইমাম- ইমাম আযম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমের চার মাযহাবই স্থায়ী হয়েছে।অপরাপর ইমাম মুজতাহিদগণের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখিত ইমামগণের কারো না কারো সাথে অভিন্ন ছিল বিধায় সেগুলো এ চার মাযহাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে।ফলে এ চার ইমাম ব্যতিরেকে অন্য কোন ইমামের মাযহাব আজ অবশিষ্ট নেই। সব গুলোই বিলুপ্ত হয়েছে।হযরত আল্লামা শেখ আহমদ মোল্লা জীবন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হানাফী, মালেকী,শাফেয়ী ও হাম্বলী-এ চার মাযহাবের অস্তিত্ব বিদ্যমান।বিশ্বব্যাপী এগুলোর অগণিত অনুসারীর অবস্থান মহান আল্লাহর নিকট এগুলোর গ্রহণযোগ্যতারই উজ্জল প্রমাণ। (তাফসীরাতে আহমদীয়া)

ইসলামের মৌলিক বিধান বা আকাঈদের দিক থেকে চার মাযহাবই “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের” উপর প্রতিষ্ঠিত। চার মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে আকীদা নিয়ে কোন মতভেদ নেই।মহান চার ইমাম একজন অপরজনের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। মহান চার ইমামের অনুপম আদর্শের প্রভাব প্রত্যেক অনুসারীদের উপর পড়েছে।ফলে,শাফেয়ী মাযহাবের অনেক বিশ্ব বরেণ্য আলেম হানাফী মাযহাবের মহান ইমাম হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাতে ইমাম আবু হানিফাকে চার ইমামের মধ্যে “ইমাম আযম” বলে অকপটে স্বীকার করেছেন।ইমাম ইবনে হাজর মক্কী হাইসামী শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, “আল খায়রাতুল হেসান-ফী মানাকেবে আবি হানিফাতান নো’মান” ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন, “তাবয়ীযুচ্ছাহীফা মানাকেবে আবি হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি”। ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বাগদাদ অবস্থান কালে ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মাযার শরীফ যিয়ারতের জন্য কুফা আসতেন। অতঃপর ইমাম আযম রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উসিলা নিয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন। এও প্রমাণিত আছে যে, হাম্বলী মাযহাবের সম্মানিত ইমাম হযরত আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মুনাজাত কবুল হবার জন্য ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উসীলা গ্রহণ করতেন। এতে তার পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিষয় প্রকাশ করলে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বললেন, নিশ্চয়ই হযরত ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মানুষের জন্য সূর্যের ন্যায় এবং দেহের জন্য সুস্থতার মত। (আৰ্দদুরারুদ্ধানীয়া, মুদাররিসুল হারাম পৃষ্ঠা ২৮ ও ফতোয়া এ-শামী-এর মোকাদ্দমা দ্রষ্টব্য)।

চার মাযহাবের সম্মানিত ইমামগণ ও তাদের অনুসারীগণ আক্ৰীদাগত দিক থেকে এক ও অভিন্ন হওয়ার ফলে পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধ আজও অবশিষ্ট রয়েছে। এক মাযহাবের অনুসারী ইমামের পেছনে “ইকতেদা” করতে অন্য মাযহাবের অনুসারীদের কোন সংকোচ নেই, নেই দ্বিধা দ্বন্দ। চার মাযহাবের পারস্পরিক মতভেদের ফলে ইসলামের কোন প্রকার ক্ষতি হয়নি; বরং এর ফলে কোরআন-সুন্নাহর চার্চা ও গবেষণার ক্ষেত্র প্রশস্থ হয়েছে। সাধারণ মুসলমানগণ ইসলামের বিধি-বিধান পালনের এক একটা সুন্দর পদ্ধতি ও তরীকা লাভ করেছে।অন্যথায় প্রত্যেকে স্থান, কাল ও পাত্র অনুসারে আমল করে ইসলামকে হাসির খোরাক বানাতো।চার মাযহাবের সম্মানিত চার ইমাম অক্লান্ত পরিশ্রম করে খোদাপ্রদত্ত প্রতিভাবলে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে যাবতীয় বিষয়ে নীতিমালা ও সুষ্ট সমাধান উদ্ভাবন করে ইসলাম ও মুসলমানদের জীবন পরিচালনার কল্যাণে অপরিসীম অবদান রেখে গেছেন। তাঁরা “চার মাযহাব হক” এর উপর ইজমা বা ঐক্যমত পোষণ করেছেন এবং বলেছেন, যে মুসলিম চার মাযহাবের কোন একটির “তালীদ” অনুসরণ করবে না, সে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অন্তর্ভুক্ত নয়।  (আল ঈমান ওয়াল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৮৫)। চার মাযহাব থেকে বহির্ভুত ব্যক্তি গোমরাহ (তাফসীরে সা’বী) । (বিস্তারিত জাআল হক প্রথম খও দেখুন)।

কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কেয়াসের আলোকে তাক্বলীদ ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মৌং মওদুদীর মন্তব্য কতো জঘন্য! তিনি বলেন, “ইসলামী শরীয়তে এইরূপ হানাফী, শাফেয়ী,আহলে হাদিস প্রভৃতি আলাদা আলাদা দল গঠন করিবার কোন অবকাশ নাই। এইরূপ দলাদলি মূর্খতার কারণেই হইয়া থাকে।” (ইসলামের হাকীকত পৃষ্ঠা ৮০)।

এখানে তিনি হানাফী, শাফেয়ী ও ‘আহলে হাদিস কে একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলেন। আর ঢালাওভাবে সবাইকে মুর্খতার শিকার বলে অভিহিত করলেন। তিনি পরোক্ষভাবে মহান চার ইমামকেই মূর্খ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। (নাউযুবিল্লাহ)। মাযহাবী মতভেদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে কোন প্রকার দলাদলি বিদ্যমান দ নেই।তবে ‘আহলে হাদিসের কারণে দলাদলি বিদ্যমান। হাদিসের মহান ইমামগণের মধ্যে যারা “মুজতাহিদে মুতলাক” (পরিপূর্ণ বা সর্বোচ্চ মানের মুজতাহিদ) ছিলেন না তাঁরা সবাই চার মাযহাবের কোন না কোন একটির অনুসারী ছিলেন। এমতাবস্থায় এ যুগের সাধারণ আলেম ও মুসলমান কিভাবে খেয়াল-খুশী মোতাবেক হাদিস অনুসরণ করে চলবে? সত্য কথা হলো, মৌং মওদুদীর এ ধরণের মন্তব্য আজ মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে দলাদলির জন্ম দিচ্ছে। কোন না কোন একজন ইমামের অনুসরণ ব্যতিরেকে শরীয়তের বিধি-বিধান পালন আদৌ সম্ভব নয়, বিধায় চার মাযহাবের কোন না কোন একটির অনুসরণ ওয়াজিব।

চার মাযহাব আক্বীদাগত দিক দিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের উপরই প্রতিষ্ঠিত।আমলের ক্ষেত্রে পদ্ধতি ও পর্যায়গত পার্থক্যের ফলে এ যাবৎ কোন প্রকার বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়নি। চার মাযহাবের ইমামগণ ও অনুসারীগণ আকীদাগত ভাবে এক ও অভিন্ন হওয়ার ফলে পারস্পরিক কোন হিংসা-বিদ্বেষও নেই; বরং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিধায় চার মাযহাবের পৃথক পৃথক অবস্থান ইসলামী ঐক্যের ক্ষেত্রে অন্তরায় নয় । ইসলামী বা মুসলিম রাষ্ট্রে চার মাযহাবের সহাবস্থানও সমস্যার নয়। আক্বীদাগত মতভেদই মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ও অনৈক্যের মূল ও একমাত্র কারণ ।

ইসলামী ঐক্যের দোহাই দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ বপনকারী মৌং মওদুদীর ভ্রান্ত মতবাদের ফলে পাক-ভারত উপমহাদেশে আজ মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে। তার ঈমান বিধংসী ভ্রান্ত মতবাদ সমাজের প্রতিটি স্তরে দলাদলির জন্ম দিচ্ছে, ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে ঐক্যের প্রাচীরে।এ দলাদলি পরিবার থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত হতে চলেছে। অনেক পরিবারে মওদুদী মতাবলম্বী ভাইয়ের সাথে সুন্নী আকীদা পোষণকারী ভাইয়ের সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন হতে দেখা যাচ্ছে। অনেক সুন্নী পিতা মওদুদী মতাবলম্বী ছেলের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক রাখতে পারছেন না। এ ভ্রান্ত মতবাদের ফলে অনেক মসজিদ,মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে।এ হলো মওদুদীর তথাকথিত ঐক্যমন্ত্রের কুফল।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, বিচার করুন! দলাদলি কি চার মাযহাবের ফলে, না মওদুদীর মতো ইসলাম বিকৃতকারীদের ঘৃণ্য মতবাদের ফলে ?
➖➖➖
চার তরীকা
শরীয়ত হলো মূল আর তরীকা বা তরীকত হলো শরীয়তের সহায়ক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের উত্তম পন্থা। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের ইমাম ও ওলামার নিকট গ্রহণযোগ্য মূল তরীকা হলো চারটি ।

(১) কাদেরীয়াঃ

পীরানে পীর দস্তগীর মাহবুবে সোবহানী, কুতবে রাব্বানী গাউসে আযম শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নামের সাথে সম্পর্কিত।তিনিই এ তরীকার প্রধান ইমাম হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।

(২) চিশতীয়াঃ

সুলতানুল হিন্দ, গরীব নেওয়ায, আতাউর রসুল খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী হাসান সাঞ্জারী আজমিরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ তরীকার প্রধান ইমাম।

(৩) সোহরাওয়ার্দীয়াঃ

হযরত শেখ শেহাবুদ্দীন ওমর সোহরাওয়ার্দী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ তরীকার প্রধান ইমাম।

(৪) নকশবন্দিয়াঃ

হযরত খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ মুশকিল কোশা বোখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ তরীকার প্রধান ইমাম। এগুলোর অনেক
শাখা-প্রশাখা রয়েছে। মোজাদ্দেদীয়া তরীকা নকশবন্দিয়ারই অন্যতম শাখা।

এছাড়াও অনেক তরীকা রয়েছে। তন্মধ্যে যেগুলোর নীতিমালা কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কেয়াসের আলোকে তরীকতের মহান ইমামদের আদর্শ ভিত্তিক, ঐ গুলো গ্রহণ ও অনুসরণ যোগ্য।আর যে গুলো এর পরিপন্থী সেগুলো অগ্রাহ্য ও বর্জনীয়।

চার তরীকা বা ঐগুলোর গ্রহণযোগ্য শাখা-প্রশাখার মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের আত্মিক উৎকৰ্ষ সাধনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লামের সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা।বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের আলোকবর্তিকা মূলত: তরীকতের মহান ইমামগণ ও তাদের অনুসারী আউলিয়া কেরামের মাধ্যমেই প্রজ্জলিত হয়েছে।আউলিয়া কেরামের আদর্শ চরিত্র ও আধ্যাত্মিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কাফির, মুশরিক, ইয়াহুদী, নাসারা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। তাদের সংস্পর্শে এসে মুসলমানগণ থাটি ঈমানদার ও শরীয়তের অকৃত্রিম অনুসারীতে পরিণত হয়েছে।শরীয়ত বিরোধী কাজে লিপ্ত মানুষ আউলিয়া কেরামের নেক নজরে সচ্চরিত্রের অধিকারী হয়েছে। সুতরাং,যাঁদের সাহচার্য অবলম্বন করার পর মুসলমানদের আক্বীদা, আমল ও আখলাক আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত আদর্শ মোতাবেক গড়ে উঠবে না, নিঃসন্দেহে এ সাহচার্য হবে নিস্ফল। আউলিয়া কেরামের সংশ্ররে গিয়ে অগণিত পাপীষ্ঠ লোক পরিপূর্ণ ঈমানদার,খাটি মুসলমান এমনকি, বেলায়তপ্রাপ্ত হয়েছে। আউলিয়া কেরামের জীবনী গ্রন্থে এর হাজারো দৃষ্টান্ত বিদ্যমান।

চার তরীকা ও এগুলোর নীতিভিত্তিক শাখা-প্রশাখাসমূহ ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের’ উপরই পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত।চার মাযহাবের ন্যায় ঐক্ষেত্রেও কোন প্রকার জটিলতা নেই।এক তরীকার অনুসারীগণ অন্য তরীকার মহান ইমাম ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এক্ষেত্রে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব-কলহ থাকার অবকাশ নেই।কারণ, সকল তরীকা আত্নীদাগত দিক থেকে এক ও অভিন্ন। তরীকতের এমন অনেক সম্মানিত পীর মাশায়িখ রয়েছেন যাঁরা একজন একাধিক তরীকার ‘খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে মুসলমানদের মধ্যে যোগ্যতানুসারে তরীকতের দীক্ষা দান করে থাকেন। তরীকাসমূহের মধ্যে কোন প্রকার বৈপরিত্ব না থাকার এটাই উজ্জল প্রমাণ। সুতরাং,চার তরীকা ও এগুলোর শাখা-প্রশাখা ইসলামে দলাদলি নয়; বরং এ হলো বিভিন্ন পন্থায় অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র।পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারকদের শীর্ষস্থানীয় অলী গরীবে নেওয়ায হযরত খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মাযার শরীফ যিয়ারতে চিশতীয়াসহ অপরাপর সকল তরীকার অনুসারীগণ অধীর আগ্রহ ও অকৃতিম শ্ৰদ্ধা সহকারে প্রতিনিয়ত আজমীর শরীফ গমন করছেন। অনুরূপভাবে অন্যান্য যে কোন তরীকার আউলিয়া কেরামদের মাযার শরীফ যিয়ারতে গমন করে থাকেন।এটা তরীকতসমূহের পারস্পরিক যোগসূত্র ও সম্প্রীতির অকাট্য প্রমাণ। অতএব, কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও দ্বন্দ্ব-কলহকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপার বলে ধরে নিতে হবে। কোন তরীকাতেই কোন ধরণের অপকর্মের প্রতি সমর্থন নেই।
➖➖➖
মাযহাব ও মাশরাব (তরীকা) এর পারস্পরিক সেতুবন্ধন
মাযহাব ও তরীকত উভয়ের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। তাইতো মাযহাবের মহান ইমামগণ আধ্যাত্মিক উৎকৰ্ষ সাধনের লক্ষ্যে ইমাম হয়েও তরীকতের ইমামের শরণাপন্ন হয়েছেন।হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দীক্ষা গ্রহণ করেছেন।তিনি বলতেন আমি যদি তার দরবারে কিছু কাল সংস্পর্শে না থাকতাম তাহলে ধ্বংস হয়ে যেতাম। অন্যান্য ইমামদের বেলায়ও একই দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।অপরদিকে তরীকতের মহান ইমামগণ শরীয়তের বিধি বিধান পালনে চার মাযহাবের যে কোন একটির তাক্বলীদ করেছেন। চিশতীয়া তরীকার ইমাম সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়ায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন। মাযহাবের দিক থেকে হানাফী। হযরত সেহাবুদ্দীন ওমর সোহরাওয়াদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন শাফেয়ী। হযরত গাউসে আযম মাহবুবে সোবহানী শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন হাম্বলী-এ- আকবর মুহিউদ্দীন ইবনে আরবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। হযরত শেখ ছিলেন মালেকী। (তারিখ ইলমে ফিকহ)। মাযহাব ও মাশরাব (তরীকা) এর মধ্যে কোন প্রকার বৈপরিত্ব নেই; বরং পরস্পরের মধ্যে রয়েছে গভীর সেতুবন্ধন। বিশ্বের অসংখ্য হানাফী মাযহাবের অনুসারী গাউসে আযম হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী হাম্বলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির তরীকা-এ-আলীয়া কাদেরীয়ার অনুসারী। অনুরূপভাবে হানাফী অধ্যুষিত বাংলাদেশের সকল সুন্নী মুসলমান হযুর গাউসে আযম রাহমাতুল্লাহি আলাইহির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন।

অতএব, ভিন্ন ভিন্ন নাম ও আমলের পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকলেও মাযহাব ও যাশরাবসমূহের মধ্যে মূলতঃ কোন বৈপরিত্য নেই।কারণ, মাযহাব ও তরীকতগুলো ইসলামের একমাত্র সঠিক রূপরেখা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের’ উপরই প্রতিষ্ঠিত। মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্ট সকল দলাদলি ও অনৈক্যের মূল কারণ হলো-আকীদাগত মতপার্থক্য । এটি যতক্ষণ দূরীভূত হবে না ততোক্ষণ পর্যন্ত দল-উপদলে বিভক্ত মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হবার সম্ভাবনাও নেই।

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment