ফিরকা-এ-আহলে কোরআন
যে সব বাতিল ফিরকার আবির্ভাব সম্পর্কে হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন তন্মধ্যে ‘ফিরকা-এ-কোরআনী’বা আহলে কোরআন অন্যতম। অন্য ভাষায় এদেরকে ‘মুনকেরীন-এ-হাদিস’ বা হাদিস অস্বীকারকারী দলও বলা হয়। এদের ভ্রান্তমতবাদ হলো,পবিত্র কোরআনে সব কিছু আছে; সুতরাং হাদিসের কোন প্রয়োজন নেই। হেদায়তের জন্য কোরআনই যথেষ্ট, হাদিসের আদৌ দরকার নেই। পবিত্র কোরআনকে আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট বয়ান বলে অভিহিত করেছেন। অনুরপভাবে কোরআনকে ‘হাদী’ বা পথ প্রদর্শক বলেছেন। অতএব, কোরআনই যথেষ্ট। এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক, ভিত্তিহীন ও চরম গোমরাহীর পরিচায়ক।
কারণ হাদিস শরীফের বর্ণনা ব্যতিরেকে কোরআনের উপর আমল করাই অসম্ভব ইসলামের মৌলিক বিধানসমূহের মধ্যে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের যথার্থ বাস্তবায়ন হাদিস শরীফ ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। কারণ পবিত্র কোরআন “সালাত কায়েম কর” এতটুকু বলেছে; কিন্তু কিভাবে, কখন ইত্যাদির স্পষ্ট কোন বর্ণনা কোরআন পাকে নেই। এমনকি “নামায পাঁচ ওয়াক্ত” তার বর্ণনাও ধারাবাহিকভাবে কোরআন পাকে উল্লেখ নেই। অতঃপর কোন্ ওয়াক্তে কয় রাকআত পড়বে, রুকু, সেজদার নিয়ম কি, কিভাবে নামায শুদ্ধ হবে, কিভাবে ভঙ্গ হবে কোন বিষয়ের বিবরণ কোরআন পাকে নেই। এভাবে অন্যান্য বিধানের বেলায়ও। এসব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ পবিত্র হাদিস শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। মুসলমানদের মধ্যে কোরআন পাকের অকৃত্রিম অনুসারীর দাবী নিয়ে পবিত্র হাদিস অস্বীকারকারী একটি ভ্রান্তদলের আবির্ভাব হবে তা অদৃশ্যজ্ঞানের অধিকারী নবী হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম চৌদ্দ’শ বছর পূর্বে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে দীর্ঘ চৌদ্দ’শ বছরের মধ্যে হাদিস অস্বীকারকারী কোন ব্যক্তি বা দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেনি। হিজরী চৌদ্দ’শ শতাব্দীতে এসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আর এ ভ্রান্ত দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটলো পাঞ্জাবের মিয়ানবী জেলার অন্তর্গত চাকরালা নামক এলাকায় আব্দুল্লাহ চাকরালভীর নেতৃত্বে। তার মধ্যে হাদিস শরীফে বৰ্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলোও বিদ্যমান ছিল। এ ভ্রান্ত দলের ভবিষ্যদ্বাণীর উপর বর্ণিত হাদিসগুলো উদ্বৃত করলাম যাতে পাঠক সমাজ এদের ভ্রান্তআকীদা থেকে সতর্ক হতে পারে।
*একঃ হযরত আবু রাফে রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন পৰ্দাবুলানো খাটের উপর হেলান দেয়া অবস্থায় না পাই যে, তার নিকট আমার বিধান সমূহ থেকে যা আমি হুকুম করেছি বা নিষেধ করেছি তা পৌছবে, অতঃপর সে বলবে আমি জানিনা কোরআন শরীফে যা পাব, তার অনুসরণ করব। (মসনদে আহমদ, তিরমিযী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ,ইবনে মাজা শরীফ, মিশকাত শরীফ ও দালায়েলুন্নবুওয়াত)।
*দুইঃ হযরত মিকদাম ইবনে মাদিকারুবা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “শুনো আমাকে কোরআনও দেয়া হয়েছে তার সাথে অনুরূপও (অর্থাৎ হাদিস শরীফ); হুশিয়ার এক ব্যক্তি উদর ভৰ্ত্তি, পর্দা ঝুলানো খাটের উপর হেলান দিয়ে বলবে, “তোমরা কোরআনকে আঁকড়ে ধর। এতে যা হালাল পাও তাকে হালাল মেনে নাও, আর তাতে যা হারাম পাও তাকে হারাম মনে কর।” সাবধান নিশ্চয় রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক হারাম কৃত বিষয় বা বস্তু আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃতের মত। দেখো! তোমাদের জন্য গৃহ পালিত গাধা এবং পায়ে ধরে ভক্ষণ করে এমন পশু (ও পাখী) হালাল নয়। অনুরূপভাবে ওয়াদাবদ্ধ কাফিরের হারানো বস্তু, তবে হ্যাঁ যখন মালিক তার মুখাপেক্ষী না হয়। যে ব্যক্তি কোন গোত্রের নিকট মেহমান হয় তখন তাদের উচিত তার মেহমানদারী করা। যদি তার মেহমানদারী না করে তাহলে সে তাদের নিকট হতে আতিথেয়তার খরচ পরিমাণ উসুল করতে পারবে।(এসব বিষয় হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত। কোরআন শরীফে এগুলোর বিবরণ নেই)। (আবু দাউদ শরীফ, দারমী শরীফ ও মিশকাত শরীফ)।
*তিনঃ হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হুযুর দণ্ডায়মান হলেন। অতঃপর বললেন, “ তোমাদের মধ্যে কেউ কি পালংকে হেলান দিয়ে এ ধারণা পোষণ করবে যে, আল্লাহ তা’আলা কোরআন
শরীফে উল্লেখিত বিষয় বা বস্তুসমূহ ছাড়া কোন কিছু হারাম করেন নি? হুশিয়ার!নিশ্চয়ই আমি যা নির্দেশ দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি এবং অনেক বিষয় নিষেধ করেছি, নিশ্চয়ই ঐ গুলোও কোরআনের সমান বা তার চেয়ে সংখ্যায় অধিক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য বিনা অনুমতিতে আহলে কিতাব
(ইয়াহুদী ও নাসরা)-এর ঘরে প্রবেশ করা,তাদের মহিলাদের মারধর করা এবং তাদের ফল-মূল ভক্ষণ করা হালাল করেননি যখন তারা তাদের উপর নির্ধারিত হক (কর) তোমাদের নিকট আদায় করবে । (আবু দাউদ শরীফ ও মিশকাতশরীফ)।
আলোচ্য তিনটি হাদিসের দুটিতে একটি বাক্য সমভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে কেউ পর্দা ঝুলানো পালংকে হেলান দিয়ে বলবে। এর ব্যাখ্যায় হাদিস বিশারদগণ বিভিন্ন অভিমত পেশ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ ঐ ব্যক্তি বেশ সম্পদশালী ও খোড়া হবে। আবার কেউ বলেন, এর অর্থ এ ফিরকার প্রতিষ্ঠাতা বড় আরাম প্রিয় হবে এবং ঘরে অবস্থান করবে। দ্বীনি শিক্ষার্জনে দেশ দেশান্তরে সফর করবে না। আর কেউ বলেন, এর দ্বারা তার অহংকারী মনোভাব এবং চাল চলনের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে । (মিরআত শরহে মিশকাত)।
বাস্তবেও এ ভ্রান্তদলের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ চাকরালভী খোড়া ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। এটা হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের উজ্জ্বল প্রমাণ যে, তিনি ভ্রান্ত দলসমূহের এবং সেগুলোর নেতৃবৃন্দের দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহও বলে দিয়েছেন। যাতে উম্মতগণ তাদের থেকে নিজেদের ঈমান ও আমল হেফাজত করতে পারে। বড় পরিতাপের বিষয় কোরআন পাককে কেন্দ্র করেও একদল পথভ্রষ্ট হবে। এটাও কোরাআন পাকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে- কোরআন করিম দ্বারা অনেকে গোমরাহ হবে,আবার অনেকে হেদায়ত পাবে। (সুরা বাকারা)।
বস্তুতঃ ইসলামী শরীয়তের বিধানসমূহ সংখ্যার দিক থেকে কোরআন পাকের তুলনায় হাদিস শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। কারণ, কোরআন হলো সংক্ষিপ্ত বিবরণ, আর হাদিস শরীফ হলো তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। এমতাবস্থায় হাদিস শরীফ অস্বীকার করা মানে পবিত্র কোরআনকেই অস্বীকার করা। বর্তমানেও একশ্রেণীর ভন্ডসূফী হাদিস শরীফ অস্বীকার করার পায়তারা চালাচ্ছে। অনুরূপভাবে আবুল আ’লা মওদুদীও তার মনপূত না হওয়ার কারণে অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিসকে মনগড়া ভিত্তিতে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ)
উপরে ইসলামে আবির্ভূত কয়েকটি ভ্রান্ত ফিরকা বা দল সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হাদিসসমূহ থেকে হাদিস সংকলন করা হলো। যাতে মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান ফিরকাবন্দি, দলাদলি ও মতানৈক্যের স্বরূপ বুঝে উঠতে সরলপ্রাণ মুসলিমগণ সক্ষম হয়। কারণ এক শ্রেণীর সরলমনা আধুনিক শিক্ষিত সুন্নী-ওহাবী বা অপরাপর আকীদাগত বিরোধকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয়।
ফলে পরবর্তীতে এ সরলতার দরুন নিজেই কোন না কোন ভ্রান্তদলের জালে আটকা পড়ে ঈমান, আমল ধ্বংস করে বসে। এভাবে উড়িয়ে না দিয়ে যদি এসবের পেছনে কি কি কারণ নিহিত বা কেন এমন হচ্ছে এ বিষয় বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যাচাই করেন তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহর মেহেরবাণীতে সত্যের সন্ধান পাবেন এবং ফেরেস্তারূপী শয়তানদের স্বরপ উন্মোচনে সফল হবেন।সরলপ্রাণ মুসলমানগণ বাতিল ফিরকার লোকদের বাহ্যিক আমলসমূহ দেখে যাতে ধোকার শিকার না হয়, তজ্জন্য হুযুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখিত হাদিসসমূহে তাও স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, হে আমার প্রকৃত অনুসারী উম্মতগণ!“তোমরা তাদের নামায,রোযা ও আমলের সামনে নিজেদের নামায, রোযা ও আমলকে নগন্য মনে করবে।” এতদসত্ত্বেও তিনি তাদেরকে ভ্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাদের আক্বীদাগত ভ্রান্তির কারণে।
অতএব, আমাদেরকেও কারো শুধুমাত্র বাহ্যিক আচার-আচরণ, নামায, রোযা, তেলাওয়াতে কোরআন এবং সুন্দর সুন্দর কথায় মুগ্ধ না হয়ে সর্ব প্রথম তার আক্বীদাগত অবস্থান যাচাই করা একান্ত কর্তব্য। কারণ, আক্কীদাই হলো আসল ভ্রান্তআক্বীদা পোষণ করে অধিক নামায, রোযা পালন কোন উপকারে আসবে না। (হাশিয়া-এ-ইবনে মাজা)।