কিতাবঃ আল-ক্বাওলুল হক্ব

পোষ্টটি অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিতে শেয়ার করুন প্লিজ।

আল্-ক্বাওলুল হক্ব

اَلْـقَـوْلُ الْـحَـقُّ

(জানাজায় উচ্চরবে যিকির জায়েয প্রসঙ্গে)

রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (رحمة الله)

প্রকাশনায়ঃ আন্জুমানে কাদেরীয়া চিশ্তীয়া আজিজিয়া, বাংলাদেশ।

অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মন্নান (এম.এম.এম.এফ)

সাবেক মুহাদ্দিছ, ছোবহানিয়া আলীয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

টেক্সট রেডীঃ ডা. মাসুম বিল্লাহ সানি

সার্বিক তত্ত্বাবধানঃ শাহজাদা আল্লামা আবুল ফরাহ্ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন

অধ্যক্ষ- ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মুঈনীয়া কামিল মাদ্রাসা

সংস্করণঃ এম.এম. মহিউদ্দীন

নির্বাহী সম্পাদক- মাসিক আল-মুবীন

(লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত)

অর্থায়ন

গোলাম মোস্তফা

পিতা- নুর আহমদ

দক্ষিণ নাঙ্গলমোড়া, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রকাশকাল

১ম প্রকাশ- ১লা নভেম্বর ১৯৮১ ইংরেজি

২য় প্রকাশ- ১লা জুলাই ২০০৮ ইংরেজি

৩য় প্রকাশ- ১লা জুন ২০১৭ ইংরেজি

হাদিয়া : ৭৫ (পঁচাত্তর) টাকা মাত্র

সূচীপত্র

নং বিষয় পৃষ্ঠা নং

১ অনুবাদকের কথা

২ অভিমত

৩ মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পথচলার সময় উচ্চস্বরে যিকির করা শরীয়ত মতে বৈধ

৪ আল্লাহ্পাক পবিত্র কোরআনে সম্মিলিতভাবে অধিকহারে যিকির করার নির্দেশ

৫ হাদিস দ্বারা জানাজায় অধিক পরিমাণে যিকিরের বর্ণনা

৬ সমাজে প্রচলিত কার্যকলাপ শরীয়ত নির্দেশিত পাবন্দীরই নামান্তর

৭ বর্তমান প্রেক্ষাপটে জানাজায় উচ্চস্বরে যিকির করা জায়েয ও মোস্তাহাব

৮ যুগের পরিবর্তনে শরীয়তের বিশেষ বিশেষ বিধির পরিবর্তন

৯ উচ্চরবে যিকির করা তালক্বীনের অন্তর্ভূক্ত

১০ সব নব প্রচলিত কাজ বর্জনীয় বা মাকরূহ নয়

১১ সৎ নিয়্যতের উপরই কর্তার ফলাফল নির্ধারণ

১২ পবিত্র কোরআনে সীমালঙ্ঘনকারী বলতে কি বুঝায়েছে এর বর্ণনা

১৩ হুজুর (ﷺ) উচ্চস্বরে দোয়া করার বর্ণনা

১৪ হানাফী মাজহাব মতে উচ্চস্বরে যিকির জায়েয

১৫ আল্লাহর আজাব ও শাস্তি হতে যা সর্বাধিক মুক্তি দিতে পারে তা হল আল্লাহর যিকির

১৬ জানাজায় যিকির করা বিদয়াত কিংবা সুন্নাহর পরিপন্থী ও ধর্মে তেলেসমাতি নয়

অনুবাদকের কথা

حامدًا ومُصليًا ومُسلمًا 

একথা অনস্বীকার্য যে, হুজুর (ﷺ) ও ছাহাবায়ে কেরামের মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত একক ‘জমাত’ হল-‘আহলে সুন্নত ওয়াল জমাত’। যুগ যুগ ধরে এ জমাতের ওলামা কোরআন, সুন্নাহ, এজমা, কিয়াস ও ওরফ এর ভিত্তিতে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং যুগোপযোগী বিভিন্ন ছওয়াব-কর্মের শিক্ষা দিয়ে আসছেন। মুসলিম সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত ‘জানাজা’ নিয়ে পথ চলার সময় উচ্চরবে ‘আল্লাহু রাব্বী’ মুহাম্মদ নবী, কিংবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ; মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্’ ইত্যাদি ‘যিকির’ করার শিক্ষাও অন্যতম। তা সম্পূর্ণ শরীয়ত-সম্মত। শরীয়তের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদিতে তার দলীলাদি যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। নিঃসন্দেহে তা মৃত ও জীবিত উভয়ের জন্য উপকারী।

কিন্তু পরবর্তী যুগে কোন কোন বাতিলপন্থী আলেম অন্যান্য বহু পূণ্যময় কর্মের ন্যায় উপরোক্ত কাজটিকেও নাজায়েজ বা বর্জনীয় বিদয়াত বলে ফতোয়া দিয়ে মুসলমানদেরকে তাতে বাধা প্রদানের অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। স্থানীয় জনৈক (তথাকথিত) আলেম আলোচ্য বিষয়ে কতিপয় ভিত্তিহীন মতামত সম্বলিত এ সম্পর্কে পুস্তক-পুস্তিকাও প্রকাশ করেছেন। তারা স্বপক্ষে মনগড়া প্রমাণাদি ও খন্ডনীয় কতিপয় বিতর্কিত উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে বিভ্রান্তির পথ উন্মুক্ত করার অপচেষ্টায় রত হয়েছে।

এমতাবস্থায় কোন সচেতন বিবেক-সঞ্জাত লেখনী শক্তি তার মণিকোটায় অস্পন্দিত থাকতে পারে না। সুতরাং আলোচ্য কার্যটিতে বাধা প্রদানকারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ, এজমা, কিয়াস এবং নির্ভরযোগ্য কিতাবাদির আলোকে উক্ত কার্যটির বৈধতা প্রমাণ করে যুগোপযোগী বিভিন্ন জনপ্রিয় পুস্তক-পুস্তিকার প্রণেতা, দেশের স্বনামধন্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, জমাতে আহলে সুন্নতের অন্যতম কর্ণধার, যুগের অন্যতম শরীয়তবেত্তা হযরতুলহাজ্ব আল্লামা আজিজুল হক আল্-কাদেরী দামাত বরকাতু হুমুল আলীয়া ‘আল-ক্বাওলুল হক্ব’ নামক পুস্তকখানা রচনা করেন। তিনি অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা বিপক্ষীয়দের উপস্থাপিত দলীলাদি ও তথাকথিত যুক্তির খন্ডন কিংবা সমাঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে উর্দু ভাষায় লিখিত এ পুস্তকে একথাই প্রমাণিত করেছেন যে, ‘জানাজা’ নিয়ে পথ চলার সময় উচ্চ রবে ‘আল্লাহু রাব্বী মুহাম্মদ নবী’ কিংবা ‘কলেমা তৈয়্যেবাহ’ পাঠ করা জায়েজ ও মোস্তাহাব এবং নিঃসন্দেহে তা যুগোপযোগী একটি ‘শরয়ী ফয়সালার’ বহিঃপ্রকাশ। পুস্তকখানা পর্যালোচনা করে প্রতিটি সচেতন পাঠক এ নিরেট সত্য অনুধাবন করতে পারবেন-এতে সন্দেহ নেই।

কাজেই, পুস্তকটির প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে তা সরল বাংলা ভাষায় অনূদিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। অতএব, আমি শ্রদ্ধেয় রচয়িতা কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে পরম দয়ালু রাব্বুল আলামীনের অপার মেহেরবাণীর উপর ভরসা করে পুস্তকটির অনুবাদে হাত দিই। মূল পুস্তকের সাথে শাব্দিক ও তাত্তি¡ক সামঞ্জস্য রক্ষা করে অনুবাদকার্য সম্পাদনে সযতœ চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও ত্রুটি বিচ্যুতি অস্বাভাবিক নয়। পরিশেষে আমার সে ত্রুটি বিচ্যুতির দিকে দৃষ্টিপাত ব্যতিরেকে বইখানা পাঠ করে পাঠকবৃন্দ উপকৃত হলে নিজেকে ধন্য মনে করব।

        ইতি-

           অনুবাদক

অভিমত

حامدًا ومُصليًا ومُسلمًا 

আমি (অধম) এ পুস্তিকাখানা আদ্যোপান্ত গভীর দৃষ্টি সহকারে পড়ে দেখেছি। প্রশ্নেয় বিষয়টির জবাবদাতার জন্য আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করছি; যেন তিনি লেখককে এ মহৎ কর্মের উপযুক্ত ফল দান করেন। জবাবদাতা সঠিক জবাবই দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, বিশেষ বিশেষ কয়েকটি স্থান ব্যতীত সর্বত্রই উচ্চরবে যিকির করা শরীয়ত মতে বৈধ; এতে সন্দেহের অবকাশ নেই; তা সর্বজন স্বীকৃতও বটে। সুতরাং ‘জানাজা’ নিয়ে পথ চলার সময় তা নাজায়েজ বা অবৈধ হবার কোন কারণ নেই। তদুপরি, হুজুর (ﷺ) হাদিস শরীফে এরশাদ করেছেন-    لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ 

অর্থাৎ: “তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তিদেরকে ‘তালকীন’ বা শিক্ষা প্রদান কর।” এ হাদিসে ‘সরব’ বা ‘নীরব’ এর কোন বিশেষত্বের উল্লেখ নেই; সাধারণ ভাবেই ‘যিকির’ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষত: যিকির আলোচ্য মুহূর্তে উচ্চরবেই উত্তম হবে। কেননা হাদিস শরীফের এ নির্দেশ শর্ত সাপেক্ষ নয়, আর কোন শর্ত নিরপেক্ষ হুকুম দেয়া হলে তা পরিপূর্ণরূপেই পালন করতে হয়। এ স্থলে উচ্চরবে যিকির করাই হবে নির্দেশিত যিকিরের পরিপূর্ণ রূপ। নীরব ‘যিকির’ নয়।

তাছাড়া মুসলিম সমাজে সর্বসম্মত ভাবে কোন কিছুর প্রচলন ‘শরীয়তের চতুর্ভিত্তিরই’ অন্যতম বা পর্যায়ভূক্ত বলে বিবেচিত। উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত কাজটি দীর্ঘকাল ধরেই মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। কাজেই, তা আল্লাহ্ তায়ালার নিকটও প্রিয় বা পছন্দনীয় কাজ বলে স্বীকৃত হবে। হাদিস শরীফের বর্ণনানুযায়ী এতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়?

পক্ষান্তরে যারা এ ধরণের যিকিরকে ‘মাকরূহে তাহ্রিমী’ বলে মনে করে; তারা যদিও কতিপয় ফকীহর মতামতের অনুসারী বলে দাবী করে, কিন্তু পরবর্তীকালীন ফোকাহা কেরামের গৃহীত মতের তা পরিপন্থী। কারণ পরবর্তী ফোকাহা-কেরামের মতে তা জায়েয এবং মোস্তাহাব। (যেহেতু এটাই যুগোপযোগী সঠিক মত)। ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদনের জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণের মাছয়ালাটা এ ক্ষেত্রে একটা উজ্জ্বল সহায়ক প্রমাণ। অতএব, পরবর্তী ফকীহগণের মতামতই নিঃসন্দেহে গ্রহণীয় ও সঠিক। ফেকাহ ও ফতোয়ার কিতাবাদি পর্যালোচনা করলে আলোচ্য বিষয়ে উল্লেখিত মতামতটার বিশুদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

ইতি

(মৌলানা) মোহাম্মদ সিরাজুল হক কাদেরী

গুমান মর্দন, চট্টগ্রাম

১৬.০৯.১৯৭৩ইং

মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পথ চলার সময় উচ্চস্বরে যিকির করা শরীয়ত মতে বৈধ

নাহমাদুহু ওয়া নুছাল্লী আলা হাবীবিল মোস্তফাল করীম!

শ্রদ্ধেয়!

সুদক্ষ ও সুক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন অভিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম! নিম্নলিখিত বিতর্কিত মাছআলায় আপনাদের অভিমত কি?

‘জায়েদ’ নামক জনৈক ব্যক্তির অভিমত হল- মৃত ব্যক্তিকে গোরস্থ করার জন্য নিয়ে যাবার সময় তদ্সঙ্গে পথচারীদের উচ্চরবে ‘যিকির করা’ শরীয়ত মতে নাজায়েজ বা অবৈধ বরং মাকরূহ তাহরীমী। তবে মৌলিক ‘যিকির’ জায়েজ। ফতোয়া ‘আলমগীরী’, ‘শামী’ ও ‘ফত্হুল ক্বাদীর’, ইত্যাদি কিতাবাদিতে বিস্তারিতভাবে তার উল্লেখ রয়েছে।

পক্ষান্তরে ‘খালেদ’ নামক জনৈক ব্যক্তির দাবী হল- মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে পথ চলার সময় উচ্চস্বরে ‘যিকির করা’ জায়েজ, মোস্তাহছান বা মোস্তাহাব। যুগোপযোগী মঙ্গলজনক পন্থাস্বরূপ ওলামা রব্বানী বর্তমানে এ পূণ্যময় কাজটির অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং তা আজ-কাল মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে। উক্ত ‘আমলটির’ বৈধতার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। যেমন- ‘উছুল-ই ফিক্হবিদগণ’ বর্ণনা করেছেন।

এখন প্রশ্ন হল- তাদের মধ্যে কার দাবী সঠিক- খালেদের না জায়েদের? 

খালেদের দাবী যদি সঠিক হয় তবে জায়েদের পেশকৃত দলিলাদির জবাব কি? 

অকাট্য প্রমাণাদিসহ তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করুন। রোজ কিয়ামত আল্লাহ্ তায়ালার নিকট যথাযথ প্রতিদান প্রাপ্ত হয়ে ধন্য হবেন নিশ্চয়ই।

জবাব

اقول بتوفيق الله الوهاب واليه الـمرجع والـماب .

উপরোক্ত পরস্পর বিপরীতমুখী দুই বক্তব্যের মধ্যে খালেদ নামক ব্যক্তির অভিমতই সঠিক। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির ‘জানাজা’ বা লাশ নিয়ে পথ চলার সময় উচ্চরবে যিকির করা একটা জায়েজ বা বৈধ কাজ; শরীয়ত মতে তা মোস্তাহাব। যেমন- ‘মাজমায়ুল আনহোর’-২য় খণ্ডের ১৮৬পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

لا باس لتشيع الجنازة بالجهر بالقران والذّكر .

অর্থাৎ- উচ্চরবে কোরআন মজিদ কিংবা আল্লাহর যিকির পাঠরত অবস্থায় জানাজার পশ্চাদ্গমন শরীয়ত মতে নিষিদ্ধ নয়। কাজেই তাতে কোন ক্ষতি নেই। 

“জামেউর রমূজ”-১ম খণ্ডের ১২৭পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

والاكتفاء مشعربانّه لا باس لمشيع الجنازة بالجهر.

অর্থাৎ- উচ্চরবে যিকির সহকারে ‘জানাজার’ পশ্চাদ্গমনকারীর জন্য কোন ক্ষতি নেই।

‘ফতোয়া শামী-১ম খণ্ডের ১১৯পৃষ্ঠায় বর্ণিত-

كلمة لا باس قد تستعمل فى المندوب كما صرح به فى البحر من الجنائز والجهاد فافهم . 

অর্থাৎ- ‘জানাজা’ ও ‘জিহাদ’ সম্পর্কিত মাছআলাসমূহে لابــاس শব্দটি কখনো ‘মোস্তাহাব’ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- ‘বাহরুর রায়েক্ব’ এ অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। তাছাড়া উক্ত কিতাবের ১ম খণ্ডের ৬৫৮ পৃষ্ঠায় এবং ২য় খণ্ডের ১৮০পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

كلمة لاباس، دليل على انّـه مستحبّ .

অর্থাৎ- لاباس শব্দ দ্বারা কোন হুকুম ব্যক্ত করা হলে তা ‘মোস্তাহাব’ বলে প্রমাণিত হয়।

ইমাম নববী (رحمة الله) তাঁর প্রণীত ‘কিতাবুল আজকার’ এ উল্লেখ করেছেন-

يستحب له (اى للماشى) ان يكون مشتغلا بذكر الله تعالٰى . 

অর্থাৎ- ‘জানাজা’ বা মৃত ব্যক্তিকে গোরস্থানে নিয়ে যাবার সময় পদাতিকদের আল্লাহ্ তায়ালার যিকিরে মশগুল হওয়া মোস্তাহাব।

‘গুনিয়াহ্’ নামক কিতাবের ৫৯৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

قال علاء الدين التاجرى ترك اولٰى .

অর্থাৎ- আলাউদ্দীন তাজেরী বলেছেন, জানাজার সাথে পথ চলার সময় ‘সরব-যিকির’ মকরূহ নয় বরং ‘অধিক উত্তম বর্জন’ মাত্র (অর্থাৎ দু’টি উত্তম কর্মের মধ্যে অধিকতর উত্তম কার্যটিই বর্জন করা)। মাকরূহ এ জন্যে নয় যে, কোন কাজ বা বস্তু মাকরূহ বলে প্রমাণিত করতে হলে তদ্প্রাসঙ্গিক কোরআন-হাদিস লব্ধ বিশেষ দলিলের প্রয়োজন।

যথা- ‘ফতোয়া শামী’তে উল্লেখ করা হয়-

اذ لابدّلها من دليل خاص .

অর্থাৎ- বিশেষ দলিল দ্বারাই মকরূহ প্রমাণিত হয়। অথচ ‘জানাজার’ সাথে পথ চলার সময় উচ্চরবে যিকির করার অবৈধতা সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট বা বিশেষ প্রমাণ নেই- না কোরআন মজিদে, না হাদিস শরীফে; বরং পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরীফের প্রকাশ্য অর্থে (دلالة النص) এটাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, যে কোন মুহূর্তে বা অবস্থায় যিকির করা জায়েজ বা বৈধ। যা ফকীহগণও সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন- উচ্চস্বরে হোক কিংবা নীরবে হোক যিকির করার নির্দেশ রয়েছে।

আল-কুরআনে সম্মিলিত ভাবে অধিকহারে যিকির করার নির্দেশ

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেছেন-

فَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ .

অর্থাৎ- তোমরা অধিক পরিমাণে (স্থান-কালের বিশেষীকরণ ব্যতিরেকেই) আল্লাহর যিকির কর। ফলে তোমরা অবশ্যই কৃতকার্যতা লাভ করবে। 

অন্যত্র এরশাদ করেছেন-

الَّذِيْنَ يَذْكُرُونَ اللهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ

অর্থাৎ- তারা দন্ডায়মান হয়ে, বসে এবং শূয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে… (আয়াত)। কাজেই উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত- فَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيرًا দ্বারা উচ্চরব বা নিম্নস্বর কিছুরই বিশেষীকরণ ব্যতিরেকেই সাধারণভাবে যিকিরের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে নির্দেশটাকে শুধু নীরবে যিকিরের বেলায় প্রযোজ্য বলে বিশেষিত করার জন্য অবশ্যই বিশেষ প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। “উসুল ফিক্হ” বিদদের এ অভিমত অনস্বীকার্য ও অকাট্য। তাছাড়া, উক্ত আয়াতে فَاذْكُرُوا (তোমরা স্মরণ কর) শব্দটি হল ‘বহুবচন’। তাতে সবাই মিলিত হয়ে সম্মিলিত কন্ঠেই আল্লাহর যিকির করার নির্দেশ সহজে অনুমেয়। তদুপরি যিকির শব্দটি সাধারণ ও ব্যাপকার্থক এবং তা যে পাক কোরআনেরই নির্দেশ এতে সন্দেহেরও কোন অবকাশ নেই। আর উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত সূরী ‘যিকির’ তখনই প্রযোজ্য হয়, যখন তা উচ্চস্বরে করা হয়। 

কোরআন পাকে এরশাদ হয়েছে:

وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِينَ

অর্থাৎ-“তুমি ‘যিকির কর’! কেননা যিকির মু’মিনদের উপকার সাধন করে।” 

এ ধরণের সময়- নির্বিশেষ অর্থবোধক আয়াত সমূহ দ্বারা সর্বদা যিকির করার অনুমতি প্রতিভাত হয়। তবে, যে সব স্থানে বা সময়ে বিশেষ দলিল দ্বারা যা নিষিদ্ধ করা হয়, তা না জায়েজ। 

(বায়ানুল কোরআন, মৌলানা আশরাফ আলী থানভী)।

উপরোক্ত আয়াতসমূহের উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে, সর্বদা ও সর্বাবস্থায় ‘যিকির’ করার বৈধতা কোরআন-হাদিস সঞ্জাত দলিলাদি দ্বারাই প্রমাণিত; যদি না সে সময়ে বা অবস্থায় হয়, যাতে যিকির করা শরীয়ত মতে নিষিদ্ধ।

হযরত আল্লামা খাইরুদ্দীন রমলী (رحمة الله) ‘ফতোয়া খাইরিয়া’-২য় খণ্ডের ১৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- واما رفع الصوت بالذكر فجائز অর্থাৎ সর্বদা উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ; শরিয়ত মতে বৈধ।

শাহ আবদুল আজিজ মোহাদ্দেছ দেহলভী ফতোয়া আজিজি ১ম খণ্ডে লিখেছেন- কোরআন মজিদের আয়াত দ্বারা ‘সরব-যিকির’ প্রমাণিত হয় সুস্পষ্টরূপে। তাছাড়া, উচ্চরবে যিকির করলে অবসন্নতা বা অলসতা দূরীভূত হয় এবং মনে উৎসাহ সৃষ্টি হয়। 

হযরত শরফুল আইম্মাহ্ মক্কী (رحمة الله) বলেছেন- هوتارك للاولى (قنية) অর্থাৎ- “উচ্চরবে যিকির করা একটা উত্তম কাজ বর্জন করা মাত্র।” সুতরাং এখানে ترك اولى শব্দটি দ্বারাই জানাজার সাথে পথ চলার সময় উচ্চরবে যিকির করার বৈধতা প্রমাণিত হচ্ছে; যদিও তা তাঁর মতে নিম্নস্বরে করাই অধিকতর উত্তম।

হাদিস দ্বারা জানাজায় অধিক পরিমাণে যিকিরের বর্ণনা

ইমাম ছুয়ূতী (رحمة الله) প্রণীত ‘জামেউচ্ ছগীর’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়, হযরত আনাস (رضي الله عنه) এর বর্ণিত এক হাদিসে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

قَالَ عَلَيْهِ السَّلَام أَكْثِرُوا فِى الْجَنَازَة قَوْلِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ .

অর্থাৎ- তোমরা জানাজায় অধিক পরিমাণে কলেমা তৈয়্যবাহ (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্…) পাঠ কর।

হযরত মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন নঈমী (رحمة الله) প্রণীত ‘জাআল্ হক’ নামক কিতাবে “নাছর্বু রায়াহ লিতাখ্রিজে আহাদিছিল্ হেদায়া” নামক কিতাব থেকে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত হাদিসে উল্লেখ করা হয়-

عن ابن عمر رضى الله تعالٰى عنهما قال لم يكن يسمع من رسول الله صلّى الله عليه وسلّم وهو يمشى خلف الجنازة الا قول لَا اِلٰه اِلَّا الله مبديًا وراجعًا .

অর্থাৎ- “হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন যে, ‘জানাজার’ সাথে পথ চলার সময় হুজুর (ﷺ)কে উচ্চস্বরে নিশ্চয়ই ‘কলেমা তৈয়্যবাহ’ (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ…) পাঠ করতে শুনা গিয়েছে।” এখন বলুন! হুজুর (ﷺ) যদি উচ্চরবে যিকির না করতেন তবে তা কিভাবে শুনা যেত? নিশ্চয়ই তিনি (ﷺ) উচ্চরবে যিকির করেছেন বলেই হাদিসের বর্ণনানুযায়ী, তা শুনা গিয়েছিল। এতে প্রমাণিত হল যে এ ধরণের ‘যিকির’ হুজুর (ﷺ) এরই পবিত্র আমল থেকে প্রমাণিত; উপরোক্ত প্রমাণাদির ভিত্তিতে তা জায়েজ ও মোস্তাহাব।

তাছাড়া, ‘যায়েদ’  নামক ব্যক্তির বর্ণনানুযায়ী তা ‘মাকরূহ’ বলে ধরে নেয়া হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, শরীয়ত মতে তা নাজায়েজ বা অবৈধ নয়; যেহেতু আমাদের দেশে মুসলিম সমাজে তা প্রচলিত রয়েছে। কেননা- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

ماراه المسلمون حسنا فهو عند الله حسن .

অর্থাৎ- মুসলমানরা যা ভাল মনে করেছেন তা আল্লাহ্ তায়ালার নিকটও ভাল বা পূণ্যময় বলে পরিগণিত। তদুপরি من سن فى الاسلام سنة حسن الخ (অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইসলামে একটা ভাল কাজের প্রচলন করবে..) এ হাদিসটাও এ প্রসঙ্গে উপরোক্ত হাদিসের সমার্থক।

‘মুজাল্লাতু আহকামিল আদ্লিয়্যাহ’ নামক কিতাবে ‘আত্তাল্বীহ্’ নামক কিতাব থেকে উদ্ধৃত করা হয়- استعمال الناس حجة يجب العمل بها অর্থাৎ- সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ‘আমল’ও শরীয়তের দলিল হিসাবে গ্রহণীয়। এমনকি তদানুযায়ী আমল করা ওয়াজিব বা অপরিহার্য। এতদ্ভিত্তিতে ‘দুর্রুল মোখতার’ প্রণেতা উল্লেখ করেছেন-

ولا بأس به عقيب العيد لان المسلمين توارثوا فوجب و عليه البلخيون ولا يمنع العامة من التكبير فى الاسواق فى الايام العشرو به تأخذ.

অর্থাৎ- ঈদের নামাজের পর তকবীর পাঠে কোন ক্ষতি নেই। কারণ, মুসলমানগণ যুগ যুগ ধরে তা করেই আসছেন। সুতরাং তারই অনুসরণ করা ওয়াজিব। তা ‘বলখ’ বাসী ফকীহগণেরও সমর্থিক মতামত। তাই, পথে, বাজারে (সর্বত্রই) জিলহজ্ব মাসের দশ-দিবসে কেউ ‘তাকবীর’ পাঠ করলে তাকে বাধা দেয়া যাবে না। এটাই আমাদের মজহাবে গৃহীত মত।

‘ফতোয়া শামী’-২য় খণ্ডের ১৮০ পৃষ্ঠায় দেখুন! তাতে ‘দুর্রুল মোখতার’ প্রণেতা মুসলমানদের সর্বস্বীকৃত আমল বা কর্ম শরীয়তের দলিল হিসেবে পরিগণিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। যদিও তা হুজুর (ﷺ) এবং ‘আইম্মায়ে মোজ্তাহিদীনের’ যুগে প্রচলিত কাজ না হয়। অর্থাৎ তা ‘বিদ্য়াত’ বা ‘পরবর্তী যুগের প্রচলিত কাজ’ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম সমাজে প্রচলিত এ আমলটি পালনীয়ের মর্যাদায় বহাল রাখার এবং তা পালনে মুসলমানদের বাধা না দেয়ার নির্দেশই উপরোলে­খিত উদ্ধৃতি থেকে প্রতিভাত হয়। তদুপরি ভাল কাজে সাধারণ মুসলমানদের অনুসরণ প্রয়োজনীয় বলে উক্ত কিতাবে উল্লেখ করা হয়।

যেমন- ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) হযরত মায়াজ ইবনে জবল (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন,

وَعَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ وَالْعَامَّةِ (مشكوٰة شريف)

অর্থাৎ- তোমরা মুসলিম জমাত বা সাধারণ মুসলমানদের (মধ্যে প্রচলিত নিয়মের) অনুসরণ কর। মোদ্দাকথায়, ভাল কাজে মুসলিম জমাতের অনুসরণ করার নির্দেশই উপরোক্ত হাদিসে দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে    বিস্তারিত অবগতির জন্য আমার লেখিত “আস্-সায়েক্বাহ” (الصاعقة) নামক পুস্তিকা দেখুন। যা বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং বুঝা যায় যে, উপরোক্ত নিয়মটি (ভাল কাজে মুসলিম জামাতের অনুসরণ অপরিহার্য) উক্ত হাদিস থেকেই গৃহীত। এতে প্রমাণিত হয় যে, পূণ্যময় কর্মে সাধারণ মুসলমানদের অনুসরণ অপরিহার্য। পরবর্তী যুগের ফকীহগণ তাই ‘ওরফ’কে শরীয়তের ‘পঞ্চম দলিল’ (اصل) হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

হানাফী মাজহাবের কোন কোন ইমাম এ মত পোষণ করেছেন যে, উপরোলে­খিত উদ্ধৃতিতে لابأس শব্দটি ‘পারিভাষিক ওয়াজিব’ অর্থে ব্যবহৃত। সুতরাং এতে বুঝা যায় যে, لابأس শব্দটি ‘ওয়াজিবে আমলী’ অর্থাৎ কার্যটির অপরিহার্যতাকেই নির্দেশ করে; ‘ফেক্হশাস্ত্রের পরিভাষায় তা ‘পারিভাষিক ওয়াজিব’ অর্থেই ব্যবহৃত।

সমাজে প্রচলিত কার্যকলাপ শরীয়ত নির্দেশিত পাবন্দীরই নামান্তর

‘মোজাল্লাতুল আহকাম’ ও ‘তাশরীউল ইসলাম’ এ মুসলিম সমাজে প্রচলিত কার্যকলাপ প্রসঙ্গে কয়েকটা ‘কায়দা’ (قاعده) উল্লেখ করা হয়। যথা-

المعروف عرفا كالمشروط شرطًا المشروط عرفا كا المشروط شرعًا . 

অর্থাৎ- সমাজে প্রচলিত কার্যকলাপের পাবন্দী অপরিহার্য; যেমনি শর্ত সাপেক্ষ বিষয়াদির উপস্থিতির জন্য তার শর্তাবলীর উপস্থিতি আবশ্যকীয়। অন্যভাবে তার অর্থ এরূপ দাঁড়ায়- মুসলমানদের মধ্য প্রচলিত বিষয়াদির পাবন্দি শরীয়ত নির্দেশিত বিষয়ের পাবন্দীরই নামান্তর মাত্র। তাই অন্যত্র বলা হয়- 

والعادة المطردة تنزل منزل الشّرط .

অর্থাৎ- ‘মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিষয় কোন শর্ত সাপেক্ষ বিষয়ে তার পূর্ব শর্তেরই পর্যায়ভূক্ত।’ অন্যরূপে, 

التعبين بالعرف كالتعبين بالنص .

অর্থাৎ- ‘ওরফ’ বা প্রচলিত বিষয়াদিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে কোন নীতি নির্ধারণ করা, কোরআন মজিদ ও হাদিস শরীফ দ্বারা নীতি নির্ধারণেই শামিল। তাই বলা হয়-

الثابت بالعرف كالثابت بالنص.

অর্থাৎ- ‘ওরফ’ দ্বারা প্রমাণিত বস্তু পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত বিধানাবলীরই সমতুল্য। যেমন, আহারের সময় সালাম না দেয়া বা সালামের জবাব না দেয়া মুসলিম সমাজের একটা প্রচলিত নিয়ম। অথচ তা নিষিদ্ধ বলে কোরআন মজিদ কিংবা হাদিসলব্ধ কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না।

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, একদা শেখ আবুল কাসেম নাছীরাবাদী (যিনি হযরত আবু ছায়ীদ আবুল খায়রের (رحمة الله) পীর ছিলেন) স্বীয় সঙ্গী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আহারে রত ছিলেন। তখনি ইমাম গাজ্জালীর (رحمة الله) ওস্তাদ হযরত ইমামুল হারামাঈন (رحمة الله) সেখানে এসে পৌঁছলেন। তিনি আহাররত সবাইকে ‘সালাম’ বললেন। কিন্তু তাঁর দিকে কেউ ভ্র“ক্ষেপও করেননি। আহার সমাপনের পরক্ষণেই ইমামুল হারামাঈন (رحمة الله) তাঁদের লক্ষ্য করে বললেন, আমি ‘সালাম’ বললাম; অথচ আপনারা তার কোন জবাবই দিলেন না। তা কি মোটেই উচিৎ হয়েছে? শেখ আবদুল কাসেম তদুত্তরে বললেন- ‘ওরফ’ বা প্রচলিত নিয়ম হলো- ‘‘যদি কেউ কোন আহাররত লোক সমাগমে উপস্থিত হয়; তবে সে আগত ব্যক্তি প্রথমে তাদের সাথে আহারে বসে যাবেন এবং আহার পর্ব শেষ হলে দাঁড়িয়ে জামায়েতের সবাইকে ‘সালাম’ বলবেন।” তখন ইমামুল হারামাঈন প্রশ্ন করলেন- এ নিয়মের উৎস কি? শুধু বিবেক যুক্তি? না, পবিত্র কোরআন কিংবা হাদিস শরীফেও তার কোন প্রমাণ রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন- ‘আক্বল’ বা যুক্তি বিবেকই তার প্রমাণবহ। কেননা, ‘আহার শুধু এবাদতের জন্য শক্তি সঞ্চায়ের নিমিত্তই।’ যে আহারে এ নিয়ত বা উদ্দেশ্য থাকে, সে আহারও একটা ‘এবাদত’ বলে বিবেচিত হয়। কাজেই আহাররূপী এবাদতরত অবস্থায় সালামের জবাব কিভাবে দেয়া যায়?

অনুরূপ, একদা হযরত খাজা কুতুব উদ্দীন (رضي الله عنه) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আহারে রত ছিলেন। এমতাবস্থায় শেখ নিজাম উদ্দীন আবুল মোআয়্যাদ (رحمة الله) এসে তথায় উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁদের প্রতি সালাম প্রদর্শন করলেন। কিন্তু খাজা সাহেব তাঁর সালামের জবাবতো দেননি; এমনকি তাঁর দিকে ভ্র“ক্ষেপও করেননি। এতে হযরত আবুল মোআয়্যাদ মনক্ষুন্ন হয়ে তাঁদের আহার সমাপনান্তে সালামের জবাব না দেয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তদুত্তরে হযরত খাজা ছাহেব বললেন- আমরা তো আল্লাহর এবাদতেই ছিলাম; সালামের জবাব তখন কিভাবে দেয়া যায়? (ফাওয়ায়েদুচ্ছালেকীন)।

ইব্নে ক্বাইয়্যেম্ বলেছেন- শরীয়তের আহকাম বা নির্দেশাবলীর (উছুলভিত্তিক) পরিবর্তন স্থান, কাল, অবস্থা এবং মানুষের নিয়ত ও স্বভাবের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। 

‘মোজাল্লাহয়’ উল্লেখ করা হয়-

لا ينكر تغير الاحكام وبتغير الزمان وبتغير الامكنة والاحوال . 

অর্থাৎ- এটা অনস্বীকার্য যে, স্থান, কাল ও অবস্থা বা পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে শরীয়তের আহকামও পরিবর্তিত হয়। তবে দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয়াদি, তাওহীদ ও ঈমানের বিধানসমূহ নিখুঁত, অপরিবর্তনীয় এবং চিরস্থায়ী। এ সব বিধানে কোরআন মজিদ ও হাদিস শরীফের যথাযথ অনুসরণ একান্ত আবশ্যকীয়।

‘পরিবেশ, স্থান ও কালের পরিবর্তনে কোরআন ও হাদিস সঞ্চাত দলিল লব্ধ আহকামের পরিবর্তন হয়’- এ ‘উছুলের’ ভিত্তিতে আনুসঙ্গিকক্রমে এমন সব মাছআলার অনুমতিও প্রচলিত হয়, যেগুলোর প্রাসঙ্গিক সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে না। অথচ সেগুলোও পালনীয়।

মোদ্দাকথায়, কালের পরিবর্তনে ‘মাছআলা’ ও পরিবর্তিত হতে পারে। সম্ভবতঃ তারই ভিত্তিতে ছদ্রুশ্ শরীয়ত হযরত মৌলানা আমজাদ আলী (رحمة الله) তাঁর প্রণীত ‘বাহারে শরীয়ত’-৪র্থ খণ্ডে উল্লেখ করেছেন যে, বর্তমানে (তৎকালীন) ওলামায়ে কেরাম জানাজার সাথে চলার সময় পদাতিকদের জন্য ‘সরবে যিকির’ করার অনুমতি দিয়েছেন।

আল্লামা সৈয়দ মুহসিনুল আমীন আল-হুসাইনী মিসরী বলেন-

ورفع الصوت بالذكر عند حمل الميت اذا كان فى رفع الصوت فائدة كالاعلان بذكر الله واتعاظ السامع ونحو ذالك، نعم لو فعلت بقصد الحصوصية والورود كانت بدعة ويرادبها اهداء الثواب إلى الميت، فيعمها ما دل على جواز اهداء الثواب للميت . 

অর্থাৎ- জানাজা নিয়ে পথচলার সময় উচ্চস্বরে যিকির করা। যখন উচ্চস্বরে যিকির করার মধ্যে বিশেষ উপকার রয়েছে। আল্লাহর যিকিরের এ’লান কিংবা প্রচার করা এবং শ্রোতাদের মৃত অন্তরকে জাগ্রত করা উদ্দেশ্য হবে। হ্যাঁ, শরীয়তে এটি করার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা রয়েছে সে ধরণের ইচ্ছা ও খেয়াল করা বেদাত। আর এ ধরণের যিকির এবং তেলাওয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে মৃতের উপর ছাওয়াব পৌঁছানো। কাজেই শরীয়তে যেখানে মৃতের উপর ছাওয়াব পৌঁছানো জায়েয বলে প্রমাণিত রয়েছে সেহেতু জায়েযের দলীল সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে প্রমাণিত। এ সমস্ত কিছু ইচছা ও নিয়্যতের উপরই নির্ভরশীল। আল্লাহর যিকির সর্বাবস্থায় জায়েয ও মুস্তাহাব। সেটি উচ্চস্বরে হউক কিংবা নিম্নস্বরে (গোপনে) হউক। সাধারণভাবে আল্লাহর যিকির জায়েয। সাধারণ তথা অনির্দিষ্টকে নির্দিষ্ট করা নিজের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী কখনো জায়েয নয়। হ্যাঁ, তবে এটি শরীয়তে বাধ্যবাধকতা আছে মনে করা বেদাত ও নাজায়েয।

‘মুহীত বুরহানী’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে- উচ্চস্বরে অর্থাৎ رفع الصوت দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে হৈ চৈ (চিল্লাচিলি­) করে কান্নাকাটি করা, কাপড় ছিঁড়ে ফেলা, পাগলামী করা, মাতামদারী করা এ সমস্ত কিছু মাকরূহ। যিকির করা, কালেমা পাঠ করা নিষেধ নয়।

যেমন হযরত ইমাম হাছান বসরী (رحمة الله) থেকে বর্ণিত আছে-

ذكر وقرأت القرآن لاتنافى بيـنهما .

অর্থাৎ- যিকির করা ও কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করার মধ্যে কোন অসুবিধা নাই।

رفع الصوت এর উদ্দেশ্য হচ্ছে-

كان عليه اهل الجاهلية من الافراط فى مدح الميت عند جنازة حتى كانوا يذكرون ماهو سبب المحال، (محيط برهانى، جلد-৬، صفحه: ৪১) 

অর্থাৎ- জাহেলী যুগে লোকগণ মৃত ব্যক্তির প্রশংসা জানাজার সময় এমনভাবে বর্ণনা করত যা হওয়াটা মোটেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ অতিমাত্রায় প্রশংসা করত। ইহাই ফকীহগণ মাকরূহ বলেছেন।

‘জা-আল হক্ব’ এ ‘হাদিকাতুন্নদীয়্যাহ’ নামক কিতাব থেকে উদ্ধৃত ‘ইমাম আবদুল গণি নাবিলিছীর’ (رحمة الله) এক মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়-

ان بعض المشائخ جوزوا الذكر الجهرىّ ورفع الصوت بالتعظيم قدام الجنازة وخلفها لتلقين الميت والاموات والاحياء وتنبيه الغفلة والظلمة ورطابة صداء القلوب وقساوتها بحبّ الدنيا ورباستها . 

অর্থাৎ- কোন কোন ফকীহ ‘জানাজার’ সম্মুখে ও পশ্চাতে মৃত ও জীবিতদের ‘তাল্ক্বীন’ বা শিক্ষা প্রদান অন্য মনষ্ক ও পার্থিব কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ে সীমালঙ্ঘনকারীদের সতর্ককরণের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে ‘যিকির’ করা জায়েজ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া পার্থিব ভালবাসা এবং কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা লাভের মোহে যাদের অন্তর পাষাণ হয়ে গিয়েছে, তাদের অন্তরে আল্লাহর স্মরণ (ذكـر) দ্বারা ধার্মিক সূলভ নম্রতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে উচ্চরবে যিকির করা ওলামা ও ফকীহ সম্প্রদায়ের মতে বৈধ।

মোটকথা, কোন কোন ‘ইমাম’ জানাজার সম্মুখে পশ্চাতে উচ্চরবে ‘যিকির’ পাঠ করা জায়েজ বা বৈধ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন; যাতে তদ্বারা মৃত ও জীবিত সবাই শিক্ষা গ্রহণে প্রয়াস পায় এবং অন্য মনষ্ক বা অলস ব্যক্তিবর্গের অলসতা, অন্তরের কলুষতা, কঠোরতা, পার্থিব লোভ, কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার মোহ দূরীভূত হয়ে যায়। 

আ’লা হযরত মৌলানা শাহ্ আহমদ রেজা খাঁন (رحمة الله) তাঁর প্রণীত পুস্তিকা ‘‘মাওয়াহেবু আরওয়াহিল কুদুছ;’’ ৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, ‘ওরফে আম’ (عرف عام) বা সমাজে সাধারণভাবে প্রচলিত বিষয়ও শরীয়তের বিশেষ দলিল হিসেবে পরিগণিত; এ ধরণের দলিল দ্বারা ‘মোস্তাহাব’ পর্যায়ের কার্যাদি প্রমাণিত হয়। এ জন্যই তো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আলেম, ছুফী, অলী ও বুজুর্গগণ জানাজার সাথে চলার পথে উচ্চরবে যিকির’ করে আসছেন।

‘আল্-আশবাহ্ ওয়ান্নাজায়ের’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়-

العادة محكمة واصلها قوله عليه السلام ما راه المسلمون حسنا فهو عند الله حسن . 

অর্থাৎ- সমাজে প্রচলিত কাজ শরীয়তে গ্রহণযোগ্য। তা প্রমাণিত হয় হুজুর (ﷺ) এর এ পবিত্র এরশাদ থেকে “মুসলমানগণ যা ভাল মনে করে তা আল্লাহ্ তায়ালার নিকটও ভাল এবং পূণ্যময়।”

এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা হয়-

واعلم ان اعتبار العادة والعرف برجع اليه الفقه فى رسائل كثيرة حتى جعلوا ذالك اهلًا . 

অর্থাৎ- ‘সামাজিক প্রচলন’ বা ‘ওরফ’ শরীয়তে গ্রহণযোগ্য হয় উক্ত হাদিসের অনুসরণেই। এ প্রসঙ্গে ফিক্হ শাস্ত্রে যথেষ্ট সংখ্যক পুস্তক-   পুস্তিকা প্রণীত হয়েছে। এমনকি ফকীহ সম্প্রদায়ের নিকট তা ‘‘উছুল’’ (মৌলিক প্রমাণ) এর মর্যাদা রাখে।

‘বরজন্দী’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়-

العرف ايضا حجة بالنص قال عليه السلام ماراه المسلمون فهو عندالله حسن 

অর্থাৎ- ‘ওরফ’ শরীয়তের একটা গ্রহণযোগ্য দলিল। তার উৎস হল নবী করীম (ﷺ)-এর পবিত্র হাদিস ‘মুসলমানরা যা পূণ্যময় মনে করে’ আল্লাহ্ তায়ালার নিকটও তা পূণ্যময় হিসেবে পরিগণিত।

শরহে ‘হেদায়া’ ‘আইনী’তে উল্লেখ করা হয়-

وبذلك جرت العادة الغاشية وهى من احد الحجج التى يحكم بها قال عليه السلام ماراه المسلمون حسنا فهو عندالله حسن . 

অর্থাৎ- যে প্রচলিত বিষয় সর্বজনবিদিত ও সর্বস্বীকৃত তা শরীয়তের একটা বিশেষ দলিল। বিচারের রায়ও তদানুসারেই হয়। কেননা হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন ‘মুসলমানগণ যা ভাল মনে করে তা আল্লাহ্ তায়ালার নিকটও ভাল বলে গণ্য হয়।’

‘মুহীতে বোরহানী’তে উল্লেখ করা হয়- 

لان العرف اذا استمر نزل منزلة الاجماع .

কেননা, ‘ওরফ’ যখন ‘স্থায়ী প্রচলন’ লাভ করে, তখন তা ‘ইজমা’র পর্যায়ে পড়ে। যেমন- ‘নফল নামাজ’ জমা’ত সহকারে আদায় করা ফকীহদের মতে মাকরূহ হলেও যুগের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে তা জায়েজ বলেই স্বীকৃতি লাভ করেছে।

لا يكره الاقتداء بالامام فى النوافل مطلقًا نحو القدر والرغائب وليلة النصف من شعبان ونحو ذالك لان ماراه المسلمون حسنا فهو عندالله حسن خصوصًا اذا استمرّ فى بلاد الاسلام والامصار . 

অর্থাৎ- নফল নামাজসমূহে ইমামের পিছনে ‘ইক্তেদা’ করা সাধারণত জায়েজ; মকরূহ নয়। যেমন- লায়লাতুল ক্বদর, লাইলাতুর রাগায়েব, পনরই শাবানের রাত্রি এবং অন্যান্য নফল নামাজসমূহ। যেহেতু মুসলমানরা এ নামাজসমূহ জমাত সহকারে পড়া অধিক পূণ্যময় মনে করে সেহেতু তা আল্লাহ্ তায়ালার নিকটও পূণ্যময় হিসেবেই গৃহীত বলে অনুমিত; বিশেষত, যখন তা মুসলমান অধ্যুষিত দেশ কিংবা শহরসমূহে নিয়মিতভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে।

(নফল নামাজ জমাতসহকারে আদায় করা জায়েজ এ মর্মে আমার লিখিত কিতাব ’’الصلواة التطوع باقتداع المطوع‘‘ নামক কিতাবটি দেখুন)

উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, জানাজার সাথে চলার পথে উচ্চরবে যিকির করা শুধু জায়েজ নয়; বরং মোস্তাহাব।

আ’লা হযরত শাহ্ আহমদ রেজা খাঁন (رضي الله عنه) তাঁর রচিত ‘ফতোয়ায়’ ‘জানাজা’ নিয়ে পথ চলার সময় সরব যিকির মোস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। তার সপক্ষে তিনি বহু অকাট্য প্রমাণও দাঁড় করেছেন।

হযরত হাকীমুল উম্মত মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন নঈমী (رضي الله عنه) এ মাছআলা সম্পর্কে ‘জাআল্ হক্ব’-১ম খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে উদ্ভুত বিভিন্ন প্রশ্নাবলীর উত্তর দিয়ে একথাই প্রমাণিত করেছেন যে, জানাজার সাথে পথ চলার সময় সরবে যিকির করা মোস্তাহাব।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে জানাজায় উচ্চস্বরে যিকির করা জায়েয ও মোস্তাহাব

পুরাকালীন নিয়মের ভিত্তিতে যেসব ফকীহ উচ্চরবে যিকির করা মাকরূহ বলেছেন তার জবাবে উল্লেখ করেছেন যে, পুরাকালে জানাজা দেখলেই লোকেরা মৃত্যুকে স্মরণ করতেন। ভয়ে তাঁদের অন্তর কেঁপে উঠত। এমনকি ভয়ে কথা বলার সাহসও তাঁরা হারিয়ে ফেলতেন। সুতরাং তাঁরা তখন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নীরবে পথ চলতেন।

যেমন হযরত বারা বিন্ আযেব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত-

قَالَ خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي جَنَازَةِ رَجُلٍ مِنْ الْأَنْصَارِ فَانْتَهَيْنَا إِلَى الْقَبْرِ وَلَمْ يُلْحَدْ بَعْدُ فَجَلَسَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ وَجَلَسْنَا مَعَهُ كَانَ عَلَى رَؤسنَا الطيْر . (رواه ابن ماجه) 

অর্থাৎ- (হযরত বারা ইবনে আযেব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর সঙ্গে একজন ‘আনছারী’ এর জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলাম। আমরা কবরের পাশে গিয়ে দেখলাম, কবর তখনও তৈরী হয়নি। তখন হুজুর (ﷺ) কেব্লামুখী হয়ে বসলেন। আমরাও হজুুর (ﷺ) এর সাথে এমনভাবে বসে পড়ি, যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসেছিল। অর্থাৎ আমরা পাখি শিকারীদের ন্যায় নিশ্চুপ ও অনড়ভাবে বসেছিলাম। (মিরআত)

এখন একথা হৃদয়াঙ্গম করা দরকার যে, পূর্ব যুগ ও বর্তমান কালের অবস্থা পরস্পর পৃথক ধরণের। এ যুগীয় লোকের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি পূর্ব যুগের তুলনায় অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে হাশর-নশর, মৃত্যু ও কবরের আজাব ইত্যাদির ভয়ভীতি তাদের অন্তরে নেই বললেও চলে। এমনকি প্রত্যক্ষ পরিদর্শনে দেখা যায় যে, জানাজার সাথে চলার সময় লোকেরা বাজে আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা এবং পার্থিব আলাপ আলোচনায় লিপ্ত হয়ে যায়; তারা অনর্থক কথা-বার্তায় সময় নষ্ট করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

এই জন্যই আবু দাউদ শরীফে উল্লেখিত হাদিসে এরশাদ করা হয়-

لَا تتْبَعُ الْجنَازَة بِصَوْتٍ .

অর্থাৎ- ‘জানাজার সাথে চলার সময় শোরগোল করা নিষিদ্ধ’।

ইমাম নববী (رحمة الله) ‘কিতাবুল আজকার’-১৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

فان هذا وقت فكرو ذكر يقبح الغفلة واللهو والاشتغال بالحديث الفارغ فان الكلام بما لا فائدة فيه حنهنى عنه فى جميع الاحوال فكيف فى هذا الحال.

অর্থাৎ- নিশ্চয়ই এটা অনুশোচনা ও ‘যিকির’ এর সময়। এ মুহূর্তে অন্য মনষ্ক হয়ে খেলাধুলা ও বাজে কাজ কর্মে লিপ্ত হওয়া সমীচীন নয়। কাজেই বিশেষত যে সব অনর্থক কথাবার্তা অন্য যে সময়েই নিষিদ্ধ; তা এ মুহূর্তে কিভাবে জায়েজ বা বৈধ হতে পারে? এ জন্যই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের ইমামগণ এ মুহূর্তে (জানাজার সাথে চলার সময়) বাজে কথাবার্তা থেকে মুসলমানদেরকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে উচ্চরবে ‘যিকির’ করা জায়েজ ও মোস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন- হযরত হাকীমুল উম্মত মুফ্তি আহমদ এয়ার খাঁন নঈমী (رحمة الله) ‘মিরআত শরহে মিশকাত’-২য় খণ্ডের ৪৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, এ যুগে ‘সরব-যিকিরই’ উত্তম হবে। নতুবা লোকেরা তখন দুনিয়াবী কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা, অন্যের কুৎসা রটনা ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যাবে।

উসুল-ই-ফিকহ্বিদ ইমামগণ বলেছেন-

ان الحكم الشرعى المبنى على علّة يدور مع علّته وجودا وعدما . 

অর্থাৎ- শর্তসাপেক্ষ শরীয়ত-বিধি তার পূর্বশর্তের অবস্থিতি ও উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ পূর্বশর্তের উপস্থিতি ঘটলেই তা পালনীয়; নতুবা নয়। 

মাওলানা ‘আলীয়া’ ছাহেব বলেছেন-

ان الحكم الشرعى مبنى على علته فبانتهائها ينتهى . 

অর্থাৎ- শরীয়তের কোন হুকুম যদি কোন ‘কারণ’ সাপেক্ষ হয়, তবে যখন সে ‘কারণ’ এর অনুপস্থিতি কিংবা অবসান ঘটে তখন উক্ত হুকুম পালনের সময় বা মেয়াদ শেষ হয়ে যায়; অর্থাৎ তখন তা আর পালনীয় থাকেনা।

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, বর্তমান যুগে জানাজার সাথে চলার সময় উচ্চরবে যিকির করাই উত্তম। কাজেই এ পূণ্যময় কার্য থেকে বাধা দেয়া মোটেই উচিত হবে না। এসব প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও যদি কোন আলেম এ ধরণের যিকির নিষিদ্ধ, হারাম কিংবা মাকরূহ বলে ফতোয়া দেয়; তবে তাকে শান্তিকামী বা জনসাধারণের ভুলত্রুটি সংশোধনকারী বলা যাবে না, অথচ আলেমগণই হলেন উম্মতের দিশারী। তাদের ভুলত্রুটি সংশোধনকারী এবং তাদের আমানতদার। যেমন: হাদিস শরীফে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন- العلماء امنعاء امتِى আলেম সম্প্রদায় আমার উম্মতদের মধ্যে শান্তি স্থাপনকারী।

স্মর্তব্য যে, ফকীহগণের মধ্যেও এ মাছয়ালাটি বিতর্কিত- কেউ কেউ তা ‘মাকরূহ তাহরীমী’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। আবার কোন কোন ফকীহ বলেছেন তা মাকরূহ তান্জীহি।

ফতোয়া শামীতে উল্লেখ করা হয়-     قيل تحريما تنزيها كما فى البحر 

অর্থাৎ- তা কোন কোন ফকীহ্র মতে মাকরূহ তাহরীমী, আবার কারো মতে মকরূহ তান্জীহি। যেমন বাহরূর রায়েকেও এরূপ উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া ফকীহদের মধ্যে কারো মতে আবার তা বর্জন করাই অধিকতর উত্তম। (ترك اولى) 

ينبغى لمن تبع الجنازة ان يطيل الصمت .

অর্থাৎ- যাঁরা জানাজার সাথে পথ চলে তাদের নিশ্চুপ থাকা দরকার। যেহেতু ‘সরব যিকির’ থেকে বিরত থাকাই অধিকতর উত্তম। উল্লেখ্য যে মাকরূহ তান্জীহি এবং ‘অধিকতর উত্তম বর্জন’ (تـرك اولـى) জায়েজ বা বৈধরই পর্যায়ভূক্ত।

মুফ্তি মাওলানা আমিমুল ইহছান ছাহেব প্রণীত ‘আত্তা রীফাতুল্ ফিকহিয়্যাহ’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়-

ان كان الى الحل اقرب تكون تنزيهية .

অর্থাৎ- “যা হালালের কাছাকাছি তা’ মাকরূহ তানজীহি। বাকী রইল, উক্ত কাজটি ‘মাকরূহ তাহরীমি’ কিনা? তা কোন কোন ফকীহ মাকরূহ তাহরীমি বলেছেন। তবে অধিক সংখ্যক ফকীহর অভিমতানুসারে তা জায়েজ। যদিও কেউ কেউ তা বর্জন করা উত্তম বলেছেন। কারণ, তা পালনে কোন ক্ষতি বা গুনাহ নেই।

যুক্তির নিরীখে বিচার করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আলোচ্য কাজটির অবৈধতার পক্ষে মাকরূহ তান্জীহি বা অপেক্ষাকৃত কাজ উত্তম-অধিক বর্জন এর (ترك اولى) বেশী কিছু অধিক বলা যাবে না। কারণ তার অবৈধতা প্রমাণের জন্য কোরআন মজিদ বা হাদিস শরীফের নিষেধসূচক কোন প্রমাণ উত্থাপন করা সম্ভব নয়। সুতরাং তা মাকরূহ তাহরীমি হতেই পারে না। কেননা, তাহলে ‘ওয়াজিব’ এরই সমপর্যায়ের। যেমন, ‘ফতোয়া শামী’ ১ম খণ্ড, ৬৩৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে-

انه فى رتبة الواجب لايثبت الّا بما يثبت به الواجب يعنى بالنهى الظنى الثبوت او الدلالة . 

অর্থাৎ- তা (মাকরূহ তাহরিমী) ওয়াজিবেরই সমমানের। যেহেতু ওয়াজিব প্রমাণিত হবার জন্য যে মানের দলীল প্রয়োজন (يعنى ظنى الثبوت والدلالة) অনুরূপ দলিল দ্বারাই ‘মাকরূহ তাহরিমী’ প্রমাণিত হয়। তাছাড়া অধিকন্তু মাকরূহ তানজিহী এবং অধিকতর উত্তম বর্জন (ترك اولى) যুগ পরিবর্তনের ফলে মোস্তাহাব এর মর্যাদা লাভ করে। আল্লামা শামী (رحمة الله) উচ্চরবে যিকির করা মাকরূহ বলেছেন। শুধু কোরআন মজিদের নিম্নলিখিত আয়াতের ভিত্তিতেই-  قوله تعالى ان الله لايحب الـمعتدين .

অর্থাৎ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।’ অতঃপর উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়- اى المجاهرين بالدعاء অর্থাৎ উচ্চরবে দোয়া করে এমন সব ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তায়ালা ভালবাসেন না।

মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) প্রণীত শরহে নেক্বায়া ও অন্যান্য কিতাবাদিতে তার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয় যে, এ কাজটা নবী করীম (ﷺ) এর যুগে ছিল না। যেমন- উল্লেখ করা হয়:

لانه بدعة محدثة بعد النبى صلى الله عليه وسلّم . (شرح النفاية، ج-১،ص-১৩৮) 

অর্থাৎ- কারণ, তা নবী করীম (ﷺ) এর পরবর্তী যুগে প্রচলিত একটা নূতন কাজ। (শরহে নেক্বায়া, ১ম খণ্ড, ১৩৮পৃ.)

এখন বিবেচ্য হল যে, ফকীহগণ জানাজার সাথে চলার সময় সরব নীরব কিংবা নির্বিশেষে ‘যিকির’ করা বৈধ বলে অভিমত প্রকাশ করে মুসলমানদেরকে যে অনুমতি দিয়েছেন তাতে যুক্তি-প্রমাণ কি? তাও তো নবী করীম (ﷺ) এর যুগে ছিলনা। যদি থাকত তবে হাদিস শরীফ সমূহে ছাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা ও কার্যে তার প্রমাণ পাওয়া যেত নিশ্চয়ই। অথচ কোন ছাহাবীর বর্ণনা কিংবা অন্য কোন ছহীহ হাদিসে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না বরং হাদিস শরীফে শুধু নীরবে বসে থাকার বর্ণনাই প্রতিভাত হয়। যেমন, পূর্বোলে­খিত ইবনে মাজা শরীফের এক হাদিসেই তার সমুজ্জ্বল প্রমাণ বিদ্যমান।

ইমাম নববী (رحمة الله) সেদিকে ইঙ্গিত করে উল্লেখ করেছেন-

ماكان عليه السلف رضى الله عنهم السكوت فى حال السير مع الجنازة . 

অর্থাৎ- তা ‘ছলফে ছালেহীন’ এর আমলে ছিল না; বরং তাঁরা ‘জানাজার’ সাথে পথ চলার সময় নীরবই থাকতেন। তাই এখন প্রশ্ন জাগে তাঁরা মৌলিক যিকিরের অনুমতি দিলেন কোন্ দলীলের ভিত্তিতে? তদুত্তরে একথা অনস্বীকার্য যে, ফোকাহা-কেরাম যুগ পরিবর্তনের প্রেক্ষিতেই প্রথমতঃ মৌলিক যিকিরের অনুমতি দিয়েছেন। কারণ, কালের পরিবর্তনে মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ও কবরের কঠিন শাস্তির ভীতি ক্রমশঃ হ্রাস পেয়েই আসছে। নবী করীম (ﷺ) এর যুগে মানুষের অন্তরের যে অবস্থা ছিল তা ক্রমে পরিবর্তিত হতে থাকে। এতদ্ভিত্তিতেই ফকীহগণ ‘জানাজার’ সাথে পথচলার সময়’ উচ্চস্বরে যিকির করার শিক্ষা দিয়েছেন।

যুগের পরিবর্তনে শরীয়তের বিশেষ বিশেষ বিধির পরিবর্তন

বর্তমান যুগেও লোকজন খোদাভীতি বিবর্জিত হয়ে ক্রমেই আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমন কি পূর্বেকার যুগের তুলনায় খোদাভীতি তাদের অন্তর থেকে বিদায় নিয়েছে বললেও স্থান বিশেষে অত্যুক্তি হয় না। এ কারণেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলেমগণ ‘জানাজা’ নিয়ে চলন্ত অবস্থায় উচ্চরবে ‘যিকির’ করার অনুমতি দিয়েছেন, যাতে মুসলমানদের অন্তরে মৃত্যুর স্মরণ ও তার ভীতি ভাবনার সঞ্চার হয় এবং পার্থিব বাজে কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে। ফকীহগণ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, আলেম সম্প্রদায়ের উচিৎ, তাঁরা যেন তাঁদের যুগের ‘ওরফ’ বা প্রচলিত অবস্থার প্রেক্ষিতেই ফতওয়া দেন। যেমন- ‘উসূল-ই-ফিকহে’ নিয়ম রয়েছে-          تغير الاحكام بـتغيـر الزمان . 

অর্থাৎ- যুগের পরিবর্তনে শরীয়তের বিশেষ বিশেষ বিধিরও পরিবর্তন ঘটে। আরো উল্লেখ করা হয়-

من لم يعرف الاحوال فى زمانه فهو جاهل .

অর্থাৎ- যে ব্যক্তি স্বীয় যুগের অবস্থাদি সম্পর্কে অবগত নয় সে এক মূর্খ।

জ্ঞাতব্য যে, মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত কার্যাদির পরিপন্থি ফতোয়া দেয়া একগুয়েমী কিংবা পক্ষপাতিত্বেরই নামান্তর মাত্র।

দেখুন! ‘জানাজার সাথে পথ চলার সময়’ ‘সরব যিকির’ আমাদের বাংলাদেশ, ভারতের বিশেষ বিশেষ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল, পাকিস্তান এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সমূহেও একটা বিশেষভাবে পরিচিত এবং প্রচলিত আমল। কাজেই ফতোয়াদানকারীদের উচিত, যেন তাঁরা ‘ওরফ’ বা মুসলিম সমাজে এ ধরণের প্রচলিত নিয়মের ভিত্তিতেই ফতোয়া দেন; এবং আলোচ্য মুহূর্তে সরব যিকিরের বৈধতা স্বীকার করে তার অনুমতি দানে গড়িমসি না করেন।

উচ্চরবে যিকির তালক্বীনের অন্তর্ভূক্ত

তাছাড়া উচ্চরবে যিকিরের ফলে জানাজা নামাজের ঘোষণা এবং দাফনের পূর্বে মৃত ব্যক্তিকে ‘তালক্বীন’ বা ‘মুনকির’ ও ‘নকীর’ এর ‘প্রশ্নাবলীর’ জবাব শিক্ষা প্রদানের কাজও সম্পন্ন হয়।

যেমন- হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে- لقنوا موتاكم অর্থাৎ- তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের তালক্বীন বা শিক্ষা প্রদান কর। উল্লেখ্য যে, এতে শর্তহীনভাবে নির্দেশিত হয় যে, মৃত ব্যক্তির ‘রূহ’ ‘জানাজার’ সাথে সাথে চলতে থাকে; যারা জানাজা বহন করে এবং দাফন করে তাদের সবাইকে ‘রূহ’ চিনতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আল্লামা ছূয়ূতী (رحمة الله) ‘শরহুচ্ছুদুর’ নামক কিতাবে বেশ সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইমামগণ মৃত ব্যক্তিদেরকে শিক্ষা প্রদান করা (তালক্বীন) মোস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, ‘সরব-যিকির’ মোস্তাহাব; যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করে সে স্বেচ্ছায় সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদেরই পর্যায়ভূক্ত এবং একগুঁয়েই বটে।

সব নব প্রচলিত কাজ বর্জনীয় বা মাকরূহ নয়

নবী করিম (ﷺ) এর পরবর্তী যুগে যে কোন কাজ নব প্রচলিত হলেই কি তা মন্দ বা বর্জনীয় কিংবা মাকরূহ বলে গণ্য হবে? এ ক্ষেত্রে মন্তব্য যে, আসলে সব নব প্রচলিত কাজ বর্জনীয় বা মাকরূহ নয় যদি না তা সত্যের দিশারী পবিত্র সুন্নাহর পরিপন্থী হয়। 

মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তদীয় প্রণীত কিতাব ‘মিরকাত শরহে মিশকাত’ এ উল্লেখ করেছেন-

انّ احداث مالا يتازع الكتاب والسنة ليس بمذموم .

অর্থাৎ- যে সব নব প্রচলিত কার্যাদি কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী নয়, তা মন্দ বা বর্জনীয় নয়। তাছাড়া, ‘দস্তুরুল ওলামা’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে-

ومن الجهلة من يجعل كل امر لم يكن فى زمن الصحابة بدعة مذمومة وان لم يقم دليل على قبحه تمسكا بقوله صلى الله عليه وسلّم اياكم ومحدثات الامور ولا يعلمون المراد بذالك ان يجعل فى الدين بما هو ليس منه . 

অর্থাৎ- কিছু এমন মূর্খ ব্যক্তি রয়েছে, যারা ছাহাবা কেরামের যুগে ছিলনা এমন সব কার্যাদিকে ‘বর্জনীয় বিদ্আত’ বলে অভিহিত করে; অথচ, তারা তাদের এ দাবীর সপক্ষে কোন সুস্পষ্ট ও যথার্থ প্রমাণ দাঁড় করাতে পারে না। যদিও তারা এ প্রসঙ্গে হুজুর (ﷺ) এর হাদিস-

ايَّـاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ

অর্থাৎ- তোমরা নব আবিষ্কৃত কার্যাদি থেকে বিরত থাক। এটিকে তাদের পক্ষে ‘দলীল’ হিসেবে পেশ করে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তারা এ ‘মহান বাণীর’ ভাবার্থ সম্পর্কে মোটেই অবগত নয়। তার প্রকৃত মাহাত্ম্য হল পবিত্র দ্বীন তার পরিপন্থী কার্যকলাপ থেকে বারণ করে। যদি কোন কাজ পথ নির্দেশক সুন্নাহর পরিপন্থী হয় তবেই তো সে কার্যটি মন্দ বা পরিহার্যের যোগ্য হয়। নতুবা সুন্নাহসম্মত নব প্রচলিত কার্যাদি সম্পর্কে হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র হাদিস-

مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً . الخ 

অর্থাৎ- যে ব্যক্তি ইসলামে প্রশংসনীয় সুন্নাহ বা কার্যাদির নব প্রচলন করে এটিই প্রযোজ্য। কাজেই উক্ত কাজটি যে ‘বিদ্য়াত-ই-হাছানাহ’ বা শরীয়তের একটা পূণ্যময় নব প্রচলিত কার্য এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর ‘বিদ্আত ই-হাছানাহ’ যে ‘মোস্তাহাব’ এতেও কারো দ্বিমত নেই। ফতোয়া শামীতে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়-

ان البدعة الـحسنة متفق على نـدبـها . (شامى)

অর্থাৎ-‘বিদ্য়াত-ই-হাছানাহ্’ ‘মোস্তাহাব’-এটা সর্বস্বীকৃত অভিমত। (শামী) 

‘নুরুল আনোয়ার’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়- المثبت اولى من النافى অর্থাৎ- ‘কোন স্বীকৃতিসূচক কাজ অস্বীকৃতিসূচক কাজ থেকে উত্তম; যদি তার অবৈধতা সম্পর্কে কোন প্রমাণ না থাকে। কেননা প্রত্যেক কিছু মূলতঃ ‘মোবাহ্’। যেমন ‘উছুল-ই-ফিক্হর’ কিতাবাদিতে বর্ণিত হয়েছে-

اصل الاشياء الاباحة

মূলতঃ প্রত্যেক কিছু ‘মোবাহ’; যতক্ষণ না তা হারাম বা মাকরূহ তাহরীমী বলে دليل ظنى বা دليل قطعى দ্বারা প্রমাণিত হয়। হাদিস শরীফে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

الْحَلَالُ مَا أَحَلَّ اللهُ فِي كِتَابِهِ وَالْحَرَامُ مَا حَرَّمَ اللهُ فِي كِتَابِهِ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ مِمَّا عَفَا عَنْهُ . (مشكوة سريف)

অর্থাৎ- সে সব বস্তু হালাল; যা আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে হালাল বলে বর্ণনা করেছেন। আর সে সব বস্তু হারাম; যা আল্লাহ্ তায়ালা কোরআন মজিদে হারাম বলে বর্ণনা করেছেন এবং যে সব বস্তু সম্পর্কে হালাল বা হারাম কিছুই বর্ণনা করেননি তা মার্জনীয় অর্থাৎ ‘মোবাহ’। আবার কোন মোবাহ বস্তু স্থান ও কাল বিশেষে মোস্তাহাবের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। যেমন- উছূল বেত্তাগণ মন্তব্য করেছেন-

مرتفع عن درجة الاباحة الى رتبة المستحب كما صرح به غير واحد من المحققين . 

অর্থাৎ- ‘মোবাহ’ কখনো ‘মোস্তাহাব’ এর পর্যায়ে উন্নীত হয়। বহু সংখ্যক বিজ্ঞ আলেম (ফকীহ) এ অভিমত প্রকাশ করেছেন।

সৎ নিয়্যতের উপরই কর্তার ফলাফল নির্ধারণ

ফতোয়া শামীতে উল্লেখ করা হয়-

فاِنّ النية تصير العادات عبادات والمباحات طاعات . 

অর্থাৎ- সৎ নিয়ত দ্বারা স্বভাবজনিত প্রচলিত কার্যাদি ও ‘মোবাহ’ কাজকে এবাদতে পরিণত করে; (যতক্ষণ না শরীয়ত মতে তা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়।) এটা অনস্বীকার্য যে, এ যুগের লোকেরা ক্রমশঃ ‘যিকির’ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার ‘যিকির’ বা স্মরণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা কি তাদের পরিশুদ্ধিমূলক পদক্ষেপ হবে? কখনো না। কারণ মুসলমানগণ উক্ত কাজটা ছওয়াবের নিয়তেই করে থাকে। নিয়ত অনুসারে কর্মফল পাওয়া যায়। ‘ফতোয়া খাইরিয়্যাহ’- ২য় খণ্ডের ১৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

ان الامور بمقاصدها والشئ الواحد ليتّصف بالحل والحرمة باعتبار ماقصد له وهى ماخوذة من الحديث الذى . (رواه الشيخان) 

অর্থাৎ- সমস্ত কাজের ফলাফল কর্তার নিয়ত অনুসারেই পাওয়া যায়। কোন কাজে নিয়ত বা উদ্দেশ্য যদি ভাল হয়, তবে সে কর্মও পূণ্যময় হয়। আর তার পরিণামও ভাল হয়। পক্ষান্তরে, উদ্দেশ্য (নিয়ত) যদি খারাপ হয়, তবে তার পরিণামও খারাপ হওয়া যুক্তিযুক্ত। এতে বুঝা যায় যে, একই কাজ কর্তার উদ্দেশ্যের (নিয়ত) ভিত্তিতে ‘হালাল’ এবং ‘হারাম’ উভয় নামেই অভিহিত হতে পারে। এ বর্ণনাটি ইমাম বোখারী ও মুসলিম (رحمة الله) এরই বর্ণনা থেকে গৃহীত। তাছাড়া আলোচ্য ‘যিকির’ দ্বারা মৃত ব্যক্তির রূহে শান্তি এবং আনন্দের সঞ্চার হয়।

বিশেষত, সর্বোৎকৃষ্ট ‘যিকির’ ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” অনুরূপভাবে অন্যান্য ‘যিকির’; যদ্বারা মৃত ব্যক্তির ‘তালক্বীন’ বা শিক্ষা প্রদানের কাজ হাসিল হয়। আল্লাহর ‘যিকির’ হিসেবে তো তা আদায় হয়ই।

যেমন- الله ربى محمد نبى صلّى الله عليه وسلّم (আল্লাহু রাব্বী, মুহাম্মদ নবী (ﷺ)) যা আমাদের দেশে (ওরফরূপে) সাধারণভাবে প্রচলিত যিকিরেরই শামিল। সুতরাং এমন এক পূণ্যময় কর্ম থেকে মুসলমানদেরকে বিরত রাখা একগুঁয়েমী ও অন্যায়ের পক্ষপাতীত্ব ছাড়া আর কি হতে পারে? কাজেই আলেম সম্প্রদায়ের উচিৎ, যেন তাঁরা এ ধরণের ‘যিকিরে’ বাধা না দিয়ে যুগের মুসলমানদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রেখেই এ যিকিরের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন। কারণ জনসাধারণকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (ﷺ) এর যিকির থেকে বিরত রাখা মুসলমানদের আত্মার পরিশুদ্ধি হবে না; বরং পথভ্রষ্ট করারই নামান্তর হবে।

‘ফতোয়া খাইরিয়্যাহ’তে বর্ণনা করা হয়-

من حرمّ الحلال فقد وقع فى الضلال .

অর্থাৎ- যে ব্যক্তি হালালকে হারাম জ্ঞান করে, সে নিশ্চয় পথভ্রষ্টতার দিকে ধাবিত হর।

উপরোলে­খিত কিতাবের ২য় খণ্ডের ১৮১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়- 

قال بعض اهل العلم انه افضل حيث خلا ممّا ذكر لانه اكثر عملا ولتعدّى فائدته الى السامعين ويوقظ قلب الذّاكر فيجمع همّه الى الفكر ويصرف سمعه اليه ويزيد النشاط . 

অর্থাৎ- কোন কোন ইমাম অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, নীরবে যিকির করা অপেক্ষা উচ্চরবে যিকির করা উত্তম। কেননা তাতে কর্মের আধিক্য রয়েছে। তাছাড়া এতে শ্রোতাগণও উপকৃত হয়; তা যিকিরকারীর অন্তরকে জাগ্রত করে; অতঃপর তার ধ্যান-ধারণা সুচিন্তার দিকে ধাবিত হয়; শ্রোতারা যিকিরকারীর দিকে কর্ণপাত করে এবং এতে তার আনন্দ ও উৎসাহ বাড়তে থাকে।

জেনে রাখা দরকার যে উক্ত সময়টা হল ‘যিকির’ ও ভাবনা-চিন্তার।

ইমাম নববী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন-

فان هذا وقت ذكر وفكر يقبح فيه الغفلة والهو والاشتغال بالحديث الفارغ ان الكلام بما لا فائدة فيه منهى عنه فى جميع الاحوال فكيف فى هذا الحال . 

অর্থাৎ- নিশ্চয়ই এ সময়টা (জানাজার) হল ‘যিকির’ ও ভাবনা-চিন্তার। এ মুহূর্তে অন্য মনষ্ক হয়ে বা অনর্থক কর্মে কিংবা বাজে কথাবার্তায় রত থাকা মোটেই উচিৎ নয়। কেননা, যেহেতু অনর্থক কথা-বার্তা অন্য যে কোন সময়ে নিষিদ্ধ, সেহেতু এ সময়টুকুতে কি করে উচিৎ বা জায়েজ হতে পারে?

কাজেই ধ্যান ধারণাকে সুচিন্তার দিকে ধাবিত করা, অলসতা বর্জন করা, বাজে কথা-বার্তা থেকে বিরত রাখা এবং ‘যিকির’ এর প্রতি উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই বর্তমানে ওলামায়ে কেরাম ‘জানাজা’ নিয়ে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ তথা মোস্তাহাব বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

দুঃখের বিষয়, অনেক স্থানে বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গকেও বাজে কথাবার্তায় মগ্ন হতে দেখা যায়। এখানে জেনে রাখা দরকার যে, কোন কাজ হুজুর (ﷺ) এর যুগে কৃত হয়নি বলে তা পরবর্তী যুগে মোস্তাহাব হতে পারে না- এমন নয়; যদি তা কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী না হয়।

যেমন- ‘বেক্বায়া’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়- والقصدمع اللفظة اولى অর্থাৎ অন্তরস্থ নিয়তের সাথে শাব্দিক সমন্বয় সাধন উত্তম।

‘মুনিয়াতুল মুছাল্লী’তে নিয়তের সাথে সাথে শাব্দিক উচ্চারণ মোস্তাহাব বলে অভিহিত করা হয়। (غررالاحكام) গুরারুল আহকাম নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়- التلفظ مستحب অর্থাৎ- মৌখিকভাবে নিয়তকে ব্যক্ত করা মোস্তাহাব। এ কথাও সুস্পষ্ট যে, ‘কুরুনে ছালাছাহ’ (হুজুর (ﷺ), ছাহাবা ও তাবেয়ী (رضي الله عنه) এর যুগসমূহ) তে যা ছিলনা, তা পরবর্তী কালে না জায়েজ বা অবৈধ হতে পারে না, যদি না তা হেদায়তসম্মত পন্থার পরিপন্থী হয়। কারণ মূলতঃ যুগ কখনো শরীয়তের বিধি-বিধানের উৎস নয়; শরীয়তের বিধি-নিষেধের উৎস হল কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। উল্লেখ্য যে, কোন কিছু তখনই মন্দ বা বর্জনীয় হয় যখন তা সর্বস্বীকৃত সুন্নাহর পরিপন্থী হয়। যেমন- ‘মিরকাত’ শরহে মিশকাত’ এ উল্লেখ করা হয়-

انّ احداث مالا ينازع الكتاب والسنّة ليس بمذموم . 

অর্থাৎ- যে সব নব প্রচলিত কাজ কিতাব ও সুন্নাহর পরিপন্থী নয় তা অবশ্যই মন্দ বা বর্জনীয় নয়।

তবে ইসলামের প্রাথমিক ‘তিন যুগ’ এর প্রাধান্য সম্পর্কে হাদীস শরীফে যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা তৎকালীন মুসলমানদের ঈমান-আকিদা ও বরকতের ভিত্তিতেই; আইন প্রণয়নকারী হিসেবে নয়। কারণ মূলতঃ ‘যুগ’ শরীয়তের বিধান সমূহের উৎস নয়; দ্বীনি বিধি নিষেধের ভিত্তি হল কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াছ। অবশ্য কেউ কেউ ‘ওরফ’ ও শরিয়তের বিধানে মৌলিকত্বের দাবীদার বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

এসব উদ্ধৃতিসমূহে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ‘জানাজার’ সাথে পথ চলার সময় উচ্চরবে যিকির করা নিঃসন্দেহে জায়েজ বা বৈধ বরং     মোস্তাহাব। সুতরাং তাতে কাকেও বাধা দেয়া কিংবা বারণ করা মোটেই উচিৎ হবে না। বরং তাতে উৎসাহিত করাই শ্রেয়।

পবিত্র কোরআনে সীমালঙ্ঘনকারী বলতে কি বুঝায়েছে এর বর্ণনা

আল্লামা শামী এ প্রসঙ্গে যে দলিল পেশ করেছেন-

انه لا يحب المعتدين اى الجاهرين بالدعاء .  

অর্থাৎ- আল্লাহ্ সীমালঙ্ঘনকারী অর্থাৎ উচ্চরবে প্রার্থনাকারীকে পছন্দ করেন না। তা উপরোক্ত দলিলাদির তুলনায় গ্রহণীয় নয়। (কারণ) আল্লামা শামীর ওস্তাদ আল্লামা খাইরুদ্দীন রমলী (رحمة الله) (আল্লামা শামী কর্তৃক উল্লেখিত আয়াতের) উক্ত তফসীরের জবাবে উল্লেখ করেছেন-

لا يحب المعتدين بالجهر بالدعاء مردود بانّ الراجح فى تفسيره التجاوز عن المامور به . 

অর্থাৎ- উক্ত আয়াতের সর্বাধিক গৃহীত তফসীর হল কোন কাজে ‘শরীয়তের নির্দেশিত সীমালঙ্ঘন করা, উচ্চরবে প্রার্থনা করা নয়’। কাজেই শেষোক্ত তফসীর (উচ্চরবে প্রার্থনা করা) ত্রুটিপূর্ণ ও বর্জনীয়।

ফতোয়া খাইরিয়্যাহ’ ২য় খণ্ডের ১৮১ পৃষ্ঠায় আল্লামা শামীর উক্ত অভিমতের অন্য এক জবাবে উল্লেখ করা হয়- উক্ত আয়াতে দোয়া বা প্রার্থনার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে; সাধারণভাবে আল্লাহর যিকিরের নয়। আমাদেরও একথা জানা আছে যে, নীরবে দোয়া বা প্রার্থনা করা উত্তম; যেহেতু তাতে একাগ্রতার প্রকাশ পায়। 

তফসীরে ‘মুজহেরী’-সূরা আ’রাফ, ৪০৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

فان الاخفاء دليل الاخلاص وابعد من الرياء .

অর্থাৎ- নীরবতা ‘ইখলাছ’ বা একাগ্রতার চিহ্ন এবং লোক দেখানো থেকে মুক্ত। উক্ত তফসীর গ্রন্থের ৪১০ পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়-

قيل المعتدين فى الدعاء كمن سأل منازل الانبياء او الصعود الى السماء او دخول الجنّة قبل ان يموت ونحو ذالك ممّا يستحيل عقلا او عادة او يسئل امورا لافائدة فيها معتدا بها . 

অর্থাৎ- দোয়া প্রার্থনায় সীমালঙ্ঘন করা, যেমন- কেউ যদি নবী  (আ.)-এর মর্যাদা প্রার্থনা করে, কিংবা আসমানে আরোহণের আকাঙ্খা ব্যক্ত করে, অথবা মৃত্যুর পূর্বেই বেহেশতে প্রবেশের সুযোগ চেয়ে বসে- এ ধরণের ‘দোয়া’ অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক; অসম্ভবও বটে অথবা এমন কিছুর প্রার্থনা করা যাতে কোন লাভ বা ক্ষতি নেই। দোয়ায় এ ধরণের সীমালঙ্ঘনই আল্লাহ্ তায়ালার অপছন্দনীয়।

উক্ত তফসীরের ৪১১ পৃষ্ঠায় আল্লামা কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি (رحمة الله) উক্ত আয়াতের অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়ে উল্লেখ করেছেন-

الاعتداء التجاوز عن حــد ود الشـرع .

অর্থাৎ- اعتداء শব্দের অর্থ হল শরীয়তের বিধিতে সীমালঙ্ঘন করা।

‘তাফ্সীরে জালালাঈন’ শরীফে উল্লেখ করা হয়- 

لايحب المعتدين فى الدعاء بالتسدق ورفع الصوت .

অর্থাৎ-একাগ্রতা ব্যতিরেকেই দোয়াকে অহেতুক দীর্ঘায়িত করা কিংবা অবাঞ্চিত ধরণের উচ্চরব সহকারে দোয়া করা আল্লাহর অপছন্দনীয়।

তফসীরে বায়দাবীর ১২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

انه لايحب المعدين المجاوزين ما امروا فى الدعاء .

অর্থাৎ- দোয়ায় নির্ধারিত সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে আল্লাহ্ ভালবাসেন না।

তফসীরে ‘মাদারেক’ এ উল্লেখ করা হয়-

انه لا يحب المعتدين المجاوزين ما امروا به فى كل شئ من الدعاء . 

অর্থাৎ- দোয়ায় যে সব বস্তুর প্রার্থনা করার সীমা নির্ধারিত হয় তা লঙ্ঘনকারীদেরকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না।

তফসীরে খাজেন ২য় খণ্ডের ২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

لا يحب المعدين يعنى فى الدعاء .

অর্থাৎ- অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক কিছু প্রার্থনা করে যারা দোয়ায় সীমালঙ্ঘন করে আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে পছন্দ করেন না।

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মৌলানা আশরফ আলী থানভী তফসীরে বয়ানুল কোরআন ৪র্থ খন্ডের ১৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- ‘‘তোমরা সর্বদা ও সর্বাবস্থায় স্বীয় প্রতিপালকের দরবারে প্রার্থনা কর প্রকাশ্যে কিংবা নিরবে। তবে, বাস্তবিক পক্ষে, আল্লাহ্ তায়ালা সে সব ব্যক্তিদের ভালবাসেন না, যারা দোয়ায় ‘আদব’ বা শালীনতার সীমালঙ্ঘন করে। উদাহরণস্বরূপ- কেউ এমন কিছু প্রার্থনা করল যা অযৌক্তিক ও শরীয়তের দৃষ্টিতে অসম্ভব বা মানবীয় প্রকৃতির পরিপন্থী। অথবা এমন কিছু প্রার্থনা করল; যা শরীয়ত মতে নিষিদ্ধ বা অস্বাভাবিক। যেমন- কেউ খোদায়ী, নবুয়ত, ফেরেশতাদের উপর স্বীয় প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষমতা, কিংবা অবিবাহিত মহিলার সাথে মেলামেশার অনুমতি এবং ‘জান্নাতুল ফেরদাউসের’ ডান পার্শ্বে একটা মনোরম শুভ্রদালান ইত্যাদির প্রার্থনা করল। এ ধরণের প্রার্থনা আল্লাহর সঙ্গে বেয়াদবী করারই শামিল। অবশ্য ‘জান্নাতুল ফেরদৌস’ লাভের দোয়া কাম্য ও মার্জনীয়। তবে এতে অতিরিক্ত শর্তাবলী আরোপ করা নিষিদ্ধ।

তফসীরে ‘খাজায়েনুল এরফান’ এ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ছদরুল আফাজেল (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে মঙ্গল কামনাই হল ‘দোয়া’। তা অবশ্যই এবাদতের শামিল। কেননা প্রার্থনাকারী তখন নিজেকে নিতান্তই বিনয়ী ও শরণাপন্ন মনে করে; আর স্বীয় প্রতিপালককে সর্বশক্তিমান ও প্রকৃত ব্যবস্থাপক জ্ঞানে একাগ্রচিত্তে স্মরণ করে।

এ জন্যই হাদিস শরীফে এরশাদ করা হয়- الدعاء مخّ العبادات অর্থাৎ- ‘দোয়াই এবাদতের সারবস্তু। আর আল্লাহ্ তায়ালা ’تضرع‘ সহকারে দোয়া করার শিক্ষা দিয়েছেন। تضرع মানে স্বীয় লাজুকতা ও বিনয় প্রকাশ করা। এ প্রসঙ্গে হযরত হাছান বসরী (رضي الله عنه) এর অভিমত হল যে, নিম্নস্বরে (বিনয়ের সাথে) দোয়া করা উচ্চরবে দোয়া করার চাইতে সত্তর গুণ অধিক উত্তম। অতঃপর উল্লেখ করা হয় যে, দোয়ায় সীমালঙ্ঘন কয়েক প্রকারের হতে পারে। তন্মধ্যে অতীব উচ্চস্বরে দোয়া করা অন্যতম। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আলেম সম্প্রদায়ও দোয়ায় চিৎকাররূপী উচ্চস্বর পছন্দ করেন না।

এখন দেখুন; আল্লামা শামী (رحمة الله), উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কি অভিমত ব্যক্ত করেছেন? তিনিও এ আয়াতের তফসীরে- المجاهرين بالدعاء (দোয়ায় স্বর-সীমালঙ্ঘনকারী) শব্দদ্বয় উল্লেখ করে উচ্চস্বরে দোয়া করা অনুচিত বলেই উল্লেখ করেছেন; উচ্চস্বরে যিকির করা সম্পর্কে কোন    মন্তব্য করেননি। বস্তুত দোয়া ও ‘যিকির’ এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উভয়ের মধ্যেকার পার্থক্য হল, ‘বিশেষ’ ও ‘সাধারণ’ বা ‘কমব্যাপকার্থক’ ও ‘অধিক ব্যাপকার্থক’ এর মধ্যকার সম্পর্ক বা পার্থক্যের ন্যায়। যেমন হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

أَفْضَلُ الذِّكْرِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ الاسْتَغْفار .

অনুরূপভাবে-

أَفْضَلُ الذِّكْرِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ قَوْلُ الْحَمْدُ لِلهِ .

অর্থাৎ- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ সর্বোৎকৃষ্ট ‘যিকির’ আর সর্বোৎকৃষ্ট দোয়া হল ‘ইস্তেগফার’ বা স্বীয় গুনাহর ক্ষমা প্রার্থনা করা। অন্য হাদিসে বলা হয়, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ পাঠ করা উৎকৃষ্টতম ‘যিকির’ এবং উৎকৃষ্টতম দোয়া হল ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলা।

সুতরাং উভয় শব্দের মধ্যে পার্থক্য কি- তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাজেই উল্লেখিত আয়াত আলোচ্য বিষয়ে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না এবং তা আমাদের প্রতি অপবাদেরও সুযোগ দেবে না। কেননা আমরা তার পরিপন্থী নই; বরং তদানুযায়ী যথাযথভাবে আমরা আমল করি।

উল্লেখিত উদ্ধৃতি ও বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হচ্ছে যে, উক্ত আয়াতের অর্থ (তফসীর) হল- দোয়ায় সীমালঙ্ঘনকারী আল্লাহর ভালবাসা অর্জনে অক্ষম; যদি সে নিম্নস্বরে এমন সব বস্তুর জন্য প্রার্থনা করে যা অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক; কিংবা দোয়ায় মার্জনীয় কন্ঠসীমা অতিক্রম করে, তবেই সে ব্যক্তি দোয়ায় সীমালঙ্ঘনকারীদের পর্যায়ভূক্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে।

হযরত ইবনে জুরাইজ (رضي الله عنه) বলেছেন-

الرافعين اصواتهم بالدعاء وعنه الصياح فى الدعاء مكروه وبدعة . 

অর্থাৎ- দোয়ায় চিৎকার করা মকরূহ ও বিদয়াত।

তফসীরে মাদারেক ও অন্যান্য তফসীর গ্রন্থসমূহেও এ ধরণের অভিমত রয়েছে।

বিশেষেতঃ এখানে একটা মাছআলা স্মরণ রাখা দরকার যে, দোয়া যদি কেউ একাকী করে তবে তার জন্য নীরবে করাই উত্তম। আর সম্মিলিতভাবে দোয়া করলে সরবে করাই শ্রেয়। কেননা এতে অন্যান্য লোকেরা ‘আমীন’ বলার সুযোগ পাবে। এ প্রসঙ্গে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

لا يجمع ملأ فيدعوا بعضهم ويؤمن بعضهم الّا اجابهم الله . 

মুসলমানদের কোন জমায়েতে যদি কেহ দোয়া করে আর অন্যান্যরা ‘আমীন’ বলে, তবে সে দোয়া আল্লাহ্ নিশ্চয় কবুল করেন।

হুজুর (ﷺ) উচ্চস্বরে দোয়া করার বর্ণনা

মিশকাত শরীফে বোখারী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়- একদা হুজুর (ﷺ) আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে স্বীয় হস্ত মোবারক উত্তোলন করে নিম্নলিখিত দোয়া করেছিলেন-

اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَأْمِنَا اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا .

অর্থাৎ- হে আল্লাহ্! আমাদের শাম (সিরিয়া) কে ধন্য কর; হে আল্লাহ্! আমাদের ইয়ামনকে তোমার কৃপা দ্বারা ধন্য কর।

তখন জনৈক সাহাবী আরজ করলেন- ‘আমাদের নজদকেও’। দ্বিতীয় বারও হুজুর (ﷺ) দোয়ায় শাম এবং ইয়ামনের কথাই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নজদের নাম উল্লেখ করেননি।

মোটকথা, হুজুর (ﷺ) ইয়ামন এবং শামের জন্য তিন বার দোয়া করেছেন এবং পরিশেষে নজদ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করেছেন-

هُنَاكَ الزَّلَازِلُ وَالْفِتَنُ وَبِهَا يَطْلُعُ قَرْنُ الشَّيْطَانِ .

অর্থাৎ- সেখানে (নজদে) নানা প্রকার ভূমিকম্প ফিৎনা-ফ্যাসাদ এবং শয়তানের অনুসারী একটা দলের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

দেখুন, এ হাদিস দ্বারা উচ্চরবে দোয়া করা বৈধতা প্রমাণিত হল। কেননা, যদি হুজুর (ﷺ) উচ্চস্বরে দোয়া না করতেন তবে নজদবাসী নজদের জন্য দোয়া করার অনুরোধ কিভাবে করত? নীরব প্রার্থনা তো শুনা যায় না। সুতরাং উচ্চরবে দোয়া করার বৈধতা হুজুর (ﷺ)-এর পবিত্র ‘আমল’ দ্বারাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে; বরং তা উত্তমও বটে। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেছেন-

ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً (سورة الأعراف)

আর এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) উল্লেখ করেছেন-

اى عـلانـيـة اوسـريـة

অর্থাৎ- সরবে ও নীরবে উভয় প্রকার দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়। (তফসীরে ইবনে আব্বাস)

তফসীরে ছাবী ২য় খণ্ডে ৭০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

واعلم ان الانسان اذا كان وحده فالسر افضل له ان كان ينشط فى ذالك والا فالجهر افضل له كلجماعة . 

অর্থাৎ- জেনে রাখ, একাকী প্রার্থনা নীরবে করা উত্তম; আর সম্মিলিত প্রার্থনা উচ্চরবে করাই শ্রেয়; যেমন লোক জামায়েতে। বাকী রইল- উচ্চরবে যিকির করার প্রসঙ্গ- কোরআন মজিদে উচ্চস্বরে যিকির করার প্রকাশ্য কিংবা অস্পষ্ট কোন নিষেধ নেই।

হযরত শাহ আবদুল আজিজ মোহাদ্দেছ দেহলভী (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে বলেছেন- কোরআন করিমে ‘সরব-যিকির’-নির্দেশক প্রমাণই বিদ্যমান। যেমন- পূর্বোলে­খিত আয়াত দ্রষ্টব্য।

‘জাআল্ হক’ এ হযরত হাকীমুল উম্মত (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন- যে সব ফকীহ্ উচ্চরবে যিকির করা নিষিদ্ধ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন; তারা স্বীয় দাবী প্রমাণে কোরআনের কোন আয়াত কিংবা কোন হাদিস উল্লেখ করেননি। তবে শুধু আল্লামা শামী (رحمة الله) প্রমাণস্বরূপ انه لايحب المعتدين (অর্থাৎ তিনি (আল্লাহ) সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না)- এ আয়াত উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তার ব্যাখ্যায়- المجاهرين بالدعاء অর্থাৎ- চিৎকার সহকারে প্রার্থনাকারীদেরকে সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন।

অতএব, বুঝা গেল যে, যিকিরে নিষেদ বা অবৈধতা সম্পর্কে কোন মন্তব্য এতে নেই। তাছাড়া হাদিস শরীফেও তার অবৈধতার প্রমাণ মিলে না। সুতরাং তা নিষিদ্ধ বলতে ‘মকরূহ তানজীহীর’ বেশী কিছু বলা যায় না। ‘মাকরূহ তান্জিহী’ জায়েজেরই পর্যায়ভূক্ত।

অনুরূপভাবে, মোশাররেহ তরীকায়ে মোহাম্মদীয়ায় বর্ণনা করেছেন-

هو يكره علٰى معنى انـه تارك الاولى .

অর্থাৎ- জানাজার সাথে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করা মাকরূহ এ অর্থে যে তা অধিকতর উত্তম বর্জিত মাত্র। সুতরাং সর্বদা এটাই অনস্বীকার্য যে, যে সব ফকীহ্ উক্ত কাজটি মাকরূহ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন; তাঁরাও তা ‘মাকরূহে তানজিহী’ বলেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। (জা’আল্ হক- ৯ম খণ্ড, ৩৯১পৃ.)

মজার কথা হল আল্লামা শামী উক্ত কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন-

قيل تحريما وقيل تنزيهًا

অর্থাৎ- তা কারো মতে ‘মাকরূহ তাহরীমি’ ও কারো মতে ‘মাকরূহ-তানজিহী’। তিনি এ বাক্যদ্বয়ে قيل (কর্তাবিহীন ক্রিয়া) দ্বারা মন্তব্যটা দুর্বল বলে ইঙ্গিত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সঠিক মতামত কি তার সুস্পষ্ট বর্ণনা দেননি।

তদুপরি এ কাজটি সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله), ইমাম আবু ইউছুপ (رحمة الله) ও ইমাম মোহাম্মদ (رحمة الله) এর মত কোন স্বতন্ত্র কিংবা বিশেষ কোন মাজহাবের অনুসারী ‘মুজতাদিদের’ কোন সুস্পষ্ট মতামত নেই। অর্থাৎ তাঁরা তাকে মাকরূহ ‘তাহরীমী’ কিংবা ‘তান্জীহী’ বলে অভিহিত করেননি। তবে ফকীহদের মধ্যে আছহাবে আখ্রীজ এর মধ্যে কেউ কেউ তা মাকরূহ তাহরীমী, আর কেউ কেউ মাকরূহ তানজিহী, আবার কেউ কেউ তা উত্তম-বর্জিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ফকীহ্গণের বিভিন্ন    মন্তব্যাদি সম্বলিত কিতাবাদি পর্যালোচনা করলে তাই অনুমিত হয়।

‘জাআল হক’ এর ৩৯৪ পৃষ্ঠায় হযরত হাকীমুল উম্মত (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন- ‘মুজতাহিদ’ (মুজতাহিদ হচ্ছে ইজতিহাদের শর্তাবলী সম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি কোরআন ও হাদিসে গবেষণা করার যোগ্যতা রাখেন) ব্যতীত অন্য কারো (যাঁরা ‘মুজতাহিদ’ এর পর্যায়ে পড়ে না) মতামতের ভিত্তিতে ‘মাকরূহ তাহরীমী’ প্রমাণিত হয় না। কারণ ‘মাকরূহ তাহরীমী’ প্রমাণে শরীয়তের তদ্সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ‘দলীলের’ই প্রয়োজন। তবে নগণ্য সংখ্যক ‘ফকীহ্র’ মতামতের ভিত্তিতে কোন কিছু ‘মোস্তাহাব’ বা জায়েজ বলে স্বীকৃত হতে পারে না। তাই ‘মোস্তাহাব’ এর সংজ্ঞায় একথাই বলা যায় যে, আলেমগণ যা মোস্তাহাব মনে করেন তাই ‘মোস্তাহাব’। কিন্তু মাকরূহ বা হারাম বলে কোন কিছু তখনই প্রমাণিত হয় যখন তা বিশেষ দলীল দ্বারা হারাম বা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়।

কাজেই, পরবর্তী যুগের আলেম সম্প্রদায় সাধারণ মুসলমানদের অবস্থা অবলোকন করে জানাজার সাথে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করায় কোন ক্ষতি তো নেই; বরং মোস্তাহাব বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তা আমাদের আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের সমস্ত ওলামা-কেরামের নিকট গ্রহণীয়। তাই, মুসলিম সমাজে তা প্রচলিত হয়ে আসছে।

সর্বজনমান্য ইমাম হযরত আল্লামা শা’রানী (رحمة الله) বলেছেন-

كقول الناس اما الجنازة لا اله الّا الله محمد رسول اللهِ وقرأة احدن القرآن اما مهلو نحو ذالك ممن حرم ذالك فهو قاصر عن فهم الشريعة . 

অর্থাৎ- যেমন জানাজার সম্মুখে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কলেমা তৈয়্যবাহ পাঠ করা অথবা কোরআন করীম তেলাওয়াত করা যে ব্যক্তি হারাম বলে শরীয়তের জ্ঞান যোগ্যতা তার নেই বললেও চলে। (জাআল হক-১ম খণ্ড, ৩৮৯পৃ.)

আবার ইমাম শা’রানী (رحمة الله) অন্যত্র বলেছেন-

لا يجب انكاره فى هذا الزمان لانهم لم يشتغلوا الحديث الدنيا وذالك لان قلبهم فادغ من ذكر الموت . 

অর্থাৎ- এ যুগে এ ধরণের যিকির থেকে নিষেধ করার কোন যৌক্তিকতা নেই এবং তা উচিৎও হবে না। কেননা, তারা যিকিরে মগ্ন না হলে পার্থিব বাজে কথাবার্তা আরম্ভ করবে। কারণ, তাদের অন্তর মৃত্যুর স্মরণ থেকে শূণ্য।

‘লাওয়াকেহুল আন্ওয়ায়িল কুদ্ছিয়াহ’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়, লেখক উল্লেখ করেছেন-

كان سيدى على الخواص رضى الله عنه يقول اذا علم من الماشيين مع الجنازة انهم لايتركون اللغو فى الجنازة يشتغلون باحوال الدنيا فينبغى ان نأمرهم بقول لا اله الّا الله محمد رسول الله، فان ذالك افضل من تركه ولا ينبغى الفقيه ان ينكر ذالك الّا بنص او اجماع . الخ  

অর্থাৎ- আমার মাননীয় ওস্তাদ হযরত ‘আলী উল খাওয়াছ’ (رحمة الله) বলতেন- যখন একথা প্রতিভাত হয় যে, জানাজার সাথে যারা চলে, তারা যদি বাজে কথাবার্তা থেকে বিরত না থাকে, বরং পার্থিব আলাপ-আলোচনায় মগ্ন হতে থাকে, তখন তাদেরকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ পাঠ করতে নির্দেশ দেয়া আমাদের উচিত। কারণ এমতাবস্থায় তা বাদ দেয়া অপেক্ষা পাঠ করাই শ্রেয় হবে। এতে বাধা সৃষ্টি করা কোন ফকীহর জন্য মোটেই উচিৎ হবে না। হ্যাঁ যদি কোরআন-হাদীস বা ইজমা লব্ধ দলীল দ্বারা তা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়, তবে তা বারণীয়।

তাতে বাধা এ জন্যই দেয়া হবে না যে, কলেমা তৈয়্যবাহ পাঠ করা হুজুর (ﷺ) এর সাধারণভাবে অনুমতি রয়েছে; যখনই চায়, তা পাঠ করতে পারে। এখানে সে সব অন্তরান্ধ ব্যক্তিদের ব্যাপারে আশ্চার্যান্বিত হতে হয়; যারা তা অস্বীকার করে এবং তাতে বাধা প্রদান করতে অপচেষ্টা চালায়। (জাআল হক, ১ম খণ্ড, ৩৮৮পৃ.)

উচ্চরবে ‘যিকির’ করা প্রসঙ্গে মৌলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেবের ফত্ওয়া দেখুন।

হানাফী মাজহাব মতে উচ্চরবে যিকির জায়েজ

প্রশ্ন: হানাফী মাজহাব মতে উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ, না ‘না জায়েজ’? সপ্রমাণ জবাব দিন।

জবাব: উচ্চরবে যিকির প্রসঙ্গে হানাফী মজহাবের কিতাবসমূহে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। কারো মতে তা ‘মাকরূহ’; কারো মতে ‘জায়েজ’। তবে শেষোক্ত মতামতই গ্রহণযোগ্য। আর তার দলীল তলব করাও অনর্থক। কেননা, তা ইমামগণের (মোজতাহিদ) নিকট একটা বিতর্কিত মাছআলা। কাজেই কে তার ফয়সালা করতে পারবে? তবে জায়েজ হবার প্রমাণ হল আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেছেন-

اذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُوْنَ الْجَهْرِ . (سورة الاعراف ২০৫ )

অর্থাৎ- বিনয় সহকারে এবং নিম্নস্বরে; চিৎকার ব্যতিরেকে তুমি তোমার পরওয়ারদেগারকে স্মরণ কর।

এ আয়াতে وَدُوْنَ الْجَهْرِ (উচ্চরব ব্যতিরেকেই) শব্দদ্বয় নিম্ন পর্যায়ের কন্ঠ সহকারে যিকির করার অনুমতির প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।

হাদিস শরীফে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

قَالَ عَلَيْهِ السَّلَام ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ . (الحديث)

এটাও অন্যতম সরব যিকির। তবে চিৎকার নিষিদ্ধ। সাধারণত: কোরআন মজিদের আয়াত এবং যথেষ্ট সংখ্যক হাদিস তার বৈধতার প্রমাণবহ। (মৌলানা রশিদ আহমদ প্রণীত ফতওয়ায়ে রশিদিয়া-২১২পৃ.)

মৌলানা রশিদ আহমদ ছাহেব অন্যত্র উল্লেখ করেছেন-

প্রশ্ন: সরবে যিকির, দোয়া এবং দরূদে; তা নিম্নস্বরে হউক কিংবা উচ্চরবে হউক যেমন নামাজে। মুহাদ্দিসগণ এবং চার মজহাবের ইমামগণের মতে হুকুম কি; তা জায়েজ কিনা?

জবাব: ইমাম আবু হানিফার (رحمة الله) মতে যে সব স্থানে উচ্চরবে দরূদ পড়া কোরআন-সুন্নাহ সম্মত সে সব স্থান ছাড়া অন্যত্র যে কোন যিকির উচ্চরবে পাঠ করা মাকরূহ। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুপ ও ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله), অন্যান্য ফকীহগণ এবং মুহাদ্দেছিন কেরাম তা জাযেজ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। আমাদের ইমামগণের মতে শেষোক্ত মতামতই অধিকতর গ্রহণীয়। (ফত্ওয়ায়ে রশিদিয়া-২১৬ পৃষ্ঠা, ১২ই রবিউচ্ছানী)

উক্ত কিতাবের ২১৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়-

প্রশ্ন: উচ্চরবে যিকির করা উত্তম, না নীরবে? দলীল সহকারে জবাব দিন।

উত্তর: প্রত্যেক প্রকার যিকিরে ফজীলত রয়েছে। কখনো সরবে উত্তম; আবার কখনো নীরবে উত্তম। কোরআন মজিদে সাধারণভাবে যিকিরের নির্দেশ দেয়াই তার উজ্জ্বল প্রমাণ।

যেমন- আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন-   اذْكُرُوا اللهَ ذِكْرًا كَثِيرًا

অর্থাৎ- তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকির কর। আর সাধারণার্থক শব্দ দ্বারা যে কাজ বা বস্তুকে বুঝানো হয় তা পালনীয়। উল্লেখ্য যে, আনুসঙ্গিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার ‘ফজীলত’ বা মর্যাদা বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এতদ্ভিত্তিতে যিকিরের ছওয়াবও সময় এবং অবস্থা অনুসারেই পাওয়া যায়। (মৌলানা রশিদ আহমদ গঙ্গুহী)।

তিনি অন্যত্র উল্লেখ করেছেন- যিকির যে কোন অবস্থায়ই হউক না কেন জায়েজ। তিনি তার লিখিত ফতোয়ার ২১৫ পৃষ্ঠায় এক প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করেছেন- ফতোয়া দানকারীর জন্য তাঁর মতে সঠিক মছয়ালাই ব্যক্ত করা আমি ‘ফরজ’ মনে করি।

উপরোক্ত মৌলানা সাহেবের (গঙ্গুহী সাহেব) এসব বক্তব্যাদি দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তার মতেও সর্বাবস্থায় উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ; শুধু তাই নয়, সময় ও অবস্থার প্রেক্ষিত কখনো কখনো তা উত্তমও বটে। তাই তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ্ তায়ালা যিকিরের জন্য সাধারণভাবে নির্দেশ বা অনুমতি দিয়েছেন। কাজেই জানাজার সাথে পথচলার সময়টাও যে সে সাধারণ নির্দেশের আওতাভূক্ত তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই; যেহেতু এ সম্পর্কে শরীয়তে কোন নিষেধ নেই। সুতরাং উক্ত আলোচ্য সময়ে উচ্চরবে যিকির করা নিষিদ্ধ হবার কোন কারণ নেই; বরং তা উত্তমই।

উল্লেখ্য যে, জানাজার সাথে পথচলার সময় পদাতিকদের ‘যিকির’ সম্মিলিত কন্ঠেই হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে ছহীহ্ বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ ইত্যাদি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তায়ালার এরশাদ হল-

أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلَإٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلَإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ . (صحيح البخارى)

অর্থাৎ- “আমি আমার বান্দার সাথে তেমন আচরণ করি যেমনি বান্দা আমার প্রতি ধারণা পোষণ করে। যে আমাকে স্মরণ করে, আমি তার সাথেই থাকি। যদি সে আমাকে একাকী স্মরণ করে, আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। যদি সে সম্মিলিতভাবে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে তদাপেক্ষা অধিক উত্তম জমায়েতে অর্থাৎ নিষ্পাপ ফেরেশতাদের জমায়েতে স্মরণ করি।”

এ হাদিস দ্বারাও সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হল যে, উচ্চরবে ‘যিকির’ করা উত্তম ও মোস্তাহাব। আর আল্লাহ্ তায়ালা যিকিরকারীদের সাথেই আছেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদিসেও কোন স্থান বা সময়ের বিশেষত্ব বর্ণিত হয়নি; বরং সর্বাবস্থায়ই উচ্চরবে সম্মিলিতভাবে যিকির করার বৈধতা ও উপকারিতা প্রমাণিত হচ্ছে। সুতরাং, জানাজার সাথে সম্মিলিত ভাবে উচ্চরবে যিকির সহকারে পথ চলাই মোস্তাহাব।

ইমাম খাইরুদ্দীন রমলী (رحمة الله) তাঁর প্রণীত ফতোয়া খাইরিয়্যাহ ২য় খণ্ডের ১৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-

فاما الذكر والجهر به وانشاء القصائد فقد جاء فى الحديث ماقتضاء طلب الجهر نحو وان ذكرنى فى ملاء ذكرته فى ملاء خير منه رواه البخارى والمسلم والترميذى والنسائى وابن ماجة ورواه احمد بنحوه باسناد صحيح وزاد فى اخره قال قتادة والله- والذكر فى الملاء لا يكون الّا عن جهر . 

অর্থাৎ- উচ্চরবে ‘যিকির’ ও ‘কছিদা’ পাঠ হাদিস শরীফ দ্বারাই প্রমাণিত। যেমন- হাদিসে কুদছীতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন- যদি বান্দা আমাকে জমায়েতে স্মরণ করে তবে আমিও তাকে তদপেক্ষা অধিক উত্তম জমায়েতে (ফেরেশতাদের জমায়েতে) স্মরণ করি।’ এ পবিত্র হাদিসের উক্ত অংশেই উচ্চরবে ‘যিকির’ এর নির্দেশ বা অনুমতি পাওয়া যায়। ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী এবং ইমাম আহমদ (رحمة الله) বিশুদ্ধ সনদ দ্বারা উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। 

ইমাম কাতাদাহ (رحمة الله) একথাও উল্লেখ করেছেন- সম্মিলিত কন্ঠে যিকির উচ্চরব ব্যতিরেকে হয় না।

পক্ষান্তরে, কোন কোন হাদিসে নীরবে যিকির করাই উত্তম বলে ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন- خير الذكر الخفى অর্থাৎ- উত্তম যিকির হল নীরবে যিকির।

এখন পরস্পর বিরোধী দুই বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানকল্পে উল্লেখ করা হয়-

والجمع منهما بانّ ذالك يختلف باختلاف الاشخاص والاحوال كما جمع بين الاحاديث الطالبة للجهر بالقرأة والطالبة للامر اربها ولايعارض ذالك خير الذكر الخفى لانه حيث خيف الرياء او تأذى المصلين والنيام . 

অর্থাৎ- উভয় প্রকার পরস্পর বিপরীতমুখী দুই বর্ণনার মধ্যে এভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যায় যে, যিকির ব্যক্তি বিশেষ ও অবস্থার ভিন্নতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমনিভাবে উচ্চরবে ও নীরবে কোরআন পাঠ নির্দেশক পরস্পর বিপরীত হাদিস সমূহের মধ্যে সমন্বয় বিধান করা যায়। সুতরাং ‘নীরব যিকির’ নির্দেশক উক্ত হাদিস সরব নির্দেশক হাদিসের খন্ডনকারী হবে না। কারণ নীরব যিকির সেখানে উত্তম; যেখানে লোক দেখানোর মনোবৃত্তির সঞ্চার হওয়ার কিংবা পার্শ্ববর্তী মুসল্লী বা কোন নিদ্রারত ব্যক্তিকে যিকিরের শব্দ দ্বারা কষ্ট পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকে।

خير الذكر الخفى (সুতরাং অন্যান্য যিকিরের বেলায়ও অনুরূপভাবে যেখানে ঘুমন্ত ব্যক্তি বা মুসল্লীর ক্ষতি হবার কিংবা “লোক দেখানোর মনোবৃত্তি সঞ্চারের সম্ভাবনা না থাকে সেখানে উচ্চরবে যিকির করা এবং যেখানে এসব বাধা থাকে সেখানে নীরবে যিকির করাই উত্তম হবে।)

কাজেই যেহেতু জানাজার সাথে যিকিররত অবস্থায় পথ চললে উপরোক্ত কোন অসুবিধার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা নেই সেহেতু এ মুহূর্তে উচ্চরবে যিকির করাই শ্রেয় হবে। উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে “অবস্থা বিশেষে”- এ শব্দদ্বয় দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জানাজার সাথে পথ চলার সময় উচ্চরবে যিকির করা একটা যুগোপযোগী পদক্ষেপ বা আমল। কেননা, বর্তমান যুগের সাধারণ মুসলমানের অবস্থা অবর্ণনীয়ই বটে। কেননা, এমন মুহূর্তে পার্থিব কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা এমন কি অন্যের কুৎসা রটনা করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেই ইমাম শা’রানী (رحمة الله) বলেছেন-

فكيف بمنع منها وتأمل احوال غالب الخلق الان فى الجنازة تجدهم مشغولين بحكايات الدنيا لم يعتبروا بالميت وقلبهم غافل عن جميع ماوقع له بل رأيت منهم من يضحك واذا تعارض عندنا مثل ذالك وكون ذالك  لم يكن فى عهد رسول الله صلّى الله عليه وسلّم قدمنا ذكرالله عزوجل بل كل حديث لغو اولى من حديث انباء الدنيا فى الجنازة فلو صاح كل من الجنازة لا اله الّا الله محمد رسول الله . فلا اعتراض . 

অর্থাৎ- তাতে (উচ্চরবে যিকিরে) কিভাবে বাধা দেয়া যায়? বর্তমানকালীন জনসাধারণের অবস্থা তোমরা পর্যবেক্ষণ করা। তাদেরকে জানাজার সাথে পথচলার মুহূর্তেই অধিকন্তু দুনিয়াবী গল্প-গুজবে রত অবস্থায় দেখতে পাবে। মৃত ব্যক্তিকে দেখে তাদের অন্তরে কোন শিক্ষা স্থান পেয়েছে বলে মনে হয় না। প্রায়শঃ তাদেরকে অন্য মনষ্কই থাকতে দেখা যায়। এমন কি আমরা অনেককে হাসি-ঠাট্টা করতেও দেখেছি। এ যুগে সাধারণের এই অবস্থার প্রেক্ষিতেই পুরাকালে এ মুহূর্তে কলেমা সরবে পাঠ করার প্রচলন না থাকিলেও এখন তাতে বাধা দেয়া উচিত হবে না। বরং তা জায়েজ বলাই আবশ্যকীয়। কারণ দুনিয়াবী কথাবার্তা অপেক্ষা এ মুহূর্তে যিকির করা যে অধিকতর শ্রেয় হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অতএব, জানাজায় উপস্থিত সবাই সম্মিলিত কন্ঠে উচ্চরবে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করলে আপত্তি করার কোন কারণ নেই।

বিবেচ্য যে, আল্লামা শা’রানী (رحمة الله) এর যুগে যদি এ হুকুম হয়, তবে বহু পরিবর্তনোত্তর এ যুগে কি হুকুম হতে পারে? একটু ভেবে দেখুন।

যে সব ফকীহ ‘জানাজার সাথে পথ চলার সময়’ উচ্চরবে যিকির করা হারাম বা মাকরূহ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও রয়েছেন যাঁদের মতে উচ্চরবে যিকির করা সর্বাবস্থায়ই মাকরূহ বা হারাম। যেমন খানীয়াহ ও অনুরূপ অন্যান্য কিতাবাদিতেও এরূপ মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই তাঁদের মতানুযায়ী শুধু জানাজার সাথে পথচলার সময়কে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজনই বা কি? অথচ কোরআন মজিদের আয়াত এবং যথেষ্ট সংখ্যক হাদিসে সরব যিকিরের বৈধতা সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে; এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সুতরাং অন্যান্য ফকীহগণ বিশেষ করে পরবর্তীকালীন ওলামা কেরাম তা জায়েজ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন এবং যারা এ কাজটাকে হারামরূপে আখ্যায়িত করে তাতে বাধা প্রদান করেন তাদের যথাযথ জবাবও দিয়েছেন। এমনকি দেওবন্দী বিশেষ উল্লেখযোগ্য আলেমগণও এ কাজটির বৈধতা নিশ্চিতভাবে স্বীকার করেছেন। যেমন- বিশেষত, ফত্ওয়ায়ে রশিদিয়াই তার প্রমাণবহ।

আল্লাহর আজাব ও শাস্তি হতে যা সর্বাধিক মুক্তি দিতে পারে তা হল আল্লাহর যিকির

হাদিস শরীফে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُنَادِي مُنَادٍ يَوْمِ الْقِيَامَةِ اَين الو الالباب يُرِيدُ  قَالَ الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ . الخ

অর্থাৎ- কিয়ামত দিবসে একজন আহবানকারী ডেকে বলবে, কোথায় জ্ঞানী লোকেরা? জিজ্ঞাসা করা হবে আহুত জ্ঞানী কারা? উত্তর আসবে, “সে সব ব্যক্তি; যাঁরা আল্লাহর যিকির করতেন- দন্ডায়মান হয়ে, বসে এবং শয়নকালে অর্থাৎ সর্বদাই যাঁরা আল্লাহ্ এক স্মরণ করতেন। অতঃপর তাঁদেরকে বলা হবে, “তোমরা বেহেশতে প্রবেশ কর এবং স্থায়ীভাবে সেখানে অবস্থান কর।”

অন্য হাদিসে এরশাদ হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট তাঁর যিকিরই সর্বাপেক্ষা উত্তম। 

হযরত আবু মুছা আশআরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করেন আর যে ব্যক্তি তা থেকে বিরত থাকে, তাদের উভয়ের উদাহরণ জীবিত ও মৃত ব্যক্তিরই সাদৃশ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি যিকির করে সে জীবিত আর যে তা বর্জন করে সে মৃতের ন্যায়।

مَثَلُ الَّذِي يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِي لَا يَذْكُرُ رَبَّهُ مَثَلُ الْحَيِّ وَالْمَيِّتِ . (صحيح البخارى)

অর্থাৎ- যে স্বীয় প্রভুকে স্মরণ করে আর যে তা থেকে বিরত থাকে তারা যথাক্রমে জীবিত ও মৃতের ন্যায়।

তাই হাদিস বেত্তাদের (মুহাদ্দেছীন) কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহর যিকির কারীদের কারো উপর অত্যাচার করা, এক জীবিত ব্যক্তির উপর অত্যাচার করারই নামান্তর মাত্র। সুতরাং তার প্রতিশোধ নেয়া যুক্তযুক্ত হবে।

ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন- আল্লাহকে স্মরণ (যিকির) করলে অন্তর সজীব হয় এবং তাতে অন্তরে বিনয়ের সঞ্চার হয়।

আ’লা হযরত মৌলানা শাহ আহমদ রেজা খাঁন (رحمة الله) ফত্ওয়া আফ্রিকায় উল্লেখ করেছেন- জানাজার সাথে চলার পথে কলেমা ও দরূদ শরীফ অথবা না’তে রসূল পাঠ করায় কোন ক্ষতি নাই। কারণ এসব তো আল্লাহর যিকিরেরই নামান্তর মাত্র। 

এক হাদীসে বর্ণিত-

مَامنْ شَيْءٌ أَنْجَى مِنْ عَذَابِ اللهِ مِنْ ذِكْرِ اللهِ .

অর্থাৎ- নিশ্চয়ই, আল্লাহর আজাব বা শাস্তি থেকে যা সর্বাধিক মুক্তি দিতে পারে, তা হল, আল্লাহর যিকির বা তাঁরই স্মরণ।

তাছাড়া আল্লাহ্ তায়ালার যিকিরের ফলে তাঁর রহমতও বর্ষিত হয়।

উপরোলে­খিত হাদিস ও উদ্ধৃতিসমূহ দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, যিকির সর্বদাই রহমত বর্ষণে সহায়ক। তদুপরি তাতে বরকত নাজিল হয়; আজাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তা সরবে হউক আর নীরবেই হউক। তাছাড়া, স্থান এবং সময়েরও কোন শর্ত তাতে নেই।

উপরন্তু, হাদিস শরীফে সাধারণভাবে যিকিরের নির্দেশ বা অনুমতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ হউক কিংবা আল্লাহু রাব্বী, মুহাম্মদ নবী (ﷺ) হউক- যেকোন যিকির উচ্চরবে পাঠরত অবস্থায় জানাজার সাথে পথ চলার প্রচলন নবী করীম (ﷺ) এর জমানায় যদিও ছিল না, পরবর্তী যুগে এ মুহূর্তে এ ধরণের যিকির অবৈধ হবার পক্ষে কোরআন মজিদে এবং হাদিস শরীফে কোন নিষেধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় না। বরং হুজুর (ﷺ) এ ধরনের নব প্রচলিত কার্যাদির ক্ষেত্রে একটা সাধারণ নিয়ম এরশাদ করেছেন- من سن سنة حسنة الخ অর্থাৎ- যে ব্যক্তি ইসলামে একটা ভাল কর্মপন্থার প্রচলন করবে… (আল-হাদিস)।

যাতে পরবর্তী যুগের আলেম (ফকীহ)গণ জনসাধারণের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভাল কাজের হুকুম দিতে পারেন।

জানাজায় যিকির করা বিদয়াত কিংবা সুন্নাহর পরিপন্থী ও ধর্মে তেলেসমাতি নয়

‘ফত্ওয়া আফ্রিকাতে’ আ’লা হযরত মুজাদ্দিদে মিল্লাত (رحمة الله) ইমাম আবদুল ওহাব শা’রানী প্রণীত ‘‘আল বাহরুল মওরূদ ফিল্ মাওয়াছীক্বে ওয়াল য়ূহুদ” থেকে উদ্ধৃত করেছেন-

اخذ علينا العهود ان لانمكن احدا من الاخوان ينكر شيئًا بما ابتدعه المسلمون علٰى وجه القربة الى الله تعالٰى وراوه حسنا فانّ كل ما ابتدع على هذا الوجه من توابع الشريعة وليس فهو من قسم البدعة المذمومة فى الشرع . 

অর্থাৎ- আমাদের প্রতিশ্র“তি নেয়া হয়েছে এ মর্মে যে, যেন আমরা কোন ধর্মীয় ভাইকে এমন কোন কাজকে মন্দ বলার সুযোগ না দিই; যে কাজ মুসলমানেরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নব প্রচলিত করেছেন; অথচ তাঁরা সে কাজকে ভাল বলে মনে করে। কারণ যা কিছু এভাবেই নবপ্রচলিত হয় সে সবই হুজুর (ﷺ) এর শরীয়ত থেকেই গৃহীত এবং তা ‘সে সব বিদয়াত’ কার্যাদির শামিল নয় যে সব বিদয়াত মন্দ ও বর্জনীয় বলে শরীয়ত বর্ণনা করেছে।

উপরোক্ত বর্ণনা থেকেও বুঝা যাচ্ছে যে, যুগ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ এবং মোস্তাহাব। কারণ এটা একটা দলীল সংক্রান্ত (فرعى) মাছয়ালা; ‘বুনিয়াদী’ নয়।

এখন যদি বলা হয় যে, ‘এ কাজটি’ সুন্নাহ’র পরিপন্থী; কিংবা ছলফে ছালেহীন এর আমলও নয়। তবে তার উত্তরে এ প্রসঙ্গে পূর্বোলে­খিত জবাবই প্রযোজ্য ও যথার্থ হবে। তবুও এখানে সংক্ষিপ্ত ভাষায় এটাই বলা যাবে যে, এমন অনেক কাজ রয়েছে, যা ছল্ফে ছালেহীন এর আমল না হওয়া সত্ত্বেও তা মোস্তাহাব।

যেমন- ফত্ওয়া আজিজিতে উল্লেখ করা হয়- বিবাহ দিবসে কলেমা তৈয়্যবাহ, ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মোফাচ্ছাল এ বর্ণিত বিষয়াদি সম্পর্কে নবদম্পতিকে পুণঃ অবগত করানো মোস্তাহাব। অথচ তা ছলফে ছালেহীনের অনুকরণে নিশ্চয়ই নয়। তাছাড়া প্রচলিত তছবীহ পাঠ পূর্ববর্তী আলেমদের মতে বিদয়াত। কিন্তু পরবর্তী আলেমগণ, যেমন মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এবং অন্যান্য ফকীহ ও সুফীগণ, যেমন- হযরত জুনাইদ বাগদাদী (رحمة الله) প্রমূখের মতে তা মোস্তাহাব বলে প্রমাণিত। কেননা,  মোস্তাহাব বা মোস্তাহাছান প্রমাণের জন্য বিশেষ দলীল এর প্রয়োজন হয় না; বরং যদি কোন কাজকে মুসলমানগণ ভাল মনে করে এবং তদানুযায়ী আমল করে তবে তা মোস্তাহাব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু মকরূহ বা হারাম প্রমাণের জন্য নিষেধ সম্বলিত বিশেষ দলীল থাকা প্রয়োজন। মৌলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী ছাহেবও তাঁর লিখিত ফত্ওয়ায়ে রশিদিয়া’য় উল্লেখ করেছেন- এমন কি মাকরূহ তানজিহী প্রমাণের জন্যও নিষেধসূচক বিশেষ দলীল আবশ্যকীয়।

দ্বিতীয়তঃ যদি এ কাজটা সুন্নাহ পরিপন্থী হয়, তবে বলুন জানাজার সাথে পথচলার সময় কোন্ আমলটাই সুন্নাত? যদি বলা হয়- চুপ থাকা, তবে প্রশ্ন জাগে যে, চুপ থাকা যদি সুন্নত আর যিকির করা বিদয়াতই হয়, তবে ফকীহগণ আলোচ্য মুহূর্তে কোন মত পার্থক্য ব্যতিরেকেই মৌলিক যিকিরের অনুমতি কেন দিয়েছেন? তাতে কি সুন্নাত পরিপন্থী কাজ সম্পন্ন হবে না? ফকীহগণ কি একটা বিদয়াত কর্ম সম্পন্ন করার নির্দেশ দিলেন? মোটেই নয়।

এখন লক্ষ্য করুন! উচ্চরবে দোয়া করা বিদয়াত। যেমন: ফতোয়া বারহানার ৩২১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়- وجهر بدعا بدعت ست (দোয়া উচ্চঃস্বরে করা বিদয়াত)। অথচ মৌং রশিদ আহমদ সাহেব ‘ফত্ওয়ায়ে রশিদিয়া’র ২১৮ পৃষ্ঠায় এক প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করেছেন যে, ফরজ নামাজের পর উচ্চরবে দোয়া করা জায়েজ; যদি শরীয়তসম্মত কোন কারণ প্রতিবন্ধক না হয়। এখন বলুন! উক্ত মৌলানা সাহেব কেন একটা অবৈধ কাজ সম্পাদনের নির্দেশ দিলেন? এতে কি তিনি বেদ্য়াতী হন নি?

আমাদের এখানকার আলেম নামের দাবীদার জনৈক ব্যক্তি তার লিখিত এক পুস্তিকায় লিখেছেন-

অর্থাৎ- উচ্চরবে যিকির করা মাকরূহ তাহরীমী এবং বর্জনীয় বিদ্য়াত। নিশ্চয়ই প্রশ্নে উল্লেখিত আলোচ্য কাজটি সুন্নাত পরিপন্থী মাকরূহ এবং বিদয়াতেই রূপান্তরিত। তা বর্জন করা ওয়াজিব, তাতে বাধা প্রদানের স্থলে নীরব ভূমিকা পালন করা ধর্মে তেলেসমাতি ও গড়িমশিরই নামান্তর মাত্র।

উক্ত উদ্ধৃতিতে সরবে যিকির করা মাকরূহ বা বিদয়াত বলে যে মন্তব্য করা হয় তার পাল্টা জবাব তো পূর্বে দেয়া হয়েছে; যা উক্ত মন্তব্যের ভ্রান্তি অনুধাবনের যথেষ্ট সহায়ক। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- উপরোক্ত দয়ালু মুফতী সাহেব তাঁর মন্তব্যের স্বপক্ষে ‘কিতাবুল ইয়তেছাম’ থেকে উদ্ধৃত করে প্রমাণস্বরূপ পেশ করেছেন-   بان السنة فى اتباع الجنازة الصمت .

অর্থাৎ- জানাজার সাথে পথ চলার সময় নীরব থাকাই সুন্নাত।

কিন্তু পক্ষান্তরে ফকীহগণ এ মুহূর্তে মৌলিক যিকিরের যে অনুমতি দিয়েছেন, তাতে তাঁর এ মন্তব্য ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়।

তাছাড়া মজার ব্যাপার হল- স্থানীয় এ মুফতী সাহেবের ফতোয়া থেকে এটাও প্রতিভাত হয় যে জানাজার সাথে পথ চলার সময় তাঁর মৃত্যু উপস্থিত হলেও তাঁকে হয়ত কলেমা (যিকির) পাঠ করা ব্যতীতই নীরবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কারণ, তাঁর ফতোয়া অনুযায়ী উক্ত সময়ে যিকির উচ্চারণ করা সুন্নত পরিপন্থী কাজ হবে। মৃত্যুকালে এমন এক বিদয়াত বা সুন্নত পরিপন্থী কাজ মুফতি ছাহেব দ্বারা কিভাবে সম্পন্ন হতে পারে?

তৃতীয় কথা হল- আল্লাহর যিকিরের নির্দেশ বা অনুমতি সব সময়ের জন্যই। কাজেই তাতে বাধা দেয়া কিংবা তা খারাপ বা বর্জনীয় বলে মন্তব্য করা মূর্খতা ছাড়া আর কি হতে পারে।

মুসলমানদের উচিৎ, একটা নিঃশ্বাস বা মুহূর্তও যেন স্বীয় মাবুদ (আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন) এর যিকির বা স্মরণ থেকে বাদ না পড়ে; বরং তাঁরই স্মরণকে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে বরণ করা উচিৎ। যেমনিভাবে হুজুর (ﷺ) আল্লাহ তায়ালার স্মরণেই প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করতেন। 

তিরমিযী শরীফে হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত-

قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَذْكُرُ اللهَ عَلَى كُلِّ أَحْيَانِهِ .

অর্থাৎ- তিনি বর্ণনা করেছেন- আল্লাহর প্রিয় রসূল (ﷺ) প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ করতেন।

বাকী রইল উচ্চরবে যিকির করার প্রসঙ্গ-উচ্চরবে যিকির করা তখনই উত্তম, যখন তা শরীয়ত মতে নিষিদ্ধ নয়। যেমন- পার্শ্ববর্তী মুসল্লীর অসুবিধা ও লোক দেখানোর মনোবৃত্তি সঞ্চার হবার সম্ভাবনা ইত্যাদি কারণের অবস্থিতির মুহূর্তে। কেননা, তখন নীরব যিকিরই উত্তম।

চতুর্থতঃ প্রশ্ন জাগে, জানাজার সাথে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করা হারাম বা মাকরূহ তাহরিমী হবার কারণ কি? কোরআন মজিদের আয়াত কিংবা ছহীহ হাদিস দ্বারা কি তা নিষিদ্ধ বলে প্রমাণিত? যার ফলে তা পালনে ধর্মীয় বিষয়ে তেলেসমাতি বা গড়িমসির মত অবাঞ্চিত কর্মে লিপ্ত না হয়ে গত্যন্তর থাকে না? অথচ যারা জানাজা গর-জানাজা নির্বিশেষে সাধারণভাবেই সরব যিকিরকে হারাম বা মাকরূহ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন অন্যান্য ফকীহগণ সাথে সাথে তাঁদের পাল্টা জবাব দিয়েছেন এবং উচ্চরবে যিকির করার বৈধতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত করেছেন। যেহেতু হাদিস শরীফে বর্ণিত-

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ (رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا) أَخْبَرَهُ أَنَّ رَفْعَ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ حِينَ يَنْصَرِفُ النَّاسُ مِنْ الْمَكْتُوبَةِ كَانَ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ . (مسند أحمد)

অর্থাৎ- হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- ফরজ নামাজ সমাপন করে ফেরার সময় উচ্চরবে যিকির করার প্রচলন নবী করীম (ﷺ) এর যুগেই ছিল।

অতএব, বুঝা যাচ্ছে যে, উচ্চরবে যিকির করা নবী করিম (ﷺ) এর যুগেও প্রচলিত ছিল। উল্লেখ্য যে, জানাজার সাথে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করা কোন কোন ফকীহ্র মতে মাকরূহ তানজিহী বা অধিকতর উত্তম বর্জিত হলেও আসলে তা ধর্মীয় কাজে তেলেসমাতি বা গড়িমসি মোটেই নয়।

হ্যাঁ, যদি কোন আয়াত বা ছহীহ হাদিস দ্বারা উচ্চরবে যিকির সহকারে জানাজার সাথে পথচলা হারাম বা মাকরূহ বলে প্রমাণিত হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে ধর্মে তেলেসমাতি বা গড়িমসি হবে। নতুবা উচ্চরবে যিকিরকারীদের প্রতি ধর্মে তেলেসমাতি বা গড়িমসির অপবাদ সরাসরি হুজুর (ﷺ) ও ছাহাবা কেরামের প্রতিই নিক্ষিপ্ত হবে (নাউযুবিল্লাহ)।

পঞ্চমতঃ ভাল ও পূণ্যময় কাজকে বিদয়াত বা শিরক বলাই প্রকৃতপক্ষে ধর্মে গড়িমসি ও তেলেসমাতি; যে কাজ কোরআন মজিদের আয়াত, ছহীহ হাদিস কিংবা এজমা ই-উম্মত এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী তা স্বীয় কৃতকর্মের অন্তর্ভূক্ত করাই হল ধর্মে গড়িমসি বা তেলেসমাতির শামিল।

যেমন-কাফির ও মুশরিকগণ সম্পর্কে যে সব আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে; তাদের মূর্তিপূজা র্শিক। তাদের নিজ হাতে গড়া মূর্তি লাত, ওজ্জা প্রভৃতির নামে জন্তু বলি দেয়া, মানত করা ইত্যাদি সম্পর্কে যে সব আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, সে সব আয়াতসমূহ মুসলমানদের বেলায় প্রযোজ্য বলে মন্তব্য করে মুসলমানদের প্রচলিত কোন কোন ভাল কাজের জন্য তাঁদের প্রতি নানা অপবাদ নিক্ষেপ করা এবং তাদের সম্পর্কে ফতোয়াবাজী করা। যেমন- ওলীর মাজারে গিয়ে তাদের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা, তথায় হাদিয়া, তোহফা ও নজর-নিয়াজ উপস্থাপন করা ইত্যাদি শরীয়তসম্মত কার্যাদির সাথে কাফির ও মুশরিকদের মূর্তিপূজা ও মূর্তির নিকট জন্তু বলি দেয়া ইত্যাদির মধ্যে সাদৃশ্য প্রমাণের অপচেষ্টা চালানো; এবং কোরআন-হাদিসের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়াই হল প্রকৃতপক্ষে ধর্মে গড়িমসি ও তেলেসমাতি।

মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত পূণ্যময় কার্যাদিকে কাফির মুশরিকদের মূর্তিপূজা ও র্শিক কার্যাদির নামান্তর বলে ফতওয়া দিয়ে তাদেরকে অযথা বিদ্য়াতী বা মুশরিক বলাই যে প্রকৃতপক্ষে দ্বীনে তেলেসমাতি ও গড়িমসি।

হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন-

قَالَ إِنَّهُمْ انْطَلَقُوا إِلَى آيَاتٍ نَزَلَتْ فِي الْكُفَّارِ فَجَعَلُوهَا عَلَى الْمُؤْمِنِينَ . (صحيح البخارى)

অর্থাৎ-সে সব খারেজীরাই (খারেজী মতবাদ পুষ্ট আলেমগণ) এমন আয়াতসমূহ মুসলমানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে ফতোয়া দেয় যে সব আয়াত আসলে কাফিরদের সম্পর্কেই নাজিল হয়েছে।

হ্যাঁ, তাদের মতানুযায়ী মাদ্রাসা বা অন্যত্র দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে বেতন গ্রহণ করা ধর্মীয় কাজে গড়িমসি বা তেলেসমাতি হতে পারে। কেননা পূর্ববর্তী ফকীহগণ তা হারাম বলে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, আমাদের দেশীয় উপরোক্ত মুফতি ও আলেম নামধারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হতে পারে।

ষষ্ঠতঃ প্রত্যেক পূণ্যময় কাজের ক্ষেত্রে كل بدعة ضلالة (প্রত্যেক বিদয়াতই পথভ্রষ্টতা) من احدث فى امرنا (যে ব্যক্তি আমাদের ধর্মীয় বিষয়ে নূতন কিছু আবিষ্কার করে…) এ হাদিসদ্বয় দ্বারা মনগড়া ফত্ওয়াবাজি করা, পক্ষান্তরে-     من سن فى الاسلام سنـة . الخ 

(অর্থাৎ- যে ব্যক্তি ইসলামে কোন পূণ্যময় নূতন কাজের প্রচলন করে…) ও

ما رأه المسلمون حسنا فهو عند الله حسن .

(অর্থাৎ- মুসলমানগণ যা ভাল বা পূণ্যময় মনে করে তা আল্লাহর নিকট ভাল বা পূণ্যময়)- এ হাদিসদ্বয়ের প্রতি অবজ্ঞা করা এবং এগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত না করাই প্রকৃতপক্ষে ধর্মে গড়িমসি বা তেলেসমাতি। আসলে এসব পূণ্যময় কার্যাদি সমর্থন করা ধর্মের প্রতি অবহেলা বা গড়িমসি নয় বরং ধর্মীয় বিধানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা। দেখুন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিবসদ্বয়ে ঈদের নামাজ সমাপনের পূর্বে নফল নামাজ পড়া মাকরূহ হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী ফকীহগণ সাধারণ মুসলমানদেরকে এ কাজে বাধা না দেয়াই উত্তম বলে মত প্রকাশ করেছেন।

দূররুল মোখতার-এ উল্লেখ করা হয়-

انما العوام فلا يمنعون من تكبير ولا تنفل اصلا لقلّة رغبتهم فى الخيرات كذافى البحر . 

অর্থাৎ- সাধারণ মুসলমানদের তক্বীর বলা ও নফল নামাজে বাধা দেয়া মোটেই উচিত হবে না কেননা ভাল কাজে তাদের আগ্রহ নিতান্তই কম। বাহরুর রায়েকেও অনুরূপ উল্লেখ করা হয়।

অর্থাৎ- তকবীর নিম্নস্বরে বলুক কিংবা উচ্চস্বরে বলুক; অনুরূপ, নফল নামাজ ঈদগাহে পড়ুক বা অন্যত্র পড়ুক; ঈদের নামাজের পূর্বে পড়ুক বা পরে পড়ুক; কোন অবস্থাতেই তাদের বাধা প্রদান করা মোটেই উচিত হবে না (তাহতাবী)। বাহ্রুর রায়েক প্রণেতা এতে বাধা দানের পক্ষে যে মন্তব্য করেছেন তা তাঁর নিজস্ব মন্তব্য ‘মাজহাবের’ নয়। তাছাড়া জনসাধারণকে এতে বাধা প্রদান করলে এ ধরণের পূণ্য কর্ম থেকে তারা ক্রমে দূরে সরে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে বেশী; বিশেষতঃ আলোচ্য সময়ে (জানাজার সময়)। (ফত্ওয়ায়ে শামী, গায়াতুল আওতর ১ম খণ্ড ৩৮৬ পৃ.)

দুর্রুল মোখতার-এ উল্লেখ করা হয়-

العوام فلا يمنعون من فعلها لانهم يتركونها والاداء الجائز عند البعض اولى من الترك اصلا، كما فى القنية وغيرها . 

অর্থাৎ- সাধারণকে এমতাবস্থায় (ঈদে) নফল নামাজ থেকে বাধা দেয়া যাবে না, এ জন্যেই যে, তারা নামাজ ছেড়ে দেবে। আর যা পালন করা কোন কোন ইমামের মতে জায়েজ তা একেবারে ছেড়ে দেয়া অপেক্ষা উত্তম। কেনিয়া ও অন্যান্য কিতাবাদিতে অনুরূপ অভিমত রয়েছে। 

উদাহরণস্বরূপ, সূর্যোদয়ের সময় নামাজ পড়া মাকরূহ হওয়া সত্ত্বেও ফকীহগণ সাধারণ লোকের জন্য তার অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং পাঠকবৃন্দ! এসব বিষয়ে সুক্ষ্ম নজর দিন।

আলহামদু লিল্লাহ্! উপরোক্ত বর্ণনা ও উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জানাজা নিয়ে পথচলার সময় উচ্চরবে যিকির করা জায়েজ ও     মোস্তাহাব। এ পূণ্যময় কার্য থেকে বাধা দেয়া মোটেই উচিত হবে না। সুতরাং খালেদ নামক (শেষোক্ত) ব্যক্তিই সঠিক পথ ও মতের উপর প্রতিষ্ঠিত; ছওয়াব ও শুভ পরিণতির উপযোগী।

هذا عندنا والله تعالى ورسوله اعلم بحقيقة الحال وصدق المقال واليه المرجع والمال من شك فيه فهو للحق عنيد وعن الصراط المستقيم بعيد . 

অর্থাৎ- আমি এখানেই আমার বক্তব্য সমাপ্ত করলাম। আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (ﷺ)ই এ বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞাত। আল্লাহরই প্রতি সবাইকে ফিরতে হবে। যে ব্যক্তি এতে সন্দিহান হবে সে অবশ্য সত্য প্রত্যাখ্যানকারী এবং সে-ই সরল সঠিক পথ থেকে দূরে অপসারিত।

وصلى الله تعالى على سيدنا وشفيعنا ومولنا وغياثنا ومغيثنا ورؤفنا ورحيمنا وحبيبنا محمد صلّى الله عليه وسلّم وعلى اله واصحابه وازواجه وانصاره وعلماء ملته واولياء واتباع امته أجمعين برحمتك يا ارحم الرحمين . 

সমাপ্ত

পোষ্টটি ভালো লেগে থাকলে আপনার মূল্যবান মতামত জানান প্লিজ!

Leave a Comment